ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

মাইকেল মধুসূদন দত্ত

বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে।
করুণার সিন্ধু তুমি, সেই জানে মনে,
দীন যে, দীনের বন্ধু!—উজ্জ্বল জগতে
হেমাদ্রির হেমকান্তি অম্লান কিরণে।
কিন্তু ভাগ্যবলে পেয়ে সে মহা পর্বতে,
যে জন আশ্রয় লয় সুবর্ণ চরণে,
সেই জানে কত গুণ ধরে কত মতে
গিরীশ। কি সেবা তার সে মুখ সদনে।—
দানে বারি নদীরূপ বিমলা কিঙ্করী;
যোগায় অমৃত ফল পরম আদরে
দীর্ঘশিরঃ তরুদল, দাসরূপ ধরি;
পরিমলে ফুলকুল দশ দিশ ভরে;
দিবসে শীতল শ্বাসী ছায়া, বনেশ্বরী,
নিশার সুশান্ত নিদ্রা, ক্লান্তি দূর করে!
পবিত্র সরকার

১. কী বাকি থাকে আমাদের জন্য?


যাঁরা ইতিহাস নির্মাণ করেন এবং এক সময় ইতিহাস হয়ে আমাদের থেকে দূরত্বে চলে যান, তাঁদের মধ্যে প্রধানত দু-ধরনের লোক থাকেন। এক, যাঁদের কথা আমরা ইতিহাস বইয়ে পড়ি, কিন্তু যাঁরা ওই বইয়ের পাতাতেই সমাধিস্থ থাকেন। তাঁদের অনেকের নাম ও বিবরণ আমাদের পাঠ্য মাত্র, মুখস্থ করার এবং (পরীক্ষার পরে, বহুলাংশে) ভুলে যাওয়ার বিষয়। এরকম হাজারো নামে ইতিহাস এবং অন্যান্য আখ্যান ছেয়ে আছে।

আবার কিছু নাম নাছোড়বান্দার মতো আমাদের সঙ্গ ছাড়ে না। মানুষের শিশুর জীবন, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের মধ্যবিত্ত মানুষের জীবন যেহেতু একটা ‘হয়ে-ওঠা’র সরণিতে ফেলে দেওয়া হয়, এবং সবাইকে একটা শিক্ষাগত, আর্থনীতিক এবং সামাজিক সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয়, সেহেতু সেই সিঁড়ির শেষে অনেকগুলি প্রতিকৃতি ঝোলানো থাকে মানবশিশুর দেখার জন্য। ইংরেজি ভাষায় আজকাল যাকে ‘রোল মডেল’ বলা হয় তাঁদের প্রতিকৃতি। বাঙালি শিশুর জন্য বিদ্যাসাগরের প্রতিকৃতি তার একেবারে কেন্দ্রে থাকে।
শহীদ ইকবাল

