মোট পৃষ্ঠাদর্শন

    ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
        মাইকেল মধুসূদন দত্ত

  বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে।
  করুণার সিন্ধু তুমি, সেই জানে মনে,
  দীন যে, দীনের বন্ধু!—উজ্জ্বল জগতে
  হেমাদ্রির হেমকান্তি অম্লান কিরণে।
  কিন্তু ভাগ্যবলে পেয়ে সে মহা পর্বতে,
  যে জন আশ্রয় লয় সুবর্ণ চরণে,
  সেই জানে কত গুণ ধরে কত মতে
  গিরীশ। কি সেবা তার সে মুখ সদনে।—
  দানে বারি নদীরূপ বিমলা কিঙ্করী;
  যোগায় অমৃত ফল পরম আদরে
  তরুদল, দাসরূপ ধরি;
  পরিমলে ফুলকুল দশ দিশ ভরে;
  দিবসে শীতল শ্বাসী ছায়া, বনেশ্বরী,
  নিশার সুশান্ত নিদ্রা, ক্লান্তি দূর করে!

বিদ্যাসাগর-মাইকেল সংবাদ

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বা মাইকেল মধুসূদন দত্ত সম্পর্কে সামান্য ধারণা রাখেন এমন সবাই অন্তত এই তথ্যটি জানেন যে, মাইকেল বিদেশে গিয়ে বিপদে পড়লে তাঁর বন্ধু বিদ্যাসাগর তাঁকে টাকা পয়সা পাঠিয়ে উদ্ধার করেছিলেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর এই দুই মহীরূহের জীবনীর অবিচ্ছেদ্দ্য অংশ বিদ্যাসাগর-মধুসূদন পর্ব।


—চৌধুরী মুফাদ আহমদ



ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর* মাইকেল মধুসূদন দত্তের** চেয়ে তিন বছর চার মাসের বড় ছিলেন। মধুসূদন ১৮৩৭ সালে যখন হিন্দু কলেজে ভর্তি হন তখন বিদ্যাসাগর পাশের ভবনের সংস্কৃত কলেজের ছাত্র। ১৮৪১ সালের শেষ দিকে বিদ্যাসাগর পাশ করে বেরোনো পর্যন্ত দু’জন পাশাপাশি কলেজে লেখাপড়া করেছেন। কিন্তু তাঁদের মধ্যে কোন পরিচয় ছিল বলে জানা যায় না। থাকার কথাও নয়। দুই কলেজের ছাত্রদের অবস্থান পাশাপাশি থাকলেও তাদের মধ্যে বিরাট সামাজিক ও মানসিক ব্যবধান ছিল সংস্কৃত কলেজে বিনা বেতনে পড়তো মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্তদের হিন্দু উচ্চবংশীয় (ব্রাহ্মণ ও বৈশ্য) ছেলেরা। আর হিন্দু কলেজে পড়তো হিন্দু উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলেরা। তাদের অনেকেই জুড়ি-গাড়ি হাঁকিয়ে কলেজে আসতো। কলেজে মাসিক বেতন ছিল পাঁচ টাকা। অথচ তখন বিদ্যাসাগরের পিতার পুরো এক মাসের আয় ছিল দশ টাকা। দুই কলেজের ছাত্রদের মধ্যে মাঝে মধ্যে ঢিল ছোঁড়াছুঁড়ি হলেও তাদের মধ্যে তেমন যোগাযোগ বা বন্ধুত্ব সম্ভবত হতো না।

মাইকেল ও বিদ্যাসাগরের মধ্যে প্রথম যোগাযোগ হয় ১৮৬০ সালে। তখন বিধবাবিবাহ প্রবর্তন আন্দোলনের জন্য বিদ্যাসাগর তাঁর খ্যাতির তুঙ্গে। বেতালপঞ্চবিংশতি, শকুন্তলা, বোধোদয়, বর্ণপরিচয় প্রকাশিত হয়েছে এবং লেখক হিসেবে তিনি আধুনিক বাংলা গদ্যের একজন নির্মাতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছেন। ইতিমধ্যে তিনি বাংলার বিভিন্ন এলাকায় অনেকগুলো ছেলেদের মডেল স্কুল খুলে ফেলেছেন, খুলেছেন অনেকগুলো মেয়েদের স্কুলও। আবার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বনিবনা না হওয়াও সংস্কৃত কলেজের প্রিন্সিপাল এবং স্কুল ইন্সপেক্টরের পদ থেকে দু’বছর আগে পদত্যাগও করেছেন।

আর মাইকেলও তখন একজন প্রতিষ্ঠিত কবি, নাট্যকার। মেঘনাদবধ কাব্য প্রকাশিত না হলেও শর্মিষ্ঠা লেখা হয়ে গেছে, যার জন্য পরবর্তীকালে তিনি আধুনিক বাংলা নাটকের জনক হিসেবে স্বীকৃত হবেন। তিনি লিখে ফেলেছেন বাংলা ভাষায় দু’টি অনবদ্য প্রহসন, একেই কি বলে সভ্যতাবুড় শালিকের ঘাড়ে রোঁ। এছাড়া পদ্মাবতী নাটকে অমিত্রাক্ষর ছন্দের ব্যবহার পরীক্ষা করার পর সম্প্রতি অমিত্রাক্ষর ছন্দে বাংলাভাষায় প্রথম কাব্যগ্রন্থ তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য লিখেছেন। ইতিমধ্যে মধুসূদন তাঁর জীবনের মাদ্রাজ-পর্ব শেষ করে এসেছেন, তাঁর চার সন্তানের জননী রেবেকার সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়েছে এবং তিনি আরেক শ্বেতাঙ্গিনী হেনরিয়েটার সঙ্গে নতুন সংসার করছেন।

দুই


বাংলাভাষায় মধুসূদন দত্ত প্রথম অমিত্রাক্ষর ছন্দ প্রবর্তন করার পর পয়ার ত্রিপদীতে অভ্যস্থ বাঙালী পাঠকের অনেকেরই এই ছন্দ পছন্দ হয়নি। প্রথম দিকে বিদ্যাসাগরেরও হয়নি। তিনি নাকি ঠাট্টা করে বলতেন,

তিলোত্তমা বলে ওহে শুনো দেবরাজ
তোমার সঙ্গে আমি কোথায় যাইব

বিদ্যাসাগর অমিত্রাক্ষর ছন্দ পছন্দ করেন নি এ খবর মাইকেলের কাছে পৌঁছাতে সময় লাগে নি। এ সময় মাইকেল তাঁর বন্ধু রাজনারায়ণ বসুর কাছে যে চিঠি লিখেছিলেন তা থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় তখন পণ্ডিত বিদ্যাসাগরের প্রতি তিনি বিরূপ ছিলেন। তবে সামান্য তিক্ততার মধ্য দিয়ে শুরু হলেও দ্রুতই সম্পর্কটি উষ্ণ হয়ে ওঠে।

কিছুদিন পর বিদ্যাসাগর তিলোত্তমাসম্ভব-এর কাব্যসৌন্দর্য উপলব্ধি করতে সক্ষম হন। দেখা যাচ্ছে রাজনারারণ বসুকে একটি চিঠিতে মাইকেল লিখছেন, “You will be pleased to hear that the Pundits are coming round regarding Tilottoma. The renowned Vidyasagar has at last condescended to see ‘Great merit’ in it”। এর পর মাইকেল বিদ্যাসাগরের প্রতি অত্যন্ত প্রসন্ন হয়ে ওঠেন। বিদ্যাসাগর তখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যক্তি। তাঁর প্রশংসার যথেষ্ট গুরুত্বও ছিল। এসময় বিধবাবিবাহে অবদানের জন্য মাইকেল তাঁর বেতনের অর্ধেক টাকা বিদ্যাসাগরের একটি প্রস্তর মূর্তি নির্মাণের জন্য দেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন।

এর পরবর্তী দুই বছরে বিদ্যাসাগর এর সঙ্গে মাইকেলের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। মধুসূদন তখন কলকাতা পুলিশ কোর্টে চাকরী করেন। হিন্দু পেট্রিয়ট পত্রিকার সম্পাদক হরিশ্চন্দ্রের মৃত্যুর পর তাঁর সম্পাদিত হিন্দু পেট্রিয়ট উঠে যাওয়ার উপক্রম হলে কালীপ্রসন্ন সিংহ হরিশ্চন্দ্রের পরিবারকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে প্রেস ও পত্রিকাটি কিনে নেন। কিছুদিন পর পত্রিকা চালাতে গিয়ে সমস্যায় পড়লে তিনি বিদ্যাসাগরের শরণাপন্ন হলেন। ১৮৬২ সালে বিদ্যাসাগরের অনুরোধে মাইকেল কিছুদিন হিন্দু পেট্রিয়ট পত্রিকার সম্পাদনা করেন। কিন্তু পত্রিকার আয়ের অভাবে নিয়মিত পারিশ্রমিক না পাওয়ায় হিন্দু পেট্রিয়ট-এর সঙ্গে তাঁর এই সম্পর্ক সম্ভবত দীর্ঘদিন স্থায়ী হয় নি।

