মোট পৃষ্ঠাদর্শন

    ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
        মাইকেল মধুসূদন দত্ত

  বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে।
  করুণার সিন্ধু তুমি, সেই জানে মনে,
  দীন যে, দীনের বন্ধু!—উজ্জ্বল জগতে
  হেমাদ্রির হেমকান্তি অম্লান কিরণে।
  কিন্তু ভাগ্যবলে পেয়ে সে মহা পর্বতে,
  যে জন আশ্রয় লয় সুবর্ণ চরণে,
  সেই জানে কত গুণ ধরে কত মতে
  গিরীশ। কি সেবা তার সে মুখ সদনে।—
  দানে বারি নদীরূপ বিমলা কিঙ্করী;
  যোগায় অমৃত ফল পরম আদরে
  তরুদল, দাসরূপ ধরি;
  পরিমলে ফুলকুল দশ দিশ ভরে;
  দিবসে শীতল শ্বাসী ছায়া, বনেশ্বরী,
  নিশার সুশান্ত নিদ্রা, ক্লান্তি দূর করে!

দীর্ঘ ও বৈচিত্রময় জীবনে বিদ্যাসাগর আরো বহু মেধাবী ব্যক্তির সঙ্গ পেয়েছেন। তাঁদের মধ্যে রাজেন্দ্রলাল মিত্র, মদনমোহন তর্কলংকার, প্যারিচরণ সরকার প্রমুখ। বিদ্যাসাগরের জীবনে প্রত্যেকের অবদান আছে। সে সমস্ত কথা বাকি রেখেই বলতে পারি বিদ্যাসাগর তাঁর মহত্ত্ব দিয়েই এই সম্পর্কগুলো গড়ে তুলতে পেরেছিলেন। তাঁর সুউচ্চ ব্যক্তিত্বই অনেকের মধ্যে থেকে তাঁকে স্বতন্ত্র মহিমা দিয়েছে।

—তুলসীদাস মাইতি



“বিদ্যাসাগর আচারের দুর্গকে আক্রমণ করেছিলেন, এই তাঁর আধুনিকতার একমাত্র পরিচয় নয়। যেখানে তিনি পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যবিদ্যার মধ্যে সম্মিলনের সেতুস্বরূপ হয়েছিলেন সেখানেও তাঁর বুদ্ধির ঔদার্য প্রকাশ পেয়েছে। তিনি যা-কিছু পাশ্চাত্য তাকে অশুচি বলে অপমান করেন নি। তিনি জানতেন বিদ্যার মধ্যে পূর্ব-পশ্চিমের দিগবিরোধ নেই। তিনি নিজে সংস্কৃতশাস্ত্রে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। তিনিই বর্তমান য়ুরোপীয় বিদ্যার অভিমুখে ছাত্রদের অগ্রসর করবার প্রধান উদ্যোগী হয়েছিলেন এবং উৎসাহ ও চেষ্টায় পাশ্চাত্য বিদ্যা আয়ত্ত করে করেছিলেন।”

কথাগুলি রবীন্দ্রনাথের। ১৩২৯ সালের ১৭ শ্রাবণ ব্রাহ্মসমাজ আয়োজিত বিদ্যাসাগর-স্মরণ সভায় তিনি একথা বলেছিলেন। এই কথাগুলি থেকে ‘আধুনিকতম মানুষ বিদ্যাসাগর’— এই প্রসঙ্গের একটা আভাস পাই। বলা বাহুল্য, সমকালীন বঙ্গভূমির সামাজিক ইতিহাসে যে সমস্ত শিক্ষিত মেধাবী মনীষীগণের পরিচয় পাই তাঁদের সাথে বিদ্যাসাগরের মননগত মিল বা অমিল কতখানি তাও এই নিরিখেই করতে চাই।
ঈশ্বরচন্দ্রের “বিদ্যাসাগর” হয়ে ওঠার সদাব্যস্ত প্রক্রিয়ায় তাঁর থেকে বহু দূরে বীরসিংহ গ্রামে শাশুড়ি ভগবতী দেবীর কর্তৃত্বাধীনে দীনময়ী ছিলেন আজীবন ব্রাত্য। তাঁর একাকিত্ব অনুভব করার অবকাশ কখনও পাননি ঈশ্বরচন্দ্র। স্বামীসঙ্গ লাভ থেকে বঞ্চিত ছিলেন দিনময়ী দেবী । তাঁর বুক ফাটলেও মুখ ফুটে কিছুই বলেননি। বিদ্যাসাগর সারাজীবন সমাজের নানাবিধ কার্যাকলাপে ব্যস্ত ছিলেন। পরিবারে তাঁর যে একটি স্ত্রী আছে সেকথা তিনি হয়তো বেমালুম ভুলেই যেতেন। স্ত্রীর নীরব প্রশ্রয়ে বিদ্যাসাগর সাংসারিক কাজ বাদে অন্যকাজে দিনরাত ব্যস্ত থাকতেন। দীনময়ী দেবীর মতো সুশীলাকে জীবনসঙ্গিনী হিসাবে পেয়েছিলেন বলেই হয়তো বিদ্যাসাগর “বিদ্যাসাগর” হতে পেরেছিলেন। দীনময়ী দেবীর ত্যাগ কোনোদিনই আমাদের কাছে প্রাধান্য পায়নি। পর্দার আড়ালে তাঁর মুখ ঢাকা পড়ে যায়।

—দীপক সাহা



দেশের নারীকল্যাণে বিদ্যাসাগরের অবদান অনস্বীকার্য। স্ত্রী-শিক্ষার প্রসার, বাল্যবিবাহ বিরোধিতা করা, বিধবাবিবাহ আইনের সমর্থন প্রভৃতি যুগান্তকারী পদক্ষেপের রূপকার ছিলেন তিনি। নারীদের প্রতি তাঁর অসামান্য অবদানের কথা স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। বিদ্যাসাগর মহাশয় নারীশিক্ষার প্রসারে যেভাবে অবতীর্ণ হয়েছিলেন, তাঁর কাছে এ বঙ্গের সমস্ত নারীদের আজীবন ঋণী থাকতে হবে। নারীও যে মানুষ এবং চেতনাময়ী নারী একটা সুন্দর জীবন যাতে পেতে পারে এই প্রচেষ্টায় তাঁর খামতি ছিল না। সেই চেষ্টার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিকটা ছিল স্ত্রী-শিক্ষার বিস্তার। শিক্ষার আলোয় আলোকিত হলে নারী নিজের ভালোমন্দ বুঝতে পারবে, তার বিরুদ্ধে ঘটে চলা সমস্ত অন্যায়ের প্রতিবাদ করার ক্ষমতা অর্জন করবে, এটা বুঝেছিলেন। তাঁর উৎসাহ, প্রচেষ্টাতেই প্রথম বালিকা বিদ্যালয় তৈরি হয়েছিল। অভাগীদের ঠাকুরঘরে, মনের মন্দিরে অচিরেই বিদ্যাসাগর স্থাপিত হলেন আর এক ঈশ্বর রূপে। ওদিকে বিদ্যাসাগরের হস্ত দ্বারা প্রজ্বলিত নারীশিক্ষার দীপটি শত ঝঞ্ঝায় না নিভে গিয়ে জ্বলে রয়েছে একইভাবে... তাঁর মৃত্যুর বহু বছর পরেও আজও সে দীপশিখা একইরকমভাবে অনির্বাণ।

আজ আলোকপাত করার চেষ্টা করব বিদ্যাসাগরের নিজের ঘরে স্ত্রী-শিক্ষার আলো কতদূর প্রসারিত হয়েছিল।
ইউরোপীয় রেনেসাঁসের এক বিশিষ্ট গোষ্ঠী ছিলেন শিক্ষাব্রতী পণ্ডিতের দল। এঁদের মূল বিদ্যাক্ষেত্র ভাষা ও পাঠচর্চা। অনেকে প্রশাসন বা রাজনীতিতেও যোগ দিতেন, অনেকে দিতেন না; কিন্তু স্রেফ মেধা ও বিদ্যার জোরে এঁদের অনেকে সমাজে ও ধর্মীয় অনুশাসনে প্রভাবশালী ছিলেন। ধর্মবোধ ও নীতিজ্ঞানকে এঁরা যুক্তি ও মনুষ্যত্বের ব্যাপক পরিসরে মুক্তি দিয়েছিলেন। এই বিদ্বানদের হিউমানিস্ট বলা হয়। শব্দটার উৎপত্তি এক বিশেষ ঐতিহাসিক সূত্রে, কিন্তু অবধারিত ভাবে তাতে সঞ্চার হয়েছে ‘হিউমান’ শব্দের বৃহত্তর মনুষ্যত্বের ব্যঞ্জনা। উনিশ শতকের বাংলায় নতুন নৈতিক ও সামাজিক চেতনা বিলক্ষণ সেই হিউমানিস্ট ধাঁচে। বিদ্যাসাগর তার উজ্জ্বলতম প্রাণপুরুষ।

— সুকান্ত চৌধুরী



বিদ্যাসাগর সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ একটা মজার কথা বলেছেন: কাক যেমন কোকিলের ছানা পালন করে, বিধাতা তেমনই ‘বঙ্গভূমির প্রতি বিদ্যাসাগরকে মানুষ করিবার ভার দিয়াছিলেন’। ‘চারিত্রপূজা’-র ওই প্রবন্ধে কবি বাঙালিদের বিস্তর গাল দিয়েছেন। ধন্দে পড়েছেন, কোন বদখেয়ালে বিধাতা চার কোটি বাঙালির মধ্যে বিদ্যাসাগরের মতো ‘দুই-একজন মানুষ’ গড়ে বসেন।

তবু কাক বেচারাই তো কোকিলকে ‘মানুষ’ করে। বিদ্যাসাগরের বিরল মনুষ্যত্ব বঙ্গভূমিতেই লালিত, তার ছাপ যাবে কোথায়? আছে তাঁর ধুতি-চাদর-চটিতে, আধুনিক বাংলা ভাষা সৃষ্টিতে তাঁর অবদানে, বাংলার ছেলেমেয়েদের (হ্যাঁ, মেয়েদেরও) শিক্ষার জন্য তাঁর জীবনভর প্রয়াসে। অথচ ধুতি-চাদর আঁকড়ে থাকার এই জেদে রবীন্দ্রনাথ পাচ্ছেন এক অন্তরস্থ সাহেবিয়ানা— ‘অনুকরণগত সাদৃশ্য’ নয়, চরিত্রগত। সেই সাহেবিয়ানাই তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছে বাঙালি পরিচয়কে তুলে ধরতে।

মোট কথা, তাঁকে নিয়ে আইডেন্টিটি পলিটিক্স চলবে না। দু’শো বছর আগের যুগসন্ধিতে পাশাপাশি গড়ে উঠেছিল ভারতীয় উদ্যোগে নতুন পাশ্চাত্য বিদ্যাচর্চার জন্য হিন্দু কলেজ আর সাহেবি উদ্যোগে সাবেক প্রাচ্য বিদ্যাচর্চার জন্য সংস্কৃত কলেজ। নামেই ফাঁস, দুটোই সোনার পাথরবাটি। সংস্কৃত ভাষা হিন্দু পরিচিতি কি রক্ষা করবে বিজাতীয় কলেজ? কলেজি সাহেবি বিদ্যাই বা ঠাঁই পাবে কোথায়?

