ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

মাইকেল মধুসূদন দত্ত

বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে।
করুণার সিন্ধু তুমি, সেই জানে মনে,
দীন যে, দীনের বন্ধু!—উজ্জ্বল জগতে
হেমাদ্রির হেমকান্তি অম্লান কিরণে।
কিন্তু ভাগ্যবলে পেয়ে সে মহা পর্বতে,
যে জন আশ্রয় লয় সুবর্ণ চরণে,
সেই জানে কত গুণ ধরে কত মতে
গিরীশ। কি সেবা তার সে মুখ সদনে।—
দানে বারি নদীরূপ বিমলা কিঙ্করী;
যোগায় অমৃত ফল পরম আদরে
দীর্ঘশিরঃ তরুদল, দাসরূপ ধরি;
পরিমলে ফুলকুল দশ দিশ ভরে;
দিবসে শীতল শ্বাসী ছায়া, বনেশ্বরী,
নিশার সুশান্ত নিদ্রা, ক্লান্তি দূর করে!

সমালোচনা, আক্রমণাত্মক কথা আমাদের ব্যাধি, বললেন শঙ্খ ঘোষ

বড় কাজ একাই করতে হয়
সেই সময়ে তো বটেই, এই সময়ের পক্ষেও তাঁর কাজকর্ম আচারব্যবহার খুব যে সুলভ তা নয়। আজও তিনি সময়ের থেকে এগিয়ে। যে ভাবে ভেবেছিলেন, যে কথা ভেবেছিলেন, এর কোনওটাই এখনও খুব সুলভ নয়।
—সাক্ষাৎকার: ইন্দ্রজিৎ চৌধুরীী


প্রশ্ন: আটপৌরে বাঙালি পোশাকে বিদ্যাসাগর ছিলেন সর্বত্রগামী। প্রবল জেদ ও আত্মসম্মানবোধ নিয়ে সরকারি চাকরি করেছেন, দ্বিরুক্তি না করে ইস্তফাও দিয়েছেন। পাঠ্যবই লিখে ছেপে বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করেছেন, দানের জন্য ধারও করেছেন। উনিশ শতকে সমাজবদলের সব আন্দোলনেই তিনি অগ্রপথিক। এমন ব্যক্তিত্ব সমসময়ে ব্যতিক্রম। দু’শো বছর পর আজ আমরা তাঁকে কী চোখে দেখব?

শঙ্খ ঘোষ: সেই সময়ে তো বটেই, এই সময়ের পক্ষেও তাঁর কাজকর্ম আচারব্যবহার খুব যে সুলভ তা নয়। আজও তিনি সময়ের থেকে এগিয়ে। যে ভাবে ভেবেছিলেন, যে কথা ভেবেছিলেন, এর কোনওটাই এখনও খুব সুলভ নয়। সরকারি চাকরি থেকে ইস্তফার প্রসঙ্গে বলি, পরে বাম সমালোচকরা তাঁর প্রতি বিরুদ্ধভাব পোষণ করলেন এই জন্য যে— বিদ্যাসাগর সিপাহিবিদ্রোহের সময় তাঁর কলেজ সরকারি কাজে ব্যবহার করতে দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁরা মনে রাখলেন না যে, সেই সরকারি নির্দেশের উত্তরে বিদ্যাসাগর যে চিঠিটি লিখেছিলেন, তার প্রথমেই জানিয়েছিলেন সরকারি চাকরি থেকে ইস্তফা দেওয়ার ইচ্ছা। এক বছর পর সত্যিই ইস্তফা দিলেন, নানা অনুরোধেও তা প্রত্যাহার করলেন না।

