বিদ্যাসাগরের জন্ম, শিক্ষা ও অবস্থান, সবই ছিল একটি সামন্তবাদী পরিবেশে। ইংরেজের বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক উপস্থিতি ও ইংরেজী শিক্ষার প্রচলন সমাজে এক ধরনের চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল। একটি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীও গড়ে উঠছিল। এই বিকাশের উজ্জ্বল প্রতিনিধিদের মধ্যে একজন ছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত, সমাজের সামন্তবাদী সঙ্কীর্ণতার বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত বিদ্রোহ ঘোষণা করে তিনি খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী হয়ে গিয়েছিলেন, চেয়েছিলেন ইংরেজী ভাষাতে সাহিত্য রচনা করে আন্তর্জাতিক যশ অর্জন করবেন। কিন্তু অত্যন্ত মেধাবান ও সাহিত্যসৃষ্টির অতিউচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ছিলেন যেহেতু তাই তিনি ফিরে এসেছেন মাতৃভাষার কাছে। বিদ্যাসাগরের ব্যাপারটা কিন্তু সম্পূর্ণ উল্টো। তিনি মাতৃভাষার চর্চা বর্জনের কথা কখনোই ভাবেন নি। ওদিকে রামমোহন যে বিলেত গেলেন এবং সেখানেই সমাধিস্থ হলেন, বিদ্যাসাগরের পক্ষে তেমন কাজও সম্ভব ছিল না। তিনি মাতৃভাষা ও মাতৃভূমিতে গভীর ভাবে প্রোথিত ছিলেন। স্তম্ভের মতো নয়, বৃক্ষের মতো।
—সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
(নতুন দিগন্ত-সম্পাদকীয়)
বিদ্যাসাগরের জন্ম আজ থেকে ঠিক দু’ শ’ বছর আগে, ১৮২০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বরে, তিনি অতিশয় কাতর ছিলেন চতুষ্পার্শ্বে নারী
নির্যাতন দেখে। বিদ্যাসাগর জানতেন বিধবারা কেমন দুর্বিষহ জীবন যাপন করে। সে জন্য তিনি বিধবাদের বিবাহদানকে বৈধ করার জন্য
রাতদিন পরিশ্রম করেছেন। মেয়েদের বিধবা হবার পেছনে বিশেষ দু’টি কারণ ছিল। বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ। বয়স্ক স্বামীর সঙ্গে অতি
অল্পবয়সের যে মেয়েটিকে জুড়ে দেওয়া হতো, তার স্বামী মারা যেত মেয়েটির মৃত্যুর অনেক আগে। আর কুলীন সমাজে বহুবিবাহ তো কিছু
ব্রাহ্মণের পেশাই ছিল, তাঁরা ঘুরে ঘুরে স্ত্রীদের বাড়িতে অতিথি হতেন; কতজন স্ত্রী, কী তাদের ঠিকানা এসব মনে রাখাও কঠিন
হতো, সে জন্য খাতায় লিখে রাখতেন এবং তালিকা দেখে দেখে স্ত্রীদের খোঁজে বের হতেন। কুলীন ঘরের মেয়েদের পক্ষে কুলীন বর
পাওয়া কঠিন ছিল; বাজারে তাই কুলীন পুরুষদের প্রচুর চাহিদা ও নীরব প্রতাপ বিদ্যমান থাকতো। বিদ্যাসাগর বিধবাবিবাহকে
আইনসম্মত করাতে পেরেছিলেন, চেষ্টা করেছিলেন বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ নিবারণের জন্য আইনী ব্যবস্থা চালু করবেন। পারেন নি
পর্যাপ্ত সামাজিক সমর্থন জোগাড় করা সম্ভব হয় নি। আর বিধবাবিবাহও যে খুব জনপ্রিয় হয়েছিল তাও নয়। তাঁর একমাত্র পুত্র একজন
বালিকাবিধবাকে বিয়ে করায় বিদ্যাসাগর সন্তুষ্ট হয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর সে সন্তোষ দীর্ঘস্থায়ী হয় নি, কারণ তাঁর পুত্র
নানাবিধ অন্যায় আচরণ করেছে যার জন্য বিদ্যাসাগর পুত্রকে কার্যত ত্যাজ্যই করে দিয়েছিলেন।
মেয়েদের জীবনে দুঃখ ও অনিশ্চয়তা দেখে মাতৃহৃদয়সম্পন্ন বিদ্যাসাগর অত্যন্ত কাতর থাকতেন। এক বন্ধুর শিশুকন্যা প্রভাবতী’র অকাল মৃত্যুতে শোকে বেদনাপুত বিদ্যাসাগর একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। ছোট্ট, কিন্তু অসাধারণ। ‘প্রভাবতীসম্ভাষণ’ নামের ওই প্রবন্ধটি সম্ভবত বাংলা সাহিত্যে প্রথম শোকগাথা। তাতে প্রভাবতী’র মৃত্যুতে অশ্রুসম্বরণের চেষ্টা করতে গিয়ে নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে বিদ্যাসাগর লিখেছেন, প্রভাবতী তুমি যে চলে গেলে একদিক দিয়ে সেটা ভালোই হলো; বেঁচে থাকলে ‘ভাগ্যদোষে’ তুমি হয়তো “অসৎপাত্রের হস্তগত ও অসৎপরিবারের কবলে পতিত হয়ে দুঃখসন্তাপে কালাতিপাত করিতে।” বঙ্গদেশে নারী হয়ে জন্মগ্রহণেই ছিল মস্ত একটি ভাগ্যদোষ।
বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানের ভেতরে নির্যাতন চলতো। অবাধে। প্রতিষ্ঠানটি ছিল সামাজিক ভাবে স্বীকৃত এবং আইনের চোখে সিদ্ধ। কিন্তু এখন? এখন তো ঘরে বাইরে পথে ঘাটে নারীধর্ষণ চলছে। অনেক ক্ষেত্রে বিবাহ নামের প্রতিষ্ঠানটাই ভেঙে গেছে, বা টিকে থাকলেও অবস্থাটা তার ভীষণ নড়বড়ে। নৃত্যকলার শিক্ষক তার শিক্ষার্থীদের পাচার করে, পাড়ার বেকার যুবক গৃহবধূকে ঘরে ঢুকে ধর্ষণ করে; ইউনিয়ন কাউন্সিলর মেম্বার টাকা খেয়ে ধর্ষককে ছেড়ে দেয়, ধর্ষিতা নারীর পক্ষে সম্ভ্রম বাঁচানোর একটিই উপায় থাকে, আত্মহত্যা। বিদ্যাসাগরের কাল এখন আর নেই। আমরা এখন আরো অনেক এগিয়েছি, কিন্তু মেয়েদের নিরাপত্তা তিল পরিমাণ বাড়ে নি। বরং অনেক কমেছে। উন্নতির মাসুল অনেককেই দিতে হচ্ছে। মেয়েরা দিচ্ছে। আর বিশেষ ভাবেই দিচ্ছে মেহনতীরা, যাদের শ্রমে এই উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে ও হচ্ছে, কিন্তু যারা উন্নতির সৌধের কোথাও আশ্রয় পায় নি। আশেপাশেও নয়। মাসুল গুণতে হচ্ছে শিশুদেরও। কেন এমন ঘটল? উন্নতি কেন কেড়ে নিল অধিকাংশ মানুষের নিরাপত্তা? কারণ তো ওই একই। এই উন্নতি পুঁজিবাদী, এর স্বভাবই হচ্ছে অধিকাংশের শোষণ-বঞ্চনার ওপর অল্পসংখ্যকের আরাম-আয়েশ বৃদ্ধি করা। পরোয়া করে না মানুষ মরলো কি বাঁচলো।
বিদ্যাসাগরের কাজের দিকে আরো একটু তাকানো যাক। তাকানোটা দরকারও। ওই কাজ আমাদের ঐতিহ্যের অন্তর্গত। বিধবা-বিবাহ বৈধকরণ তাঁর একটা বড় কাজ। আর একটা কাজ বাংলাগদ্যকে শিল্পসৌন্দর্যসম্পন্ন করা। কাজ দু’টো আসলে অভিন্ন। কারণ দু’টোই সামাজিক। মেয়েদের দুঃখ নিরসন করে যেমন, বাংলা গদ্যের আড়ষ্টতা ঘুঁচানোর মধ্য দিয়েও তেমনি সমাজে তিনি চলমানতা আনতে চেয়েছেন। ভাষা সামাজিক সম্পত্তি। ভাষার মুক্তি সমাজের মুক্তি না ঘটলে সম্ভব নয়। আবার ভাষার মুক্তি সমাজের মুক্তিতে সহায়তাও দেয়। বিদ্যাসাগর সমাজের মুক্তি ও ভাষার মুক্তিকে একত্র করে দেখেছেন, অনেকেই সেভাবে দেখতে পান না। ভাষাকে যদি বেগবান ও সমৃদ্ধ করা যায় তবে সমাজ-প্রগতিতে তা সহায়ক হবে এটা মনে করেই তিনি মাতৃভাষার চর্চা করেছিলেন। এটা খুবই স্পষ্ট যে সামাজিক প্রয়োজনের বোধ থেকেই তিনি সাহিত্যিক হয়েছেন, সাহিত্যের প্রয়োজনে সমাজাশ্রয়ী হন নি। বিদ্যাসাগরকে সমাজ-সংস্কারক বলা হয়। সে-উপাধি কিন্তু তাঁর জন্য পর্যাপ্ত নয়। তিনি সমাজে সংস্কার আনাটাকে যথেষ্ট মনে করেন নি, চেয়েছিলেন সমাজ-রূপান্তর। তাঁকে বরঞ্চ সামাজিক বিপ্লবের অগ্রপথিক বলাটা সঙ্গত। বিদ্যাসাগরকে রামমোহনের উত্তরসূরী হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়ে থাকে; সেটাও কিন্তু ষোলআনা সঠিক নয়। রামমোহন রায় সামাজিক কাজ অনেক করেছেন, কিন্তু সেই সঙ্গে ধর্মসংস্কারেও তিনি উদ্যোগী ছিলেন। সনাতন ধর্মকে পৌত্তলিকতামুক্ত করতে চেয়েছেন। ব্রাহ্মধর্মের প্রবর্তনে তাঁর ভূমিকাই ছিল সর্বাগ্রগণ্য। বিদ্যাসাগর কিন্তু ছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্নপথের পথিক। তিনি ছিলেন পুরোপুরি ইহজাগতিক। বলা যায় ধর্মনিরপেক্ষ। পরকালে মোক্ষলাভ নয়, ইহকালে যন্ত্রণা দূর করাই ছিল তাঁর লক্ষ্য। ঈশ্বর আছেন কি নেই, সে-নিয়েও তাঁর কোনো দুশ্চিন্তা ছিল না। তাঁকে নাস্তিক বলার প্রয়োজন নেই, তবে ধর্মকর্ম বিষয়ে তিনি যে উদাসীন ছিলেন সেটা খুবই সঠিক। সংস্কৃত কলেজের পাঠ্যসূচী প্রস্তুত করার সময় তিনি বলেছিলেন যে তিনি পড়াতে চান আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান। সংস্কৃত কলেজে বেদান্ত ও সাংখ্যদর্শন পড়ানো হতো, পড়ানোটাই ছিল স্বাভাবিক; ওই পঠনপাঠনে বিদ্যাসাগর শিক্ষার্থীদের কোনো উপকার দেখেন নি। বেদান্ত ঈশ্বরবাদী, সাংখ্য নিরীশ্বরবাদী। দু’টোকেই তিনি ভ্রান্ত বলে লিখিত ভাবে জানিয়ে দিয়েছেন। সাহস ছিল। সমাজের মঙ্গলচিন্তাই ওই সাহসের উৎস। রামমোহন একদিকে বেদান্ত অপর দিকে ফান্সিস বেকন, এই দুই বিপরীতকে একত্র করতে চেয়েছিলেন, উদারনীতিক সমন্বয়বাদীরা যেমনটা করে থাকেন। বিদ্যাসাগর কিন্তু ছিলেন পুরোপুরি বেকনের দিকে, বেদান্তকে সরিয়ে রেখে। বিদ্যাসাগর কোনো ধর্মগ্রন্থ অনুবাদ করেন নি, রামমোহন যেমনটা করেছিলেন; অনুবাদ করেছেন সংস্কৃত ও ইংরেজী ভাষা থেকে উৎকৃষ্ট সাহিত্য। হিন্দী ভাষা থেকে অনুবাদ করে মনোরম কাহিনীও উপহার দিয়েছেন। এবং তাঁর প্রত্যেকটি পদক্ষেপেই মাতৃভাষাকে সমৃদ্ধ করেছে। মাতৃভাষার মাধ্যম ছাড়া জ্ঞানানুশীল যে গভীর, স্থায়ী, সৃষ্টিশীল, কোনোটাই হয় না, এই কাণ্ডজ্ঞান তখন অনেকেরই ছিল না, বিদ্যাসাগরের ছিল। আবার ওই কাণ্ডজ্ঞান যাদের ছিল তাঁরাও কর্মক্ষেত্রে অবতীর্ণ হন নি; বিদ্যাসাগর হয়েছেন। তাঁর আগে কেউ ছিল না। পরে অনেকে যুক্ত হয়েছেন। বিদ্যাসাগরের সময়ে উপযোগিতাবাদী জন স্টুয়ার্ট মিলের রচনা কলকাতায় সদ্য এসে পৌঁছেছে মাত্র; বিদ্যাসাগর পণ্ডিত ছিলেন সংস্কৃতের, ইংরেজী শিখেছেন নিজের চেষ্টায়, কিন্তু তিনি বুঝে ফেলেছেন ভাববাদী বিশপ বার্কলের তুলনায় যুক্তিবাদী স্টুয়ার্ট মিল অনেক বেশী গ্রহণযোগ্য। বেনারসের সংস্কৃত কলেজের ইংরেজ অধ্যক্ষ ছিলেন বিশপ বার্কলের রচনা পড়ানোর পক্ষে, বিদ্যাসাগর ছিলেন মিল-এর পক্ষে। এক আশ্চর্য অগ্রসরমানতা।