মাইকেল ১৮৬৩ সালে প্রকাশিত তাঁর বীরাঙ্গনা কাব্য বিদ্যাসাগরকে উৎসর্গ করেন। উৎসর্গ পত্রে তিনি লিখেছিলেন, ‘বঙ্গকুলচূড় শ্রীযুক্ত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহোদয়ের চিরস্মরণীয় নাম এই অভিনব কাব্যশিরে শিরোমণিরূপে স্থাপিত করিয়া, কাব্যকার ইহা উক্ত মহানুভবের নিকট যথোচিত সম্মানের সহিত উৎসর্গ করিল।’

এসময় রাজনারায়ণ বসুর কাছে লেখা চিঠিতে তিনি বিদ্যাসাগরকে ‘a splendid fellow’, ‘the first man among us’ এবং ‘above flattering any man’ বলে উল্লেখ করেন।

তিন


কিছুদিন পর ব্যারিস্টারী পড়ার জন্য মাইকেল বিলেত যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এতে বিদ্যাসাগর তাঁকে উৎসাহ দিয়েছিলেন এবং নানাভাবে সাহায্য করেছিলেন। বিলেত যাওয়ার খরচ জোগাড় করার জন্য তিনি পৈত্রিক বাড়ি ও আরো কিছু সম্পত্তি বিক্রি করেন। বেশ কয়েকজনের কাছ থেকে ধার করেছিলেন। বিদ্যাসাগরের নিকট থেকেও ধার করেছিলেন এক হাজার টাকা।

স্থির হয়েছিল তাঁর স্ত্রী হেনরিয়েটা পুত্র-কন্যা নিয়ে কলকাতাতেই থাকবেন। বিলেত যাওয়ার আগে মাইকেল সুন্দরবন এলাকায় অবস্থিত তাঁর কিছু সম্পত্তি তাঁর পৈত্রিক আমলের কর্মচারী মহাদেব চট্টোপাধ্যায়ের স্ত্রীকে সাত বছরের জন্য পত্তনি দেন। ঠিক হয়েছিল এর বিনিময়ে প্রতিমাসে মাইকেলের স্ত্রী হেনরিয়েটাকে দেড় শ’ টাকা দেয়া হবে আর মাইকেলের প্রাপ্য বাকি টাকা প্রতি বছর চার কিস্তিতে ইংল্যান্ডে তাঁর কাছে পাঠানো হবে।

১৮৬২ সালের জুন মাসে মাইকেল বিলেত গেলেন। গ্রে’জ ইন-এ ব্যারিস্টারী পড়তে শুরু করলেন। কিন্তু তিনি যাঁদের সঙ্গে টাকা পয়সা পাঠাবার ব্যবস্থা করে গিয়েছিলেন কিছুদিন পর তাঁরা টাকা পাঠানো বন্ধ করে দিলেন। হেনরিয়েটার কাছেও টাকা পয়সা আসা বন্ধ হয়ে গেল। বাধ্য হয়ে তিনি পুত্র-কন্যা নিয়ে মাইকেল-এর কাছে বিলেতে চলে গেলেন। এর ফলে বিদেশে টাকা পয়সার অভাবে মাইকেলকে খুবই অসুবিধায় পড়তে হয়। লন্ডনে খরচ চালাতে না পেরে ১৮৬৩ সালের মাঝামঝি তিনি লন্ডন থেকে ভার্সাই চলে এলেন। কিন্তু দেশ থেকে দীর্ঘদিন টাকা না পাওয়ায় তাঁকে ধার দেনা করে চলতে হয়, জিনিসপত্র বন্ধক দিতে হয়। বাংলা সাহিত্যে অমিত্রাক্ষর ছন্দ প্রবর্তনের জন্য কালীপ্রসন্ন সিংহ মাইকেলকে একটি রূপার পানপাত্র উপহার দিয়েছিলেন। সেটিও মাইকেল বন্ধক দিয়েছিলেন। তাঁর দুরবস্থার কথা জানতে পেরে একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান তাঁর দরজায় খাবার ও বাচ্চাদের জন্য দুধ রেখে যেত। শেষে পরিস্থিতি এমন হল যে দেনার দায়ে মেঘনাদবধ কাব্যের কবিকে বুঝি জেলে যেতে হয়!

এই পরিস্থিতিতে মাইকেল বিদ্যাসাগরকে চিঠি লিখলেন। নিজের দুরবস্থার বর্ণনা দিয়ে তাঁর সাহায্য চাইলেন। বিদ্যাসাগর যাতে নিশ্চিতভাবে তাঁর চিঠি পান, এর জন্য তিনি একটি দু’টি নয়, তিনটি চিঠি লিখলেন বিদ্যাসাগরকে। তৃতীয় চিঠিতে মাইকেল লিখলেন,
আমি আশা করি আমাকে মেঘনাদ কাব্যের রামের মত বলতে হবে না, ‘বৃথা হে জলধি আমি বাঁধিনু তোমারে’।
আমার মন তিক্ততায়, রাগে আর হতাশায় ভরে গেছে; তাই এই চিঠির ভুল ও নিরস সুর মার্জনা করবেন।
পুনশ্চ: আশা করি আপনি ফ্রান্সে আমাকে চিঠি লিখবেন এবং আমি আমার দেশবাসীকে এই কথা বলার জন্য বেঁচে থাকবো যে, আপনি কেবল বিদ্যাসাগর নন, করুণাসাগরও বটে।***

বিদ্যাসাগর তখন নিজেই মহা-ঝামেলায় আছেন। চাকরী নেই, তবুও প্রতিমাসে তাঁর দেয়া মাসোহারার অপেক্ষায় থাকেন এমন লোকের তালিকা দীর্ঘ। বিধবাবিবাহের কারণে বিশাল ঋণভারে তিনি জর্জরিত। তিনি মধুসূদনের বন্ধুবান্ধব ও অন্যান্যদের নিকট থেকে অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে, ঋণ করে মধুকবিকে ফ্রান্সে টাকা পাঠালেন।

সেদিন রবিবার। ১৮৬৮ সালের ২৮ আগস্ট। মাইকেলের স্ত্রী হেনরিয়েটার মন খুব খারাপ। তিনি মাইকেলের কাছে এসে বললেন, ‘ছেলেমেয়েরা মেলায় যেতে চাচ্ছে। কিন্তু আমার কাছে আছে মাত্র তিন ফ্রাঁ। তোমার দেশের লোক আমাদের সঙ্গে এত নিষ্ঠুর ব্যবহার করছে কেন?’

মাইকেল বললেন ‘আজই ডাক আসবে। আমি নিশ্চিত এই ডাকে কোন সুখবর আসছে। কারণ আমি যাঁর কাছে চিঠি লিখেছি, তাঁর প্রজ্ঞা প্রাচীন ঋষির মতো, তাঁর শক্তি ও তেজ ইংরেজদের মতো আর তাঁর হৃদয় বাঙালী মায়ের মতো। (the man to whom I have appealed has the genius and wisdom of an ancient saint, the energy of an Englishman, and the heart of a Bengali mother)’. আসলেই এক ঘণ্টা পর বিদ্যাসাগরের চিঠি এলো। সঙ্গে দেড় হাজার টাকা।

বিদ্যাসাগর প্রথমে দেড় হাজার টাকা পাঠানোর পর কলকাতায় মাইকেলের পাওনা কিছু টাকা উদ্ধারের চেষ্টা করলেন। তারপর অনুকূলচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে তিন হাজার ও শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্নের**** নিকট থেকে পাঁচ হাজার, এই আট হাজার টাকা ধার করে মাইকেলকে পাঠালেন। কিন্তু এসব টাকা তো মাইকেলের কাছে নস্যি। তাঁর অনেক টাকা দরকার। অবশেষে তিনি বিদ্যাসাগরকে তাঁর এজেন্ট নিযুক্ত করে ওকালতনামা পাঠালেন। এবার বিদ্যাসাগর মাইকেল-এর সম্পত্তি বন্ধক রেখে পাঠালেন আরো টাকা। প্রয়োজনীয় টাকা পাওয়ার পর মাইকেল লন্ডনে ফিরে যান এবং গ্রেজ ইনে ব্যারিস্টারী পড়া শেষ করেন। ব্যারিস্টারী পাশের খবর বিদ্যাসাগরকে জানিয়ে মাইকেল লিখেছিলেন,
আমি নিশ্চিত আপনি জেনে দারুণ খুশি হবেন যে, গতরাতে গ্রেজ ইন সোসাইটি আমাকে বারে ডেকে পাঠিয়েছিল এবং অবশেষে ব্যারিস্টার হয়েছি। এর সবকিছুর জন্য আমি ঋণী প্রথমে ঈশ্বর তাঁর নীচে আপনার কাছে। এবং আপনাকে আমি নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারি, আমি চিরদিন আপনাকে আমার সবচেয়ে বড়ো উপকারী এবং সবচেয়ে খাঁটি বন্ধু বলে বিবেচনা করবো। আপনি না-হলে আমার যে কী হতো!...প্রিয় বিদ্যাসাগর, আমি জানি আপনি ছাড়া আমার কোন বান্ধব নেই। (গোলাম মুরশিদের অনুবাদ)

