মোট পৃষ্ঠাদর্শন

    ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
        মাইকেল মধুসূদন দত্ত

  বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে।
  করুণার সিন্ধু তুমি, সেই জানে মনে,
  দীন যে, দীনের বন্ধু!—উজ্জ্বল জগতে
  হেমাদ্রির হেমকান্তি অম্লান কিরণে।
  কিন্তু ভাগ্যবলে পেয়ে সে মহা পর্বতে,
  যে জন আশ্রয় লয় সুবর্ণ চরণে,
  সেই জানে কত গুণ ধরে কত মতে
  গিরীশ। কি সেবা তার সে মুখ সদনে।—
  দানে বারি নদীরূপ বিমলা কিঙ্করী;
  যোগায় অমৃত ফল পরম আদরে
  তরুদল, দাসরূপ ধরি;
  পরিমলে ফুলকুল দশ দিশ ভরে;
  দিবসে শীতল শ্বাসী ছায়া, বনেশ্বরী,
  নিশার সুশান্ত নিদ্রা, ক্লান্তি দূর করে!

ইংরেজ সরকারের আইন উপদেষ্টা ও শিক্ষা সংসদের সভাপতি শিক্ষাবিদ জন ইলিয়ট ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন ছিলেন কেম্ব্রিজ-এর কৃতী ছাত্র, গ্র্যাজুয়েট এবং ব্যারিস্টার। ভারতপ্রেমিক ও মানবতাবাদী এই মানুষটির ভারতবর্ষে তথা কলকাতায় আগমন এদেশের দুর্ভাগা ও অবহেলিত নারীসমাজের কাছে আশীর্বাদস্বরূপ বলা যায়। অনেকের মতে, যিনি এই বেথুন সাহেবকে বাঙালি নারীর শিক্ষাক্ষেত্রে অনগ্রসরতা এবং অসহায়তা সম্পর্কে অবহিত করে এ কাজে এগিয়ে আসতে সার্বিক প্রেরণা জুগিয়েছিলেন, তিনি স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।

—কানাই লাল রায়



অধ্যাপক আহমদ শরীফ তাঁর ‘বিদ্যাসাগর’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘তিনি [বিদ্যাসাগর] নতুন চেতনার জনক, সংস্কার মুক্তির জনক, জীবন-জিজ্ঞাসার জনক, বিদ্রোহের জনক, শিক্ষা ও সংস্কারের জনক, সংগ্রামীর জনক, ত্যাগ-তিতিক্ষার জনক। জনকত্বই তাঁর কৃতি ও কীর্তি। সমকালীন বাংলার সব নতুনেরই জনক ছিলেন তিনি। তিনিই ছিলেন ঈশ্বর। বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁর পরবর্তী কর্মীরা ছিলেন প্রবর্তনাদাতা, সে ঈশ্বরেরই অভিপ্রায়-চালিত নিমিত্ত মাত্র।’