তখন আর এখনকার কাল এক নয়। দুশো বছর পেরুল। বিদ্যাসাগরের দ্বিশতজন্মবর্ষ, কাল গুনলে দিবস-রজনীর মাপে খুব বেশি সময় নয় হয়তো। কিন্তু মানবজীবনের হিসাবে তা নেহায়েত কম বলি কী করে! তবে প্রশ্ন, এতদিন পর কেন বিদ্যাসাগর? তাঁকে কী শ্রেষ্ঠ মানুষ ভেবে, একপ্রকার বিশাল দেবমূর্তি বানিয়ে, ভক্তির ভাবে প্রতিষ্ঠার জন্য— নাকি তাঁর কর্মপরিধি, কর্মের ও পাণ্ডিত্যের মেলবন্ধন যাচাইপূর্বক, আধুনিক শিক্ষার দ্বীপ জ্বেলে তিনি যে অন্ধকার দূরীভূতকরণের দায়ে, সত্য-মিথ্যা, সংস্কার-কুসংস্কারের সীমানা অতিক্রম করে মানবজাতির জন্য এক বিক্ষত প্রতিজ্ঞার ভার কাঁধে নিয়েছিলেন —নিরন্তর তীব্র হয়ে উঠেছিলেন —সে-কারণে! তিনি তো এখনো আছেন প্রজন্মান্তরে, চলমান, কে না জানে বিদ্যাসাগর কে ছিলেন? স্কুল-পাঠ্যবইয়ে, উচ্চশিক্ষায় বিদ্যাসাগরের পঠন-পাঠন তো এখনো উবে যায়নি। তবে বরঞ্চ প্রশ্নের চেয়ে জিজ্ঞাসাটা এখন শক্তিশালী হতে পারে— তাঁর মতো চিন্তার দার্ঢ্য-দৃঢ়তা কিংবা কথা ও কাজের মিল— আর সেটি প্রতিষ্ঠা করার জন্য তিনি যে বরাবর দুর্মর সাহস দেখিয়েছেন —সেটা কতটা সম্ভব, অন্তত একালে বা তা কজনের রয়েছে! আমরা কতটা তার চর্চা করতে পারছি? এমন সহজলভ্য সমাজে বিদ্যাসাগরের কাজ বা দৃষ্টি তো পরিপ্রেক্ষিত পাওয়ারই কথা। সেটা কতটা পাচ্ছে! বস্তুত, তিনি যে-সমাজে বেড়ে উঠেছিলেন, সেটা প্রচণ্ড স্ববিরোধী ও সদ্য বিকাশমান পুঁজির দাপটময় চঞ্চল সমাজ। মধ্যবিত্তের তখন গজাচ্ছিল ‘দাড়িগোঁফ’। তারা প্রায়শ তেতে উঠছিল, পরিবর্তনের তাড়নায়। আবার যখন দেখা যাচ্ছিল পরিবর্তনের ওপারে নিজের পরিবর্তন দরকার তখন সুযোগ বুঝে লেজ গুটিয়ে পালিয়েও যাচ্ছিল। বিদ্যাসাগরের জীবনাচরণের ভেতর দিয়ে এসব উঁকিঝুঁকি আমাদের চোখে পড়ে। আস্তিক-নাস্তিক, ঈশ্বরবাদী-নিরীশ্বর, ডিরোজিওপন্থা বা নিছক বস্তুবাদী, ভাববাদী, ধর্মরক্ষা, সমাজরক্ষা —এমন নামে-বেনামে অনেক প্রবণতা ওই সমাজে বিছানো ছিল। বিদ্যাসাগর ঘরে-বাইরে দেখছিলেন সব। কী করবেন তিনি? কী চান তিনি! এসবের মাঝে নিজেকে ঠিক কোন পরিমার্জনা দেবেন বুঝে ওঠা কঠিন ছিল। তিনিও যাদের ওপর ভরসা করেন, পান না তাদের সময়মতো, পেলেও পিছিয়ে যান, এগিয়ে চলেন, পিচ্ছিলতায় গড়ানো জীবন। বস্তুত, তিনি চলতি সমাজে দূরে বা কাছে কারোরই ভালো হতে পারেননি, আস্থাভাজনও হননি। দৈনন্দিন চলতি সমাজব্যবস্থার ভেতরে তিনি ছিলেন ‘জঞ্জাল’ —একক, আলাদা। ব্রিটিশ-শাসক বা এদেশের পণ্ডিতপ্রবর মহল তাঁকে কিছুতেই গ্রহণ করতে চায়নি। সেটি চাওয়ার কথাও নয়। কাজেই, লড়তে হয়েছে —এক অর্থে —একাই, এক হাতে, মুখোমুখি হতে হয়েছে সর্বপ্রকার শক্তির বিরুদ্ধে; সে-কারণে বিশ্বাস ও আস্থায় তাঁকে পরিষ্কার ও দৃঢ় হতে হয়েছে, কেউ যেন অযথা ভুল ধরতে না পারে, আর ভুল ধরলেও তা যুক্তিতে যেন ধরাশায়ী হয়। ফলত, যে-মতের পণ্ডিতই হোক, কেউ তাঁর কাছে দৃঢ় হতে পারেননি।
দেবাশীষ মুখোপাধ্যায়

‘নন্দন কানন’ থেকে মানুষটা হেঁটে চলেছেন। মাথার ওপর অমলিন নীল আকাশ। পায়ের নিচে লাল মাটির বুকে জুতোর মশমশ। চাদর জড়ানো বুকের নিচে কত যে আঘাত— ক্রুশের চিহ্ন! দৃঢ়মনস্ক ঈশ্বর পথাশ্রয়ী। দূরে দাঁড়িয়ে দেহাতি মানুষগুলোর ডাক্তার দেবতা। বারে বারে আঘাতও তাঁর পরোপকারে বাধা হয়নি।

পায়ে বিঁধেছে কাঁটা
     ক্ষতবক্ষে পড়েছে রক্তধারা
       নির্মম কঠোরতা মেরেছে ঢেউ
          আমার নৌকোর ডাইনে বাঁয়ে
জীবনের পণ্য চেয়েছে ডুবিয়ে দিতে
            নিন্দার তলায়, পঙ্কের মধ্যে

তবুও সর্বংসহা এক সমুদ্র প্রাণে হৃদয় ভরা। মনে মনে আউরে চলেন : ‘They alone live who live for others. The rest are more dead or alive.’
শক্তিসাধন মুখোপাধ্যায়

হেনরি লুই ডিভিয়ান ডিরোজিও (১৮০৯, ১৮ এপ্রিল-১৮৩১, ২৬ ডিসেম্বর) ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০, ২৬ সেপ্টেম্বর-১৮৯১, ২৯ জুলাই) বঙ্গীয় জীবনের দুই অবিস্মরণীয় চরিত্র; কিন্তু বিস্মৃতিপরায়ণ বাঙালি তাঁদের দুজনের ক্ষেত্রে একই রকম উদাসীনতার স্বাক্ষর রেখেছে তাই নিয়ে আজকের আলোচনা। আবেগ-বিহ্বল জাতি হিসেবে বাঙালি যেমন অদ্বিতীয়, দায়িত্বজ্ঞানহীনতাতেও তেমনি দ্বিতীয় রহিত। মৃত্যু নিয়ে তার বিহ্বলতা যেমন অতুলনীয়, স্মৃতিরক্ষার ব্যাপারে তার অকর্মণ্যতাও তেমনি লজ্জাজনক। এটা তরুণবঙ্গের পথিকৃৎ ডিরোজিওর ক্ষেত্রেও যেমন দেখা গিয়েছিল করুণা সাগর বিদ্যাসাগরের ক্ষেত্রেও তার ব্যত্যয় হয়নি।

