ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

মাইকেল মধুসূদন দত্ত

বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে।
করুণার সিন্ধু তুমি, সেই জানে মনে,
দীন যে, দীনের বন্ধু!—উজ্জ্বল জগতে
হেমাদ্রির হেমকান্তি অম্লান কিরণে।
কিন্তু ভাগ্যবলে পেয়ে সে মহা পর্বতে,
যে জন আশ্রয় লয় সুবর্ণ চরণে,
সেই জানে কত গুণ ধরে কত মতে
গিরীশ। কি সেবা তার সে মুখ সদনে।—
দানে বারি নদীরূপ বিমলা কিঙ্করী;
যোগায় অমৃত ফল পরম আদরে
দীর্ঘশিরঃ তরুদল, দাসরূপ ধরি;
পরিমলে ফুলকুল দশ দিশ ভরে;
দিবসে শীতল শ্বাসী ছায়া, বনেশ্বরী,
নিশার সুশান্ত নিদ্রা, ক্লান্তি দূর করে!

অনন্য ব্যক্তিত্ব ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

—আহমদ শরীফ

বিদ্যাসাগরকে দেখিনি। শুনে শুনেই তাঁকে জেনেছি। ভালই হয়েছে। দেখলে তাঁকে খণ্ড খণ্ড ভাবেই পেতাম। শুনে শুনে তাঁকে অখণ্ডভাবে সমগ্ররূপে পেয়েছি। কেননা; চোখের দেখা হারিয়ে যায়। অনুধ্যানে পাওয়াই চিরপ্রাপ্তি, সেই পাওয়া যেমন অনন্য, তার স্থিতি যেমন মর্মমূলে, তেমনি তার রূপও সামগ্রিক। উনিশ শতকী বাঙলায় অনেক কৃতীপুরুষ জন্মেছিলেন, বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁদের দান গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সব কিছুর মূলে ছিলেন দুই অসামান্য পুরুষ। প্রথমে রামমোহন, পরে ঈশ্বরচন্দ্র। একজন রাজা, অপরজন সাগর। উভয়েই ছিলেন বিদ্রোহী। পিতৃ-ধর্ম ও পিতৃ-সমাজ অবজ্ঞাত ও উপেক্ষিত হয়েছে উভয়ের কাছেই। তাঁদের দ্রোহ ছিল পিতৃকূলের ধর্ম ও সমাজের, জাতি ও নীতির, আচার ও আচরণের বিরুদ্ধে।

উভয়েই ছিলেন পাশ্চাত্য প্রজ্ঞায় প্রবুব্ধ। জগৎ ও জীবনকে তাঁরা সাদা চোখে দেখবার, জানবার ও বুঝবার প্রয়াসী ছিলেন। বিষয়ীর বুদ্ধি ছিল তাঁদের পুঁজি। সমকালীন জনারণ্যে তাঁরা ছিলেন individual, ব্যক্তিত্বই তাঁদের চরিত্র। তাই তাঁরা ছিলেন চির-একা। তাঁদের কেউ সহযাত্রী ছিল না— বন্ধু ছিল না, সহযোগী ছিল না। তাই তাঁরা কেউ সেনাপতি নন, সংগ্রামী সৈনিক। অদম্য আকাঙ্ক্ষা আর দুঃসাহসই তাঁদের সম্বল। নতুন করে গড়ব স্বদেশ— এ ছিল আকাঙ্ক্ষা, আর একাই কাজে নেমে পড়ার দুঃসাহস। ভিমরুলের চাকে খোঁচা দেয়ার পরিণাম জেনেও হাত বাড়িয়ে দেবার সংকল্পই হচ্ছে তাঁদের ব্যক্তিত্ব। এ ব্যক্তিত্ব আত্মপ্রত্যয় ও মানব-প্রীতির সন্তান। রামমোহন ও বিদ্যাসাগরই আমাদের দেশে আধুনিক মানববাদের নকীব ও প্রবর্তক।

