মোট পৃষ্ঠাদর্শন

    ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
        মাইকেল মধুসূদন দত্ত

  বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে।
  করুণার সিন্ধু তুমি, সেই জানে মনে,
  দীন যে, দীনের বন্ধু!—উজ্জ্বল জগতে
  হেমাদ্রির হেমকান্তি অম্লান কিরণে।
  কিন্তু ভাগ্যবলে পেয়ে সে মহা পর্বতে,
  যে জন আশ্রয় লয় সুবর্ণ চরণে,
  সেই জানে কত গুণ ধরে কত মতে
  গিরীশ। কি সেবা তার সে মুখ সদনে।—
  দানে বারি নদীরূপ বিমলা কিঙ্করী;
  যোগায় অমৃত ফল পরম আদরে
  তরুদল, দাসরূপ ধরি;
  পরিমলে ফুলকুল দশ দিশ ভরে;
  দিবসে শীতল শ্বাসী ছায়া, বনেশ্বরী,
  নিশার সুশান্ত নিদ্রা, ক্লান্তি দূর করে!

বিদ্যাসাগরের জন্ম, শিক্ষা ও অবস্থান, সবই ছিল একটি সামন্তবাদী পরিবেশে। ইংরেজের বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক উপস্থিতি ও ইংরেজী শিক্ষার প্রচলন সমাজে এক ধরনের চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল। একটি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীও গড়ে উঠছিল। এই বিকাশের উজ্জ্বল প্রতিনিধিদের মধ্যে একজন ছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত, সমাজের সামন্তবাদী সঙ্কীর্ণতার বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত বিদ্রোহ ঘোষণা করে তিনি খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী হয়ে গিয়েছিলেন, চেয়েছিলেন ইংরেজী ভাষাতে সাহিত্য রচনা করে আন্তর্জাতিক যশ অর্জন করবেন। কিন্তু অত্যন্ত মেধাবান ও সাহিত্যসৃষ্টির অতিউচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ছিলেন যেহেতু তাই তিনি ফিরে এসেছেন মাতৃভাষার কাছে। বিদ্যাসাগরের ব্যাপারটা কিন্তু সম্পূর্ণ উল্টো। তিনি মাতৃভাষার চর্চা বর্জনের কথা কখনোই ভাবেন নি। ওদিকে রামমোহন যে বিলেত গেলেন এবং সেখানেই সমাধিস্থ হলেন, বিদ্যাসাগরের পক্ষে তেমন কাজও সম্ভব ছিল না। তিনি মাতৃভাষা ও মাতৃভূমিতে গভীর ভাবে প্রোথিত ছিলেন। স্তম্ভের মতো নয়, বৃক্ষের মতো।

—সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

(নতুন দিগন্ত-সম্পাদকীয়)


