মোট পৃষ্ঠাদর্শন

    ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
        মাইকেল মধুসূদন দত্ত

  বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে।
  করুণার সিন্ধু তুমি, সেই জানে মনে,
  দীন যে, দীনের বন্ধু!—উজ্জ্বল জগতে
  হেমাদ্রির হেমকান্তি অম্লান কিরণে।
  কিন্তু ভাগ্যবলে পেয়ে সে মহা পর্বতে,
  যে জন আশ্রয় লয় সুবর্ণ চরণে,
  সেই জানে কত গুণ ধরে কত মতে
  গিরীশ। কি সেবা তার সে মুখ সদনে।—
  দানে বারি নদীরূপ বিমলা কিঙ্করী;
  যোগায় অমৃত ফল পরম আদরে
  তরুদল, দাসরূপ ধরি;
  পরিমলে ফুলকুল দশ দিশ ভরে;
  দিবসে শীতল শ্বাসী ছায়া, বনেশ্বরী,
  নিশার সুশান্ত নিদ্রা, ক্লান্তি দূর করে!

বিদ্যাসাগরের সামাজিক যুদ্ধ

বিদ্যাসাগরের বিশিষ্টতা এখানে যে, ধর্মাক্রান্ত, দেশাচারপ্রবণ ও যৌনশুচিগ্রস্ত বাঙালীদের মধ্যে তিনি ছিলেন যথার্থই একজন মুক্ত চিন্তার মানুষ : আধুনিক, ইহজাগতিক এবং খুব সম্ভবত নাস্তিক। নানা শঙ্কায় কাতর ও অজুহাতপ্রবণ বাঙালী যে সকল স্থানে যেতে পিছপা হয়েছে, বিদ্যাসাগর সেখানে উপস্থিত হয়েছেন সদর্পে। বিদ্যাসাগরের এই যে চারিত্রিক দৃঢ়তা তাঁকে রবীন্দ্রনাথ আখ্যায়িত করেছেন অজেয় পৌরুষ হিসেবে।

—মন্ময় জাফর



উপক্রমণিকা


ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের (১৮২০-১৮৯১) দু’শো বছরের জন্মবার্ষিকীতে তাঁর সমাজ সংস্কার আন্দোলনকে ফিরে দেখার প্রচেষ্টা থেকে এই প্রবন্ধের উৎপত্তি। বিধবা বিবাহ সম্পর্কিত তর্কাতর্কি মাতিয়ে রেখেছিল উনিশ শতকের প্রায় পুরোভাগ। আলোচ্য প্রবন্ধে এর পক্ষে-বিপক্ষের যুক্তিগুলো পুনর্বিবেচনা করার প্রয়াস নেয়া হয়েছে। সে সঙ্গে আলোচিত হয়েছে বিধবা বিবাহ সিদ্ধকরণে বিদ্যাসাগরের যুগান্তকারী ভূমিকা। বঙ্কিমের সর্বজনবিদিত বিদ্যাসাগর বিরোধিতার প্রসঙ্গটি সঙ্গত কারণে এসেছে। এপার ও ওপার বাংলার, বিশেষত ‘বাম ঘরানার বুদ্ধিজীবীরা বিদ্যাসাগরের কি ধরনের মূল্যায়ন করেছেন, তার ওপরেও আলোকপাত করা হয়েছে। বিদ্যাসাগর নিজেকে একজন সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত হিসেবে শুধু দেখেন নি, দেখেছেন মুক্ত চিন্তার একজন মানুষ হিসেবে। সে কারণে মিল খোঁজা হয়েছে বিদ্যাসাগরের উনিশ শতকের বিধবা বিবাহ আন্দোলন এবং একুশ শতকের সমকামী সম্পর্ক ও বিবাহকে আইনগত বৈধতাদান আন্দোলনের গতিপ্রকৃতির মধ্যে। বিদ্যাসাগরকে যে শুধু একজন কুশলী ও বাস্তববাদী সমাজ সংস্কারক হিসেবে দেখানো হয়েছে তা-ই নয়, বরং তাঁকে উপস্থাপন করা হয়েছে বাঙালীর দেশাচারপ্রবণ, ধর্মাক্রান্ত, যৌনশুচিগ্রস্ত ও জাড্যময় জীবনের একজন কড়া সমালোচক হিসেবে।



উনিশ শতকের ঔপনিবেশিক বাংলায় নারী জীবন নিয়ন্ত্রণকারী পিতৃতান্ত্রিক বিবিধ ধারণাকে নানা প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছিলেন যাঁরা তাঁদের মধ্যে রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩), ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১) ও ইয়ং বেঙ্গলের প্রথাবিরোধী সদস্যরা অবশ্য স্মর্তব্য। এঁদের কল্যাণেই দানা বাঁধে সংস্কার আন্দোলন। অবশ্য ইয়ং বেঙ্গলের কর্ম পদ্ধতির সঙ্গে রামমোহন ও বিদ্যাসাগরের কাজের ফারাক ছিল বিস্তর। ইয়ং বেঙ্গলেরা বাঙালী হিন্দু সমাজ সংস্কারের লক্ষ্যে নানা ধরনের অভিনব পন্থা অবলম্বন করেছিলেন যার মধ্যে গো-মাংস ভক্ষণ এবং তাঁদের সম্পাদিত জ্ঞানান্বেষণ পত্রিকায় বহু বিবাহকারী কুলীন ব্রাহ্মণদের নামের তালিকা প্রকাশ অন্যতম ছিল। রামমোহন ও বিদ্যাসাগর অবশ্য সে পথে হাঁটলেন না, বরং সমাজকে তাঁরা বদলাতে চাইলেন ভেতর থেকে, যার মধ্যে গণসংযোগ ও লেখালেখিকে প্রাধান্য দেওয়া হলো। ইয়ং বেঙ্গলদের মতো তৎকালীন সমাজকে র‍্যাডিকালভাবে প্রত্যাখ্যান করার চাইতে তাঁরা মনোযোগ দিলেন নারী সম্পর্কিত দীর্ঘ দিনের ধ্যান ধারণা, আচার ও বিশ্বাসকে বদলানোর প্রচেষ্টায়, বেছে নিলেন এক ধরনের ‘ধীরে চলো’ নীতি। কখনো বাঙালীর মনন তাঁরা যুক্তি দিয়ে জাগ্রত করতে চাইলেন, কখনো আবেদন রাখলেন তাদের বিবেকের কাছে। তাঁদের এই মধ্য পন্থা অবশ্য পছন্দ করেন নি ইয়ং বেঙ্গলেরা, তমা দিয়েছিলেন ‘হাফ-লিবারেল’-এর। কিন্তু রামমোহন ও বিদ্যাসাগরের ধৈর্য ও স্থৈর্য অবশেষে কাঙ্ক্ষিত সুফল বয়ে এনেছিল। ব্রিটিশ সরকার ১৮২৯ সালে ভারতবর্ষে সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। এরই হাত ধরে ১৮৫৬ সালে বিধবা বিবাহকে আইনগত বৈধতা প্রদান করা হয়; যদিও বালবিবাহ তখনো বহাল ছিল।

আমরা জানি বিদ্যাসাগর তাঁর কর্মজীবনের একটি বৃহৎ অংশ ব্যয় করেছিলেন বিধবা বিবাহের পক্ষে এবং বালবিবাহ ও বহুবিবাহের বিপক্ষে জনমত গঠনের কাজে। এছাড়া নারীরও যে রয়েছে শিক্ষা লাভের অধিকার তা কলকাতার বেথুন স্কুলের পরিচালনা কমিটিতে তাঁর জোরালো ভূমিকার মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন। কলকাতা শহর ও আশেপাশের এলাকায় তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন অনেকগুলো মেয়েদের স্কুল। তবে বাংলার বিধবাদের প্রতি তাঁর যে কর্তব্যযুক্ত দরদ তা-ই তাঁর জীবন, কাজ ও অর্জনকে সেকালে ও পরবর্তী প্রজন্মের কাছে বিশিষ্টতা দান করেছে। উল্লেখ্য যে, বিধবা বিবাহের পক্ষে তাঁর এই সংগ্রাম তৎকালীন সমাজে একটি বিভেদ সৃষ্টিকারী ঘটনা হিসেবে পরিগণিত হয়েছিল। ফলে, বিধবা বিবাহের পক্ষে-বিপক্ষে লেখালেখি হয়েছে অজস্র। দু’টি বিস্তারিত প্রস্তাবনার মাধ্যমে বিদ্যাসাগর অবশ্য সমালোচনার জবাব দিয়েছিলেন, খুঁজে বের করেছিলেন বিধবা বিবাহের পক্ষে শাস্ত্রীয় সমর্থন, পরাশর সংহিতায়। পূর্বসুরী রামমোহন রায়ের মতো শাস্ত্রের পুনর্পাঠ উপস্থাপনের মাধ্যমে শাস্ত্রকে শাস্ত্র দিয়ে ঠেকিয়ে দিতে চেয়েছেন বিদ্যাসাগর। এসঙ্গে দেশাচার কিংবা সমাজে প্রচলিত ধ্যান-ধারণাকে করেছেন প্রশ্নবিদ্ধ। শুধু লেখালেখিতেই সীমাবদ্ধ রাখেন নি নিজেকে। বিধবা বিবাহের পক্ষে সামাজিক সমর্থনের জন্যে যেমন পথে নেমেছেন, ইংরেজ শাসকের কাছে দেন-দরবারও করেছেন এর আইনগত বৈধতা আদায়ের লক্ষ্যে। ১৮৫৬ সালে বিধবা বিবাহ আইনসিদ্ধ হওয়ার পরেও তাঁর আন্দোলনে যতি পড়েনি। সামাজিক বাধা এমনকি ব্যক্তিগত আক্রমণের মুখেও নিজ অর্থ ব্যয় করে আয়োজন করেছেন অর্ধ-শতাধিক বিধবা বিবাহের। মৃত্যু পূর্ববর্তী করা উইলে এর নিমিত্তে একটি মোটা অঙ্কের টাকা বরাদ্দ রাখতে ভোলেন নি তিনি। এসব কারণেই সমাজ সংস্কারের জন্যে নেওয়া বিদ্যাসাগরের বহুমুখী প্রয়াসকে সামাজিক যুদ্ধ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ (১৮৬১-১৯৪১)। বলেছেন, বিদ্যাসাগরই সেই ব্যক্তি যিনি শত প্রতিকূলতার মধ্যেও পল্লী আচারের ক্ষুদ্রতা এবং বাঙালী জীবনের জড়ত্বের ঊর্ধ্বে উঠতে পেরেছিলেন। এক্ষেত্রে কাজে এসেছিল তাঁর অদম্য চারিত্র্যশক্তি। তিনি হিন্দুত্বের দিকে যান নি, যান নি সাম্প্রদায়িকতার দিকেও। কারণ, “তিনি যথার্থ মানুষ ছিলেন” (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ১৯৯১:৬৫)। মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩) তো আরো এক ধাপ এগিয়ে বলেছেন, বাঙালী মায়ের দরদের সঙ্গে ইংরেজের কর্তব্যনিষ্ঠা যুক্ত হয়েছে বিদ্যাসাগরের মধ্যে (ব্রায়ান হ্যাচার, ২০১২: ১)। আর নীরদ চন্দ্র চৌধুরী (১৮৯৭-১৯৯৯) তো তাঁকে বাঙালী বলেই স্বীকার করতে চান নি, কারণ বিদ্যাসাগরের যে গুণ তা বাঙালীর মধ্যে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর (নীরদ চন্দ্র চৌধুরী, ১৯৯৭: ১১৬)।



উনিশ শতকে যে বিষয়গুলো নারী জীবনকে আক্রান্ত ও স্থবির করে রেখেছিল সেগুলো হলো বালবিবাহ, কুলীনদের বহুবিবাহ, অকাল বৈধব্য এবং এসবের ফলে উদ্ভূত পতিতাবৃত্তি। বলাই বাহুল্য, এই বিষয়গুলো ছিল একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত। বালবিবাহের ফলে অনেক মেয়েই অল্প বয়সে বৈধব্য বরণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। বিদ্যাসাগর তো বটেই, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়েরও (১৮৩৮-১৮৯৪) বিয়ে হয়েছিল অপ্রাপ্ত বয়স্ক মেয়ের সঙ্গে। এগার বছর বয়সে পাঁচ বছর বয়সী বধূর পাণি গ্রহণ করেন বঙ্কিম এবং চৌদ্দ বছর বয়সে বিদ্যাসাগর লাভ করেন আট বছর বয়সী স্ত্রী। কুলীন ব্রাহ্মণদের বহুবিবাহের ফলেও সমাজে নানা জটিলতার সৃষ্টি হয়। অজস্র বিবাহের মাধ্যমে প্রভূত যৌতুক সংগ্রহ অনেক কুলীনের পেশা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সম্বুদ্ধ চক্রবর্তী (১৯৯৮) জানাচ্ছেন যে, অনেক কুলীনের স্ত্রী তাঁদের জীবদ্দশায় মাত্র এক কিংবা দু’বার স্বামী সঙ্গলাভের সুযোগ পেতেন। এমনটিও ঘটেছে যে এক কুলীনের চিতায় সহমরণে উঠেছেন তাঁর বহু স্ত্রী (সম্বুদ্ধ চক্রবর্তী, ৮-৯)।