বিদ্যাসাগরের জন্ম, শিক্ষা ও অবস্থান, সবই ছিল একটি সামন্তবাদী পরিবেশে। ইংরেজের বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক উপস্থিতি ও ইংরেজী শিক্ষার প্রচলন সমাজে এক ধরনের চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল। একটি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীও গড়ে উঠছিল। এই বিকাশের উজ্জ্বল প্রতিনিধিদের মধ্যে একজন ছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত, সমাজের সামন্তবাদী সঙ্কীর্ণতার বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত বিদ্রোহ ঘোষণা করে তিনি খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী হয়ে গিয়েছিলেন, চেয়েছিলেন ইংরেজী ভাষাতে সাহিত্য রচনা করে আন্তর্জাতিক যশ অর্জন করবেন। কিন্তু অত্যন্ত মেধাবান ও সাহিত্যসৃষ্টির অতিউচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ছিলেন যেহেতু তাই তিনি ফিরে এসেছেন মাতৃভাষার কাছে। বিদ্যাসাগরের ব্যাপারটা কিন্তু সম্পূর্ণ উল্টো। তিনি মাতৃভাষার চর্চা বর্জনের কথা কখনোই ভাবেন নি। ওদিকে রামমোহন যে বিলেত গেলেন এবং সেখানেই সমাধিস্থ হলেন, বিদ্যাসাগরের পক্ষে তেমন কাজও সম্ভব ছিল না। তিনি মাতৃভাষা ও মাতৃভূমিতে গভীর ভাবে প্রোথিত ছিলেন। স্তম্ভের মতো নয়, বৃক্ষের মতো।
অথচ তিনি ছিলেন বুর্জোয়া বিকাশের একজন খাঁটি প্রতিনিধি। বুর্জোয়াদের অনেকগুলো সদগুণ তাঁর মধ্যে সক্রিয় ছিল। ছিলেন তিনি উদ্যোগী ও পরিশ্রমী। আগেই বলেছি ছিলেন তিনি পুরোপুরি ইহজাগতিক। ভালো বেতনের সরকারী চাকরী ছেড়ে দিয়েছিলেন অল্প বয়সেই। কারণ চাকুরী তাঁর কাছে অসম্মানজনক বোধ হচ্ছিল। আত্মসম্মানবোধের ক্ষেত্রে তিনি পেটি বুর্জোয়া নন, বুর্জোয়াই ছিলেন। সামন্তবাদী সংস্কার ও শিক্ষার বন্ধন যেমন ছিন্ন করেছিলেন তেমনি অসম্মত ছিলেন অবনত হতে। এগুণ সমাজে তখন বিরল ছিল। সরকারী চাকরী যখন ছেড়ে দেন তখন তিনি কী করে খাবেন, গুঞ্জন উঠেছিল এই প্রশ্নে। ওঠাটাই স্বাভাবিক। তিনি দরিদ্র ছিলেন। বিদ্যাসাগর বলেছিলেন, “বলে দিও বিদ্যাসাগর আলু-পটল বেচে খাবে, তবু অসম্মানের চাকরী সে করবে না”। আলুপটল না বেচলেও বই বেচেছেন যে সেটা তো ঠিক। নিজে বই লিখেছেন, সে বই নিজে ছাপিয়েছেন, ছাপাবার জন্য ছাপাখানা খুলেছেন, বই বিক্রিও নিজেই করেছেন, বিক্রির জন্য নিজস্ব দোকান খুলেছিলেন। বইগুলো পাঠ্যপুস্তক; ভালো বিক্রি হয়েছে। অর্থাগম কম ঘটে নি। কিন্তু বড়লোক হন নি। উপার্জিত অর্থ ব্যয় করেছেন শিক্ষাবিস্তারে, বিধবাবিবাহকে উৎসাহিতকরণে এবং ব্যক্তিগত বদান্যতায়।
পুঁজিবাদের আধিপত্যের কালে ব্যক্তিগত ভাবে মুনাফামনস্ক হওয়াটাই স্বাভাবিক। আবার এটাও সত্য যে অবস্থাপন্ন ঘরের মানুষদের ভেতর থেকেই বড় মাপের সমাজবিপ্লবীরা বের হয়ে এসেছেন। বিদ্যাসাগর তো দরিদ্র অবস্থা থেকে নিজের উদ্যোগ ও কর্মের মধ্য দিয়ে অর্থ উপার্জন করেছিলেন, কিন্তু তিনি মোটেই ব্যক্তিগত সম্পত্তি বৃদ্ধির লালসায় আবদ্ধ ছিলেন না; তাঁর ঝোঁক সামাজিক পরিবর্তনের দিকেই, সে-অর্থে তিনি শ্রেণীতে আটক থাকেন নি, স্বেচ্ছায় ও স্বীয় উদ্যমে শ্রেণী-অতিক্রান্ত হয়ে গিয়েছিলেন। সদ্য-উদ্ভিন্ন তখনকার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর একাংশের ভেতর স্বদেশচেতনা তৈরী হয়েছিল, কেউ কেউ ইংরেজ শাসন নিয়ে প্রশ্নও তুলেছেন; কিন্তু বিদ্যাসাগর যেভাবে এগিয়ে গেছেন সেভাবে ও সেই মাত্রায় কেউই এগুতে পারেন নি। কিছু সহযাত্রী অবশ্যই পেয়েছিলেন। কিন্তু এক সময়ে দেখলেন তিনি একেবারেই একা। সঙ্গের বন্ধুরা অনেকেই পিছিয়ে পড়েছেন, দু’য়েকজন বিশ্বাসঘাতকতা পর্যন্ত করে বসেছেন। বিদ্যাসাগর বুঝলেন এই শ্রেণীকে দিয়ে কাজ হবে না। সমাজ-রূপান্তরের কাজের জন্য দরকার ছিল কৃষকের কাছে যাওয়া। কিন্তু যাওয়া সম্ভব ছিল না। বাধা ছিল পরিবেশ ও পরিস্থিতির; জমিদারী ব্যবস্থার আবেষ্টন মোটেই অকার্যকর ছিল না। কিন্তু তিনি তাঁর কালের মধ্যবিত্তদের কাছ থেকে মানসিক ভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন। এদের সহায়তা পাবেন না সেটা বুঝে ফেলেছিলেন। কিন্তু হতাশ হয়ে তিনি ধর্মের কাছে চলে যান নি, বঙ্কিমচন্দ্র যেমনটা গেছিলেন। আবেদন-নিবেদনওয়ালাদের ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসেও যোগ দেন নি, যার কার্যক্রম ততদিনে শুরু হয়ে গিয়েছিল, অথবা কলকাতায় বিচ্ছিন্ন জীবন যাপন করেন নি, মাইকেল মধুসূদন যেমনটা করেছিলেন। তিনি চলে গেছেন সাঁওতালদের কাছে, তাদের পল্লীতে। সাঁওতালরাও মেহনতীই। সরাসরি কৃষক নয় যদিও, তবু কৃষিনির্ভর; এবং কৃষকদের চাইতেও সহজ সরল। তদুপরি সাঁওতালরা বিদ্রোহ করেছে। সিপাহী অভ্যত্থানের দু’বছর আগেই তারা মস্ত বড় একটি অভ্যুত্থান ঘটিয়েছিল ইংরেজের বিরুদ্ধে, যেটি দমনে ইংরেজ তো ছিলই, থাকবেই; বাঙালী ব্যবসায়ী ও আমলারাও কম সক্রিয় ছিল না।
বিদ্যাসাগর সাম্প্রদায়িক ছিলেন না, প্রশ্নই ওঠে নি। তাঁকে বলা চলে একজন খাঁটি বাঙালী জাতীয়তাবাদী। তিনি ভারতবর্ষের কথা অবশ্যই বলেছেন। না-বলে উপায় ছিল না। ভারতবর্ষ ছিল একটি রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক বাস্তবতা। কিন্তু মনেপ্রাণে তিনি বাঙালী ছিলেন। সে জন্যই নিজে তিনি মাতৃভাষার চর্চা করেছেন। মাতৃভাষা বাংলার মাধ্যমে জ্ঞানের চর্চা চলুক এমনটা চেয়েছেন। সেই লক্ষ্যে কাজ করেছেন। এই যে ইংরেজী ভাষাকে সরিয়ে রেখে বাংলা ভাষার প্রতি অনুরাগ এটি কিন্তু উপনিবেশের কর্তৃত্বকে অস্বীকার করারই নামান্তর। একে নীরব রাষ্ট্রদ্রোহিতাও বলা চলে। ইংরেজ শাসকরা চাইছিল শিক্ষিতরা সবাই একেকজন নকল সাহেব হোক। তাদের নিজেদের ভাষা চলে যাক ইংরেজী ভাষার অধীনে। অধিকাংশই সেটা মেনেও নিয়েছেন। বিদ্যাসাগর মেনে নেন নি। তাঁর ধ্বনিটা ছিল, চর্চা চাই মাতৃভাষার। জ্ঞানার্জন হবে মাতৃভাষার মাধ্যমে। এর জন্য বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ ও সুন্দর সাহিত্য সৃষ্টি করতে হবে। তাই তো তিনি মনোযোগ দিয়েছিলেন সাহিত্যসৃষ্টিতে। এবং সফলও হয়েছেন। তিনি যে গদ্যরীতি তৈরী করে রেখে গেছেন আমরা তাকেই ব্যবহার করছি, নতুন নতুন সংযোজন যুক্ত করে, আরও বিকশিত করে নিয়ে।
সেকালে বাঙালী জাতীয়তাবাদের সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক বিকাশের পথে প্রতিবন্ধক ছিল তিন দিক থেকে। লৈঙ্গিক, শ্রেণীগত ও সাম্প্রদায়িক। তাঁর নিজের অবস্থানে দাঁড়িয়ে বিদ্যাসাগর নারী-পুরুষের ভেদাভেদটা খুব পরিষ্কার ভাবে এবং গভীর মর্মবেদনার সঙ্গে দেখতে পেয়েছেন। নারীকে তিনি মুক্ত করতে চেয়েছেন; তারা পুরুষের সমান হবে, এই আশা থেকে নয়, তারা মানুষের মান-মর্যাদা পাবে এই কল্পনা থেকে। ঔপনিবেশিকতার ও সামন্তবাদিতার শক্তকে দুই শৃঙ্খলে আবদ্ধ বঙ্গভূমিতে পুরুষেরাও তো পরিপূর্ণ মানুষের মতো ছিল না, তাদের মতো হওয়াটা আর কত বড় অর্জন! তবে নারী যদি পুরুষের সঙ্গে এসে যোগ দেয় তাহলে সমাজ তো অবশ্যই এগিয়ে যাবে। বিদ্যাসাগরের চিন্তা ছিল সে-রকমের। সবচেয়ে বড় বিভাজনটা অবশ্য ছিল শ্রেণীর। বিদ্যাসাগর সেটা জানতেন, ততোটা পরিষ্কার ভাবে নিশ্চয়ই নয় যেমন ভাবে তাঁরই ইউরোপীয় সমসাময়িক কার্ল মার্কস (১৮১৮-৮৩) জানতেন। তাঁর আশা ছিল যে মধ্যবিত্তকে শিক্ষিত করতে পারলে সে-শিক্ষা মেহনতীদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়বে। বাস্তবে অবশ্য সেটা ঘটে নি। ঘটা সম্ভবও ছিল না, কেননা বিদ্যা যে পেয়েছে সে অন্যকে সেটা দিয়ে দিতে চায় নি, ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসেবে কাছে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। বিদ্যার্জন শ্রেণীদূরত্বকে মোটেই কমায় নি, উল্টো বাড়িয়েই দিয়েছে। জাতীয়তাবাদী অনৈক্যের তৃতীয় কারণটি ছিল সাম্প্রদায়িক। হিন্দু-মুসলিমের ধর্মপরিচয়গত পার্থক্যটা তো ছিলই, অর্থনৈতিক বৈষম্যও ছিল। কিন্তু ধূর্ত ইংরেজ সেই বৈষম্যকে কাজে লাগিয়েছে বিরোধ বাধানোর লক্ষ্যে। কখনো এপক্ষের দিকে কখনো অপরপক্ষের দিকে ঝুঁকে দুই সম্প্রদায়ের ভেতর বিদ্বেষ বৃদ্ধি করাতে চেষ্টার কোনো কার্পণ্য করে নি। বিদ্যাসাগরের সময়ে অবশ্য বিরোধটা তেমন জমে ওঠে নি, কারণ তখনকার বাংলাদেশে শিক্ষিত বাংলাভাষী মুসলমানরা দৃশ্যমান ছিল না। বাংলার মুসলিম সমাজের প্রতিনিধিদের মধ্যে বিশিষ্ট ছিলেন নবাব আবদুল লতীফ (১৮২৬-৯৩), নিজে তিনি উর্দুভাষী ছিলেন এবং তাঁরা যে ‘মহামেডান লিটারারি সোসাইটি’ গঠন করেছিলেন সেখানে সাহিত্যচর্চা বাংলাভাষায় হতো না, হতো উর্দু ভাষায়। এর মধ্যেই বাঙালী মুসলমানরা যখন গুটি গুটি এগিয়ে এসেছে তখনই শুরু হয়েছে বিরোধ। উষ্কানি ছিল ইংরেজের, কিন্তু সহনশীলতার অভাব ছিল ব্রাহ্মণ্যবাদীদের, যারা নিজেদের সমাজেই তথাকথিত নিম্নবর্ণের মানুষদেরকে মর্যাদার অযোগ্য জ্ঞান করতো, যে জন্য বিদ্যাসাগর তাঁর সংস্কৃত কলেজে শূদ্রদের জন্য দরজা খুলে দিতে পারলেন না। অগ্রসর অবস্থানে- প্রতিষ্ঠিত বর্ণবাদী হিন্দুরা মুসলমানদেরকে কোনো প্রকার ছাড় দিতে প্রস্তুত ছিল না, পরবর্তীতে সীমিত ভোটাধিকারের মধ্যে হলেও মুসলমানরা ভোটের শক্তি অর্জন করাতে রাজনৈতিক দরকষাকষিতে তারা যখন কিছুটা আত্মসচেতন হয়ে উঠলো এবং দাবী তুললো স্বতন্ত্র আবাসভূমির তখন দেখা গেল ব্রাহ্মণ্যবাদী বর্ণহিন্দুরা ভয় পাচ্ছে। পাছে বাংলা পাকিস্তানের অংশ হয়ে যায় এই ভীতিতে এমন কি দ্বিখণ্ডিত করে হলেও বাংলার একাংশ নিজেদের জন্য ধরে রাখার অভিপ্রায়ে দেশভাগের প্রস্তাবে সম্মত হয়ে গেল। বঙ্গভূমিকে দখল করার জন্য ১৭৫৭-তে বণিকবেশে যে-ইংরেজ ঢুকেছিল এবং দখল করে সম্পদ লুণ্ঠন ও পাচার চালিয়ে এবং পাশাপাশি শিল্পোদ্যোগকে বাধাগ্রস্ত করে দেশটিকে নিঃস্ব করে ফেলছিল, ১৯৪৭-এ তারাই বাংলার মানুষের ওপর সর্বনাশা দ্বিখণ্ডিতকরণ চাপিয়ে দিয়ে গেল। বাঙালীর জাতীয়তাবাদ শ্রেণী ও লৈঙ্গিক বৈষম্যে দুর্বল হয়েই ছিল, সাম্প্রদায়িক বিভাজনে সেটি দুইভাবে ভাগ হয়ে গেল; এক ভাগের পরিচয় হলো ভারতীয়, অপর ভাগের পরিচয় দাঁড়াল পাকিস্তানী। এপার ওপার দু’পারই দীর্ঘশ্বাস ফেললো পরস্পরের দুর্দশা দেখে।
