ইংরেজ সরকারের আইন উপদেষ্টা ও শিক্ষা সংসদের সভাপতি শিক্ষাবিদ জন ইলিয়ট ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন ছিলেন কেম্ব্রিজ-এর কৃতী
ছাত্র, গ্র্যাজুয়েট এবং ব্যারিস্টার। ভারতপ্রেমিক ও মানবতাবাদী এই মানুষটির ভারতবর্ষে তথা কলকাতায় আগমন এদেশের দুর্ভাগা
ও অবহেলিত নারীসমাজের কাছে আশীর্বাদস্বরূপ বলা যায়। অনেকের মতে, যিনি এই বেথুন সাহেবকে বাঙালি নারীর শিক্ষাক্ষেত্রে
অনগ্রসরতা এবং অসহায়তা সম্পর্কে অবহিত করে এ কাজে এগিয়ে আসতে সার্বিক প্রেরণা জুগিয়েছিলেন, তিনি স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র
বিদ্যাসাগর।
—কানাই লাল রায়
অধ্যাপক আহমদ শরীফ তাঁর ‘বিদ্যাসাগর’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘তিনি [বিদ্যাসাগর] নতুন চেতনার জনক, সংস্কার মুক্তির জনক, জীবন-জিজ্ঞাসার জনক, বিদ্রোহের জনক, শিক্ষা ও সংস্কারের জনক, সংগ্রামীর জনক, ত্যাগ-তিতিক্ষার জনক। জনকত্বই তাঁর কৃতি ও কীর্তি। সমকালীন বাংলার সব নতুনেরই জনক ছিলেন তিনি। তিনিই ছিলেন ঈশ্বর। বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁর পরবর্তী কর্মীরা ছিলেন প্রবর্তনাদাতা, সে ঈশ্বরেরই অভিপ্রায়-চালিত নিমিত্ত মাত্র।’১
আধুনিক পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যার সঙ্গে আমাদের দেশে লৌকিক সংস্কৃতবিদ্যার যোগসূত্র প্রতিষ্ঠা, শিক্ষাসংস্কার এবং বাংলা ভাষার মাধ্যমে গণশিক্ষা প্রচলন— শিক্ষাক্ষেত্রে এগুলি হল শিক্ষাব্রতী বিদ্যাসাগরের প্রধান কীর্তি। এই কথাটাকে আর একটু পরিষ্কারভাবে বলা যায়, মাতৃভাষাকে বিদ্যার মাধ্যম করা, মৌলিক চিন্তার বিকাশে উৎসাহ দেওয়া ও শিক্ষাকে সব রকমের ধর্মীয় গোঁড়ামি থেকে মুক্ত করে বিষয়বস্তুতে পরিপূর্ণ মানবিক আদর্শের বিকাশ ঘটানো— এই ছিল বিদ্যাসাগরের শিক্ষাপরিকল্পনার মূল কথা। তাঁর আর-একটি কীর্তি হল বালকদের জন্য বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সঙ্গে এদেশে স্ত্রীশিক্ষা প্রচলনের চেষ্টা ও বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন। সেসময় স্ত্রীশিক্ষা পুরুষদের তুলনায় অনেকটাই পিছিয়ে ছিল। জন ইলিয়ট ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন (১৮০১-১৮৫১), যিনি মহাত্মা বেথুন নামে সমধিক খ্যাত, তাঁর সহযোগী রূপে বিদ্যাসাগর বাংলাদেশে স্ত্রীশিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রে পদার্পণ করেন। সেকালে আমাদের দেশে স্ত্রীশিক্ষা সম্বন্ধে নানা বদ্ধমূল কুসংস্কার প্রচলিত ছিল। যেমন, নারীরা শিক্ষিত হলে তারা বিধবা হবে, তারা মুখরা, দুশ্চরিত্রা ও গৃহকর্মবিমুখ হবে। হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার পর আধুনিক পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান-সাহিত্যের নিরবচ্ছিন্ন চর্চার ফলে এদেশের মানুষ, সীমিত সংখ্যায় হলেও, প্রাচীন গোঁড়া সংস্কার থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করেন। এই শিক্ষিত নাগরিক উচ্চ সমাজের মধ্যে ধীরে ধীরে স্ত্রীশিক্ষা সম্বন্ধে প্রাথমিক চেতনা জাগছিল। ঠিক সেই সময় বেথুন ও বিদ্যাসাগর স্থির সংকল্পের সঙ্গে এগিয়ে এলেন স্ত্রীশিক্ষাকে বাস্তবে রূপদান করার জন্য। রাজপুরুষ ডালহৌসি ও হ্যালিডে-র সঙ্গে যুক্ত হল দুই শিক্ষাবিদ বেথুন ও বিদ্যাসাগরের অধ্যবসায়, দৃঢ়তা ও নিষ্ঠা।