আমরা এর আগে ঊনবিংশ শতাব্দীর অন্যান্য মানুষের সঙ্গে উৎসের দিক থেকে বিদ্যাসাগরের তুলনা করে দেখিয়েছি যে, অত্যন্ত গ্রামীণ, দরিদ্র, ঐতিহ্যভিত্তিক ও ‘অনাধুনিক’ শিক্ষায় শিক্ষিত পরিবার থেকে বিদ্যাসাগর উঠে এসেছিলেন বলে তাঁর উত্থান এবং পথ-পরিক্রমা ছিল অনেকের চেয়ে অনেক কঠিন। এবারে আমরা লক্ষ করব যে, হয়তো সেই কারণেই বিদ্যাসাগরকে ছুঁতে বা তাঁর কাছে পৌঁছোতে পারতেন একেবারে নিঃস্বতম থেকে শুরু করে সমাজের সব স্তরের, সব সম্প্রদায়ের মানুষ, ভিক্ষুক থেকে অস্পৃশ্য, ভদ্রলোক থেকে গ্রামীণ অভাবগ্রস্ত নারী-পুরুষ। তাঁর কাছে ধর্ম, সম্প্রদায়, হিন্দু-সমাজের জাতিগোত্র, শিক্ষা, বিত্ত —কিছুই কোনো বাধা ছিল না। ঊনবিংশ শতাব্দীতে আর কোনো অগ্রনেতা সম্বন্ধে এমন কথা বলা যায় কি না সন্দেহ। এ-বিষয়ে অজস্র গল্প পাঠকদের জানা আছে, তার উদ্ধার প্রবন্ধের আয়তন বৃদ্ধি করবে মাত্র।
—পবিত্র সরকার
১. কী বাকি থাকে আমাদের জন্য?
যাঁরা ইতিহাস নির্মাণ করেন এবং এক সময় ইতিহাস হয়ে আমাদের থেকে দূরত্বে চলে যান, তাঁদের মধ্যে প্রধানত দু-ধরনের লোক থাকেন। এক, যাঁদের কথা আমরা ইতিহাস বইয়ে পড়ি, কিন্তু যাঁরা ওই বইয়ের পাতাতেই সমাধিস্থ থাকেন। তাঁদের অনেকের নাম ও বিবরণ আমাদের পাঠ্য মাত্র, মুখস্থ করার এবং (পরীক্ষার পরে, বহুলাংশে) ভুলে যাওয়ার বিষয়। এরকম হাজারো নামে ইতিহাস এবং অন্যান্য আখ্যান ছেয়ে আছে।
আবার কিছু নাম নাছোড়বান্দার মতো আমাদের সঙ্গ ছাড়ে না। মানুষের শিশুর জীবন, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের মধ্যবিত্ত মানুষের জীবন যেহেতু একটা ‘হয়ে-ওঠা’র সরণিতে ফেলে দেওয়া হয়, এবং সবাইকে একটা শিক্ষাগত, আর্থনীতিক এবং সামাজিক সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয়, সেহেতু সেই সিঁড়ির শেষে অনেকগুলি প্রতিকৃতি ঝোলানো থাকে মানবশিশুর দেখার জন্য। ইংরেজি ভাষায় আজকাল যাকে ‘রোল মডেল’ বলা হয় তাঁদের প্রতিকৃতি। বাঙালি শিশুর জন্য বিদ্যাসাগরের প্রতিকৃতি তার একেবারে কেন্দ্রে থাকে।