এই সজোর প্রতিবাদের পাশেই ছিল কাজের দৃঢ়তা। হঠাৎ মনে হল, শহরে ক’টা স্কুল করে কী হবে গোটা দেশে যদি স্কুল না থাকে। সঙ্গে সঙ্গে কাজে লেগে গেলেন, সাত-আট মাসে ৩৫টা স্কুল তৈরি হয়ে গেল। এই আশ্চর্য ব্যাপার আজও কি ভাবা যায়? অথচ এই মানুষটির সঙ্গে আমরা যে ব্যবহার করেছি—তখনও, এখনও— সেটা লজ্জার। এই যে বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙা, সেটা খুব বড় জিনিস না। আমরা তো অহরহই মূর্তি ভাঙছি। ভিতর থেকে। সেটা অনেক বড় ব্যাপার। শুধু বাইরে নয়, বাড়িতে, পরিবারের মধ্যে কী পরিমাণে লাঞ্ছিত হয়েছেন! ছেলে নারায়ণ তাঁর কাছে বিধবাবিবাহ করার জন্য অনুমতি চেয়ে চিঠি লিখেছিল— তার আগে তো উনি নিজেই তাঁকে বলতে পারতেন। কিন্তু এর জন্য মনে মনে কতটা অপেক্ষা করে ছিলেন তা বোঝা যায় যখন ভাই শম্ভুচন্দ্রকে লিখছেন, নারায়ণ স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে এই কাজ করে তাঁর মুখ উজ্জ্বল করেছে। অপেক্ষা করছেন, ছেলে কবে স্বাধীন ভাবে কাজ করবে। অন্যেরও স্বাধীনতা আছে ভাববার— এটাও একটা শিক্ষা।

ভাবতাম, কী ভাবে এত সহ্য করেছেন। এক সময় তো পালিয়েই গিয়েছিলেন— তোমাদের এই ভদ্র দেশে, তোমাদের মধ্যে থাকব না আমি। তার চেয়ে অনেক ভাল সাঁওতালরা। সেটাই করেছেন। সাঁওতালদের মধ্যে থেকে তাঁদের পরিচর্যা করেছেন।

প্র: হরপ্রসাদ শাস্ত্রী কর্মাটাঁড়ে বিদ্যাসাগরের যাপনচিত্র বর্ণনা করেছেন। সাঁওতালদের কাছ থেকে ভুট্টা কেনা, পরে তাঁদের আবার সেই ভুট্টা খাওয়ানো, দূর গ্রামে পায়ে হেঁটে গিয়ে অসুস্থ মানুষের সেবা করা। সম্প্রতি রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য একটি লেখায় উল্লেখ করেছেন, বিদ্যাসাগর শেষ জীবনে অনাস্থাবাদী ও মানববিদ্বেষী হয়ে পড়েন এমন একটি কথা চালু থাকলেও যোগেন্দ্রকুমার চট্টোপাধ্যায় ও শিবনাথ শাস্ত্রীর লেখায় এর বিপরীত ছবিই ফুটে ওঠে।

উ: মানববিদ্বেষী হওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভবই ছিল না। তবে ভিতরের অভিমানটা টের পাওয়া যায়। খুব অভিমান হয়েছিল। অনেকে বলেছেন, তিনি পালিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু সেখানে গিয়েও তো কাজই করছেন। অন্যদের সঙ্গে কাজ করছেন। তাঁর মনে হয়েছিল, এই ভদ্রসমাজে কিছু হবে না। এদের মধ্যে কাজ করার কোনও মানে আছে?— এ তো একেবারে আজকের চিন্তা। না, আজকের চিন্তা হয়ে ওঠেনি, হতে পারত। এই যে গায়ত্রী [চক্রবর্তী স্পিভাক] এখানে আসেন, গ্রামে যান, নিজে স্কুল তৈরি করার চেষ্টা করেন, কত সমস্যার মধ্যে কাজ করেন। বিদ্যাসাগর সেই সময় কী করে এত কিছু পারছিলেন, কল্পনা করা যায় না। বিধবাবিবাহ আইনসিদ্ধ করতে হন্যে হয়ে শাস্ত্রের বচন খুঁজছেন, সেটা না হয় বোঝা যায়। মেয়েদের লেখাপড়া শেখাতে হবে, সে জন্যেও শাস্ত্রবচন খুঁজতে হচ্ছে: ‘কন্যাপ্যেবং পালনীয়া শিক্ষণীয়াতিযত্নতঃ’। ছাত্রীদের পাল্কির দু’পাশে এই শাস্ত্রবচন লিখিয়ে দিচ্ছেন, যাতে মানুষ জানতে পারে মেয়েদেরও শিক্ষা দেওয়া দরকার।

প্র: এত শাস্ত্রবচন খুঁজেছেন, যুক্তি প্রতিষ্ঠায় শাস্ত্রের উপর নির্ভর করেছেন। অনেকে ওঁকে ‘নাস্তিক’ আখ্যা দিয়েছেন। ‘ধর্ম’ বলতে তিনি কী বুঝতেন?

