ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

মাইকেল মধুসূদন দত্ত

বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে।
করুণার সিন্ধু তুমি, সেই জানে মনে,
দীন যে, দীনের বন্ধু!—উজ্জ্বল জগতে
হেমাদ্রির হেমকান্তি অম্লান কিরণে।
কিন্তু ভাগ্যবলে পেয়ে সে মহা পর্বতে,
যে জন আশ্রয় লয় সুবর্ণ চরণে,
সেই জানে কত গুণ ধরে কত মতে
গিরীশ। কি সেবা তার সে মুখ সদনে।—
দানে বারি নদীরূপ বিমলা কিঙ্করী;
যোগায় অমৃত ফল পরম আদরে
দীর্ঘশিরঃ তরুদল, দাসরূপ ধরি;
পরিমলে ফুলকুল দশ দিশ ভরে;
দিবসে শীতল শ্বাসী ছায়া, বনেশ্বরী,
নিশার সুশান্ত নিদ্রা, ক্লান্তি দূর করে!

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও আদালত খান : বেতালপঞ্চবিংশতি বনাম BETAL PUNCHABINSATI

জ্যোৎস্না চট্টোপাধ্যায়

ঊনবিংশ শতকের পরাধীন ভারত। এরই মধ্যে নবজাগরণের তরঙ্গে জেগে উঠেছিল বিবিধ চিন্তন। শিক্ষা, সমাজসংস্কার, নারীমুক্তির ভাবনায় ব্যাপৃত সমাজের একদল মানুষ দীর্ঘদিন পালিত অন্ধ কুসংস্কার ও প্রথা ভেঙে বেরিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর; তাঁর জন্ম ২৬ সেপ্টেম্বর ১৮২০ খ্রিষ্টাব্দে মেদিনীপুর (তৎকালীন হুগলী জেলা) জেলার বীরসিংহ গ্রামে। পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, মাতা ভগবতী দেবী। কর্মসূত্রে ঠাকুরদাস থাকতেন কলকাতায়। কলকাতা আর গ্রামে তাঁর যাতায়াত চলত। বিদ্যাসাগরের বিদ্যাচর্চা গড়ে উঠেছিল যে উনিশ শতকের প্রেক্ষাপটে সেটি জানা দরকার।

১৮০০ খ্রিষ্টাব্দের ১০ই জানুয়ারি উইলিয়াম কেরি তাঁর দুই সহযোগী উইলিয়াম ওয়ার্ড ও জোসুয়া মার্শসম্যানের সাহায্যে শ্রীরামপুর মিশন প্রেস প্রতিষ্ঠা করেন। অন্যতম সহযোগী ছিলেন হানা মার্শম্যানও। ইংরেজ সিভিলিয়ানদের এদেশীয় ভাষা শিক্ষার জন্য কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হলো ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ ১০ই জুলাই ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দে।

শ্রীরামপুর মিশন প্রেসে ১৮০৩-এ মুদ্রিত হলো কৃত্তিবাসী রামায়ণ, যার দ্বারা সূচিত হলো নবযুগ। ওই প্রেসে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের এবং ক্যালকাটা স্কুলবুক সোসাইটির যাবতীয় পাঠ্যপুস্তক, পঁচিশটি ভাষায় বাইবেল এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কয়েকটি ভাষার মুদ্রণ মিলিয়ে প্রায় আটত্রিশটি ভাষার হরফ তৈরি হলো। অসামান্য এই কৃত্যটি সম্ভবপর করে তুললেন উইলিয়াম কেরি ও তাঁর সহযোগীরা সম্মিলিতভাবে। এই হরফ নির্মাণের মূল স্থপতি স্থানীয় পঞ্চানন কর্মকার। ক্রমে এ-কাজে যুক্ত হয়েছিলেন তাঁর জামাতা মনোহর এবং দৌহিত্র কৃষ্ণ। এই শ্রীরামপুরে কেরির উদ্যোগে ১৮১৮ খ্রিষ্টাব্দে গড়ে উঠল ভারতের দ্বিতীয় উচ্চশিক্ষার কেন্দ্র শ্রীরামপুর কলেজ।