ওপারের ব্যাপার ওপার বুঝবে এবং বুঝছে; আমাদের ব্যাপার তো বিশেষ সুবিধার নয়। বিদ্যাসাগর চেয়েছিলেন শিক্ষা সর্বজনীন হোক, জনশিক্ষার প্রসার সর্বত্র ঘটুক। তাঁর সময় কবে পার হয়ে গেছে, পূর্ববঙ্গ স্বাধীন হয়েছে সাতচল্লিশে, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বায়াত্তরে, কিন্তু শতভাগ সাক্ষরতা কি অর্জিত হয়েছে? সাক্ষরতার সংজ্ঞা যে কি তা নিয়েও প্রশ্ন থাকে। সে কি শুধু টিপসই না-দিয়ে সই করার মতো অক্ষরজ্ঞানলাভ? বিতর্কে না গিয়েও বলা হচ্ছে বাংলাদেশে সাক্ষরতার হার এখন ৭৪.৭০ শতাংশ। অর্থৎ প্রতি চার জনের ভেতর একজন মানুষ সম্পূর্ণ নিরক্ষর। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনী ঘোষণাপত্রের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে ক্ষমতায় গেলে ২০১৪-এর মধ্যে তারা দেশের একজন মানুষকেও নিরক্ষর থাকতে দেবে না। তারা ক্ষমতায় গেছে, একবার নয়, দু’বার, এখন তাদের তৃতীয় বার চলছে, কিন্তু এখনো সরকারী হিসাবেই দেশের ৪ কোটি লোক অক্ষর চেনে না। গত এক বছরে দেশে সাক্ষরতার হার নাকি শতকরা ১ ভাগও বাড়েনি, বেড়েছে ০.৮০ শতাংশ; গণশিক্ষা প্রকল্প নাকি মুখ থুবড়ে পড়েছে। গণমাধ্যমের লোকেরা প্রশ্ন তুলেছেন এমনটা কেন ঘটলো? জবাবটা কিন্তু সোজা। প্রথম কারণ রাষ্ট্রক্ষমতায় যাঁরা যান তাঁরা মুখে যা-ই বলুন অন্তরে চান না দেশে সব মানুষ শিক্ষিত হয়ে যাক। অশিক্ষিত থাকা মানেই বোবা এবং ক্ষীণদৃষ্টি হয়ে থাকা, তাদেরকে সেয়ানা না করাই ভালো, হট্টগোল বাধাবে। অপরদিকে শিক্ষায় মেহনতী মানুষের আগ্রহও কি বেড়েছে? কেন বাড়বে? শিক্ষা কি জীবিকার নিশ্চয়তা দিচ্ছে? উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত, এরা সন্তানদের বিদ্যালয়ে পাঠায় জীবিকা উপার্জনের জন্য বিদ্যা সহায়ক হবে আশা করে, যদিও আজকাল সে আশা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দুরাশায় পরিণত হয়। আর বিত্তহীন যারা তারা কেন সন্তানদের পড়ার জন্য বিদ্যালয়ে পাঠাতে যাবে? বিদ্যা তাদের কোন কাজে লাগবে? তার চেয়ে ভালো নয় কি এখনই কাজে লাগিয়ে দেওয়া; খেতে-খামারে, দোকানে, কারখানায় কিংবা কারো গৃহে? সেটাই তারা করছে। গরীবের ছেলেমেয়েরা বিদ্যালয়ে আসে না, আসে যদি-বা টেকে না। হাল্কা টোকাতেই ঝরে পড়ে যায়।
দেশভাগ হয়েছে, বাংলাদেশ পড়েছে নীচু এলাকাতে। একটি দু’টি বাদ দিয়ে বাংলাদেশের সব নদীই উপর থেকে নীচে নেমে এসেছে। উপরে ভারত, নীচে বাংলাদেশ। শুকনা মওসুমে ভারত কৃপণের মতো পানি আটকে রাখে; ফলে হাহাকার পড়ে যায় বাংলাদেশে। আর বর্ষায় সর্বোচ্চ উদারতায় তারা পানি দেয় ছেড়ে, বাংলাদেশ প্লাবিত হয়। বন্যা প্রতিবছরই হচ্ছে; এবছর কোনো কোনো জেলায় এক দফায় নয়, চার চার দফায় প্লাবন ঘটেছে। সম্প্রতি দেখা দিয়েছে নতুন এক উপসর্গ। যে আগরতলাতে ভারতীয়দের জন্য আমরা স্থল ও জল উভয় পথে পণ্য ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নেওয়ার বন্দোবস্ত করে দিয়েছি, বিনিময়ে সেখান থেকেই পাওয়া শুরু হয়েছে বিষাক্ত বর্জ্য পানি। ওই পানি দূষিত হয়েছে শিল্পকারখানায়, হাসপাতালে এবং গৃহে। দূষিত পানি যাবে কোথায়? চলে এসেছে সৎ প্রতিবেশী ভ্রাতৃপ্রতিম বাংলাদেশে। (ডেইলি স্টার, ১১-০৯-২০)
বন্ধুত্বের এই নিদর্শন অবশ্য আরও প্রকৃষ্ট পরিমাণে পাওয়া যাচ্ছে ভারত- বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সীমান্তে। সেখানে নিয়মিত বাংলাদেশীরা নিহত হচ্ছে। চুক্তি আছে মারণাস্ত্র ব্যবহার না-করার। বন্ধুদের মধ্যে আবার অস্ত্রশস্ত্র প্রদর্শন কেন? কিন্তু তবু মারণাস্ত্রের ব্যবহার ঘটছে তো ঘটছেই। ভারতই ঘটাচ্ছে। থামাবার লক্ষণ নেই। হিসাব মতে, ২০১৯ সালে সীমান্তে ৪৩ জন বাংলাদেশী নিহত হয়েছেন, তাদের মধ্যে গুলিতে নিহত ৩৭ জন। আর এবছর জানুয়ারী থেকে আগস্টের মধ্যে (করোনাকালেই) নিহত হয়েছেন ৩৫ জন, গুলিতে ২৯ জন। চীন-ভারত সীমান্তে একজন ভারতীয় সৈন্য মারা গেলেও মহা হৈ চৈ পড়ে যায়। কাঁটাতারের বেড়াতে নিহত ফেলানীর ঝুলন্ত মৃতদেহটি কি ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের প্রতীক? কে জানে। সাক্ষী রইল ইতিহাস।
বলছিলাম যে বিদ্যাসাগরের সামাজিক ইচ্ছাটা ছিল সংস্কারের নয়, সামাজিক পরিবর্তনের। তবে সেই ইচ্ছাটা অবশ্যই ততোটা সুস্পষ্ট ছিল না যেমনটা ছিল তাঁরই সমসাময়িক জার্মানীর কাল মার্কসের। মার্কসের জন্ম ১৮১৮-তে, বিদ্যাসাগরের ১৮২০-এ; দু’বছরে ছোট-বড়। নানা দিক থেকেই দু’জনের ভেতর পার্থক্য বিস্তর। তুলনা অপ্রাসঙ্গিক ও অপ্রয়োজনীয়। কিন্তু মিল আছে এই জায়গাটাতে যে তাঁরা দু’জনেই ছিলেন সমাজে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের আবশ্যকতার বিষয়ে স্থিরনিশ্চিত। মার্কসের জগৎটা অনেক বড়। তিনি ছিলেন আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন, বিদ্যাসাগর ছিলেন জাতীয় পরিধিতে কর্মরত। মার্কস যে সুযোগ সুবিধাগুলো পেয়েছিলেন তাদের প্রায় কোনটিই উপস্থিত ছিল না বিদ্যাসাগরের জন্য। ১৮৫৭-তে যখন সিপাহী অভ্যুত্থান ঘটে মার্কস তখন লন্ডনে, বিদ্যাসাগর কলকাতায়। মার্কস দেখতে পাচ্ছেন যে ভারতবর্ষে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। বিদ্যাসাগর তখন বিব্রত তাঁর সংস্কৃত কলেজের ভবনটি কোম্পানীর সৈন্যদেরকে ছেড়ে দিতে হচ্ছে বলে; বলাবাহুল্য কলেজটি ছিল সরকারী। কলকাতা জুড়ে তখন কোম্পানীর লোকেরা আতঙ্ক ছড়াচ্ছে যে বিদ্রোহী সিপাহীরা এসে সমস্ত কিছু তছনছ করে দেবে। কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত তখন মহাউল্লাসে সিপাহী অভ্যুত্থানের মানুষদেরকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করছেন। বিদ্যাসাগর নিশ্চুপ ছিলেন। তবে হিন্দু-পেট্রিয়ট নামের যে পত্রিকাটি সিপাহীদের সমর্থনে লিখতো, বিদ্যাসাগর তাকে সমর্থন জুগিয়েছেন। পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যু ঘটলে (১৮৬১) তিনি পত্রিকাটির পরিচালনা ভার স্বহস্তে গ্রহণ করেছিলেন। বুঝতে পারি তাঁর পক্ষপাত কোনদিকে ছিল।
মার্কসের মতবাদকে কাজে লাগিয়ে বিপ্লব হয়েছে। এক দেশে নয়, অনেক দেশে। বিদ্যাসাগরের দেশে কোনো বিপ্লব হয় নি। কেন হলো না সেই কারণগুলো আমাদের ইতিহাসের মধ্যেই নিহিত রয়েছে। সেগুলোর অনুসন্ধান করা এবং স্মরণে রাখা আবশ্যক, যাতে আমরা সামনের দিকে এগুতে পারি। প্রথম কারণ, ভারতবর্ষ স্বাধীন ছিল না, ছিল ইংরেজদের উপনিবেশ। ইউরোপের যে ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে আধিপত্য কায়েম করে তাদের মধ্যে সবচেয়ে ধুরন্ধর ছিল এই ইংরেজ ঔপনিবেশিকরা। তারা ভারতবর্ষের মানুষদের মাতৃভাষার চর্চাকে কঠিন করে দিয়ে নিজেদের ভাষাকে তাদের উপর চাপিয়ে দিয়েছে। তারা এখানে একটি তাঁবেদার শ্রেণী তৈরী করে নিয়েছে যে-শ্রেণী সদা-সর্বদা ইংরেজদের অনুকরণ করবে, তাদের মাপে নিজেদেরকে মাপবে, যাদের বাইরের চেহারাটাই যা দেশী, ভেতরের চেহারাটা দাঁড়াবে ইংরেজদের; যারা জনবিচ্ছিন্ন তো হবেই, যাদের সার্বক্ষণিক দুশ্চিন্তা থাকবে দেশে যেন কোনো বিপ্লব না ঘটে, কারণ বিপ্লব ঘটলে তাদের সুযোগ-সুবিধাগুলোর ভিত্তিটাই যাবে চুরমার হয়ে। বঙ্কিমচন্দ্র সাধারণ মানুষ ছিলেন না, কিন্তু অসাধারণ ওই মানুষটি এই শ্রেণীর মুখপাত্র হিসেবেই তো তাঁর সেই স্পষ্ট ও দ্বিধাহীন কথাটা ফাঁস করে দিয়েছেন : “আমরা সামাজিক বিপ্লবের অনুমোদক নহি”। তাঁর সাহস ছিল বলবার।
অথচ এই শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীটিই তো ছিল নেতৃত্বে। বিশেষ ভাবে রাজনীতির ক্ষেত্রে। এরাই ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস গঠন করেছে, প্রতিদ্বন্দ্বী সর্বভারতীয় মুসলিম লীগও এই শ্রেণীরই তৈরী। কংগ্রেস ও লীগ দু’টোই ছিল জাতীয়তাবাদী দল। কংগ্রেস ভারতীয় জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী; শেষ পর্যন্ত যা পরিণত হয়েছিল হিন্দু জাতীয়তাবাদে; আর মুসলিম লীগ তো ঘোষিত রূপেই ছিল মুসলিম জাতীয়তাবাদী। এরা উভয়েই ক্ষমতা হস্তান্তর চেয়েছে, সামাজিক বিপ্লব চায় নি, বরঞ্চ উভয়েরই আজন্ম আগ্রহ ছিল সেই বিপ্লবকে প্রতিহত করবার। কমিউনিস্ট পার্টি কিছু পরে এসেছে, তবে সে পার্টির নেতৃত্বও ছিল এই শ্রেণীর হাতেই। সেটাই ছিল স্বাভাবিক। কমিউনিস্ট পার্টি সামাজিক বিপ্লবের জন্য লড়েছে, আর সেজন্যই সে পার্টি বিষনজরে পড়েছিল রাষ্ট্রশাসকদের তো বটেই, কংগ্রেস ও লীগ উভয় নেতৃত্বেরই। রাষ্ট্র ওই পার্টির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা সাজিয়েছে, দ্রুতগতিতে কারাবন্দী করেছে এর সংগঠকদের এবং কিছু পরে পার্টিকে একেবারে নিষিদ্ধই করে ছেড়েছে। কংগ্রেস ও লীগের লোকেরা বলেছে কমিউনিস্টরা বিদেশী মতাদর্শ প্রচার করেছে; ক্ষেত্রবিশেষে তারা গুজব রটিয়েছে যে কমিউনিস্টরা নাস্তিক। এসব কাজে কংগ্রেস ও লীগে কোনো বিরোধ ছিল না, তারা ছিল একাট্টা। ভাই ভাই। কমিউনিস্ট পার্টির নিজেরও দুর্বলতা ছিল। সে-দুর্বলতা কেবল যে সাংগঠনিক তা নয়, ছিল দার্শনিকও। মার্কসবাদকে লেনিন রাশিয়াতে এবং মাও সে তুঙ চীনে যে-রকম সৃষ্টিশীল ও বাস্তবসম্মত উপায়ে প্রয়োগ করেছেন ভারতীয় কমিউনিস্টরা সে-ভাবে প্রয়োগ করতে পারেন নি। তদুপরি তাঁরা নির্ভরশীল ছিলেন সোভিয়েট ইউনিয়নের পরামর্শের ওপর। বাস্তব অবস্থা বলছিল যে বিপ্লবের জন্য যেতে হবে কৃষকের কাছে। কারণ ভারতবর্ষ ছিল একটি কৃষিপ্রধান দেশ, শতকরা ৯০ জন লোকই যুক্ত ছিল কৃষিকাজের সঙ্গে। শ্রমিক শ্রেণী ছিল অত্যন্ত ক্ষীণ। কমিউনিস্ট পার্টি কৃষকের কাছে যে যায় নি তা নয়; কিন্তু সে- ভাবে যায় নি যে-ভাবে যাওয়াটা অত্যাবশ্যক ছিল। কৃষকদের সংগঠিত করতে পারে নি। তাদের সচেতন করে তুলতে পারে নি।