জরা ও জীর্ণতার বিরুদ্ধে ছিল তাঁদের সংগ্রাম। তাঁরা ছিলেন কর্মীপুরুষ— নির্মাতা। মানুষের মনোভূমি শূন্য থাকে না। তাই গড়ার আগে ভাঙতে হয়। তাই তাঁরা আঘাত হানলেন ধর্মের দুর্গে, ভাঙতে চাইলেন সমাজ ও সংস্কারের বেড়া। কেননা, বিশ্বাসী মানুষের জীবন নিয়ন্ত্রিত হয় শাস্ত্রীয় শাসনে ও আচারিক আনুগত্যে। যে সব প্রত্যয় ও প্রতিজ্ঞা মানুষকে বদ্ধকূপের জিয়ল মাছ করে রেখেছে, যে সব বিশ্বাস ও সংস্কারের লালন, যে সব আচার-আচরণের বন্ধনে তাদের জীবনে নেমে এসেছে জড়তা, সে সব লক্ষ্যেই তাঁরা কামান দাগালেন। গড়ার সংকল্প ও উল্লাস তাঁদেরকে দিয়েছিল মনোবল ও বৈনাশিক শক্তি। উভয়েই ছিলেন বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন নির্ভীক কর্মীপুরুষ। রামমোহনের ছিল জগৎ ও জীবন সম্পর্কে আবাল্য জিজ্ঞাসা। পশ্চিমের বাতায়নিক হাওয়ার ছোঁয়ায় সে-জিজ্ঞাসা গভীর ও ব্যাপক হয়ে ওঠে এবং কালোপযোগী জীবন-ভাবনা ও জগৎচেতনা তাঁকে দ্রোহী ও আপোষহীন বিরামহীন নির্ভীক সংগ্রামী করে তুলেছিল। কেননা, তিনি স্বদেশী-স্বধর্মীর জন্যেও এই জাগ্রত জীবনের প্রসাদ কামনা করেছিলেন।

রাজা রামমোহন কিংবা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর— প্রচলিত অর্থে কেউই ধার্মিক ছিলেন না। রামমোহনের জীবনে উচ্ছৃঙ্খলতা ছিল। আর শ্রেয়োবোধই ছিল বিদ্যাসাগরের ধর্ম। দুইজনেই ছিলেন জীবনদায়ী মানবতাব্রতী মুক্তপুরুষ। তাই বিবেকই ছিল তাঁদের Boss; তাই তাঁরা ছিলেন ভেতরে বাইরে নিঃসঙ্গ। ভূতে-ভগবানে কারো বিশ্বাস ছিল না বলেই, তাঁরা জীবন-স্বপ্নের বাস্তবায়নে উদ্যোগী হতে পেরেছিলেন এবং একারণেই যুক্তিই ছিল তাঁদের যুদ্ধের অস্ত্র। যুক্তির অস্ত্রে শাস্ত্রকে বিনাশ করতে চেয়েছিলেন তাঁরা।

রামমোহন আচারিক ধর্মকে বোধের জগতে উন্নীত ও প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। পাশ্চাত্য শিক্ষা ও ধর্মের বৈদান্তিক ব্যাখ্যার মাধ্যমেই তিনি তাঁর প্রয়াসে সিদ্ধি কামনা করেছিলেন। এতে অবশ্য স্বকালে তাঁর প্রত্যক্ষ সাফল্য সামান্য। সেজন্যে তাঁর অসামর্থ্য দায়ী নয়। জন-সমাজে প্রতীচ্য শিক্ষার অভাবই ব্যর্থতার কারণ। তবু এদেশে প্রতীচ্য-চেতনা-সূর্যের উদয় ঘটে রামমোহনের মাধ্যমেই। এবং সে সূর্য মধ্যযুগীয় নিশীথের তমসা অপসারিত করে। রামমোহন ও বিদ্যাসাগর ছিলেন মেকলের উদ্দিষ্ট এ্যাঙলো-ইন্ডিয়ান— মন মেজাজ ও প্রজ্ঞা ছিল যাঁদের প্রগতিশীল বিদ্বান প্রতীচ্য নাগরিকের, আর জীবনবোধ ছিল নাস্তিক দার্শনিকের, জীবনরসিক বিজ্ঞানীর। উভয়েই ছিলেন মানববাদী— তাই হিতবাদী কর্মী না হয়ে তাঁদের উপায় ছিল না। রামমোহনের উত্তরসূরী বিদ্যাসাগর। রামমোহনের আরব্ধ কর্মে সাফল্য দানই ছিল বিদ্যাসাগরের ব্রত। রামমোহন সংশয়বাদী, বিদ্যাসাগর নাস্তিক। রামমোহন আন্তর্জাতিক, বিদ্যাসাগর জাতীয়তাবাদী।

