ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

মাইকেল মধুসূদন দত্ত

বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে।
করুণার সিন্ধু তুমি, সেই জানে মনে,
দীন যে, দীনের বন্ধু!—উজ্জ্বল জগতে
হেমাদ্রির হেমকান্তি অম্লান কিরণে।
কিন্তু ভাগ্যবলে পেয়ে সে মহা পর্বতে,
যে জন আশ্রয় লয় সুবর্ণ চরণে,
সেই জানে কত গুণ ধরে কত মতে
গিরীশ। কি সেবা তার সে মুখ সদনে।—
দানে বারি নদীরূপ বিমলা কিঙ্করী;
যোগায় অমৃত ফল পরম আদরে
দীর্ঘশিরঃ তরুদল, দাসরূপ ধরি;
পরিমলে ফুলকুল দশ দিশ ভরে;
দিবসে শীতল শ্বাসী ছায়া, বনেশ্বরী,
নিশার সুশান্ত নিদ্রা, ক্লান্তি দূর করে!

‘আমার লেখা আর আমার জীবন, দুটোই তোদের পড়তে হবে’

বিদ্যাসাগরের দ্বিশত জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে তাঁর সঙ্গে কাল্পনিক কথোপকথনে পবিত্র সরকার। সেই অগ্নিচক্ষু ব্রাহ্মণের সামনে দাঁড়িয়ে কাঁপছিলাম আমি। তিনি কোমল স্বরে বললেন, ‘আগে বল্‌, আমাকে নিয়ে এখন তোরা কী ভাবছিস?’
—পবিত্র সরকার


‘বিদ্যাসাগর, আপনি আমাদের প্রণম্য, তবু আপনাকে নিয়ে আমরা বেশ ভয়ে ভয়ে থাকি। হ্যাঁ, আমরা জানি যে, যতবার আমরা আপনার মূর্তির মাথা ভাঙি বা নতুন মূর্তি বসাই, বা আপনার নামে সেতু করি, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় করি, তাতে আপনার কিছু এসে যায় না। আপনি যা ছিলেন আপনি তাই থাকবেন। কোথায় থাকবেন, কার কাছে? আমাদের স্মৃতির কুলুঙ্গিতে, দ্বিশত জন্মবার্ষিকীর ধুপধুনোয় আচ্ছন্ন হয়ে হাঁচি-কাশিতে বিপর্যস্ত, না কি মুদ্রিত গ্রন্থে মলাটবদ্ধ ও দূরবর্তী, যা আমরা খেরোর কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখব। আপনিই বলে দিন, আপনাকে নিয়ে আমরা কী করব।’

সেই অগ্নিচক্ষু ব্রাহ্মণের সামনে দাঁড়িয়ে কাঁপছিলাম আমি। তিনি কোমল স্বরে বললেন, ‘আগে বল্‌, আমাকে নিয়ে এখন তোরা কী ভাবছিস?’

আমি বললাম, ‘অন্যেরা কে কী ভাবে জানি না, আমি এইটা ভেবে অবাক হয়ে যাই যে, মেদিনীপুরের এক এঁদো গ্রামের ছেলে আপনি, আপনার বাপ-ঠাকুরদারা কেউ বড় বা বিখ্যাত লোক ছিলেন না, তবু আপনি আপনার জীবনে কী করে এমন উঁচুতে উঠলেন যে বলতে পারলেন, এ দেশে এমন বড়লোক নেই যে, যার নাকের সামনে এই চটিজুতো না নাচিয়ে পারি। আপনি বেঁটেখাটো মানুষ, কিন্তু আপনার মাথা সকলের মাথা ছাড়িয়ে উঠল কেমন করে? শুধু মেধার জোরে? ‘বিদ্যাসাগর’ পদবি তো সংস্কৃত কলেজে কত ছাত্রই পেয়েছিল?