ভারতবর্ষ যেহেতু স্বাধীন ছিল না, তাই জাতীয় স্বাধীনতার প্রশ্নটাই তখন প্রধান হয়ে উঠেছিল। জাতীয় স্বাধীনতার সংগ্রামটা ছিল সাম্রাজ্যবাদবিরোধী। কিন্তু ভারতবর্ষের ভেতরেই একটা জাতিগত সমস্যা ছিল। সেটা এই যে, উপমহাদেশ এক জাতির দেশ ছিল না, ছিল বহু জাতির দেশ। সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের শোষণতান্ত্রিক- প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তুলে উপমহাদেশকে একটি এককে পরিণত করেছিল, কিন্তু তাতে জাতি-সমস্যার সমাধান হয় নি। দেশভাগের সময়ে উপমহাদেশে কমপক্ষে সতেরটি জাতি ছিল, যাদের প্রত্যেকের ছিল স্বতন্ত্র ভাষা ও সংস্কৃতি। কংগ্রেস বললো ভারতবর্ষ এক জাতির দেশ, তবে বলতে পারলো না সেই একজাতিত্বের ভিত্তিটা কি সেটা তো কেবল ভৌগোলিক বা প্রশাসনিক হতে পারে না, ভেতরের ঐক্য চাই। ঐক্যের সেই ভিত্তিটা শেষ পর্যন্ত এসে ঠেকলো ধর্মে। মুসলমানরা বললো আমরা কম কিসে? সংখ্যায়, রাষ্ট্রশাসনের ইতিহাসে, সংস্কৃতিতে, ঐতিহ্যে আমরা মর্যাদাবান, এবং আমরা একটি স্বতন্ত্র জাতি। তাই নিয়ে দ্বন্দ্ব। বিপ্লব ঘটবে কি, দাঙ্গাই ঘটলো; পরিণতিটা দাঁড়াল দেশভাগ। ক্ষতি হলো অনেকের, অনেক কিছুর, সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা ঘটলো সমাজ-পরিবর্তনকামী বিপ্লবী আন্দোলনের।
কংগ্রেস ও লীগ উভয়েরই কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে ছিলেন আইনজীবীরা। এঁরা আইন বেঝেন, আন্দোলনেও যান, কিন্তু আইনের দিকটা ভোলেন না। এবং পেশাগত কারণে সাধারণ মানুষের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারেন না, বেশীরভাগ ওঠাবসা তাঁদের সঙ্গেই যাঁরা মামলামোকদ্দমা করতে আসে। গান্ধী এবং জিন্নাহ দু’জনেই ব্যারিস্টার ছিলেন। গান্ধী প্রথম জীবনে দক্ষিণ আফ্রিকায় ওকালতি করলেও ভারতবর্ষে এসে আর ওদিকে যান নি, পুরোপুরি ও সার্বক্ষণিক রাজনীতিতে নিজেকে যুক্ত রেখেছেন। কংগ্রেসকে তিনি বৈঠকখানা ও সভাসমিতির দালানকোঠা থেকে বের করে জনগণের কাছে নিয়ে গেলেন, কিন্তু ভেতরে তিনি তাঁর আইনী শিক্ষাকে পরিত্যাগ করতে পারলেন না। প্রথমেই ডাক দিলেন ইংরেজের সঙ্গে অসহযোগিতার। তার এই আন্দোলনে যোগ দিল খেলাফতপন্থী মুসলিম নেতারা। কিন্তু গান্ধী আর যাই করুন সমাজ-বিপ্লবে বিশ্বাসী ছিলেন না। বরং তাঁর রাজনৈতিক কাজের ভেতরকার অঙ্গীকারটি ছিল বিপ্লবকে প্রতিহত করবার। তাই দেখা গেছে জনগণ যখন এগিয়ে গেছে তিনি তখন পিছিয়ে গেছেন। জনগণকে থামতে বলেছেন। চল্লিশের দশকে এসে গণঅসন্তোষ ও বিক্ষোভ যখন চরম আকার ধারণ করে তখন কংগ্রেস নেতৃত্ব ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনের ডাক দিয়েছে, কিন্তু পুলিশ এসে সঙ্গে সঙ্গে বড় নেতাদের সবাইকে গ্রেফতার করে ফেলেছে। আন্দোলন চলেছে। চালিয়েছে জনগণ। বিশেষত সমাজতন্ত্রীরা।
গান্ধী আন্দোলনে ব্যক্তিগত সত্যাগ্রহকে ও চরকাকে নিয়ে এসেছেন; এগুলো পরাধীন দেশকে স্বাধীন করার অস্ত্র নয়। গান্ধী অত্যন্ত ক্ষতিকর যে কাজটি করলেন তা হলো রাজনীতির সঙ্গে ধর্মকে খুব ভালোভাবে জড়িয়ে দেওয়া। ব্যক্তিগত আচরণে তিনি অসাম্প্রদায়িক ছিলেন, কিন্তু মতাদর্শিক ভাবে মোটেই ধর্মনিরপেক্ষ ছিলেন না; রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনায় তিনি সকল ধর্মের উপস্থিতি চাইতেন। সর্বোপরি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অসংশোধনীয় রূপে ভাববাদী। বিদ্যাসাগর যে ধর্মনিরপেক্ষতা ও ইহজাগতিকতার চর্চা চাইছিলেন গান্ধীর রাজনীতি ছিল তার একেবারে বিপরীত প্রান্তে। এবং সে-অবস্থান স্বভাবতই সামাজিক বিপ্লবের অনুকূলে নয়, বিপক্ষে বটে। সামাজিক বিপ্লবের জন্য মেহনতীদের এগিয়ে আসাটা দরকার ছিল। মেহনতীরা এগুতে চেয়েছে, কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টি যেহেতু শক্তিশালী ছিল না, তাই নেতৃত্ব চলে গেছে মূলত কংগ্রেসের হাতেই, যাদের কাজ ছিল আন্দোলনকে বিপ্লবের দিকে এগিয়ে যেতে না দিয়ে আপোসের পথে সবেগে পরিচালনা করা। ফলে দেশ প্রকৃত স্বাধীনতার দিকে না গিয়ে চলে গেছে ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসনের (ডমিনিয়ন স্ট্যাটাস) দিকে। এবং সাতচল্লিশে তো সেটাই পাওয়া গেলো।
তাত্ত্বিক ভাবে কমিউনিস্ট পার্টির এটা অজানা ছিল না যে, ভারতবর্ষ একটি বহুজাতিক দেশ; সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনের ভেতরে থেকেই সেই সত্যটাকে খেয়ালে রাখা এবং তাকে বিবেচনার বাইরে না-যেতে দেওয়াটা পার্টির রাজনৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য ছিল। কিন্তু সে কাজটি তারা করতে পারে নি। ফলে জাতি-সমস্যা সাম্প্রদায়িক সমস্যার চেহারা নিয়েছে, হিন্দু ও মুসলিম দুই সম্প্রদায় দুই জাতির হিসেবে দাঁড়িয়ে গিয়ে পারস্পরিক দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়েছে, সুবিধা হয়েছে ইংরেজ শাসকদের, কারণ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াইটা সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের গলিপথে ঢুকে পড়ে তার সংগ্রামী শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। ইংরেজ শাসকেরা ভারতবর্ষকে দু’টুকরো করে তাদের প্রতি মিত্রভাবাপন্ন দুই রাজনৈতিক দলের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা তুলে দিয়েছে।
গান্ধী ও লেনিন একই সময়ে নিজ নিজ দেশের সার্বক্ষণিক রাজনৈতিক সংগ্রামে যুক্ত হয়ে ছিলেন। কিন্তু তাঁদের লক্ষ্য ছিল পরস্পরের বিপরীত। গান্ধী চাইছিলেন সংস্কার, লেনিন চাইছিলেন বিপ্লব। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় গান্ধী যখন ইংরেজের সঙ্গে সহযোগিতার উপায় খুঁজছেন, লেনিন তখন সচেষ্ট রয়েছেন যুদ্ধে-সৃষ্ট বিক্ষোভ ও অভাবকে বিপ্লবের পথে নিয়ে যেতে। তাঁরা দু’জনেই সফল হয়েছেন। ভারতবর্ষে বিপ্লবের সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে গেছে, রাশিয়াতে বিপ্লব ঘটেছে। ইংরেজের শাসনটা আমলাতান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী ছিল, ভারত ও পাকিস্তানের নেতারাও পুঁজিবাদী পথেই অগ্রসর হয়েছেন। উন্নতি ওই পথেই ঘটেছে। পথটা স্বাস্থ্যের নয়, অসুখের। যে অসুখের আপাত-সর্বশেষ বৈশ্বিক প্রকাশ করোনাভাইরাসের তাণ্ডব।
বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যের যে রূপটি স্থির করে দিলেন সেটিকে বলা হয় সাধুরীতি, বিপরীতে রয়েছে চলতি রীতি। বিদ্যাসাগর চেয়েছেন সাহিত্য ভদ্র গোছের হবে (ইংরেজীতে তিনি বলেছেন elegant)। সেই ভদ্রধারাটিই কিন্তু রয়ে গেছে। চলতি রীতি এসেছে, কিন্তু তা মুখের ভাষার কাছাকাছি আসে নি। ভদ্র বলতে বিদ্যাসাগর সৌন্দর্য ও সমৃদ্ধ গদ্যই বুঝেছিলেন। ভদ্রলোকদের হাতে পড়ে সে গদ্য সুন্দর ও সমৃদ্ধ হয়েছে অবশ্যই, তবে ভদ্রভাবে। ‘না’ অব্যয় ক্রিয়ার আগে না-বসিয়ে পরে বসাবার রীতি বাংলা গদ্যে চালু আছে। সপ্তদশ শতাব্দীর যে কবি, আবদুল হাকিম বঙ্গভাষার চর্চার পক্ষে লিখেছিলেন তিনি কিন্তু ‘না’কে ক্রিয়াপদের পরে বসান নি, বসিয়েছেন আগে : “যে সবে বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী।/ সে সবার কি বা রীতি নির্ণয় না জানি।” ভদ্রলোকদের পক্ষে ‘না’ বলাতে যে সংকোচ আছে, ‘না’-এর অবস্থান পরিবর্তন যেন তারই প্রতিফলন। অথচ ‘না’ বলাটা খুবই জরুরী। মনে মনে আমরা অনেক সময়েই না বলি, কিন্তু মুখে বলতে পারি না। ভদ্রতায় বাধে; বোধকরি সাহসেও। অনেকবারই আমাদের এদেশ বিদেশীরা দখল করে নিয়েছে, তাদেরকে না বলা হয় নি। আবার দেখি সংগঠনের সদস্যদেরকে ‘সভ্য’ বলা হয়। বামপন্থী রাজনৈতিক দলের সদস্যদেরকেও। সদস্যরা অত বেশী সভ্য-না হলেই ভালো, তাতে সংগঠনের শক্তি বাড়ে। সংবাদপত্রে সকলকেই আপনি বলা চলছে; সকলেই ‘করেন’, ‘বলেন’, ‘ছিলেন’; এমন কি গুরুতর অপরাধীরাও ‘সে’ থাকে না ‘তিনি’ হয়ে যান। তার অপরাধ-কর্মের বিবরণটিও ‘ন’-এর সংযুক্তি পেয়ে যায়। সর্বনামের আপনি, তুমি, তুই, এই তিন রূপও বদলায় নি। এগুলো সবই সামাজিক ব্যাকরণ দ্বারা স্থিরকৃত ও নিয়ন্ত্রিত। অনেক কিছুই বদলেছে, রাষ্ট্রের ভাঙাগড়াও ঘটেছে, কিন্তু সমাজে যে কোনো বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে নি তার প্রমাণ বহুবিধ বৈকি।