শিক্ষা-সংস্কৃতির এই আবর্তে বিদ্যাসাগর ঝাঁপ দিলেন। ছাত্রাবস্থায় সংস্কৃত কলেজে যেটুকু ইংরেজি পড়া যেত পড়লেন, তার পর পড়লেন শিক্ষক রেখে। অধ্যক্ষ হয়ে চাঞ্চল্যকর ‘নোটস’-এ সুপারিশ করলেন, সংস্কৃতের সব ছাত্রকে ইংরেজি শিখতে হবে। সেই বক্তব্য বিস্তারে লিখলেন কাশীর সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ ব্যালেন্টাইন সাহেবের সমীক্ষার জবাবে। ব্যালেন্টাইনের মতে সংস্কৃতের ছাত্রদের ইংরেজি শেখাতে হবে সাবধানে মেপে মেপে, নইলে প্রাচ্য আর পাশ্চাত্য বিদ্যার ঠোকাঠুকিতে তারা ভেবে বসবে সত্য দু’রকম। জ্ঞানের এই দ্বিত্ব বিদ্যাসাগর মানতে পারেননি; দৃঢ় ভাবে বলেছেন সত্য সত্যই, তার খাতিরে কখনও বা প্রাচ্য বিদ্যা ত্যাগ করে নব্য পাশ্চাত্য বিদ্যাকে অধিষ্ঠিত করতে হবে। আক্ষেপ করেছেন, প্রাচীন শাস্ত্রে যদি আধুনিক বিজ্ঞানের লেশমাত্র তত্ত্ব মেলে, কিছু লোকে বিজ্ঞান অস্বীকার করে শাস্ত্রবচনকে আরও আঁকড়ে ধরবে। আজকের ভারতে কথাটা বড়ই প্রাসঙ্গিক।
বিদ্যাসাগরের তিরোভাবের পর ‘সখা’ পত্রিকায় তাঁহার লিখিত দু’তিনটি গল্প প্রকাশিত হইয়াছিল। ১৮৯৩-এ জর্জ ওয়াশিংটনের কাহিনী অবলম্বনে ‘মাতৃভক্তি’ নামক গল্প, ১৮৯৪-এ ‘ছাগলের বুদ্ধি’ নামে অপর একটি গল্প এই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এতদ্ভিন্ন কখনও ‘মুকুল’-এ, কখনও ‘ধ্রুব’তে তাঁহার লিখিত গল্প প্রকাশিত হইয়াছে। পূর্বেই বলিয়াছি, সে যুগ গল্পের যুগ নহে, গঠনের যুগ।

—প্রতিভাকান্ত মৈত্র



বিদ্যাসাগরকে বাঙ্গালা গদ্যের জনক বলা সুযুক্তিসম্মত কি না সে-বিষয়ে মতভেদের অবকাশ যদি-বা থাকে, তবু, বিদ্যাসাগরকে আধুনিক বঙ্গের শিক্ষিত-সমাজের জনক বলিয়া মানিয়া লইতে দ্বিধা থাকিবার কথা নহে। সামগ্রিকভাবে বিচার করিয়া একথা মানিয়া লইতেই হইবে যে, বিংশ শতকের শিক্ষিত-সমাজের জন্মই হইয়াছে বিদ্যাসাগরের আনুকূল্যে। বঙ্গসন্তানকে কেমন করিয়া শৈশব হইতেই ধাপে ধাপে শিক্ষার পথে অগ্রসর করিয়া দিতে হইবে তাহা তিনি গভীর ও ব্যাপকরূপে চিন্তা করিয়াছিলেন। যথার্থ শিক্ষা-বিজ্ঞান বলিতে যাহা বুঝায় তাহা তাঁহার সম্পূর্ণ আয়ত্ত ছিল। যে-কালে বিদ্যাসাগর বর্তমান ছিলেন সেই কালের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষা-সম্পর্কে তাঁহার অবদান পর্যালোচনা করিলে মনে হয় কোনো একজন বাঙ্গালীর দ্বারা শিক্ষা-জগতের এমন সর্বাঙ্গীণ উপকার আর কখনও সাধিত হয় নাই। সর্ববিধ শিক্ষাবিস্তারে তাঁহার দান অপরিসীম।

এ-দেশীয় বালক-বালিকার সংস্কৃত শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা যদিও তিনি অনুভব করিতেন, তবু, তৎকালীন প্রথানুযায়ী টোল বা চতুষ্পাঠীর দীর্ঘসূত্রী শিক্ষায় তাঁহার আস্থা ছিল না। তখনকার দিনে যে সংস্কৃত-শিক্ষাক্রম দীর্ঘ দ্বাদশ বৎসর ধরিয়া আয়ত্ত করিতে হইত তাহা ছয় মাসে আয়ত্ত করিবার ব্যবস্থা বিদ্যাসাগর করিয়াছিলেন তাঁহার ‘সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা’ প্রণয়ন করিয়া। তিনি চাহিয়াছিলেন সমকালীন জীবনযুদ্ধে জয়ী হইবার উপযুক্ত শিক্ষাবিস্তার করিতে। বাঙ্গালা দেশের মানুষ জীবনের নিত্যপ্রয়োজনীয় সকল প্রকার জ্ঞান অর্জন করুক—ইহাই বিদ্যাসাগরের কাম্য ছিল। তৎকালীন পরিবেশে এই কথাটি তিনি স্পষ্ট বুঝিয়াছিলেন যে, মাতৃভাষা ও ইংরাজী ভাষার মধ্য দিয়াই দেশের মানুষকে শিক্ষিত করিয়া তোলা সহজ হইবে। “এই কারণে তিনি বাংলা ‘বর্ণপরিচয়’ দিয়া আরম্ভ করিয়াছেন, এবং শিশুকে ধাপে ধাপে ‘কথামালা’, ‘বোধোদয়’, ‘জীবনচরিত’, ‘চরিতাবলী’ ও ‘আখ্যানমঞ্জরী’-র গল্পগুলির মধ্য দিয়া পূর্ণবিকশিত মনুষ্যত্বের দ্বার পর্যন্ত উত্তীর্ণ করিয়া দিবার ব্যবস্থা স্বয়ং করিয়া গিয়াছেন।” এবম্বিধ শিক্ষা পরিকল্পনার শুরুতেই যে-গ্রন্থের সহিত বিদ্যার্থী বালকের প্রথম পরিচয় হইবার কথা, তাহা, বিদ্যাসাগর-প্রণীত ‘বর্ণপরিচয়’-১ম ও ২য় ভাগ। বিদ্যাসাগরের জীবনের সর্বাধিক স্মরণীয় কীর্তি এই ‘বর্ণপরিচয়’। সুকুমারমতি বালক-বালিকার ভবিষ্যৎ জীবনের বনিয়াদ পোক্ত করিয়া গড়িবার কাজেই এই গ্রন্থের গৌরব সীমায়িত নহে, বাঙ্গালা গল্পসাহিত্যের জন্ম-সম্ভাবনার আকর এই ‘বর্ণপরিচয়’।
বিদ্যাসাগরী ভাষাকে এখন কেউ কেউ কঠিন ভাষা বলেন, কিন্তু আমরা যদি তাঁর সমকালীন লেখকদের রচনার পাশাপাশি রেখে দেখি, তবে নিশ্চয়ই স্বীকার করব, তাঁর ভাষা অতিশয় প্রাঞ্জল ও সুবোধ্য। অন্বয়গুণে প্রতিটি বাক্যের অর্থ সুস্পষ্টঃ শুধু তাই নয়, বিন্যাস-কৌশলে বাক্যগুলি সুললিত। বিষয়ের অনুরোধে স্থানে স্থানে তাঁকে গম্ভীর সংস্কৃত শব্দ ব্যবহার করতে হয়েছে, কিন্তু তাতে লালিত্য ক্ষুণ্ন হয়নি, এবং সন্ধি-সমাসের জটিলতায় অর্থ আচ্ছন্ন হয়নি।

—ধীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়



কর্মবীর রূপে যিনি সর্বজনবন্দিত, সাহিত্য-শিল্পীরূপেও তিনি রেখে গেছেন তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর। জীবনের যে সকল কর্তব্য বিদ্যাসাগরের কাছে সাহিত্য-রচনার চেয়ে বড়ো বলে মনে হয়েছিল, তার প্রতিই তিনি বিশেষভাবে মন দিয়েছিলেন। বই লেখা ছিল নানান কাজের মধ্যে একটি এবং তাও প্রধানতঃ প্রয়োজনের তাগিদে—কখনও বিদ্যার্থীদের জন্য, কখনও সমাজসংস্কারের উদ্দেশ্যে। তথাপি সাহিত্যসৌন্দর্যে মণ্ডিত তাঁর অনেক রচনা—বিশেষ, তাঁর সংস্কৃত কাব্যের ভাবানুবাদ— ‘শকুন্তলা’ ও ‘সীতার বনবাস’। ‘শকুন্তলা’র মূলে আছে কালিদাসের বিখ্যাত নাটক; আর ‘সীতার বনবাসে’র প্রথম দুই পরিচ্ছেদের উৎস ভবভূতির ‘উত্তররামচরিত’, অবশিষ্টাংশের উপাদান প্রধানত; বাল্মীকি রামায়ণের উত্তরকাণ্ড থেকে নেওয়া। ‘রামের রাজ্যাভিষেক’ নামেও একখানি গ্রন্থ তিনি আরম্ভ করেছিলেন, কিন্তু তার কয়েক পৃষ্ঠার বেশী আর অগ্রসর হতে পারেননি। কাব্যানুবাদের বেলায় কেবল আখ্যান-বর্ণনা ও ভাব-পরিবেশনেই তাঁর দৃষ্টি নিবন্ধ ছিল না, তিনি চেয়েছিলেন মূল কাব্যের রস আহরণ করতে, গদ্যের চলনকেও ছন্দোময় করে তুলতে। বাক্যগঠনে অবহিত হলে শুধু যে অর্থকে সুবোধ্য করা যায়, তাই নয়, রচনাকে শ্রুতিমধুর ও তরঙ্গায়িত করে তোলা যায়, তার দৃষ্টান্ত তিনি রেখে গেছেন।