এই চিঠিতেই মাইকেল জানান যে, তিনি তাঁর পদবীর বানান ইংরেজী Dutt থেকে সংস্কৃত Dutta করেছেন। এখন তিনি Michael Madhusudhana Dutta Esquire ওয়েস্টমিনিস্টারে কোর্ট অব কমন বেঞ্চ-এ ইংলিশ ব্যারিস্টার হিসেবে তিনি তালিকাভুক্তও হয়ে এসেছেন। এখন তিনি স্ত্রী-পুত্রকে ফ্রান্সে রেখে ফরাসী জাহাজে দেশে ফিরবেন। দীর্ঘ যাত্রাপথে তাঁর যদি কিছু হয় তবে তাঁর স্ত্রী ও দু’টি শিশু সন্তান বিদ্যাসাগরের কাছেই সাহায্য চাইবে। সম্ভবত এরকম কোন এক সময় তিনি বিদ্যাসাগরের নামে এই সনেটটি রচনা করেন :

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে।
করুণার সিন্ধু তুমি, সেই জানে মনে,
দীন যে, দীনের বন্ধু!—উজ্জ্বল জগতে
হেমাদ্রির হেম-কাস্তি অম্লান কিরণে
কিন্তু ভাগ্য-বলে পেয়ে সে মহা পৰ্ব্বতে,
যে জন আশ্রয় লয় সুবর্ণ চরণে,
সেই জানে কতো গুণ ধরে কতো মতে
গিরীশ। কি সেবা তার সে সুখ-সদনে!
দানে বারি নদীরূপ বিমলা কিঙ্করী;
যোগায় অফাত ফল পরুন আদরে
দীর্ঘ শিরঃ তরু-দল, দাসরূপ ধরি;
পরিমলে ফুল-কুল দশ দিশ ভরে;
দিবসে শীতল-শ্বাসী ছায়া, বনেশ্বরী,
নিশায় সুশান্ত নিদ্রা, ক্লান্তি দূর করে!


বিদ্যাসাগরের নিকট লেখা মাইকেলের একটি চিঠি থেকে আমরা জানতে পারছি যে সেসময় প্যারিসের বইয়ের দোকানে বিদ্যাসাগরের বই বিক্রি হতো! একদিন মাইকেল প্যারিসের এক বইয়ের দোকানে বিদ্যাসাগরের বই দেখে দোকানিকে গর্বভরে জানান, ‘এই লেখক আমার অনেক বড় বন্ধু।’

চার


মাইকেল ছিলেন সে-সময়ের বিখ্যাত উকিল রাজনারায়ণ দত্তের চার স্ত্রীর সন্তানদের মধ্যে একমাত্র জীবিত সন্তান। বালক বয়স থেকেই তিনি পরিবারের প্রশ্রয়ে অত্যন্ত অমিতব্যয়ী হয়ে উঠেন। এই অমিতব্যয়িতা সারাজীবন তাঁর পিছু ছাড়ে নি এবং এর জন্য তাঁর ভোগান্তির অন্ত ছিল না। তাঁর শেষ জীবনের করুণ পরিণতি ও অকাল মৃত্যুর জন্যও তাঁর এই বেহিসেবিপনাই মূলত দায়ী ছিল।

ব্যারিস্টার হয়ে ১৮৬৭ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে মাইকেল ভারতে ফিরে আসেন। স্ত্রী ও সন্তানরা ফ্রান্সেই রইলেন। এর কয়েকমাস আগে বিদ্যাসাগরকে লেখা এক চিঠিতে মাইকেল লিখেছিলেন, তিনি কলকাতায় এসে উঠবেন বিদ্যাসাগরের বাড়ির একটা ঘরে, আর পর্যাপ্ত পরিমাণে ডালভাত পেলেই খুশি হবেন। কিন্তু তবুও মাইকেল আসার আগে বিদ্যাসাগর তাঁর জন্য সুকিয়া স্ট্রিট-এ একটি তিনতলা বাসা ভাড়া করে সাহেবী কায়দায় সাজিয়ে রাখেন। কিন্তু মাইকেল এসে উঠলেন সাহেব পাড়ায় দামি হোটেল স্পেন্সেস-এ! ভাড়া করলেন হোটেলের তিনটি কক্ষ। তিনি হোটেল স্পেন্সেস- এ উঠেছেন শুনে সেখানে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এলেন অসুস্থ বিদ্যাসাগর। মাইকেল এসে বিদ্যাসাগরকে জড়িয়ে ধরলেন, বারবার তাঁর মুখ চুম্বন করলেন। কিন্তু বিদ্যাসাগরের অনুরোধ সত্ত্বেও হোটেল ছাড়তে রাজি হলেন না।

মাইকেল ব্যারিস্টারী শুরু করলেন কলকাতা হাইকোর্টে। তখন কলকাতা হাইকোর্টে প্র্যাক্টিস করতেন চল্লিশজন ব্যারিস্টার। আর তাঁদের মধ্যে তাঁকে নিয়ে বাঙালী ছিলেন মাত্র তিন জন।১০ তাই ব্যারিস্টার হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে মাইকেলের খুব একটা বেগ পেতে হতো না। কিন্তু তাঁর হলো না। প্রথম দিকে তিনি বেশ ভালোই শুরু করেছিলেন। মাসিক আয় এক হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা পর্যন্ত হয়েছিল।১১ কিন্তু সেই অবস্থা বেশীদিন ছিল না। তিনি যতো আয় করতেন ব্যয় করতেন তার চেয়ে বেশী। তার উপর আবার প্রতিমাসে কিছু টাকা পাঠাতে হতো ফ্রান্সে স্ত্রীর কাছে। তাছাড়া বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে হৈ হুল্লোড় পান-ভোজনের ব্যয় তো ছিলই। বিদ্যাসাগরের ঋণের কথা তিনি ভুলে যান নি কিন্তু তা পরিশোধ করার মতো অবস্থা তাঁর হয় নি। এতো বেহিসেবি খরচ করার কারণে মাইকেলের অভাব আর কাটতো না। তিনি নানা জনের কাছে একের পর এক ঋণ করেই চলতেন। বিদ্যাসাগরের কাছ থেকে তিনি আবার টাকা চেয়েছেন, বিদ্যাসাগররের মাধ্যমে অন্যদের কাছ থেকে আরো ঋণ নিয়েছেন। সেসব টাকা যথেচ্ছ ব্যয় করে উড়িয়ে দিয়েছেন।

এদিকে যাঁদের নিকট থেকে ধার করে মাইকেলকে ফ্রান্সে টাকা পাঠিয়েছিলেন তাঁরা বিদ্যাসাগরকে বারবার তাগিদ দিচ্ছিলেন। শ্রীশচন্দ্রতো বিদ্যাসাগরের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করার হুমকি দেন। অনন্যোপায় বিদ্যাসাগর মাইকেলকে লিখলেন:
অনেকের এরূপ সংস্কার আছে, আমি যাহা বলি, কোনোক্রমে তাহার অন্যথাভাব ঘটে না, সুতরাং তাঁহারা অসন্ধিগ্ধচিত্তে আমার বাক্যে নির্ভর করিয়া কার্য্য করিয়া থাকেন। লোকের এরূপ বিশ্বাসভাজন হওয়া যে প্রার্থনীয় তাহার সন্দেহ নাই। কিন্তু আমি অবিলম্বে সেই বিশ্বাসে বঞ্চিত হইব, তাহার পূর্ব লক্ষণ ঘটিয়াছে। যৎকালে আমি অনুকূল বাবুর নিকট টাকা লই, অঙ্গীকার করিয়াছিলাম, আপনি প্রত্যাগমন করিলেই পরিশোধ করিব; তৎপরে পুনরায় যখন আপনার টাকার প্রয়োজন হইল, তখন যথাকালে টাকা না পাইলে পাছে আপনার ক্ষতি বা অসুবিধা হয়, এই আশঙ্কায় অন্য কোন উপায় না দেখিয়া শ্রীশচন্দ্রের নিকট কোম্পানীর কাগজ ধার করিয়া টাকা পাঠাইয়া দি। তাহার ধার ত্বরায় পরিশোধ করিব এই অঙ্গীকার ছিল। কিন্তু উভয়স্থলে আমি অঙ্গীকারভ্রষ্ট হইয়াছি এবং শ্রীশচন্দ্র ও অনুকূল বাবু সত্বর টাকা না পাইলে বিলক্ষণ অপদস্ত ও অপমানগ্রস্ত হইব, তাহার কোনো সংশয় নাই।