কলেরা মরবাসে আক্রান্ত হয়ে ডিরোজিও যখন মারা যান তখন তাঁর বয়স মাত্র বাইশ বছর আট মাস আটদিন। ছাত্রদের ‘ফ্রেন্ড, ফিলোজফার অ্যান্ড গাইড’ বলতে যা বোঝায় তিনি ছিলেন আক্ষরিক অর্থে তাই, কাজেই তাঁকে ঘিরে যে-ছাত্রদের জীবন আবর্তিত হতো তারা নিঃসহায় হয়ে পড়েছিল। সংবাদ রত্নাকর লিখেছিল, ‘ড্রোজুর মরণে তাহারা জীবন্মৃত হইয়া থাকিবেক’  — এতে একবিন্দু সন্দেহের কারণ ছিল না। তিনি ইস্ট ইন্ডিয়ান নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। সেই পত্রিকা তাঁর অকস্মাৎ প্রয়াণে হাহাকারের ভাষায় লিখেছিল— ‘কত আশা নিরাশায় পরিণত হয়ে গেল …অকস্মাৎ চুরি হয়ে গেল পত্রিকার সম্পাদকীয় কলমটাই’ ‘How many hopes, disappointed— how man expectations unrealized’… 2 প্রতিশ্রুতিসম্পন্ন এই মহৎ প্রতিভার অকালমৃত্যুতে ইস্ট ইন্ডিয়ান সমাজের গহন ক্ষতি হয়ে গিয়েছিল, যা কোনোভাবেই পূরণ হওয়ার নয়, তা তারা ব্যক্ত করেছিল একটি শোকসভায় মিলিত হয়ে।

বিশ্বজিৎ ঘোষ

উপনিবেশিত বাংলাদেশে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের (১৮২০-৯১) জন্ম, বেড়ে ওঠা, জীবনসাধনা এবং মৃত্যু। হুগলির অজপাড়াগাঁয়ে জন্ম নিলেও তাঁর জীবনের অধিকাংশ সময় অতিবাহিত হয়েছে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশের শাসনাধীন ভারতবর্ষের রাজধানী শহর কলকাতায়। তাঁর কর্মস্থল প্রধানত ছিল কলকাতা, চাকরি করতেন কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ম (১৭৮১) এবং সংস্কৃত কলেজে (১৮২৪), চাকরি-সূত্রে সম্পর্কিত ছিলেন ঔপনিবেশিক প্রশাসনের অনেকের সঙ্গে। ঔপনিবেশিক শাসনাধীনে চাকরি করতে হয়েছে স্বাধীনচেতা জেদি একরোখা বিদ্যাসাগরকে। অন্যদিকে তিনি ছিলেন সময়সতর্ক, কর্তব্যসচেতন, ন্যায়নিষ্ঠ এবং উদার মানবতাবাদী। চরিত্রের এই দ্বিমাত্রিক অথচ আপাত বিপ্রতীপ বৈশিষ্ট্যের কারণে ঔপনিবেশিক প্রশাসনের অনেকের সঙ্গেই তাঁর ছিল মধুর সম্পর্ক, কারো সঙ্গে সম্পর্কে ছিল অম্ল-মধুর বৈরিতা। তিনি চলতে চেয়েছেন নিজের ইচ্ছায়, —কখনো ঊর্ধ্বতন প্রশাসকদের কাছ থেকে পেয়েছেন প্রত্যাশিত আনুকূল্য, আবার কখনো-বা তাঁকে পড়তে হয়েছে দ্বন্দ্ব ও দ্বৈরথ-অর্ণবে। কিন্তু সর্বত্রই লক্ষ করা যাবে, ঔপনিবেশিক প্রশাসকের কাছে ন্যায়-নীতি বিসর্জন দিয়ে তিনি কখনো নতি স্বীকার করেননি, নিজের জাগতিক স্বার্থকে উপেক্ষা করে তিনি সবসময় সত্য ও ন্যায়ের পথে ছিলেন অটল, নিজস্ব বিবেচনায় ছিলেন সুস্থির। ঔপনিবেশিক প্রশাসনের সঙ্গে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সম্পর্কের এই খতিয়ান সন্ধানই বর্তমান নিবন্ধের অন্বিষ্ট বিষয়।
রাজীব সরকার

ইউরোপীয় রেনেসাঁসের যুগকে অভিনন্দন জানিয়ে এঙ্গেলস লিখেছিলেন— ‘আজ পর্যন্ত মানুষ যা দেখেছে তার মধ্যে এটি সবচেয়ে প্রগতিশীল বিপ্লব, এ যুগের প্রয়োজন ছিল অসাধারণ মানুষের এবং তার সৃষ্টিও হয়েছিল— যাঁরা ছিলেন চিন্তাশক্তি, নিষ্ঠা, চরিত্র, সর্বজনীনতা এবং বিদ্যায় অসাধারণ।’