সাহিত্যও সেই ভদ্রগোছেরই রয়ে গেলো। বাংলা সাহিত্য অনেক এগিয়েছে, কিন্তু কৃষককে তার প্রাপ্য জায়গাটির ব্যবস্থা করে দিতে পারে নি। মেহনতীদের উপস্থিতিও খুবই কম। এ সাহিত্য ভদ্রলোকেরাই লেখে, ভদ্রলোকদের জন্য। সাহিত্যিক রুচিটাও ভদ্রলোকদেরই। তাই দেখা যায় সাহিত্যবিচারে দর্শন ও ইতিহাসের বিবেচনাটা আসতে চায় না। অথচ দর্শন ছাড়া তো সাহিত্য নেই। সাহিত্যরচয়িতারা শুধু যে দেখেন তা নয়, তাঁরা ভাবেনও, গভীর ভাবেই ভাবেন। যে জন্য কোনো সাহিত্যই মহৎ হয় না যদি না তাতে গভীর চিন্তা থাকে। সে-চিন্তা আসে অন্তর্দৃষ্টি, অভিজ্ঞতা ও কল্পনা শক্তি থেকে। সাহিত্য তাই কখনোই আদর্শনিরপেক্ষ নয়। দ্বিতীয়ত, সাহিত্য রচিত হয় ইতিহাসের ভেতর থেকেই। অন্যসব মানুষের মতোই সাহিত্যিকও বাস করেন একটি নির্দিষ্ট সময়ে, সমাজব্যবস্থায় ও শ্রেণীতে। সেটাই হচ্ছে ইতিহাস। কিন্তু বাংলা ভাষায় সাহিত্য সমালোচনা ওই সত্যগুলোর অন্বেষণটা কম। সাহিত্যের বিচারে ‘রস’-এর কথা, সৌন্দর্যের কথা, আনন্দের কথাই বেশী বেশী করে থাকে; পড়লে মনে হয় সাহিত্য বুঝি এক প্রকারের মিষ্টান্ন, সাহিত্যস্রষ্টারা বুঝি ময়রা। কিন্তু সাহিত্যপাঠের আনন্দ তো মিষ্টান্নভোজের সুখ নয়। সাহিত্যের আনন্দ কল্পনা করবার, ভাববার ও অনুভব করবার। সাহিত্য পড়ে আমাদের কল্পনার, অনুভবের ও চিন্তাশক্তির বৃদ্ধি ঘটে। তাছাড়া এটাও তো বাস্তবিক সত্য যে, অতিরিক্ত মিষ্টান্নভোজন স্বাস্থ্যের জন্য মোটেই মঙ্গলজনক নয়। সাহিত্যসমালোচনা ও সাহিত্য পাঠদানের ক্ষেত্রে নান্দনিক বিচারের সঙ্গে সঙ্গে তাই মতাদর্শিক বিবেচনাটাও আনা চাই। শব্দের গুণ, উপমার তাৎপর্য, আঙ্গিকের ব্যবহার, এসব তো বিবেচনাতে থাকবেই; কিন্তু শব্দ তো কেবল শোনার ব্যাপার নয়, শব্দের ধ্বনির সঙ্গে অর্থ থাকে, শব্দব্যবহারের পেছনে লেখকের রুচির পাশে দৃষ্টিভঙ্গিও থাকে। গভীরতা না থাকলে সাহিত্য তো হয়ে দাঁড়ায় শব্দের দোকানদারি।
মেয়েদের জীবনে দুঃখ ও অনিশ্চয়তা দেখে মাতৃহৃদয়সম্পন্ন বিদ্যাসাগর অত্যন্ত কাতর থাকতেন। এক বন্ধুর শিশুকন্যা প্রভাবতী’র অকাল মৃত্যুতে শোকে বেদনাপুত বিদ্যাসাগর একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। ছোট্ট, কিন্তু অসাধারণ। ‘প্রভাবতীসম্ভাষণ’ নামের ওই প্রবন্ধটি সম্ভবত বাংলা সাহিত্যে প্রথম শোকগাথা। তাতে প্রভাবতী’র মৃত্যুতে অশ্রুসম্বরণের চেষ্টা করতে গিয়ে নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে বিদ্যাসাগর লিখেছেন, প্রভাবতী তুমি যে চলে গেলে একদিক দিয়ে সেটা ভালোই হলো; বেঁচে থাকলে ‘ভাগ্যদোষে’ তুমি হয়তো “অসৎপাত্রের হস্তগত ও অসৎপরিবারের কবলে পতিত হয়ে দুঃখসন্তাপে কালাতিপাত করিতে।” বঙ্গদেশে নারী হয়ে জন্মগ্রহণেই ছিল মস্ত একটি ভাগ্যদোষ।
বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানের ভেতরে নির্যাতন চলতো। অবাধে। প্রতিষ্ঠানটি ছিল সামাজিক ভাবে স্বীকৃত এবং আইনের চোখে সিদ্ধ। কিন্তু এখন? এখন তো ঘরে বাইরে পথে ঘাটে নারীধর্ষণ চলছে। অনেক ক্ষেত্রে বিবাহ নামের প্রতিষ্ঠানটাই ভেঙে গেছে, বা টিকে থাকলেও অবস্থাটা তার ভীষণ নড়বড়ে। নৃত্যকলার শিক্ষক তার শিক্ষার্থীদের পাচার করে, পাড়ার বেকার যুবক গৃহবধূকে ঘরে ঢুকে ধর্ষণ করে; ইউনিয়ন কাউন্সিলর মেম্বার টাকা খেয়ে ধর্ষককে ছেড়ে দেয়, ধর্ষিতা নারীর পক্ষে সম্ভ্রম বাঁচানোর একটিই উপায় থাকে, আত্মহত্যা। বিদ্যাসাগরের কাল এখন আর নেই। আমরা এখন আরো অনেক এগিয়েছি, কিন্তু মেয়েদের নিরাপত্তা তিল পরিমাণ বাড়ে নি। বরং অনেক কমেছে। উন্নতির মাসুল অনেককেই দিতে হচ্ছে। মেয়েরা দিচ্ছে। আর বিশেষ ভাবেই দিচ্ছে মেহনতীরা, যাদের শ্রমে এই উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে ও হচ্ছে, কিন্তু যারা উন্নতির সৌধের কোথাও আশ্রয় পায় নি। আশেপাশেও নয়। মাসুল গুণতে হচ্ছে শিশুদেরও। কেন এমন ঘটল? উন্নতি কেন কেড়ে নিল অধিকাংশ মানুষের নিরাপত্তা? কারণ তো ওই একই। এই উন্নতি পুঁজিবাদী, এর স্বভাবই হচ্ছে অধিকাংশের শোষণ-বঞ্চনার ওপর অল্পসংখ্যকের আরাম-আয়েশ বৃদ্ধি করা। পরোয়া করে না মানুষ মরলো কি বাঁচলো।
৩
বিদ্যাসাগরের কাজের দিকে আরো একটু তাকানো যাক। তাকানোটা দরকারও। ওই কাজ আমাদের ঐতিহ্যের অন্তর্গত। বিধবা-বিবাহ বৈধকরণ তাঁর একটা বড় কাজ। আর একটা কাজ বাংলাগদ্যকে শিল্পসৌন্দর্যসম্পন্ন করা। কাজ দু’টো আসলে অভিন্ন। কারণ দু’টোই সামাজিক। মেয়েদের দুঃখ নিরসন করে যেমন, বাংলা গদ্যের আড়ষ্টতা ঘুঁচানোর মধ্য দিয়েও তেমনি সমাজে তিনি চলমানতা আনতে চেয়েছেন। ভাষা সামাজিক সম্পত্তি। ভাষার মুক্তি সমাজের মুক্তি না ঘটলে সম্ভব নয়। আবার ভাষার মুক্তি সমাজের মুক্তিতে সহায়তাও দেয়। বিদ্যাসাগর সমাজের মুক্তি ও ভাষার মুক্তিকে একত্র করে দেখেছেন, অনেকেই সেভাবে দেখতে পান না। ভাষাকে যদি বেগবান ও সমৃদ্ধ করা যায় তবে সমাজ-প্রগতিতে তা সহায়ক হবে এটা মনে করেই তিনি মাতৃভাষার চর্চা করেছিলেন। এটা খুবই স্পষ্ট যে সামাজিক প্রয়োজনের বোধ থেকেই তিনি সাহিত্যিক হয়েছেন, সাহিত্যের প্রয়োজনে সমাজাশ্রয়ী হন নি। বিদ্যাসাগরকে সমাজ-সংস্কারক বলা হয়। সে-উপাধি কিন্তু তাঁর জন্য পর্যাপ্ত নয়। তিনি সমাজে সংস্কার আনাটাকে যথেষ্ট মনে করেন নি, চেয়েছিলেন সমাজ-রূপান্তর। তাঁকে বরঞ্চ সামাজিক বিপ্লবের অগ্রপথিক বলাটা সঙ্গত। বিদ্যাসাগরকে রামমোহনের উত্তরসূরী হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়ে থাকে; সেটাও কিন্তু ষোলআনা সঠিক নয়। রামমোহন রায় সামাজিক কাজ অনেক করেছেন, কিন্তু সেই সঙ্গে ধর্মসংস্কারেও তিনি উদ্যোগী ছিলেন। সনাতন ধর্মকে পৌত্তলিকতামুক্ত করতে চেয়েছেন। ব্রাহ্মধর্মের প্রবর্তনে তাঁর ভূমিকাই ছিল সর্বাগ্রগণ্য। বিদ্যাসাগর কিন্তু ছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্নপথের পথিক। তিনি ছিলেন পুরোপুরি ইহজাগতিক। বলা যায় ধর্মনিরপেক্ষ। পরকালে মোক্ষলাভ নয়, ইহকালে যন্ত্রণা দূর করাই ছিল তাঁর লক্ষ্য। ঈশ্বর আছেন কি নেই, সে-নিয়েও তাঁর কোনো দুশ্চিন্তা ছিল না। তাঁকে নাস্তিক বলার প্রয়োজন নেই, তবে ধর্মকর্ম বিষয়ে তিনি যে উদাসীন ছিলেন সেটা খুবই সঠিক। সংস্কৃত কলেজের পাঠ্যসূচী প্রস্তুত করার সময় তিনি বলেছিলেন যে তিনি পড়াতে চান আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান। সংস্কৃত কলেজে বেদান্ত ও সাংখ্যদর্শন পড়ানো হতো, পড়ানোটাই ছিল স্বাভাবিক; ওই পঠনপাঠনে বিদ্যাসাগর শিক্ষার্থীদের কোনো উপকার দেখেন নি। বেদান্ত ঈশ্বরবাদী, সাংখ্য নিরীশ্বরবাদী। দু’টোকেই তিনি ভ্রান্ত বলে লিখিত ভাবে জানিয়ে দিয়েছেন। সাহস ছিল। সমাজের মঙ্গলচিন্তাই ওই সাহসের উৎস। রামমোহন একদিকে বেদান্ত অপর দিকে ফান্সিস বেকন, এই দুই বিপরীতকে একত্র করতে চেয়েছিলেন, উদারনীতিক সমন্বয়বাদীরা যেমনটা করে থাকেন। বিদ্যাসাগর কিন্তু ছিলেন পুরোপুরি বেকনের দিকে, বেদান্তকে সরিয়ে রেখে। বিদ্যাসাগর কোনো ধর্মগ্রন্থ অনুবাদ করেন নি, রামমোহন যেমনটা করেছিলেন; অনুবাদ করেছেন সংস্কৃত ও ইংরেজী ভাষা থেকে উৎকৃষ্ট সাহিত্য। হিন্দী ভাষা থেকে অনুবাদ করে মনোরম কাহিনীও উপহার দিয়েছেন। এবং তাঁর প্রত্যেকটি পদক্ষেপেই মাতৃভাষাকে সমৃদ্ধ করেছে। মাতৃভাষার মাধ্যম ছাড়া জ্ঞানানুশীল যে গভীর, স্থায়ী, সৃষ্টিশীল, কোনোটাই হয় না, এই কাণ্ডজ্ঞান তখন অনেকেরই ছিল না, বিদ্যাসাগরের ছিল। আবার ওই কাণ্ডজ্ঞান যাদের ছিল তাঁরাও কর্মক্ষেত্রে অবতীর্ণ হন নি; বিদ্যাসাগর হয়েছেন। তাঁর আগে কেউ ছিল না। পরে অনেকে যুক্ত হয়েছেন। বিদ্যাসাগরের সময়ে উপযোগিতাবাদী জন স্টুয়ার্ট মিলের রচনা কলকাতায় সদ্য এসে পৌঁছেছে মাত্র; বিদ্যাসাগর পণ্ডিত ছিলেন সংস্কৃতের, ইংরেজী শিখেছেন নিজের চেষ্টায়, কিন্তু তিনি বুঝে ফেলেছেন ভাববাদী বিশপ বার্কলের তুলনায় যুক্তিবাদী স্টুয়ার্ট মিল অনেক বেশী গ্রহণযোগ্য। বেনারসের সংস্কৃত কলেজের ইংরেজ অধ্যক্ষ ছিলেন বিশপ বার্কলের রচনা পড়ানোর পক্ষে, বিদ্যাসাগর ছিলেন মিল-এর পক্ষে। এক আশ্চর্য অগ্রসরমানতা।
বিদ্যাসাগরের জন্ম, শিক্ষা ও অবস্থান, সবই ছিল একটি সামন্তবাদী পরিবেশে। ইংরেজের বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক উপস্থিতি ও ইংরেজী শিক্ষার প্রচলন সমাজে এক ধরনের চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল। একটি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীও গড়ে উঠছিল। এই বিকাশের উজ্জ্বল প্রতিনিধিদের মধ্যে একজন ছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত, সমাজের সামন্তবাদী সঙ্কীর্ণতার বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত বিদ্রোহ ঘোষণা করে তিনি খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী হয়ে গিয়েছিলেন, চেয়েছিলেন ইংরেজী ভাষাতে সাহিত্য রচনা করে আন্তর্জাতিক যশ অর্জন করবেন। কিন্তু অত্যন্ত মেধাবান ও সাহিত্যসৃষ্টির অতিউচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ছিলেন যেহেতু তাই তিনি ফিরে এসেছেন মাতৃভাষার কাছে। বিদ্যাসাগরের ব্যাপারটা কিন্তু সম্পূর্ণ উল্টো। তিনি মাতৃভাষার চর্চা বর্জনের কথা কখনোই ভাবেন নি। ওদিকে রামমোহন যে বিলেত গেলেন এবং সেখানেই সমাধিস্থ হলেন, বিদ্যাসাগরের পক্ষে তেমন কাজও সম্ভব ছিল না। তিনি মাতৃভাষা ও মাতৃভূমিতে গভীর ভাবে প্রোথিত ছিলেন। স্তম্ভের মতো নয়, বৃক্ষের মতো।