বিদ্যাসাগরের জন্ম আজ থেকে ঠিক দু’ শ’ বছর আগে, ১৮২০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বরে, তিনি অতিশয় কাতর ছিলেন চতুষ্পার্শ্বে নারী নির্যাতন দেখে। বিদ্যাসাগর জানতেন বিধবারা কেমন দুর্বিষহ জীবন যাপন করে। সে জন্য তিনি বিধবাদের বিবাহদানকে বৈধ করার জন্য রাতদিন পরিশ্রম করেছেন। মেয়েদের বিধবা হবার পেছনে বিশেষ দু’টি কারণ ছিল। বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ। বয়স্ক স্বামীর সঙ্গে অতি অল্পবয়সের যে মেয়েটিকে জুড়ে দেওয়া হতো, তার স্বামী মারা যেত মেয়েটির মৃত্যুর অনেক আগে। আর কুলীন সমাজে বহুবিবাহ তো কিছু ব্রাহ্মণের পেশাই ছিল, তাঁরা ঘুরে ঘুরে স্ত্রীদের বাড়িতে অতিথি হতেন; কতজন স্ত্রী, কী তাদের ঠিকানা এসব মনে রাখাও কঠিন হতো, সে জন্য খাতায় লিখে রাখতেন এবং তালিকা দেখে দেখে স্ত্রীদের খোঁজে বের হতেন। কুলীন ঘরের মেয়েদের পক্ষে কুলীন বর পাওয়া কঠিন ছিল; বাজারে তাই কুলীন পুরুষদের প্রচুর চাহিদা ও নীরব প্রতাপ বিদ্যমান থাকতো। বিদ্যাসাগর বিধবাবিবাহকে আইনসম্মত করাতে পেরেছিলেন, চেষ্টা করেছিলেন বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ নিবারণের জন্য আইনী ব্যবস্থা চালু করবেন। পারেন নি পর্যাপ্ত সামাজিক সমর্থন জোগাড় করা সম্ভব হয় নি। আর বিধবাবিবাহও যে খুব জনপ্রিয় হয়েছিল তাও নয়। তাঁর একমাত্র পুত্র একজন বালিকাবিধবাকে বিয়ে করায় বিদ্যাসাগর সন্তুষ্ট হয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর সে সন্তোষ দীর্ঘস্থায়ী হয় নি, কারণ তাঁর পুত্র নানাবিধ অন্যায় আচরণ করেছে যার জন্য বিদ্যাসাগর পুত্রকে কার্যত ত্যাজ্যই করে দিয়েছিলেন।

মেয়েদের জীবনে দুঃখ ও অনিশ্চয়তা দেখে মাতৃহৃদয়সম্পন্ন বিদ্যাসাগর অত্যন্ত কাতর থাকতেন। এক বন্ধুর শিশুকন্যা প্রভাবতী’র অকাল মৃত্যুতে শোকে বেদনাপুত বিদ্যাসাগর একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। ছোট্ট, কিন্তু অসাধারণ। ‘প্রভাবতীসম্ভাষণ’ নামের ওই প্রবন্ধটি সম্ভবত বাংলা সাহিত্যে প্রথম শোকগাথা। তাতে প্রভাবতী’র মৃত্যুতে অশ্রুসম্বরণের চেষ্টা করতে গিয়ে নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে বিদ্যাসাগর লিখেছেন, প্রভাবতী তুমি যে চলে গেলে একদিক দিয়ে সেটা ভালোই হলো; বেঁচে থাকলে ‘ভাগ্যদোষে’ তুমি হয়তো “অসৎপাত্রের হস্তগত ও অসৎপরিবারের কবলে পতিত হয়ে দুঃখসন্তাপে কালাতিপাত করিতে।” বঙ্গদেশে নারী হয়ে জন্মগ্রহণেই ছিল মস্ত একটি ভাগ্যদোষ।
ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিদ্যাসাগর হয়ে ওঠার সাক্ষী যে মানুষেরা ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বর্ধমানের এই ভূমিপুত্র। তিনি ছিলেন বিদ্যাসাগরের পাঠগুরু, তাঁর লেখালেখির সূচনাপর্বের উৎসাহদাতা। প্রেমচন্দ্র তর্কবাগীশকে নিয়ে লিখছেন স্বপ্নকমল সরকার। প্রেমচন্দ্র নিজেই যে শুধু কবি ছিলেন তা নয়, ছাত্রদের ভাল কবিতা পড়ে তাদের প্রশংসা করা ও লেখালেখি চালিয়ে যাওয়ায় অনুপ্রেরণা দেওয়ায় তাঁর জুড়ি ছিল না।