বিদ্যাসাগর বললেন, ‘মেধা-টেধা শুধু নয় রে। আমার একটা প্রচণ্ড জেদ ছিল। পড়াশোনাটাও আমার একটা জেদ। এটা অনেকটা আমার একার লড়াই, সে আমি লড়ব।এটা হয়তো আমার বাপ-ঠাকুরদার ধারা। আমার ঠাকুরদাডাকাতদের পিটিয়েছিলেন আর ভালুকের সঙ্গে লড়াই করেছিলেন জানিস তো! বাবা যখন ১৮২৮ সালে আমাকে কলকাতা নিয়ে এলেন তখনই আমার মনে হল, ওরে ঈশ্বর, তুই রাজধানীতে এসেছিস, তার মানে এখন তুই আর সেই পাড়াগাঁর বাসিন্দে নোস, তুই সারা পৃথিবীর নাগরিক। তোকে একটা কোথাও পৌঁছতে হবে। শুধু তোর নিজের জন্য নয়। তোর বাবা না-খেয়ে, আধপেটা খেয়ে তোকে মানুষ করতে কলকেতায় এনেছেন, তোর মা-ঠাকুমা গ্রামে বসে তোর জন্য চোখের জল ফেলে, তাদের মুখ রাখতে হবে।’

‘এই জেদটারই অন্য চেহারা হল তো ‘দুর্জয় সাহস’,রবীন্দ্রনাথ যে কথাটা বলেছেন, বলেছেন যেটা আপনার চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য।’ আমি বললাম। এই সাহস কি আজ আমরা কেউ দেখাতে পারি? আমাদের কত ভয়, কত লোভ। বিশ্বায়ন এসে আমাদের জেদের শেকড়সুদ্ধ উপড়ে ফেলেছে মনে হয়। কোটি কোটি টাকার হাতবদল হচ্ছে, দলবদল হচ্ছে, ঘুষ, তোলা, কাটমানিতে ছয়লাপ দেশ। আমাদের জেদের আর সাহসের শিরাটা কেউ যেন কেটে নিয়ে গেছে। আমরা কী করব আপনাকে নিয়ে?’

বিদ্যাসাগর এবার ধমকে উঠলেন। ‘হতভাগারা, আমি বলে দেব, সেই আশায় তোরা বসে আছিস! জেদ আর সাহস ধার করা যায় নাকি এক ধামা চালের মতো, টাকার মতো! নিজেদের ভেতর থেকে যদি জেদ আর সাহস উদ্ধার করতে না পারিস তো যা মর্‌-গে যা!’

আমি হাল ছাড়লাম না। বলতে লাগলাম, ১৮৪১-এ আপনি কলেজ থেকে বিদ্যাসাগর হয়ে বেরলেন, বলুন তো কী করে তখন বাংলার সমাজের সেই যে এলিটস্য এলিট, সেই দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নজরে পরলেন? গাঁয়ের ছেলে এতটা সিঁড়ি ভাঙল কী করে? এটাও আমাদের কাছে একটা অদ্ভুত ব্যাপার!’

‘সেটা বোধ হয় একটু আধটু বাংলা লিখতে পারতুম বলে। ঠাকুরমশায় তখন ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকা বার করছেন, অক্ষয়কুমার দত্ত আর আমাকে তার কাজে লাগিয়ে দিলেন। অক্ষয়ও বেশ ভাল বাংলা লিখত। তোদের এখনকার তুলনায় আমাদের বাংলা একটু খটোমটো মনে হবে, কিন্তু তখন ওইটেই ছিল চল।’

‘এখানেও আমার আশ্চর্য লাগে যে, দেবেন্দ্রনাথের কাছে গিয়েও আপনি ব্রাহ্ম হলেন না। আসলে আপনি কী ধর্ম মানতেন তা নিয়ে বাঙালি খুব ধাঁধায় আছে।’

বিদ্যাসাগর খানিকটা ‘হ্যা-হ্যা’ করে হাসলেন, যেন বিষয়টায় দারুণ মজা পেয়েছেন। বললেন, ‘হ্যাঁ, এখন ধম্মো ধম্মো করে হদ্দ হয়ে গেলি তোরা। ঠাকুরে ঠাকুরে গুরুদেবে গুরুদেবে জ্যোতিষে আংটিতে পাথরে তাগায় ধুন্ধুমার। বাপের জন্মে শুনিনি বাঙালি গণেশের বারোয়ারি করছে। এখন পুজোর আগে খুঁটিও হয়েছে তোদের একঠাকুর, তারও পুজো কচ্চিস।’