অথচ তিনি ছিলেন বুর্জোয়া বিকাশের একজন খাঁটি প্রতিনিধি। বুর্জোয়াদের অনেকগুলো সদগুণ তাঁর মধ্যে সক্রিয় ছিল। ছিলেন তিনি উদ্যোগী ও পরিশ্রমী। আগেই বলেছি ছিলেন তিনি পুরোপুরি ইহজাগতিক। ভালো বেতনের সরকারী চাকরী ছেড়ে দিয়েছিলেন অল্প বয়সেই। কারণ চাকুরী তাঁর কাছে অসম্মানজনক বোধ হচ্ছিল। আত্মসম্মানবোধের ক্ষেত্রে তিনি পেটি বুর্জোয়া নন, বুর্জোয়াই ছিলেন। সামন্তবাদী সংস্কার ও শিক্ষার বন্ধন যেমন ছিন্ন করেছিলেন তেমনি অসম্মত ছিলেন অবনত হতে। এগুণ সমাজে তখন বিরল ছিল। সরকারী চাকরী যখন ছেড়ে দেন তখন তিনি কী করে খাবেন, গুঞ্জন উঠেছিল এই প্রশ্নে। ওঠাটাই স্বাভাবিক। তিনি দরিদ্র ছিলেন। বিদ্যাসাগর বলেছিলেন, “বলে দিও বিদ্যাসাগর আলু-পটল বেচে খাবে, তবু অসম্মানের চাকরী সে করবে না”। আলুপটল না বেচলেও বই বেচেছেন যে সেটা তো ঠিক। নিজে বই লিখেছেন, সে বই নিজে ছাপিয়েছেন, ছাপাবার জন্য ছাপাখানা খুলেছেন, বই বিক্রিও নিজেই করেছেন, বিক্রির জন্য নিজস্ব দোকান খুলেছিলেন। বইগুলো পাঠ্যপুস্তক; ভালো বিক্রি হয়েছে। অর্থাগম কম ঘটে নি। কিন্তু বড়লোক হন নি। উপার্জিত অর্থ ব্যয় করেছেন শিক্ষাবিস্তারে, বিধবাবিবাহকে উৎসাহিতকরণে এবং ব্যক্তিগত বদান্যতায়।
পুঁজিবাদের আধিপত্যের কালে ব্যক্তিগত ভাবে মুনাফামনস্ক হওয়াটাই স্বাভাবিক। আবার এটাও সত্য যে অবস্থাপন্ন ঘরের মানুষদের ভেতর থেকেই বড় মাপের সমাজবিপ্লবীরা বের হয়ে এসেছেন। বিদ্যাসাগর তো দরিদ্র অবস্থা থেকে নিজের উদ্যোগ ও কর্মের মধ্য দিয়ে অর্থ উপার্জন করেছিলেন, কিন্তু তিনি মোটেই ব্যক্তিগত সম্পত্তি বৃদ্ধির লালসায় আবদ্ধ ছিলেন না; তাঁর ঝোঁক সামাজিক পরিবর্তনের দিকেই, সে-অর্থে তিনি শ্রেণীতে আটক থাকেন নি, স্বেচ্ছায় ও স্বীয় উদ্যমে শ্রেণী-অতিক্রান্ত হয়ে গিয়েছিলেন। সদ্য-উদ্ভিন্ন তখনকার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর একাংশের ভেতর স্বদেশচেতনা তৈরী হয়েছিল, কেউ কেউ ইংরেজ শাসন নিয়ে প্রশ্নও তুলেছেন; কিন্তু বিদ্যাসাগর যেভাবে এগিয়ে গেছেন সেভাবে ও সেই মাত্রায় কেউই এগুতে পারেন নি। কিছু সহযাত্রী অবশ্যই পেয়েছিলেন। কিন্তু এক সময়ে দেখলেন তিনি একেবারেই একা। সঙ্গের বন্ধুরা অনেকেই পিছিয়ে পড়েছেন, দু’য়েকজন বিশ্বাসঘাতকতা পর্যন্ত করে বসেছেন। বিদ্যাসাগর বুঝলেন এই শ্রেণীকে দিয়ে কাজ হবে না। সমাজ-রূপান্তরের কাজের জন্য দরকার ছিল কৃষকের কাছে যাওয়া। কিন্তু যাওয়া সম্ভব ছিল না। বাধা ছিল পরিবেশ ও পরিস্থিতির; জমিদারী ব্যবস্থার আবেষ্টন মোটেই অকার্যকর ছিল না। কিন্তু তিনি তাঁর কালের মধ্যবিত্তদের কাছ থেকে মানসিক ভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন। এদের সহায়তা পাবেন না সেটা বুঝে ফেলেছিলেন। কিন্তু হতাশ হয়ে তিনি ধর্মের কাছে চলে যান নি, বঙ্কিমচন্দ্র যেমনটা গেছিলেন। আবেদন-নিবেদনওয়ালাদের ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসেও যোগ দেন নি, যার কার্যক্রম ততদিনে শুরু হয়ে গিয়েছিল, অথবা কলকাতায় বিচ্ছিন্ন জীবন যাপন করেন নি, মাইকেল মধুসূদন যেমনটা করেছিলেন। তিনি চলে গেছেন সাঁওতালদের কাছে, তাদের পল্লীতে। সাঁওতালরাও মেহনতীই। সরাসরি কৃষক নয় যদিও, তবু কৃষিনির্ভর; এবং কৃষকদের চাইতেও সহজ সরল। তদুপরি সাঁওতালরা বিদ্রোহ করেছে। সিপাহী অভ্যত্থানের দু’বছর আগেই তারা মস্ত বড় একটি অভ্যুত্থান ঘটিয়েছিল ইংরেজের বিরুদ্ধে, যেটি দমনে ইংরেজ তো ছিলই, থাকবেই; বাঙালী ব্যবসায়ী ও আমলারাও কম সক্রিয় ছিল না।
বিদ্যাসাগর সাম্প্রদায়িক ছিলেন না, প্রশ্নই ওঠে নি। তাঁকে বলা চলে একজন খাঁটি বাঙালী জাতীয়তাবাদী। তিনি ভারতবর্ষের কথা অবশ্যই বলেছেন। না-বলে উপায় ছিল না। ভারতবর্ষ ছিল একটি রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক বাস্তবতা। কিন্তু মনেপ্রাণে তিনি বাঙালী ছিলেন। সে জন্যই নিজে তিনি মাতৃভাষার চর্চা করেছেন। মাতৃভাষা বাংলার মাধ্যমে জ্ঞানের চর্চা চলুক এমনটা চেয়েছেন। সেই লক্ষ্যে কাজ করেছেন। এই যে ইংরেজী ভাষাকে সরিয়ে রেখে বাংলা ভাষার প্রতি অনুরাগ এটি কিন্তু উপনিবেশের কর্তৃত্বকে অস্বীকার করারই নামান্তর। একে নীরব রাষ্ট্রদ্রোহিতাও বলা চলে। ইংরেজ শাসকরা চাইছিল শিক্ষিতরা সবাই একেকজন নকল সাহেব হোক। তাদের নিজেদের ভাষা চলে যাক ইংরেজী ভাষার অধীনে। অধিকাংশই সেটা মেনেও নিয়েছেন। বিদ্যাসাগর মেনে নেন নি। তাঁর ধ্বনিটা ছিল, চর্চা চাই মাতৃভাষার। জ্ঞানার্জন হবে মাতৃভাষার মাধ্যমে। এর জন্য বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ ও সুন্দর সাহিত্য সৃষ্টি করতে হবে। তাই তো তিনি মনোযোগ দিয়েছিলেন সাহিত্যসৃষ্টিতে। এবং সফলও হয়েছেন। তিনি যে গদ্যরীতি তৈরী করে রেখে গেছেন আমরা তাকেই ব্যবহার করছি, নতুন নতুন সংযোজন যুক্ত করে, আরও বিকশিত করে নিয়ে।
সেকালে বাঙালী জাতীয়তাবাদের সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক বিকাশের পথে প্রতিবন্ধক ছিল তিন দিক থেকে। লৈঙ্গিক, শ্রেণীগত ও সাম্প্রদায়িক। তাঁর নিজের অবস্থানে দাঁড়িয়ে বিদ্যাসাগর নারী-পুরুষের ভেদাভেদটা খুব পরিষ্কার ভাবে এবং গভীর মর্মবেদনার সঙ্গে দেখতে পেয়েছেন। নারীকে তিনি মুক্ত করতে চেয়েছেন; তারা পুরুষের সমান হবে, এই আশা থেকে নয়, তারা মানুষের মান-মর্যাদা পাবে এই কল্পনা থেকে। ঔপনিবেশিকতার ও সামন্তবাদিতার শক্তকে দুই শৃঙ্খলে আবদ্ধ বঙ্গভূমিতে পুরুষেরাও তো পরিপূর্ণ মানুষের মতো ছিল না, তাদের মতো হওয়াটা আর কত বড় অর্জন! তবে নারী যদি পুরুষের সঙ্গে এসে যোগ দেয় তাহলে সমাজ তো অবশ্যই এগিয়ে যাবে। বিদ্যাসাগরের চিন্তা ছিল সে-রকমের। সবচেয়ে বড় বিভাজনটা অবশ্য ছিল শ্রেণীর। বিদ্যাসাগর সেটা জানতেন, ততোটা পরিষ্কার ভাবে নিশ্চয়ই নয় যেমন ভাবে তাঁরই ইউরোপীয় সমসাময়িক কার্ল মার্কস (১৮১৮-৮৩) জানতেন। তাঁর আশা ছিল যে মধ্যবিত্তকে শিক্ষিত করতে পারলে সে-শিক্ষা মেহনতীদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়বে। বাস্তবে অবশ্য সেটা ঘটে নি। ঘটা সম্ভবও ছিল না, কেননা বিদ্যা যে পেয়েছে সে অন্যকে সেটা দিয়ে দিতে চায় নি, ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসেবে কাছে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। বিদ্যার্জন শ্রেণীদূরত্বকে মোটেই কমায় নি, উল্টো বাড়িয়েই দিয়েছে। জাতীয়তাবাদী অনৈক্যের তৃতীয় কারণটি ছিল সাম্প্রদায়িক। হিন্দু-মুসলিমের ধর্মপরিচয়গত পার্থক্যটা তো ছিলই, অর্থনৈতিক বৈষম্যও ছিল। কিন্তু ধূর্ত ইংরেজ সেই বৈষম্যকে কাজে লাগিয়েছে বিরোধ বাধানোর লক্ষ্যে। কখনো এপক্ষের দিকে কখনো অপরপক্ষের দিকে ঝুঁকে দুই সম্প্রদায়ের ভেতর বিদ্বেষ বৃদ্ধি করাতে চেষ্টার কোনো কার্পণ্য করে নি। বিদ্যাসাগরের সময়ে অবশ্য বিরোধটা তেমন জমে ওঠে নি, কারণ তখনকার বাংলাদেশে শিক্ষিত বাংলাভাষী মুসলমানরা দৃশ্যমান ছিল না। বাংলার মুসলিম সমাজের প্রতিনিধিদের মধ্যে বিশিষ্ট ছিলেন নবাব আবদুল লতীফ (১৮২৬-৯৩), নিজে তিনি উর্দুভাষী ছিলেন এবং তাঁরা যে ‘মহামেডান লিটারারি সোসাইটি’ গঠন করেছিলেন সেখানে সাহিত্যচর্চা বাংলাভাষায় হতো না, হতো উর্দু ভাষায়। এর মধ্যেই বাঙালী মুসলমানরা যখন গুটি গুটি এগিয়ে এসেছে তখনই শুরু হয়েছে বিরোধ। উষ্কানি ছিল ইংরেজের, কিন্তু সহনশীলতার অভাব ছিল ব্রাহ্মণ্যবাদীদের, যারা নিজেদের সমাজেই তথাকথিত নিম্নবর্ণের মানুষদেরকে মর্যাদার অযোগ্য জ্ঞান করতো, যে জন্য বিদ্যাসাগর তাঁর সংস্কৃত কলেজে শূদ্রদের জন্য দরজা খুলে দিতে পারলেন না। অগ্রসর অবস্থানে- প্রতিষ্ঠিত বর্ণবাদী হিন্দুরা মুসলমানদেরকে কোনো প্রকার ছাড় দিতে প্রস্তুত ছিল না, পরবর্তীতে সীমিত ভোটাধিকারের মধ্যে হলেও মুসলমানরা ভোটের শক্তি অর্জন করাতে রাজনৈতিক দরকষাকষিতে তারা যখন কিছুটা আত্মসচেতন হয়ে উঠলো এবং দাবী তুললো স্বতন্ত্র আবাসভূমির তখন দেখা গেল ব্রাহ্মণ্যবাদী বর্ণহিন্দুরা ভয় পাচ্ছে। পাছে বাংলা পাকিস্তানের অংশ হয়ে যায় এই ভীতিতে এমন কি দ্বিখণ্ডিত করে হলেও বাংলার একাংশ নিজেদের জন্য ধরে রাখার অভিপ্রায়ে দেশভাগের প্রস্তাবে সম্মত হয়ে গেল। বঙ্গভূমিকে দখল করার জন্য ১৭৫৭-তে বণিকবেশে যে-ইংরেজ ঢুকেছিল এবং দখল করে সম্পদ লুণ্ঠন ও পাচার চালিয়ে এবং পাশাপাশি শিল্পোদ্যোগকে বাধাগ্রস্ত করে দেশটিকে নিঃস্ব করে ফেলছিল, ১৯৪৭-এ তারাই বাংলার মানুষের ওপর সর্বনাশা দ্বিখণ্ডিতকরণ চাপিয়ে দিয়ে গেল। বাঙালীর জাতীয়তাবাদ শ্রেণী ও লৈঙ্গিক বৈষম্যে দুর্বল হয়েই ছিল, সাম্প্রদায়িক বিভাজনে সেটি দুইভাবে ভাগ হয়ে গেল; এক ভাগের পরিচয় হলো ভারতীয়, অপর ভাগের পরিচয় দাঁড়াল পাকিস্তানী। এপার ওপার দু’পারই দীর্ঘশ্বাস ফেললো পরস্পরের দুর্দশা দেখে।
8
ওপারের ব্যাপার ওপার বুঝবে এবং বুঝছে; আমাদের ব্যাপার তো বিশেষ সুবিধার নয়। বিদ্যাসাগর চেয়েছিলেন শিক্ষা সর্বজনীন হোক, জনশিক্ষার প্রসার সর্বত্র ঘটুক। তাঁর সময় কবে পার হয়ে গেছে, পূর্ববঙ্গ স্বাধীন হয়েছে সাতচল্লিশে, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বায়াত্তরে, কিন্তু শতভাগ সাক্ষরতা কি অর্জিত হয়েছে? সাক্ষরতার সংজ্ঞা যে কি তা নিয়েও প্রশ্ন থাকে। সে কি শুধু টিপসই না-দিয়ে সই করার মতো অক্ষরজ্ঞানলাভ? বিতর্কে না গিয়েও বলা হচ্ছে বাংলাদেশে সাক্ষরতার হার এখন ৭৪.৭০ শতাংশ। অর্থৎ প্রতি চার জনের ভেতর একজন মানুষ সম্পূর্ণ নিরক্ষর। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনী ঘোষণাপত্রের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে ক্ষমতায় গেলে ২০১৪-এর মধ্যে তারা দেশের একজন মানুষকেও নিরক্ষর থাকতে দেবে না। তারা ক্ষমতায় গেছে, একবার নয়, দু’বার, এখন তাদের তৃতীয় বার চলছে, কিন্তু এখনো সরকারী হিসাবেই দেশের ৪ কোটি লোক অক্ষর চেনে না। গত এক বছরে দেশে সাক্ষরতার হার নাকি শতকরা ১ ভাগও বাড়েনি, বেড়েছে ০.৮০ শতাংশ; গণশিক্ষা প্রকল্প নাকি মুখ থুবড়ে পড়েছে। গণমাধ্যমের লোকেরা প্রশ্ন তুলেছেন এমনটা কেন ঘটলো? জবাবটা কিন্তু সোজা। প্রথম কারণ রাষ্ট্রক্ষমতায় যাঁরা যান তাঁরা মুখে যা-ই বলুন অন্তরে চান না দেশে সব মানুষ শিক্ষিত হয়ে যাক। অশিক্ষিত থাকা মানেই বোবা এবং ক্ষীণদৃষ্টি হয়ে থাকা, তাদেরকে সেয়ানা না করাই ভালো, হট্টগোল বাধাবে। অপরদিকে শিক্ষায় মেহনতী মানুষের আগ্রহও কি বেড়েছে? কেন বাড়বে? শিক্ষা কি জীবিকার নিশ্চয়তা দিচ্ছে? উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত, এরা সন্তানদের বিদ্যালয়ে পাঠায় জীবিকা উপার্জনের জন্য বিদ্যা সহায়ক হবে আশা করে, যদিও আজকাল সে আশা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দুরাশায় পরিণত হয়। আর বিত্তহীন যারা তারা কেন সন্তানদের পড়ার জন্য বিদ্যালয়ে পাঠাতে যাবে? বিদ্যা তাদের কোন কাজে লাগবে? তার চেয়ে ভালো নয় কি এখনই কাজে লাগিয়ে দেওয়া; খেতে-খামারে, দোকানে, কারখানায় কিংবা কারো গৃহে? সেটাই তারা করছে। গরীবের ছেলেমেয়েরা বিদ্যালয়ে আসে না, আসে যদি-বা টেকে না। হাল্কা টোকাতেই ঝরে পড়ে যায়।