এক্ষণে কিরূপে আমার মানরক্ষা হইবেক, এই দুর্ভাবনায় সৰ্ব্বক্ষণ আমার অন্তঃকরণকে আকূল করিতেছে, এবং ক্রমে ক্রমে এত প্রবল হইতেছে যে রাত্রিতে নিদ্রা হয় না। অতএব আপনাদের নিকট বিনয়বাক্যে প্রার্থনা এই, সবিশেষ যত্ন ও মনোযোগ করিয়া ত্বরায় আমার পরিত্রাণ করেন। পীড়াশান্তি এবং স্বাস্থ্যলাভের নিমিত্ত পশ্চিমাঞ্চলে যাওয়া এবং অন্ততঃ ছয় মাস কাল তথায় থাকা অপরিহার্য্য হইয়া উঠিয়াছে। আশ্বিনের প্রথম ভাগে যাইব বলিয়া স্থির করিয়াছি। কিন্তু আপনি নিস্তার না করিলে কোন মতেই যাইতে পারিব না। এই সমস্ত আলোচনা করিয়া যাহা বিহিত বোধ হয় করিবেন, অধিক আর কি লিখিব,আমি নিজে চেষ্টা ও পরিশ্রম করিয়া কার্য্য শেষ করিয়া লইব, আমার শরীরের যে অবস্থা তাহাতে সে প্রত্যাশা করিবেন না। অনেক লিখিব ভাবিয়াছিলাম, কিন্তু অসুস্থতাবশতঃ পারিলাম না।

বিদ্যাসাগরের এ চিঠি পেয়ে মাইকেল ব্যথিত হয়েছিলেন। তিনি অনুধাবন করতে পারছিলেন তাঁর এক নিঃস্বার্থ পরার্থপর বন্ধুকে তিনি কী বিপদে ফেলেছেন। তিনি বিদ্যাসাগরকে জবাব লিখলেন :
কয়েক মিনিট আগে আমার হাতে আপনার যে চিঠি পৌঁছেছে, তা থেকে আমি দারুণ কষ্ট পেয়েছি। আপনি জানেন, এ পৃথিবীতে বলতে গেলে এমন কিছু নেই যা আমি আপনার জন্যে করতে পারবো না। আমার জন্যে যে-অপ্রীতিকর বোঝা আপনি তুলে নিয়েছেন, তা থেকে মুক্তি লাভের জন্যে আপনি যে-কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেন—তাতে আমার সম্মতি রয়েছে জানবেন। (গোলাম মুরশিদের অনুবাদ)

বিদ্যাসাগরের অসুস্থতার খবর পেয়েও মাইকেল তাঁকে দেখতে যেতে পারেন নি। কারণ তিনি নিজেও তখন অসুস্থ ছিলেন। তিনি এই কবিতাটি লিখে বিদ্যাসাগরকে পাঠান:

পণ্ডিতবর
শ্রীযুক্ত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

শুনেছি লোকের মুখে পীড়িত আপনি
হে ঈশ্বরচন্দ্র! বঙ্গে বিধাতার বরে
বিদ্যার সাগর তুমি; তব সম মণি,
মলিনতা কেন কহ ঢাকে তার করে?
বিধির কি বিধি সূরি, বুঝিতে না পারি,
হেন ফুলে কীট কেন পশিবারে পারে?
করমনাশার স্রোত অপবিত্র বারি
ঢালি জাহ্নবীর গুণ কি হেতু নিবারে?
বঙ্গের সুচূড়ামণি করে হে তোমারে
সৃজিলা বিধাতা, তোমা জানে বঙ্গজনে
বিধিতে হে বঙ্গরত্ন! এ হেন রতনে?
যে পীড়া ধনুক ধরি হেন বাণ হানে
(রাক্ষসের রূপ ধরি), বুঝিতে কি পার,
বিদীর্ণ বঙ্গের হিয়া সে নিষ্ঠুর বাণে?
কবিপুত্র সহ মাতা কাঁদে বারম্বার।

পাঁচ


অবশেষে মাইকেল তাঁর সম্পত্তি প্রকৃত মূল্যের চেয়ে কম দামে, মাত্র বিশ হাজার টাকায় বিক্রি করেন এবং তা থেকে উনিশ হাজার টাকা দিয়ে অনুকূলচন্দ্রের দেনা শোধ করেন। গোলাম মুরশিদ তাঁর লেখা মাইকেলের জীবনী আশার ছলে ভূলি-তে বলেছেন, মাইকেল শ্রীশচন্দ্রের টাকা শোধ করেছিলেন কি না সে বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তিনি অনুমান করেছেন সম্পত্তি বিক্রির আগেই তিনি শ্রীশচন্দ্রের ধার পুরো বা আংশিক পরিশোধ করেছিলেন।১২

মাইকেলের সম্পত্তি বিক্রির দলিল সম্পাদিত হয় ১৮৬৮ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে।১৩ কিন্তু তাঁর নয় মাস পরে ৭ সেপ্টেম্বর মাইকেলের কাছে লেখা বিদ্যাসাগরের চিঠি১৪ থেকে জানা যাচ্ছে আদালতের মামলা হওয়া থেকে বাঁচার জন্য বিদ্যাসাগর মাইকেলকে কিছু শর্তে পাঁচ হাজার টাকা অগ্রীম দিতে এক ব্যক্তিকে সম্মত করিয়েছেন, যা থেকে শ্রীশচন্দ্রের ঋণ শোধ করা যায়। কিন্তু এর জন্য একটি দলিল স্বাক্ষর ও রেজিস্ট্রেশন করার প্রয়োজন ছিল। বিদ্যাসাগর দলিলের একটি খসড়া মাইকেলের কাছে পাঠান এবং পরবর্তী বুধবার কয়েক মিনিটের জন্য রেজিস্ট্রি অফিসে আসার জন্য অনুরোধ করেন। তার অর্থ হলো মাইকেল শ্রীশচন্দ্রের ধার ‘পুরো বা আংশিক’ আগেই পরিশোধ করেছিলেন গোলাম মুরশিদের এই অনুমান ঠিক নয়।

বিদ্যাসাগরের জীবনীকার সুবলচন্দ্র মিত্র লিখেছেন যে মাইকেল বিদ্যাসাগরের উপদেশ ও অনুরোধে সাড়া না দেয়ায় এবং শ্রীশচন্দ্রের জরুরী তাগিদে ১৮৬৯ সালের ৯ আগস্ট রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও কালীচরণ ঘোষের কাছে তাঁর ‘সংস্কৃত প্রেস’ এর দুই-তৃতীয়াংশ আট হাজার টাকায় বিক্রি করেন এবং শ্রীশচন্দ্রের ঋণ শোধ করেন।১৫ বিদ্যাসাগরের জীবনীকার চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ও লিখেছেন যে মাইকেলের জন্য যে ঋণ ছিল তা পরিশোধ করতে বিদ্যাসাগরকে তাঁর ছাপাখানা ‘সংস্কৃত যন্ত্ৰ’— এর তিনভাগের দুই ভাগ বিক্রি করতে হয়েছিল।১৬ বিদ্যাসাগরের অনুজ শম্ভুচন্দ্রের বইয়েও মাইকেলের ঋণ শোধ করার জন্য প্রেস বিক্রির কথা আছে।১৭ এদের বিদ্যাসাগর জীবনীকার বিহারীলাল আরো নির্দিষ্ট করে বলেছেন,
১২৭৬ সালের ২৬ শ্রাবণ বা ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দের ৯ আগস্ট বিদ্যাসাগর মহাশয় পরম বন্ধু রাজকৃষ্ণ বাবুকে সংস্কৃত প্রেসের এক তৃতীয়াংশ চারি সহস্র টাকায় এবং কালীচরণ ঘোষকে তৃতীয়াংশ চারি সহস্র টাকায় বিক্রয় করেন। রাজকৃষ্ণ বাবুর মুখেই শুনিয়াছি শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন পাওনা টাকার জন্য পীড়াপীড়ি করাতে বিদ্যাসাগর মহাশয় ছাপাখানার অংশ বিক্রয় করিয়া তাঁহার দেনা পরিশোধ করেন।১৮

মাইকেলের একজন আদি জীবনীকার যোগীন্দ্রনাথ বসুও লিখেছেন,
মধুসূদন বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ঋণের কিয়দংশ মাত্র পরিশোধ করিতে পারিয়াছিলেন। অবশিষ্ট তাঁহার মৃত্যুকাল পর্যন্ত অপরিশোধিত ছিল।১৯

গোলাম মুরশিদ বিদ্যাসাগরের জীবনীকার বিহারীলালের দেয়া এই তথ্য নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তবে তিনি বিদ্যাসাগরের অন্যান্য জীবনীকারের বক্তব্য বা যোগীন্দ্রনাথ বসুর বক্তব্য নিয়ে কিছু বলেন নি। তাঁর সন্দেহের সপক্ষে তিনি যে যুক্তি দিয়েছেন, তা যুক্তি হিসেবে দুর্বল। তিনি লিখেছেন :
বিদ্যাসাগর যদি নিজে শ্রীশচন্দ্রের পাঁচ হাজার টাকা শোধ দিয়ে থাকেন, তা হলেও তিনি সেকথা কোথাও লেখেন নি বা অন্যদের বলেন নি। মাইকেলকে লেখা তাঁর পরবর্তী চিঠিপত্রে অথবা তাঁকে লেখা মাইকেলের চিঠিপত্রে এর কোনো ইঙ্গিতও নেই। এর কারণ বোঝা যায় না। ১৮৬৯ সালে বিদ্যাসাগর যখন কাশিম বাজারের মহারাণী স্বর্ণময়ীর দেওয়ান রাজীবলোচন রায়কে অনুরোধ জানিয়ে টাকা ধার করেন, তখনও চিঠিতে বিধবাবিবাহের কারণে তাঁর ঋণের কথা উল্লেখ করেছেন, মাইকেলের ধার শোধ দিতে গিয়ে ঋণী হবার কথা বলেন নি।২০

