মোট পৃষ্ঠাদর্শন

    ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
        মাইকেল মধুসূদন দত্ত

  বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে।
  করুণার সিন্ধু তুমি, সেই জানে মনে,
  দীন যে, দীনের বন্ধু!—উজ্জ্বল জগতে
  হেমাদ্রির হেমকান্তি অম্লান কিরণে।
  কিন্তু ভাগ্যবলে পেয়ে সে মহা পর্বতে,
  যে জন আশ্রয় লয় সুবর্ণ চরণে,
  সেই জানে কত গুণ ধরে কত মতে
  গিরীশ। কি সেবা তার সে মুখ সদনে।—
  দানে বারি নদীরূপ বিমলা কিঙ্করী;
  যোগায় অমৃত ফল পরম আদরে
  তরুদল, দাসরূপ ধরি;
  পরিমলে ফুলকুল দশ দিশ ভরে;
  দিবসে শীতল শ্বাসী ছায়া, বনেশ্বরী,
  নিশার সুশান্ত নিদ্রা, ক্লান্তি দূর করে!

প্রখর রোদে ঘর্মাক্ত বিদ্যাসাগর হনহন করে আল পথ ধরে হেঁটে আসছেন, একটি পাথরের বাটি। হরপ্রসাদ প্রশ্ন করাতে বিদ্যাসাগর জানালেন কিছুক্ষণ আগে একটি সাঁওতালি এসে খবর দিয়েছে তার ছেলের নাক দিয়ে হু হু করে রক্ত পড়ছে, বললে, বিদ্যাসাগর তুই এসে যদি তাকে বাঁচাস। আমি একটা হোমিওপ্যাথিক ওষুধ নিয়ে গেছিলাম জানিস এক ডোজ ওষুধেই ছেলেটার রক্ত পড়া বন্ধ হয়ে গেল। বিদ্যাসাগর আরো বললেন এরা তো মেলা ওষুধ খায় না অল্প ওষুধে এদের উপকার হয়।

—প্রসূন কাঞ্জিলাল



সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত, সমাজসেবী, সমাজ সংস্কারক, এক বিশাল জ্ঞানের অধিকারী ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়কে সারা বিশ্বের মানুষ চেনেন। কিন্তু চিকিৎসক রূপে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ব্যাপ্তি সমন্ধে খুব কম সংখ্যক মানুষই জ্ঞাত। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগর মহাশয় এর আগ্রহ ও অবদান ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য। কিন্তু তার চিকিৎসা পদ্ধতির মূল অস্ত্র ছিল তার নিঃস্বার্থ সেবাপরায়ণতা এবং দরিদ্র মানুষের প্রতি তার অন্তরের ভালোবাসা।