আধুনিক পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যার সঙ্গে আমাদের দেশে লৌকিক সংস্কৃতবিদ্যার যোগসূত্র প্রতিষ্ঠা, শিক্ষাসংস্কার এবং বাংলা ভাষার মাধ্যমে গণশিক্ষা প্রচলন— শিক্ষাক্ষেত্রে এগুলি হল শিক্ষাব্রতী বিদ্যাসাগরের প্রধান কীর্তি। এই কথাটাকে আর একটু পরিষ্কারভাবে বলা যায়, মাতৃভাষাকে বিদ্যার মাধ্যম করা, মৌলিক চিন্তার বিকাশে উৎসাহ দেওয়া ও শিক্ষাকে সব রকমের ধর্মীয় গোঁড়ামি থেকে মুক্ত করে বিষয়বস্তুতে পরিপূর্ণ মানবিক আদর্শের বিকাশ ঘটানো— এই ছিল বিদ্যাসাগরের শিক্ষাপরিকল্পনার মূল কথা। তাঁর আর-একটি কীর্তি হল বালকদের জন্য বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সঙ্গে এদেশে স্ত্রীশিক্ষা প্রচলনের চেষ্টা ও বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন। সেসময় স্ত্রীশিক্ষা পুরুষদের তুলনায় অনেকটাই পিছিয়ে ছিল। জন ইলিয়ট ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন (১৮০১-১৮৫১), যিনি মহাত্মা বেথুন নামে সমধিক খ্যাত, তাঁর সহযোগী রূপে বিদ্যাসাগর বাংলাদেশে স্ত্রীশিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রে পদার্পণ করেন। সেকালে আমাদের দেশে স্ত্রীশিক্ষা সম্বন্ধে নানা বদ্ধমূল কুসংস্কার প্রচলিত ছিল। যেমন, নারীরা শিক্ষিত হলে তারা বিধবা হবে, তারা মুখরা, দুশ্চরিত্রা ও গৃহকর্মবিমুখ হবে। হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার পর আধুনিক পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান-সাহিত্যের নিরবচ্ছিন্ন চর্চার ফলে এদেশের মানুষ, সীমিত সংখ্যায় হলেও, প্রাচীন গোঁড়া সংস্কার থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করেন। এই শিক্ষিত নাগরিক উচ্চ সমাজের মধ্যে ধীরে ধীরে স্ত্রীশিক্ষা সম্বন্ধে প্রাথমিক চেতনা জাগছিল। ঠিক সেই সময় বেথুন ও বিদ্যাসাগর স্থির সংকল্পের সঙ্গে এগিয়ে এলেন স্ত্রীশিক্ষাকে বাস্তবে রূপদান করার জন্য। রাজপুরুষ ডালহৌসি ও হ্যালিডে-র সঙ্গে যুক্ত হল দুই শিক্ষাবিদ বেথুন ও বিদ্যাসাগরের অধ্যবসায়, দৃঢ়তা ও নিষ্ঠা।
আমরা আরম্ভ করি, শেষ করি না; আড়ম্বর করি, কাজ করি না, যাহা অনুষ্ঠান করি তাহা বিশ্বাস করি না, যাহা বিশ্বাস করি তাহা পালন করি না, ভূরিপরিমাণ বাক্যরচনা করিতে পারি, তিলপরিমাণ আত্মত্যাগ করিতে পারি না, আমরা অহংকার দেখাইয়া পরিতৃপ্ত থাকি, যোগ্যতালাভের চেষ্টা করি না, আমরা সকল কাজেই পরের প্রত্যাশা করি অথচ পরের ক্রুটি লইয়া আকাশ বিদীর্ণ করিতে থাকি, পরের অনুকরণে আমাদের গর্ব, পরের অনুগ্রহে আমাদের সম্মান, পরের চক্ষে ধূলিনিক্ষেপ করিয়া আমাদের পলিটিক্স, এবং নিজের বাক্চাতুর্যে নিজের প্রতি ভক্তিবিহ্বল হইয়া উঠাই আমাদের জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য। এই দুর্বল, ক্ষুদ্র, হৃদয়হীন, কর্মহীন, দাম্ভিক, তার্কিক জাতির প্রতি বিদ্যাসাগরের এক সুগভীর ধিক্কার ছিল। কারণ তিনি সর্ববিষয়েই ইহাদের বিপরীত ছিলেন।