বিধবাবিবাহের জন্য বিদ্যাসাগরের ঋণ আর মাইকেলের জন্য ঋণ একই প্রকৃতির ঋণ ছিল না। বিধবাবিবাহ প্রবর্তনের সময় অনেকেই এর জন্য এককালীন ও নিয়মিত অর্থ সাহায্য দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এঁদের প্রতিশ্রুতির ভরসায় বিদ্যাসাগর ঋণ করেছিলেন। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে বেশীর ভাগ প্রতিশ্রুতিদাতাই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন। এঁদের এই আচরণে বিদ্যাসাগর প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ ও হতাশ হয়েছিলেন এবং সঙ্গত কারণেই তাঁর ক্ষোভ ও হতাশা গোপন রাখেন নি। বিধবাবিবাহের জন্য বিদ্যাসাগরের ঋণ সাড়ে সাত হাজার টাকা ছিল না। আরো অনেক বেশী ছিল। তিনি ধীরে ধীরে সেই ঋণ শোধ করছিলেন। কিন্তু দুই ব্যক্তির কাছে বেশী টাকার ঋণ ছিল এবং তাঁরা এককালীন টাকা চাচ্ছিলেন। একারণে তিনি রাজীবলোচনের মাধ্যমে স্বর্ণময়ীর কাছে ধার চেয়েছিলেন। বিধবাবিবাহের জন্য বিদ্যাসাগরের ঋণগ্রস্ততার জন্য তাঁর প্রতি অনেকেরই সহানুভূতি ছিল। তাই তিনি রানী স্বর্ণময়ীর নিকট থেকে তিনি শুধু সুদমুক্ত ঋণই পান নি, বলা হয়েছিল যখন সুবিধা হবে তখন এই ঋণ পরিশোধ করলে চলবে।২১ বিধবাবিবাহের এই ঋণ পরিশোধের জন্য টাকা ধার চাওয়ার সময় মাইকেলের ঋণের কথাও কেন বিদ্যাসাগরের উল্লেখ করতে হবে বলে গোলাম মুরশিদের মনে হলো তা বোঝা যাচ্ছে না। মাইকেল তাঁর স্নেহের পাত্র ও বন্ধু ছিলেন। তিনি স্বেচ্ছায় এবং ঝুঁকি নিয়ে বার বার তাঁকে সাহায্য করেছিলেন। তাঁর কাছে একজন বিখ্যাত বন্ধুর ঋণ নিয়ে সবাইকে বলে বেড়াবেন বিদ্যাসাগরই কি তেমন রুচির লোক ছিলেন?২২ আর শ্রীশচন্দ্রের ঋণ বিদ্যাসাগর পরিশোধ করেছেন এমন কথা কোনো চিঠিতে যেমন উল্লেখ নেই তেমনি মাইকেল এই ঋণ আংশিক বা সম্পূর্ণ পরিশোধ করেছেন বলেও কোনো চিঠিতে উল্লেখ নেই।

বিদ্যাসাগর ও মাইকেলের জীবনীকারদের দেয়া সুনির্দিষ্ট তথ্য নাকচ করে গোলাম মুরশিদ নিছক অনুমানের ভিত্তিতে কেন লিখেন ‘এর পরও যুদ্ধংদেহী শ্রীশচন্দ্রের ধার শোধ দিতে বিদ্যাসাগর তাঁকে (মাইকেলকে) নিশ্চয়ই সাহায্য করেছিলেন’ তা বুঝা যায় না। এর পরই তিনি লিখেছেন, ‘কিন্তু কিভাবে এ ঋণ শোধ হয়েছিল তা পরিষ্কার বলা যায় না।২৩ আবার একটু পরেই তিনি লিখেছেন,
১৮৬৮ সালের শেষদিকে বিদ্যাসাগরকে লেখা কবির দু’টি চিঠি থেকেও জানা যায় যে, তখনও বিদ্যাসাগর কবির বৈষয়িক ব্যাপারের সঙ্গে জড়িত। এই চিঠিতে কবি একটি দলিল রেজিস্ট্রি করার জন্য রেজিস্ট্রি অফিসে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন। তিনি উল্লেখ করেছিলেন যে বিদ্যাসাগর তারিখটাকে ১৮৬৮ সালের অক্টোবর থেকে পরিবর্তন করে নভেম্বরে করলে তিনি যেতে পারবেন। এই দলিল কিসের তা জানা যায় নি। কিন্তু মনে হয়, নতুন কোনো ধার জোটানো অথবা পুরোনো কোনো আর্থিক সমস্যা মোচনের সঙ্গে এর যোগ ছিল।২৪

এখানে যে কারণে রেজিস্ট্রি অফিসে যাওয়ার কথা হচ্ছে তা যে শ্রীশচন্দ্রের পাওনা পরিশোধের সঙ্গে সম্পর্কিত তা ১৮৬৮ সালের ৭ সেপ্টেম্বর মাইকেলের কাছে লেখা বিদ্যাসাগরের চিঠি থেকে স্পষ্টই বোঝা যায়। আমাদের সন্দেহ হচ্ছে গোলাম মুরশিদ বিদ্যাসাগরের এই চিঠিটি দেখেন নি কিন্তু এ বিষয়ে মাইকেলের জবাবটি দেখেছেন। তবে এই পত্র বিনিময়ের উদ্দেশ্য তিনি ঠিকই আঁচ করতে পেরেছেন।

ছয়


সম্পত্তি বিক্রি করে বিশ হাজার টাকা পেয়ে উনিশ হাজার টাকা অনুকূলচন্দ্রকে দেয়ার পর মাইকেলের কাছে এক হাজার টাকা ছিল। কিন্তু সপ্তাহ তিনেকের মধ্যেই তিনি আবার অনেক অনুনয় বিনয় করে টাকা চেয়ে বিদ্যাসাগরের কাছে নীচের চিঠিটি লিখেন এবং পড়ার পর চিঠিটি ছিঁড়ে ফেলার অনুরোধ করেন :
আপনি যদি ইতর শ্রেণীর লোক হতেন অথবা হতেন আপনাকে যারা ঘিরে থাকে, সেই লোকদের মতো একজন সাধারণ মানুষ, তা হলে আমি আপনাকে আমার ব্যাপারে আবার জড়িয়ে পড়ার অনুরোধ জানাতে দ্বিধা করতাম, বিশেষ করে শ্রীশ লোকটা যখন যুদ্ধংদেহি মনোভাব নিয়েছে। কিন্তু বাঙালী হলেও, আপনি একজন মানুষ এবং আমি বিশ্বাস করি আমার মতো বিপদগ্রস্ত একজন লোককে বাঁচানোর জন্যে আপনি যেকোনো রকমের ঝুঁকি নিতে তৈরী থাকবেন। আমার বেচারী স্ত্রী খুবই আর্থিক অনটনের মধ্যে আছে— আপনাকে যখন আমি প্রথম লিখেছিলাম প্রায় তেমন খারাপ অবস্থায়, এবং আমি এ পরিস্থিতিতে একেবারে অসহায়।...আপনি স্বভাবতই একজন মহৎ লোক, এবং বাঙালী হলেও (আমি যদি খুব ভুল না-করে থাকি) আপনি আমার কষ্ট বুঝতে পারবেন এবং আমার প্রতি সহানুভূতি বোধ করবেন।...আগামী ২৫ তারিখে ফ্রান্সের উদ্দেশ্যে যে-ডাক যাবে, তার আগে আপনি এ টাকাটা আমাকে জোগাড় করে না-দিলে ইউরোপে বসে তারা প্রায় মরে যাবে।

এ যাবৎ আপনার মতো মহৎ কোনো বাঙালীর জন্ম হয় নি। লোকেরা আপনার কথা বলে উচ্ছ্বসিত হৃদয় নিয়ে আর সজল চোখে। এবং আমার সবচেয়ে বড়ো শত্রুও এ কথা বলতে সাহস পাবে না যে, আমি একটা খারাপ লোক। দয়া করে আমার দিকে নজর দিন এবং এমন একজন লোককে সাহায্য করুন যে আপনাকে ভালোবাসে এবং যার আপনি ছাড়া পরোয়া করার মতো কোনো বন্ধু নেই। নিজে গিয়ে এ কথা আপনার কাছে বলার মতো সাহস আমার নেই। সে জন্যে, আমাকে ডেকে পাঠাবেন না। বরং সেই দুঃসাহস এবং শক্তি নিয়ে কাজ শুরু করুন, যা আপনাকে হাজার হাজার লাখপতির চেয়েও বেশী প্রিয়, বেশী সম্মানিত, বেশী শ্রদ্ধাভাজন করেছে। আপনি নিশ্চয় জানেন আমি প্রত্যাখ্যাত হবো না। অনুকূল আপনাকে এবং আমাকে যে-টাকা দেবার জন্যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তার মধ্য থেকে এক হাজার টাকা পাঠানোর জন্যে তাকে দয়া করে লিখুন। এটা-ওটা বলে এবং সবিনয়ে আমার প্রার্থনা না-মঞ্জুর করে একজন জঘন্য বাঙালীর মতো আমাকে একটা বাজে চিঠি লিখবেন না। পরিশেষে আমি আমার বন্ধু ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কাছে আবেদন জানাচ্ছি এবং এ রকমের পরিস্থিতিতে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর যেমন কাজ করতেন, তিনি তেমন করুন!২৫ (গোলাম মুরশিদের অনুবাদ)

