মোট পৃষ্ঠাদর্শন

    ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
        মাইকেল মধুসূদন দত্ত

  বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে।
  করুণার সিন্ধু তুমি, সেই জানে মনে,
  দীন যে, দীনের বন্ধু!—উজ্জ্বল জগতে
  হেমাদ্রির হেমকান্তি অম্লান কিরণে।
  কিন্তু ভাগ্যবলে পেয়ে সে মহা পর্বতে,
  যে জন আশ্রয় লয় সুবর্ণ চরণে,
  সেই জানে কত গুণ ধরে কত মতে
  গিরীশ। কি সেবা তার সে মুখ সদনে।—
  দানে বারি নদীরূপ বিমলা কিঙ্করী;
  যোগায় অমৃত ফল পরম আদরে
  তরুদল, দাসরূপ ধরি;
  পরিমলে ফুলকুল দশ দিশ ভরে;
  দিবসে শীতল শ্বাসী ছায়া, বনেশ্বরী,
  নিশার সুশান্ত নিদ্রা, ক্লান্তি দূর করে!

বিধবাবিবাহ সংগঠিত করতে গিয়ে বারবার প্রতারিত হয়ে পরম সুহৃদ দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে তিনি লিখছেন, “আমাদের দেশের লোক এত অসার ও অপদার্থ বলিয়া পূর্বে জানিলে আমি কখনই বিধবাবিবাহ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করিতাম না।” এই পরম সুহৃদ দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ও (স্যর সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাবা) চলে গেলেন ১৮৭০ সালে।

—সুমন্ত্র চট্টোপাধ্যায়



সাল ১৮৭৫, তারিখ ৩১ মে। স্থান কলকাতা। গভীর রাত।

অভিমানে ক্ষতবিক্ষত এক জন আমহার্স্ট স্ট্রিটের ৬৩ নম্বর বাড়িতে দোতলার একটি ঘরে বসে নিজের হাতে লিখছেন তাঁর ইচ্ছাপত্র বা উইল। তাঁকে শুধু তাঁর একমাত্র পুত্র বা পরিবার আহত করেনি, তাঁকে রক্তাক্ত করেছে তথাকথিত শিক্ষিত সমাজ, ইংরেজ শাসক, সেই শাসকদের করুণা-লোভী জমিদার শ্রেণির বাবু সম্প্রদায়, এমনকী তাঁর পরম আরাধ্যা জননী। মাত্র পঞ্চান্ন বছর বয়সেই উইল লিখছেন তিনি।

পঁচিশটি অনুচ্ছেদে সম্পূর্ণ এই উইল। এতে রয়েছে তাঁর নিজের সম্পত্তির তালিকা, পঁয়তাল্লিশ জন নরনারীকে নির্দিষ্ট হারে মাসিক বৃত্তি দেবার নির্দেশ। এর মধ্যে ছাব্বিশ জন তাঁর অনাত্মীয়। এ ছাড়াও ব্যবস্থা আছে দাতব্য চিকিৎসালয় ও মায়ের নামে স্থাপিত বালিকা বিদ্যালয়ের জন্য। সব থেকে বিস্ময়কর পঁচিশ নম্বর অনুচ্ছেদ।
রামমোহন কিংবা বিদ্যাসাগরের কর্মক্ষেত্র হিন্দুসমাজেই নিবদ্ধ ছিল। এমন কি শিক্ষাবিস্তার ক্ষেত্রেও বিদ্যাসাগর মুসলিম জনশিক্ষার দায়িত্ব নেন নি। কিন্তু এ জন্যে বিদ্যাসাগরকে দায়ী করা চলবে না। প্রথমত, এঁদের শিক্ষা-সমস্যা কিংবা সমাজ-সমস্যা নিবদ্ধ ছিল কোলকাতা ও তার চতুস্পার্শস্থ জেলাগুলোর উচ্চবর্ণের শিক্ষিত সমাজে। ইংরেজি শিক্ষাবিমুখ স্বসমাজের মানুষের সমস্যাও তাঁদের বিচলিত করে নি। দ্বিতীয়ত, সে যুগে বৈষয়িক বা আর্থনীতিক ক্ষেত্র ছাড়া অন্য ক্ষেত্রে মুসলমান সমাজের সঙ্গে উচ্চবর্ণের ও উচ্চ বিত্তের হিন্দুসমাজের মধ্যযুগীয় সামাজিক-সাংস্কৃতিক কিংবা রাজনীতিক যোগসূত্র প্রায় সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তৃতীয়ত, বিদ্যাসাগরের সমকালে নওয়াব আবদুল লতিফ প্রমুখের নেতৃত্বে মুসলিম-শিক্ষাপদ্ধতি সম্বন্ধে তখনো অস্থির বিচার বিবেচনা চলছে। আবদুল লতিফ স্বয়ং ছিলেন উর্দুভাষী এবং বিদেশাগত উচ্চবিত্তের উর্দুভাষী মুসলিম পরিবারগুলোর প্রতিনিধিত্ব করছেন তিনি। তাঁর বাঙলা-বিরোধী সুস্পষ্ট উক্তি রয়েছে। তিনি ছিলেন মুসলমানের মাতৃভাষারূপে উর্দু প্রর্বতনের দাবীদার এবং দেশজ নিম্নবিত্তের মুসলমানদের জন্যেও তিনি বিশুদ্ধ বাঙলা কামনা করেন নি— চেয়েছিলেন নিদেনপক্ষে সন্ধিকালের জন্যে সাময়িকভাবে আরবি-ফারসি-মিশ্রিত দোভাষী রীতির বাঙলার প্রচলন, যাতে উত্তরকালে মাতৃভাষারূপে উর্দু গ্রহণ করা সহজ হয়। এমন অবস্থায় বিদ্যাসাগরের পক্ষে মুসলমানের জন্যেও বাঙলা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাপ্রয়াস সম্ভব ছিল না, তাঁর সে অধিকারই ছিল না।