কুলীন ব্রাহ্মণদের চরিত্রের এই বিশেষ দিকটি প্রকাশ করেন ইয়ং বেঙ্গলেরা ১৮৩৬ সালে প্রকাশিত তাঁদের জ্ঞানান্বেষণ পত্রিকায়। যে তালিকা তাতে ছাপানো হয় তাতে দেখা যায় বেশ কিছু কুলীন ব্রাহ্মণ ষাটাধিক বিবাহ করেছেন (সম্বুদ্ধ চক্রবর্তী, ৯২)। আমরা সে সময়কার পতিতালয়গুলোর কথা জানি। বিধবারা তো বটেই, স্বামী পরিত্যক্তা অনেক কুলীন স্ত্রীও এখানে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন। ক্রমান্বয়ে পতিতালয়গুলো হয়ে উঠেছিল বাঙালী বাবুদের এক ধরনের বৈঠকী মিলনস্থল। নীরদ চন্দ্র চৌধুরী তাঁর বাঙালী জীবনে রমণী (১৯৬৮) গ্রন্থে দেখিয়েছেন কিভাবে কলকাতায় বাড়ির গৃহবধূদের চাইতে পতিতালয়বাসী নারীদের দাম ও দাপট প্রকট হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এটি ঘটেছিল এমন একটি সময়ে যখন অন্দর মহলের বাইরে বাঙালী বধূদের তেমন কোন পদচারণা ছিল না। কলকাতার পতিতাদের মধ্যে বিখ্যাত ছিলেন বাপিয়ারী, দামড়াগোপী, ওমদা খাতুন, মুন্নুজান প্রমুখ যাঁরা প্রভাবশালী বাঙালী বাবুদের ভালোই বাঁধতে সক্ষম হয়েছিলেন তাঁদের আঁচলের খুঁটোতে। এ প্রসঙ্গে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের (১৮৭৬-১৯৩৮) বিখ্যাত উপন্যাস দেবদাস (১৯১৭)-এর কথা স্মরণ করা যেতে পারে। এই উপন্যাসে বাঙালী বাবুদের পতিতালয় গমনকে এক ধরনের স্বাভাবিকতা প্রদান করা হয়েছিল যা সে সময়কার পরিস্থিতির সঙ্গে সাযুজ্যমান। গোলাম মুরশিদ (১৯৮৪) উনিশ শতকের প্রহসনের কথা লিখেছেন যেখানে বাঙালী বাবুদের রক্ষিতা সংশ্রবের চটকদার বর্ণনা মেলে। ভবানীচরণ বন্দোপাধ্যায়ের (১৭৮৭-১৮৪৮) কলিকাতা কমলালয় (১৮২৩)-এর উদাহরণ এ প্রসঙ্গে টানা যেতে পারে। তবে প্রহসনে বর্ণিত বাঙালী বাবুদের স্ত্রীদের জীবন যে তাঁদের স্বামীদের মতো বর্ণিল ও বর্ণাঢ্য ছিল না তা বলাই বাহুল্য।

রামমোহন রায়ের হস্তক্ষেপের ফলে ১৮২৯ সালে আইনের মাধ্যমে বিধবারা চিতার আগুন থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন সত্যি, তবে স্বামীর মৃত্যুর পরে যে রুক্ষ জীবন তাঁদেরকে ধর্মীয় ও সামাজিকভাবে বরণ করতে বাধ্য করা হতো তার যন্ত্রণা চিতার আগুনের চেয়ে কোন অংশে কম ছিল না। সম্পত্তিতে বিধবাদের ছিল না অধিকার, পারিবারিক অনুষ্ঠানে তাঁরা ছিলেন অনাহূত, অপয়া বলে নিজ পরিবারের হাতেই অনেক সময় হতে হতো নিগৃহীত। বিধবাদের খাদ্যাভাসে যে কড়া পরিবর্তন আনা হতো তার উদ্দেশ্য ছিল একটিই, তা হলো তাঁদেরকে রূপ-যৌবন, সৌন্দর্য ও যৌনকামনার স্বাভাবিক প্রকাশ থেকে বঞ্চিত করা। অবৈধ গর্ভধারণের পরিণতিতে গর্ভস্খলন এমনকি আত্মহত্যায় সমাজের নীরব সম্মতি ছিল। যে সব বিধবা এমন প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে জান বাঁচানো ফরজ মনে করেছেন তাঁদের অনেকেই হয়েছিলেন পতিতালয় অভিমুখী। পতিতালয়গুলো তাঁদের অর্থ উপার্জনের ব্যবস্থা করেছিল। এমনকি বাঙালী বাবুদের হাতেও মিলেছিল কিছুটা সম্মান ও স্বীকৃতি যা হতে প্রথাগত সমাজ তাঁদের বঞ্চিত করেছিল। একটি হিসাব অনুযায়ী, ১৮৫৩ সালে কলকাতা শহরে ১২,৪১৯ জন পতিতাবৃত্তিতে নিয়োজিত ছিলেন। ১৮৬৭ সালে এই সংখ্যা তিরিশ হাজারে উন্নীত হয়। অমৃতবাজার পত্রিকার মতে এঁদের মধ্যে শতকরা ৯০ ভাগই ছিলেন বিধবা (গোলাম মুরশিদ, ১৯৮৪: ১৬-১৭)।

সমাজ ও ধর্মের এই যে অশুভ মেলবন্ধন, যার শিকার হচ্ছিলেন বাংলার মেয়েরা তা বুঝতে বিদ্যাসাগরকে বেগ পেতে হয়নি। তিনি একে আখ্যায়িত করলেন দেশাচার হিসেবে এবং ঘরে-বাইরে নারীর স্থান, গমন ও বিচরণ সীমিত করার জন্যে এই দেশাচারকেই দুষলেন তিনি। বিশেষত বালবিবাহ ও বৈধব্যের কারণে নারীর যে অসহায়ত্ব তিনি বাস্তব জীবনে প্রত্যক্ষ করেছিলেন, তা তাঁর নারী আন্দোলনের খোরাক হিসেবে কাজ করেছে বলে বিদ্যাসাগরের একাধিক জীবনীকার জানিয়েছেন (দেখুন, বিনয় ঘোষ, ১৯৭৩ ও সুবল চন্দ্র মিত্র ১৯০২, পুনর্মুদ্রণ ২০০৮)। কলকাতার সংস্কৃত কলেজের বেদান্ত পণ্ডিত শম্ভুচন্দ্ৰ বাচস্পতির বাড়িতে গিয়ে তিনি দেখতে পেয়েছিলেন, তাঁর বৃদ্ধ জরাগ্রস্ত শিক্ষক একটি কন্যা শিশুকে বিবাহপূর্বক বাড়ি এনেছেন। মেয়েটির ভবিষ্যতে যে দীর্ঘ বৈধব্যের জ্বালা রয়েছে তা বুঝতে পেরে বিদ্যাসাগর এতোটাই মর্মাহত হয়েছিলেন যে, শিক্ষাগুরুর বাড়িতে জল পর্যন্ত স্পর্শ না করে বের হয়ে এসেছিলেন। আমরা বিদ্যাসাগরের শৈশবের এক বন্ধুনীর কথা জানি যিনি অল্প বয়সে বৈধব্য বরণ করেছিলেন। যে স্বামীর সঙ্গে তাঁর সংসার করাই হলো না তার জন্যে কৈশোরে একাদশীতে উপোস দিতে দেখে বিদ্যাসাগর যার পর নাই পীড়িত হয়েছিলেন (সুবল চন্দ্র মিত্র, ২০০৮: ১৭২)।

বিধবা বিবাহ প্রচলনে বিদ্যাসাগরের এই যে আন্দোলন তার পেছনে প্রচ্ছন্ন সমর্থন যুগিয়েছিল তৎকালীন ঔপনিবেশিক বাংলার পরিবর্তনশীল আর্থ-সামাজিক অবস্থা। বহু শিক্ষিত বাঙালী যুবক ততদিনে শিক্ষালাভের উদ্দেশ্যে ও কর্মসন্ধানে শহরমুখী হতে শুরু করেছেন। এঁদের অনেককেই লেখাপড়া না জানা অল্প বয়সী মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল। স্বভাবতই স্ত্রীদের সঙ্গে তাঁদের শিক্ষায় ও মননে বিস্তর পার্থক্য ছিল। ফলে, দাম্পত্য জীবনে সৃষ্টি হতে লাগলো নানা অসুবিধা। ঔপনিবেশিক শিক্ষার সুবাদে অনেকে ইউরোপীয় বিদ্যা অর্জন করেন। ভারত ছেড়ে বিলেতে যাবারও সুযোগ পান এঁদের একাংশ। পশ্চিমা শিক্ষা ও বিলেত গমন তাঁদের পরিচয় ঘটায় এমন এক সমাজ ব্যবস্থার সঙ্গে যেখানে বালবিবাহ অচল এবং নারী অন্তঃপুরে বন্দী নন (সুমিত সরকার, ১৯৮৫, ১৯৯৭)।

ঔপনিবেশিক বাঙালী সমাজে এই যে পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছিল, ক্রমশ মানুষের নগরমুখী ও নাগরিক হওয়া, ইংরেজী শিক্ষা লাভ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিকাশ-এ সব কিছুই বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহ এবং সর্বোপরি নারী মুক্তির আন্দোলনকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যায়। অবশ্য একজন নামজাদা পণ্ডিত হিসেবে বিদ্যাসাগরের সামাজিক পরিচয়ও এক্ষেত্রে কম কাজে আসে নি। বিদ্যাসাগর শুধু সংস্কৃতের অধ্যাপকই ছিলেন না, ছিলেন সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষও। তবে তার মানে এই নয় যে, তাঁর আন্দোলনের পথ কুসুমাস্তীর্ণ ছিল। অর্থশালী জমিদার এবং সমাজের রক্ষণশীল অংশটি একযোগে বিধবা বিবাহের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছিলেন; শুরু করেছিলেন স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযান। শাস্ত্রের দোহাই দিয়ে তাঁরা প্রথাগত বাঙালী পরিবার-জীবন রক্ষাকল্পে সংকল্পবদ্ধ হলেন। এমনটি বলা হলো যে, একবার যে নারী বিধবা হয়েছেন, তাঁকে পুনর্বার বিবাহ দেওয়া হলে তিনি আবারও বিধবা হবেন। যেহেতু একজন হিন্দু নারী ইহ ও পরকালে একজন স্বামীর স্ত্রী হিসেবেই পরিগণিত, দু’বার বিবাহিত নারীর ক্ষেত্রে পরজগতে দু’স্বামীর অধিকার কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে? এমন যুক্তিও দেওয়া হলো যে, বিধবা বিবাহ চালু হলে বর্তমান স্বামীতে অনাসক্ত নারী পছন্দের পুরুষটিকে বিয়ে করার জন্যে স্বামীকে খুন করার বন্দোবস্ত করতেও পিছপা হবেন না (আনিসুজ্জামান, ২০০০:৪১)। তাছাড়া, আরও বলা হলো, “যে যে দেশে বিধবা বিবাহ চলিত আছে তথাকার স্ত্রীরা অধিকাংশ অসতী” (বিনয় ঘোষ, ১৯৭৩:৫৩৯)। বিধবার পুনর্বিবাহজাত সন্তান জারজ হিসেবে পরিগণিত হবে বলেও ফতোয়া দিলেন কেউ কেউ।

রক্ষণশীল বাঙালী যে বিধবা বিবাহের বিরুদ্ধাচরণ করলেন এর অন্তর্নিহিত একটি কারণ ছিল নারীর যৌনতার ওপরে পুরুষের কর্তৃত্ব হারানোর আশঙ্কা। “হিন্দু প্রথা ও সংস্কৃতির মধ্যেই রয়েছে নারীর তথাকথিত অদম্য যৌনতার একটি ধারণা” (শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়, ২০১১: ১৬২)। এ কারণেই, সেকালে বালবিবাহ দ্বারা নারীর যৌনতা ও প্রজনন সক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা হতো। সে সময়কার বাঙালী নারীদের স্মৃতিকথায় দাম্পত্য জীবনের নানা অভিজ্ঞতার বর্ণনা মেলে। অল্প বয়সে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে বাধ্য অনেক শিশু বধূরই সহবাস সম্পর্কিত কোন ধারণা ছিল না। স্বামীর যৌনাকাঙ্ক্ষা পূরণের লক্ষ্যে একপ্রকার নিরুপায় হয়েই নিজেদের সমর্পণ করতে বাধ্য হতেন তাঁরা। এহেন দৈহিক মিলনে নারীর যৌন তৃপ্তির ব্যাপারটি যে নিতান্ত গৌণ ছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

ঊনিশ শতকের শেষার্ধে বেশ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল ১০-১১ বছরের ফুলমণি দাসীর ৪০ বছর বয়স্ক স্বামী হরি মাইতি কর্তৃক উপর্যুপরি ধর্ষণে মৃত্যুর করুণ কাহিনী। তৎকালীন বাংলার প্রসিদ্ধ পত্রিকাগুলো এ ঘটনার নিন্দায় আশানুরূপ সরব হয় নি, বরং উল্টো হিন্দু প্রথা সংরক্ষণের ক্ষেত্রে বিবাহের গুরুত্ব সম্পর্কে লিখেছে যে, কোন বিবাহে যদি ফুলমণির মতো শিশু বধূর ‘বিসর্জন’ও ঘটে, তাতে দোষ নেই। বিষয়টি শেষ পর্যন্ত কোর্ট পর্যন্ত গড়িয়েছিল। ইংরেজ বিচারক উইলসন বৈবাহিক ধর্ষণের বিরুদ্ধে কোন আইন না থাকায় হিন্দু প্রথা ও আচার রক্ষার অজুহাত তুলে এবং ফুলমণি দাসীর পক্ষে দেওয়া সাক্ষ্য প্রমাণকে একপ্রকার অগ্রাহ্য করে আসামী হরি মাইতিকে ধর্ষণের অভিযোগ থেকে বেকসুর খালাস দিয়ে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৩৮ ধারা অনুযায়ী ‘অপরের জীবন কিংবা নিরাপত্তা বিপন্নকারী মারাত্মক জখম’ ঘটানোর দায়ে মাত্র এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করেন। বলা বাহুল্য, ফুলমণি দাসীর মৃত্যু কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। মামলা চলাকালীন সময়ে উপস্থাপিত বিভিন্ন তথ্য প্রমাণে দেখা যায়, এ রকম ঘটনা আগেও ঘটেছে, তবে পাষণ্ড স্বামী অধিকাংশ ক্ষেত্রে শাস্তিপ্রাপ্ত হয়নি (তনিকা সরকার, ২০১১)।