বুর্খহার্ট তাঁর রেনেসাঁস সংক্রান্ত বিখ্যাত বইয়ে রেনেসাঁসকে ব্যক্তিপ্রতিভার বিস্ফোরণের যুগ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। উনিশ শতকের ভারতীয় রেনেসাঁসেও ব্যক্তিপ্রতিভার বিস্ফোরণের দেখা মেলে। রামমোহন রায় থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত শতাব্দীব্যাপী ইতিহাসে বাংলায় যে-উজ্জ্বল প্রতিভার মিছিল দৃশ্যমান, এর তুলনা সমগ্র ভারতবর্ষের ইতিহাসে আর নেই। ধর্ম ও সমাজসংস্কারে, শিক্ষা-দীক্ষায়, নারী উন্নয়নে, মানবসেবায়, জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্মেষে, শিল্প-সাহিত্য-সংগীতে, আধুনিক ধ্যান-ধারণায়, সর্বোপরি স্বাধীনতা আন্দোলনে —এমন বহুমুখী জাগরণ আর কখনো দেখা যায়নি ভারতবর্ষে। ‘এমন অল্পকালের মধ্যে ভারতের মাত্র একটি জাতির (বাঙালির) মধ্যে যত মনস্বীর, যত কর্মীর, যত ভাবুকের, যত শিল্পী ও সাহিত্যিকের আবির্ভাব ঘটেছে, ভারতের ইতিহাসেও আর ঘটেনি— অশোকের কালে নয়, গুপ্ত সাম্রাজ্যের সময়ে নয়, মোগল রাজত্বে— আকবরের দিনেও নয়, বৈষ্ণব আন্দোলনের বাঙলায়ও নয়।’ গোপাল হালদারের এই উক্তিতে কোনো আতিশয্য নেই।
আহমেদ মাওলা

উনিশ শতক আমাদের বর্তমানতার মধ্যে কীভাবে, কতটা তাজাভাবে, ইতিহাস-ঐতিহ্যের ভাব-প্রভাব নিয়ে হাজির হয়েছে, সেটা একটু দেখা দরকার। উনিশ শতক সম্পর্কে যে মেটান্যারেটিভস প্রচারিত-প্রতিষ্ঠিত, তা নিয়ে ঢাকার বাঙালি সমাজে কোনো ক্রিটিক্যাল রিডিং চোখে পড়ে না। কাণ্ডজ্ঞান বা বুদ্ধিবৃত্তিক অভিনিবেশ দিয়েও যে পাঠ বা চর্চা করা হয়েছে, তা নয়। কলকাতায় বরং উপনিবেশ-উত্তর সময়ে কিছু জিজ্ঞাসা, আত্মসমীক্ষার সন্দর্ভ রচিত হয়েছে, এখনো হচ্ছে। উনিশ শতক মানেই বাঙালি রেনেসাঁস, আধুনিকতা, সমাজসংস্কার, প্রগতি— এই বিষয়গুলোর বয়ান জারি আছে। ইতিহাসের এই বয়ানগুলো কতটা কার্যকরভাবে আমাদের বর্তমানময়তার মধ্যে খুঁজে পাই? এই জিজ্ঞাসাকে সামনে রেখে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে (১৮২০-৯১) পাঠ এবং তাঁর দ্বিশতজন্মবার্ষিকীতে স্মরণ করা হবে আমাদের জন্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। উনিশ শতকে নবজাগরণ বা রেনেসাঁস হয়েছে কি হয়নি, এই বেহুদা আলাপে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন দেখি না। রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩), ডিরোজিও (১৮০৯-৩১), রামতনু লাহিড়ী (১৮১৩-৯৮), ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-৯১), মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-৭৩), রামকৃষ্ণ পরমহংস (১৮৩৬-৮৬), বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮-৯৪), প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর (১৭৯৪-১৮৪৬), দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭-১৯০৫), কেশবচন্দ্র সেন (১৮৩৮-৮৪), রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১), বিবেকানন্দ (১৮৬৩-১৯০২) প্রমুখ রেনেসাঁসের পুনর্জাত সন্তান। এঁরা কলকাতার আরবান জনগোষ্ঠী, উচ্চবর্ণ হিন্দু, ভদ্রলোক শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত, দেবেশ রায় বলেছেন, নবজাগরণ বলে যদি কিছু ঘটেও থাকে, তা এই গোষ্ঠীর মধ্যেই ঘটেছে, ইতিহাসের আকার পায়নি, মিথ আকারে থেকে গেছে। (দেবেশ ১৯৯০ : ৪৩) এই রেনেসাঁস প্রকল্পের মধ্যে ‘আদারিং’ রয়েছে। বাঙালি ভদ্রলোক শ্রেণি ইংরেজদের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকেছে এবং নিশ্ছিদ্র কলোনিয়াল প্রসেসের মধ্যে এরা বিকশিত হয়েছে। এর বাইরে বিপুলসংখ্যক নিম্নবর্ণের হিন্দু, সাধারণ মানুষ, কৃষক সমাজ, মুসলমান জনগোষ্ঠীর মানুষকে তারা জাগাতে পারেনি। নিম্নবর্ণের হিন্দু এবং মুসলমান সমাজের জন্য নবজাগরণের কোনো প্রকল্প বা কর্মসূচি ছিল না।
ফারজানা সিদ্দিকা