‘কিন্তু আপনার ধর্ম?’ আমার নাছোড়বান্দা প্রশ্ন।

‘আমার আবার ধর্ম কী? আমার ধর্ম মানুষ! আমি নেহাত পইতে ছাড়তে পারিনি, কিন্তু বাড়িতে পুজো-আচ্চার ধার-ধারিনি। ছেলেবেলার পর সন্ধ্যাআহ্নিকও ছেড়ে দিয়েছিলুম। গুরুমন্ত্র নিইনি, তেত্থ-মেত্থ কিচ্ছু করিনি। কাশীতে গেছি বাবা-মাকে দেখতে, বিশ্বনাথের মন্দিরমুখো হইনি। পাণ্ডারা এসে অভিযোগ করায় বাবা-মাকে দেখিয়ে বলেছি, এই আমার বাবা বিশ্বনাথ, এই আমার মা অন্নপূর্ণা। ছাড় ওসব কথা!’

আমি বললাম, ‘না ছাড়ব কেন? আপনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন না?’

‘আরে ঈশ্বর যদি থাকতেন তবে তিনি মানুষের এত দুঃখ কষ্ট সইতেন? দিল্লিতে নাদির শা এক লক্ষ বন্দির গলা কচাকচ কেটে নিল, তোদের ঈশ্বর সেটা দেখতে পারলেন? দেখে কী ঘেঁচুটা করলেন? ১৮৬৬ সালে উড়িষ্যায় (এখন তো আবার ওডিশা হয়েছে) দুর্ভিক্ষ হল, হাজার হাজার লোক মরল, ঈশ্বর সেটা দেখলেন তো? কই, একটা লোককে বাঁচাবার জন্য তো তিনি আঙুল তুললেন না! তোদের ঈশ্বর নিয়ে তোরা ধুয়ে খা, দেবদেবী নিয়ে উচ্ছন্নে যা। মানুষ কষ্ট পেতে থাক, মানুষ মরতে থাক।’

‘আপনাকে এমন কালাপাহাড় করলে কে? অক্ষয়কুমার দত্ত?’

বিদ্যাসাগর আবার জোরে হেসে উঠলেন। বললেন, ‘হ্যাঁ, সে একটা নাস্তিক ছিল বটে! তত্ত্ববোধিনীর সভায় বোর্ডে গণিতের সমীকরণ লিখলে, পরিশ্রম + প্রার্থনা = শস্য। মানে এক বছরে চাষি পরিশ্রম করলে খুব, ভগবানের কাছে প্রার্থনাও করলে, তাই খুব শস্য হল। তার পরের বছর শুধু পরিশ্রম করলে, তাতেও খুব ফসল পেল, মানে পরিশ্রম = শস্য। কাজে কাজেই তার সিদ্ধান্ত হল প্রার্থনা =০, মানে প্রার্থনায় কাঁচকলা হয়।’ বলে আবার বললেন, ‘জানিস তো, এক সভায় সে ভোটের জোরে পাস করিয়ে নিয়েছিল যে ঈশ্বর নেই।’ বলে আবার ‘হ্যা হ্যা’ করে হাসলেন কিছুক্ষণ। তার পর হাসি থামিয়ে বললেন, ‘না রে, জীবনে আমি যাঁকে সবচেয়ে বেশি ভক্তি করতুম সেই আমার মায়েরও তেমন ধর্মের বাই ছিল না। একবার বাবা বাড়িতে জগদ্ধাত্রী পুজো করতে চাইলেন তো মা বললেন, তো ওই খরচে গাঁয়ের গরিবদের কম্বল দেওয়া হোক, পুজোয় কাজ নেই।’

আমি বললাম, ‘কিন্তু আপনার দয়া আর দানধ্যান? সে কথা তো এখনও লোকের মুখে মুখে ফেরে!’

বিদ্যাসাগর জিভ কেটে কানে আঙুল দিলেন। বললেন,‘ছি ছি, ও সব আমার শুনতে নেই। মানুষকে ভালবাসতাম, আমার মা যেমন বাসতেন, তাই লোকের কষ্ট দেখলে অস্থির লাগত। তা সে নিজের ব্যক্তিগত ব্যাপার। তোরা মানুষকে সাহায্য করবি কি না সে কি আমি বলে দেব? না আমার জন্মের দুশো বছর পড়লে সক্কালবেলায় সংকল্প নিবি যে, না, বিদ্যাসাগর করে গেছে তাই গরিব আর দুঃখী মানুষকে সেবা করতে হবে! মেয়েরা তো আমাদের সমাজে আরও দুঃখী ছিল—বেধবারা, সেই মেয়েরা, যাদের বাচ্চা বয়সে বে দেওয়া হত। তা তাদের কথা যে ভাববে নে সে মানুষ নাকি?’

আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘আর শিক্ষা?’

বিদ্যাসাগর বললেন, ‘শিক্ষা কী? কথাটা পরিষ্কার করে বলবি তো? দ্যাখ্‌, আমার সময়ে সবাই বুঝেছিল, ওই তোরা যাকে আজকাল ‘ক্ষমতায়ন’ না কী বলিস, তার প্রধান উপায় হচ্ছে শিক্ষা। বড়লোকদের চেয়ে গরিবদের তা অনেক বেশি দরকার, মেয়েদের তা অনেক বেশি দরকার। তাই, শুধু বেধবার বে নয়, তার আগেই আমি ঝাঁপিয়ে পরেছিলুম মেয়েদের শিক্ষায়, পরে মেট্রোপলিটন সুদ্ধ এখানে-ওখানে গাদা গাদা ইশকুল বসালুম। কী করতে? যে না, শিক্ষা পেলে ছেলে মেয়ে দু’য়েরই লাভ হবে। ‘বর্ণপরিচয়’ লিখলুম। কে একজন পণ্ডিত নাকি বলেছে আমি ব্রিটিশ রাজের জন্য সুবোধ প্রজা তৈরি করার জন্য লিখেছি। মিথ্যে কথা। কলকাতার বড়লোকের ছেলেরা সব বখে যাচ্ছিল, মাইকেলের ‘একেই কি বলে সভ্যতা’, দীনবন্ধুর ‘সধবার একাদশী’ পড়েছিস তো! তাই ভাল ছেলের একটা আদল দিতে চাইছিলুম।’

আমি বললুম, ‘আপনি নিজে তো মোটেই আপনার গোপালের মতো ভাল ছেলে ছিলেন না!’

বিদ্যাসাগর হেসে বললেন, ‘তবেই বোঝ্‌! আমার লেখা আর আমার জীবন—দুটোই তোদের পড়তে হবে, তোদের রবিঠাকুর যা করেছিল।’

বিদ্যাসাগর বললেন, ‘ওই সময়ে সমাজে, শিক্ষায়—কতকগুলো কাজের দরকার ছিল। শুধু আমি কেন, অনেকেই এগিয়ে এসেছিল। এখন তোদের হাজার হাজার ইশকুল কলেজ হয়েছে, শুধু মেয়েদের কত বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে। কিন্তু পড়তে গেলে হাজার হাজার টাকা লাগছে। হ্যাঁ রে, দেশের সব লোক কি বড়লোক হয়ে গেছে? আর কে কী শিখছে তা যাচাই করেছিস?’

আমি কথা ঘোরাবার জন্য বললাম, ‘আর আপনার লেখা বই? কত কত লেখা! আপনি সাহিত্যের গদ্য তৈরি করে দিলেন!’

বিদ্যাসাগর বললেন, ‘সে তোরা পণ্ডিতেরা বলবি ভাষা নিয়ে ছাইভস্ম কী করেছি। তবে আমিই তো শেষ কথা না, পরে কত বড় বড় লেখক হয়েছে বাংলায়। তাই তো হয়!’

আমি বললাম, ‘আর শেষে আপনার একা হয়ে যাওয়া? তা কেন হল? কলকাতা ছেড়ে সতেরো বছর কর্মাটাঁড়ে নির্বাসনে কাটানো?’

বিদ্যাসাগর একটু সময় নিলেন উত্তর দিতে। বললেন, ‘নিজের সত্যকে বুকে নিয়ে তুই সময়ের বিরুদ্ধে যা, সকলের বিরুদ্ধে যা, প্রচলনের বিরুদ্ধে যা—তোকেও একা হতে হবে। তাতে কী হল? হাল ছেড়ে দিবি নাকি? তা হলে আমার দু-শো বছর মেনে তোদের কাজ নেই বাপু।’

২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯ খ্রীস্টাব্দে প্রকাশিত।


কোন মন্তব্য নেই

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন

vidyasagar.info ©