উনিশ শতকে শাস্ত্রের যে সকল ব্যাখ্যা সমাজে ও পণ্ডিতদের মধ্যে প্রচলিত ছিল তাতে বিধবা বিবাহ নিষিদ্ধ ছিল। বিদ্যাসাগর বুঝতে পেরেছিলেন যে, তিনি যদি বিধবা বিবাহের পক্ষে শাস্ত্রীয় সমর্থন খুঁজে পেতে সক্ষম না হন, তাহলে তাঁর সংস্কার আন্দোলনের পক্ষে জনমত গঠন অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। তিনি এটিও অনুধাবন করেছিলেন যে, বিধবা বিবাহকে নাগরিক কর্তব্য হিসেবে দেখানোর চেষ্টা না করে ‘কর্তব্য কর্ম’ তথা ধর্মীয় দায়িত্ব হিসেবে উপস্থাপন করা গেলে সুফল পাওয়া যেতে পারে। একই সঙ্গে বিদ্যাসাগর বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানটিরও একটি পুনর্চিন্তা করতে চাইলেন স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য এবং সংসারে স্ত্রীর অধিকারের ওপর জোর দিয়ে। যদিও হিন্দু বিবাহে স্বামী-স্ত্রীর সমতা তিনি দাবি করেন নি, কিন্তু পরিবারে স্বামীকে যে দেবতা হিসেবে দেখা হয় যার পদতলে স্ত্রী আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য—এ রকম একটি ধারণা থেকে তিনি অনেকটাই সরে দাঁড়ালেন। ১৮৫০ সালে প্রকাশিত “বাল্যবিবাহের দোষ” প্রবন্ধে তিনি স্বামী-স্ত্রীর বৈবাহিক সম্পর্ককে কেবল প্রজননমুখী না দেখিয়ে বিবাহকে দুটি আত্মার মিলন হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করলেন (বিদ্যাসাগর, ২০১২: ৪২১-২৪)। স্বামী-স্ত্রীর মনের ঐক্য ও প্রণয়কে প্রাধান্য দিলেন এমন একটি সামাজিক পরিবেশে যেখানে একান্নবর্তী পরিবারে বসবাসরত বহু বিবাহিত মহিলা তাঁদের স্বামীর সঙ্গে রাতের আঁধার ভিন্ন অন্য কোন সময়ে দেখা করার সুযোগ পেতেন না। এমন গল্পও প্রচলিত ছিল যে, দিনের বেলা ভুলক্রমে স্বামীর সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে অনেক স্ত্রী-ই নিজ স্বামীকে চিনতে পারেন নি। বিদ্যাসাগর আরো বললেন যে, বালবিবাহে দু’জন অপ্রাপ্তবয়স্কের মধ্যে প্রণয়ের সম্পর্ক হওয়া অসম্ভব। যেহেতু “মনের ঐক্যই প্রণয়ের মূল”, তাই বিবাহিত বালক-বালিকার প্রণয়বিযুক্ত যৌন সম্পর্ককে তিনি আখ্যায়িত করলেন “অপ্রীতিকর” বলে (৪২১- ২২)। বংশরক্ষাই যদি বিবাহের উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, বালবিবাহে সে লক্ষ্যও সঠিকভাবে অর্জিত হয় না। এ ধরনের বিবাহে বালিকা বধূকে পর্যাপ্ত মানসিক কিংবা শারীরিক প্রস্তুতি ছাড়াই মাতৃত্বের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়। ফলে সন্তান প্রায়শই ভগ্নস্বাস্থ্য হয়ে থাকে : “তাহার গর্ভবাসেই প্রায় বিপত্তি ঘটে, যদি প্রাণবিশিষ্ট হইয়া ভূমিষ্ঠ হয়, তাহাকে আর ধাত্রীর অঙ্কশয্যাশায়ী হইতে না হইয়া অনতিবিলম্বেই ভূতধাত্রীর গর্ভশায়ী হইতে হয়” (৪২২)। নববিবাহিত বালক-বালিকারা কামকৌশল আয়ত্তকরণে ব্যস্ত থাকায় তাদের বিদ্যার্জন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হবার পূর্বেই তারা সন্তানের জনক-জননী হয়ে বসে যা উক্ত দম্পতিকে “বিব্রত ও ব্যতিব্যস্ত” করে (৪২৩)। তাছাড়া ঘটকের মধ্যস্থতায় বালবিবাহ সম্পন্ন হয় বলে এ সকল বিবাহে “প্রণয়ী ভর্তাস্বরূপ এবং প্রণয়িনী গৃহপরিচারিকাস্বরূপ হইয়া সংসার যাত্রা নির্বাহ করে” (৪২২)। অর্থাৎ বালবিবাহে নারীর অবমূল্যায়নকে একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয়। সর্বোপরি অল্প বয়সে যে বৈধব্য দশা উপস্থিত হয় বালবিবাহই তার মূল কারণ। এ সকল বিবেচনায় বিদ্যাসাগর বালবিবাহকে “অতিশয় নির্দয় ও নৃশংসের কর্ম” হিসেবে দেখেছেন (৪২৪)। বাঙালী জানে যে “বিধবার জীবন কেবল দুঃখের ভার”(৪২৪)। কিন্তু যেহেতু তারা শাস্ত্র ও লোকাচার ভয়ে ভীত, বিধবাদের জন্যে যাদের কিছু করার আগ্রহ আছে, তারাও সে সৎকর্ম থেকে নিজেদের বিরত রাখে। বালবিবাহ সম্পর্কিত বিদ্যাসাগরের প্রবন্ধটি নাতিদীর্ঘ হতে পারে, কিন্তু হিন্দু মধ্যবিত্ত বাঙালী যে সংস্কার প্রসঙ্গে ভীরু ও দোদুল্যমান তা প্রবন্ধটির স্বল্প পরিসরে তিনি ঠিকই ধরতে পেরেছিলেন।

বিদ্যাসাগর “বাল্যবিবাহের দোষ” লিখেছিলেন ১৮৫০ সালে, মাত্র তিরিশ বছর বয়সে। প্রবন্ধটি শেষ করেছিলেন তিনি অকাল বৈধব্যের যন্ত্রণার ওপর আলোকপাত করে। সঙ্গত কারণেই ব্যভিচার ও ভ্রূণ হত্যার মতো বিষয়গুলো এসেছিল। ১৮৫৫ সালের জানুয়ারী মাসে প্রকাশিত হলো বিধবা বিবাহ সম্পর্কিত তাঁর প্রথম পুস্তক। এই পুস্তকে বিধবা বিবাহ প্রচলিত না থাকাতে যে নানা রকম অনিষ্ট হচ্ছিল তার বিশদ বিবরণ দিলেন। বিধবা বিবাহ প্রচলিতকরণের পক্ষে খুঁজলেন শাস্ত্রীয় সমর্থন, কারণ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, দেশাচারকে পাশ কাটাতে সক্ষম হলেও বিধবা বিবাহের পক্ষে শাস্ত্রীয় অনুমোদন তাঁর লাগবেই। সে কারণে বিধবা বিবাহ কর্তব্যকর্ম অর্থাৎ শাস্ত্রীয় দায়িত্ব কিনা তা প্রমাণে সচেষ্ট হলেন। এর পক্ষে প্রমাণও তিনি পেলেন, পরাশর সংহিতায়, যেখানে কলিযুগের বিধবাদের জন্যে তিনটি বিধি নির্দেশ করা হয়েছে; তা হলো, বিবাহ, ব্রহ্মচর্য ও সহগমন :

স্বামী অনুদ্দেশ হইলে, মরিলে, ক্লীব স্থির হইলে, সংসারধর্ম পরিত্যাগ করিলে, অথবা পতিত হইলে, স্ত্রীদিগের পুনর্বার বিবাহ করা শাস্ত্রবিহিত। যে নারী, স্বামীর মৃত্যু হইলে, ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করিয়া থাকে, সে দেহান্তে স্বর্গলাভ করে। মনুষ্যশরীরে যে সার্ধ ত্রিকোটি লোম আছে, যে নারী স্বামীর সহগমন করে, তৎসমকাল স্বর্গে বাস করে (বিদ্যাসাগর, ২০১২: ৪৩৩)।


যেহেতু সহমরণ ইংরেজ সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং ব্রহ্মচর্য পালন কলিযুগে সম্ভবপর নয়, সেহেতু বিধবার পুনর্বার বিবাহই এক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরের বিবেচনায় শাস্ত্রমতে প্রদর্শিত পথ। এসঙ্গে পরাশর সংহিতা যে কলি অর্থাৎ বর্তমান যুগের জন্যে প্রযোজ্য শাস্ত্র, তার পক্ষেও প্রমাণ হাজির করলেন তিনি। যেহেতু হিন্দু মতে বিবাহের উদ্দেশ্য পুত্র সন্তানের জন্মদান, বিধবার দ্বিতীয় বিবাহের সন্তান কি ঔরস, দত্তক, কৃত্রিম অথবা পুনর্ভব হিসেবে গণ্য হবে কি না তাও নিষ্পত্তি করে জানালেন, পুনর্বিবাহিত বিধবার সন্তান ঔরস ও বৈধ হিসেবেই পরিগণিত হবে, জারজ হিসেবে নয়। যুক্তিদানের পরবর্তী পর্যায়ে বিদ্যাসাগর স্বীকার করে নিলেন যে, বৃহন্নারদীয় ও আদিত্য পুরাণে কলিযুগে বিধবা বিবাহ নিষিদ্ধ করা হয়েছে; তবে পরাশর সংহিতা স্মৃতি হবার কারণে এর অবস্থান ও মর্যাদা পুরাণের ঊর্ধ্বে। সে কারণে, বিধবা বিবাহের ক্ষেত্রে পরাশর সংহিতার দিক নির্দেশনাই প্রযোজ্য হবে। বিদ্যাসাগরের লেখার যে অনন্য বৈশিষ্ট্য প্রখর যুক্তিবাদিতা তা তাঁর প্রস্তাবনার প্রতিটি বাক্যে বিদ্যমান। পুস্তকটি শেষ করলেন তিনি সমাজে বিধবা নারীর করুণ অবস্থার প্রতি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বিধবারা তাঁদের জীবনের বিবিধ পর্যায়ে যে পুরুষ কর্তৃকই নানাভাবে ব্যবহৃত হচ্ছেন তা জোরের সঙ্গেই বললেন তিনি। স্বামীর মৃত্যুর পরে পুনর্বার বিবাহের সুযোগ না থাকায় তাঁদেরকে অবৈধ সন্তান ধারণ, পরিণামে গর্ভস্খলন, এমনকি পতিতাবৃত্তি পর্যন্ত বেছে নিতে হচ্ছে। অথচ শাস্ত্রমতে “বিধবা বিবাহের প্রথা প্রচলিত হইলে, অসহ্য বৈধব্য যন্ত্রণা, ব্যভিচার দোষ ও ভ্রূণ হত্যাপাপের নিবারণ ও তিন কুলের কলঙ্ক নিবারণ হইতে পারে” (৪৩৭)। “বাল্যবিবাহের দোষ” প্রবন্ধের সমাপ্তিতে তিনি বাংলার বিধবাদের দুঃখ-জর্জরিত জীবনের কথা বলেছিলেন; বিধবা বিবাহের সপক্ষে রচিত প্রথম পুস্তকের অন্ত্যেও এর ব্যত্যয় হলো না।

বিধবা বিবাহের পক্ষে রচিত প্রথম পুস্তকটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৫৫ সালের জানুয়ারী মাসে। একই বছরের অক্টোবরে কলেবরে আটগুণ দীর্ঘ আরো একটি পুস্তক ছাপালেন বিদ্যাসাগর। তাঁর লেখার মাধ্যমেই আমরা জানতে পারলাম যে, প্রথম পুস্তকটি পাঠক মহলে ব্যাপক ঔৎসুক্যের সৃষ্টি করেছিল, যার কারণে মাত্র দু’এক সপ্তাহের মধ্যেই এর পাঁচ হাজার কপি নিঃশেষ হয়ে যায়। দ্বিতীয় পুস্তকের শুরুতে বিদ্যাসাগর তাঁর প্রথম পুস্তকের বিরুদ্ধে আনীত নানা ওজর আপত্তির জবাব দিলেন। তথাকথিত “প্রতিবাদী মহাশয়”দের কিছু বাগাড়ম্বরকে তিনি “অলীক অমূলক আপত্তি” হিসেবে খারিজও করলেন (৪৪০)। উপহাস ও কটূক্তির জবাব প্রদান থেকে বিরত থাকলেন। তাঁর প্রথম পুস্তকটির বিপক্ষে যে লেখাগুলো বের হয়েছিল সেগুলো সম্পর্কে বললেন যে, কোন কোন লেখক ইচ্ছাকৃতভাবে সংস্কৃত শাস্ত্রের বিকৃত অনুবাদ ও ব্যাখ্যা করেছেন। যেহেতু অনেক সাধারণ পাঠক সংস্কৃত জানেন না, তাঁরা এসব ভুল অনুবাদ ও ব্যাখ্যা দ্বারা বিভ্রান্ত হচ্ছেন। দ্বিতীয় পুস্তকে শাস্ত্র আলোচনার পাশাপাশি বিদ্যাসাগর যুক্তি-তর্ক সহযোগে বিধবা বিবাহের যৌক্তিকতা প্রমাণে সচেষ্ট হলেন। তাঁর বক্তব্যের পক্ষে হাজির করলেন নানা উদাহরণ; জানতে চাইলেন, যদি স্ত্রীর মৃত্যুতে বিরহকাতর স্বামী পুনর্বিবাহের মাধ্যমে সেই শোক কিছুটা লাঘব করতে সক্ষম হন, তাহলে স্বামীর অবর্তমানে বিধবা স্ত্রীকে কোন যুক্তিবলে পুনর্বিবাহের সুযোগ প্রদান না করে আমৃত্যু বৈধব্যের শাস্তি প্রদান করা হচ্ছে : “ঈদৃশ স্থলে বৈধব্যদশাকে দণ্ড বলিয়া বিধান করা কিরূপে সংলগ্ন হইতে পারে” (৪৬৮)।