—শুভেন্দু সরকার



হরনাথ তর্কভূষণের মৃত্যুর পর ১৮৪৪-এ সংস্কৃত কলেজের ব্যাকরণের অধ্যাপক হওয়ার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-৯১)। বিকল্প হিসেবে তারানাথ তর্কবাচস্পতির নাম তিনি শুধু সুপারিশই করেননি, কলকাতা থেকে হেঁটে অম্বিকা-কালনা গিয়ে তাঁর সম্মতিও নিয়ে আসেন। অথচ দেখা গেল, দু’বছর পর সে-কলেজের সহকারী সম্পাদক হতে বিদ্যাসাগর এককথায় রাজি। এমনকী, দরখাস্তে আত্মপক্ষ সমর্থনে বেশ কিছু যুক্তিও সাজালেন তিনি। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে বাংলা পড়ানোর সময় সংস্কৃত কলেজের বার্ষিক বৃত্তি পরীক্ষার মূল্যায়নে তাঁর সক্রিয় ভুমিকা থাকত। এ ছাড়া, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অধ্যক্ষ মেজর জি. টি. মার্শাল-এর সুপারিশপত্র বিশেষ কাজে দিল। বিদ্যাসাগর নতুন চাকরিতে ঢুকলেন ৬ এপ্রিল ১৮৪৬-এ। প্রশ্ন জাগে: তাঁর মত পালটানোর হেতু কী? ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে নিজের জায়গায় ভাই দীনবন্ধু ন্যায়রত্নকে নিতে অনুরোধ করার পেছনে এর সম্ভাব্য উত্তরটি পাওয়া যাবে। বিদ্যাসাগরের আশঙ্কা ছিল: সংস্কৃত কলেজে তাঁর চাকরি বেশিদিন না-ও টিকতে পারে। প্রাক্তন ছাত্র বলে সংস্কৃত কলেজের শিক্ষা-প্রণালীর নানা খামতির কথা বিদ্যাসাগর জানতেন। সেসব দূর করাই ছিল তাঁর আসল উদ্দেশ্য। তাই অধ্যাপক নয়, প্রশাসকের পদ তিনি বেছে নিলেন। কিন্তু তাঁর পথ যে মসৃণ হবে না— তা নিয়ে বিদ্যাসাগরের দুশ্চিন্তা ছিল।

চাকরি পাওয়ার পরই উঠে-পড়ে লাগলেন বিদ্যাসাগর। ১৯ সেপ্টেম্বর ১৮৪৬-এ সংস্কৃত কলেজের পঠনপাঠন নিয়ে তাঁর সংস্কার-পরিকল্পনাটি শিক্ষাপরিষদে পাঠানোর জন্যে সম্পাদক রসময় দত্তর কাছে দাখিল করলেন। এ ব্যাপারে তিনি চার-পাঁচজন শিক্ষকের সাহায্য পেয়েছিলেন। পরিকল্পনায় ব্যাকরণ পাঠের পদ্ধতি ও পাঠ্যপুস্তকের পরিবর্তন চাওয়া হল। এ ছাড়া, ইংরিজি বিভাগের আমূল সংস্কারও ছিল বিদ্যাসাগরের অভীষ্ট। গোড়া থেকেই নিজের কাছে তাঁর শিক্ষাচিন্তার লক্ষ্য ছিল স্থির। বিদ্যাসাগর বরাবর এমন একদল লোক গড়ে তুলতে চেয়েছেন যারা পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান দিয়ে বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করবে। তাই সংস্কৃতর পাশাপাশি ইংরিজি পড়ানোর ওপর জোর দেন তিনি। এ কথাও ঠিক, ভাল বাংলা লেখার জন্যে সংস্কৃতয় দখল থাকা জরুরি। তখন সংস্কৃত কলেজে ইংরিজি ছিল ঐচ্ছিক বিষয়; বিদ্যাসাগর সেটিকে বাধ্যতামূলকভাবে পড়াতে চাইলেন। বিদ্যাসাগরের প্রকল্পটি ব্যক্তিগতভাবে অনুমোদন করেন মার্শাল।
‘প্রতিদিন দেখিয়াছেন— আমরা আরম্ভ করি, শেষ করি না; আড়ম্বর করি, কাজ করি না, যাহা অনুষ্ঠান করি তাহা বিশ্বাস করি না, যাহা বিশ্বাস করি তাহা পালন করি না, ভূরিপরিমাণ বাক্যরচনা করিতে পারি, তিলপরিমাণ আত্মত্যাগ করিতে পারি না, আমরা অহংকার দেখাইয়া পরিতৃপ্ত থাকি, যোগ্যতালাভের চেষ্টা করি না, আমরা সকল কাজেই পরের প্রত্যাশা করি অথচ পরের ত্রুটি লইয়া আকাশ বিদীর্ণ করিতে থাকি, পরের অনুকরণে আমাদের গর্ব, পরের অনুগ্রহে আমাদের সম্মান, পরের চক্ষে ধূলিনিক্ষেপ করিয়া আমাদের পলিটিক্স, এবং নিজের বাক্চাতুর্যে নিজের প্রতি ভক্তিবিহ্বল হইয়া উঠাই আমাদের জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য। এই দুর্বল, ক্ষুদ্র, হৃদয়হীন, কর্মহীন, দাম্ভিক, তার্কিক জাতির প্রতি বিদ্যাসাগরের এক সুগভীর ধিক্কার ছিল। কারণ তিনি সর্ববিষয়েই ইহাদের বিপরীত ছিলেন।’ (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