বিদ্যাসাগর ছিলেন গরীব ঘরের সন্তান। সে ঘরে দুই পুরুষ ধরে আর্থিক স্বস্তি কিংবা আত্মিক প্রশান্তি ছিল না। ঘরোয়া কোঁদল, অবজ্ঞা ও অবহেলা এবং আর্থিক দৈন্য সুস্থ জীবনের পরিপন্থী ছিল। এমনকি পিতৃশাসনও ছিল প্রতিকূল।

জন্মমুহূর্তে বিদ্যাসাগরের পিতামহের মুখে এক অমোঘ সত্য উচ্চারিত হয়েছিল— এঁড়ে বাছুর জন্মেছে।

গোঁ বা জেদই ছিল বিদ্যাসাগরের সব আচরণ ও কর্মপ্রচেষ্টার মূলে। বলা চলে, ঈশ্বরচন্দ্রের অন্য নামই ‘জেদ’। এক্ষেত্রে তিনি যথার্থই ঈশ্বর। ঈশ্বরের মতোই ছিল তাঁর অপপেক্ষ শক্তি। সে শক্তির উৎস জেদ ছাড়া কিছুই নয়। এরই শালীন নাম দৃঢ় সংকল্প। একারণেই বিদ্যাসাগর ত্যাগ, তিতিক্ষা ও কর্মের প্রতীক রূপে প্রতিভাত হয়েছেন।

বিস্ময়ের বিষয়, টুলো বামুন পরিবারে যাঁর জন্ম, দারিদ্র্য যাঁর আজন্ম সহচর, বাল্যে যাঁর ইংরেজি শিক্ষা হয়নি, রক্ষণশীল পিতা যাঁর পারিবারিক ঐতিহ্য-প্রীতিবশে, হিতাকাঙ্ক্ষীর পরামর্শ উপেক্ষা করে, সন্তানকে শাস্ত্র শিক্ষাদানে সচেষ্ট, সেই বিদ্যাসাগর আবাল্য দেব-দ্বিজে আস্থাহীন। অনুজ শম্ভুচন্দ্র বলেছেন— জ্যেষ্ঠ মহাশয়ের ভগবানে ভক্তি ছিল না, তবে মাতাপিতাকে তিনি দেবতা-জ্ঞানে ভক্তি করতেন। বিদ্যাসাগর নির্বিচারে কিছুই মানেননি। বাল্যেও তিনি সব ব্যাপারে মাতাপিতারই অনুগত ছিলেন না, জেদ চাপলে তাঁকে শায়েস্তা করা সহজ ছিল না। তাঁর বিচারশীলতার ভিত্তি ও মান ছিল কল্যাণ। যা কল্যাণকর তা-ই বরণীয়; আর সব বর্জনীয়। তাই ব্রাহ্মণপণ্ডিত, অধ্যক্ষ বিদ্যাসাগর বলতে পেরেছেন— বেদান্তদর্শন ভ্রান্ত, দেশীয় ন্যায়শাস্ত্র অকেজো— তা পড়িয়ে কাজ নেই। মায়াবাদের কবলমুক্ত করে পাশ্চাত্য জীবনবাদী দর্শনের রাজ্যে নিয়ে যেতে হবে স্বজাতিকে।

কিন্তু সেদিন রামমোহন কিংবা বিদ্যাসাগরকে বুঝবার লোক এদেশে বেশি ছিল না। থাকার কথাও নয়। অগ্রসর চিন্তাচেতনা কেবল কোটিতে গুটিক সম্ভব। এজন্যে অপরিচিত চিন্তার দীপ্তি সহ্য করবার মতো লোক ‘লাখে না মিলয়ে এক’।

তাই বিদ্যাসাগরও ছিলেন স্বকালে অস্বীকৃত। কিন্তু মেঘ-ভাঙা রোদের মতো তাঁর ব্যক্তিত্বের দীপ্তি, তাঁর চিন্তার দ্যুতি, তাঁর সংকল্পের বাঙালীকে বিরক্ত, বিচলিত ও ব্যস্ত করে তুলেছিল। প্রতিরোধ-প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্যে হলেও তাদের গা-ঝাড়া দিয়ে উঠতে হয়েছে— জড়তা জড়িয়ে ঝিমিয়ে থাকা আর সম্ভব হয়নি। তারা আহ্বানে সাড়া দিয়ে জাগেনি; ঘা খেয়ে আর্তচিৎকারে জাগল।