এবার আসা যাক ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ ও বিদ্যাসাগর প্রসঙ্গে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজে বিদ্যাশিক্ষা সম্পন্ন করে মাত্র একুশ বছর বয়সে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে শিক্ষকতায় যুক্ত হলেন ১৮৪১-এ। ১৮৪৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি হেডপণ্ডিতরূপে এই কার্য নির্বাহ করেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি যে-কাজে বিশেষভাবে নিয়োজিত ছিলেন সেটি হলো বাংলা ভাষার উন্নতি ও বিকাশসাধন। সংস্কৃত সাহিত্য থেকে আবার কখনো ইংরেজি সাহিত্য থেকে, অনুবাদের কাজটিই হলো সেই লক্ষ্যের প্রথম উদ্যোগ।

এদেশের ক্লাসিক্যাল সংস্কৃতবিদ্যার সঙ্গে আধুনিক পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যার যোগসূত্র স্থাপনের দূরদৃষ্টির অধিকারী বিদ্যাসাগরের অন্যতম ভিত্তি ছিল গ্রন্থ মুদ্রণ ও প্রকাশ, শিক্ষাবিস্তারের সঙ্গে যার অঙ্গাঙ্গি সম্বন্ধ।

ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অধ্যক্ষ জি টি মার্শাল সাহেবের পরামর্শে ১৮৪৭ সালে তিনি হিন্দি বৈতালপচ্চিসীর বাংলা অনুবাদ করেন। আমাদের আলোচ্য এই গ্রন্থটি। প্রসঙ্গত, বিদ্যাসাগর-প্রতিষ্ঠিত ‘সংস্কৃত ডিপজিটরি প্রেস’ থেকে ওই মার্শাল সাহেবের অনুরোধে তিনি কৃষ্ণনগরের রাজবাড়ি থেকে ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল কাব্যের মূল পুথি এনে প্রকাশ করেন অন্নদামঙ্গল কাব্য। এটি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের সিভিলিয়ানদের পাঠ্যপুস্তক ছিল এবং প্রিয় গ্রন্থটির পাঠদান করতেন বিদ্যাসাগর স্বয়ং। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ ছয়শো টাকা দিয়ে কলেজের জন্য একশ অন্নদামঙ্গল পুস্তক ক্রয় করে, যার দ্বারা বিদ্যাসাগর প্রেসের যাবতীয় ঋণও পরিশোধ করেছিলেন।

বেতালপঞ্চবিংশতি মূল রচনাটি সংস্কৃত ভাষায় কথাসরিৎসাগরের অন্তর্গত। একাদশ শতকে সংকলিত কথাগুলি সোমদেবের সংস্কৃত কথাসরিৎসাগর হিন্দি, তামিল, বাংলা এবং মারাঠিতে ভিন্ন ভিন্ন সময়কালে অনূদিত হয়েছে। জনপ্রিয় এই কাহিনিগুলি আজও সমানভাবে গৃহীত। প্রচলিত হিন্দি অনুবাদ বৈতালপচ্চিসী থেকে বিদ্যাসাগর অংশবিশেষ পরিমার্জন করে বেতালপঞ্চবিংশতি প্রকাশ করেন ১৮৪৭-এ। পঁচিশটি গল্পের অনুবাদকর্মটি এতই জনপ্রিয় হয়েছিল যে, দু-বছরের মধ্যেই তিনি এর দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করেছিলেন। দ্বিতীয় সংস্করণের মুখবন্ধে তিনি পুনরায় কিছু সংশোধন, অশ্লীল পদ, বাক্য ও উপাখ্যান বর্জন করেছেন একথা বলেছেন। দ্বিতীয় সংস্করণটির প্রকাশকাল ১০ ফাল্গুন, সংবৎ ১৯০৬ অর্থাৎ ১৮৫০ খ্রিষ্টাব্দ। বেতালপঞ্চবিংশতি বাংলাদেশের বিদ্যালয়স্তরে প্রায় সর্বত্রই পাঠ্যপুস্তকরূপে গৃহীত হয়েছিল। পরবর্তীকালে গ্রন্থটির দশটি সংস্করণ হয়েছিল।