দেশভাগ হয়েছে, বাংলাদেশ পড়েছে নীচু এলাকাতে। একটি দু’টি বাদ দিয়ে বাংলাদেশের সব নদীই উপর থেকে নীচে নেমে এসেছে। উপরে ভারত, নীচে বাংলাদেশ। শুকনা মওসুমে ভারত কৃপণের মতো পানি আটকে রাখে; ফলে হাহাকার পড়ে যায় বাংলাদেশে। আর বর্ষায় সর্বোচ্চ উদারতায় তারা পানি দেয় ছেড়ে, বাংলাদেশ প্লাবিত হয়। বন্যা প্রতিবছরই হচ্ছে; এবছর কোনো কোনো জেলায় এক দফায় নয়, চার চার দফায় প্লাবন ঘটেছে। সম্প্রতি দেখা দিয়েছে নতুন এক উপসর্গ। যে আগরতলাতে ভারতীয়দের জন্য আমরা স্থল ও জল উভয় পথে পণ্য ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নেওয়ার বন্দোবস্ত করে দিয়েছি, বিনিময়ে সেখান থেকেই পাওয়া শুরু হয়েছে বিষাক্ত বর্জ্য পানি। ওই পানি দূষিত হয়েছে শিল্পকারখানায়, হাসপাতালে এবং গৃহে। দূষিত পানি যাবে কোথায়? চলে এসেছে সৎ প্রতিবেশী ভ্রাতৃপ্রতিম বাংলাদেশে। (ডেইলি স্টার, ১১-০৯-২০)
বন্ধুত্বের এই নিদর্শন অবশ্য আরও প্রকৃষ্ট পরিমাণে পাওয়া যাচ্ছে ভারত- বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সীমান্তে। সেখানে নিয়মিত বাংলাদেশীরা নিহত হচ্ছে। চুক্তি আছে মারণাস্ত্র ব্যবহার না-করার। বন্ধুদের মধ্যে আবার অস্ত্রশস্ত্র প্রদর্শন কেন? কিন্তু তবু মারণাস্ত্রের ব্যবহার ঘটছে তো ঘটছেই। ভারতই ঘটাচ্ছে। থামাবার লক্ষণ নেই। হিসাব মতে, ২০১৯ সালে সীমান্তে ৪৩ জন বাংলাদেশী নিহত হয়েছেন, তাদের মধ্যে গুলিতে নিহত ৩৭ জন। আর এবছর জানুয়ারী থেকে আগস্টের মধ্যে (করোনাকালেই) নিহত হয়েছেন ৩৫ জন, গুলিতে ২৯ জন। চীন-ভারত সীমান্তে একজন ভারতীয় সৈন্য মারা গেলেও মহা হৈ চৈ পড়ে যায়। কাঁটাতারের বেড়াতে নিহত ফেলানীর ঝুলন্ত মৃতদেহটি কি ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের প্রতীক? কে জানে। সাক্ষী রইল ইতিহাস।
বলছিলাম যে বিদ্যাসাগরের সামাজিক ইচ্ছাটা ছিল সংস্কারের নয়, সামাজিক পরিবর্তনের। তবে সেই ইচ্ছাটা অবশ্যই ততোটা সুস্পষ্ট ছিল না যেমনটা ছিল তাঁরই সমসাময়িক জার্মানীর কাল মার্কসের। মার্কসের জন্ম ১৮১৮-তে, বিদ্যাসাগরের ১৮২০-এ; দু’বছরে ছোট-বড়। নানা দিক থেকেই দু’জনের ভেতর পার্থক্য বিস্তর। তুলনা অপ্রাসঙ্গিক ও অপ্রয়োজনীয়। কিন্তু মিল আছে এই জায়গাটাতে যে তাঁরা দু’জনেই ছিলেন সমাজে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের আবশ্যকতার বিষয়ে স্থিরনিশ্চিত। মার্কসের জগৎটা অনেক বড়। তিনি ছিলেন আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন, বিদ্যাসাগর ছিলেন জাতীয় পরিধিতে কর্মরত। মার্কস যে সুযোগ সুবিধাগুলো পেয়েছিলেন তাদের প্রায় কোনটিই উপস্থিত ছিল না বিদ্যাসাগরের জন্য। ১৮৫৭-তে যখন সিপাহী অভ্যুত্থান ঘটে মার্কস তখন লন্ডনে, বিদ্যাসাগর কলকাতায়। মার্কস দেখতে পাচ্ছেন যে ভারতবর্ষে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। বিদ্যাসাগর তখন বিব্রত তাঁর সংস্কৃত কলেজের ভবনটি কোম্পানীর সৈন্যদেরকে ছেড়ে দিতে হচ্ছে বলে; বলাবাহুল্য কলেজটি ছিল সরকারী। কলকাতা জুড়ে তখন কোম্পানীর লোকেরা আতঙ্ক ছড়াচ্ছে যে বিদ্রোহী সিপাহীরা এসে সমস্ত কিছু তছনছ করে দেবে। কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত তখন মহাউল্লাসে সিপাহী অভ্যুত্থানের মানুষদেরকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করছেন। বিদ্যাসাগর নিশ্চুপ ছিলেন। তবে হিন্দু-পেট্রিয়ট নামের যে পত্রিকাটি সিপাহীদের সমর্থনে লিখতো, বিদ্যাসাগর তাকে সমর্থন জুগিয়েছেন। পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যু ঘটলে (১৮৬১) তিনি পত্রিকাটির পরিচালনা ভার স্বহস্তে গ্রহণ করেছিলেন। বুঝতে পারি তাঁর পক্ষপাত কোনদিকে ছিল।
মার্কসের মতবাদকে কাজে লাগিয়ে বিপ্লব হয়েছে। এক দেশে নয়, অনেক দেশে। বিদ্যাসাগরের দেশে কোনো বিপ্লব হয় নি। কেন হলো না সেই কারণগুলো আমাদের ইতিহাসের মধ্যেই নিহিত রয়েছে। সেগুলোর অনুসন্ধান করা এবং স্মরণে রাখা আবশ্যক, যাতে আমরা সামনের দিকে এগুতে পারি। প্রথম কারণ, ভারতবর্ষ স্বাধীন ছিল না, ছিল ইংরেজদের উপনিবেশ। ইউরোপের যে ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে আধিপত্য কায়েম করে তাদের মধ্যে সবচেয়ে ধুরন্ধর ছিল এই ইংরেজ ঔপনিবেশিকরা। তারা ভারতবর্ষের মানুষদের মাতৃভাষার চর্চাকে কঠিন করে দিয়ে নিজেদের ভাষাকে তাদের উপর চাপিয়ে দিয়েছে। তারা এখানে একটি তাঁবেদার শ্রেণী তৈরী করে নিয়েছে যে-শ্রেণী সদা-সর্বদা ইংরেজদের অনুকরণ করবে, তাদের মাপে নিজেদেরকে মাপবে, যাদের বাইরের চেহারাটাই যা দেশী, ভেতরের চেহারাটা দাঁড়াবে ইংরেজদের; যারা জনবিচ্ছিন্ন তো হবেই, যাদের সার্বক্ষণিক দুশ্চিন্তা থাকবে দেশে যেন কোনো বিপ্লব না ঘটে, কারণ বিপ্লব ঘটলে তাদের সুযোগ-সুবিধাগুলোর ভিত্তিটাই যাবে চুরমার হয়ে। বঙ্কিমচন্দ্র সাধারণ মানুষ ছিলেন না, কিন্তু অসাধারণ ওই মানুষটি এই শ্রেণীর মুখপাত্র হিসেবেই তো তাঁর সেই স্পষ্ট ও দ্বিধাহীন কথাটা ফাঁস করে দিয়েছেন : “আমরা সামাজিক বিপ্লবের অনুমোদক নহি”। তাঁর সাহস ছিল বলবার।
অথচ এই শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীটিই তো ছিল নেতৃত্বে। বিশেষ ভাবে রাজনীতির ক্ষেত্রে। এরাই ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস গঠন করেছে, প্রতিদ্বন্দ্বী সর্বভারতীয় মুসলিম লীগও এই শ্রেণীরই তৈরী। কংগ্রেস ও লীগ দু’টোই ছিল জাতীয়তাবাদী দল। কংগ্রেস ভারতীয় জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী; শেষ পর্যন্ত যা পরিণত হয়েছিল হিন্দু জাতীয়তাবাদে; আর মুসলিম লীগ তো ঘোষিত রূপেই ছিল মুসলিম জাতীয়তাবাদী। এরা উভয়েই ক্ষমতা হস্তান্তর চেয়েছে, সামাজিক বিপ্লব চায় নি, বরঞ্চ উভয়েরই আজন্ম আগ্রহ ছিল সেই বিপ্লবকে প্রতিহত করবার। কমিউনিস্ট পার্টি কিছু পরে এসেছে, তবে সে পার্টির নেতৃত্বও ছিল এই শ্রেণীর হাতেই। সেটাই ছিল স্বাভাবিক। কমিউনিস্ট পার্টি সামাজিক বিপ্লবের জন্য লড়েছে, আর সেজন্যই সে পার্টি বিষনজরে পড়েছিল রাষ্ট্রশাসকদের তো বটেই, কংগ্রেস ও লীগ উভয় নেতৃত্বেরই। রাষ্ট্র ওই পার্টির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা সাজিয়েছে, দ্রুতগতিতে কারাবন্দী করেছে এর সংগঠকদের এবং কিছু পরে পার্টিকে একেবারে নিষিদ্ধই করে ছেড়েছে। কংগ্রেস ও লীগের লোকেরা বলেছে কমিউনিস্টরা বিদেশী মতাদর্শ প্রচার করেছে; ক্ষেত্রবিশেষে তারা গুজব রটিয়েছে যে কমিউনিস্টরা নাস্তিক। এসব কাজে কংগ্রেস ও লীগে কোনো বিরোধ ছিল না, তারা ছিল একাট্টা। ভাই ভাই। কমিউনিস্ট পার্টির নিজেরও দুর্বলতা ছিল। সে-দুর্বলতা কেবল যে সাংগঠনিক তা নয়, ছিল দার্শনিকও। মার্কসবাদকে লেনিন রাশিয়াতে এবং মাও সে তুঙ চীনে যে-রকম সৃষ্টিশীল ও বাস্তবসম্মত উপায়ে প্রয়োগ করেছেন ভারতীয় কমিউনিস্টরা সে-ভাবে প্রয়োগ করতে পারেন নি। তদুপরি তাঁরা নির্ভরশীল ছিলেন সোভিয়েট ইউনিয়নের পরামর্শের ওপর। বাস্তব অবস্থা বলছিল যে বিপ্লবের জন্য যেতে হবে কৃষকের কাছে। কারণ ভারতবর্ষ ছিল একটি কৃষিপ্রধান দেশ, শতকরা ৯০ জন লোকই যুক্ত ছিল কৃষিকাজের সঙ্গে। শ্রমিক শ্রেণী ছিল অত্যন্ত ক্ষীণ। কমিউনিস্ট পার্টি কৃষকের কাছে যে যায় নি তা নয়; কিন্তু সে- ভাবে যায় নি যে-ভাবে যাওয়াটা অত্যাবশ্যক ছিল। কৃষকদের সংগঠিত করতে পারে নি। তাদের সচেতন করে তুলতে পারে নি।
ভারতবর্ষ যেহেতু স্বাধীন ছিল না, তাই জাতীয় স্বাধীনতার প্রশ্নটাই তখন প্রধান হয়ে উঠেছিল। জাতীয় স্বাধীনতার সংগ্রামটা ছিল সাম্রাজ্যবাদবিরোধী। কিন্তু ভারতবর্ষের ভেতরেই একটা জাতিগত সমস্যা ছিল। সেটা এই যে, উপমহাদেশ এক জাতির দেশ ছিল না, ছিল বহু জাতির দেশ। সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের শোষণতান্ত্রিক- প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তুলে উপমহাদেশকে একটি এককে পরিণত করেছিল, কিন্তু তাতে জাতি-সমস্যার সমাধান হয় নি। দেশভাগের সময়ে উপমহাদেশে কমপক্ষে সতেরটি জাতি ছিল, যাদের প্রত্যেকের ছিল স্বতন্ত্র ভাষা ও সংস্কৃতি। কংগ্রেস বললো ভারতবর্ষ এক জাতির দেশ, তবে বলতে পারলো না সেই একজাতিত্বের ভিত্তিটা কি সেটা তো কেবল ভৌগোলিক বা প্রশাসনিক হতে পারে না, ভেতরের ঐক্য চাই। ঐক্যের সেই ভিত্তিটা শেষ পর্যন্ত এসে ঠেকলো ধর্মে। মুসলমানরা বললো আমরা কম কিসে? সংখ্যায়, রাষ্ট্রশাসনের ইতিহাসে, সংস্কৃতিতে, ঐতিহ্যে আমরা মর্যাদাবান, এবং আমরা একটি স্বতন্ত্র জাতি। তাই নিয়ে দ্বন্দ্ব। বিপ্লব ঘটবে কি, দাঙ্গাই ঘটলো; পরিণতিটা দাঁড়াল দেশভাগ। ক্ষতি হলো অনেকের, অনেক কিছুর, সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা ঘটলো সমাজ-পরিবর্তনকামী বিপ্লবী আন্দোলনের।
