তিনি উপকার করিয়া কৃতঘ্নতা পাইয়াছেন; …দেখাইয়াছেন, আমরা কাজ আরম্ভ করি, শেষ করি না; আড়ম্বর করি, কাজ করি না; আমরা অহংকার দেখাইয়া পরিতৃপ্ত থাকি, যোগ্যতালাভের চেষ্টা করি না; আমরা সকল কাজেই পরের প্রত্যাশী।
—আহমদ রফিক
এক
‘বিদ্যাসাগর’ শব্দটি উচ্চারণের সঙ্গে-সঙ্গে আমার চোখে ভেসে ওঠে মেদভারহীন, স্থূলতাহীন, শীর্ণ অথচ দৃঢ়সন্নিবদ্ধ ঋজু পেশির স্থাপত্যে গড়া নির্ভীক, সাহসী একজন প্রকৃত হোমো সেপিয়েন প্রজাতির আধুনিক, আদর্শ মানুষের প্রতিচ্ছবি। তাঁকে শিক্ষিত বাঙালি নানা অভিধায় চিহ্নিত করলেও দুটো কথায় তাঁর সার্বিক পরিচিতি —বিদ্যাসাগর এবং দয়ার সাগর। বাঙালি মহাকবি মাইকেল মধুসূদনের কাব্যপঙ্ক্তিতে ধৃত এ-পরিচয় একাধিক লেখকের রচনায় প্রকাশ পেয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে ঈশ্বরচন্দ্র শর্মার (জন্ম ১৮২০ খ্রি.) জীবন ও চারিত্রবৈশিষ্ট্য বহুমাত্রিক। বহুগুণান্বিত বিদ্যাসাগরের চারিত্রবৈশিষ্ট্য তাঁর কঠোর ন্যায়নীতিভিত্তিক দৃঢ় ব্যক্তিত্ব, সেই সঙ্গে সরস কৌতুকপ্রবণতা, তাতে কখনো নিহিত স্যাটায়ারের শিল্পগুণ। যা আপাত-বিচারে উপভোগ্য মনে হলেও লক্ষ্যভেদে নিপুণ। এবং তা স্বতঃস্ফূর্ত তৎপরতায় আঘাত করে অলস, কর্মভীরু, ভোগ ও ভোজনবিলাসী, আড্ডাপ্রিয় ও পরচর্চায় উৎসাহী বাঙালির অপগুণগুলিকে। আর, এসব নিয়েই তাঁর যোগ্য উত্তরসূরির তীক্ষ্ণ কাব্যপঙ্ক্তির প্রতিক্রিয়া : ‘রেখেছ বাঙালি করে, মানুষ করনি।’ মানুষ হওয়া এবং মনুষ্যত্বগুণ ও মানবিক চেতনা অর্জন কঠিন কাজ হলেও মানব প্রজাতির প্রতিটি সদস্যের জন্য তা অর্জন জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে অত্যাবশ্যক, বিশেষ করে মানবসভ্যতা-সংস্কৃতির সর্বোত্তম বিকাশের বাধ্যবাধকতায়। বিশ্বপরিসরের সমাজে মানবিক মূল্যবোধের ঘাটতি কম নয় বঙ্গদেশে, বাংলাদেশে সম্ভবত তা অধিক। বিদ্যাসাগরের যথার্থ উত্তরসূরি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ওপরে উল্লিখিত বিষয়গুলো নিয়ে যথেষ্ট ভাবিত ছিলেন, লিখেছেনও বিস্তর। তাঁর উপলব্ধি, এ-সাধনায় বাঙালির ‘শুরু আছে, শেষ নেই’, অর্থাৎ আন্তরিকতার অভাব। তবে ব্যতিক্রম তো থাকবেই। ব্যতিক্রম সাধারণ সূত্রের সত্যতা প্রমাণ করে। রামমোহন, অক্ষয়কুমার দত্ত থেকে পরবর্তীকালের একাধিক মনীষী তার প্রমাণ।