আমরা জানি যে, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৯৪৬-এর এপ্রিল মাসে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ থেকে সংস্কৃত কলেজের সহকারী সম্পাদক রূপে যোগদান করেন। ১৮৪৭-এর জুলাই পর্যন্ত প্রথম পর্বের পর তিনি এই চাকরি থেকে ইস্তফা দেন। দ্বিতীয় পর্বে অধ্যক্ষ হিসেবে জানুয়ারি ১৮৫১ থেকে ১৮৫৮ পর্যন্ত সাত বছর নয় মাস যুক্ত ছিলেন। এই কলেজের যাবতীয় কাজের সঙ্গেই সমাজসংস্কারের পরিকল্পনা করেছিলেন বিদ্যাসাগর।

বেতালপঞ্চবিংশতিকে কেন্দ্র করেই বিদ্যাসাগর ও আদালত খানের অসামান্য সংযোগসূত্রটি আমরা লক্ষ করব।

মানিকগঞ্জের (অধুনা বাংলাদেশের) হরিরামপুর উপজেলার দাদরাখি গ্রামের জুলফিকার খান (১৭৯০-১৮৫৪) ছিলেন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের প্রাচ্যশাখার গ্রন্থাগারিক। একথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সঙ্গে তাঁর বিশেষ পরিচয় ছিল। তাঁর চার পুত্র ছিলেন আসালত খান, আল্লাহেদাদ খান, আদালত খান ও ডা. আকবর খান।

তৃতীয় পুত্র আদালত খান কলকাতা মাদ্রাসা ও প্রেসিডেন্সি কলেজে বিদ্যার্জন করেন। ১৮৫৪ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ তুলে দিয়ে বোর্ড অফ একজামিনার্সের অধীনে ইংরেজ সিভিলিয়ানদের শিক্ষার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। আদালত খান ১৮৬২ সালে বোর্ড অব একজামিনার্সের অধীন অফিসে মুন্সি হিসেবে যোগদান করেন। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের রামরাম বসু, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, চণ্ডীচরণ মুন্সী প্রমুখ প্রথম যুগের বিখ্যাত ব্যক্তিদের মতোই আদালত খান এই বোর্ডে সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ১৮৬২ সাল থেকে।

১৮৬৪ সালে তিনি বিদ্যাসাগরের বেতালপঞ্চবিংশতির ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করেন। বলাই বাহুল্য, ইতোমধ্যে বেতালপঞ্চবিংশতির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। আদালত খানের ইংরেজি অনুবাদ BETAL PUNCHABINSATI-র পরিকল্পনার মূলে ছিল ইংরেজ সিভিলিয়ানদের বিদ্যাসাগরের বেতালপঞ্চবিংশতি পাঠ্যপুস্তক পাঠের সঙ্গে সঙ্গে এর সম্যক উপলব্ধি। আমরা লক্ষ করব যে, তিনি অনুবাদের পাশাপাশি নিজস্ব চিন্তাভাবনা যেমন প্রয়োগ করেছেন কাহিনির বিন্যাসে, তেমনই কোনো কোনো কাহিনির চরিত্র, শব্দবিন্যাস ও অন্যান্য অর্থবোধক বিষয়কে সহজতর করার জন্য বিশেষ পরিবর্তনও করেছেন। আমরা আদালত খানের একাধিক গ্রন্থের পরিচয় পাই যেগুলি বাংলা, ফার্সি প্রভৃতি ভাষা থেকে তিনি স্বচ্ছন্দ অনুবাদ করেছেন, প্রয়োজনীয় Exercise বা Grammar বই রচনা করেছেন। সর্বোপরি তুলসীদাস-রচিত হিন্দি রামায়ণ তথা রামচরিতমানসের অংশবিশেষ অনুবাদ করেছেন। তাঁর বহুধা জ্ঞান, পাণ্ডিত্য, একাধিক ভাষার ওপর দখল উনিশ শতকের বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতির ইতিহাসে এক অনন্য সংযোজন।

আমরা এখানে বিদ্যাসাগরের বেতালপঞ্চবিংশতি এবং আদালত খানের BETAL PUNCHABINSATI-এর তুলনামূলক পর্যালোচনা করে বিষয়টিতে অগ্রসর হবো।

বেতালপঞ্চবিংশতিতে পঁচিশটি কাহিনি বা গল্প আছে। কাহিনির মুখবন্ধে এই গ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণের কারণ বিন্যাস করেছেন বিদ্যাসাগর।