‘এই গিরির শিখরদেশ আকাশপথে সতত সঞ্চরমাণ জলধরপটল-সংযোগে নিরন্তর নিবিড় নীলিমায় অলঙ্কৃত; অধিত্যকাপ্রদেশ ঘনসন্নিবিষ্ট বনপাদপসমূহে সমাচ্ছন্ন থাকাতে, সতত স্নিগ্ধ, শীতল ও রমণীয়; পাদদেশে প্রসন্নসলিলা গোদাবরী তরঙ্গবিস্তার করিয়া প্রবল বেগে গমন করিতেছে।’ [সীতার বনবাস]—এ বাক্যের পর্বে পর্বে যে সুন্দর ধ্বনি-সামঞ্জস্য, তা তাঁর শিল্পবোধেরই অভ্রান্ত নিদর্শন।
দক্ষিণেশ্বরের পূজারীঠাকুরের একবার খেয়াল হ’ল সমুদ্রস্নানের, অমনি অযাচিতভাবে বাদুড়বাগানের বাড়িতে এসে হাজির সাগর-সঙ্গমে। প্রথম সম্ভাষণও অদ্ভুত রকমের। ‘এতদিন ছিলাম খালে-বিলে নদী-নালায়, এবার এসে পড়েছি একেবারে সাগরে’। উত্তরও ঠিক তেমনই, ‘তা বেশ, খানিকটা! নোনা পানি নিয়ে যান।’

—জনার্দন চক্রবর্তী



আমাদের ধারণার অনধিগম্য যে-সমস্ত বিষয় আছে বিদ্যাসাগরের মনুষ্যমহিমা নিশ্চয়ই তেমন একটি বিষয়। এমন একটি মহাজীবনের আলোকে আমরা কিছুটা আভাস পেতে পারি ভূমা কাকে বলে, ভূমৈব সুখং নাল্পে সুখমস্তি, এই সুচিরশ্রুত বাণীরই বা অর্থসঙ্কেত কি? তদ্ধিদ্ধি প্রণিপাতেন পরিপ্রশ্নেন সেবয়া। প্রণিপাত পরিপ্রশ্ন ও সেবা, এই তিনটি সিংহদ্বার অতিক্রম করে জ্ঞানী তত্ত্বদর্শীর উপদেশে অনুভূতির সেই রাজ্যে আমরা প্রবেশাধিকার পেতে পারি। এই মহামানবের বিস্ময়কর প্রতিভা ও বিদ্যাবত্তার পরিমাপ করবার বিগলিত করুণা-মন্দাকিনীর উৎস নির্দেশ করতে পারি এমন সেবা-সুকৃতিও জীবনে সঞ্চয় করা হয়নি। আমাদের সম্বল শুধু প্রণিপাত।

এই প্রণিপাত প্রত্যক্ষ করেছি বিদ্যাসাগরের করুণাসিন্ধুর তটস্থ মহাকবি শ্রীমধুসূদনে। কবির স্বানুভবের স্বচ্ছ দর্পণে প্রতিবিম্বিত হয়েছে এই বিরাট মনুষ্যমহিমা—
                বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে,
                করুণার সিন্ধু তুমি, সেই জানে মনে
                দীন যে, দীনের বন্ধু।

বিদ্যাসাগরের নিকটতম ব্যক্তিসান্নিধ্যে অবস্থান করে এই মহৎ উদার বিশাল কবিপ্রাণ স্বতঃস্ফুর্ত সুগভীর কৃতজ্ঞতার আবেশে জীবন-নাট্যের এক দুর্যোগসন্ধিতে সদ্যঃপরীক্ষালব্ধ নতুন ছন্দে এই কথাগুলি গেঁথেছিলেন। প্রাণসম্পদে রাজাধিরাজ এই মহাকবি নিজের দীনতার অকুণ্ঠ বৈষ্ণবজনোচিত স্বীকৃতি দিয়ে দেবমানবের মনুষ্যমহিমা এবং নামমহিমার কাব্যময় মহিম্নঃ স্তোত্র রচনা করেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ যাকে বিদ্যাসাগরের ‘অক্ষয় মনুষ্যত্ব’ বলেছেন তা তাঁর মানবিকতারই একটি দিক। তাঁর মানবসেবায় আত্মনিয়োগের কথা ইতিমধ্যেই উল্লেখ করা হয়েছে। মানবপ্রীতিই তাঁর মূল প্রেরণা। সম্ভবত রবীন্দ্রনাথ যা বলতে চেয়েছিলেন তা হ’ল এই যে, তাঁর মানবসেবা কোনো ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না।

—হিরণ্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়



ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর একটি অনন্যসাধারণ চরিত্র। উনবিংশ শতাব্দীতে যে সকল ক্ষণজন্মা মহাপুরুষের বাংলাদেশে আবির্ভাব হয়েছিল তাঁদের মধ্যেও তিনি স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে বিশেষভাবে চিহ্নিত ছিলেন। অগণিত গুণের বিচিত্র সমাবেশ নিয়ে তিনি একক মাহাত্ম্যে জীবনের পথে বলিষ্ঠ পদক্ষেপে চলে গেছেন। তিনি যে আছেন তা জীবনের সকল ক্ষেত্রে সকলে অনুভব করেছে এবং সকলেরই শ্রদ্ধা তাঁর প্রতি আপনা হতে আকৃষ্ট হয়েছে। তাঁর জন্মের সার্ধশতবৎসর পূর্তি উপলক্ষে তাঁর চরিত্রের একটি সংক্ষিপ্ত মূল্যায়নের মধ্য দিয়ে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করবার প্রস্তাব করি।

তাঁর সমসাময়িক মানুষদের মন্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়েই এই মূল্যায়ন আরম্ভ করা যাক। মাইকেল মধুসূদন দত্ত শুধু তাঁর সমসাময়িক ছিলেন না, বন্ধু ছিলেন। কাছে থেকে জানবার সুযোগ তাঁর যথেষ্ট হয়েছিল। তিনি বিদ্যাসাগর সম্বন্ধে স্ত্রীর নিকট মন্তব্য করেছিলেন, বিদ্যাসাগর এমন একজন মানুষ ‘যাঁর মনীষা প্রাচীন ‌ঋষিদের মতো, কর্মদক্ষতা ইংরেজের মতো এবং হৃদয়বত্তা বাঙালী জননীর মতো।’ এই উক্তি যে অক্ষরে অক্ষরে তাঁর ওপর প্রযোজ্য তা তাঁর জীবনী হতেই প্রমাণিত হয়।
বিদ্যাসাগর একদিন শিবনাথ শাস্ত্রীকে বলিয়াছিলেন, “দেখ, ভারতবর্ষে এমন কোনো রাজা নাই যাহার নাকে এই চটিজুতাসুদ্ধ পায়ে টক্ করিয়া লাথি না মারিতে পারি।” শিবনাথ শাস্ত্রী লিখিয়াছেন, একথা শুনিয়া তাঁহার একটুও অবিশ্বাস হয় নাই।

—রাধারমণ মিত্র



৬.৪.১৮৪৬ হইতে ১৫.৭.১৮৪৭-এর মধ্যে কোনো এক সময়ের ঘটনা। বিদ্যাসাগর তখন সংস্কৃত কলেজের সহকারী সম্পাদক ও মিঃ জেমস্ কার হিন্দু কলেজের অধ্যক্ষ।

একদিন বিদ্যাসাগর কোনো প্রয়োজনে সংস্কৃত কলেজ হইতে হিন্দু কলেজে কার সাহেবের সহিত সাক্ষাৎ করিতে যান। কার সাহেব তখন তাঁহার কামরায় সম্মুখস্থ টেবিলের উপর পাদুুকা-শোভিত পদযুগল সম্প্রসারিত করিয়া চেয়ারে বসিয়াছিলেন। বিদ্যাসাগরকে দেখিয়া পদযুগল নামাইলেনও না বা গুটাইলেনও না, বরং পায়ের দিকে যে চেয়ার ছিল অঙ্গুলিসংকেতে তাহাতে বিদ্যাসাগরকে বসিতে বলিলেন। সেই অবস্থায় কথাবার্তা সারিয়া বিদ্যাসাগর চলিয়া গেলেন। এই ঘটনার কিছুদিন পরে কি প্রয়োজনে কার সাহেব সংস্কৃত কলেজে বিদ্যাসাগরের সহিত সাক্ষাৎ করিতে যান। বিদ্যাসাগর টেবিলের উপর তাহার তালতলার চটি-শোভিত পদযুগল কার সাহেবের দিকে প্রসারিত করিয়া দিয়া কথাবার্তা বলিলেন। এই ব্যবহারে কার সাহেব অত্যন্ত অপমানিত বোধ করিয়া উপরিওয়ালার নিকট নালিশ করিলেন। বিদ্যাসাগরের নিকট লিখিত কৈফিয়ৎ তলব করা হইলে তিনি উত্তরে যাহা লিখিয়াছিলেন তাহা অবিকল ইংরাজিতেই উদ্ধৃত করিয়া দিলাম দুই কারণে; প্রথম, বাংলা অনুবাদে মূলের তীব্র ব্যঙ্গরস রক্ষা করা সম্ভব হইবে না; দ্বিতীয়, এই সময়ের মধ্যেই তিনি ইংরাজি রচনায় কিরূপ সিদ্ধহস্ত হইয়াছিলেন তাহা দেখাইবার জন্য।
সেই মহামানবের কর্মকীর্তির কথা আমি আর নূতন করিয়া কি বলিব, আর কতটুকুই বা বলিতে পারি? শুধু ইহাই বলিতে পারি—ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বঙ্গজননীর শ্রেষ্ঠতম সন্তান। পৃথিবীর ইতিহাসেও ঠিক এমন একটি চরিত্রের মানুষ আমি খুঁজিয়া পাই নাই।

—আশুতোষ মুখোপাধ্যায়



আমার বয়স যখন দশ বৎসর, তখন আমি বিদ্যাসাগর মহাশয়কে প্রথম দর্শন করি। সেই প্রথম দর্শনের স্মৃতি আমার মনে চিরজাগ্রত। সেই সময়ে তিনি আমাকে একখানি ‘রবিনসন ক্রুশো’ উপহার দিয়াছিলেন। তাঁহার নিজের হাতে দেওয়া সেই উপহারটি আমি সযত্বে এবং শ্রদ্ধার সঙ্গে রক্ষা করিয়াছি তাহার পর আমার কর্ম-জীবনের আরম্ভে আমি আর-একবার তাঁহার সংস্পর্শে আসিয়াছিলাম। তখন তিনি আমাকে তাঁহার মেট্রোপলিটন কলেজে একটি অধ্যাপকের চাকরি দিয়াছিলেন।
বিদ্যাসাগরের উন্নত সুদৃঢ় চরিত্রে যাহা মেরুদণ্ড, সাধারণ বাঙালীর চরিত্রে তাহার একান্তই অসদ্ভাব। মেরুদণ্ডের অস্তিত্ব প্রাণীর পক্ষে সামর্থ্যের ও আত্মনির্ভরশক্তির প্রধান পরিচয়। বিদ্যাসাগর যে সামর্থ্য ও আত্মনির্ভরশক্তি লইয়া জন্ম গ্রহণ করিয়াছিলেন, সাধারণ বাঙালীর চরিত্রে তাহার তুলনা মিলে না।

—রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী



রত্নাকরের রামনাম উচ্চারণের ক্ষমতা ছিল না। অগত্যা ‘মরা’ ‘মরা’ বলিয়া তাঁহাকে উদ্ধার লাভ করিতে হইয়াছিল।

এই পুরাতন পৌরাণিক নজিরের দোহাই দিয়া আমাদিগকেও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের নামকীর্তনে প্রবৃত্ত হইতে হইবে। নতুবা ঐ নাম গ্রহণ করিতে আমাদের কোনোরূপ অধিকার আছে কি না, এ বিষয়ে ঘোর সংশয় আরম্ভেই উপস্থিত হইবার সম্ভাবনা। বস্তুত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এত বড় ও আমরা এত ছোট, তিনি এত সোজা ও আমরা এত বাঁকা যে, তাঁহার নাম গ্রহণ আমাদের পক্ষে বিষম আস্পর্ধার কথা বলিয়া বিবেচিত হইতে পারে। বাঙালী জাতির প্রাচীন ইতিহাস কেমন ছিল, ঠিক স্পষ্ট জানিবার উপায় নাই। লক্ষ্মণসেনঘটিত প্রাচীন কিংবদন্তী অনৈতিহাসিক বলিয়া উড়াইয়া দেওয়া যাইতে পারে; কিন্তু পলাশির লড়াই-এর কিছুদিন পূর্ব হইতে আজ পর্যন্ত বাঙালী-চরিত্র ইতিহাসে যে স্থান লাভ করিয়া আসিয়াছে, বিদ্যাসাগরের চরিত্র তাহা অপেক্ষা এত উচ্চে অবস্থিত যে, তাঁহাকে বাঙালী বলিয়া পরিচয় দিতেই অনেক সময় কুণ্ঠিত হইতে হয়। বাগ্ যত, কর্মনিষ্ঠ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যসাগরও আমাদের মতো! বাক্‌ সর্বস্ব সাধারণ বাঙালী, উভয়ের মধ্যে এত ব্যবধান যে, স্বজাতীয় পরিচয়ে তাঁহার গুণকীর্তন দ্বারা প্রকারান্তরে আত্মগৌরব খ্যাপন করিতে গেলে বোধহয় আমাদের পাপের মাত্রা আরও বাড়িয়া যাইতে পারে।
বিদ্যাসাগর নারীশিক্ষা, প্রৌঢ়শিক্ষা, বিধবাবিবাহ— এ-সবকিছুর মাধ্যমে চেয়েছিলেন সামাজিক পরিবর্তন। তিনি জোর দিয়েছিলেন শিক্ষার উপর, কারণ তিনি বুঝেছিলেন, শিক্ষাই সামাজিক পরিবর্তনের জন্য মোক্ষম অস্ত্র। নারীশিক্ষা ও নারীর প্রতি সম্মান সমাজের গতিপথে উন্নতি আনবে। এক শিক্ষিতা নারী পরিবারের শিক্ষার জন্য দীপশিখা। আমাদের দায়িত্ব সেই অদ্ভুত আধুনিক মনোভাবাপন্ন বিদ্যাসাগরের দীপশিখা প্রজ্জ্বলিত করে রাখা।

—প্রমথেশ দাস


শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য উত্তম চরিত্র ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ তৈরি করা। এই লক্ষ্য নিয়ে যুগ যুগ ধরে সারা পৃথিবীতে শিক্ষাধারা অব্যাহত রয়েছে। কোনো ব্যক্তিকে যদি উত্তম চরিত্র ও ব্যক্তিত্বের মাপকাঠিতে বিচার করতে হয়, তখন একটি বৈশিষ্ট্য বিশেষভাবে দেখতে হয়, যে তার চিন্তাভাবনা, কথাবার্তা ও আচার-আচরণের মধ্যে কী কী মূল্যবোধ, কত মাত্রায় বিদ্যমান বা প্রকাশ পাচ্ছে। যে-কোনো ব্যক্তির সঙ্গে দেখা হলে আমরা তার শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রমাণপত্র দেখি না, কিন্ত শিক্ষার প্রমাণ ও প্রভাব তার আচরণের মধ্যেই প্রকাশ পায়। আচরণ অন্তর্নিহিত জ্ঞান, চিন্তা ও বিচারবুদ্ধির পরিপ্রকাশ। কোনো মনীষী শিক্ষার সংজ্ঞা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে যথার্থই বলেছেন— শিক্ষা হলো সেই জিনিস যা একজন মানুষের মধ্যে থেকে যায় যখন তার পড়াশোনা শেষ হয়ে গেছে এবং পড়ার বিষয়বস্তু ভুলে গেছে।

বিদ্যাসাগরের অনাড়ম্বর পোশাক এবং অতি সাধারণ চেহারার ভেতর থেকে প্রকাশ পেত অন্তর্নিহিত তেজ, প্রচণ্ড বিচারশক্তি এবং প্রগাঢ় মূল্যবোধের অভিব্যক্তি। যে-শিক্ষা তিনি পেয়েছেন বীরসিংহ গ্রামে, পরিবারে এবং কলকাতায়, তিনি তাঁর অতিমানস শক্তির দ্বারা সে-শিক্ষাকে নিজের ব্যক্তিত্ব বিকাশে সুচারুভাবে কাজে লাগিয়েছেন। সেই অতিমানস শক্তি তাঁকে শিক্ষা ও সমাজসংস্কারে অদম্য প্রেরণা ও সাহস দিয়েছে। তাই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মূল্যবোধের এক জীবন্ত উদাহরণ।
‘সাঁওতালরা তাঁকে তাদের ফসল উপহার দিত (শাকপাতা, কন্দ, মুল, কুদ্রুম), গরিবের যে-উপহার পেয়ে তিনি অশ্রপাত করেছেন। ১৮৮৮ অবধি তিনি কর্মাটাঁড়ে যেতেন, তার পরেও নিয়মিত খবরাখবর নিতেন ও মাসোহারা পাঠাতেন। বাংলোর মুখোমুখি, তাঁর প্রতিষ্ঠিত এই উপমহাদেশের প্রথম দাতব্য আদিবাসী বালিকা বিদ্যালয় ও দাতব্য হোমিও চিকিৎসালয় চালু রয়েছে।

—ড. অর্চনা বন্দ্যোপাধ্যায়

              কুড়ি কুড়িকো নঁরঙা করমবুটে তিঁরিয়ঁ দ...
              (ওই শোনো মেয়েরা, করমগাছে করমবাঁশি বাজছে, চলো চলো)
              করো ত্বরা, করো ত্বরা, কাজ আছে মাঠ ভরা
              দেখিতে দেখিতে দিন আঁধার হবে।         —রবীন্দ্রনাথ।


জীবনের শেষ দিকে বিদ্যাসাগর কর্মাটাঁড় (অর্থাৎ, বিস্তীর্ণ কর্মভূমি বা করমগাছ-এর ডাঙা)-এ আঠারো বছর সাঁওতালদের মধ্যে কাটান। (হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে, কর্মা নামে এক সাঁওতালের নামে কর্মাটাঁড়)। এখানে তিনি বিদ্যার গুরু নন, কর্মের পাহাড় করমবুরু বা কর্ম-দেবতা। ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চলের অনেক স্থানে বিভিন্ন গ্রামের এক নাম দেখা যায়, প্রধানত গাছের নামে, যেমন কর্মাটাঁড় (হলদু ও কেলিকদম), জামতাড়া, মাতকোমডিহি (মহুয়া), সারজংডিহি (শাল), সাপারমডিহি (শিউলিবনা)। এ ছাড়া, দুয়ারসিনি, যদুগোড়া, চকইচালান, ধুন্দিখাপ, ডাবা তোরাং, বাঘমুন্ডি, বুরুয়াকোচা, ঝালদা গ্রামগুলি ও আশপাশে কুমোরপাড়া, কামারপাড়া, পেটোপাড়া, তাঁতিপাড়া, গোয়ালপাড়ার বাসিন্দারা নিজেদের পেশা কাঠের কাজ, পাতার থালাবাটি, ঝুড়ি, খাটিয়া বোনার কাজ করে। কর্মনিপুণতা পরম্পরায় চর্চিত। চাষবাস, হস্তশিল্প হাটবারে কেনাবেচা, বিনিময় হয়। রোপণের পরের অবসরে, করম পরবের আগে, প্রধানত হস্তশিল্পের কাজ হয়।

হাওয়া বদল ও বিশ্রাম নিতে বিদ্যাসাগর বাঙালি-অধ্যুষিত দেওঘরের বড় বাড়ি কেনার চেয়ে নির্যাতিত, বিধ্বস্ত সাঁওতালদের মধ্যে থাকার জন্য এই কর্মাটাঁড়ের বৃক্ষবাগানসহ ছোট বাড়ি কেনা ঠিক করেন (১৮৬৯)। সাঁওতালরা ওখানকার সাত-আট ঘর দিকো (বহিরাগত) বা বাঙালিদের বিশ্বাস করত না, কারণ ভদ্রলোকদের কাছ থেকে তারা জিনিসের দাম বা শ্রমের মজুরি পেত না। বিদ্যাসাগর ন্যায্য মজুরি দিয়ে সাঁওতালদের আত্মীয়ের বিশ্বাস অর্জন করেন। সেই কালে প্রতি বছর হাজার টাকার বেশি খরচ করে কাপড়, শীতবস্ত্র, মোটা চাদর, কম্বল কিনে, কমলালেবু, খেজুর কলকাতা থেকে কিনে নিয়ে দিয়েছেন। রোগে ওষুধ, ভেষজ ও পথ্য দিয়েছেন। নিজ হাতে জমাদারনি কলেরা রোগীর, সাঁওতাল বালকের মলমুত্র পরিষ্কার করতে দ্বিধা করেননি। দুপুর রোদে তিন মাইল হেঁটে সাঁওতাল বালকের চিকিৎসা করেছেন। শিক্ষা, কর্ম, আনন্দে ভরা তাঁর বাগানবাড়ি। তাঁরই দেওয়া নাম নন্দন কানন-কে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ‘মহর্ষির আশ্রম’ বলেছেন। নন্দন কাননে সকালে আম, লতানে আমের কলম ও আরও নানা ফলবৃক্ষরোপণ, বাগানের কাজ এবং খাওয়াদাওয়ার পরে আনন্দের নাচ হতো।
বিদ্যাসাগরের রচনাগুলি নিয়ে যখন আলোচনা হয়, তখন সাধারণভাবে আখ্যানমঞ্জরী-র তিনটি ভাগ শুধু উল্লেখ করা হয়। বিদ্যাসাগর বিভিন্ন বই থেকে নানান কাহিনি উদ্ধৃত করে সেগুলি সরল ভাষায় ছাত্রদের জন্য গ্রন্থনা করেন। প্রথম ভাগে একুশটি, দ্বিতীয় ভাগে ছাব্বিশটি ও তৃতীয় ভাগে কুড়িটি কাহিনি স্থান পেয়েছে। লেখাগুলি বেশ সুখপাঠ্য। রচনারীতি খানিকটা নতুন বলা যায়। বেশ ক’টি কাহিনি ঔপনিবেশিক নির্মমতা ও নিষ্ঠুরতার বিবরণ। সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দিতে দেশ দখল করতে গিয়ে ইংরেজ, স্পেনীয় দখলকারেরা অধিকৃত দেশগুলির আদিবাসীদের ওপর যে-নৃশংস অত্যাচার চালিয়েছিল, তারই পরিচয় তিনি দিয়েছেন। এই লেখাগুলি খুঁটিয়ে পড়লে ঔপনিবেশিকতাবাদীদের, বিশেষ করে ইংরেজ রবিনসন ক্রুসোদের, স্বরূপ বুঝতে অসুবিধে হয় না। তাঁর আগে বোধ হয় আর কেউ এমন উদ্ঘাটন করেননি। দু’একটি কাহিনির সংক্ষেপে উল্লেখ করছি।