“বাল্যবিবাহের দোষ” প্রবন্ধে আমরা দেখেছি বিদ্যাসাগর স্বামী-স্ত্রীর মনের ঐক্য ও দাম্পত্য প্রণয়ের ওপর জোর দিয়েছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয় পুস্তকে তিনি বৈবাহিক প্রণয় ও মৃত স্বামীর প্রতি স্ত্রীর কর্তব্যের ধারণা থেকে অনেকটা সরে এসে জোর দিলেন বিধবা নারীর যৌনাকাঙ্ক্ষার ওপর। তৎকালীন সমাজে এটি ছিল অবশ্যই একটি সাহসী পদক্ষেপ। বিধবাদের ব্যাপারে তিনি বললেন যে, তাঁদের অনেকেই মনোদৈহিক সমস্যায় ভোগেন এবং শিকার হন যৌন নিপীড়নের। সমাজ ও সমাজপতিদের হাতে বিধবাদের এহেন দশার ফলে অযাচিত গর্ভধারণ, গর্ভপাত ও পতিতাবৃত্তির ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। যদিও শাস্ত্রে বিধবাকে ব্রহ্মচর্য পালনের কথা বলা হয়েছে, কিন্তু এ ধরনের বিধানে বিধবা নারীর স্বাভাবিক যৌনতার ধারণাটিকে অস্বীকার করা হয়েছে। ধর্ম ও দেশাচারের সমর্থনপুষ্ট বিধবা নিপীড়নের সামাজিক কাঠামোটি এমনই প্রকট রূপ ধারণ করেছে যে, নির্যাতিত বিধবারাও এই নিপীড়নকে এক প্রকার স্বীকার করে নিয়েছেন। যুক্তি-তর্কের এই পর্যায়ে বিদ্যাসাগর তাই সরাসরি জানতে চাইলেন তাঁর বাঙালী পাঠকের কাছে: “তোমরা মনে কর, পতিবিয়োগ হইলেই, স্ত্রী জাতির শরীর পাষাণময় হইয়া যায়, দুঃখ আর দুঃখ বলিয়া বোধ হয় না; যন্ত্রণা আর যন্ত্রণা বলিয়া বোধ হয় না; দুর্জয় রিপুবর্গ এককালে নির্মূল হইয়া যায়”(৫১৫)। বিধবাদের কাছে সমাজের এই যে অনুচিত প্রত্যাশা তা সঙ্গত কারণেই তাঁরা পূরণে অপারগ। কিন্তু “ভ্রান্তিমূলক” কিছু ধারণার বশবর্তী হয়ে বিধবাদের পুনর্বিবাহ হতে বঞ্চিত করা হচ্ছে। ফলে “ভ্রূণ হত্যা পাপের প্রবল স্রোতে” দেশ নিমজ্জিত এবং এর জন্যে যে বাঙালী হিন্দুর রক্ষণশীল মনোভাবই দায়ী তা বলতে বিদ্যাসাগর ভুললেন না(৫১৪)। বাঙালীর চিন্তার জগৎ, জীবন ও সমাজকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে দেশাচার। “চিরসঞ্চিত সংস্কারে” বশীভূত বাঙালী দেশাচারের সেবাদাসে এমনই পরিণত হয়েছে যে, “শাস্ত্রও অশাস্ত্র বলিয়া গণ্য হইতেছে, অশাস্ত্রও শাস্ত্র বলিয়া মান্য হইতেছে; ধর্মও অধর্ম বলিয়া গণ্য হইতেছে, অধর্মও ধর্ম বলিয়া মান্য হইতেছে”(৫১৪)। এসব কারণে, বিধবা বিবাহের পক্ষে বিদ্যাসাগরের আনীত শাস্ত্রীয় প্রমাণ গ্রহণে বাঙালীর এতো নিদারুণ অনীহা। অথচ, দেশাচার যে একেবারেই “অপরিবর্তনীয়...ইহা কেহই প্রতিপন্ন করিতে পারিবেন না”(৫১২)। এমতাবস্থায়, বিদ্যাসাগর বাঙালী হিন্দুকে “কুসংস্কার বিসর্জন” দিয়ে এবং “দেশাচারের আনুগত্যপরিত্যাগ” করে “যথার্থ সৎপথের পথিকে” পরিণত হবার আহ্বান জানালেন(৫১৪)। উপরি-উক্ত পরিস্থিতিতে বিধবাদের অবস্থা সহজেই অনুমেয়। তবে তাঁরা প্রচলিত ধারণামতে অপয়া নন। বরং এ ধরনের মনোভাবের বিপরীতে দাঁড়িয়ে, দ্বিতীয় পুস্তকের অন্ত্যে, বিদ্যাসাগর বিধবাদের তথাকথিত অবলা রূপটিকেই ফুটিয়ে তুললেন: “হা অবলাগণ! তোমরা কি পাপে, ভারতবর্ষে আসিয়া, জন্ম গ্রহণ কর, বলিতে পারি না!”(৫১৫)। বিধবাকে ধর্ম ও সমাজ বাধ্য করেছে অবলা থাকতে। অবলা বলতে এখানে ‘বলহীন’, ‘অ-বলা’ কিংবা ‘বলতে না পারা’—এই তিনটি অবস্থাকেই বোঝানো যেতে পারে। বিধবাদের এই অবলা অস্তিত্বের নির্মাণে বিদ্যাসাগর অবশ্য তাঁদের অসহায় অবস্থাকেই উপস্থাপন করেছেন; কিন্তু তাঁদের মধ্যেই যে সুপ্ত থাকতে পারে কোন শক্তি—সেটি তাঁর দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে বলা চলে। হয়তো এটি একজন পুরুষ ও পণ্ডিত হিসেবে বিদ্যাসাগরের সীমাবদ্ধতা।

ওপরে বর্ণিত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও মানবিক আবেদনসমৃদ্ধ দ্বিতীয় পুস্তকটির উপসংহার সঙ্গত কারণেই বিখ্যাত ও বহুল মুদ্রিত, কারণ এখানে যুক্তিবাদী বিদ্যাসাগর সরে দাঁড়িয়ে জায়গা করে দিয়েছিলেন ‘করুণাসাগর’ বিদ্যাসাগরের জন্যে। বিধবা বিবাহের পক্ষে শাস্ত্রীয় প্রমাণ বের করে এনেছেন সত্যি, একে একে জবাব দিয়েছেন প্রতিপক্ষের প্রতিবাদমুখরতার, গণসংযোগ করেছেন, চেয়েছেন রাজশক্তির সহায়তা, সংগ্রহ করেছেন সহস্রাধিক স্বাক্ষর, বিধবা বিবাহের পক্ষে। কিন্তু ঐ যে বিরোধী শিবিরের নেতা রাধাকান্ত দেব বলেছিলেন বিদ্যাসাগর (১৯৫০) সেই চলচ্চিত্রে, “সমাজ একটি অচল পাঁঠা। তাকে ঠেলে নেবার শক্তি আমার নেই সামাজিক অচলায়তন ভাঙার জন্যে বিদ্যাসাগর মানবিক আবেদন রাখলেন বাঙালীর হৃদয়ের কাছে। হয়ত ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক ও লেখক ছিলেন বলেই, হিউম্যানিটিস (Humanities) তথা মানবিকতার পণ্ডিত ছিলেন বলেই হিউম্যান-হার্ট অর্থাৎ মানব-হৃদয়কে তিনি তাঁর সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ইংরেজ কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থের (১৭৭০-১৮৫০) সমসাময়িক ছিলেন বিদ্যাসাগরের পূর্বসুরী রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩)। বিদ্যাসাগর যে বছর “বাল্যবিবাহের দোষ” (১৮৫০) প্রকাশ করেছিলেন, সে বছরেই প্রয়াণ ঘটে ওয়ার্ডসওয়ার্থের। সেই যে ওয়ার্ডসওয়ার্থ বলেছিলেন তাঁর বিখ্যাত “Tintern Abbey” (১৭৯৮) কবিতায়— “Felt in the blood, and felt along the heart’ ঠিক তেমনিভাবে হিন্দু বাঙালীও যেন তার শোণিতে শোনে বিদ্যাসাগরের আহ্বান এবং হৃদয়ের অন্তঃমূলে অনুভব করে বৈধব্যের যন্ত্রণা (Greenblatt, 2012: 289)। যুক্তিশীল বিদ্যাসাগরের কলমে আক্ষেপও উঠে আসে যখন তিনি লেখেন,

যে দেশে পুরুষজাতির দয়া নাই, ধর্ম নাই, ন্যায় অন্যায় বিচার নাই, হিতাহিত বোধ নাই, সদসদ্বিবেচনা নাই, কেবল লৌকিকরক্ষাই প্রধান কর্ম ও পরম ধর্ম, আর যেন সে দেশে হতভাগা অবলাজাতি জন্ম গ্রহণ না করে (মুহম্মদ আবদুল হাই ও আনিসুজ্জামান, ১৯৬৮: ৪৫৩)।


তাঁর এই আক্ষেপে কেবল আক্ষেপ নয়, বরং আহ্বানও ছিল, বাঙালী হিন্দুর প্রতি। তারা যেন বর্জন করে কুসংস্কার এবং মুক্ত হয় দেশাচারের বন্ধন হতে :

অভ্যাসদোষে তোমাদের বুদ্ধিবৃত্তি ও ধর্মপ্রবৃত্তি সকল এরূপ কলুষিত হইয়া গিয়াছে ও অভিভূত হইয়া রহিয়াছে যে, হতভাগা বিধবাদিগের দুরবস্থা দর্শনে, তোমাদের চিরশুষ্ক নীরস হৃদয়ে কারুণ্য রসের সঞ্চার হওয়া কঠিন ... (ঐ, ১৯৬৮: ৪৫২)।


মানবাত্মার যে নিথর করুণ সঙ্গীত কান পেতে শোনার প্রয়োজনীয়তার কথা বলে গেছেন ওয়ার্ডসওয়ার্থ, তাঁর সেই “still sad music of humanity”-র ধারণাটি বিদ্যাসাগরের “হৃদয়ের কারুণ্য রসের” ধারণা থেকে খুব বেশী দূরে নয়।

তবে বাস্তব কৌশল জ্ঞানে দীক্ষিত বিদ্যাসাগর তাঁর উত্তরসূরী রবীন্দ্রনাথের মতো এও জানতেন, “সত্য যে কঠিন” (রবীন্দ্রনাথ, ২০১০: ৮৩৭)। সে কারণেই বিধবা বিবাহের পক্ষে সমাজ সংস্কার আন্দোলনে তিনি কোন খুঁত রাখতে চান নি। এসঙ্গে তিনি এও মানতেন, সেই রবীন্দ্রনাথের মতোই, “মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ” (রবীন্দ্রনাথ, ২০১৬: ৭৩১)। তাই তাঁর বিভিন্ন পুস্তকের সমাপ্তিতে তিনি আবেদন রেখেছিলেন সেই মানুষের কাছেই। বাস্তব-ভাবনা ও মানবিক আবেদন— এই দু’য়ের যুগলবন্দীত্ব তাঁর সংস্কার আন্দোলনকে বিশিষ্টতা দান করেছে।


১৮৫৬ সালে বিধবা বিবাহ আইনগতভাবে সিদ্ধ হলো। তবে ১৮৫৭ সালে সংগঠিত হলো সিপাহী বিদ্রোহ যা বদলে দিলো অনেক কিছু, বিশেষত ভারতীয়দের প্রতি ইংরেজ শাসকদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং ইংরেজদের প্রতি ভারতীয়দের অবস্থান। সিপাহী বিদ্রোহের পূর্বে ইংরেজরা অবলম্বন করেছিল এক ধরনের ‘প্রজাহিতৈষী সমাজ সংস্কারকের’ ভূমিকা (ব্রায়ান হ্যাচার,২০১২:৭)। কিন্তু সিপাহী বিদ্রোহ সমাপ্তিতে ভারতীয় সংস্কার আন্দোলনে ইংরেজদের উৎসাহে অনেকটাই ভাটা পড়ে। ভারতীয়দের ব্যক্তিগত জীবনে এবং বিশেষত স্পর্শকাতর বিষয়গুলোতে আইনগত হস্তক্ষেপে বিরত থাকা তারা শ্রেয় মনে করে; হয়ে ওঠে অতিমাত্রায় সাবধানী। সিপাহী বিদ্রোহের পরবর্তী সময়টিকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের জাগরণের কাল হিসেবেই দেখতে হবে। যে দেশাচারের বিরুদ্ধে বিদ্যাসাগরের লড়াই চলেছিল, তা সংস্কারের পরিবর্তে আঁকড়ে ধরে থাকাকেই অনেক জাতীয়তাবাদী ইংরেজদের বিরুদ্ধে আদর্শগত সংগ্রামের একটি হাতিয়ার হিসেবে দেখলেন। অবশ্য এর পেছনে ভারতীয়দের প্রতি ইংরেজদের ঋণাত্মক মনোভাবও রসদ জুগিয়েছিল। পার্থ চট্টোপাধ্যায় (১৯৯৯) জানাচ্ছেন যে, ভারতবর্ষে ইংরেজরা তাদের শাসন পাকাপোক্ত করেছিল ভারতীয়দের ধর্মীয় আচার ও প্রথার সমালোচনার মাধ্যমে। তথাকথিত ন্যায়সঙ্গত ও যৌক্তিক এক শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ভারতবাসীদের ‘সভ্যকরণের’ গুরুদায়িত্ব তারা নিয়েছে বলে প্রচারও করেছিল। ভারতীয়রা তাদের প্রথাগত জীবনাচরণের তথাকথিত অসারতা উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে এবং নতুন ধারার যে ‘সভ্য, সামাজিক ব্যবস্থা’ তাদের সামনে উপস্থাপন করা হয়েছে, তা অনেকটা হৃষ্টচিত্তে গ্রহণ করে নেবে এমনটিই ছিল ইংরেজ অভিপ্ৰায় (পার্থ চট্টোপাধ্যায়, ১১৮-৯)। এর প্রত্যুত্তরে, বিশেষত সিপাহী বিদ্রোহের পরে, ভারতীয় জাতীয়তাবাদীরা হিন্দু ধর্মের প্রাচীনত্ব, আধ্যাত্মিকতাবাদ ও বিদ্যমান আচার ব্যবস্থাকে ইংরেজ শাসনের বিদেশীয়ানার বিরুদ্ধে খাড়া করলেন। এ সময়টিতেই নারীকে দেখা হতে লাগলো ভারতীয়ত্বের প্রতীক হিসেবে। বিদ্যাসাগরের বিরুদ্ধাচরণে ব্যস্ত বঙ্কিমকে আমরা দেখলাম “কমলাকান্তের দপ্তর”-এ সতীদাহ প্রথার জয়গান গাইতে। পতঙ্গেরও রয়েছে আগুনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মাহুতি দেবার অধিকার, তাহলে হিন্দু নারীর জন্য “সহমরণ নিষেধের আইন জারি কেন?” (বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ১৯৫৪: ৫৭)। “স্ত্রীলোকের রূপ”-এ বঙ্কিম ভারতীয় পুনর্জাগরণের সঙ্গে সতীদাহের সম্পর্ক খুঁজলেন এইভাবে :

যখন আমি ভাবি যে, কিছু দিন হইল, আমাদিগের দেশীয়া অবলা অঙ্গনাগণ কোমলাঙ্গী হইয়াও এইরূপে মরিতে পারিত, তখন আমার মনে নূতন আশার সঞ্চার হয়, তখন আমার বিশ্বাস হয় যে, মহত্ত্বের বীজ আমাদিগের অন্তরেও নিহিত আছে।...হে বঙ্গ পৌরাঙ্গনাগণ— তোমরা এ বঙ্গদেশের সার রত্ন! (বঙ্কিমচন্দ্র, ১৯৫৪:৭৩)।


বিশ শতকের শুরুতে লিখিত রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত ঘরে বাইরে (১৯১৬) উপন্যাসেও আমরা দেখি স্বদেশী আন্দোলনের সন্দীপ বন্ধুপত্নী বিমলাকে এক রকম পুজোই করে বসলেন। জাতীয়তাবাদীরা যে ভারতীয় নারীদের এরকম দেবীর আসনে বসালেন তার একটি কারণ ছিল মেয়েদেরকে তাঁদের তথাকথিত গৃহলক্ষ্মীর মর্যাদা সম্পর্কে স্মরণ করিয়ে দেওয়া এবং প্রকারান্তরে গার্হস্থ্য জীবন অর্থাৎ অন্দর মহলকে গৌরবান্বিত করে ভারতীয়ত্বের প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করা।