BETAL PUNCHABINSATI গ্রন্থের Preface বা মুখবন্ধে আদালত খান পাঠ্য বেতালপঞ্চবিংশতি গ্রন্থটির প্রশংসা করেছেন, আবার এই গ্রন্থের কোনো কোনো কাহিনির ভাষারীতি, বাক্যগঠন, উপমা-প্রয়োগ ইত্যাদি ইংরেজ সিভিলিয়ানদের পক্ষে যথেষ্ট কঠিন বা অধিগত করতে না পারার অসুবিধাগুলি উপলব্ধি করে তিনি সময়াভাব সত্ত্বেও গ্রন্থটির ইংরেজি অনুবাদের প্রয়াস গ্রহণ করেছেন বলে জানিয়েছেন।

উপক্রমণিকায় বিদ্যাসাগর বিক্রমাদিত্যের পরিচয় এবং কীভাবে বেতালের সঙ্গে রাজার সংযোগ হলো সে-ঘটনার দীর্ঘ বিবরণ দিয়েছেন। উপক্রমণিকাটিতেই একাধিক উপকাহিনির প্রসঙ্গ আছে।

মৃত রাজা চন্দ্রভানুর প্রেতাত্মার নাম বেতাল। বেতাল পঁচিশটি কাহিনি বর্ণনা করেছেন উজ্জয়িনীর রাজা বিক্রমাদিত্যের কাঁধে ভর করে। প্রতিটি কাহিনির শেষে বেতাল শর্তসাপেক্ষে বিক্রমাদিত্যকে প্রশ্ন করে। প্রশ্নের সঠিক উত্তর প্রদান করলে বেতাল পুনরায় ফিরে যাবে আবার জেনেও উত্তর না দিলে রাজার বক্ষ বিদীর্ণ হবে। রাজা অগত্যা বেতালের প্রশ্নে সম্মত হয়ে বেতালকে সন্ন্যাসী শান্তশীলের আশ্রমের দিকে নিয়ে চললেন। পথিমধ্যে এই পঁচিশটি কাহিনি বা গল্পের সমাহারই হলো বেতালপঞ্চবিংশতি বা BETAL PUNCHABINSATI।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর গ্রন্থের ভূমিকায় বলেছেন যে, অনুবাদের সময় তিনি প্রাচীন কাহিনির অংশবিশেষ বর্জন করেছেন, কোথাও কাহিনি সংযোগ করেছেন।

প্রথম যে-পার্থক্যটি আদালত খানের ইংরেজি অনুবাদে পরিলক্ষিত হয় তা হলো, বাংলা গ্রন্থটিতে কাহিনির সংখ্যা অর্থাৎ ‘প্রথম উপাখ্যান’ নির্দেশ করে কাহিনির সূত্রপাত বা বর্ণনা।

আদালত খান প্রতিটি কাহিনির সংখ্যা ‘STORY I’ নির্দেশ করার পর ‘CONTENTS’ শিরোনামে কাহিনির মূল প্রতিপাদ্য বিষয়টি সংক্ষেপে দু-চারটি বাক্যে অর্থাৎ অতিসংক্ষেপে লিখেছেন। বাংলা এবং ইংরেজি উভয় গ্রন্থেই কাহিনি বা গল্পের সংখ্যা নির্দেশিত হয়েছে।

চতুর্থ উপাখ্যানটি দীর্ঘ। এই উপাখ্যানের মধ্যে তিনটি উপকাহিনি আছে। সেগুলি স্বতন্ত্রভাবে চিহ্নিত না হয়ে কাহিনির ধারাবাহিকতাতেই বর্ণিত হয়েছে।

আদালত খান ইংরেজি গ্রন্থটিতে ‘STORY IV’-এ তিনটি উপকাহিনির মধ্যে দ্বিতীয় উপাখ্যানটিকে প্রথমে স্থান দিয়ে ‘CONTENTS’-এর কাহিনি বর্ণনা করেছেন। তারপর প্রথম উপকাহিনিটি ওই ‘STORY IV’-এর অন্তর্গত ‘EPISODE I’ করেছেন। শুধু তাই নয়, ‘EPISODE I’-এর কাহিনির প্রধান চরিত্রানুযায়ী নামকরণ করেছেন ‘THE JAY’S STORY’।