উ: ওঁকে ‘নাস্তিক’ বলা যায় না। নাস্তিক হলে কি চিঠির উপর নিয়মিত লিখতে পারতেন ‘শ্রীশ্রীহরিঃশরণম্’? ধর্মের কোনও বহিরঙ্গ মানতেন না তিনি, আচরণও করতেন না। এখন যেমন অনেকে বলেন, ধর্মটা ব্যক্তিগত ব্যাপার, অনেকটা সেই রকম। বললাম বটে অনেকে বলেন, তবে খুব বেশি লোক বলেন না। বিদ্যাসাগর এ নিয়ে কথা বলতেন না বেশি, মানতেন না কি মানতেন না, সেটা অবান্তর। তার থেকে অনেক জরুরি কাজ করার ছিল। আসলে ওঁর মায়ের একটা মূর্তি ছিল মনের ভেতর। ‘‘গরিবদের সারা বছর দু’মুঠো খাওয়াতে পারলে পুজো না করলেও চলবে’’, ছেলের প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন ভগবতী দেবী। এটা নাস্তিকতা নয়। এই মায়েরই জন্য এক বার লেপ পাঠিয়েছিলেন, মা গায়ে দেননি। কারণ জিজ্ঞাসা করলে বলেন, গ্রামে তো কেউ লেপ পায় না। ছেলে জানতে চান, গ্রামের সবার এবং মায়ের একটা, সব মিলিয়ে ক’টা লেপ লাগবে। সেই মতো সবার জন্য লেপ পাঠিয়ে দেন বিদ্যাসাগর। এটাই ছিল ওঁর ‘ধর্ম’। আরও একটা সমালোচনা হয়। উনি এত শাস্ত্রনির্ভর কেন? যা করবেন ভেবেছিলেন নিজের জোরেই করতে পারতেন। এটা যে একটা বিরাট কর্মপদ্ধতি হতে পারে, সেটা বুঝছে না কেউ। আমি বিশ্বাস করি এটা হবে, তোমরা বিশ্বাস করো না। তোমরা যা দিয়ে বিশ্বাস করো তাই দিয়েই করাব। এই যে জেদটা, এর জন্যেই দিনরাত পড়াশুনো। যখন ‘পরাশর-সংহিতা’র সেই শ্লোকটা—‘নষ্টে মৃতে প্রব্রজিতে...’ পেলেন, তখন ‘পেয়ে গেছি, পেয়ে গেছি’ বলছেন।