বিদ্যাসাগরের জেদ যেমন তাঁর চরিত্রে দিয়েছে কাঠিন্য, সংকল্পে দিয়েছে দৃঢ়তা, তেমনি প্রজ্ঞা জানিয়েছে প্রগতির পথ। বর্জন করবার শক্তিই বিদ্যাসাগরকে অনন্য করেছিল। এমনি গুণ রামমোহনেরও ছিল। স্বধর্মের ও স্বদেশের আজন্মলব্ধ বিশ্বাস সংস্কার তিনি গায়ে-লাগা ধুলোর মতো ফুঁ দিয়ে ঝেড়ে ফেলতে পেরেছিলেন। হিতবাদী দর্শনেই ছিল তাঁর আস্থা। তাই বিধবাবিবাহ, বাল্যবিবাহ, কিংবা বহুবিবাহ ব্যাপারে তিনি শাস্ত্রের পরোয়া করেননি। কেবল গণমত প্রভাবিত করার জন্যেই শাস্ত্র আওড়িয়েছেন। তাঁর আত্মচরিতসূত্রে প্রকাশ, এক অনাত্মীয়া নারীর মমতামুগ্ধ বিদ্যাসাগর বাল্যেই নারীর প্রতি শ্রদ্ধাবান হয়ে উঠেন। শরৎচন্দ্র এক্ষেত্রে যেন বিদ্যাসাগরেরই মানস-সন্তান। প্রতীচ্য শিক্ষা ব্যতীত তাঁর উদ্দেশ্য যে সফল হবার নয়, তা বিদ্যাসাগর গোড়াতেই বুঝেছিলেন, কেননা তাঁর মানববাদেরও উৎস ছিল পাশ্চাত্য শিক্ষালব্ধ জীবন-চেতনা। কিন্তু জেদী বিদ্যাসাগর অপেক্ষা করবার লোক ছিলেন না। তিনি কাঁচা কলা পাকাতে চেয়েছেন, তাই ব্যর্থতাই বরণ করতে হল। বঙ্কিমচন্দ্রও বুঝেছিলেন ইংরেজি শিক্ষার প্রসারেই কেবল বহুবিবাহ নিবারণ সম্ভব। কুন্দ ও হরলাল, নগেন্দ্রনাথ ও গোবিন্দলাল চরিত্র-মাধ্যমে বঙ্কিমচন্দ্র বিধবা সম্পর্কে সংস্কার-লালিত মনের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব দেখিয়েছেন। বঙ্কিমচন্দ্রের ব্যক্তিগত মতও বিধবাবিবাহের অনুকূল ছিল না। তবু কুন্দ-নগেনের বিয়ে তো বিদ্যাসাগরের আন্দোলনের প্রভাবেই সম্ভব হয়েছিল। বঙ্কিমচন্দ্র দেবীচৌধুরাণী ছাড়া সব উপন্যাসেই বহুবিবাহ-বিরোধী মনোভাব সুপ্রকট।

শিক্ষাই যে মোহমুক্তির ও অন্ধতা বিনাশের একমাত্র ঋজু উপায় তা সেকালে বিদ্যাসাগরের চাইতে বেশি কেউ উপলব্ধি করেনি। তাই শিক্ষাবিস্তারে তিনি দেহ-মন-আত্মনিয়োগ করেন। তিনি এ-ও বুঝেছিলেন মাতৃভাষাই শিক্ষার বাহন হওয়া উচিত। এবং নারী-পুরুষ সবারই জন্যে সমভাবে শিক্ষার প্রয়োজন। সামাজিক নির্যাতন ও সংস্কারের বন্ধন কেবল শিক্ষার মাধ্যমেই ঘুঁচতে পারে— এ বিষয়ে তাঁর মনে কোন সংশয় ছিল না। গাঁয়ে গাঁয়ে বিদ্যালয় স্থাপন, পাঠ্যপুস্তক রচনা ও প্রকাশনাই ছিল তাঁর ব্রত। বর্ণপরিচয়- বোধোদয়- আখ্যানমঞ্জরী- ইতিহাস- উপক্রমণিকা ও ব্যাকরণ কৌমুদী- ঋজুপাঠ- বেতাল পঞ্চবিংশতি- শকুন্তলা- সীতার বনবাস প্রভৃতি তাঁর লিখিত ও সম্পাদিত যাবতীয় গ্রন্থই পাঠ্যপুস্তক। প্রভাবতীসম্ভাষণ ও অসমাপ্ত আত্মচরিত ব্যতীত তাঁর সব রচনাই শিক্ষাবিস্তারের ও সমাজ-সংস্কারের উদ্দেশ্যে রচিত। এ সব রচনায় তাঁর সাহিত্য-রুচি, শালীনতাবোধ, বৈদগ্ধ্য, শিল্পনৈপুণ্য, বর্ণনভঙ্গির বৈশিষ্ট্য ও কল্পনার উৎকর্ষ আজকাল আর অস্বীকৃত নয়।