১৮৫০-এ সর্ব্বশুভকরী পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয় বিদ্যাসাগরের ‘বাল্যবিবাহের দোষ’। সেখানে সৃষ্টিকর্তা যে জগতের সকল প্রাণীর মধ্যেই নারী ও পুরুষ সৃষ্টি করে সমতা বিধান করেছেন এবং মানুষ সৃষ্টির শুরু থেকেই যে বিবাহের প্রচলন ছিল না, সে-বিষয়ে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন। বিবাহের উৎস সম্পর্কে লিখেছেন, ‘জগৎসৃষ্টির কত কাল পরে মনুষ্যজাতির এই বিবাহসম্বন্ধের নিয়ম চলিত হইয়াছে, যদ্যপি তদ্বিশেষ নির্দেশ করা অতি দুরূহ, তথাপি এইমাত্র উল্লেখ করা যাইতে পারে, যখন মনুষ্যমণ্ডলীতে বৈষয়িক জ্ঞানের কিঞ্চিৎ নির্মলতা ও রাজনীতির কিঞ্চিৎ প্রবলতা হইতে আরম্ভ হইল এবং যখন আত্মপরবিবেক, স্নেহ, দয়া, বাৎসল্য, মমতাভিমান ব্যতিরেকে সংসারযাত্রার সুনির্বাহ হয় না, বিবাহসম্বন্ধই ঐ সকলের প্রধান কারণ, ইত্যাকার বোধ সকলের অন্তঃকরণে উদয় হইতে লাগিল, তখনি দাম্পত্য সম্বন্ধ অর্থাৎ বিবাহের নিয়ম সংস্থাপিত হইয়াছিল সন্দেহ নাই।’ লক্ষ করা যেতে পারে, ‘মনুষ্যমণ্ডলীতে বৈষয়িক জ্ঞানের কিঞ্চিৎ নির্মলতা ও রাজনীতির কিঞ্চিৎ প্রবলতা’ —এ দুটি দিক নিয়ে। এই প্রবন্ধের ৩৪ বছর পর ১৮৮৪-এ প্রকাশ পেয়েছে ফ্রেডরিখ অ্যাঙ্গেলসের পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি —সমাজতান্ত্রিক নারীবাদের গোড়াপত্তন হয়েছে যে গ্রন্থের আলোকে— সেখানেও ব্যক্তিগত মালিকানাতে পরিবার ও রাষ্ট্রের উৎস সন্ধানে নারীর বিশ্ব-ঐতিহাসিক পরাজয়ের পেছনে সম্পদ বা সম্পত্তি বিষয়ে মানুষের, মূলত পুরুষের, বৈষয়িক জ্ঞান ও পুরুষ-আধিপত্যের রাজনীতিকেই চিহ্নিত করা হয়েছে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, বিদ্যাসাগর এবং অ্যাঙ্গেলস —দুজনেরই জন্ম ১৮২০ সালে! সতীদাহপ্রথা, বাল্যবিবাহপ্রথা বা বিধবাবিবাহের ক্ষেত্রে যে তুমুল বাধা তার সবকিছুর পেছনেই এই সম্পদের অধিকার ও পুরুষ-আধিপত্যের রাজনীতিই যে বিদ্যমান সেটি স্পষ্টতই বুঝেছিলেন ভারতবর্ষের নারীদের দুই উদ্ধারকর্তা রাজা রামমোহন রায় ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।
এম আবদুল আলীম

উনিশ শতকের বাঙালি-সমাজে গভীর প্রভাবসঞ্চারী দুই মনীষী ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-৯১) এবং বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮-৯৪)। আধুনিক জীবনবোধ তথা রেনেসাঁসের আলোয় আলোকিত হলেও পাণ্ডিত্য, সৃজনশীলতা, দেশ-কাল-সমাজভাবনায় দুজন ছিলেন দুই মেরুর বাসিন্দা। একজন ব্রাহ্মণ-সন্তান হয়েও ব্রাহ্মণ্য অনুশাসনের বিরুদ্ধে ছিলেন খড়্গহস্ত; আরেকজন আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত এবং চিন্তা-মননে আধুনিক হলেও ছিলেন সমাজের শাশ্বত মূল্যবোধে বিশ্বাসী এবং সময় সময় ঋষির আসনে সমাসীন। উভয়ের চিন্তা-কর্মে অমিল যেমন প্রবল, তেমনি মিলও বিস্তর; একজন পরশুরামের কঠোর কুঠার হাতে ভারতীয় সমাজে দীর্ঘকাল প্রচলিত সংস্কার-কুসংস্কারের মর্মমূলে আঘাত হানতে সদা উদ্যত, আরেকজন শাণিত লেখনীর মাধ্যমে সমাজের নানা অসংগতির মূলোচ্ছেদে তৎপর। কিছু বিষয়ে ভিন্নমত থাকলেও সামগ্রিকভাবে এই দুই মনীষী স্বীয় চিন্তা এবং কর্মকাণ্ড দ্বারা উনিশ শতকের বাঙালি-সমাজের নানা সংস্কার সাধন করেছেন এবং সমাজের অগ্রগতি ও মানবকল্যাণে রেখেছেন অসামান্য অবদান।
পিয়াস মজিদ

১৯৭০-এর ডিসেম্বরে অর্থাৎ প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে গোলাম মুরশিদের সম্পাদনায় প্রকাশ পায় বিদ্যাসাগর সার্ধশতবর্ষ স্মারকগ্রন্থ বিদ্যাসাগর। ২০২০ সালে বিদ্যাসাগরের দ্বিশততম জন্মবার্ষিকীতে যখন এ-আলোচনা লিখছি তখন আমাদের হাতে রয়েছে ফেব্রুয়ারি ২০১১-তে শোভাপ্রকাশ-প্রকাশিত এই গ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণ। উৎসর্গিত হয়েছে ‘বিদ্যাসাগরের পুণ্যস্মৃতির উদ্দেশে।’