প্র: সমালোচনার ঝড় তো আজীবন সহ্য করেছেন।

উ: সমালোচনা হয়েছে, আক্রমণাত্মক কথাও হয়েছে। সেটা সামাজিক একটা ব্যাধির লক্ষণ বলে মনে হয়। নিজেরা কাজ করতে পারি না, আর কেউ যদি করে, তাকে সন্দেহ করি। নিশ্চয়ই কিছু মতলব আছে। মাঝে মাঝে মনে হয়, এটা কি বাঙালি সমাজেরই একটা বৈশিষ্ট্য? ১৯৫০-এর দশকের আগে বিদ্যাসাগরকে নিয়ে কতই বা কথাবার্তা হয়েছে? খুব বেশি নয় কিন্তু। বিহারীলাল, চণ্ডীচরণ, শম্ভুচন্দ্র— এই দু’চারখানা বই। এর বেশি কিছু লেখাই হয়নি। অবশ্য রবীন্দ্রনাথের আশ্চর্য প্রবন্ধটি অনেক বইয়ের কাজ করে দিয়েছে। কিন্তু পরে নতুন লেখাপত্র যখন শুরু হল, তখন দেখি উল্টো সুর। আমরা আধুনিক হয়েছি, বিপ্লবী হয়েছি, উনিশ শতকের অনেক কিছুকেই তাচ্ছিল্য করতে শিখেছি। মূর্তিভাঙার ব্যাপারটা যখন শুরু হল— আক্ষরিক নয়, আলঙ্কারিক অর্থে— সেই সময় যাদবপুরে পড়াই। এক দিন ক্লাসে রামমোহন রায় প্রসঙ্গে বলছি, হঠাৎ এক ছাত্র বলল, ‘‘এগুলো ঠিক কথা নয়। রামমোহন তেমন কিছুই করেননি।’’ তর্ক জুড়ল। আস্তে আস্তে দেখা গেল, উনিশ শতকটাই কিছু নয়। বিদ্যাসাগর ছাড়াও উনিশ শতকে যাঁরা কিছুমাত্র কাজ করেছেন, প্রত্যেককেই তো লাঞ্ছিত হতে হয়েছে।

প্র: সাম্প্রতিক আলোচনায় দেখছি, ক’টা বিধবাবিবাহ হয়েছে, ক’টা টিকে থেকেছে এই দিক থেকে সাফল্য-ব্যর্থতার পরিমাপ করা হচ্ছে।

উ: বিদ্যাসাগর নিজে বলেছেন, ‘‘বিধবা-বিবাহ প্রবর্ত্তন আমার জীবনের সর্ব্বপ্রধান সৎকর্ম্ম।’’ সেই বিধবাবিবাহ ক’টা হয়েছে, তাতে কী লাভ হয়েছে, এই সব হিসেব চলে। এটা হিন্দু উঁচু বর্ণের ব্যাপার— ক’জন লোক তারা? দেশের কী লাভ হয়েছে এতে? এমন সমালোচনা করেছি আমরা। ব্যর্থতার এ এক অদ্ভুত হিসেব। বিধবাবিবাহ তো একটি বিধবার বিয়ে হচ্ছে শুধু তা-ই নয়, সেটা যে একটা মানসিক মুক্তি, অনেক জড়তা কেটে যেতে পারে, সে দিকটা ভাবছে না কেউ। মেয়েদের বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গি, সেটাই পাল্টে যাচ্ছে। এই দৃষ্টির কথাটা ভাবাই হচ্ছে না। শুরুটা তো একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা— তাঁর পূর্বপরিচিত একটি ছোট মেয়ের সঙ্গে অনেক দিন পর দেখা হয়েছে, সে কিছু খাচ্ছে না। কেন খাচ্ছে না? বিয়ে হয়েছিল, মেয়েটি এখন বিধবা। একাদশী বলে খাচ্ছে না। সেই থেকেই তো শুরু —মেয়েরা কেন ধর্মের কারণে এত কষ্ট পাবে।

প্র: বিদ্যাসাগরের লড়াইটা ছিল একার লড়াই। এমন লড়াই —আজও তো —একারই লড়াই?

উ: খুব বড় রকম কোনও কাজ —যেটায় অনেক বড় স্বপ্ন থাকে, সেটা একাই করতে হয়। এই জন্য করতে হয় যে, প্রথমে কেউ বিশ্বাসই করে না। যদি বা বিশ্বাস করল, ভাবতে থাকে, এত বড় জিনিস ঘটিয়ে তোলা যাবে না। কেউ কি পারছে? পারছে হয়তো একটু —না, সেটা পারা নয়। নিশ্চয়ই কিছু গোলমাল আছে। সেই গোলমালের সন্ধানটাই তখন বেশি বড় কথা হয়ে ওঠে।