কংগ্রেস ও লীগ উভয়েরই কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে ছিলেন আইনজীবীরা। এঁরা আইন বেঝেন, আন্দোলনেও যান, কিন্তু আইনের দিকটা ভোলেন না। এবং পেশাগত কারণে সাধারণ মানুষের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারেন না, বেশীরভাগ ওঠাবসা তাঁদের সঙ্গেই যাঁরা মামলামোকদ্দমা করতে আসে। গান্ধী এবং জিন্নাহ দু’জনেই ব্যারিস্টার ছিলেন। গান্ধী প্রথম জীবনে দক্ষিণ আফ্রিকায় ওকালতি করলেও ভারতবর্ষে এসে আর ওদিকে যান নি, পুরোপুরি ও সার্বক্ষণিক রাজনীতিতে নিজেকে যুক্ত রেখেছেন। কংগ্রেসকে তিনি বৈঠকখানা ও সভাসমিতির দালানকোঠা থেকে বের করে জনগণের কাছে নিয়ে গেলেন, কিন্তু ভেতরে তিনি তাঁর আইনী শিক্ষাকে পরিত্যাগ করতে পারলেন না। প্রথমেই ডাক দিলেন ইংরেজের সঙ্গে অসহযোগিতার। তার এই আন্দোলনে যোগ দিল খেলাফতপন্থী মুসলিম নেতারা। কিন্তু গান্ধী আর যাই করুন সমাজ-বিপ্লবে বিশ্বাসী ছিলেন না। বরং তাঁর রাজনৈতিক কাজের ভেতরকার অঙ্গীকারটি ছিল বিপ্লবকে প্রতিহত করবার। তাই দেখা গেছে জনগণ যখন এগিয়ে গেছে তিনি তখন পিছিয়ে গেছেন। জনগণকে থামতে বলেছেন। চল্লিশের দশকে এসে গণঅসন্তোষ ও বিক্ষোভ যখন চরম আকার ধারণ করে তখন কংগ্রেস নেতৃত্ব ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনের ডাক দিয়েছে, কিন্তু পুলিশ এসে সঙ্গে সঙ্গে বড় নেতাদের সবাইকে গ্রেফতার করে ফেলেছে। আন্দোলন চলেছে। চালিয়েছে জনগণ। বিশেষত সমাজতন্ত্রীরা।
গান্ধী আন্দোলনে ব্যক্তিগত সত্যাগ্রহকে ও চরকাকে নিয়ে এসেছেন; এগুলো পরাধীন দেশকে স্বাধীন করার অস্ত্র নয়। গান্ধী অত্যন্ত ক্ষতিকর যে কাজটি করলেন তা হলো রাজনীতির সঙ্গে ধর্মকে খুব ভালোভাবে জড়িয়ে দেওয়া। ব্যক্তিগত আচরণে তিনি অসাম্প্রদায়িক ছিলেন, কিন্তু মতাদর্শিক ভাবে মোটেই ধর্মনিরপেক্ষ ছিলেন না; রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনায় তিনি সকল ধর্মের উপস্থিতি চাইতেন। সর্বোপরি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অসংশোধনীয় রূপে ভাববাদী। বিদ্যাসাগর যে ধর্মনিরপেক্ষতা ও ইহজাগতিকতার চর্চা চাইছিলেন গান্ধীর রাজনীতি ছিল তার একেবারে বিপরীত প্রান্তে। এবং সে-অবস্থান স্বভাবতই সামাজিক বিপ্লবের অনুকূলে নয়, বিপক্ষে বটে। সামাজিক বিপ্লবের জন্য মেহনতীদের এগিয়ে আসাটা দরকার ছিল। মেহনতীরা এগুতে চেয়েছে, কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টি যেহেতু শক্তিশালী ছিল না, তাই নেতৃত্ব চলে গেছে মূলত কংগ্রেসের হাতেই, যাদের কাজ ছিল আন্দোলনকে বিপ্লবের দিকে এগিয়ে যেতে না দিয়ে আপোসের পথে সবেগে পরিচালনা করা। ফলে দেশ প্রকৃত স্বাধীনতার দিকে না গিয়ে চলে গেছে ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসনের (ডমিনিয়ন স্ট্যাটাস) দিকে। এবং সাতচল্লিশে তো সেটাই পাওয়া গেলো।
তাত্ত্বিক ভাবে কমিউনিস্ট পার্টির এটা অজানা ছিল না যে, ভারতবর্ষ একটি বহুজাতিক দেশ; সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনের ভেতরে থেকেই সেই সত্যটাকে খেয়ালে রাখা এবং তাকে বিবেচনার বাইরে না-যেতে দেওয়াটা পার্টির রাজনৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য ছিল। কিন্তু সে কাজটি তারা করতে পারে নি। ফলে জাতি-সমস্যা সাম্প্রদায়িক সমস্যার চেহারা নিয়েছে, হিন্দু ও মুসলিম দুই সম্প্রদায় দুই জাতির হিসেবে দাঁড়িয়ে গিয়ে পারস্পরিক দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়েছে, সুবিধা হয়েছে ইংরেজ শাসকদের, কারণ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াইটা সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের গলিপথে ঢুকে পড়ে তার সংগ্রামী শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। ইংরেজ শাসকেরা ভারতবর্ষকে দু’টুকরো করে তাদের প্রতি মিত্রভাবাপন্ন দুই রাজনৈতিক দলের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা তুলে দিয়েছে।
গান্ধী ও লেনিন একই সময়ে নিজ নিজ দেশের সার্বক্ষণিক রাজনৈতিক সংগ্রামে যুক্ত হয়ে ছিলেন। কিন্তু তাঁদের লক্ষ্য ছিল পরস্পরের বিপরীত। গান্ধী চাইছিলেন সংস্কার, লেনিন চাইছিলেন বিপ্লব। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় গান্ধী যখন ইংরেজের সঙ্গে সহযোগিতার উপায় খুঁজছেন, লেনিন তখন সচেষ্ট রয়েছেন যুদ্ধে-সৃষ্ট বিক্ষোভ ও অভাবকে বিপ্লবের পথে নিয়ে যেতে। তাঁরা দু’জনেই সফল হয়েছেন। ভারতবর্ষে বিপ্লবের সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে গেছে, রাশিয়াতে বিপ্লব ঘটেছে। ইংরেজের শাসনটা আমলাতান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী ছিল, ভারত ও পাকিস্তানের নেতারাও পুঁজিবাদী পথেই অগ্রসর হয়েছেন। উন্নতি ওই পথেই ঘটেছে। পথটা স্বাস্থ্যের নয়, অসুখের। যে অসুখের আপাত-সর্বশেষ বৈশ্বিক প্রকাশ করোনাভাইরাসের তাণ্ডব।
৫
বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যের যে রূপটি স্থির করে দিলেন সেটিকে বলা হয় সাধুরীতি, বিপরীতে রয়েছে চলতি রীতি। বিদ্যাসাগর চেয়েছেন সাহিত্য ভদ্র গোছের হবে (ইংরেজীতে তিনি বলেছেন elegant)। সেই ভদ্রধারাটিই কিন্তু রয়ে গেছে। চলতি রীতি এসেছে, কিন্তু তা মুখের ভাষার কাছাকাছি আসে নি। ভদ্র বলতে বিদ্যাসাগর সৌন্দর্য ও সমৃদ্ধ গদ্যই বুঝেছিলেন। ভদ্রলোকদের হাতে পড়ে সে গদ্য সুন্দর ও সমৃদ্ধ হয়েছে অবশ্যই, তবে ভদ্রভাবে। ‘না’ অব্যয় ক্রিয়ার আগে না-বসিয়ে পরে বসাবার রীতি বাংলা গদ্যে চালু আছে। সপ্তদশ শতাব্দীর যে কবি, আবদুল হাকিম বঙ্গভাষার চর্চার পক্ষে লিখেছিলেন তিনি কিন্তু ‘না’কে ক্রিয়াপদের পরে বসান নি, বসিয়েছেন আগে : “যে সবে বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী।/ সে সবার কি বা রীতি নির্ণয় না জানি।” ভদ্রলোকদের পক্ষে ‘না’ বলাতে যে সংকোচ আছে, ‘না’-এর অবস্থান পরিবর্তন যেন তারই প্রতিফলন। অথচ ‘না’ বলাটা খুবই জরুরী। মনে মনে আমরা অনেক সময়েই না বলি, কিন্তু মুখে বলতে পারি না। ভদ্রতায় বাধে; বোধকরি সাহসেও। অনেকবারই আমাদের এদেশ বিদেশীরা দখল করে নিয়েছে, তাদেরকে না বলা হয় নি। আবার দেখি সংগঠনের সদস্যদেরকে ‘সভ্য’ বলা হয়। বামপন্থী রাজনৈতিক দলের সদস্যদেরকেও। সদস্যরা অত বেশী সভ্য-না হলেই ভালো, তাতে সংগঠনের শক্তি বাড়ে। সংবাদপত্রে সকলকেই আপনি বলা চলছে; সকলেই ‘করেন’, ‘বলেন’, ‘ছিলেন’; এমন কি গুরুতর অপরাধীরাও ‘সে’ থাকে না ‘তিনি’ হয়ে যান। তার অপরাধ-কর্মের বিবরণটিও ‘ন’-এর সংযুক্তি পেয়ে যায়। সর্বনামের আপনি, তুমি, তুই, এই তিন রূপও বদলায় নি। এগুলো সবই সামাজিক ব্যাকরণ দ্বারা স্থিরকৃত ও নিয়ন্ত্রিত। অনেক কিছুই বদলেছে, রাষ্ট্রের ভাঙাগড়াও ঘটেছে, কিন্তু সমাজে যে কোনো বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে নি তার প্রমাণ বহুবিধ বৈকি।
সাহিত্যও সেই ভদ্রগোছেরই রয়ে গেলো। বাংলা সাহিত্য অনেক এগিয়েছে, কিন্তু কৃষককে তার প্রাপ্য জায়গাটির ব্যবস্থা করে দিতে পারে নি। মেহনতীদের উপস্থিতিও খুবই কম। এ সাহিত্য ভদ্রলোকেরাই লেখে, ভদ্রলোকদের জন্য। সাহিত্যিক রুচিটাও ভদ্রলোকদেরই। তাই দেখা যায় সাহিত্যবিচারে দর্শন ও ইতিহাসের বিবেচনাটা আসতে চায় না। অথচ দর্শন ছাড়া তো সাহিত্য নেই। সাহিত্যরচয়িতারা শুধু যে দেখেন তা নয়, তাঁরা ভাবেনও, গভীর ভাবেই ভাবেন। যে জন্য কোনো সাহিত্যই মহৎ হয় না যদি না তাতে গভীর চিন্তা থাকে। সে-চিন্তা আসে অন্তর্দৃষ্টি, অভিজ্ঞতা ও কল্পনা শক্তি থেকে। সাহিত্য তাই কখনোই আদর্শনিরপেক্ষ নয়। দ্বিতীয়ত, সাহিত্য রচিত হয় ইতিহাসের ভেতর থেকেই। অন্যসব মানুষের মতোই সাহিত্যিকও বাস করেন একটি নির্দিষ্ট সময়ে, সমাজব্যবস্থায় ও শ্রেণীতে। সেটাই হচ্ছে ইতিহাস। কিন্তু বাংলা ভাষায় সাহিত্য সমালোচনা ওই সত্যগুলোর অন্বেষণটা কম। সাহিত্যের বিচারে ‘রস’-এর কথা, সৌন্দর্যের কথা, আনন্দের কথাই বেশী বেশী করে থাকে; পড়লে মনে হয় সাহিত্য বুঝি এক প্রকারের মিষ্টান্ন, সাহিত্যস্রষ্টারা বুঝি ময়রা। কিন্তু সাহিত্যপাঠের আনন্দ তো মিষ্টান্নভোজের সুখ নয়। সাহিত্যের আনন্দ কল্পনা করবার, ভাববার ও অনুভব করবার। সাহিত্য পড়ে আমাদের কল্পনার, অনুভবের ও চিন্তাশক্তির বৃদ্ধি ঘটে। তাছাড়া এটাও তো বাস্তবিক সত্য যে, অতিরিক্ত মিষ্টান্নভোজন স্বাস্থ্যের জন্য মোটেই মঙ্গলজনক নয়। সাহিত্যসমালোচনা ও সাহিত্য পাঠদানের ক্ষেত্রে নান্দনিক বিচারের সঙ্গে সঙ্গে তাই মতাদর্শিক বিবেচনাটাও আনা চাই। শব্দের গুণ, উপমার তাৎপর্য, আঙ্গিকের ব্যবহার, এসব তো বিবেচনাতে থাকবেই; কিন্তু শব্দ তো কেবল শোনার ব্যাপার নয়, শব্দের ধ্বনির সঙ্গে অর্থ থাকে, শব্দব্যবহারের পেছনে লেখকের রুচির পাশে দৃষ্টিভঙ্গিও থাকে। গভীরতা না থাকলে সাহিত্য তো হয়ে দাঁড়ায় শব্দের দোকানদারি।
নতুন দিগন্ত জানুয়ারী-মার্চ ২০২১ সংখ্যায় প্রকাশিত। (সম্পাদকীয় ১৩-২৫ [২-৫])
কোন মন্তব্য নেই
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন