ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

মাইকেল মধুসূদন দত্ত

বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে।
করুণার সিন্ধু তুমি, সেই জানে মনে,
দীন যে, দীনের বন্ধু!—উজ্জ্বল জগতে
হেমাদ্রির হেমকান্তি অম্লান কিরণে।
কিন্তু ভাগ্যবলে পেয়ে সে মহা পর্বতে,
যে জন আশ্রয় লয় সুবর্ণ চরণে,
সেই জানে কত গুণ ধরে কত মতে
গিরীশ। কি সেবা তার সে মুখ সদনে।—
দানে বারি নদীরূপ বিমলা কিঙ্করী;
যোগায় অমৃত ফল পরম আদরে
দীর্ঘশিরঃ তরুদল, দাসরূপ ধরি;
পরিমলে ফুলকুল দশ দিশ ভরে;
দিবসে শীতল শ্বাসী ছায়া, বনেশ্বরী,
নিশার সুশান্ত নিদ্রা, ক্লান্তি দূর করে!

সংস্কৃতজ্ঞ হয়েও পাশ্চাত্য দর্শন গ্রহণে দ্বিধা ছিল না

শিক্ষা সংস্কার করে আধুনিক যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা পদ্ধতি প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে নিজেকে উজাড় করে দেন ঈশ্বরচন্দ্র। বিদ্যাসাগরের জন্ম দ্বিশতবর্ষ লিখছেন কাকলি ভৌমিক
—কাকলি ভৌমিক


ভারতীয় দর্শনের মধ্যে চার্বাক দর্শনই হল স্বতন্ত্র ও ব্যতিক্রমী ধারা। ভারতীয় দর্শন মূলত অধ্যাত্মবাদের দর্শন, তাই এই প্রকার দর্শনের প্রচলিত বা সর্বজনবিদিত দিকটি চার্বাকবাদীরা অনুসরণ করেননি। চার্বাক দর্শন নাস্তিক ও জড়বাদী। ভারতীয় দর্শনিকদের ধারণা অনুযায়ী মোক্ষ লাভের জন্য যে জ্ঞানচর্চা, সেটিই আসল দর্শন। চার্বাক মত এই মোক্ষলাভকেই সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন জগতের অন্তিম উপাদান হল জড় এবং জড় থেকেই এই জগতের উৎপত্তি। অজড় বলে এ জগতে কিছু নেই। দেহাতিরিক্ত আত্মাও নেই, পাপ-পুণ্য কিছুই নেই, তাই কর্মফল, মুক্তি এ সব কিছুই নেই।

চার্বাকদের এই অধ্যাত্মবাদের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ প্রতিবাদকে সঠিক ভাবে আত্মস্থ করতে পেরেছিলেন যুগপুরুষ বাংলা ভাষা তথা সমাজের উন্নতির পথপ্রদর্শক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তাঁর নিজের মননের সঙ্গে চার্বাক মতবাদের অনেকাংশেই যে মিল রয়েছে, তা তিনি আত্মোপলব্ধি করেছিলেন। ধর্মের নামে অধর্মাচার সামাজিক প্রথার নামে মানুষের উপর অত্যাচার ও অযৌক্তি ভাবে কোনও চিন্তাধারাকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার ঘোরতর বিরোধী ছিলেন তিনি। নিজে সংস্কৃত ভাষার পণ্ডিত হয়েও পাশ্চাত্যের জ্ঞান, বিজ্ঞান ও দর্শন তত্ত্বের মধ্যে বিচরণ করতে দ্বিধা করেননি। ইংরেজি ভাষাও আয়ত্ত করেছিলেন যথার্থ রূপেই। আবার, পাশ্চাত্য বস্তুবাদী দর্শনের সংস্পর্শে আসার অনেক আগেই প্রাচ্যের দর্শন শাস্ত্রের গভীরে প্রবেশ করেন বিদ্যাসাগর। সেই সূত্রেই ভারতীয় ভাববাদী দর্শনতত্ত্ব আয়ত্ত করার পাশাপাশি— “দুই মেরুর এই ভারতীয় দর্শন অধ্যায়ন করে তাঁর যুক্তিবাদী মন বেদান্ত-সহ ভাববাদী দর্শনগুলিকে নাকচ করে দেয় এবং গ্রহণ করে বস্তুবাদী দর্শনের সারবস্তু।”

আর সেই চিন্তাধারাতেই অর্জিত হয়ে তিনি বিশ্বাস করতেন ঈশ্বর বাক্‌পথের অতীত, অবাঙমনসগোচর, জীব সেবাই তাঁর কাছে ঈশ্বরসেবা। তিনি মনে করতেন নরের সেবার মাধ্যমেই লাভ করা যায় নরোত্তমকে। হিন্দু দর্শনের সীমাবদ্ধতা বিষয়ে তিনি সচেতন ছিলেন, জ্ঞাত ছিলেন যে দর্শনের বিচার বুদ্ধি আশ্রয়ী। এই বুদ্ধি আশ্রয়ী দর্শন কি ঈশ্বরের অনুভূতির সহায়ক হতে পারে? এই দৃষ্টিকোণ থেকেই তিনি বেদান্ত ও সাংখ্যদর্শনকে ভ্রান্ত বলেছেন।