অন্তর্ভুক্ত লেখক যথাক্রমে— আহমদ শরীফ, সুনীলকুমার মুখোপাধ্যায়, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, রমেন্দ্রনাথ ঘোষ, মুখলেসুর রহমান, সনৎকুমার সাহা, মযহারুল ইসলাম, বদরুদ্দীন উমর, গোলাম মুরশিদ, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, অজিতকুমার ঘোষ, আলী আনোয়ার। পরিশিষ্টে সংযুক্ত হয়েছে বিদ্যাসাগর-বর্ষপঞ্জি।
চৌধুরী মুফাদ আহমদ

‘দেশে এখন জাঁকজমজপূর্ণ শান্তির সময়। এখন চিতাবাঘের পাশে হরিণ, হাঙ্গরের পাশে মাছ, বাজের নিকটে কপোত এবং ঈগলের পাশে চড়ুই শুয়ে থাকে’— এভাবেই ফকির খাইরুদ্দিন এলাহাবাদি উনিশ শতকের প্রথম দশকের ভারতকে বর্ণনা করেছেন। ১৮০৩ সালের দিল্লির এবং মহারাষ্ট্রের অসইয়ের লড়াইয়ে মারাঠা শক্তির বিরুদ্ধে ইংরেজদের জয়ের মাধ্যমে কার্যত ভারতের স্থানীয় শক্তির বিরুদ্ধে ইংরেজদের জয় সম্পূর্ণ হয়। এর আগে মীর কাশিম, সুজাউদ্দৌলা, টিপু সুলতান প্রমুখের প্রতিরোধ ছলে-বলে-কৌশলে ইংরেজরা নস্যাৎ করেছে। দিল্লির লড়াইয়ের পর অন্ধ মোগল সম্রাট শাহ আলম ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সুরক্ষায় নামমাত্র সম্রাটে পরিণত হন এবং ভারতে দীর্ঘস্থায়ী ব্রিটিশ শাসনের পাকাপোক্ত ভিত নির্মিত হয়। এসময়ই অভিজাত মুসলমানরা মনে করেন যে, দ্বাদশ শতাব্দীর পর এই প্রথম ভারতের শাসন মুসলমানদের হাত থেকে চলে গেল। দিল্লি জামে মসজিদের ইমাম শাহ্‌ আব্দুল আজিজ লিখেছিলেন— ‘এখান (দিল্লি) থেকে কলকাতা পর্যন্ত এখন খ্রিস্টানদের নিয়ন্ত্রণে… এই দেশ আর ‘দারুল ইসলাম’ নয়।’ ছোটখাটো ঘটনা বাদ দিলে ১৮০৩ সালের পরবর্তী কয়েক দশক ছিল ভারতে ইংরেজ শাসনের অধীনে একটি সুস্থির সময়। কলকাতা তখন ইংরেজদের রাজধানী। কলকাতার হিন্দু ‘ভদ্রলোক’দের কাছে এই সময়টা ছিল এক স্বস্তির সময়। ইংরেজ শাসনের প্রতি তাঁদের কৃতজ্ঞতা ও মুগ্ধতা প্রচুর। তাঁরা ব্যবসা-বাণিজ্য করে, মহাজনি ব্যবসা করে প্রচুর বিত্ত-বৈভবের মালিক হচ্ছেন, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তর কারণে পুরোনো জমিদারদের সম্পত্তি নিলাম হলে সেই জমিদারি কিনছেন, আবার সেগুলি অন্যদের কাছে পত্তন দিচ্ছেন। কলকাতাকে কেন্দ্র করে ধীরে ধীরে একটি হিন্দু মধ্যশ্রেণি গড়ে উঠছে। তাদের মধ্যে ইংরেজি শেখার আকাক্সক্ষা তীব্র। এরকম একটি সময়ে কলকাতা কেন্দ্রিক বঙ্গীয় জাগরণের সূচনা এবং রামমোহন রায়ের আবির্ভাব।
সেলিম মাহমুদ

মাতৃভক্তি, শিশুদের পাঠ্যবই রচনা, দানশীলতা, বিধবা বিবাহ প্রচলন প্রভৃতি কর্মসম্পাদন দ্বারা বাঙালির মনের মণিকোঠায় বিদ্যাসাগর অবিস্মরণীয় এক সত্তা। বিদ্যাসাগর প্রসঙ্গে যেসব গুণপনা বহুচর্চিত,  সেগুলি হচ্ছে— বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যরীতির জনক, সমাজ-সংস্কারক, স্ত্রীশিক্ষার প্রবর্তক, সৃষ্টিশীল অনুবাদক ইত্যাদি।

বাংলার শিক্ষা ও সমাজের ইতিহাসে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর উন্মুক্ত ও উদার মননের প্রতীক। তাঁর বিদ্যা ও দয়া কোনোটাই ভোলার নয়।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর এক বক্তৃতামালায় বক্তৃতা শুরু করেছিলেন বিদ্যাসাগরের চরিত্রের অন্যতম প্রধান গুণের কথা বলে— ‘যে গুণে তিনি পল্লী আচারের ক্ষুদ্রতা, বাঙালি জীবনের জড়ত্ব সবলে ভেদ করিয়া একমাত্র নিজের গতিবেদপ্রাবল্যে কঠিন প্রতিকূলতায় বক্ষ বিদীর্ণ করিয়া— হিন্দুত্বের দিকে নহে— করুণার অশ্রজলপূর্ণ উন্মুক্ত অপার মনুষ্যত্বের অভিমুখে আপনার দৃঢ়নিষ্ঠ একাগ্র একক জীবনকে প্রবাহিত করিয়া লইয়া গিয়াছিলেন।’
লোকমান কবীর