সাহিত্যক্ষেত্রে বঙ্কিমচন্দ্রের আবির্ভাবে আঠারো শ’ পয়ষট্টি সালের পরে বিদ্যাসাগরের ভাষিক প্রত্যক্ষ প্রভাব অপগত। মোটামুটিভাবে আঠারো শ’ সত্তর সালের দিকে পাঠ্যপুস্তকের ক্ষেত্রেও তিনি একক নন। তাছাড়া বিধবাবিবাহ কিংবা বহুবিবাহের ক্ষেত্রেও তাঁর প্রয়াস তখন ব্যর্থ ও অতীতের দুঃস্বপ্নমাত্র। বাস্তবজীবনে এমনি করে তাঁর ভূমিকা ম্লান ও গৌণ হয়ে গেল আঠারো শ’ পঁচাত্তরের দিকে। তিনি ছিন্নমূল তালতরুর মতো বেঁচে রইলেন আঠারো শ’ একানব্বই সাল অবধি। তাহলে বিদ্যাসাগরের রইল কি? তাঁর কোন্ কৃতি কীর্তি হিসেবে গৌরবমিনার হয়ে রইল?

সেই যে বাঙলা গদ্যরীতির ‘জনক’ বলে তাঁর এক খ্যাতি আছে, সেই জনকত্বেই তাঁর স্থিতি। তিনি নতুন চেতনার জনক, সংস্কারমুক্তির জনক, জীবন-জিজ্ঞাসার জনক, বিদ্রোহের জনক, শিক্ষা ও সংস্কারের জনক, সংগ্রামীর জনক, ত্যাগ-তিতিক্ষার জনক। জনকত্বই তাঁর কৃতি ও কীর্তি। সমকালীন বাঙ্লার সব নতুনেরই জনক ছিলেন তিনি। তিনিই ছিলেন ঈশ্বর। বিভিন্নক্ষেত্রে তাঁর পরবর্তী কর্মীরা ছিলেন প্রবর্তনাদাতা সে ঈশ্বরেরই অভিপ্রায়-চালিত নিমিত্তমাত্র।