মানবদরদী দয়ার সাগর ঈশ্বরচন্দ্র তাই কখনই ঈশ্বরের নিষ্ঠুরতায় বিশ্বাস করেননি। মানুষের প্রতি নিষ্ঠুরতা, প্রেমহীনতা থাকলে সেই পরিপ্রেক্ষিতে তিনি ঈশ্বরকে সন্দেহ করবেন। কিন্তু তার জন্য এই বক্তব্য কখনই সঠিক নয় যে তিনি ঈশ্বরবিশ্বাসী নন। আবার, ঈশ্বর বিশ্বাস বলতে শুধুই যদি ধর্মাচরণ হয় তবে সেই ধর্মবিশ্বাসে তিনি ঈশ্বরবিশ্বাসী নন। উনবিংশ শতকের মানবিকতার বোধই তাঁর ঈশ্বরচিন্তা, মধ্যযুগীয় অন্ধবিশ্বাস ও ধর্মীয় হানাহানির মধ্যে নয়। এই বাস্তববাদী ও যুক্তিবাদী চিন্তার বিকাশের জন্যই তিনি সর্বসাধারণের মননের বিকাশ ঘটাতে চেয়েছিলেন।

তিনি বুঝেছিলেন সাধারণ মানুষের চক্ষু উন্মোচন না হলে, চিন্তার বিকাশ ঘটবে না। আসলে তাঁর চরিত্রে নানা বিরুদ্ধ গুণের সমাবেশ ঘটেছিল। তিনি বেদান্ত দর্শন, ন্যায়, জ্যোতিষশাস্ত্র, ধর্মশাস্ত্র প্রভৃতি পাঠ করেছিলেন বলেই এই সব শাস্ত্রের অন্তর্রহস্য তাঁর চরিত্রকে প্রভাবিত করেছিল। এক জন ভবিষ্যৎদ্রষ্টা হিসেবে তিনি সমাজ বিকাশের গতিমুখকে আধুনিক যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞানভিত্তিক সাংস্কৃতিক চেতনার দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। শিক্ষাকে এবং শিক্ষাব্যবস্থাকে এই সংস্কারের বেড়াজাল থেকে মুক্ত করে, কূপমণ্ডুক গোঁড়া পণ্ডিতদের আঙ্গিনা থেকে বের করে এনে যুক্তিবাদী বিশ্ববিজ্ঞান ও সংস্কৃতির কেন্দ্রস্থলে সুপ্রতিষ্ঠিত করার সার্বিক প্রচেষ্টায় তিনি সচেষ্ট হয়েছিলেন।

“মায়াবাদী পিছুটানের প্রবণতা যে কতখানি বিপজ্জনক তা বুঝতে পেরেছেন বলেই বিদ্যাসাগর অধিবিদ্যার কলঙ্কমুক্ত এক নতুন স্লেটে অখণ্ড এক সংস্কৃতির বর্ণ-পরিচয় ঘটাতে চেয়েছিলেন। এই সমস্যাটাকে এদেশে তাঁর যুগে তো বটেই, তার পরেও কয়জন এত গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছেন জানি না।”

তিনি বেশ কয়েকটি সংস্কৃত গ্রন্থ রচনা ও সম্পাদনা করেছিলেন। মাধবাচার্যের ‘সর্বদর্শন সংগ্রহ’ তার মধ্যে একটি বিখ্যাত গ্রন্থ। চার্বাক দর্শনের ভাব যার মধ্যে বিদ্যমান। এই চার্বাক দর্শনের কথা খ্রিস্টিয় পাঁচ শতক থেকে উপলব্ধি করা গিয়েছিল। তার পর এই দর্শন বস্তুবাদী দর্শনের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে নানা ভাবে মানুষের মনে জায়গা করে নেয়। বিদ্যাসাগর এই চার্বাক দর্শন চর্চাতেই নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছিলেন এমন কথা বলার আবশ্যক নেই। তবে এই দর্শন বিষয়েও যে তাঁর জ্ঞানের পরিধি ও গভীরতা যথেষ্ট পরিমাণে ছিল তা-ও অস্বীকার করা যায় না। তাঁর সম্পাদিত ‘সর্বদর্শন সংগ্রহ’ প্রকাশের পরই বাংলা তথা ভারতে এমনকী, বিদেশেও চার্বাক দর্শন তথা বস্তুবাদী দর্শনের মূল ভাব প্রকাশ পেয়ে যায়। এই গ্রন্থটি থেকেই দেশে ও বিদেশে প্রাচীন ভারতের আপসহীন, নিরীশ্বরবাদী বেদবিরোধী ও বস্তুবাদী দর্শন সম্পর্কে জনগণ অবগত হতে পারলেন। এর পূর্বে চার্বাক দর্শন সম্পর্কে আধুনিক পণ্ডিতদেরও ধারণা ছিল খুবই অল্প। ১৮৫৩-১৮৫৮ সালের মধ্যে ‘সর্বদর্শন সংগ্রহ’ সম্পূর্ণ রূপে প্রকাশ পায়। এই সময়ে বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত থাকায় এই কলেজের শিক্ষা সংস্কার করে আধুনিক যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা পদ্ধতি প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে নিজেকে উজাড় করে দেন। পাশাপাশি যুক্তিহীন কুসংস্কারাচ্ছন্নতার বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিয়ে বস্তুবাদী ও যুক্তিগ্রাহ্য দর্শনে আগ্রহী হন।