শিমলার ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্সড স্টাডিজ়ে থাকাকালীন আমাকে এক গবেষক জিজ্ঞাসা করেছিলেন, গাঁধীজির একটা আশ্রম আছে, শ্রীঅরবিন্দের একটা আশ্রম আছে, রবীন্দ্রনাথেরও একটা আশ্রম আছে। গাঁধীজির আশ্রমে যাঁরা থাকেন, তাঁরা একটা আদর্শ— সেটা ভুল ঠিক যা-ই হোক —অনুসরণ করে চলেন। শ্রীঅরবিন্দের আশ্রমেও তা-ই। রবীন্দ্রনাথের আশ্রমে তা হয় না কেন? বললাম, রবীন্দ্রনাথের আশ্রম তো ঠিক সে রকম আশ্রম নয়। উনি বললেন, তা ঠিকই। কিন্তু সেটা কি বাঙালিদের ব্যাপার বলে? খুব লজ্জা হয়েছিল শুনে।

এই বাঙালি প্রসঙ্গেই আর একটা ঘটনা। এক বার ইউ আর অনন্তমূর্তি এসেছেন বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে। বোধ হয় শতবর্ষের অনুষ্ঠানের সময়। পরিষদে ঢোকার সময় বলছেন, এত নোংরা কেন, ধুলো-ময়লা জমে আছে। বললাম, লোকজন তো খুব কম...। উনি বললেন, ভাবছি আমাদের রাজ্যে যদি এমন একটা প্রতিষ্ঠান থাকত, তাতে কিছুতেই এমনটা ঘটতে পারত না। লজ্জা পেয়েছিলাম। করা তো যায় ঠিকই। ইচ্ছে থাকলে নিশ্চয়ই করা যায়।

প্র: ঘটনাচক্রে আপনার প্রথম মুদ্রিত বইটি তো বিদ্যাসাগরের জীবনী?

উ: হ্যাঁ। মনে মনে ভাবতাম, আমি যে বিদ্যাসাগরকে এত ভালবাসি, সেটা কি পারতাম যদি বাবা না থাকতেন। বাবা —রবীন্দ্রনাথ, বিদ্যাসাগর, আর অশ্বিনীকুমার দত্ত, এঁদের মনে করতেন জীবনের সবচেয়ে বড় আশ্রয়। আশ্রয় শুধু নন, দিশারি। তাই ছোটবেলা থেকেই বিদ্যাসাগরকে— কী বলব— আমাদের প্রায় ঘরের মানুষ বলেই মনে হত। আমরা বিদ্যাসাগরকে কতটা ভুলে গেছি সেটা বুঝেছিলাম ১৯৬৪ সালে। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে তখন ‘ভারতকোষ’ সঙ্কলনের কাজ চলছে। যে ঘরটায় আমরা কাজ করতাম, সেখানে বিদ্যাসাগরের টেবিল আর কয়েক আলমারি বই ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক দর্শনের অধ্যাপক এসেছেন। জিজ্ঞাসা করলেন, এই বইগুলো কার? এই সব আলমারি? —বিদ্যাসাগরের। না, বইগুলো? —বইও তাঁর। এত ইংরেজি বই! বিদ্যাসাগর কি ইংরেজি জানতেন?

আবার ইংরেজি বা সংস্কৃত থেকে বাংলা করা— যে ভাষায় করেছেন, আমার তো মনে হয় তার চেয়ে সুন্দর লেখা খুব কম আছে। গদ্যের মধ্যে যে একটা ছন্দ আছে —সেটা বিদ্যাসাগরের লেখাতেই প্রথম দেখি। ‘এই সেই জনস্থানমধ্যবর্তী প্রস্রবণগিরি’ পড়ে ‘পথের পাঁচালী’র অপুর মনে হয়েছিল, খুঁজে বার করতে হবে কোথায় আছে এই লেখা। আর এটা পড়ে আমারও ঠিক সে কথাই মনে হয়েছিল।

প্র: সভা-সমিতি করে বিশেষ কাজ হবে বলে মনে করতেন না তিনি— অনেককে নিয়ে সংগঠন তৈরি করার দিকে সেই জন্যই হয়তো কোনও দিন যাননি।