বিধাতা সেকালের কোলকাতায় ‘মানুষ’ একজনই গড়েছিলেন, যিনি ধুতি-চাদর-চটির মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, যিনি জীবন ও জীবিকাকে আদর্শের পদানত করেছিলেন, যাঁর হিমাদ্রি-দৃঢ় সংকল্পের কাছে মাথানত করেছে ইংরেজ-ভারতীয় সবাই। যাঁর মানস-ঐশ্বর্যের কাছে হার মেনেছিল রাজসম্পদ। যাঁর আত্মসম্মানবোধের কাছে রাজকীয় দাপট ম্লান হয়ে গিয়েছিল। মানববাদী বিদ্যাসাগর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যেরও প্রবক্তা। ব্যক্তিজীবনের দুঃখ-দুর্দশা ও অভাব অসুবিধার গুরুত্ব-চেতনা প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্বের চেয়ে কম ছিল না তাঁর কাছে। ‘প্রভাবতীসম্ভাষণ’ মানুষ বিদ্যাসাগরের অন্তর্লোকের পরিচয়বাহী। হিউম্যানিস্ট বিদ্যাসাগরের পরিচয় ‘দয়ার সাগর’ খ্যাতিও বহন করছে। আসলে হিন্দু কলেজে শিক্ষাপ্রাপ্ত এজুরা বা ইয়ং বেঙ্গলেরাই অশিক্ষা, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ ও বিধবাবিবাহ সম্বন্ধে মৌখিক ও লিখিত আলোচনার মাধ্যমে আন্দোলনের সূচনা করেন। কিন্তু তাঁদের পক্ষে তা ছিল সুরুচি ও সংস্কৃতিসংপৃক্ত সমস্যা-জাতীয় লজ্জাবিশেষ। এই সৌখিন দ্রোহীরা হিন্দুর ও হিন্দুয়ানীর সব কিছুরই নিন্দা করতেন— এগুলোও ছিল তার অন্তর্গত। এই এজুরা চল্লিশোত্তর জীবনে গোঁড়া হিন্দু বা নিষ্ঠ ব্রাহ্ম হয়েই তুষ্ট ছিলেন, — হয়তো বা প্রথম যৌবনের ঔদ্ধত্যের জন্যে লজ্জিত কিংবা অনুতপ্তও হয়েছিলেন। কাজেই বিদ্যাসাগরে যা ছিল তাঁর অস্তিত্বের মতোই সত্য, ডিরোজিও দীক্ষিত ইয়ং বেঙ্গলদের পক্ষে তা ছিল বয়োধর্মপ্রসূত সৌখিন সংস্কৃতিবানতা। তাঁরা বিদ্বান ও বুদ্ধিমান ছিলেন; কেউ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমাজকর্মী এবং লেখকও ছিলেন, কিন্তু বিদ্রোহী থাকেন নি। হিউম্যানিস্ট বিদ্যাসাগর মানবকল্যাণে “আবশ্যক হইলে প্রাণান্ত স্বীকারেও পরাঙ্মুখ” ছিলেন না। তাই বিদ্যাসাগর মহৎ ও অনন্য। কেবল ভাষার ক্ষেত্রে নয়, জগৎচেতনা ও জীবন-জিজ্ঞাসার ব্যাপারেও সংস্কৃতিবান বিদ্যাসাগর বাঙালী হিন্দুকে গ্রাম্য পাণ্ডিত্য এবং গ্রাম্য বর্বরতা, উভয়ের হস্ত হতে উদ্ধার করে প্রতীচ্য সংজ্ঞায় আধুনিক সভ্য মানুষ করে তুলতে প্রয়াসী ছিলেন। তাঁর জীবিতকালেই তিনি স্বচক্ষে তাঁর এ সাফল্য দেখে গেছেন। স্বকালে বিদ্যাসাগরকে বুঝেছিলেন কেবল মধুসূদনই। তাই তিনি বলতে পেরেছিলেন—

“The man to whom I have appealed has the genius and wisdom of an ancient sage, the energy of an Englishman and the heart of an Bengali mother.”— এর চাইতে বিদ্যাসাগরের যথার্থ ও পূর্ণাঙ্গ পরিচয় আর কিছুই হতে পারে না।

রামমোহন কিংবা বিদ্যাসাগরের কর্মক্ষেত্র হিন্দুসমাজেই নিবদ্ধ ছিল। এমন কি শিক্ষাবিস্তার ক্ষেত্রেও বিদ্যাসাগর মুসলিম জনশিক্ষার দায়িত্ব নেন নি। কিন্তু এ জন্যে বিদ্যাসাগরকে দায়ী করা চলবে না। প্রথমত, এঁদের শিক্ষা-সমস্যা কিংবা সমাজ-সমস্যা নিবদ্ধ ছিল কোলকাতা ও তার চতুস্পার্শস্থ জেলাগুলোর উচ্চবর্ণের শিক্ষিত সমাজে। ইংরেজি শিক্ষাবিমুখ স্বসমাজের মানুষের সমস্যাও তাঁদের বিচলিত করে নি। দ্বিতীয়ত, সে যুগে বৈষয়িক বা আর্থনীতিক ক্ষেত্র ছাড়া অন্য ক্ষেত্রে মুসলমান সমাজের সঙ্গে উচ্চবর্ণের ও উচ্চ বিত্তের হিন্দুসমাজের মধ্যযুগীয় সামাজিক-সাংস্কৃতিক কিংবা রাজনীতিক যোগসূত্র প্রায় সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তৃতীয়ত, বিদ্যাসাগরের সমকালে নওয়াব আবদুল লতিফ প্রমুখের নেতৃত্বে মুসলিম-শিক্ষাপদ্ধতি সম্বন্ধে তখনো অস্থির বিচার বিবেচনা চলছে। আবদুল লতিফ স্বয়ং ছিলেন উর্দুভাষী এবং বিদেশাগত উচ্চবিত্তের উর্দুভাষী মুসলিম পরিবারগুলোর প্রতিনিধিত্ব করছেন তিনি। তাঁর বাঙলা-বিরোধী সুস্পষ্ট উক্তি রয়েছে। তিনি ছিলেন মুসলমানের মাতৃভাষারূপে উর্দু প্রর্বতনের দাবীদার এবং দেশজ নিম্নবিত্তের মুসলমানদের জন্যেও তিনি বিশুদ্ধ বাঙলা কামনা করেন নি— চেয়েছিলেন নিদেনপক্ষে সন্ধিকালের জন্যে সাময়িকভাবে আরবি-ফারসি-মিশ্রিত দোভাষী রীতির বাঙলার প্রচলন, যাতে উত্তরকালে মাতৃভাষারূপে উর্দু গ্রহণ করা সহজ হয়। এমন অবস্থায় বিদ্যাসাগরের পক্ষে মুসলমানের জন্যেও বাঙলা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাপ্রয়াস সম্ভব ছিল না, তাঁর সে অধিকারই ছিল না।