বিদ্যাসাগরের হোমিওপ্যাথি চর্চার অত্যন্ত মানবিক নাকি ঐশ্বরিক বিবরণ পাওয়া যায় তার কারমাটার বাস কালে দরিদ্র শিক্ষাহীন সাঁওতালদের সান্নিধ্যে। বিহারীলাল সরকার লিখছেন “সাঁওতাল প্রবল পীড়ায় প্রায় শয্যাগত বিদ্যাসাগর তাহার শিয়রে বসিয়া, মুখে ঔষধ ঢালিয়া দিতেন, হা করাইয়া পথ্য দিতেন উঠাইয়া বসাইয়া মলমূত্র ত্যাগ করাইতেন সর্বাঙ্গে হাত বুলাইয়া দিতেন।” এ আন্তরিকতার হদিশ পেয়েছে শুধু সাঁওতালরা নয় সমাজের বিভিন্ন বৃত্তের মানুষ আর এই প্রয়াসের বলিষ্ঠতা তার আকৈশোরের অভ্যাস অথবা বলা ভালো জীবনধর্ম। এই মরমী মনটি হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার বহু আগে থেকেই ছিল সে কোন কৈশোর কালে বাবা ঠাকুরদাসের আশ্রয়দাতা জগদ্দূর্লভ সিংহের পরিচিত কিছু মানুষ কলেরায় আক্রান্ত হয়েছে শুনে বালক ঈশ্বরচন্দ্র তার বাবা ও দুই ভাই এর ভোজনের আয়োজন করে অসহায় পাঁচজন রোগীর কাছে গেলেন। ক্রমাগত বমি ও মলত্যাগের ক্লান্ত ও পিপাসার্ত মানুষগুলির জন্য স্থানীয় গৃহস্থ বাড়ি থেকে জল এনে খাওয়ালেন, ডাক্তার রূপচাঁদের বাড়ি থেকে বেদানা, মিছরি, এক কলসি পরিষ্কার জল এনে রোগীদের খাওয়ালেন নিজের হাতে বমি মলমূত্র পরিষ্কার করে ধোয়া কাপড় পড়ালেন। ডাক্তারের জল চিকিৎসায় আর ঈশ্বরচন্দ্রের সেবায় ক্রমে রোগীরা সুস্থ হয়ে উঠলেন। ১৮৬৬ সালের দুর্ভিক্ষে কলকাতার কলেজ স্কয়ার অঞ্চলে উপোসী মানুষকে নিজে হাতে খাবার পরিবেশন করেছিলেন। বীর সিংহ গ্রামে অন্ন ছত্র খুলেছিলেন, বিদ্যাসাগরের কড়া হুকুম ছিল যত টাকা খরচ হোক কেউ যেন অভুক্ত না থাকে। ১৮৬৯-৭০ সালে বর্ধমান এ এক ভয়ানক জ্বরে প্রচুর মানুষ মারা যায়। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সেইসব মানুষদের বিদ্যাসাগর সেবা ঔষধ পথ্য দিয়ে সুচিকিৎসার বন্দোবস্ত করেছেন। সেই জ্বর ছিল প্রকৃতপক্ষে ম্যালেরিয়া। বিদ্যাসাগর এ রোগের চিকিৎসার জন্য ডিসপেনসারি, ওষুধ পত্রের ব্যবস্থা করে ক্ষান্ত হননি, কলকাতায় এসে সেকালের ছোটলাট গ্রে সাহেবের কাছে বিষয়ের গুরুত্ব বোঝান। ফলে সরকারি বদান্যতায় আরো অনেক ডিসপেন্সারি খোলা হল। বিদ্যাসাগরের ডিসপেন্সারি থেকে শুধু ওষুধ পত্র নয় পয়সা ও পরনের কাপড় পর্যন্ত পাওয়া যেত। এই ডিসপেন্সারীর কাজে বিদ্যাসাগরকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিলেন প্যারীচাঁদ মিত্রের ভাইপো ডাক্তার গঙ্গা নারায়ন মিত্র। ম্যালেরিয়া রোগীকে সেখান থেকে কুইনাইন দেওয়া হত প্রয়োজনে তাদের বাড়ি গিয়েও বিদ্যাসাগর স্বয়ং ওষুধ পথ্য পৌঁছে দিয়ে আসতেন। বিদ্যাসাগরের এই অনন্য সাধারণ সেবার কথা স্মরণ করে, আরেক বিশিষ্ট মানুষ রজনীকান্ত গুপ্ত লিখছেন “১৮৮৩ সালে একদা তিনি বিদ্যাসাগর মশাই প্রাত :কালে ভ্রমণ করিতে করিতে এই নগরের প্রান্ত ভাগ অতিক্রম করিয়া কিয়দ্দূর গিয়েছেন, সহসা দেখিলেন একজন বৃদ্ধা অতিসার রোগে আক্রান্ত হইয়া পথের পাশে পড়িয়া রহিয়াছে। দেখিয়ে তিনি ওই মল লিপ্ত বৃদ্ধাকে পরমযত্নে ক্রোড়ে করিয়া আনিলেন এবং তাহার যথোচিত চিকিৎসা করাইলেন। দরিদ্রা বৃদ্ধা তাহার যত্নে আরোগ্য লাভ করিল।”
বিদ্যাসাগরের প্রগতিশীল চিন্তা ভাবনা এবং উদ্যোম আর দ্বারকানাথের মুদ্রণযন্ত্র,আর্থিক সঙ্গতি ও স্বচ্ছ সামাজিক, রাজনৈতিক চেতনা সোমপ্রকাশকে এমন উচ্চতায় নিয়ে যায় যে, বিভিন্ন বিষয়ে জনমত গঠনে অতি প্রভাবশালী ভূমিকা গ্রহণ করে এই পত্রিকা।