এই চিঠি পেয়ে বিদ্যাসাগর ব্যথিত হলেও মাইকেলকে কোন সাহায্য করতে পারেন নি। তিনি নিজে তখন অসুস্থ এবং শয্যাশায়ী। আর শ্রীশচন্দ্রের ঋণ মাথায় নিয়ে, আদালতে মামলায় জড়ানোর ঝুঁকিতে থেকে আবার মাইকেলের জন্য ঝামেলায় জড়ানোর কোনো ইচ্ছাও হয়তো তাঁর ছিল না। তিনি মাইকেলের চিঠির এই ছোট্ট জবাব দিয়েছিলেন ইংরেজীতে:
আমি এখনও খুব অসুস্থ ও শয্যাশায়ী। ফলে আমার কোনো রকম শারীরীক ও মানসিক পরিশ্রম করার সামর্থ্য নেই। সেজন্য আপনার উদ্দেশ্য সফল করার ব্যাপারে আমার অপারগতা দয়া করে ক্ষমা করবেন। (গোলাম মুরশিদের অনুবাদ)

শেষ বাক্যটি লিখে কি ভেবে যেন কেটে দিয়েছেন।

আমরা ইতিমধ্যে জেনেছি ১৮৬৮ সালের সেপ্টেম্বর-এ বিদ্যাসাগর শ্রীশচন্দ্রের পাওনা মেটাবার জন্য মাইকেলের জন্য কিছু শর্ত সাপেক্ষে পাঁচ হাজার টাকা পাওয়ার একটি ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মাইকেল এই ব্যবস্থায় আসেন নি। সম্ভবত এরপর থেকে বিদ্যাসাগর মাইকেলের ব্যাপার থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কারণ ১৮৫৮ সালের অক্টোবরের এক চিঠিতে মাইকেল বিদ্যাসাগরকে লিখছেন, ‘তুমি যদি আর আমাকে বন্ধু না মনে করো, তবে যত দ্রুত আমি এই বিপর্যয়ের খবর শুনি ততোই ভালো’।২৬ পরের বছর বাধ্য হয়ে প্রেসের অংশ বিক্রি করে বিদ্যাসাগর শ্রীশচন্দ্রের ঋণ শোধ করেন এবং এর পর থেকে হতাশ ও বিরক্ত হয়েই সম্ভবত মাইকেলের বিষয়ে সকল আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন।

বিদ্যাসাগরের কাছে মাইকেলের ক্লার্ক কৈলাশচন্দ্র বসুর লেখা একটি চিঠি থেকে এসময় মাইকেলের দেনার নিম্নলিখিত হিসাব পাওয়া যায় :
ট্রেডস এসোসিয়েশন ৫০০ টাকা, বাবু কালীচরণ ঘোষ ৫,০০০ টাকা, গোবিন্দচন্দ্র দে, বহুবাজার ৩,০০০ টাকা, দ্বারকানাথ মিত্র ২,৫০০ টাকা, প্রাণকৃষ্ণ দত্ত, শ্যামবাজার ১,১০০ টাকা, হরিমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, খিদিরপুর ১,৬০০ টাকা, রাজেন্দ্র দত্ত ডাক্তার, চন্দননগর ২০০ টাকা, কেদার ডাক্তার ২০০ টাকা, গোপীকৃষ্ণ গোস্বামী ১,০০০ টাকা, লালা, বড়বাজার ৮,৫০০ টাকা, গমেজ সাহেব ৫০০ টাকা, বিশ্বনাথ লাহা ১০০ টাকা, দে কোং ১০০ টাকা, মানভূম ৫০০ টাকা, মনির উদ্দিন ৪০০ টাকা আমিরন আয়া ২০০ টাকা, ঈশ্বর চন্দ্র বসু কোং ৩,৬০০ টাকা, বেনারসের রাজা ১,৫০০ টাকা, মতি চাঁদ বন্দ্যোপাধ্যায় ২,০০০ টাকা, উমেশ চন্দ্র বসু ও মুন্সির মিহি আনা ৫০০ টাকা, বাড়িভাড়া ৩৯০ টাকা, চাকরের মাহিনা ৪০০ টাকা।২৭

এই বিশাল দেনার হিসাব দেয়ার পর কৈলাশচন্দ্র এবং সম্ভবত মাইকেলও আশা করেছেন যে বিদ্যাসাগর এই দেনা থেকে মাইকেলকে উদ্ধার করবেন।

এরপর ১৮৭২ সালের শেষার্ধে, তাঁর সম্পর্কে ইতিমধ্যে বিদ্যাসাগরের কি ধারণা হয়েছে তা জেনেও, মাইকেল বিদ্যাসাগরকে একটি চিঠি লিখে অনেক কাকুতি মিনতি করে অনুরোধ জানান যেনো তিনি কাশিমবাজারের মহারানী স্বর্ণময়ীর এস্টেটের দেওয়ান রাজীবলোচনকে বলে দু’হাজার টাকা ধার দেয়ার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু বিদ্যাসাগর ততোদিনে মাইকেলের উপর সকল আস্থা হারিয়েছেন এবং নিশ্চিত হয়েছেন তিনি সকল সংশোধনের অতীত। তাছাড়া বিভিন্ন ঝামেলায় হতাশায় বিদ্যাসাগর নিজেই তখন বিপর্যস্ত। তিনি ১৮৭২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর মাইকেলকে ইংরেজীতে তাঁর শেষ চিঠিটি২৮ লিখলেন :
আমি আমার সাধ্যমত চেষ্টা করেছি এবং দুঃখের সঙ্গে এটা আমার মেনে নিতে হয়েছে যে, আপনার বিষয়টা একেবারে নৈরাশ্যজনক। আমি অথবা অন্য কেউ—তাঁর যদি না অনেক টাকা থাকে—যতোই কঠোরভাবে চেষ্টা করিনে কেন, আপনাকে রক্ষা করা যাবে না। জোড়াতালি দিয়ে আপনার সমস্যার সমাধান করার পক্ষে যথেষ্ট দেরী হয়ে গেছে। আমার শরীর মোটেই ভালো নেই আর এবং আমি আর লিখতে পারছিনে।

এরপর মাইকেল বিদ্যাসাগরকে কোনো চিঠি লিখেন নি। তাঁদের মধ্যে আর কোনো যোগাযোগ হয়েছিল বলেও জানা যায় না।

সাত

জীবনের শেষ দিকে, ১৮৭২ সালের সম্ভবত জানুয়ারী মাসে এক মামলার কাজে মাইকেল ঢাকা এসেছিলেন। উঠেছিলেন আরমানীটোলার পগোজ সাহেবের বাড়িতে। পগোজ স্কুলে তাঁকে একটি সম্বর্ধনা দেয়া হয়। সেই সম্বর্ধনায় এক যুবক বলেছিলেন, ‘আপনি ইংরেজ হয়ে গিয়েছেন শুনে আমরা খুব দুঃখিত হয়েছিলাম। কিন্তু আপনার সঙ্গে আলাপ করে সে ভুল ভাঙলো’। এর জবাবে মাইকেল বলেছিলেন,
আমার সম্পর্কে আপনাদের আর যে কোনো ভুলই হোক, আমি সাহেব হয়ে গিয়েছি এই ভুল হওয়া অন্যায়। আমার সাহেব হওয়ার পথ বিধাতা বন্ধ করে রেখেছেন। আমি আমার বসার ও শোয়ার ঘরে একটি করে আয়না রেখে দিয়েছি। যখনই আমার মনে সাহেব হওয়ার ইচ্ছা জাগে তখনই আয়নায় মুখ দেখি। আরো, আমি কেবল বাঙালী নই, আমি বাঙাল, আমার বাড়ি যশোর।২৯

আসলে এই সাহেব হওয়ার খায়েস, কল্পনা বিলাস ও প্রচণ্ড বেহিসেবীপনা মাইকেল মধুসূদন দত্তের মতো একজন আসাধারণ প্রতিভাশালী মানুষের জন্য বিপর্যয় ডেকে এনেছিল। সেই কিশোর বয়স থেকে তিনি নানা অলীক স্বপ্নের পেছনে ছুটতে শুরু করেন। বার বার হোঁচট খেয়েও তিনি বদলান নি। তিনি সাহেবী পোশাক পরতেন, সাহেবী চালে চলতেন, সাহেবদের ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন, দু-দু’জন শ্বেতাঙ্গিনী বিয়ে করেছিলেন, একসময় তো বাংলা ভাষাকে অবজ্ঞাই করেছেন। সারাজীবন তিনি বিদ্যাসাগরসহ সকল বাঙালী বন্ধুকে চিঠি লিখেছেন ইংরেজীতে। বিদ্যাসাগর একটি চিঠিতে তাঁকে ‘বাবু’ বলে সম্বোধন করায় তিনি সে চিঠি গ্রহণই করেন নি।৩০ এই সাহেব হওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে তিনি প্রচণ্ড দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিয়েছেন সারা জীবন। কিভাবে শোধ দিতে পারবেন তা চিন্তা না করেই একের পর এক যার তার কাছে আত্মমর্যাদা বিকিয়ে ঋণ করেছেন এবং ঋণ করা অর্থ যথেচ্ছ ব্যয় করেছেন।৩১ এসব কারণে একে একে বন্ধু-বিচ্ছেদ হয়েছে। একজন আপাত বৈষয়িক লোক বিদ্যাসাগরও অবশ্য ঋণ করেছেন। মাইকেলের জন্যই শুধু নয়, নানা প্রয়োজনেও ঋণ করেছেন। কিন্তু সেই ঋণ বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই করেছেন পরের জন্য। বিধবাবিবাহ প্রবর্তনের সময় অন্যের ভরসায় ঋণ করে বিপদে পড়েছিলেন বটে। কিন্তু সাধারণতঃ পরিশোধ করতে পারবেন জেনেই ঋণ করতেন। একারণে তাঁকে ঋণ দেয়ার লোকের অভাব ছিল না। বিদ্যাসাগর যখন মারা যান তখন তিনি খুব সামান্য অর্থই নগদ রেখে গিয়েছিলেন। কিন্তু কোন ঋণ রেখে যান নি।

আট


১৮৭৩ সালের ২৯ জুন আলীপুর জেনারেল হাসপাতালে কপর্দকহীন অবস্থায় মধুসূদন মারা যান। তাঁর মৃত্যুর বেশ কয়েক বছর পর কয়েকজন ব্যক্তি মধুসূদনের অস্থিপঞ্জর রক্ষা করার এবং একটি স্মৃতিস্তম্ভ রক্ষার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তাঁরা চাঁদার জন্য বিদ্যাসাগরের কাছেও গিয়েছিলেন। বিদ্যাসাগর অশ্রুপূর্ণ নয়নে বলেছিলেন, ‘দেখো, প্রাণপণ চেষ্টা করে যার জান রাখতে পারি নি, তাঁর হাড় রাখবার জন্য আমি ব্যস্ত নই। তোমাদের নতুন উৎসাহ ও আগ্রহ আছে, তোমরা করগে।’৩২

মধুকবির মহা-বিপদের সময় বিদ্যাসাগর তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছেন, নিঃস্বার্থভাবে তাঁকে সাহায্য করেছেন এবং এজন্য নিজে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, নানা মানসিক চাপ সহ্য করেছেন। মাইকেলকে তিনি অত্যন্ত স্নেহ করতেন এবং তাঁর নানা আবদার মেনে নিয়েছেন। একটি চিঠিতে দেখা যায় মাইকেল অন্য একজনসহ বিদ্যাসাগরের বাড়ি যাওয়ার আগে বিদ্যাসাগরকে অনুরোধ করছেন এক বোতল শেরি আনাতে!৩৩ বিদ্যাসাগরকে মদ আনিয়ে রাখার কথা বলার অধিকার মাইকেল ছাড়া আর কারো ছিল বলে মনে হয় না।

বিদ্যাসাগররের বৈষয়িক ঋণ মাইকেল শোধ করতে পারেন নি। কিন্তু বিদ্যাসাগরের ঋণ তিনি শোধ করে গেছেন তিনটি কবিতা ও বিদ্যাসাগর সম্পর্কে তাঁর কিছু বিখ্যাত মন্তব্য দিয়ে। যেমন,
করুণাসাগর,
the first man among us,
above flattering any man,
the genius and wisdom of an ancient sage, the energy of an Englishman and the heart of a Bengali mother,
সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী, ইত্যাদি।

এ প্রসঙ্গে বিনয় ঘোষের মন্তব্য দিয়ে শেষ করছি,
নবযুগের বাংলার আদি কবি মধুসূদন ‘আমাদের মধ্যে প্রধান মানুষ’ ও ‘সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী’ পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের চরিত্র যেভাবে উপলব্ধি করেছিলেন পরবর্তী কালে রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আর কেউ তা করতে পেরেছেন বলে মনে হয় না।...কবির দৃষ্টিপথেই মানুষের সত্তার ‘সমগ্রতা’ ফুলের মতো প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে। একজন সাধারণ মানুষের চরিত্র বুঝতে হলে কিছুটা কল্পনা শক্তির প্রয়োজন হয়। দাঁড়িপাল্লায় একজন মানুষকে সম্পূর্ণরূপে মাপা যায় না। যারা অনন্যসাধারণ তাঁদের চরিত্রের গভীরে প্রবেশ করতে হলে কল্পনাকে বহুদূর পর্যন্ত প্রসারিত করতে হয়। মধুসূদন রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিপথে তাই বিদ্যাসাগর চরিত্রের দিগন্ত পর্যন্ত উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল। দু’জন শ্রেষ্ঠ বাঙালী কবির সামনে একজন ‘শ্রেষ্ঠ বাঙালী’ ও ‘অদ্বিতীয় মানুষ’ যেন সম্পূর্ণ নিরাভরণ রূপে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন।৩৪



: তথ্যসূত্র ও টীকা :


১. ডেভিড হেয়ারের স্কুল থেকে পড়ে আসা কিছু গরীব মেধাবী ছেলে হিন্দু স্কুলে বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ পেত। রাজনারায়ণ বসু তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘এই সকল বালকদিগকে হিন্দু কলেজের ছোকরারা ‘বড়ে’ বলিত। কেন ‘বড়ে’ বলিত তাহা নিশ্চয় করা কঠিন। হেয়ার সাহেব তাঁহার কলেজ হইতে তাঁহাদিগকে বড়ের মতন কলেজে চালিয়া দিতেন, এই জন্য কিম্বা বালকেরা দরিদ্র বলিয়া তাহারা কলেজের বড় মানুষ ছাত্রদিগের কল্পনানুসারে বড়ি ভাতে দিয়া খাইয়া তাহারদিগের বড়মানুষ সমাধ্যায়ী অপেক্ষা সকাল সকাল কলেজে আসিতে সমর্থ হইত, এই বলিয়া তাহারা উক্ত বড় মানুষ ছাত্রদিগের নিকট হইতে তাহাদিগের নিকট অগৌরব কিন্তু প্রকৃতপক্ষে গৌরবসূচক এই উপাধি লাভ করিয়াছিল কিনা বলিতে পারি না।’ (রাজনারায়ণ বসু, আত্মচরিত, কলিকাতা, ১৩১৫ বঙ্গাব্দ, পৃ ১৭)

২. বিপিনবিহারী গুপ্ত, পুরাতন প্রসঙ্গ, কলিকাতা, ১৩২০ বঙ্গাব্দ, পৃ ৭৮

৩. মাইকেল লিখেছিলেন, The new poem is doing well considering everything. I have heard that V.—has been speaking of it with contempt This does not surprise me...some other Pundits, literary stars of equal magnitude, say ‘হ্যাঁ উত্তম অলঙ্কার আছে। মন্দ হয় নি। ‘But they regret the author did not write in rhyme, that would have made him popular. These men, my dear Raj, little understand the heart of a proud, silent, lonely man of song!’ এখানে v বলতে বিদ্যাসাগরকে বোঝানো হয়েছে।

৪. ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, মধুসূদন দত্ত, সাহিত্যসাধক চরিতমালা- ২৩, ১৩৫০ বঙ্গাব্দ, পৃ ৬০-৬২

৫. যোগীন্দ্রনাথ বসু, মাইকেল মধুসূদনের জীবনচরিত, তৃতীয় সংস্করণ, কলিকাতা, ১৯০৫, পৃ ৫৩৬-৩৭

৬. ইন্দ্রমিত্র, করুণাসাগর বিদ্যাসাগর, আনন্দ পাবলিশার্স, দশম মুদ্রণ, পৃ ৩৭৫

৭. Subal Chnadra Mitra, Isvar Chandra Vidyasagar, Calcutta, 1902, p 386-389

৮. ১৮৬৪ সালের ৩ নভেম্বর বিদ্যাসাগরের লেখা চিঠিতে মাইকেল লিখেছিলেন, I have seen one or two of your works in a shop in Paris. I told the shopkeeper, ‘This author is a great friend of mine.’ ‘Ah Sir’, said he, ‘we thought he was dead’. ‘God for- did’, said I. ‘His country and friends cannot spare him’। Fancy this on the banks of the famous Seine

৯. গোলাম মুরশিদ : আশার ছলে ভুলি, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা, এপ্রিল ২০১৮, পৃ ২৯৭

১০. ঐ, পৃ ২৯৭

১১. যোগীন্দ্রনাথ বসু, মাইকেল মধুসূদনের জীবনচরিত, তৃতীয় সংস্করণ, কলিকাতা, ১৯০৫, পৃ ৫৯৩