অনুরূপভাবে তৃতীয় উপাখ্যানটি ‘STORY IV’-এর অন্তর্গত ‘EPISODE II’-এর কাহিনির অন্তর্গত করে বিষয়ানুসারে নামকরণ করেছেন ‘THE PARROT’S STORY’।

বিদ্যাসাগর এবং আদালত খান উভয় গ্রন্থকারই পঁচিশটি কাহিনির লক্ষ্যে অনুবাদ করেছেন, তাই বিদ্যাসাগর হিন্দি বৈতালপচ্চিসীর কাহিনি-কাঠামোটি মূলানুসারী রেখেছেন; অন্যদিকে আদালত খানের মনে হয়েছে যে, উপকাহিনিটি স্বতন্ত্র কাহিনির মতোই অথচ গল্পের বা কাহিনির সংখ্যা পঁচিশটি নির্দিষ্ট, তাই উপকাহিনিগুলি মূল ‘STORY IV’-এর অন্তর্গত EPISODE I, II করে চিহ্নিত করেছেন।

অর্থাৎ কাহিনি-কাঠামোটি বিদ্যাসাগরের অনুবাদে মূলানুসারী হলেও লেখকের স্বাধীনতায় আদালত খান কাহিনির চরিত্র, শব্দ এবং অন্যান্য অর্থবোধক বিষয়টি সহজতর করার জন্য বিশেষ ভাবনাচিন্তা করেছেন। ইংরেজি অনুবাদে বেতালের বর্ণিত কাহিনির সূচনা থেকে সমাপ্তি পর্যন্ত উদ্ধৃতিচিহ্ন [ ‘ ’ ] ব্যবহার করেছেন, যা বিদ্যাসাগরে অনুপস্থিত।

হিন্দি বৈতালপচ্চিসী থেকে বাংলা অনুবাদের সময় বিদ্যাসাগর যেমন অনেকাংশ বর্জন, পরিমার্জন করেছেন, তেমনই আদালত খান তাঁর ইংরেজি অনুবাদের সময় বিদ্যাসাগরের বেতালপঞ্চবিংশতির বেশ কিছু শব্দের হুবহু অনুবাদ না করে সিভিলিয়ানদের পক্ষে সহজবোধ্য হবে এমন রূপান্তর ঘটিয়েছেন।

যেমন বিদ্যাসাগরের গ্রন্থে ‘দেবী কাত্যায়নী’র উল্লেখ আছে একাধিক কাহিনিতে। আদালত খান সর্বত্রই ‘দেবী কাত্যায়নী’র পরিবর্তে ‘দেবী দুর্গা’ ব্যবহার করেছেন। আমরা বুঝতে পারি যে, ‘দেবী দুর্গা’র বিষয়টির সঙ্গে এদেশে আগত সকল সিভিলিয়ানের নিঃসন্দেহে পরিচয় ঘটেছিল, ফলে বক্তব্যটি তাদের পক্ষে উপলব্ধি করা সহজতর।

বেতালপঞ্চবিংশতিতে কাহিনির বর্ণনায় ‘বিদ্যাশিক্ষা’ গ্রহণের প্রসঙ্গটি বারবার উপস্থাপিত হয়েছে। অর্থাৎ কোনো চরিত্র বা একাধিক চরিত্র ‘বিদ্যাশিক্ষা’ গ্রহণের জন্য অন্যত্র গিয়েছেন বা গ্রহণ করেছেন এরকম উল্লেখ আছে। আদালত খান ‘বিদ্যাশিক্ষা’ শব্দের ইংরেজি সর্বত্রই ‘SCIENCE’ লিখেছেন। সামগ্রিক পাঠে বোঝা যায়, ‘SCIENCE’ অর্থে ‘বিশেষ জ্ঞান’ বোঝানো হয়েছে। প্রচলিত অর্থে আমরা যেভাবে Arts, Science ব্যবহার করি তা নয়। বেতালপঞ্চবিংশতি গ্রন্থের চতুর্দশ উপাখ্যানে আছে যে, ‘ভূদেব’ নামক ব্যক্তি ‘মনস্বী’ নামক এক ব্যক্তিকে বিশেষ ইচ্ছাপূরণের ‘একাক্ষর মন্ত্র’ শিখিয়েছিলেন। এর ফলে ‘মনস্বী’ এক ‘ষোড়শবর্ষীয়া’ কন্যার রূপ ধারণ করতে পারবে আবার ইচ্ছেমতো স্বরূপে ফিরে আসতে পারবে।

আদালত খান ইংরেজি অনুবাদের সময় BETAL PUNCHABINSATI গ্রন্থে জাদুবিদ্যার বিষয়টি মনে রেখে ইংরেজদের কাছে সহজবোধ্য অনুবাদটি করেছেন নিম্নরূপ—

…he first made two balls, one of which he gave to Munosee, saying, ‘If you put this into your mouth, you will be, by the power of magic, transformed into a girl of twelve years of age, and if you will take it out again, you will remain your original shape. (p 97)

‘একাক্ষর মন্ত্র’ বিষয়টির চেয়ে ‘magic’ যে অনেক বেশি উপলব্ধি-সহায়ক সেকথা অনস্বীকার্য। শুধু তাই নয়, ভিন্নদেশীয় বা পাশ্চাত্য সমাজ-সংস্কৃতিতে ‘ষোড়শবর্ষীয়া’ কন্যার ধারণাটি পরিবর্তিত হয়ে ‘girl of twelve years of age’ করেছেন।
বেতালপঞ্চবিংশতি গ্রন্থের ত্রয়োবিংশ উপাখ্যানের কাহিনিতে ধর্ম্মপুরের গোবিন্দ নামক ব্রাহ্মণের দুই পুত্র এবং তাদের বিশেষ গুণাবলি যথাক্রমে ‘শয্যাবিন্যাস’ ও ‘ভোজনবিলাস’ এবং এ নিয়ে কাহিনি অগ্রসর হয়েছে। আদালত খান ইংরেজি অনুবাদে তিনটি পুত্রের কথা বলেছেন। তৃতীয় পুত্রটি ‘নারীচরিত্রবিলাস’ গুণের অধিকারী। ফলে কাহিনিটি আরো চিত্তাকর্ষক হয়েছে।

উভয় গ্রন্থের পৃষ্ঠাসংখ্যাও প্রায় একই। বেতালপঞ্চবিংশতি গ্রন্থের ১৪১ আর BETAL PUNCHABINSATI-র পৃষ্ঠাসংখ্যা ১৪৩। উভয় গ্রন্থের উপসংহারটি লক্ষ করা যাক।

বিদ্যাসাগরের বেতালপঞ্চবিংশতি— ‘রাজা বিক্রমাদিত্যও, সর্বপ্রকারে চরিতার্থ হইয়া, নিরতিশয় হৃষ্টচিত্তে, প্রতিগমনপূর্বক, অপ্রতিহতভাবে রাজ্যশাসন ও প্রজাপালন করিতে লাগিলেন।’ (পৃ ১৪১)

আদালত খানের BETAL PUNCHABINSATI-র অনুবাদে উপসংহারটি এইরকম— ‘king Bikramaditya also returned to his capital with cheerful heart, and surrounded his nine years (i.e. his nine able ministers) began to rule the kingdom, and maintain his subjects with the utmost felicity.’ (p 143)
সংস্কৃত কথাসরিৎসাগর, পঞ্চতন্ত্র, হিতোপদেশই হোক বা ঈশপের গল্প-কাহিনিগুলির মধ্যে নীতিশিক্ষাদানই মুখ্য বিষয়। কিন্তু আকারে সংক্ষিপ্ত হলেও কাহিনিগুলির গল্পরস অসাধারণ। নীতিকথা থাকলেও কাহিনির মধ্যে প্রাচীন সমাজ, রাজতন্ত্র, রাজন্যবর্গ, রাজসভা, রাজধর্ম, কূটনীতি নানানভাবে চিত্রিত হয়েছে। অজস্র সামাজিক উপাদানের মধ্যে নারী-পুরুষ সম্পর্ক, তাদের অবস্থান, সংসারযাত্রা, আর্থসামাজিক পরিপ্রেক্ষিত, বিদ্যাচর্চা, সাংস্কৃতিক পরিবেশ-পরিচয়, গৌরীদান, সহমরণ, পাপ-পুণ্য, শাস্তি-পুরস্কার, পশু-পাখি অর্থাৎ সামাজিক জীবনধারার তাৎপর্যে গল্পগুলি অসামান্য হয়ে উঠেছে। গল্প বলার বয়ানগুলিও লক্ষণীয়। বেতালপঞ্চবিংশতির আকর্ষণ আজও অপরিসীম। আদালত খানের ইংরেজি অনুবাদটি সুপাঠ্য, যথাসম্ভব মূলানুগ অর্থাৎ বিদ্যাসাগর অনুসারী হয়েও ভাষারীতি এবং প্রকরণে আধুনিক পাঠকের কাছেও অপেক্ষাকৃত গ্রহণীয় হতে পারে।