একদা স্বয়ং শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণদেব ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়কে প্রশ্ন করেছিলেন যে, ঈশ্বর সম্বন্ধে তিনি কী ভাবেন? বিদ্যাসাগর মহাশয় এর উত্তরে বলেছিলেন— “তাঁকে তো জানবার যো নাই। এখন কর্ত্তব্য কি? আমার মতে কর্ত্তব্য— আমাদের নিজেদের এরূপ হওয়া উচিত যে সকলে যদি সেরূপ হয় পৃথিবী স্বর্গ হয়ে যাবে।”

রামকৃষ্ণদেব এর পর বলেছিলেন ব্রহ্মের স্বরূপ যে কী, তা আজ অবধি মুখে কেউই বলতে পারেননি। পরমহংসদেবের এই কথা শুনে বিদ্যাসাগর মহাশয় তাজ্জব বনে গিয়েছিলেন। তিনি যেন এক নতুন কথা ও নবচেতনাবোধে আবিষ্ট হয়েছিলেন সেই মুহূর্ত থেকে। উনিশ শতকে পাশ্চাত্য ভাবধারায় তৎকালীন সমাজ ও সমাজের তরুণ প্রজন্ম যখন ভেসে যাচ্ছে, তখনই রামকৃষ্ণের এই মহৎ বোধের ভাবনায় বিদ্যাসাগর মোহিত হলেন। হিন্দুশাস্ত্রের কর্মযোগ, মানবপ্রেম ও বিদ্যার অনুশীলনই তাঁর কাছে প্রাধান্য পেয়েছে। তাঁর রচিত ‘আখ্যানমঞ্জুরী’, ‘বোধেদয়’, ‘বাসুদেবচরিত’, ‘প্রভাবতী সম্ভাষণ’ প্রভৃতি রচনায় সেই ভাবেরই প্রকাশ ঘটেছে। আপাতনাস্তিক বিদ্যাসাগর তাঁর মানবধর্ম, কর্মসাধনা, বিদ্যাচর্চার দ্বারা উনিশ শতকের শীর্ষ স্থানীয় ব্যক্তি হয়ে উঠেছেন, বেদান্তের অন্ধ অনুসরণে নয়।

বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সঙ্গে তাঁর সমকালীন ব্যক্তিত্বদের পার্থক্য ছিল এই সব সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ও সামাজিক কর্মের ক্ষেত্রে। তাঁর মানবীয় প্রয়াস ও পৌরুষ কোনওটিই তুচ্ছ প্রতিপন্ন করার মতো সাধ্য তাদের ছিল না। তাই গোঁড়ারা প্রত্যেক ক্ষেত্রে তাঁকে আঘাত দিয়েছে। তাঁর সমাজ সংস্কারের কাজে বারবার হস্তক্ষেপ করেছে। কিন্তু তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে সে আঘাত নস্যাৎ করে দিতে পেরে ছিলেন বলেই বলতে পারেন— “বিধবা বিবাহ প্রবর্তন আমার জীবনের সৎকর্ম। এজন্মে যে ইহা অপেক্ষা অধিকতর আর কোনও সৎকর্ম করিতে পারিব, তাহার সম্ভাবনা নাই।”

তিনি এ দেশের দুর্দশার দূরীকরণে সর্বতো ভাবে নিজের সর্বস্ব দান করে গিয়েছেন। চার্বাক দর্শনের ভাবাদর্শে ভাবিত হয়ে তিনি এই পরাধীন ভারতবাসীর মননকে জাগ্রত করতেই অগ্রসর হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন প্রাণধর্মে যথার্থই মানবতাবাদী।

রবীন্দ্রনাথ যথার্থই বলেছিলেন, “বিদ্যাসাগর যে বাঙালি বড়লোক ছিলেন তাহা নহে, তিনি যে রীতিমত হিন্দু ছিলেন তাহাও নহে— তিনি তাহা অপেক্ষাও অনেক বেশী বড়ো ছিলেন, তিনি যথার্থ মানুষ ছিলেন।”

(উদ্ধৃতির বানান অপরিবর্তিত)

মুজফ্‌ফর আহমেদ মহাবিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগীয় প্রধান

২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯ খ্রীস্টাব্দে প্রকাশিত।


কোন মন্তব্য নেই

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন

vidyasagar.info ©