—পবিত্রকুমার সরকার



তালিবান নেতা মোল্লা মুহম্মদ ওমরের নির্দেশে ২০০১ সালের মার্চের একেবারে গোড়ার দিকে একদল ধর্মীয় সন্ত্রাসী আফগানিস্তানের বামিয়ান বুদ্ধমূর্তি ডিনামাইট ফাটিয়ে উড়িয়ে দেয়। এটি ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় বুদ্ধমূর্তিগুলোর একটি। দেড় হাজার বছরের ওই মূর্তি ঐতিহাসিক সৌকর্ষের গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত হত। ওই জায়গাটি ইউনেস্কো ঘোষিত ঐতিহ্যকেন্দ্র বা হেরিটেজ সাইট। বামিয়ান উপত্যকায় পাহাড়ের পৃষ্ঠতল কেটে-কেটে একদিন ওই বুদ্ধমূর্তি তৈরি হয়েছিল। মৌলবাদী অন্ধতার কাছে অবশ্য এই সবের দাম নেই। ইসলামের নামে এই সব কাণ্ডকারখানা চলেছিল। গোটা বিশ্ব ওই ঘটনায় স্তম্ভিত হয়ে যায়। পাকিস্তানসহ চুয়ান্নটি ইসলামিক রাষ্ট্র বামিয়ান বুদ্ধমূর্তি ধ্বংসের নিন্দা করে। বর্তমানে সুইটজারল্যান্ডের উদ্যোগে ওই মূর্তি পুননির্মাণের চেষ্টা চলছে। মূর্তি নির্মাণ হলেও ঐতিহ্য ফিরে আসবে না।

২০০৩ সালে মার্কিনরা যখন ইরাক দখলে উন্মত্ত সামরিক অভিযান চালায়, ধ্বংস হয়েছিল সুমের ও মেসোপটেমিয়া সভ্যতার অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নসামগ্রী। এত বড় এবং এর তুল্য না-হলেও, একদা এই বাংলাতেও এই সব বোধবুদ্ধিহীন ঘটনা ঘটেছে রাজনৈতিক মৌলবাদের আশ্রয়ে। ১৯৬৯-৭০ আন্দোলনের পথ ধরে মাওবাদী (ওদের দাবি অনুযায়ী) কৃষক বিপ্লবের ধ্যানধারণা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য একদল তরুণ-তরুণী সংকল্পবদ্ধ হয়। ওদের নেতা ছিলেন চারু মজুমদার, সুশীতল রায়চৌধুরী, কানু সান্যাল, সরোজ দত্ত, জঙ্গল সাঁওতাল প্রমুখ। বহু মেধাবি উজ্জ্বল ছাত্রছাত্রী সশস্ত্র বিপ্লবের কুহক-আকর্ষণে ঝাপিয়ে পড়ে। ওরা জোতদার-জমিদার-মুৎসুদ্দি বুর্জোয়ার শাসন-শোষণ থেকে দেশকে দ্রুত মুক্ত করার লক্ষ্যে কলকাতা শহর-সহ রাজ্যের কয়েকটি অঞ্চলে চোরাগোপ্তা হামলা চালায় ও হত্যার আশ্রয় নেয়। ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের আগে লেনিন বিচ্ছিন্ন সন্ত্রাসী ক্রিয়াকাণ্ডের তীব্র নিন্দা করেন এবং একে ‘নারোদনিজম’ (রুশ দেশের ১৮৬০-৭০ সালে কৃষক অভ্যূত্থানভিত্তিক এই মতবাদ প্রচলিত। পরে এর পরিণতি হয় সন্ত্রাসমূলক কার্যকলাপে) আখ্যা দেন। তালিবানদের মতো এই বাংলার নকশালপন্থীরা স্কুল-কলেজ-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ধ্বংস করার এবং ওদের শ্রেণি-উৎস বা মতাদর্শগত পার্থক্য যা-ই থাক না কেন, উভয়ের প্রয়োগ-পদ্ধতি একই ছিল। নকশালপন্থী নামে পরিচিত ওই ছাত্র-যুবরা স্বাধীনতা ও সংস্কার আন্দোলনে অর্জিত গণতান্ত্রিক মূল্যবোধগুলি বিনির্মাণে নেমে পড়ে।
অবহেলিতা নারীজাতির প্রতি নবজাগৃতির এই অগ্রদূতের যে কী অপরিসীম সহানুভূতি ও সমবেদনা ছিল, তার প্রমাণ মেলে বিদ্যাসাগরের জীবনচরিত-এ বারবার। শুধু বিধবাবিবাহ নয়, নারীত্বের অবমাননাকারী কৌলিন্য প্রথার বিরুদ্ধে, বহুবিবাহের বিরুদ্ধে তাঁর সংগ্রাম এবং সর্বোপরি বেথুন স্কুলের সম্পাদনাকাল হতে পরবর্তীকালে জেলায়-জেলায় মেয়েদের স্কুল স্থাপনা— এ-সবকিছুই নারীমুক্তির অগ্রণী অভিভাবক ঈশ্বরচন্দ্র চরিত্রের এক অন্যতম বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছে।

—সোমেশ দাশগুপ্ত



মাইকেল এবং তাঁর ‘Vid’

উনিশ শতকের প্রথমার্ধে ইংরেজি শিক্ষার সংস্পর্শে আলোকপ্রাপ্ত দুই বাঙালি প্রতিভা— ঈশ্বরচন্দ্র এবং মধুসূদন, একই সংস্কারমুক্ত, যুক্তিবাদী মানসিকতায় গড়ে উঠেছেন, আধুনিক মানবতাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে। দুজনের কাজের মধ্যেই এই আদর্শবাদ এবং যুক্তিবাদী চেতনার স্বাক্ষর স্পষ্ট।

বিদ্যাসাগরের সীতার বনবাস এবং মাইকেলের মেঘনাদবধ কাব্য— এই উভয় রচনাতেই আর্যাবর্তের এ-যাবৎ কালের প্রধান নায়ক অযোধ্যার শ্রীরামচন্দ্র অবতারত্বের পদ থেকে নেমে সাধারণ মনুষ্যত্বের স্তরে এসে দাঁড়িয়েছেন।

সীতার বনবাস আলোচনার আগে আরও দুয়েকটি প্রাসঙ্গিক কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন। এক, সীতার বনবাস বিদ্যাসাগর মহাশয়ের অপেক্ষাকৃত পরিণত বয়সের রচনা। ১২৬৭ বঙ্গাব্দের ১ বৈশাখ (১৮৬০ এর ১৫ এপ্রিল) এর প্রথম প্রকাশ। রবীন্দ্রনাথের জন্মের এক বছর আগে। দুই, ওই ১৮৬০ সালের ২৪ এপ্রিল ঋষি রাজনারায়ণ বসুকে লেখা মধুসূদনের এক চিঠি থেকে জানতে পারি, তিলোত্তমাশর্মিষ্ঠা লেখার পরে মধুসূদনকে ‘একটি জাতীয় মহাকাব্য’, রচনার অনুরোধ জানিয়েছিলেন রাজনারায়ণ। তিন, ১৮৬৩-এর ২৪ এপ্রিল থেকে ১৮৬১-র জুনের মধ্যে মেঘনাদবধ কাব্য— প্রথম খণ্ড (প্রথম পাঁচটি সর্গ) লেখা হয়। রবীন্দ্রনাথের জন্মের পর-পরই।
প্রখর রোদে ঘর্মাক্ত বিদ্যাসাগর হনহন করে আল পথ ধরে হেঁটে আসছেন, একটি পাথরের বাটি। হরপ্রসাদ প্রশ্ন করাতে বিদ্যাসাগর জানালেন কিছুক্ষণ আগে একটি সাঁওতালি এসে খবর দিয়েছে তার ছেলের নাক দিয়ে হু হু করে রক্ত পড়ছে, বললে, বিদ্যাসাগর তুই এসে যদি তাকে বাঁচাস। আমি একটা হোমিওপ্যাথিক ওষুধ নিয়ে গেছিলাম জানিস এক ডোজ ওষুধেই ছেলেটার রক্ত পড়া বন্ধ হয়ে গেল। বিদ্যাসাগর আরো বললেন এরা তো মেলা ওষুধ খায় না অল্প ওষুধে এদের উপকার হয়।

—প্রসূন কাঞ্জিলাল



সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত, সমাজসেবী, সমাজ সংস্কারক, এক বিশাল জ্ঞানের অধিকারী ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়কে সারা বিশ্বের মানুষ চেনেন। কিন্তু চিকিৎসক রূপে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ব্যাপ্তি সমন্ধে খুব কম সংখ্যক মানুষই জ্ঞাত। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগর মহাশয় এর আগ্রহ ও অবদান ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য। কিন্তু তার চিকিৎসা পদ্ধতির মূল অস্ত্র ছিল তার নিঃস্বার্থ সেবাপরায়ণতা এবং দরিদ্র মানুষের প্রতি তার অন্তরের ভালোবাসা।