—স্বপ্নকমল সরকার



চলতি বছরটিতে পালিত হচ্ছে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দু’শো তম জন্মবার্ষিকী। সে উপলক্ষে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হচ্ছে। ঈশ্বরচন্দ্রের গড়ে ওঠা এবং তার প্রতিভার বিকাশে নানা ভাবে যে মনীষীরা সাহায্য করেছিলেন তাঁদের কথাও এই সময়ের প্রেক্ষিতে বিচার করা প্রয়োজন। ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিদ্যাসাগর হয়ে ওঠার সাক্ষী যে মানুষেরা ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বর্ধমানের এক ভূমিপুত্র। এক দিকে, তিনি ছিলেন বিদ্যাসাগরের পাঠগুরু, তাঁর লেখালেখির সূচনাপর্বের উৎসাহদাতা। এমনকি, বিদ্যাসাগরের আমন্ত্রণে সুকিয়া স্ট্রিটে আয়োজিত প্রথম বিধবা বিবাহের সেই ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানেরও সাক্ষী। তিনি উনিশ শতকের শিক্ষক ও কবি প্রেমচন্দ্র তর্কবাগীশ।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের তীব্র সমালোচক‌ও ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বঙ্কিমের সমালোচনা এতটাই মাত্রাতিরিক্ত ছিল যে, বিদ্যাসাগর কিছুটা হলেও বিরক্ত‌ হয়েছিলেন। লিখছেন গৌতম সরকার রাজপোশাক নষ্ট হয়ে যেতে পারে মনে করে শচীশচন্দ্র বাঁ হাত দিয়ে বিদ্যাসাগরকে সরিয়ে দিলেন। থতমত খেয়ে বিদ্যাসাগর চকিতে পিছু হটলেন।

—গৌতম সরকার



বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বড়দা শ্যামাচরণ চট্টোপাধ্যায়ের ছোট ছেলে শচীশচন্দ্রের বিয়ে। বিয়ে হচ্ছে সাহিত্যিক দামোদর মুখোপাধ্যায়ের মেয়ে সুরেশ্বরীর সঙ্গে। শচীশচন্দ্র পাইকপাড়ার জমিদারদের কাছ থেকে পোশাক ধার করে একেবারে রাজপুত্র সেছে এসেছেন। রাজবেশে তখন বর নামছেন। রাজপোশাক নষ্ট হয়ে যেতে পারে মনে করে শচীশচন্দ্র বাঁ হাত দিয়ে বিদ্যাসাগরকে সরিয়ে দিলেন। থতমত খেয়ে বিদ্যাসাগর চকিতে পিছু হটলেন। পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। ভাইপোর এমন আচরণ দেখে তিনি তো অগ্নিশর্মা, “তুমি জানো ইনি কে? ইনি বিদ্যাসাগর! এক্ষুণি ক্ষমা চাও।” মাথা নিচু করে ক্ষমা চাইতে বাধ্য হলেন শচীশচন্দ্র। বঙ্কিমের এরকম শ্রদ্ধা অটুট ছিল ঈশ্বরের মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত।
উনিশ শতকের নবজাগরণের মধ্য দিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে আধুনিকতার সূত্রপাত ঘটে। এই নবজাগরণের প্রধান চরিত্র বিদ্যাসাগর। বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্বের অধিকারী বিদ্যাসাগরের প্রধান পরিচয় তিনি রেনেসাঁস-পুরুষ। ইহজাগতিকতা, যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞানমনস্কতা, নতুন গদ্যরীতি, সমাজসংস্কার, নারীশিক্ষার প্রসার, পাঠ্যসূচি থেকে অলৌকিকতার বিলুপ্তি, চারিত্রিক দৃঢ়তা এবং মানবমুখিনতার মতো বৈশিষ্ট্য; যা ইউরোপীয় রেনেসাঁসকে তুলে ধরেছিল, বিদ্যাসাগর তার জীবন্ত প্রতীক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন।