বেতালপঞ্চবিংশতি (১৮৪৭) ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা ওরফে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের (১৮২০-৯১) প্রথম প্রকাশিত গদ্যসাহিত্য। হিন্দি গ্রন্থ বৈতালপচ্চিসী অবলম্বনে এটি রচিত হলেও বাংলা গদ্যের উদ্ভব ও বিকাশে গ্রন্থটির গুরুত্ব অপরিসীম। এই পুস্তকের প্রথম সংস্করণে লেখক হিসেবে বিদ্যাসাগরের নাম লেখা ছিল না। এটি রচিত হয়েছিল ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পাঠ্যবইয়ের সংকট দূর করার উদ্দেশ্যে। কেননা এর পূর্বে ওই কলেজে পাঠ্যবই থাকলেও দূরান্বয় ও দুর্বোধ্যতা সেসব বইকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ছিল। দ্বিতীয় সংস্করণের বিজ্ঞাপনে বিদ্যাসাগরের ভাষ্য থেকে আমরা জানতে পারি লেখকের নাম ও গ্রন্থ রচনার প্রেক্ষাপট :

কালেজ অব্ ফোর্ট উইলিয়ম নামক বিদ্যালয়ে, তত্রত্য ছাত্রগণের পাঠার্থে, বাংলা ভাষায় হিতোপদেশ নামে যে পুস্তক নির্দ্দিষ্ট ছিল, তাহার রচনা অতি কদর্য। বিশেষতঃ, কোনও কোনও অংশ এরূপ দুরূহ ও অসংলগ্ন যে কোনও ক্রমে অর্থবোধক ও তাৎপর্য্যগ্রহ হইয়া উঠে না। তৎপরিবর্ত্তে পুস্তকান্তর প্রচলিত করা উচিত ও আবশ্যক বিবেচনা করিয়া, উক্ত বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ মহামতি শ্রীযুত মেজর জি. টি. মার্শল মহোদয় কোনও নূতন পুস্তক প্রস্তুত করিতে আদেশ দেন। তদনুসারে আমি বৈতালপচীসীনামক প্রসিদ্ধ হিন্দি পুস্তক অবলম্বন করিয়া এই গ্রন্থ লিখিয়াছিলাম।
মহীবুল আজিজ

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের চার বছর বয়সে কলকাতা থেকে একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়— চার্লস লুসিংটনের দ্য হিস্ট্রি, ডিজাইন অ্যান্ড প্রেজেন্ট স্টেট অব দ্য রিলিজিয়াস, বেনেভোলেন্ট অ্যান্ড চ্যারিটেবল ইনস্টিটিউশন্স, ফাউন্ডেড বাই দ্য ব্রিটিশ ইন ক্যালকাটা অ্যান্ড ইট্‌স ভিসিনিটি। ততদিনে বাংলায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভূমি সংস্কারের পরিণতি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হয়ে জমিদারশ্রেণির প্রজন্মান্তর ঘটে গেছে। বস্তুত ভারতবর্ষে পাশ্চাত্য শিক্ষা কোনোভাবেই স্থানীয়দের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় ছিল না, এর পুরোটাই ছিল ঔপনিবেশিক স্বার্থপুষ্ট। কোম্পানি থেকে ব্রিটিশ সরকারে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়ায় শিক্ষার প্রকৃতি বদলেছে; কিন্তু সেটির অভিমুখ থেকে গেছে মোটামুটি একই। প্রশ্ন উঠতে পারে, শিক্ষার মতো একটি ব্যয়সম্ভব খাতে কোম্পানি কেন তাহলে অর্থ খরচ করার সিদ্ধান্ত নিল? আসলে শিক্ষার নেপথ্যে নিহিত ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অন্যতর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। খ্রিষ্টান বিশ্বে তখন ক্যাথলিক-প্রোটেস্ট্যান্ট মেরুকরণের প্রক্রিয়ায় উভয় শিবিরের মধ্যে একটা পারস্পরিক প্রতিযোগিতার প্রতিবেশ বিদ্যমান, যা কখনো-কখনো দ্বান্দ্বিক পরিণামে পর্যবসিত হচ্ছিল। আমরা জানি, রানি এলিজাবেথের সঙ্গে ভ্যাটিকান চার্চের দ্বন্দ্ব শেষ পর্যন্ত খ্রিষ্টবিশ্বে প্রোটেস্ট্যান্ট মতবাদের সূচনা করেছিল। কিন্তু এর পরিণতি আরো দূরপ্রসারী হয়। ১৫৩৮ খ্রিষ্টাব্দে রোমান ক্যাথলিক পৃষ্ঠপোষিত জেসুইট মিশনারিদের সংগঠনের সূচনা বিশ্বে খ্রিষ্টধর্মে আনুষ্ঠানিক বিভক্তির একটি মাত্রা। এর বিপরীতে আট-নয়টি দেশ যেগুলো ক্যাথলিকধারার বাইরে বেরিয়ে যায়। এসবের নেপথ্যে ছিল লাতিন বাইবেলের অনুবাদের ঘটনা। ভ্যাটিকানের দৃষ্টিতে বাইবেল যেহেতু ঈশ্বরের ভাষা সেহেতু এর অনুবাদ ব্লাসফেমিসুলভ কাজ। অন্যদিকে ক্যাথলিকবিপরীত দেশগুলো নিজ-নিজ ভাষায় বাইবেল অনুসরণকে ঈশ্বরবিশ্বাসের অনুগামী বলেই বিবেচনা করে। পরিস্থিতির নেতৃত্ব নিয়ে নেয় রানি এলিজাবেথের দেশের শাসকেরাই। এরই ধারাবাহিকতায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের দুই বছরের মাথায় ১৭৯৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় লন্ডন মিশনারি সোসাইটি। প্রতিষ্ঠানটির উদ্দেশ্য ছিল ঈশ্বরের গৌরবময় বাণী ছড়িয়ে দেওয়া। এর ঠিক চার বছর পরে ১৭৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় চার্চ মিশনারি সোসাইটি তথা সিএমএস। এটি মূলত একটি ব্রিটিশ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। বিশ্বময় অ্যাংলিকান এবং প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিষ্টানদের একই ছাতার নিচে একই লক্ষ্যে কাজ করার একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান।
সৌভিক রেজা