বিদ্যাসাগরের হোমিওপ্যাথি চর্চার অত্যন্ত মানবিক নাকি ঐশ্বরিক বিবরণ পাওয়া যায় তার কারমাটার বাস কালে দরিদ্র শিক্ষাহীন সাঁওতালদের সান্নিধ্যে। বিহারীলাল সরকার লিখছেন “সাঁওতাল প্রবল পীড়ায় প্রায় শয্যাগত বিদ্যাসাগর তাহার শিয়রে বসিয়া, মুখে ঔষধ ঢালিয়া দিতেন, হা করাইয়া পথ্য দিতেন উঠাইয়া বসাইয়া মলমূত্র ত্যাগ করাইতেন সর্বাঙ্গে হাত বুলাইয়া দিতেন।” এ আন্তরিকতার হদিশ পেয়েছে শুধু সাঁওতালরা নয় সমাজের বিভিন্ন বৃত্তের মানুষ আর এই প্রয়াসের বলিষ্ঠতা তার আকৈশোরের অভ্যাস অথবা বলা ভালো জীবনধর্ম। এই মরমী মনটি হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার বহু আগে থেকেই ছিল সে কোন কৈশোর কালে বাবা ঠাকুরদাসের আশ্রয়দাতা জগদ্দূর্লভ সিংহের পরিচিত কিছু মানুষ কলেরায় আক্রান্ত হয়েছে শুনে বালক ঈশ্বরচন্দ্র তার বাবা ও দুই ভাই এর ভোজনের আয়োজন করে অসহায় পাঁচজন রোগীর কাছে গেলেন। ক্রমাগত বমি ও মলত্যাগের ক্লান্ত ও পিপাসার্ত মানুষগুলির জন্য স্থানীয় গৃহস্থ বাড়ি থেকে জল এনে খাওয়ালেন, ডাক্তার রূপচাঁদের বাড়ি থেকে বেদানা, মিছরি, এক কলসি পরিষ্কার জল এনে রোগীদের খাওয়ালেন নিজের হাতে বমি মলমূত্র পরিষ্কার করে ধোয়া কাপড় পড়ালেন। ডাক্তারের জল চিকিৎসায় আর ঈশ্বরচন্দ্রের সেবায় ক্রমে রোগীরা সুস্থ হয়ে উঠলেন। ১৮৬৬ সালের দুর্ভিক্ষে কলকাতার কলেজ স্কয়ার অঞ্চলে উপোসী মানুষকে নিজে হাতে খাবার পরিবেশন করেছিলেন। বীর সিংহ গ্রামে অন্ন ছত্র খুলেছিলেন, বিদ্যাসাগরের কড়া হুকুম ছিল যত টাকা খরচ হোক কেউ যেন অভুক্ত না থাকে। ১৮৬৯-৭০ সালে বর্ধমান এ এক ভয়ানক জ্বরে প্রচুর মানুষ মারা যায়। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সেইসব মানুষদের বিদ্যাসাগর সেবা ঔষধ পথ্য দিয়ে সুচিকিৎসার বন্দোবস্ত করেছেন। সেই জ্বর ছিল প্রকৃতপক্ষে ম্যালেরিয়া। বিদ্যাসাগর এ রোগের চিকিৎসার জন্য ডিসপেনসারি, ওষুধ পত্রের ব্যবস্থা করে ক্ষান্ত হননি, কলকাতায় এসে সেকালের ছোটলাট গ্রে সাহেবের কাছে বিষয়ের গুরুত্ব বোঝান। ফলে সরকারি বদান্যতায় আরো অনেক ডিসপেন্সারি খোলা হল। বিদ্যাসাগরের ডিসপেন্সারি থেকে শুধু ওষুধ পত্র নয় পয়সা ও পরনের কাপড় পর্যন্ত পাওয়া যেত। এই ডিসপেন্সারীর কাজে বিদ্যাসাগরকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিলেন প্যারীচাঁদ মিত্রের ভাইপো ডাক্তার গঙ্গা নারায়ন মিত্র। ম্যালেরিয়া রোগীকে সেখান থেকে কুইনাইন দেওয়া হত প্রয়োজনে তাদের বাড়ি গিয়েও বিদ্যাসাগর স্বয়ং ওষুধ পথ্য পৌঁছে দিয়ে আসতেন। বিদ্যাসাগরের এই অনন্য সাধারণ সেবার কথা স্মরণ করে, আরেক বিশিষ্ট মানুষ রজনীকান্ত গুপ্ত লিখছেন “১৮৮৩ সালে একদা তিনি বিদ্যাসাগর মশাই প্রাত :কালে ভ্রমণ করিতে করিতে এই নগরের প্রান্ত ভাগ অতিক্রম করিয়া কিয়দ্দূর গিয়েছেন, সহসা দেখিলেন একজন বৃদ্ধা অতিসার রোগে আক্রান্ত হইয়া পথের পাশে পড়িয়া রহিয়াছে। দেখিয়ে তিনি ওই মল লিপ্ত বৃদ্ধাকে পরমযত্নে ক্রোড়ে করিয়া আনিলেন এবং তাহার যথোচিত চিকিৎসা করাইলেন। দরিদ্রা বৃদ্ধা তাহার যত্নে আরোগ্য লাভ করিল।”
বিদ্যাসাগরের প্রগতিশীল চিন্তা ভাবনা এবং উদ্যোম আর দ্বারকানাথের মুদ্রণযন্ত্র,আর্থিক সঙ্গতি ও স্বচ্ছ সামাজিক, রাজনৈতিক চেতনা সোমপ্রকাশকে এমন উচ্চতায় নিয়ে যায় যে, বিভিন্ন বিষয়ে জনমত গঠনে অতি প্রভাবশালী ভূমিকা গ্রহণ করে এই পত্রিকা।

—প্রসূন কাঞ্জিলাল



দ্বিশতবর্ষে বিদ্যাসাগর স্মরণ এবং শ্রদ্ধা এ প্রজন্মের বাঙালিকে করেছে ঋদ্ধ। উৎসাহিত করছে এই অন্যতম শ্রেষ্ঠ যুগপুরুষকে জানতে এবং আত্মস্থ করতে। রক্ত-মাংসের এই ঈশ্বরের সামগ্রিক কর্মকান্ডের ক’য়েক শতাংশও যদি থাকত অনুপস্থিত, তবে জাতি হিসেবে বাঙালি যে আজ কতটা দীন থেকে যেত তা কল্পনায় আনলেই শিউরে উঠতে হয়। বিদ্যাসাগরের মতো মহামানবের জন্মের জন্য যেমন অপেক্ষা করতে হয় ক’য়েক শতাব্দী, তেমনই যে জাতির একজন বিদ্যাসাগর থাকেন সে জাতিকে কখনই অন্ধকারের অতল গহ্বরে তলিয়ে যেতে হয় না। বিদ্যাসাগরের মতো ঈশ্বররা কোনো একটি বিশেষ কাজের জন্যও জন্মান না। এক জীবনে বহু কাজের মাধ্যমে সমগ্র জাতিকে উন্নত করার দায়িত্ব তুলে নেন কাঁধে।

বিদ্যাসাগরের কর্মময় জীবনের অজস্র ধারার অন্যতম ছিলতৎকালীন বিভিন্ন পত্র পত্রিকার পৃষ্ঠেপোষকতাও। পেশা নয়, তাঁর বহুমুখী কর্মকাণ্ডকে পূর্ণতা দিতেই হাতে তুলে নিতে হয়েছিল ক্ষুরোধার কলম। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে বেশ ক’য়েকটি সাময়িক পত্রের দায়িত্ব তাঁকে সামলাতে হয়েছে দীর্ঘদিন। ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’, ‘সর্ব্বশুভকরী পত্রিকা’, ‘সোমপ্রকাশ’ ও ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’ ছিল তাঁর এই পর্বের কর্মকান্ডের বিচরণ ক্ষেত্র। তত্ত্ববোধিনীসোমপ্রকাশ ছিল সেই সময়ের অত্যন্ত প্রভাবশালী দুটি বাংলা পত্রিকা। শিক্ষিত বাঙালি সমাজে অত্যধিক প্রভাবশালী ইংরেজি পত্রিকা ছিল হিন্দু পেট্রিয়ট
বিদ্যাসাগর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো (১৮৫৬) এবং রয়াল এশিয়াটিক সোসাইটির সম্মানিত সদস্য (১৮৬৪) নির্বাচিত হন। ১৮৭৭ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার লেফটেন্যান্ট-গভর্ণর স্যার রিচার্ড টেম্পল বিধবাবিবাহ আন্দোলনের নেতা হিসাবে তাঁকে এক বিশেষ সম্মানলিপি প্রদান করেন। ১৮৮০-তে ভারত সরকার তাঁকে সি.আই. ই. উপাধিতে ভূষিত করেন।

—আনিসুজ্জামান

১. বিদ্যাসাগরচরিত

উনিশ শতকের বাংলা দেশে বহু কীর্তিমান পুরুষের জন্ম হয়েছিল। এঁদের মধ্যেও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের স্বাতন্ত্র্য সহজেই ধরা পড়ে। যে-বিস্ময়বোধ থেকে রবীন্দ্রনাথ তাঁর সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘বিশ্বকর্মা যেখানে চার কোটি বাঙালি নির্মাণ করিতেছিলেন, সেখানে হঠাৎ দুই-একজন মানুষ গড়িয়া বসেন কেন, তাহা বলা কঠিন’, যুগান্তরেও আমাদের সে-বিস্ময়বোধের অবসান হয় না।

অথচ তিনি লালিত হয়েছিলেন নিতান্ত প্রাচীনপন্থী পরিবেশে। মেদিনীপুর (তখন হুগলি) জেলার বীরসিংহ গ্রামে তাঁর জন্ম হয় (২৬ সেপ্টেম্বর ১৮২০। ১২ আশ্বিন ১২২৭)। তাঁর পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় সামান্য কর্ম করতেন; তাঁর বেতন কখনো মাসে দশ টাকার বেশি হয়নি। দারিদ্র তাঁদের সহচর ছিল; সম্পদ বলতে ছিল পুরুষানুক্রমিক চরিত্রবল। বিদ্যাসাগর-জননী ভগবতী দেবীও এ-চরিত্রগুণের অধিকারী ছিলেন। উত্তরাধিকারসূত্রে বিদ্যাসাগর যদি তাঁর পরিবার থেকে কিছু পেয়ে থাকেন, তবে তা ছিল চরিত্রের এই তেজ।
প্রকাশকাল ১৮৩৬, প্রকাশক ‘কলিকাতা ট্রাক/ট্র্যাক সোসাইটি’। বইটিতে বর্ণপরিচয় অংশটি নেই, কিন্তু উনিশ শতকের প্রথমার্ধের বাংলা প্রাইমারের যাবতীয় বৈশিষ্ট্য ধরা আছে। বালকের প্রথম পড়িবার বহি গ্রন্থে আছে ছোট ছোট বাক্য গঠন এবং পরে প্রাথমিক পাঠের আয়োজন। পাঠের বিষয় হল— নীতিশিক্ষা এবং বিদ্যালয়ের সুফল সম্পর্কিত বক্তব্য। এ ছাড়া আছে খ্রিস্ট ধর্মের প্রচারমূলক আখ্যান এবং হিন্দু ধর্মের মূর্তিপূজা সম্পর্কে বিরূপ ব্যাখ্যা। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযোগ্য, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বর্ণপরিচয় গ্রন্থের বেশ কিছু বাক্যপাঠ নির্মিত হয়েছে হুবহু বালকের প্রথম পড়িবার বহি গ্রন্থে উল্লিখিত বাক্যপাঠের অনুকরণে।