ঊনিশ শতকের শেষার্ধে ১৮৭৩ সালে প্রকাশ পেলো বিদ্যাসাগরের বহুবিবাহ রোধকল্পে লিখিত দুটি প্রস্তাবনা। “যদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত বহুবিবাহকাণ্ড যে শাস্ত্রবহির্ভূত ও সাধুবিগর্হিত ব্যবহার” তা তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন (বিদ্যাসাগর, ২০১২: ৫৬২)। সেই সঙ্গে উদ্ঘাটন করলেন কুলীন ব্রাহ্মণদের “পাষণ্ড ও পাতকী” চরিত্র (৫৩২)। পঞ্চাশ থেকে আশি বার পর্যন্ত বিবাহকারী কুলীনদের নাম ও বাসস্থানের তালিকাও প্রকাশ করলেন তাঁর প্রস্তাবনায়। লিখলেন,

এ দেশের ভগ্নকুলীনদের মত পাষণ্ড ও পাতকী ভূমণ্ডলে নাই। তাঁহারা দয়া, ধৰ্ম্ম, চক্ষুলজ্জা ও লোকলজ্জায় একেবারে বর্জিত। তাঁহাদের চরিত্র অতি বিচিত্র।...কোনও অতিপ্রধান ভগ্নকুলীনকে কেহ জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, ঠাকুরদাদা মহাশয়! আপনি অনেক বিবাহ করিয়াছেন, সকল স্থানে যাওয়া হয় কি? তিনি অম্লান মুখে উত্তর করিলেন, যেখানে ভিজিট পাই, সেইখানে যাই। গত দুর্ভিক্ষের সময়, একজন ভগ্নকুলীন অনেকগুলি বিবাহ করেন। তিনি লোকের নিকট আস্ফালন করিয়াছিলেন, এই দুর্ভিক্ষে কত লোক অন্নাভাবে মারা পড়িয়াছে, কিন্তু আমি কিছুই টের পাই নাই; বিবাহ করিয়া স্বচ্ছন্দে দিনপাত করিয়াছি (বিদ্যাসাগর, ২০১২: ৫৩২-৩)।


ইতিপূর্বে ১৮৫৫ ও ১৮৬৬ সালে পরপর দু’বার বিদ্যাসাগর আবেদনপত্র পাঠিয়েছিলেন ভারতীয় ব্যবস্থাপক সভার কাছে, বহুবিবাহ নিবারণকল্পে। কিন্তু ১৮৭৩ সালে, সিপাহী বিদ্রোহের পরবর্তী পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে, তেমন জনসমর্থন তাঁর ভাগ্যে জুটলো না। এমনকি মিললো না রাজশক্তির সমর্থন। ‘বহুবিবাহ শাস্ত্রসম্মত নয়’— বিদ্যাসাগরের এমন সিদ্ধান্ত মানতে এক রকম নারাজ বঙ্কিম লিখলেন, “আমাদিগের বিবেচনায় বহুবিবাহ নিবারণের জন্য আইনের প্রয়োজন নাই।” (বঙ্কিমচন্দ্র, ১৯৫৪: ৩১৮)। কারণ, “সুশিক্ষার ফলে উহা অবশ্য লুপ্ত হইবে” (৩১৮)। বঙ্কিমের বিদ্যাসাগর বিরোধিতা প্রসঙ্গে এক্ষেত্রে বদরুদ্দীন উমরের (১৯৭৪, পুনর্মুদ্রণ ২০১৬) বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য:

সংস্কার আন্দোলনের ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরের যেমন বিশেষ কতকগুলি কৌশল ছিল (যেমন সংস্কার শাস্ত্র-সম্মত প্রমাণ করা) তেমনি সংস্কার আন্দোলন বিরোধিতার ক্ষেত্রে বঙ্কিমচন্দ্রেরও কতকগুলি কৌশল ছিল। তার মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য হলো, সংস্কারের প্রয়োজনীয়তাকে স্বীকার করে নিয়ে তার সপক্ষে জোরালোভাবে আলোচনা করা এবং ঠিক তার পরবর্তী পর্যায়েই অন্যান্য কতকগুলি প্রসঙ্গের অবতারণার দ্বারা সেই সংস্কার যে অর্থহীন তা প্রমাণ করে বাস্তব ক্ষেত্রে তার বিরোধিতা করা (বদরুদ্দীন উমর, ২০১৬: ৭২)।


যে কারণে বঙ্কিম বহুবিবাহকে “অনিষ্টকারক, সকলের বর্জ্জনীয়, এবং স্বাভাবিক নীতিবিরুদ্ধ” স্বীকার করে নিয়েও বিদ্যাসাগরের প্রস্তাবের লিখিত বিরোধিতা করেছিলেন (বঙ্কিমচন্দ্র, ৩১৪)। আর বিদ্যাসাগর যে বহুবিবাহের বিপক্ষে শাস্ত্রীয় প্রমাণ হাজির করেছিলেন তারও কোন প্রয়োজন ছিল না বলে মত দিলেন বঙ্কিম। কারণ, “প্রজার হিতার্থে” ইংরেজ যদি মনে করে “আইনের আবশ্যকতা আছে”, তাহলে তারা জোর করেই তা প্রণয়ন করবে, “ধর্ম্মশাস্ত্রের মুখ চাহিবার আবশ্যক”তা বোধ করবে না (৩১৯)। প্রবন্ধ-সমাপ্তিতে ব্যঙ্গচ্ছলে “বিদ্যাসাগর মহাশয়ের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা” করতেও ভুললেন না ‘সাহিত্য সম্রাট’ (৩১৯)।


বিদ্যাসাগর নারী মুক্তির যে আন্দোলন করেছিলেন তাতে নিরঙ্কুশ সফলতা এসেছিল এমন বলা যাবে না। “বাল্যবিবাহের দোষ” লিখেছিলেন ১৮৫০ সালে, তরুণ বয়সে। নিজ মেয়েদের বালবিবাহ দেন নি। অথচ পরবর্তীতে বালবিবাহ রদ করার ক্ষেত্রে তাঁকে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করতে দেখা যায় বলে অভিযোগ করেছেন স্বপন বসু (১৯৯১)। বিধবা বিবাহের ক্ষেত্রে ১৮৫৬ সালে ইংরেজ সরকার কর্তৃক আইন প্রণয়নে তিনি সফল হয়েছিলেন এবং নিজের একমাত্র পুত্রের বিবাহও দিয়েছিলেন এক বিধবার সঙ্গে। পরবর্তী দশ বছরে গাঁটের পয়সা খরচ করে প্রায় ষাটটি বিধবা বিবাহ তিনি দিয়েছিলেন, হয়েছিলেন আর্থিকভাবে সর্বস্বান্ত, কিন্তু বিধবা বিবাহকে সর্বজনস্বীকৃত প্রথায় রূপান্তরিত করতে পারেন নি। ১৮২৯ সালে রামমোহনের উদ্যোগে সতীদাহ প্রথা আইন করে রদ করা গিয়েছিল। বিধবা বিবাহও আইনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে স্বীকৃতি পেলো, কিন্তু সে রকমভাবে প্রচলন করা গেল না। একটি হিসাব বলছে, ১৮৫৬ থেকে ১৯১১— এই সময়ে অনুষ্ঠিত বিধবা বিবাহের সংখ্যা পাঁচশ’র বেশী নয় (স্বপন বসু, ২৭৩)। আসলে বিধবা বিবাহের প্রসঙ্গটি সংস্কারগত হওয়ায় “সম্মতিমূলক আইন করেও ব্যাপক কোন পরিবর্তন আনা যায়নি, সমাজমনও তাকে স্বীকার করে নেয়নি” (২৭৩)। “একটি প্রথা নিবারণ করা যত সহজ, একটি প্রথা শুধু মাত্র আইনের জোরে প্রবর্তন ও চালু করা মোটেই তত সহজ নয়” (বদরুদ্দীন উমর, ২০১৬:৩২)। বিধবা বিবাহ সম্পর্কিত বিদ্যাসাগরের দু’টি পুস্তক সম্পর্কেও সমালোচনা হয়েছে। তাঁর লেখায় বিধবা নারীর অসহায় অবস্থার প্রতি প্রকাশিত করুণাকে “male guilt” তথা ‘পুরুষ হয়ে জন্মানোর অনুশোচনা’ বলে আখ্যায়িত করেছেন সুমিত সরকার (২০১১: ১৯২)। সে সঙ্গে বিদ্যাসাগরকে তিনি তাত্ত্বিক জটিলতায় আবদ্ধ একজন সংস্কারক হিসেবে দেখেছেন; অভিযোগ করেছেন, যে সব বিধবা বিয়ে করতে চাইলেন না, বিধবাই থাকতে চাইলেন, তাঁদের জন্য বিদ্যাসাগর কিছু করেন নি। বিদ্যাসাগরের ব্যক্তিগত জীবনের প্রসঙ্গ টেনে বলেছেন, ঊনিশ শতকে অনেক স্ত্রীই তাঁদের স্বামীর উদ্যোগে পড়ালেখা শিখেছিলেন, কিন্তু বিদ্যাসাগরের স্ত্রী দিনময়ী দেবী সারা জীবন নিরক্ষরই থেকে গেছেন, জীবন কাটিয়েছেন বীরসিংহে শ্বশুর শাশুড়ির সেবায়। বিদ্যাসাগরের নিজ কন্যা যখন বৈধব্য বরণ করে পিতৃগৃহে প্রত্যাবর্তন করলেন, বিদ্যাসাগর মেয়ের বৈধব্যজনিত কৃচ্ছ্রতা সাধন নিজেও বেছে নিলেন, অবশ্য কিছুদিনের জন্যে। কিন্তু কন্যাকে তিনি ধর্মীয় ও সামাজিক প্রথা বিসর্জন দিতে বলেছেন বলে শোনা যায় না (সুমিত সরকার, ২০০-২০১)। শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়ও (২০১১) বলেছেন, বিদ্যাসাগরের লেখায় একজন সংস্কৃত পণ্ডিতের বক্তব্যই প্রাধান্য পেয়েছে। যে নারীদের নিয়ে পুস্তক দু’টি লিখিত হয়েছিল তাঁদের কণ্ঠস্বর চাপা পড়েছে বিদ্যাসাগরের শুষ্ক শাস্ত্র আলোচনায়। বিধবাদের পুনর্বিবাহ আয়োজনের মাধ্যমে তাঁদের দেহ ও যৌনাকাঙ্ক্ষার ওপর পুনরায় প্রাতিষ্ঠানিক ও পিতৃতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা হলো যাতে করে তাঁরা অবৈধ গর্ভধারণের শিকার হয়ে পুরো পরিবারকে একটি লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে ঠেলে দিতে না পারেন। অর্থাৎ সংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে প্রকারান্তরে বিদ্যাসাগর সমাজে নারীর প্রান্তিক অবস্থানকেই এক রকম মেনে নিয়েছিলেন।

বদরুদ্দীন উমর (২০১৬) বিদ্যাসাগরের শ্রেণীচরিত্র এবং তাঁর প্রতি ইংরেজদের আশীর্বাদপুষ্টতা নির্দেশ করতে গিয়ে বলেছেন, বিদ্যাসাগরের সামগ্রিক মূল্যায়নে তাঁর শ্রেণীগত সীমাবদ্ধতা উল্লেখ না করার উপায় নেই। তৎকালীন বাংলায় বাঙালী মধ্যবিত্তের একটি অংশ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সামন্ততান্ত্রিক সুফল ভোগ করেছিল প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে। বঙ্কিম রক্ষণশীল বাঙালীর এ ধারাটির প্রতিভূ। মধ্যবিত্ত বাঙালীর অপর অংশটি নির্ভরশীল ছিলেন ইংরেজ প্রদত্ত চাকুরীর ওপর। অর্থাৎ রুটি-রুজি ও আনুকূল্যের জন্য তাঁরা অনেকাংশেই ছিলেন ইংরেজের দারস্থ। এই অংশটি বিশেষত ইউরোপীয় চিন্তা-ভাবনার প্রভাবে প্রগতিশীল ছিলেন কিন্তু ব্যাপকভাবে ইংরেজদের বিরুদ্ধাচরণ করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। কি কাজে, কি লেখায় তাঁরা বেছে নিয়েছিলেন এক ধরনের সমঝোতার নীতি। বদরুদ্দীন উমরের মতে, বিদ্যাসাগর এঁদেরই প্রতিনিধি। সে জন্যে বিদ্যাসাগরের লেখায় মেলে না সিপাহী বিদ্রোহের পক্ষে কোন বক্তব্য কিংবা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কারণে নিঃস্ব ও জর্জরিত কৃষকের দুর্দশার চিত্র। তাঁর বিধবা বিবাহ আন্দোলনও সমাজের ওপর তলার বিধবাকেন্দ্রিক। এর বাইরে তাঁর দৃষ্টি যায়নি। এমনকি মুসলমান নারীরাও ছিলেন তাঁর সংস্কার প্রচেষ্টার বাইরে যেটি বঙ্কিম কটাক্ষচ্ছলে নির্দেশ করেছেন তাঁর “বহুবিবাহ”প্রবন্ধে :

আর একটি কথা এই যে, এ দেশে অর্দ্ধেক হিন্দু, অর্দ্ধেক মুসলমান। যদি বহুবিবাহ নিবারণ জন্য আইন হওয়া উচিত হয়, তবে হিন্দু মুসলমান উভয় সম্বন্ধেই সে আইন হওয়া উচিত। হিন্দুর পক্ষে বহুবিবাহ মন্দ, মুসলমানের পক্ষে ভাল, এমত নহে (বঙ্কিমচন্দ্ৰ, ১৯৫৪: ৩১৮)।


অবশ্য, বদরুদ্দীন উমরই আবার অন্যত্র বলেছেন যে, বিদ্যাসাগরের আন্দোলন বিধবা বিবাহ প্রচলনের ক্ষেত্রে তেমন কোন উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করতে না পারলেও,

একদিকে নারী মুক্তির প্রশ্নকে তা সামাজিক চিন্তার অন্যতম প্রধান বিষয়বস্তু হিসেবে সামনে নিয়ে আসে এবং অন্যদিকে তা হিন্দু সমাজের কতকগুলি শক্তিশালী সংস্কার ও আচারের ভিত্তিমূলে আঘাত করে সেই সমাজের মধ্যে আবার কতকগুলি তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে (বদরুদ্দীন উমর, ২০১৬: ৭১)।


