বিদ্যাসাগরের জন্ম, শিক্ষা ও অবস্থান, সবই ছিল একটি সামন্তবাদী পরিবেশে। ইংরেজের বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক উপস্থিতি ও ইংরেজী শিক্ষার প্রচলন সমাজে এক ধরনের চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল। একটি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীও গড়ে উঠছিল। এই বিকাশের উজ্জ্বল প্রতিনিধিদের মধ্যে একজন ছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত, সমাজের সামন্তবাদী সঙ্কীর্ণতার বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত বিদ্রোহ ঘোষণা করে তিনি খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী হয়ে গিয়েছিলেন, চেয়েছিলেন ইংরেজী ভাষাতে সাহিত্য রচনা করে আন্তর্জাতিক যশ অর্জন করবেন। কিন্তু অত্যন্ত মেধাবান ও সাহিত্যসৃষ্টির অতিউচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ছিলেন যেহেতু তাই তিনি ফিরে এসেছেন মাতৃভাষার কাছে। বিদ্যাসাগরের ব্যাপারটা কিন্তু সম্পূর্ণ উল্টো। তিনি মাতৃভাষার চর্চা বর্জনের কথা কখনোই ভাবেন নি। ওদিকে রামমোহন যে বিলেত গেলেন এবং সেখানেই সমাধিস্থ হলেন, বিদ্যাসাগরের পক্ষে তেমন কাজও সম্ভব ছিল না। তিনি মাতৃভাষা ও মাতৃভূমিতে গভীর ভাবে প্রোথিত ছিলেন। স্তম্ভের মতো নয়, বৃক্ষের মতো।
—সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
(নতুন দিগন্ত-সম্পাদকীয়)
বিদ্যাসাগরের জন্ম আজ থেকে ঠিক দু’ শ’ বছর আগে, ১৮২০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বরে, তিনি অতিশয় কাতর ছিলেন চতুষ্পার্শ্বে নারী
নির্যাতন দেখে। বিদ্যাসাগর জানতেন বিধবারা কেমন দুর্বিষহ জীবন যাপন করে। সে জন্য তিনি বিধবাদের বিবাহদানকে বৈধ করার জন্য
রাতদিন পরিশ্রম করেছেন। মেয়েদের বিধবা হবার পেছনে বিশেষ দু’টি কারণ ছিল। বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ। বয়স্ক স্বামীর সঙ্গে অতি
অল্পবয়সের যে মেয়েটিকে জুড়ে দেওয়া হতো, তার স্বামী মারা যেত মেয়েটির মৃত্যুর অনেক আগে। আর কুলীন সমাজে বহুবিবাহ তো কিছু
ব্রাহ্মণের পেশাই ছিল, তাঁরা ঘুরে ঘুরে স্ত্রীদের বাড়িতে অতিথি হতেন; কতজন স্ত্রী, কী তাদের ঠিকানা এসব মনে রাখাও কঠিন
হতো, সে জন্য খাতায় লিখে রাখতেন এবং তালিকা দেখে দেখে স্ত্রীদের খোঁজে বের হতেন। কুলীন ঘরের মেয়েদের পক্ষে কুলীন বর
পাওয়া কঠিন ছিল; বাজারে তাই কুলীন পুরুষদের প্রচুর চাহিদা ও নীরব প্রতাপ বিদ্যমান থাকতো। বিদ্যাসাগর বিধবাবিবাহকে
আইনসম্মত করাতে পেরেছিলেন, চেষ্টা করেছিলেন বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ নিবারণের জন্য আইনী ব্যবস্থা চালু করবেন। পারেন নি
পর্যাপ্ত সামাজিক সমর্থন জোগাড় করা সম্ভব হয় নি। আর বিধবাবিবাহও যে খুব জনপ্রিয় হয়েছিল তাও নয়। তাঁর একমাত্র পুত্র একজন
বালিকাবিধবাকে বিয়ে করায় বিদ্যাসাগর সন্তুষ্ট হয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর সে সন্তোষ দীর্ঘস্থায়ী হয় নি, কারণ তাঁর পুত্র
নানাবিধ অন্যায় আচরণ করেছে যার জন্য বিদ্যাসাগর পুত্রকে কার্যত ত্যাজ্যই করে দিয়েছিলেন।
মেয়েদের জীবনে দুঃখ ও অনিশ্চয়তা দেখে মাতৃহৃদয়সম্পন্ন বিদ্যাসাগর অত্যন্ত কাতর থাকতেন। এক বন্ধুর শিশুকন্যা প্রভাবতী’র অকাল মৃত্যুতে শোকে বেদনাপুত বিদ্যাসাগর একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। ছোট্ট, কিন্তু অসাধারণ। ‘প্রভাবতীসম্ভাষণ’ নামের ওই প্রবন্ধটি সম্ভবত বাংলা সাহিত্যে প্রথম শোকগাথা। তাতে প্রভাবতী’র মৃত্যুতে অশ্রুসম্বরণের চেষ্টা করতে গিয়ে নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে বিদ্যাসাগর লিখেছেন, প্রভাবতী তুমি যে চলে গেলে একদিক দিয়ে সেটা ভালোই হলো; বেঁচে থাকলে ‘ভাগ্যদোষে’ তুমি হয়তো “অসৎপাত্রের হস্তগত ও অসৎপরিবারের কবলে পতিত হয়ে দুঃখসন্তাপে কালাতিপাত করিতে।” বঙ্গদেশে নারী হয়ে জন্মগ্রহণেই ছিল মস্ত একটি ভাগ্যদোষ।
মেয়েদের জীবনে দুঃখ ও অনিশ্চয়তা দেখে মাতৃহৃদয়সম্পন্ন বিদ্যাসাগর অত্যন্ত কাতর থাকতেন। এক বন্ধুর শিশুকন্যা প্রভাবতী’র অকাল মৃত্যুতে শোকে বেদনাপুত বিদ্যাসাগর একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। ছোট্ট, কিন্তু অসাধারণ। ‘প্রভাবতীসম্ভাষণ’ নামের ওই প্রবন্ধটি সম্ভবত বাংলা সাহিত্যে প্রথম শোকগাথা। তাতে প্রভাবতী’র মৃত্যুতে অশ্রুসম্বরণের চেষ্টা করতে গিয়ে নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে বিদ্যাসাগর লিখেছেন, প্রভাবতী তুমি যে চলে গেলে একদিক দিয়ে সেটা ভালোই হলো; বেঁচে থাকলে ‘ভাগ্যদোষে’ তুমি হয়তো “অসৎপাত্রের হস্তগত ও অসৎপরিবারের কবলে পতিত হয়ে দুঃখসন্তাপে কালাতিপাত করিতে।” বঙ্গদেশে নারী হয়ে জন্মগ্রহণেই ছিল মস্ত একটি ভাগ্যদোষ।