—আবীর কর



তখনও বিদ্যাসাগরের জন্ম হয়নি। সময়কাল হল ১৮১৬, লঙ সাহেব প্রদত্ত বাংলা ক্যাটালগের তথ্যানুসারে যা বাংলা প্রাইমারের প্রথম প্রকাশকাল হিসেবে চিহ্নিত। ১৮১৬ সালে শ্রীরামপুর মিশনারিরা প্রকাশ করেছিলেন লিপিধারা নামে বর্ণশিক্ষার বই। যদিও এ যাবৎ বইটির কোনও হদিশ মেলেনি, তবে জেমস লঙ-এর তথ্য অনুসারে লিপিধারা নামে ১২ পৃষ্ঠার বইয়ে বাংলা বর্ণের আকৃতি অনুযায়ী ছিল বইটির বর্ণবিন্যাস। অর্থাৎ ভাষাতত্ত্বের পথ মেনে উচ্চারণভিত্তিক নয়, রূপগত বিচারে বর্ণের জ্যামিতিক ফর্ম মেনে প্রকাশিত হয়েছিল বাংলা বর্ণ পরিচয়ের প্রথম বইটি। এর পরের বছর অর্থাৎ ১৮১৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে ‘কলিকাতা স্কুল বুক সোসাইটি’, যার প্রথম ও প্রধান উদ্দেশ্য ছিল পাঠ্যপুস্তক রচনা ও প্রকাশনা। সেই ‘স্কুল বুক সোসাইটি’ থেকে স্টুয়ার্ট সাহেব লিখলেন বর্ণমালা, এই গ্রন্থটিরও উল্লেখ মিলছে লঙ-এর ক্যাটালগ থেকে, লঙ সাহেবের বর্ণনা অনুসারে বর্ণমালা বইয়ের গোড়ায় ছিল বর্ণের পরিচয় পরে ‘ত্র্যক্ষর’ শব্দের বানান। এরপর লঙ-এর ক্যাটালগে যে-বইটির উল্লেখ আছে সেটি রাধাকান্ত দেবের বাংলা বানানের বই। তার বক্তব্য অনুযায়ী বইটি বানান শেখার বই, পৃষ্ঠা সংখ্যা ২৫৬। কিন্তু এই বইটি নিয়ে সংশয়ের বিষয় হল এই যে, রাধাকান্ত দেবের আলোচনায় কোথাও এই গ্রন্থটির উল্লেখ পাওয়া যায় না। সাহিত্য-সাধক চরিতমালা-য় রাধাকান্ত দেব সম্পর্কে আলোচনায় বাংলা শিক্ষাগ্রন্থ (১৮২১)-এর নাম আছে, যেখানে বিষয় হিসেবে প্রাথমিক বাংলা, বাংলা ব্যাকরণ, ইতিহাস ভূগোল, গণিতের সংকলন লক্ষ করা যায়।
স্বভাবতই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সতীদাহপ্রথা নিবারণের জন্য আইন পাস হওয়ার পর আবার একটি আইন প্রণয়ন করে হিন্দু প্রজাদের চটাতে সাহস করা সুবিবেচনা বলে মনে করছিলেন না। বৃহত্তর সমাজে আলোচনা কিন্তু চলছিল। সব থেকে সরব ছিলেন ইয়ং বেঙ্গল দল। তাঁদের মুখপত্র বেঙ্গল স্পেকটেটর ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দে প্রশ্ন তুলে ফেলল, স্ত্রীর মৃত্যুর পর পুরুষ যদি পুনর্বিবাহ করতে পারে তবে নারীকে সেই অধিকার কেন দেওয়া হবে না?

—গোপা দত্তভৌমিক



বিদ্যাসাগরের কর্মমুখর জীবনের অজস্র তরঙ্গভঙ্গের মধ্যে কোন কাজটিকে সর্বাপেক্ষা প্রাধান্য দেওয়া যাবে তা নিয়ে বিস্তর মতভেদ আছে। সমাজ সংস্কার, শিক্ষা সংস্কার, ভাষা ও সাহিত্য— কোনওটিই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। দানধ্যানের কথা নাহয় আপাতত থাক। বিদ্যাসাগর নিজে কিন্তু স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ‘বিধবাবিবাহ প্রবর্ত্তন আমার জীবনের সর্ব্বপ্রধান সৎকর্ম্ম।’ আজকাল অনেকে মনে করছেন বিধবাবিবাহ প্রবর্তনের জন্য এতটা পরিশ্রম ও কষ্টস্বীকার না করে তিনি যদি সাহিত্য চর্চায় সেই সময় ও অধ্যবসায় ব্যয় করতেন তবে চিরস্থায়ী কিছু ফল হত। অর্থাৎ এঁরা মনে করেন কালের গতিতে হিন্দু বিধবাদের বিয়ে একদিন প্রচলিত হতই— এত চাপাচাপি এবং আন্দোলনের দরকার ছিল না। বিশেষত এই কাজ করতে গিয়ে বিদ্যাসাগর রক্ষণশীল সমাজের বিরাগভাজন হন, আর্থিক দিকে নিঃস্ব হয়ে পড়েন এবং যাঁদের উপর ভরসা রেখেছিলেন তাঁরা কার্যকরী সাহায্য না করে সরে দাঁড়ানোতে বঙ্গসমাজের উপর তিনি আস্থা হারিয়ে ফেলেন। এককথায় শেষজীবনে যে তিনি শহর থেকে দূরে বিষণ্ণ এক প্রান্তিক জীবনে নিজেকে সরিয়ে নিলেন তার প্রধান কারণ বিধবাবিবাহ নিয়ে তাঁর প্রাণপণ আন্দোলন। এই ধারণা খুবই সরলীকৃত এবং বিদ্যাসাগর ও বঙ্গসমাজের পারস্পরিক সম্পর্কের লঘু বিচার। বিদ্যাসাগর কেন ‘বিধবাবিবাহ প্রবর্ত্তন’ তাঁর ‘সর্ব্বপ্রধান সৎকর্ম্ম’ বলে বিবেচনা করেছেন সেটি প্রথমত ভেবে দেখা দরকার। তিনিই যে বঙ্গসমাজে বিধবাবিবাহের কথা প্রথম বললেন এমনটা নয়। বস্তুত এই নিয়ে একটা চিন্তাভাবনা অষ্টাদশ শতক থেকেই ছিল। অদ্ভুত এক সমাপতন যে বিধবাবিবাহ আইন পাস (১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দ) হওয়ার ঠিক একশো বছর আগে ঢাকার নায়েব রাজবল্লভ সেন নিজের ছোট মেয়ে অভয়ার অকালবৈধব্যে ব্যথিত হয়ে বিধবাবিবাহের প্রচলন করার চেষ্টা করেন। তাঁর তিনজন দ্বার-পণ্ডিত কৃষ্ণদাস বেদান্তবাগীশ, নীলকণ্ঠ সার্বভৌম এবং কৃষ্ণদেব বিদ্যাবাগীশ জানিয়েছিলেন অক্ষতযোনি বিধবাদের পুনর্বিবাহে হিন্দুশাস্ত্রে কোনও নিষেধ নেই। রাজবল্লভ শুধু এঁদের কথার উপর নির্ভর করে মেয়ের বিয়ে দিতে ভরসা পেলেন না। তিনি কাশী, কাঞ্চী, মিথিলার পণ্ডিতদের কাছ থেকে অনুকূল মত আনালেন। কিন্তু তাঁর প্রয়াস ব্যর্থ হল নবদ্বীপে। নবদ্বীপের পণ্ডিতসমাজ চিরকালই রক্ষণশীল। চৈতন্যদেব ও তাঁর প্রেমভক্তিধর্মকেও তাঁরা সমকালে সুনজরে দেখেননি। তার উপর মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র তখন হিন্দুসমাজের মাথা। তিনি কীভাবে বাধা দিয়েছিলেন তা নিয়ে একটি কিংবদন্তি আছে। বিধবাবিবাহের প্রস্তাব নিয়ে রাজবল্লভের লোক আসার পর কৃষ্ণচন্দ্র তাঁদের যথাবিধি ভোজ্যের সঙ্গে একটি বাছুরও পাঠালেন। কারণ হিসেবে বলা হল বিধবাবিবাহ বহুকাল যাবৎ অপ্রচলিত আছে তা প্রচলিত হতে পারলে শাস্ত্রানুসারে গোমাংস ভক্ষণেও আপত্তি হতে পারে না। এরপর হিন্দুসমাজে আর কারও এগোবার সাহস হবে না বলা বাহুল্য। বিধবাবিবাহ নিয়ে অষ্টাদশ শতকে কেমন মনোভাব প্রচলিত ছিল ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের অন্নদামঙ্গল-এ তার একটি পরিচয় আছে। বাদশা জাহাঙ্গীর ও কৃষ্ণচন্দ্রের পূর্বপুরুষ ভবানন্দ মজুমদারের সম্পূর্ণ কাল্পনিক কথোপকথনে বিষয়টি এসেছে। এটি ধর্মাচার সম্বন্ধে মুসলমান শাসনের শেষপ্রহরে ইসলামি ও হিন্দু দুই বিরোধী পক্ষের ভারতাশ্রীয় ডিসকোর্স। জাহাঙ্গীর বিধবাদের বিষয়ে হিন্দুসমাজের আচারকে ধিক্কার দিলেন,
সেইজন্য বিদ্যাসাগর এই বঙ্গদেশে একক ছিলেন। এখানে যেন তাঁহার স্বজাতি-সোদর কেহ ছিল না। এদেশে তিনি তাঁহার সমযোগ্য সহযোগীর অভাবে আমৃত্যুকাল নির্বাসন ভোগ করিয়া গিয়াছেন। তিনি সুখী ছিলেন না। তিনি নিজের মধ্যে যে এক অকৃত্রিম মনুষ্যত্ব সর্বদাই অনুভব করিতেন, চারিদিকের জনমণ্ডলীর মধ্যে তাহার আভাস দেখিতে পান নাই। তিনি উপকার করিয়া কৃতঘ্নতা পাইয়াছেন, কার্যকালে সহায়তা প্রাপ্ত হন নাই। এই দুর্বল, ক্ষুদ্র, হৃদয়হীন, কর্মহীন, দাম্ভিক, তার্কিক জাতির প্রতি বিদ্যাসাগরের এক সুগভীর ধিক্কার ছিল। কারণ তিনি সর্ববিষয়েই ইহাদের বিপরীত ছিলেন।

—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর



বিদ্যাসাগরের চরিত্রে যাহা সর্বপ্রধান গুণ—যে গুণে তিনি পল্লী আচারের ক্ষুদ্রতা, বাঙালি জীবনের জড়ত্ব সবলে ভেদ করিয়া একমাত্র নিজের গতিবেগপ্রাবল্যে কঠিন প্রতিকূলতার বক্ষ বিদীর্ণ করিয়া— হিন্দুত্বের দিকে নহে, সাম্প্রদায়িকতার দিকে নহে— করুণায় অশ্রুপূর্ণ উন্মুক্ত অপার মনুষ্যত্বে অভিমুখে আপনার দৃঢ়নিষ্ঠ একাগ্র একক জীবনকে প্রবাহিত করিয়া লইয়া গিয়াছিলেন, আমি যদি তাঁহার সেই গুণকীর্তন করিতে বিরত হই, তবে আমার কর্তব্য একেবারেই অসম্পন্ন থাকিয়া যায়। কারণ বিদ্যাসাগরের জীবন-বৃত্তান্ত আলোচনা করিয়া দেখিলে এই কথাটি বারংবার মনে উদয় হয় যে, তিনি যে বাঙালি বড়লোক ছিলেন, তাহা নহে, তিনি যে রীতিমতো হিন্দু ছিলেন, তাহাও নহে—তিনি তাহা অপেক্ষাও অনেক বেশী বড় ছিলেন, তিনি যথার্থ মানুষ ছিলেন।

বিদ্যাসাগরের গৌরব কেবলমাত্র তাঁহার প্রতিভার উপর নির্ভর করিতেছে না। প্রতিভা মানুষের সমস্তটা নহে, তাহা মানুষের একাংশ মাত্র। প্রতিভা মেঘের মধ্যে বিদ্যুতের মতো, আর মনুষ্য চরিত্রের দিবালোক, তাহা সর্বব্যাপী ও স্থির। প্রতিভা মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ অংশ— আর, মনুষ্যত্ব জীবনের সকল মুহূর্তেই সকল কার্যেই আপনাকে ব্যক্ত করিতে থাকে। প্রতিভা অনেক সময় বিদ্যুতের ন্যায় আপনার আংশিকতা বশতই লোকচক্ষে তীব্রতররূপে আঘাত করে এবং চরিত্র-মহত্ব আপনার ব্যাপকতাগুণেই প্রতিভা অপেক্ষা ম্লানতর বলিয় প্রতীয়মান হয়। কিন্তু চরিত্রের শ্রেষ্ঠতাই যে যথার্থ শ্রেষ্ঠতা, ভাবিয়া দেখিলে, সে বিষয়ে কাহারো সংশয় থাকিতে পারে না।
অধ্যক্ষের পদে প্রতিষ্ঠিত হইয়াই তিনি নানা প্রকার সংস্কারকার্যে হস্তার্পণ করেন। (১ম) প্রাচীন সংস্কৃত পুস্তকগুলির রক্ষণ ও মুদ্রণ; (২য়) ব্রাহ্মণ ও বৈদ্য ব্যতীত অন্য জাতির ছাত্রগণের জন্য কলেজের দ্বার উদ্ঘাটন; (৩য়) ছাত্রদিগের বেতনগ্রহণের রীতি প্রবর্তন, (৪র্থ) উপক্রমণিকা, ঋজুপাঠ প্রভৃতি সংস্কৃত শিক্ষার উপযোগী গ্রন্থাদি প্রণয়ন; (৫ম) ২ মাস গ্রীষ্মাবকাশপ্রথা প্রবর্তন; (৬ষ্ঠ) সংস্কৃতের সহিত ইংরাজী শিক্ষা প্রচলন।

—শিবনাথ শাস্ত্রী



এক্ষণে আমরা বঙ্গ সমাজের ইতিবৃত্তের যে যুগে প্রবেশ করিতেছি, তাহার প্রধান পুরুষ পণ্ডিতপ্রবর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। এককালে রামমোহন রায় যেমন শিক্ষিত ও অগ্রসর ব্যক্তিগণের অগ্রণী ও আদর্শ পুরুষরূপে দণ্ডায়মান ছিলেন এবং তাঁহার পদভারে বঙ্গ সমাজ কাঁপিয়া গিয়াছিল, এই যুগে বিদ্যাসাগর মহাশয় সেই স্থান অধিকার করিয়াছিলেন। মানব-চরিত্রের প্রভাব যে কি জিনিস, উগ্র-উৎকট-ব্যক্তিত্বসম্পন্ন তেজীয়ান পুরুষগণ ধনবলে হীন হইয়াও যে সমাজমধ্যে কিরূপ প্রতিষ্ঠা লাভ করিতে পারেন, তাহা আমরা বিদ্যাসাগর মহাশয়কে দেখিয়া জানিয়াছি। যে দরিদ্র ব্রাহ্মণের সন্তান, যাঁহার পিতার দশ-বারো টাকার অধিক আয় ছিল না, যিনি বাল্যকালে অধিকাংশ সময় অর্ধাশনে থাকিতেন, তিনি এক সময় নিজ তেজে সমগ্র বঙ্গ সমাজকে কিরূপ কাঁপাইয়া গিয়াছেন তাহা স্মরণ করিলে মন বিস্মিত ও স্তব্ধ হয়। তিনি এক সময় আমাকে বলিয়াছিলেন—“ভারতবর্ষে এমন রাজা নাই যাহার নাকে এই চটি জুতা সুদ্ধ পায়ে টক করিয়া লাথি না মারিতে পারি।” আমি তখন অনুভব করিয়াছিলাম, এবং এখনও অনুভব করিতেছি ষে, তিনি যাহা বলিয়াছিলেন তাহা সত্য। তাঁহার চরিত্রের তেজ এমনই ছিল যে, তাঁহার নিকট ক্ষমতাশালী রাজারাও নগণ্য ব্যক্তির মধ্যে।

বিদ্যাসাগর মহাশয় ১৮২০ সালে মেদিনীপুর জেলার অন্তঃপাতী বীরসিংহ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। যে ব্রাহ্মণকুলে তিনি জন্মিলেন, তাঁহারা গুণ-গৌরবে ও তেজস্বিতার জন্য সে প্রদেশে প্রসিদ্ধ ছিলেন। তাঁহার পিতামহ রামজয় তর্কভূষণ কোনও পারিবারিক বিবাদে উত্যক্ত হইয়া স্বীয় পত্মী দুর্গাদেবীকে পরিত্যাগপূর্বক কিছুকালের জন্য দেশান্তরী হইয়া গিয়াছিলেন। দুর্গাদেবী নিরাশ্রয় হইয়া বীরসিংহ গ্রামে স্বীয় পিতা উমাপতি তর্কসিদ্ধান্ত মহাশয়ের ভবনে আশ্রয় গ্রহণ করেন। জ্যেষ্ঠ পুত্র ঠাকুরদাস সেই সময় হইতে ঘোর দারিদ্র্যে বাস করিয়া জীবন-সংগ্রাম আরম্ভ করেন। তাঁহার বয়ঃক্রম যখন ১৫ বৎসর হইবে তখন জননীর দুঃখ নিবারণার্থ অর্থোপার্জনের উদ্দেশ্যে কলিকাতাতে আগমন করেন। এই অবস্থায় তাঁহাকে দারিদ্রের সঙ্গে যে ঘোর সংগ্রাম করিতে হইয়াছিল, তাহার হৃদয়বিদারক বিবরণ এখানে দেওয়া নিষ্প্রয়োজন। এই বলিলেই যথেষ্ট হইবে যে, অনেক দিনের পর, অনেক ক্লেশ ভূগিয়া, অবশেষে একটি আট টাকা বেতনের কর্ম পাইয়াছিলেন। এই অবস্থাতে গোঘাটনিবাসী রামকান্ত তর্কবাগীশের দ্বিতীয়া কন্যা ভগবতী দেবীর সহিত ঠাকুরদাসের বিবাহ হয়, ঈশ্বরচন্দ্র তাঁহাদের প্রথম সন্তান।
ঈশ্বরচন্দ্রের ন্যায় তেজস্বিতা, মানসিক বল ও দৃঢ় প্রতিজ্ঞা সকলের সম্ভবে না। ঈশ্বরচন্দ্রের ন্যায় জগৎগ্রাহী সহৃদয়তা, বদান্যতা ও উপচিকীর্ষাও সকলের হইয়া উঠে না। কিন্তু তথাপি ঈশ্বরচন্দ্রের কথা স্মরণ করিয়া আমরা বোধ হয় একটু সোজা পথে চলিতে শিখিতে পারি,—একটু কর্তব্য অনুষ্ঠানে উদ্যম করিতে পারি; একটু ভণ্ডামি ত্যাগ করিতে পারি।

—রমেশচন্দ্র দত্ত



ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর আমাদের মধ্যে আর নাই, কিন্তু পুরুষানুক্রমে বঙ্গবাসীদিগের নিকট প্রাতঃস্মরণীয় হইয়া থাকিবেন। তিনি ইদানীন্তন বঙ্গ সাহিত্যের প্রণেতা, তিনি বঙ্গ সমাজের সংস্কার-কর্তা, তিনি হৃদয়ের ওজস্বিতা ও দাক্ষিণ্যগুণে জগতের একজন শিক্ষা গুরু। গুরু আজ পাঠশালা বন্ধ করিলেন, কিন্তু, তাঁহার কীর্তিমণ্ডিত চিত্রখানি ধ্যান করিয়া দুই-একটি বিষয়ে আজ শিক্ষালাভ করিব।

যাঁহাদিগের বয়ঃক্রম ৪০ বৎসর পার হইয়া গিয়াছে, আজ তাঁহারা নিজ শৈশবাবস্থার করা স্মরণ করিতেছেন। সে সময়ের বঙ্গ সমাজ অদ্যকার সমাজের মতো নহে, তখনকার সাহিত্য অদ্যকার সাহিত্যের ন্যায় নহে। প্রাচীনা গৃহিণীগণ অথবা দোকানী পসারী লোকে রামায়ণ মহাভারত পড়িতেন, যুবকগণ ভারতচন্দ্র আওড়াইতেন, শাক্তগণ রামপ্রসাদের গান গাহিতেন, নব্য সম্প্রদায় নিধুবাবুর টপ্পা গাহিতেন অথবা দাশু রায়ের ভক্ত ছিলেন। বৈষ্ণব পাঠক কেহ কেহ চৈতন্য-চরিতামৃতের পাতা উল্টাইতেন, শাক্ত পাঠক কেহ কেহ মুকুন্দরামের চণ্ডীখানি খুলিয়া দেখিতেন। এই ছিল বাঙ্গলা গদ্যের অবস্থা, সুমার্জিত বাঙ্গলা গদ্য তখনও সৃষ্ট হয় নাই।
vidyasagar.info ©