—আহমদ শরীফ



বিদ্যাসাগরকে দেখিনি। শুনে শুনেই তাঁকে জেনেছি। ভালই হয়েছে। দেখলে তাঁকে খণ্ড খণ্ড ভাবেই পেতাম। শুনে শুনে তাঁকে অখণ্ডভাবে সমগ্ররূপে পেয়েছি। কেননা; চোখের দেখা হারিয়ে যায়। অনুধ্যানে পাওয়াই চিরপ্রাপ্তি, সেই পাওয়া যেমন অনন্য, তার স্থিতি যেমন মর্মমূলে, তেমনি তার রূপও সামগ্রিক।

উনিশ শতকী বাঙলায় অনেক কৃতীপুরুষ জন্মেছিলেন, বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁদের দান গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সব কিছুর মূলে ছিলেন দুই অসামান্য পুরুষ। প্রথমে রামমোহন, পরে ঈশ্বরচন্দ্র। একজন রাজা, অপরজন সাগর। উভয়েই ছিলেন বিদ্রোহী। পিতৃ-ধর্ম ও পিতৃ-সমাজ অবজ্ঞাত ও উপেক্ষিত হয়েছে উভয়ের কাছেই। তাঁদের দ্রোহ ছিল পিতৃকূলের ধর্ম ও সমাজের, জাতি ও নীতির, আচার ও আচরণের বিরুদ্ধে।

উভয়েই ছিলেন পাশ্চাত্য প্রজ্ঞায় প্রবুব্ধ। জগৎ ও জীবনকে তাঁরা সাদা চোখে দেখবার, জানবার ও বুঝবার প্রয়াসী ছিলেন। বিষয়ীর বুদ্ধি ছিল তাঁদের পুঁজি। সমকালীন জনারণ্যে তাঁরা ছিলেন individual, ব্যক্তিত্বই তাঁদের চরিত্র। তাই তাঁরা ছিলেন চির-একা। তাঁদের কেউ সহযাত্রী ছিল না— বন্ধু ছিল না, সহযোগী ছিল না। তাই তাঁরা কেউ সেনাপতি নন, সংগ্রামী সৈনিক। অদম্য আকাঙ্ক্ষা আর দুঃসাহসই তাঁদের সম্বল। নতুন করে গড়ব স্বদেশ— এ ছিল আকাঙ্ক্ষা, আর একাই কাজে নেমে পড়ার দুঃসাহস। ভিমরুলের চাকে খোঁচা দেয়ার পরিণাম জেনেও হাত বাড়িয়ে দেবার সংকল্পই হচ্ছে তাঁদের ব্যক্তিত্ব। এ ব্যক্তিত্ব আত্মপ্রত্যয় ও মানব-প্রীতির সন্তান। রামমোহন ও বিদ্যাসাগরই আমাদের দেশে আধুনিক মানববাদের নকীব ও প্রবর্তক।
vidyasagar.info ©