—প্রসূন কাঞ্জিলাল



দ্বিশতবর্ষে বিদ্যাসাগর স্মরণ এবং শ্রদ্ধা এ প্রজন্মের বাঙালিকে করেছে ঋদ্ধ। উৎসাহিত করছে এই অন্যতম শ্রেষ্ঠ যুগপুরুষকে জানতে এবং আত্মস্থ করতে। রক্ত-মাংসের এই ঈশ্বরের সামগ্রিক কর্মকান্ডের ক’য়েক শতাংশও যদি থাকত অনুপস্থিত, তবে জাতি হিসেবে বাঙালি যে আজ কতটা দীন থেকে যেত তা কল্পনায় আনলেই শিউরে উঠতে হয়। বিদ্যাসাগরের মতো মহামানবের জন্মের জন্য যেমন অপেক্ষা করতে হয় ক’য়েক শতাব্দী, তেমনই যে জাতির একজন বিদ্যাসাগর থাকেন সে জাতিকে কখনই অন্ধকারের অতল গহ্বরে তলিয়ে যেতে হয় না। বিদ্যাসাগরের মতো ঈশ্বররা কোনো একটি বিশেষ কাজের জন্যও জন্মান না। এক জীবনে বহু কাজের মাধ্যমে সমগ্র জাতিকে উন্নত করার দায়িত্ব তুলে নেন কাঁধে।

বিদ্যাসাগরের কর্মময় জীবনের অজস্র ধারার অন্যতম ছিলতৎকালীন বিভিন্ন পত্র পত্রিকার পৃষ্ঠেপোষকতাও। পেশা নয়, তাঁর বহুমুখী কর্মকাণ্ডকে পূর্ণতা দিতেই হাতে তুলে নিতে হয়েছিল ক্ষুরোধার কলম। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে বেশ ক’য়েকটি সাময়িক পত্রের দায়িত্ব তাঁকে সামলাতে হয়েছে দীর্ঘদিন। ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’, ‘সর্ব্বশুভকরী পত্রিকা’, ‘সোমপ্রকাশ’ ও ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’ ছিল তাঁর এই পর্বের কর্মকান্ডের বিচরণ ক্ষেত্র। তত্ত্ববোধিনীসোমপ্রকাশ ছিল সেই সময়ের অত্যন্ত প্রভাবশালী দুটি বাংলা পত্রিকা। শিক্ষিত বাঙালি সমাজে অত্যধিক প্রভাবশালী ইংরেজি পত্রিকা ছিল হিন্দু পেট্রিয়ট
বিদ্যাসাগর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো (১৮৫৬) এবং রয়াল এশিয়াটিক সোসাইটির সম্মানিত সদস্য (১৮৬৪) নির্বাচিত হন। ১৮৭৭ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার লেফটেন্যান্ট-গভর্ণর স্যার রিচার্ড টেম্পল বিধবাবিবাহ আন্দোলনের নেতা হিসাবে তাঁকে এক বিশেষ সম্মানলিপি প্রদান করেন। ১৮৮০-তে ভারত সরকার তাঁকে সি.আই. ই. উপাধিতে ভূষিত করেন।

—আনিসুজ্জামান

১. বিদ্যাসাগরচরিত

উনিশ শতকের বাংলা দেশে বহু কীর্তিমান পুরুষের জন্ম হয়েছিল। এঁদের মধ্যেও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের স্বাতন্ত্র্য সহজেই ধরা পড়ে। যে-বিস্ময়বোধ থেকে রবীন্দ্রনাথ তাঁর সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘বিশ্বকর্মা যেখানে চার কোটি বাঙালি নির্মাণ করিতেছিলেন, সেখানে হঠাৎ দুই-একজন মানুষ গড়িয়া বসেন কেন, তাহা বলা কঠিন’, যুগান্তরেও আমাদের সে-বিস্ময়বোধের অবসান হয় না।

অথচ তিনি লালিত হয়েছিলেন নিতান্ত প্রাচীনপন্থী পরিবেশে। মেদিনীপুর (তখন হুগলি) জেলার বীরসিংহ গ্রামে তাঁর জন্ম হয় (২৬ সেপ্টেম্বর ১৮২০। ১২ আশ্বিন ১২২৭)। তাঁর পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় সামান্য কর্ম করতেন; তাঁর বেতন কখনো মাসে দশ টাকার বেশি হয়নি। দারিদ্র তাঁদের সহচর ছিল; সম্পদ বলতে ছিল পুরুষানুক্রমিক চরিত্রবল। বিদ্যাসাগর-জননী ভগবতী দেবীও এ-চরিত্রগুণের অধিকারী ছিলেন। উত্তরাধিকারসূত্রে বিদ্যাসাগর যদি তাঁর পরিবার থেকে কিছু পেয়ে থাকেন, তবে তা ছিল চরিত্রের এই তেজ।
vidyasagar.info ©