বিদ্যাসাগরের সংস্কার আন্দোলনকে এ কারণেই ঊনিশ শতকের বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি অত্যন্ত গুরুত্ববাহী ঘটনা হিসেবে দেখেছেন বদরুদ্দীন উমর।

বিদ্যাসাগরের সার্বিক মূল্যায়ন প্রসঙ্গে শ্রেণীর প্রশ্ন তুলেছেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীও (২০১৭)। বিপিন বিহারী গুপ্তের পুরাতন প্রসঙ্গ (১৯৬৬)-এর প্রসঙ্গ টেনে চৌধুরী লিখেছেন, ঊনিশ শতকে “বিদ্যাসাগরের প্রতিপত্তির বিশেষ কারণ ছিল দু’টি; একটি তাঁর প্রতি সেকালের ‘সমস্ত বড়লোকদের’ আনুগত্য এবং অপরটি সাহেবদের সঙ্গে তাঁর ওঠাবসা” (৫২)। সার্বিক বিচারে যদিও বিদ্যাসাগরকে “অসামান্য” বলেছেন চৌধুরী, কিন্তু দেখেছেন “তাঁর শ্রেণীরই মানুষ” হিসেবে (৫২)। প্রশ্ন করেছেন, “গ্রামে যখন গেছেন বিদ্যাসাগর তখন কার কাছে গেছেন, কত দূর গেছেন?” (৫২)। নিজেই এর উত্তর দিয়েছেন, “যেতেন তিনি পিতৃগৃহে। কোন কৃষকের দরজায় পদধূলি পড়বার কথা নয় এই ব্রাহ্মণের, যিনি হাঁটতে ভালোবাসতেন” (৫২)। চৌধুরীর মতে বিদ্যাসাগরে জীবনের অন্যতম ট্র্যাজেডি হলো, “বর্ষার রাতে দামোদর সাঁতরালেও সাঁতরাতে পারেন, কিন্তু শ্রেণী বিন্যাসের নিষ্ঠুর নদী পার হওয়া সম্ভব ছিল না; এই ক্ষণজন্মা পুরুষের পক্ষেও নয়। করুণার সাগর পরাভূত হন সামাজিক সাগরের কাছে” (৫২)। তবে বদরুদ্দীন উমরের মতো সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী মানতে বাধ্য হয়েছেন যে, “বিদ্যাসাগরের বৃহৎ হৃদয়” ঠিকই স্পন্দিত হয়েছিল বিধবা বিবাহের পক্ষে এবং বালবিবাহের বিপক্ষে: “বিদ্যাসাগরের মধ্যে প্রাচীন সন্তের মণীষা ও জ্ঞানের সঙ্গে এসে মিশেছিল বাঙালী মায়ের আঁকুপাঁকু হৃদয়” (৫৩)। বিশেষত, “মধুসূদনের কাছে তিনি ছিলেন শ্রেষ্ঠতম বাঙালী” (৫৩)।


বিদ্যাসাগরের শেষ জীবনে বাঙালী আবদ্ধ হয়ে পড়লো নানা টানা-পোড়েনের গণ্ডিতে। একদিকে ছিল ইংরেজদের ভারতীয় ধর্ম ও আচার-অনুষ্ঠানকে খাটো করে দেখার প্রয়াস, অন্যদিকে এর প্রত্যুত্তরে ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের নারীর তথাকথিত দেবীত্বকে মহিমান্বিত করার প্রচেষ্টা। এ সময়টিতে বাঙালীর কাছে ধর্ম ও লোকাচার সংস্কারের চাইতে তা আঁকড়ে ধরে থাকাই মুখ্য হয়ে দাঁড়ালো। এসব কারণে বিদ্যাসাগরের নেওয়া পদক্ষেপগুলো সমাজে ব্যাপক পরিবর্তন সাধন করতে পারলো না। বাঙালী পুরুষের হাতে নারীর কিছুটা মুক্তি এলো বটে,তবে তা ছিল গৃহাভ্যন্তরে, এক ধরনের ‘বন্ধুসুলভ দাম্পত্যে’ (সুমিত সরকার, ১৯৯৭: ২২৯)। নারীর স্বাধীনতার প্রশ্নটি আলোচিত হলো, তবে নারী মুক্তি বন্দী রইলো বিবাহ ও গার্হস্থ্যের ঘেরাটোপের মাঝখানে। যে বছর বিদ্যাসাগর মৃত্যুবরণ করলেন সেই ১৮৯১ সালে বাঙালী পুরুষেরা দ্বিধাবিভক্ত হলেন স্বামী কর্তৃক ধর্ষিত বালিকা ফুলমণি দাসীর মৃত্যুর কারণগুলোকে সমর্থন করবেন নাকি সমালোচনা করবেন, এই প্রশ্নে। বলাই বাহুল্য, নারী প্রশ্ন প্রসঙ্গে তাঁদের রক্ষণশীল মানসিকতারই প্রকাশ ঘটেছিল এই দোদুল্যমানতায়। শেষ জীবনে বিদ্যাসাগর স্বয়ং আপসকামী হয়ে উঠেছিলেন এমনটিও বলেছেন কেউ কেউ, বিশেষত সহবাস সম্মতি আইনে তাঁর বিরোধিতার প্রসঙ্গ টেনে। আসলে এই আইনের বিরুদ্ধাচরণ করেছিলেন বিদ্যাসাগর কেবল শাস্ত্রীয় বিবেচনায়। আইনে দ্বাদশ বর্ষীয় স্ত্রীর সঙ্গে সহবাস সিদ্ধ করার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু বিদ্যাসাগর বললেন যে, অনেক বালিকা তার আগেই রজঃস্বলা হয়, এবং প্রথম রক্তদর্শনে তারা গর্ভবতী না হলে শাস্ত্রমতে তাদের পিতা-মাতা ও ভ্রাতা মহা পাপী হবেন। তবে বিদ্যাসাগরের লিখিত বিরোধিতা সত্ত্বেও তাঁর মৃত্যুর মাত্র ক’মাস আগে আইনটি পাশ করেছিল ইংরেজ সরকার। বিধবা বিবাহ প্রচলন করে বিদ্যাসাগর যে ‘ভুল’ করেছিলেন তা অনুধাবনে সমর্থ হয়েই এই আইনের বিরোধিতা করেছিলেন বলে রটনা করলেন তাঁর বিরুদ্ধ শিবিরের লোকেরা। বিদ্যাসাগরের এই ব্যর্থ বিরোধিতা সমগ্র হিন্দু সমাজকে সুখী করেছিল বলে অ দিয়েছিলেন তাঁর প্রথম দিককার জীবনীকার বিহারীলাল সরকার (১৮৯৫)।

বিদ্যাসাগরের জীবদ্দশায় যে সকল সমালোচনার মুখে তাঁকে পড়তে হয়েছিল তা বিশেষত বাঙালী মধ্যবিত্তের একটি প্রবণতারই দিক নির্দেশক। তা হলো, বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনকে বাঙালী মধ্যবিত্ত সমর্থন করে বটে, তবে প্রয়োজনে পিছপা হতেও দ্বিধা করে না। বঙ্কিমসহ অনেকেই যে বিদ্যাসাগরকে সমর্থন জোগাতে ব্যর্থ হলেন তার পেছনে বাঙালী মধ্যবিত্তের এই দোদুল্যমানতা অনেকাংশে দায়ী। সে জন্যেই আমরা দেখলাম, প্রগতি ও রক্ষণশীলতার দোলাচলে আবদ্ধ বাঙালী মধ্যবিত্ত বিদ্যাসাগরের প্রচেষ্টাসমূহকে পূর্ণ রূপ দেওয়ার পথে বারবার বাধা হয়ে দাঁড়ালেন। বিদ্যাসাগরের সংস্কার আন্দোলনের হাত ধরে জেনানায় আবদ্ধ বাঙালী নারীর জীবনে কিছু পরিবর্তন অবশ্য সাধিত হয়েছিল, তবে বৃহত্তর পৃথিবীতে তাঁদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়নি (মন্ময় জাফর, ২০১৪)। ১৮৫৬ সালে পাশকৃত বিধবা বিবাহ আইনের সুযোগ নিয়ে বিধবারা যে ব্যাপক সংখ্যায় বিবাহ করার সুযোগ পেয়েছিলেন এমনটি বলা যাবে না। বিদ্যাসাগর স্বয়ং ষাটটি বিবাহের আয়োজন করেছিলেন এবং প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তাঁর সমর্থক ও শুভানুধ্যায়ীরা চাঁদা না দেওয়ায় এক প্রকার সর্বস্বান্ত হয়েছিলেন। বাধ্য হয়েছিলেন ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে : “আমাদের দেশের লোক এতো অসার ও অপদার্থ বলিয়া পূৰ্ব্বে জানিলে, আমি কখনোই বিধবাবিবাহ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করিতাম না” (বিনয় ঘোষ, ১৯৭৩: ৪৩৩)।

উনিশ শতকের শেষ পর্যন্ত শ’পাঁচেক বিধবা বিবাহ সংঘটিত হয়েছিল বলে পরিসংখ্যানসূত্রে জানা যায়। তবে সংখ্যাতাত্ত্বিক সাফল্যই বিদ্যাসাগরের সংস্কার আন্দোলনের একমাত্র মাপকাঠি হতে পারে কিনা তা পুনর্বিবেচনা করার সময় এসেছে। পরিসংখ্যানের প্রশ্ন তুলে অনেকে বিদ্যাসাগরের উদ্যোগে প্রণীত বিধবা বিবাহ আইনটিকে উনিশ শতকের পটভূমিতে একটি dead letter তথা নিষ্ফল কানুন বলেও ঘোষণা দিয়েছেন। তবে সমালোচকেরা এক্ষেত্রে এই বিষয়টি উপেক্ষা করেছেন যে, বিদ্যাসাগরের আন্দোলন বাঙালীর চিন্তার জগতে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল এবং ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিল সনাতনী হিন্দুত্বের; তৈরী করেছিল প্রথাকে প্রশ্ন করার এবং প্রয়োজনে বিসর্জন দেওয়ার মানসিকতা। বিদ্যাসাগরের উদাহরণ দ্বারা অনেকেই অনুপ্রাণিত হয়েছেন, যুক্ত হয়েছেন সমাজ সংস্কার আন্দোলনে। বিদ্যাসাগরের অবদান কিংবা আন্দোলনের সাফল্য তাই কেবল এর সংখ্যাতাত্ত্বিকতাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না।

বিদ্যাসাগরকে বুঝতে হলে তিনি যে আইন প্রণয়নে বিশ্বাসী ছিলেন এবং এর জন্যে প্রয়োজনে রাজশক্তির সহায়তা কামনায় তাঁর যে আপত্তি ছিল না, সেটিও মাথায় রাখতে হবে। বহুবিবাহ রোধকরণের ক্ষেত্রেও তিনি আইনী নিষেধাজ্ঞা চেয়েছিলেন। লিখেছিলেন, “অধুনা এদেশের যেরূপ অবস্থা ঘটিয়াছে, তাহাতে রাজ্যশাসন ব্যতিরেকে, ঈদৃশ দেশব্যাপক দোষ নিবারণের উপায়ান্তর নাই” (আনিসুজ্জামান, ২০০০)। এখানেই বঙ্কিমের সঙ্গে বিদ্যাসাগরের পার্থক্য। বিদ্যাসাগরের সার্বিক মূল্যায়নের ক্ষেত্রে বঙ্কিমের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘ বিরোধের বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। বঙ্কিম ও বিদ্যাসাগর দু’জনেই কাজ করেছিলেন ইংরেজ শাসকদের সঙ্গে। বঙ্কিম ছিলেন সরকারী কর্মকর্তা এবং বিদ্যাসাগর ছিলেন সরকার কর্তৃক নিয়োগকৃত সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ ও অধ্যাপক। সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগর চেয়েছেন রাজশক্তির সমর্থন ও হস্তক্ষেপ। অন্যদিকে বঙ্কিম ভারতীয় প্রথার জয়গান গেয়েছেন, বিদ্রূপ করে বিদ্যাসাগরকে মূর্খ ডেকেছেন। সংস্কারের প্রশ্নে তাঁর অবস্থান ছিল রক্ষণশীল। বঙ্কিম যদি সংস্কার চেয়েও থাকেন, তবে সে পরিবর্তন ভেতর থেকে আসুক, আইনগতভাবে নয়—এমনটিই ছিল তাঁর অবস্থান। দেশাচারের প্রশ্নেও দু’জনের অভিমত দু’মেরুর। বিদ্যাসাগর যেখানে দেশাচারকে তাঁর সংস্কার প্রচেষ্টার মুখে একটি জগদ্দল পাথর হিসেবে দেখেছেন, বঙ্কিম সেখানে অনেকটাই ছিলেন দেশাচারের হেফাজতকারী। বিধবা বিবাহের পক্ষে কিংবা বহুবিবাহের বিপক্ষে শাস্ত্র প্রমাণের প্রয়োজনীয়তা নেই বলে লিখেছেন বঙ্কিম। কিন্তু বিধবা বিবাহ যে শাস্ত্রসিদ্ধ এবং “যদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত” বহুবিবাহ যে শাস্ত্রবিরুদ্ধ তা শাস্ত্র ঘেঁটে তথ্য-উপাত্ত হাজিরপূর্বক প্রমাণ করা অতীব জরুরী ছিল (বিদ্যাসাগর, ২০১২: ৫৬২)। সংস্কৃত পণ্ডিত আরো অনেকেই ছিলেন, কিন্তু বিধবা বিবাহের স্বার্থে এবং বহুবিবাহ রোধকল্পে বিদ্যাসাগর যে কাজটি করে গেলেন, তা কিন্তু তাঁরা নিজ দায়িত্বে করেন নি। বিদ্যাসাগরের সাফল্য এখানেই যে, শাস্ত্র দিয়ে তিনি সমাজপতিদের ঘায়েল করতে পেরেছিলেন।