বহুবিবাহ সম্পর্কে আলোচনাকালে বিদ্যাসাগর বলেছেন : “বহুবিবাহ প্রথা প্রচলিত থাকাতে বাঙ্গালা দেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে যত দোষ ও যত অনিষ্ট ঘটিতেছে, বোধ হয়, ভারতবর্ষের অন্য অন্য অংশে তত নহে, এবং বাঙ্গালা দেশের মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যেও, সেরূপ দোষ বা সেরূপ অনিষ্ট শুনিতে পাওয়া যায় না।” বিদ্যাসাগর নিশ্চয়ই জানতেন, চারের অধিক স্ত্রী গ্রহণ ইসলামে অবৈধ। এবং ভোগ-বাঞ্ছাবশেই তারা বিয়ে করে —কন্যাদায়গ্রস্তদের উদ্ধার করবার জন্যে পেশা হিসাবে বর সাজে না। তাছাড়া মুসলমান সমাজে তালাক ও পুনর্বিবাহের ব্যবস্থা রয়েছে। কাজেই হিন্দু নারীর দাম্পত্য বিড়ম্বনা কিংবা বৈধব্য যন্ত্রণা মুসলিম নারীতে অনুপস্থিত। কাজেই বিদ্যাসাগর মুসলমান কিংবা অন্য প্রদেশের হিন্দুর বহুবিবাহ নিবারণের জন্যে আন্দোলন করেন নি। বাঙ্‌লা হিন্দুসমাজেও পেশা হিসেবে বহুবিবাহ প্রথাটা ব্রাহ্মণদের মধ্যে সীমিত ছিল। সুতরাং এটি ছিল একান্তই ব্রাহ্মণ পরিবারের সমস্যা। ইংরেজি শিক্ষাটা ব্রাহ্মণদের মধ্যেই বিশেষ করে প্রসার লাভ করে, তাই স্ব-স্বার্থেই প্রতীচ্য শিক্ষাপ্রাপ্ত ব্রাহ্মণদের এ বিচলন ও আন্দোলন।

বাঙালী মুসলমানসমাজে রামমোহনের মতো সংশয়বাদী আন্তর্জাতিক চেতনাসম্পন্ন কর্মীপুরুষ কিংবা বিদ্যাসাগরের মতো মানবহিতবাদী নাস্তিক সংগ্রামীপুরুষ একজনও জন্মাননি। হয়তো যে কালিক প্রয়োজনে রামমোহন-বিদ্যাসাগরের আবির্ভাব, প্রতীচ্য-চেতনা-বিমুখ মুসলিমসমাজে তেমন কাল অনুভূত হয়নি। অথবা রামোহন-বিদ্যাসাগর সমাজের জন্যে যা করেছেন, তা জাগরণ মুহূর্তে প্রতীচ্য বিদ্যাপ্রাপ্ত মুসলিম সমাজকেও দিশা দিয়েছিল। পথিকৃতের চাইতে অনুগামীর স্বাচ্ছন্দ্য যে অনেক বেশী তা কে অস্বীকার করবে? বাঙালী মুসলমান, প্রতিবেশীর পশ্চাদ্গামী ছিল বলেই অনায়াসেই অনেক সমস্যার অনুকৃত সমাধান পেয়েছিল। তবু বোধ হয় প্রশ্ন থেকে যায়— রামমোহন ও বিদ্যাসাগরের মতো প্রত্যাশিত মুক্তচিত্ত দ্রোহী ও নাস্তিক মানববাদীর অনুপস্থিতি মুসলমান সমাজের সৌভাগ্যের না দুর্ভাগ্যের কারণ?



কোন মন্তব্য নেই

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন

vidyasagar.info ©