—রাজীব সরকার



‘বাংলার রেনেসাঁস’ নামে বহুল আলোচিত ঘটনার কেন্দ্রস্থল ছিল উনিশ শতকের কলকাতা। বিভিন্ন ক্ষেত্রে কৃতী মনীষীদের আবির্ভাবে উত্তাল হয়ে উঠেছিল কলকাতা নগরী। খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে একটি জনপদে এত প্রতিভাবান মানুষের সম্মিলন বিশ্ব ইতিহাসে বিরল ঘটনা। রামমোহন রায় থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত শতাব্দীব্যাপী ইতিহাসে বাংলায় যে-উজ্জ্বল প্রতিভার মিছিল দৃশ্যমান, এর তুলনা সমগ্র ভারতবর্ষের ইতিহাসে আর নেই। ধর্ম ও সমাজসংস্কারে, শিক্ষা-দীক্ষায়, নারী উন্নয়নে, মানবসেবায়, জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্মেষে, শিল্প-সাহিত্য-সংগীতে, আধুনিক ধ্যান-ধারণায়, সর্বোপরি স্বাধীনতা আন্দোলনে এমন বহুমুখী জাগরণ আর কখনও দেখা যায়নি ভারতবর্ষে। গোপাল হালদার যথার্থই বলেছিলেন, ‘এমন অল্পকালের মধ্যে ভারতের মাত্র একটি জাতির (বাঙালির) মধ্যে যত মনস্বীর, যত কর্মীর, যত ভাবুকের, যত শিল্পী ও সাহিত্যিকের আবির্ভাব ঘটেছে, ভারতের ইতিহাসেও আর ঘটেনি– অশোকের কালে নয়, গুপ্ত সাম্রাজ্যের সময়ে নয়, মোগল রাজত্বে– আকবরের দিনেও নয়, বৈষ্ণব আন্দোলনের বাঙলায়ও নয়।’ এই প্রতিভাবান ব্যক্তিদের অন্যতম ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর; যাঁকে অনায়াসে রেনেসাঁস-পুরুষ আখ্যা দেওয়া যায়।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বা মাইকেল মধুসূদন দত্ত সম্পর্কে সামান্য ধারণা রাখেন এমন সবাই অন্তত এই তথ্যটি জানেন যে, মাইকেল বিদেশে গিয়ে বিপদে পড়লে তাঁর বন্ধু বিদ্যাসাগর তাঁকে টাকা পয়সা পাঠিয়ে উদ্ধার করেছিলেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর এই দুই মহীরূহের জীবনীর অবিচ্ছেদ্দ্য অংশ বিদ্যাসাগর-মধুসূদন পর্ব।


—চৌধুরী মুফাদ আহমদ



ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর* মাইকেল মধুসূদন দত্তের** চেয়ে তিন বছর চার মাসের বড় ছিলেন। মধুসূদন ১৮৩৭ সালে যখন হিন্দু কলেজে ভর্তি হন তখন বিদ্যাসাগর পাশের ভবনের সংস্কৃত কলেজের ছাত্র। ১৮৪১ সালের শেষ দিকে বিদ্যাসাগর পাশ করে বেরোনো পর্যন্ত দু’জন পাশাপাশি কলেজে লেখাপড়া করেছেন। কিন্তু তাঁদের মধ্যে কোন পরিচয় ছিল বলে জানা যায় না। থাকার কথাও নয়। দুই কলেজের ছাত্রদের অবস্থান পাশাপাশি থাকলেও তাদের মধ্যে বিরাট সামাজিক ও মানসিক ব্যবধান ছিল সংস্কৃত কলেজে বিনা বেতনে পড়তো মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্তদের হিন্দু উচ্চবংশীয় (ব্রাহ্মণ ও বৈশ্য) ছেলেরা। আর হিন্দু কলেজে পড়তো হিন্দু উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলেরা। তাদের অনেকেই জুড়ি-গাড়ি হাঁকিয়ে কলেজে আসতো। কলেজে মাসিক বেতন ছিল পাঁচ টাকা। অথচ তখন বিদ্যাসাগরের পিতার পুরো এক মাসের আয় ছিল দশ টাকা। দুই কলেজের ছাত্রদের মধ্যে মাঝে মধ্যে ঢিল ছোঁড়াছুঁড়ি হলেও তাদের মধ্যে তেমন যোগাযোগ বা বন্ধুত্ব সম্ভবত হতো না।
vidyasagar.info ©