উ: মাইকেল মধুসূদনের মৃত্যুর পর তাঁর একটি মূর্তি স্থাপনের কথা হয়। বিদ্যাসাগরের কাছে কয়েক জন এসেছেন, তাঁরা এ জন্য চাঁদা তুলছেন। বিদ্যাসাগর বললেন, বেঁচে থাকতে তাঁর জন্য যা করার আমি করেছি, এখন মৃত মানুষটিকে নিয়ে যা করার তোমরা করো। কোনও কাজে ‘আমি কিছু করছি’ বলে নামতেন না। মধুসূদন প্যারিসে অর্থকষ্টে পড়ে তাঁকে বার বার চিঠি লিখছেন। বলছেন, স্ত্রীকে আশ্বস্ত করেছেন, এমন এক জনকে লিখেছেন যাঁর কাছ থেকে সাড়া আসবেই। এমন এক জন মানুষ যিনি প্রাচীন ঋষির মতো জ্ঞানী ও প্রতিভাবান, ইংরেজদের মতো কর্মোৎসাহী আর যাঁর হৃদয় বাঙালি মায়ের মতো। সে টাকা সেই দিনই মধুসূদনের হাতে পৌঁছেছে। আর সেই টাকা বিদ্যাসাগর এখানে ধার করছেন! এ পাগলামির কোনও শেষ নেই।

জীবনের দশটি বছর


• ১৮২৮: আট বছর বয়সে বাবার সঙ্গে কলকাতায় পদার্পণ করেন ঈশ্বরচন্দ্র।

• ১৮৪৭: ‘বেতালপঞ্চবিংশতি’ প্রকাশ। ‘বাসুদেব-চরিত’ আগে রচিত হলেও অপ্রকাশিত। মদনমোহন তর্কালঙ্কারের সঙ্গে ‘সংস্কৃত প্রেস’ প্রতিষ্ঠা।

• ১৮৫৫: ১৩ এপ্রিল ‘বর্ণপরিচয়’ প্রথম ভাগ প্রকাশ। ১৪ জুন প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় ভাগ। বহুবিবাহ রহিত করার জন্য প্রথম আবেদনপত্র পাঠালেন। • ১৮৫৬: ২৬ জুলাই বিধবাবিবাহ আইনসিদ্ধ হল। ৭ ডিসেম্বর সুকিয়া স্ট্রিটে প্রথম বিধবাবিবাহ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো। ১৮৫৭ থেকে ১৮৫৮ সালের মধ্যে ৩৫টি বালিকা-বিদ্যালয় স্থাপন করেন। সরকার এগুলির অনুমোদন দেয়নি। মতভেদের জেরে ১৮৫৮-য় সরকারি চাকরিতে ইস্তফা দিলেও স্কুলগুলি চালু রাখেন বিদ্যাসাগর।

• ১৮৬৯: ম্যালেরিয়া-আক্রান্ত মানুষের সেবায় বর্ধমানে বাড়ি ভাড়া নিয়ে ত্রাণের কাজ করেন।

• ১৮৭১: তৎকালীন সাঁওতাল পরগনার কর্মাটাঁড়ে বাড়ি কিনে কিছু দিন বসবাস। ১৮৭২: স্কুল থেকে কলেজে উন্নীত হল মেট্রোপলিটন (বর্তমান বিদ্যাসাগর কলেজ)। এটি দেশের প্রথম কলেজ যার প্রতিষ্ঠাতা-পরিচালক-শিক্ষক সবই ভারতীয়।

• ১৮৭৪: চটিজুতো পরে এশিয়াটিক সোসাইটির মিউজ়িয়ামে ঢুকতে বাধা। বিদ্যাসাগর আর কোনও দিন সেখানে পা রাখেননি।

• ১৮৮২: বাদুড়বাগানের বাড়িতে এলেন শ্রীরামকৃষ্ণ।

• ১৮৮৭: ‘মহামহোপাধ্যায়’ উপাধি দানের সরকারি প্রস্তাব অসুস্থতার অজুহাতে প্রত্যাখ্যান।

সাক্ষাৎকার: ইন্দ্রজিৎ চৌধুরী

২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯ খ্রীস্টাব্দে প্রকাশিত।


কোন মন্তব্য নেই

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন

vidyasagar.info ©