কেউ কেউ বিদ্যাসাগরকে ইংরেজদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের একজন দোসর হিসেবে গাল-মন্দ করেছেন। প্রকৃতার্থে বিদ্যাসাগর ছিলেন একজন কুশলী বাস্তববাদী। ইংরেজদের বাদ দিয়ে তাঁর সংস্কার প্রচেষ্টাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া কিংবা আইন প্রণয়ন করা যে সম্ভব ছিল না তা তিনি ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন; কারণ, রাজ্য শাসনের দায়িত্বে ছিল ওই ইংরেজরাই। ইংরেজদের সঙ্গে তাঁর যতটুকু সমঝোতা, তা কৌশলগত কারণেই। এই একই বিদ্যাসাগরকে আমরা দেখি বিধবা বিবাহের পক্ষে সমর্থন আদায়ের জন্যে বাঙালীর বিবেকের কাছে আবেদন রাখতে। কিন্তু তাঁর বাস্তবমুখী মন ঠিকই বুঝতে পেরেছিল যে, শুনতে হলে বাঙালী ওই ইংরেজ শাসকের কথাই শুনবে। এসব কারণেই বিদ্যাসাগরের জীবনীকার ব্রায়ান হ্যাচার (২০১২) তাঁকে ইংরেজ শাসক এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে একজন মধ্যস্থতাকারী হিসেবে দেখেছেন। বিশেষত, বিধবা বিবাহ সম্পর্কিত তাঁর দু’টি পুস্তককে অভিহিত করেছেন আধুনিক ভারতের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী অর্জন হিসেবে। ইউরোপীয় ও সংস্কৃত এই দুই বৌদ্ধিক ঐতিহ্যের মিলনও দেখেছেন তিনি বিদ্যাসাগরের মধ্যে। বিনয় ঘোষ (১৯৭৩) বিদ্যাসাগরকে উপস্থাপন করেছেন একজন বিদ্বান পণ্ডিত ও উদ্‌যোগী সমাজকর্মীর মিশেল হিসেবে। আর রবীন্দ্রনাথ তাঁর মধ্যে খুঁজে পেয়েছেন সমাজের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ একজন বুদ্ধিজীবীকে। নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সমাজের সঙ্গেই সম্পর্কযুক্ত থাকতে চেয়েছেন বিদ্যাসাগর, যদিও শেষ জীবনে তাঁর সমাজ-সঙ্গীরাই তাঁকে এক রকম বাধ্য করেছিলেন কলকাতার গুঞ্জনমুখর জীবন ত্যাগ করে কর্মাটাঁড়ে সাঁওতাল সান্নিধ্য বেছে নিতে।

বিদ্যাসাগরের বিশিষ্টতা এখানে যে, ধর্মাক্রান্ত, দেশাচারপ্রবণ ও যৌনশুচিগ্রস্ত বাঙালীদের মধ্যে তিনি ছিলেন যথার্থই একজন মুক্ত চিন্তার মানুষ : আধুনিক, ইহজাগতিক এবং খুব সম্ভবত নাস্তিক। নানা শঙ্কায় কাতর ও অজুহাতপ্রবণ বাঙালী যে সকল স্থানে যেতে পিছপা হয়েছে, বিদ্যাসাগর সেখানে উপস্থিত হয়েছেন সদর্পে। বিদ্যাসাগরের এই যে চারিত্রিক দৃঢ়তা তাঁকে রবীন্দ্রনাথ আখ্যায়িত করেছেন অজেয় পৌরুষ হিসেবে। (অবশ্য একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে চারিত্রিক দৃঢ়তা যে কেবল পুরুষেরই একান্ত বৈশিষ্ট্য তা আমরা মানতে নারাজ।) তবে শেষ জীবনে বিদ্যাসাগর সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে ভগ্নস্বাস্থ্য হন। তিনি অবসাদগ্রস্ত ছিলেন এবং স্বজাতির হাতে প্রতারিতও বোধ করেছিলেন, এমনটি ধারণা করলে অত্যুক্তি হবে না। তাঁর কলকাতা ছেড়ে সাঁওতাল পল্লীতে গমন তেমনটিরই ইঙ্গিতবাহী। বাঙালীর হাতে বিদ্যাসাগরের এই দুরবস্থাকে ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখেন নি তরুণ রবীন্দ্রনাথ। বিদ্যাসাগর প্রয়াণে কলকাতার এমারেল্ড থিয়েটারে পঠিত প্রবন্ধে বিদ্যাসাগর ভিন্ন অন্য কোন বাঙালীকে মানুষ হিসেবে গ্রহণ করতে অপারগতা জানিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেন,

মাঝে মাঝে বিধাতার নিয়মের এরূপ আশ্চর্য ব্যতিক্রম হয় কেন, বিশ্বকর্মা যেখানে চার কোটি বাঙালী নির্মাণ করিতেছিলেন সেখানে হঠাৎ দুই-একজন মানুষ গড়িয়া বসেন কেন, তাহা বলা কঠিন (রবীন্দ্রনাথ, ১৯৯১:৬৭)।


বাঙালী চরিত্রের দোদুল্যমানতা যে বিদ্যাসাগরকে বিশেষভাবে পীড়িত করেছিল তার উল্লেখপূর্বক রবীন্দ্রনাথ বলেন,

আমরা আরম্ভ করি, শেষ করি না; আড়ম্বর করি, কাজ করি না; যাহা অনুষ্ঠান করি তাহা বিশ্বাস করি না; যাহা বিশ্বাস করি তাহা পালন করি না; ভূরিপরিমাণ বাক্য রচনা করিতে পারি, তিলপরিমাণ আত্মত্যাগ করিতে পারি না; আমরা অহংকার দেখাইয়া পরিতৃপ্ত থাকি, যোগ্যতালাভের চেষ্টা করি না (রবীন্দ্রনাথ, ১৯৯১: ৮২)।


বাঙালী যে বিদ্যাসাগরকে ভুগিয়েছে তার আরো প্রমাণ মেলে যখন বাংলাদেশে এই সমাজ সংস্কারকের জন্মকে কাকের বাসায় কোকিলের ডিম পাড়ার সঙ্গে তুলনা করেন রবীন্দ্রনাথ। বলেন, প্রথাবিরোধী এই ক্ষণজন্মা মানুষটিকে বোঝার কিংবা ধারণ করার মতো যোগ্যতাসম্পন্ন কোন বাঙালীকেই খুঁজে পাওয়া ভার : “সেই জন্য বিদ্যাসাগর এই বঙ্গদেশে একক ছিলেন। এখানে যেন তাঁহার স্বজাতি সোদর কেহ ছিল না” (৮২)।

রবীন্দ্রনাথের এই বহুল উল্লেখিত ভাষণে দ্বিধাবিভক্ত বাঙালীকুলের মধ্যে বিদ্যাসাগরকে এক ট্র্যাজিক মহানায়ক হিসেবেই উপস্থাপন করা হয়েছে, যিনি “উপকার করিয়া কৃতঘ্নতা পাইয়াছেন, কার্যকালে সহায়তা প্রাপ্ত হন নাই” (৮২)। বাঙালী সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের মূল্যায়ন নির্দয় হয়ে ওঠে যখন তিনি বলেন, “এই দুর্বল, ক্ষুদ্র, হৃদয়হীন, কর্মহীন, দাম্ভিক, তার্কিক জাতির প্রতি বিদ্যাসাগরের এক সুগভীর ধিক্কার ছিল। কারণ তিনি সর্ববিষয়েই ইহাদের বিপরীত ছিলেন” (৮২)। “সমযোগ্য সহযোগীর” অভাবে বিদ্যাসাগরকে বাঙালীর সংসর্গ পরিত্যাগ করে বেছে নিতে হয়েছিল সাঁওতালপল্লীতে “আমৃত্যুকাল নির্বাসন” (৮২)। সার্বিক বিচারে “সুখী ছিলেন না” এই মহান পুরুষ (৮২)। রবীন্দ্রনাথের এই মূল্যায়নের প্রায় একশ’ বছর পরে আহমদ শরীফও লিখেছেন যে, বিদ্যাসাগর “বাঙালীর উদ্যমহীনতায়, উদ্যোগবিমুখতায়, চারিত্রিক দুর্বলতায় ও মানসিক অসারতায়” শেষ জীবনে ক্ষুব্ধ ছিলেন (আহমদ শরীফ, ২০০০:৬০)। তবে কর্মাটাঁড়ে তাঁর বহুল আলোচিত অবসর গ্রহণকে আহমদ শরীফ “দ্রোহী বিদ্যাসাগরের অসহযোগী শহর ও সমাজ বর্জন” হিসেবে দেখেছেন, “পরাজয় বা পলায়ন” হিসেবে নয় (৬০)।

উপসংহার,


উনিশ শতকে বিধবা বিবাহ সিদ্ধ করতে বেগ পেতে হয়েছিল বিদ্যাসাগরকে। লড়তে হয়েছিল শাস্ত্র ও দেশাচারের বিরুদ্ধে। উল্লেখযোগ্য সমর্থন লাভ করেছিলেন সত্যি, কিন্তু গালমন্দও কপালে কম জোটেনি। বাস্তব জীবনে বিদ্যাসাগর অর্ধ-শতাধিক বিধবা বিবাহ দিতে সক্ষম হয়েছিলেন এমন একটি সামাজিক বাস্তবতায় যখন তাঁর সমসাময়িক বঙ্কিম তাঁর উপন্যাসে পর্যন্ত বিধবা বিবাহ দেন নি। একই কথা খাটে অনুজপ্রতিম রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্রের বেলায়। কিন্তু তাতে কি? বিদ্যাসাগরকে ঠিকই মূর্খ প্রতিপন্ন করে ছেড়েছিলেন বঙ্কিম তাঁর বিষবৃক্ষ (১৮৭৩) উপন্যাসে; বলিয়েছিলেন সূর্যমুখীর মুখ দিয়ে,

আর একটি হাসির কথা। ঈশ্বর বিদ্যাসাগর নামে কলিকাতায় কে না কি বড় পণ্ডিত আছেন, তিনি আবার একখানি বিধবা বিবাহের বহি বাহির করিয়াছেন। যে বিধবার বিবাহের ব্যবস্থা দেয়, সে যদি পণ্ডিত হয়, তবে মূর্খ কে? (বঙ্কিমচন্দ্র ১৯৫৩: ২৭৯)।


বলাই বাহুল্য, বাঙালী জীবনে সমাজ বরাবরই ব্যক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছে এবং এক্ষেত্রে সহায়তা করেছে ধর্ম। দুই-এ মিলে তৈরী হয়েছে তথাকথিত দেশাচার। বিদ্যাসাগরের লেখা পাঠে এটি স্পষ্ট হয়েছে যে, দেশাচারকেই তিনি তাঁর সমাজ সংস্কার আন্দোলনের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হিসেবে দেখেছিলেন। শাস্ত্রবিরুদ্ধ দেশাচার যে পালনীয় নয়, তা অধর্ম, কাজে ও কর্মে বিদ্যাসাগর তার প্রমাণ রেখেছেন বহুবার। বিদ্যাসাগর ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন যে, দেশাচার জগদ্দল পাথরের মতো বাঙালী হিন্দুর ঘাড়ের ওপর চেপে বসে আছে, সে বাঙালী সাধারণ কেউ হোক বা বঙ্কিমের মতো অ-সাধারণ কেউ হোক। দেশাচার বিধবাদের পুনর্বিবাহের পথে নিদারুণ বাধা, তাই শাস্ত্রেই বিধবা বিবাহের পক্ষে ব্যবস্থাপত্র খুঁজেছিলেন বিদ্যাসাগর। শত বিপত্তি সত্ত্বেও তিনি আর দশজনের মতো নিজেকে কখনো দেশাচারের সেবাদাস মনে করেন নি, দেখেছেন মুক্তচিন্তার একজন মানুষ হিসেবে। জীবনব্যাপী ব্যাপক কর্মযজ্ঞের মধ্যে বিধবা বিবাহকেই তিনি তাঁর জীবনের মহত্তম কর্ম হিসেবে চিহ্নিত করেছেন :

বিধবা-বিবাহ প্রবর্তন আমার জীবনের সর্বপ্রধান সৎকর্ম।...এ বিষয়ের জন্য সৰ্ব্বস্বান্ত হইয়াছি এবং আবশ্যক হইলে প্রাণান্ত স্বীকারেও পরান্মুখ নহি।...আমি দেশাচারের নিতান্ত দাস নহি; নিজের বা সমাজের মঙ্গলের নিমিত্ত যাহা উচিত বা আবশ্যক বোধ হইবে, তাহা করিব (রমেশচন্দ্র মজুমদার, ১৯৯১: ১০৯)।


বিদ্যাসাগরের লেখাতে আমরা যে কেবল একজন একগুঁয়ে ও কুশলী সমাজ সংস্কারকের দেখা পেয়েছি তা-ই নয়, বরঞ্চ দেখা মিলেছে বাঙালী জাতির উদ্যোগহীনতার এক কড়া সমালোচকের। বাঙালী যে সংস্কার প্রশ্নে ভীরু ও আধমরা; বাঙালীর যে সাহসের অভাব আছে; ‘পাছে লোকে কিছু বলে’ এ সংশয়ে তার সঙ্কল্প যে সদা টলে; বাঙালীকে যে ঘা মেরেই জাগাতে ও বাঁচাতে হবে, তা রবীন্দ্রনাথের আগে বিদ্যাসাগরই ভালো বুঝতে পেরেছিলেন। এ কথা সত্যি যে, কলকাতার বিদ্বৎসমাজে বিদ্যাসাগরের প্রতিষ্ঠা অধিকাংশ সময় তাঁর সামাজিক আন্দোলনের পক্ষে এসেছিল, যদিও তাঁর বিরোধী শিবিরের সদস্য সংখ্যা কম ছিল না। আজকে যারা বলেন, যে সব বিধবা বিয়ে করতে চান নি, তাঁদের জন্য বিদ্যাসাগর কিছু করেন নি, তাঁরা ভুলতে বসেন যে, বিদ্যাসাগর আইনগত সংস্কার চেয়েছিলেন, কিন্তু স্বামী ও সমাজ পরিত্যক্ত নারীদের জন্য রোকেয়ার মত তারিণীভবন নির্মাণ তাঁর সংস্কার প্রচেষ্টার অন্তর্গত ছিল না। যাঁরা বিদ্যাসাগরকে ইংরেজের দোসর জ্ঞান করেন, তাঁরাও ভুলে যান যে, ইংরেজ শাসকদের সঙ্গে মতান্তরের পরিপ্রেক্ষিতে মাত্র ৩৮ বছর বয়সে সরকারী চাকুরী হতে ইস্তফা দিয়ে এক অনিশ্চিত অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ বেছে নেবার সাহস বিদ্যাসাগরই দেখিয়েছিলেন। ইংরেজদের সঙ্গে ইতিপূর্বে তাঁর যে সমঝোতা হয়েছিল, তা কৌশলগত কারণেই। সদা কুশলী ছিলেন বলেই তিনি তাঁর বিধবা বিবাহ বিষয়ক পুস্তিকা দু’টিরও সর্বাধিক প্রচার চেয়েছিলেন, প্রকাশ করেছিলেন স্বকৃত ইংরেজী অনুবাদ, সংক্ষিপ্ত কলেবরে হলেও। এভাবে “বুদ্ধির ব্যবহারিক প্রয়োগের আদর্শকেই” তাঁর সমস্ত কাজের মধ্য দিয়ে অনুসরণ করার চেষ্টা করে গেছেন বিদ্যাসাগর (আলী আনোয়ার, ১৯৭০, পুনর্মুদ্রণ ২০১১: ২১০)।