অধ্যাপক অশোক সেন মনে করতেন যে, ‘নানা গরমিলে শিক্ষিতজনের আগাপাশতলায় স্ববিরোধের অভাব নেই।’ কথাটি খুবই সত্যি বলে মনে হয়। সেই অশোক সেনই বিদ্যাসাগর সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘Vidyasagar loved his ego responsibly, conceived of it as a social task, and was greedless in its pursuance; such were his bonafides.’ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ‘দয়ার সাগর’ নামেও পরিচিত ছিলেন। মধুসূদন দত্ত যে লিখেছিলেন—

বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে।
করুণার সিন্ধু তুমি, সেই জানে মনে,
         দীন যে, দীনের বন্ধু! উজ্জ্বল জগতে
হেমাদ্রির হেম-কান্তি অম্লান কিরণে।
জ্যোৎস্না চট্টোপাধ্যায়

ঊনবিংশ শতকের পরাধীন ভারত। এরই মধ্যে নবজাগরণের তরঙ্গে জেগে উঠেছিল বিবিধ চিন্তন। শিক্ষা, সমাজসংস্কার, নারীমুক্তির ভাবনায় ব্যাপৃত সমাজের একদল মানুষ দীর্ঘদিন পালিত অন্ধ কুসংস্কার ও প্রথা ভেঙে বেরিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর; তাঁর জন্ম ২৬ সেপ্টেম্বর ১৮২০ খ্রিষ্টাব্দে মেদিনীপুর (তৎকালীন হুগলী জেলা) জেলার বীরসিংহ গ্রামে। পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, মাতা ভগবতী দেবী। কর্মসূত্রে ঠাকুরদাস থাকতেন কলকাতায়। কলকাতা আর গ্রামে তাঁর যাতায়াত চলত। বিদ্যাসাগরের বিদ্যাচর্চা গড়ে উঠেছিল যে উনিশ শতকের প্রেক্ষাপটে সেটি জানা দরকার।

১৮০০ খ্রিষ্টাব্দের ১০ই জানুয়ারি উইলিয়াম কেরি তাঁর দুই সহযোগী উইলিয়াম ওয়ার্ড ও জোসুয়া মার্শসম্যানের সাহায্যে শ্রীরামপুর মিশন প্রেস প্রতিষ্ঠা করেন। অন্যতম সহযোগী ছিলেন হানা মার্শম্যানও। ইংরেজ সিভিলিয়ানদের এদেশীয় ভাষা শিক্ষার জন্য কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হলো ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ ১০ই জুলাই ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দে।

তারিক মনজুর

শিশু সহজাতভাবেই মুখের ভাষা আয়ত্ত করে ফেলে; অর্থাৎ কোনো রকম প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই মাতৃভাষায় কথা বলতে শিখে যায়। কিন্তু ভাষার পঠন ও লিখন দক্ষতা আনুষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যমে ঘটে। এই পঠন ও লিখন দক্ষতা যত দ্রুত তৈরি করা সম্ভব হয়, তত দ্রুত শিক্ষার্থীকে কার্যকরভাবে অন্য বিষয়ের পাঠের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা যায়। বিশ্বজুড়ে এটি বড় চ্যালেঞ্জ— কীভাবে প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক পর্যায়ের স্কুল শিক্ষার্থীদের দ্রুততার সঙ্গে পড়তে ও লিখতে শেখানো যায়।

ভাষা-শিক্ষণের একটি প্রক্রিয়ায় প্রথমে বর্ণ শেখানো হয়; এরপর শব্দ ও বাক্যের পর্যায়ে যাওয়া হয়। একে বলে আরোহী পদ্ধতি। বিপরীত পদ্ধতিকে বলে অবরোহী পদ্ধতি— যেখানে আগে বাক্য শোনানো ও পড়ানো হয়; পরবর্তী ধাপে শব্দ ও বর্ণ শেখানো হয়। অবরোহী পদ্ধতিতে শিশু বেশ তাড়াতাড়ি পড়তে শিখে যায়; কিন্তু তার পঠনে প্রচুর ভুল হতে থাকে। অবরোহী পদ্ধতির সুবিধা-অসুবিধা লক্ষ করে এখন অধিকাংশ ভাষা-শিক্ষণ প্রক্রিয়া এগোয় মিশ্র পদ্ধতিতে।

মোট পৃষ্ঠাদর্শন

vidyasagar.info ©