বিদ্যাসাগর এবং আদালত খানের এই সংযোগসূত্রটি নিঃসন্দেহে উনিশ শতকের সাহিত্যের এবং সমাজ ইতিহাসের ধারায় গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।

বাঙালি মুন্সিরূপে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে রামরাম বসু, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, চণ্ডীচরণ মুন্সী প্রমুখের নাম সুপরিচিত। নিজ পাণ্ডিত্য ও কর্মকুশলতার পরিচয়ে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে যুক্ত ছিলেন আদালত খান। তাঁর অন্যান্য গ্রন্থের পরিচয় এখানে যুক্ত করা হলো। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দ্বিশতবর্ষে এই সম্পর্ক-সূত্রটি বিশেষভাবে স্মরণীয়। উনিশ শতকের নবজাগরণের প্রেক্ষাপটে এই অনালোকিত দিকটি আলোয় উপস্থাপিত হোক, এটিই একান্ত কাম্য।

গ্রন্থঋণ

১. বেতালপঞ্চবিংশতি (দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৮৫০), শ্রী ঈশ্বরচন্দ্র শর্ম্মা, অন্নপূর্ণা প্রকাশনী, প্রথম সংস্করণ, অগ্রহায়ণ ১৩৬০, কলকাতা।

২. THE BETAL PUNCHABINSATI, Translated into English by ADALUT KHAN, A COLLEGE MOONSHEE, J.C. BOSE AND CO, STANHOPE PRESS,182, BOWBAZAR ROAD, 1864.

গ্রন্থতালিকা : আদালত খান

১. THE BETAL PUNCHABINSATI, Translated into English, Calcutta J. C. Bose & Co, Stanhope Press, 182, Bow Bazar road, 1864.

২. Translation of the Second Book of the Ramayan from the THE HINDI OF TULSI DAS into literal English with copious explanatory notes and allusions, Calcutta. printed at the Baptist Mission Press, 1871.

৩. The pleasure garden, being the poetical work of Shekh ood deen sa’di shirazi. Literary translation with copious explanatory notes and allusions, and prefaced by a sketch of the life of the poet, Calcutta, printed by CB Lewis,1868.

৪. Selections from the history of India (chapter 2-7 of J. C. Marskran’s Ancient history of India) and Bagh-o-Bahar by Adalut Khan, Calcutta Baptist Mission Press, 1877.

৫. Selection from the Prem sagar and Bagh-o-Bahar, Calcutta Baptist Mission Press and published by the Author, 80, Old Baithak Khana Bazar Road,1881.

৬. The ‘Iqd-I Gul’ : or The Rose-Necklace, selection from the Gulistan and The Anwar-I Suhailic [of Hussain-Vaiz Kashifi] 1883.

৭. The ‘Iqd-I Gul’, second edition, Calcutta, 1888.

৮. Book of Exercises – For the lower and higher standard examinations, Compiled from various works of narrative, etc., third edition, Calcutta, Baptist Mission Press, Published by the Author, 79, old Baithak Khana Bazar Road, 1893.

৯. The ‘Iqd-I Gul’, third edition, 1894, Calcutta.

১০. The ‘Iqd-I Manzum’ or The Poetic necklace, the selections from the Bustan of Shekh muslih-ud-din sa’di of Shiraz, translated into very literal English with copious notes, fourth edition, Calcutta, printed by the Author’s Son, 79, old Baithak Khana Bazar Road, 1894.

তথ্যসহায়তা : শামসুজ্জামান খান।


২১ ডিসেম্বর, ২০২০ খ্রীস্টাব্দে প্রকাশিত।



কোন মন্তব্য নেই

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন

vidyasagar.info ©