—সেমন্তী ঘোষ



যোগবাশিষ্ঠের একটি শ্লোক উদ্ধৃত করে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জীবনীবিষয়ক প্রবন্ধ লিখতে শুরু করেছিলেন শিবনাথ শাস্ত্রী শ্লোকটি হল— ‘তরবোহপি হি জীবন্তি জীবন্তি মৃগপক্ষিণঃ/ স জীবতি মনো যস্য মননেন হি জীবতি’: ‘গাছপালাও জীবনধারণ করে, পশুপাখিও জীবনধারণ করে, কিন্তু সে-ই প্রকৃতরূপে জীবিত, যে মনের দ্বারা জীবিত থাকে’। আবার, তাঁর প্রবন্ধ থেকে ঠিক এই শ্লোকটি তুলে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘বিদ্যাসাগর’ নামে প্রবন্ধটি রচনা করেছিলেন ১৩০৫ বঙ্গাব্দে, অর্থাৎ ১৮৯৮ সালে।

সুতরাং, এই শ্লোক বিদ্যাসাগর-জীবনীর ক্ষেত্রে ঘুরে ঘুরে আসা একটি ধুয়ো, এমন কথা বললে খুব ভুল হবে না। আপাতত এই লেখা শুরু করার জন্যও বেশ উপযুক্ত মনে হচ্ছে শ্লোকটিকে, কেননা বিদ্যাসাগরের চরিত্র বিষয়ে পরবর্তী বাঙালি মনীষীদের কৌতূহলের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ এর মধ্যে মোক্ষমভাবে ধরা আছে। ইতিহাসে বিদ্যাসাগরকে কত নানাভাবে ফিরে ফিরে দেখা হয়েছে, আমরা এখানে তার একটা মোটের উপর ধারণা তৈরি করতে চাইছি, তাই এই শ্লোক আমাদের সহায়ক হতে পারে। বুঝিয়ে দিতে পারে, বিদ্যাসাগর বিষয়ে শ্রদ্ধাভিভূত রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে বিদ্যাসাগরের প্রধান গুণটি কেন এই সূত্রের মধ্যেই প্রকাশিত: ‘সাধারণ বাঙালির সহিত বিদ্যাসাগরের যে একটি জাতিগত সুমহান্‌ প্রভেদ দেখিতে পাওয়া যায়, সে প্রভেদ শাস্ত্রীমহাশয় যোগবাশিষ্ঠের একটিমাত্র শ্লোকের দ্বারা পরিস্ফুট করিয়াছেন। আমাদের অপেক্ষা বিদ্যাসাগরের একটা জীবন অধিক ছিল। তিনি কেবল দ্বিজ ছিলেন না, তিনি দ্বিগুণ জীবিত ছিলেন।’ এই কারণেই ‘তাঁহার লক্ষ্য, তাঁহার আচরণ, তাঁহার কার্যপ্রণালী আমাদের মতো ছিল না। আমাদের সম্মুখে আছে আমাদের ব্যক্তিগত সুখদুঃখ, ব্যক্তিগত লাভক্ষতি। তাঁহার সম্মুখেও অবশ্য সেগুলো ছিল, কিন্তু তাহার উপরেও ছিল তাঁহার অন্তর্জীবনের সুখদুঃখ, মনোজীবনের লাভক্ষতি। সেই সুখদুঃখ-লাভক্ষতির নিকট বাহ্য সুখদুঃখ-লাভক্ষতি কিছুই নহে।’
vidyasagar.info ©