একুশ শতকে দাঁড়িয়ে আজ আমরা কিভাবে বিদ্যাসাগরের মূল্যায়ন করবো? জন্মভূমি ভারতে একদিকে যেমন তাঁর পুজো করা হচ্ছে, অন্যদিকে ভাঙা হচ্ছে তাঁর মূর্তি। বোঝা যায়, রবীন্দ্রনাথের কবিতার মতই তাঁর সংস্কার-প্রচেষ্টা “হয় নাই (সে) সর্বত্রগামী” (রবীন্দ্রনাথ, ২০১০: ৮২৫)। একুশ শতকের সমকামী সম্পর্ক কিংবা বিবাহের পক্ষে-বিপক্ষে নানা মতামত ও ধর্মশাস্ত্র আরোপিত নিষেধাজ্ঞা কেন জানি বিদ্যাসাগরের সময়কার বিধবা বিবাহ সম্পর্কিত তর্কাতর্কির কথাই স্মরণ করায়। ভারতসহ যে সকল দেশে সমকামী সম্পর্ককে, এমনকি বিবাহকে আইনগত স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, সে সব দেশে এর পক্ষে যে ব্যাপক জনসমর্থন গড়ে উঠেছিল, তা বলা যাবে না। অথচ মানবাধিকার কর্মী ও সংস্থাগুলোর যুক্তি মেনে নিয়ে সে সব দেশের উচ্চ আদালত ও সরকার সমকামী সম্পর্ককে স্বীকৃতি দিয়েছেন এই বিবেচনায় যে, দু’জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের সম্মতিসূচক সম্পর্কের ব্যাপারে ধর্মশাস্ত্রের আপত্তি থাকতে পারে, কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্রের নয়। এই নয়া আইনের সুযোগ নিয়ে কতজন সমকামী সম্পর্কে জড়ালেন বা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেন, সেই পরিসংখ্যানটি এখানে কম গুরুত্বপূর্ণ। আইন থাকাটি জরুরী ছিল সমকামী সম্পর্ককে বৈধতা প্রদানের লক্ষ্যে, সংখ্যাতাত্ত্বিক বিবেচনার কারণে নয়। যারা বিদ্যাসাগরকৃত আইনের সাফল্য বিচার করেন ঊনিশ শতকে কত সংখ্যক বিধবা বিয়ে করতে সমর্থ হয়েছিলেন সেই সংখ্যা গুণে, তাঁদেরকে আহ্বান জানাই একুশ শতকের সমকামী সম্পর্ক সিদ্ধকরণ আইনটি বিবেচনা করতে। প্রথা, আচার ও ধর্মের নিগড় হতে মুক্তির জন্যে যে একটি ধর্মনিরপেক্ষ আইনের প্রয়োজনীয়তা ছিল তা বিদ্যাসাগর যেমন অনুভব করেছিলেন ঊনিশ শতকে, একুশ শতকের ভারতসহ নানা দেশের মানবাধিকার কর্মী ও উদারপন্থী সরকারও তা-ই অনুভব করেছেন। সে জন্যে আমরা দেখেছি প্রখ্যাত ভারতীয় লেখক বিক্রম শেঠের উদ্যোগে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন, বুকার পুরস্কারপ্রাপ্ত ঔপন্যাসিক অরুন্ধতী রায়সহ একশ’র অধিক বিশিষ্ট ভারতীয় নাগরিককে সমকামী সম্পর্ক সিদ্ধকরণের সপক্ষে একযোগে কলম ধরতে, লিখতে একটি খোলা চিঠি যা ছাপা হয়েছিল বিশ্বের তাবৎ গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকায়। বিদ্যাসাগর কিংবা বিক্রম শেঠের এ জাতীয় উদ্যোগসমূহের মূলে ছিল মানুষের মুক্তির একটি সর্বজনীন ধারণা, তা সে মানুষটি বিধবাই হন, কিংবা সমপ্রেমী নারী বা পুরুষই হন। একুশ শতকের ভারত এ ভাবে নিজের অজান্তেই উনিশ শতকের বিদ্যাসাগরের মানব মুক্তির চেতনার কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে। বিদ্যাসাগর আর অপ্রাসঙ্গিক থাকতে পারেন নি, হয়ে উঠেছেন সমসাময়িক।

সার্বিক বিচারে, বিশেষত বাঙালী কুলে, বিদ্যাসাগর অনন্য। কারণ ধর্মীয় বিধিনিষেধ এবং সামাজিক ও ব্যক্তিগত দোলাচলে আবদ্ধ বাঙালীকে তিনিই শিখিয়েছেন সামাজিক আন্দোলনের সহজ পাঠ। তিনি যা বিশ্বাস করেছেন, তা-ই করেছেন। কথাটি শুনতে সহজ মনে হতে পারে, কিন্তু বাস্তবে তা সহজ ছিল না মোটেই। সুনির্ধারিত সমাজ সংস্কার আন্দোলনে বিদ্যাসাগর মেধা, বুদ্ধি, মানবিকতা; সময়, প্রতিষ্ঠা, এমনকি স্বীয় পুস্তকের বিক্রয়লব্ধ অর্থ—সবই নিয়োগ করেছিলেন, প্রতিদানের আশা না করেই। বর্তমান জমানার পুঁজিবাদ আক্রান্ত, বিচ্ছিন্নতাবাদী ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক সমাজে এমন উদাহরণ বিরল। এই প্রবন্ধ সমাপ্তিতে, বিদ্যাসাগরের মতোই দ্রোহী, নাস্তিক ও ধর্মীয় মৌলবাদের সামনে নির্ভীক শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত আহমদ শরীফের দারস্থ হতে চাই বিদ্যাসাগর সম্পর্কে তাঁর তেজিয়ান মূল্যায়নের জন্যে :

সেই যে বাঙলা গদ্যরীতির ‘জনক’ বলে তাঁর খ্যাতি আছে, সেই জনকত্বেই তাঁর স্থিতি। তিনি নতুন চেতনার জনক, সংস্কারমুক্তির জনক, জীবনজিজ্ঞাসার জনক, বিদ্রোহের জনক, শিক্ষা ও সংস্কারের জনক, সংগ্রামীর জনক। জনকত্বই তাঁর কৃতি ও কীর্তি। সমকালীন বাঙলায় সব নতুনেরই জনক ছিলেন তিনি। তিনিই ছিলেন ঈশ্বর (আহমদ শরীফ, ২০০২:১৭)।



* এই প্রবন্ধটি জীবন-বিনষ্টকারী স্ট্রোকে আক্রান্ত আমার চলৎশক্তিরহিত ও দেহবন্দী জননী শাহেদা খানম চৌধুরীর প্রতি উৎসর্গীকৃত।


গ্রন্থপঞ্জী



১. আনিসুজ্জামান, ২০০০, বাঙালী নারী : সাহিত্যে ও সমাজে, সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা

২. আনোয়ার আলী, ১৯৭০ (পুনর্মুদ্রণ ২০১১), “বিদ্যাসাগর ও ব্যক্তির সীমানা”, বিদ্যাসাগর: সার্ধশতবর্ষ স্মারক গ্রন্থ, সম্পা. গোলাম মুরশিদ, শোভা প্রকাশ, ঢাকা, পৃ. ২০২-১৬

৩. আহমদ শরীফ, ২০০০, “বিদ্যাসাগর: দ্রোহ ও মানবতাবাদ”, বাংলাদেশে বিদ্যাসাগর চর্চা, সম্পা. প্রথমা রায় মণ্ডল, বিশ্বকোষ পরিষদ, কলকাতা, পৃ. ৪৭-৬৯

৪. ঐ, ২০০২, “বিদ্যাসাগর সোসাইটির ৫ম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী ও বিদ্যাসাগরের ১৮২তম জন্ম-উৎসব উপলক্ষে প্রদর্শনী ও সেমিনার”-এর ক্রোড়পত্র, সম্পা. মোহাম্মদ আবদুল হাই। বিদ্যাসাগর সোসাইটি, ঢাকা, পৃ. ১৭

৫. ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, ২০১২, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর রচনাসমগ্র, সম্পা. তপন রুদ্র, সালমা বুক ডিপো,ঢাকা

৬. গোলাম মুরশিদ, ১৯৮৪, সমাজ সংস্কার আন্দোলন ও বাংলা নাটক : ১৮৫৪-১৮৭৬, বাংলা একাডেমী, ঢাকা

৭. নীরদ চন্দ্র চৌধুরী, ১৯৬৮, বাঙালী জীবনে রমণী, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স, কলকাতা

৮. ঐ, ১৯৯৭, নির্বাচিত প্রবন্ধ, সম্পা. ধ্রুব নারায়ণ চৌধুরী, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড,কলকাতা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ১৯৫৩ (১৩৬০), বঙ্কিম রচনাবলী (প্রথম খণ্ড), সাহিত্য সংসদ, কলিকাতা ঐ, ১৯৫৪ (১৩৬১), বঙ্কিম রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড), সাহিত্য সংসদ, কলকাতা

৯. বদরুদ্দীন উমর, ১৯৭৪ (পুনর্মুদ্রণ ২০১৬), ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও উনিশ শতকের বাঙালী সমাজ, সুবর্ণ, ঢাকা

১০. বিনয় ঘোষ, ১৯৭৩, বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ, ওরিয়েন্ট লংম্যান, কলকাতা

১১. বিপিন বিহারী গুপ্ত, ১৯৬৬, পুরাতন প্রসঙ্গ, বিদ্যাভারতী, কলকাতা

১২. বিহারীলাল সরকার, ১৮৯৫ (পুনর্মুদ্রণ ১৯৮৬), বিদ্যাসাগর : ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জীবনী, সম্পা

১৩. প্রহ্লাদ কুমার প্রামাণিক। ওরিয়েন্ট বুক কো., কলকাতা

১৪. ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৮২৩ (১৩৪৩)। কলিকাতা কমলালয়, রঞ্জন পাবলিশিং হাউস, কলকাতা

১৫. মুহম্মদ আবদুল হাই ও আনিসুজ্জামান, ১৯৬৮, বিদ্যাসাগর রচনাসংগ্রহ, স্টুডেন্ট ওয়েজ, ঢাকা

১৬. রমেশচন্দ্র মজুমদার, ১৯৯১, “সংস্কৃত পণ্ডিত ও বাংলার নবজাগরণ”, প্রসঙ্গ: বিদ্যাসাগর, সম্পা, বিমান বসু, বঙ্গীয় সাক্ষরতা প্রসার কমিটি, কলকাতা

১৭. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ১৯৯০ (১৩৯৭), “ঘরে বাইরে”, রবীন্দ্র উপন্যাস সংগ্রহ, বিশ্বভারতী, কলকাতা ঐ, ১৯৯১, “বিদ্যাসাগর চরিত”, প্রসঙ্গ: বিদ্যাসাগর, সম্পা, বিমান বসু, বঙ্গীয় সাক্ষরতা প্রসার কমিটি, কলকাতা

১৮. ঐ, ২০১০ (১৪১৬), “ঐকতান”, সঞ্চয়িতা, বিশ্বভারতী, কলকাতা

১৯. ঐ, ২০১০ (১৪১৬), “রূপ-নারানের কূলে”, সঞ্চয়িতা, বিশ্বভারতী, কলকাতা

২০. ঐ, ২০১৬, “সভ্যতার সংকট”, রবীন্দ্র-রচনাবলি (ঊনত্রিংশ খণ্ড), ঐতিহ্য, ঢাকা

২১. সম্বুদ্ধ চক্রবর্তী, ১৯৯৮, অন্তরে অন্দরে : উনিশ শতকে বাঙালী ভদ্রমহিলা, ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ঢাকা

২২. স্বপন বসু, ১৯৯১, “সামাজিক আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে বিদ্যাসাগর”, প্রসঙ্গ: বিদ্যাসাগর, সম্পা. বিমান বসু, বঙ্গীয় সাক্ষরতা প্রসার কমিটি, কলকাতা

২৩. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ২০১৭, বাংলা সাহিত্য ও বাঙালী মধ্যবিত্ত, সংহতি, ঢাকা

২৪. Brian Hatcher (tr.), 2012. Hindu Widow Marriage. Columbia University Press, New York

২৫. Manmay Zafar, 2014. “Social reform in colonial Bengal: Revisiting Vidyasagar”. Philosophy and Progress. Vols. LV-LVI, Jan-June, July-Dec., pp. 109-24, University of Dhaka, Dhaka

২৬. Partha Chatterjee, 1999. The Partha Chatterjee Omnibus, Oxford University Press, New Delhi

২৭. Saratchandra Chattopadhayay, 1917 (rpt. 2002). Devdas, Penguin, New Delhi

২৮. Sekhar Bandyopadhyay, 2011. “Caste, widow-remarriage, and the reform of pop- ular culture in colonial Bengal”, in Sumit Sarkar & Tanika Sarkar (ed.) Women and Social Reform in Modern India: Vol. 1. Permanent Black, New Delhi

২৯. Stephen Greenblatt, (eds.). 2012. The Norton Anthology of English Literature: The Romantic Period, vol. D. W. W. Norton & Company, New York & London

৩০. Subal Chandra Mitra, 1902 (rpt. 2008). Isvar Chandra Vidyasagar : Story of His Life and Work, Parul Prakashani, Kolkata

৩১. Sumit Sarkar, 1985. A Critique of Colonial India, Papyrus, Calcutta

৩২. Ibid., 1997. Writing Social History. Oxford University Press, New Delhi

৩৩. Ibid., 2011. “Vidyasagar and Brahmanical society”, in Sumit Sarkar & Tanika Sarkar (ed.) Women and Social Reform in Modern India: Vol. 1. Permanent Black, New Delhi

৩৪. Tanika Sarkar, 2011. “Conjugality and Hindu nationalism: Resisting colonial reason and the death of a child-wife”, in Sumit Sarkar & Tanika Sarkar (ed.) Women and Social Reform in Modern India: vol. 1. Permanent Black, New Delhi



নতুন দিগন্ত অক্টোবর-ডিসেম্বর ২০২০ সংখ্যায় প্রকাশিত। (৮২-১০৬ পৃষ্ঠা)

কোন মন্তব্য নেই

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

vidyasagar.info ©