১২. গোলাম মুরশিদ, প্রাগুক্ত, পৃ ৩০৬

আবার ইন্দ্রমিত্রও লিখেছেন, ‘মাইকেলের জন্য বিদ্যাসাগরে যতো ঋণ করেছেন, সব টাকা মাইকেল নিজের সম্পত্তি বিক্রী করে শোধ করেছেন, বিদ্যাসাগরকে দায়মুক্ত করেছেন।’ (পৃ ৩৮২) কিন্তু তিনি ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়-এর মধুসূদন দত্ত গ্রন্থের যে সূত্র উল্লেখ করেছেন সেখানে সম্পত্তি বিক্রির দলিলে অনুকূলচন্দ্রের উনিশ হাজার টাকার দেনা পরিশোধের জন্য বিশ হাজার টাকায় সম্পত্তি বিক্রির কথা আছে, কিন্তু শ্রীশচন্দ্রের দেনা কখন কীভাবে পরিশোধ করা হয় সে বিষয়ে কোন উল্লেখ নেই।

‘এইক্ষণ আমি শ্রীযুক্ত বাবু অনুকূলচন্দ্র মুখোপাধ্যাইয়ের নিকট প্রায় ১৯,০০০/- উনিশ হাজার টাকার দায়িক হইয়াছি তাহা পরিশোধের জন্য আমি উক্ত উভয় মহাল সংক্রান্ত আমার দরহস্ত হকুক মবলগে ২০,০০০/- বিশ হাজার টাকা মূল্যে আপনার নিকট বিক্রয় করিলাম।’ (ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, মধুসূদন দত্ত, সাহিত্যসাধক চরিতমালা- ২৩, ১৩৫০ বঙ্গাব্দ, পৃ ৮৭) বিনয় ঘোষও লিখেছেন, ‘শ্রীশচন্দ্রের ও অনুকূল চন্দ্রের সমস্ত ঋণ, বিষয় সম্পত্তি বিক্রি করে, শেষ পর্যন্ত মধুসূদন পরিশোধ করেছিলেন এবং বিদ্যাসাগরও দায়মুক্ত হয়েছিলেন।’ (বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ, পৃ ৩৬৬) কিন্তু তিনি কোনো সূত্র উল্লেখ করেন নি কিংবা বিদ্যাসাগর সংস্কৃত প্রেসের দুই তৃতীয়াংশ বিক্রি করে শ্রীশচন্দ্রের দেনা পরিশোধ করেছেন বলে বিহারীলালের দেয়া তথ্যের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেন নি।

১৩. ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, মধুসূদন দত্ত, সাহিত্যসাধক চরিতমালা-২৩, ১৩৫০ বঙ্গাব্দ, পৃ ৮৭

১৪. MY DEAR DATTA,

I have succeeded in persuading a friend of mine to advance rupees 5,000 to enable me to pay off Shrish Chandra who is sure to go to Court in case we fail to clear his account without further delay. The conditions on which my friend is willing to advancemoney you will find in the enclosed draft. The deed is to be registered. It will therefore be necessary for you to step over to the Registration Office for a few minutes on Wednesday next. Be so kind as to do the needful and save me from the trouble and annoyance, as I feel it exceedingly disagreeable to my feelings to be any longer in connection with the party to pay off whom the new transaction is to take place.
It will be seen from the following memorandum that to complete the transac- tion Rs. 141 over the sum of Rs. 5,000 is required. This small amount you will have to pay from your own. pocket Please return the draft by the bearer and. oblige.

Yours sincerely
Sd. I.C.SARMA

Principal
4,600
Interest for 22 months and 7 day
510
Stamp
25
Registration fee
6
5141
7-9-68 (Sd). I.C. SARMA.
(Subal Chandra Mitra, Isvar Chandra Vidyasagar, Calcutta, 1902, p 395-396)

১৫. Subal Chandra Mitra, Isvar Chandra Vidyasagar, Calcutta, 1902, p 396

১৬. চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিদ্যাসাগর, দে’জ পাবলিশিং, ১৪২৬ বঙ্গাব্দ, পৃ ৪২৭

১৭. শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন, বিদ্যাসাগর চরিত, ১২৯৮ বঙ্গাব্দ, কলিকাতা, পৃ ১৬৯

১৮. বিহারীলাল সরকার, বিদ্যাসাগর, ওরিয়েন্ট বুক কোম্পানী, দ্বিতীয় সংস্করণ ১৯৯১, পৃ ২৯১

১৯. যোগীন্দ্রনাথ বসু, মাইকেল মধুসূদনের জীবনচরিত, তৃতীয় সংস্করণ, কলিকাতা ১৯০৫, পৃ ৫৩৬

২০. গোলাম মুরশিদ, প্রাগুক্ত, পৃ ৩০৮ ৩০৯

২১. ইন্দ্রমিত্র, প্রাগুক্ত, পৃ ৪৭৮-৪৭৯

২২. বিদ্যাসাগর মানুষকে সাহায্য করতেন কিন্তু সেসব বলে বেড়াতেন না। বিহারীলাল সরকার লিখেছেন, ‘বিদ্যাসাগর মহাশয় কৃত লোকের বিপন্ন ব্যক্তির দায়োদ্ধার করিয়াছেন, তাঁহার ঠিক সংবাদ সংগ্রহ করা বড় দুঃসাধ্য ব্যাপার। কেননা তিনি গগনভেদী ঢক্কা শব্দে কাঁপাইয়া দান করিতেন না। অনেক সময় তিনি অনেককেই এককালেই দান করিতেন। কিন্তু প্রায়ই সেসব লিপিবদ্ধ করিতেন না। (বিহারীলাল সরকার, বিদ্যাসাগর, ওরিয়েন্ট বুক কোম্পানী, দ্বিতীয় সংস্করণ ১৯৯১, পৃ ২২০ )

২৩. ঐ, পৃ ৩০৮

২৪. ঐ, পৃ ৩০৯

২৫. ঐ, পৃ ৩০৭

২৬. ইন্দ্রমিত্র, প্রাগুক্ত, পৃ ৩৮১

২৭. বিহারীলাল সরকার, প্রাগুক্ত, পৃ ২৩৬

২৮. মাইকেলকে নিয়ে হতাশ হয়ে ১৮৭২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর বিদ্যাসাগর মাইকেলকে লিখেন,

My Dear Dutt,
I have tried my best and am sadly convinced that your case is an utterly hope-less one—no exertion of mine, or that of that of anybody else who is not a moneyed man, however strenuous it may be, can save you. It is too late to mend matters by patch-works. I am very unwell and therefore unable to write more.

Yours sincerely,
Isvar Chandra Sarma

২৯. ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রাগুক্ত, পৃ ৯০-৯১

৩০. Subal Chnadra Mitra, Isvar Chandra Vidyasagar, Calutta, 1902, p 399

৩১. এখানে চার্বাক সূত্র হিসেবে কথিত ‘যাবজ্ জীবেৎ সুখং জীবেৎ, ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ’ (যতো দিনই বাঁচবে, সুখে বাঁচবে, ঋণ করে ঘি খাও) উল্লেখ করা যেত; গোলাম মুরশিদ তা করেছেনও। কিন্তু বস্তুবাদী লেখক রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য তাঁর চার্বাকচর্চা গ্রন্থে এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, প্রাচীন সাহসী বস্তুবাদী লোকায়ত দৰ্শনকে নিছক একটি ভোগবাদী দর্শন হিসেবে উপস্থাপন করার জন্য মূল শ্লোককে বিকৃত করে ‘ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ’ অংশটুকু ঢোকানো হয়েছে। মূল শ্লোকে ছিল, ‘যাবজ্ জীবেৎ সুখং জীবেৎ, নাস্তি মৃত্যোর অগোচরঃ।’ অর্থাৎ (যতোদিন বাঁচবে, সুখে বাঁচবে, মৃত্যুর নাগালের বাইরে কিছু নেই।

৩২. চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় : বিদ্যাসাগর, দে’জ পাবলিশিং, ১৪২৬ বঙ্গাব্দ, পৃ ৪২৮

৩৩. Subal Chnadra Mitra, প্রাগুক্ত, p 399
‘My Dear Vid: I am going to take with me to your 2 (Prasad) my learned co-adjutor Babu Mutty Lal Chowdhury. You had to be a little charitable and send for a bottle of Sherry. Yours affectionately. Michael M. Datta .’

৩৪. বিনয় ঘোষ, বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ, ওরিয়েন্ট লংম্যান লিমিটেড, ১৯৮৪, পৃ ৩৬৭

___

* জন্ম, ১৮২০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর

** জন্ম ২৫ জানুয়ারী ১৮২৪

*** মাইকেল বিদ্যাসাগরকে সব কটি চিঠিই লিখেছেন ইংরেজীতে। কয়েকটি বাদে শেষ চিঠিসহ কয়েকটি বাদে বিদ্যাসাগর মাইকেলকে সব চিঠি লিখেছেন বাংলায়।

**** প্রথম বিধবাবিবাহকারী হিসেবে পরিচিত



নতুন দিগন্ত জানুয়ারী-মার্চ ২০২১ সংখ্যায় প্রকাশিত। (৭৮-৯৫ পৃষ্ঠা)


কোন মন্তব্য নেই

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

vidyasagar.info ©