অধ্যক্ষের পদে প্রতিষ্ঠিত হইয়াই তিনি নানা প্রকার সংস্কারকার্যে হস্তার্পণ করেন। (১ম) প্রাচীন সংস্কৃত পুস্তকগুলির রক্ষণ ও মুদ্রণ; (২য়) ব্রাহ্মণ ও বৈদ্য ব্যতীত অন্য জাতির ছাত্রগণের জন্য কলেজের দ্বার উদ্ঘাটন; (৩য়) ছাত্রদিগের বেতনগ্রহণের রীতি প্রবর্তন, (৪র্থ) উপক্রমণিকা, ঋজুপাঠ প্রভৃতি সংস্কৃত শিক্ষার উপযোগী গ্রন্থাদি প্রণয়ন; (৫ম) ২ মাস গ্রীষ্মাবকাশপ্রথা প্রবর্তন; (৬ষ্ঠ) সংস্কৃতের সহিত ইংরাজী শিক্ষা প্রচলন।
—শিবনাথ শাস্ত্রী
এক্ষণে আমরা বঙ্গ সমাজের ইতিবৃত্তের যে যুগে প্রবেশ করিতেছি, তাহার প্রধান পুরুষ পণ্ডিতপ্রবর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। এককালে রামমোহন রায় যেমন শিক্ষিত ও অগ্রসর ব্যক্তিগণের অগ্রণী ও আদর্শ পুরুষরূপে দণ্ডায়মান ছিলেন এবং তাঁহার পদভারে বঙ্গ সমাজ কাঁপিয়া গিয়াছিল, এই যুগে বিদ্যাসাগর মহাশয় সেই স্থান অধিকার করিয়াছিলেন। মানব-চরিত্রের প্রভাব যে কি জিনিস, উগ্র-উৎকট-ব্যক্তিত্বসম্পন্ন তেজীয়ান পুরুষগণ ধনবলে হীন হইয়াও যে সমাজমধ্যে কিরূপ প্রতিষ্ঠা লাভ করিতে পারেন, তাহা আমরা বিদ্যাসাগর মহাশয়কে দেখিয়া জানিয়াছি। যে দরিদ্র ব্রাহ্মণের সন্তান, যাঁহার পিতার দশ-বারো টাকার অধিক আয় ছিল না, যিনি বাল্যকালে অধিকাংশ সময় অর্ধাশনে থাকিতেন, তিনি এক সময় নিজ তেজে সমগ্র বঙ্গ সমাজকে কিরূপ কাঁপাইয়া গিয়াছেন তাহা স্মরণ করিলে মন বিস্মিত ও স্তব্ধ হয়। তিনি এক সময় আমাকে বলিয়াছিলেন—“ভারতবর্ষে এমন রাজা নাই যাহার নাকে এই চটি জুতা সুদ্ধ পায়ে টক করিয়া লাথি না মারিতে পারি।” আমি তখন অনুভব করিয়াছিলাম, এবং এখনও অনুভব করিতেছি ষে, তিনি যাহা বলিয়াছিলেন তাহা সত্য। তাঁহার চরিত্রের তেজ এমনই ছিল যে, তাঁহার নিকট ক্ষমতাশালী রাজারাও নগণ্য ব্যক্তির মধ্যে।
বিদ্যাসাগর মহাশয় ১৮২০ সালে মেদিনীপুর জেলার অন্তঃপাতী বীরসিংহ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। যে ব্রাহ্মণকুলে তিনি জন্মিলেন, তাঁহারা গুণ-গৌরবে ও তেজস্বিতার জন্য সে প্রদেশে প্রসিদ্ধ ছিলেন। তাঁহার পিতামহ রামজয় তর্কভূষণ কোনও পারিবারিক বিবাদে উত্যক্ত হইয়া স্বীয় পত্মী দুর্গাদেবীকে পরিত্যাগপূর্বক কিছুকালের জন্য দেশান্তরী হইয়া গিয়াছিলেন। দুর্গাদেবী নিরাশ্রয় হইয়া বীরসিংহ গ্রামে স্বীয় পিতা উমাপতি তর্কসিদ্ধান্ত মহাশয়ের ভবনে আশ্রয় গ্রহণ করেন। জ্যেষ্ঠ পুত্র ঠাকুরদাস সেই সময় হইতে ঘোর দারিদ্র্যে বাস করিয়া জীবন-সংগ্রাম আরম্ভ করেন। তাঁহার বয়ঃক্রম যখন ১৫ বৎসর হইবে তখন জননীর দুঃখ নিবারণার্থ অর্থোপার্জনের উদ্দেশ্যে কলিকাতাতে আগমন করেন। এই অবস্থায় তাঁহাকে দারিদ্রের সঙ্গে যে ঘোর সংগ্রাম করিতে হইয়াছিল, তাহার হৃদয়বিদারক বিবরণ এখানে দেওয়া নিষ্প্রয়োজন। এই বলিলেই যথেষ্ট হইবে যে, অনেক দিনের পর, অনেক ক্লেশ ভূগিয়া, অবশেষে একটি আট টাকা বেতনের কর্ম পাইয়াছিলেন। এই অবস্থাতে গোঘাটনিবাসী রামকান্ত তর্কবাগীশের দ্বিতীয়া কন্যা ভগবতী দেবীর সহিত ঠাকুরদাসের বিবাহ হয়, ঈশ্বরচন্দ্র তাঁহাদের প্রথম সন্তান।
বিদ্যাসাগর মহাশয় শৈশবে কিয়ৎকাল গ্রাম্য পাঠশালাতে পড়িয়া পিতার সহিত কলিকাতাতে আসেন। কলিকাতাতে আসিয়া তাঁহার পিতার মনিব বড়বাজারের ভাগবত সিংহের ভবনে পিতার সহিত বাস করিতে আরম্ভ করেন। পিতা-পুত্রে রন্ধন করিয়া খাইতেন। অতি কষ্টে দিন যাইত। এই সময় ভাগবতচরণ সিংহের কনিষ্ঠা কন্যা রাইমণি তাঁহাকে পুত্রাধিক যত্ম করিতেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কোমল হৃদয় কোনোদিন সে উপকার বিস্মৃত হয় নাই। বৃদ্ধ বয়সেও রাইমণির কথা বলিতে দর দর ধারে তাঁহার চক্ষে জলধারা বহিত।
কলিকাতাতে আসিয়া কয়েক মাস পাঠশালে পড়িবার পর বিদ্যাসাগর মহাশয়ের পিতা তাঁহাকে কলিকাতা সংস্কৃত কলেজে ভর্তি করিয়া দেন। কলেজে পদার্পণ করিবামাত্র তাঁহার অসাধারণ প্রতিভা শিক্ষক ও ছাত্র সকলের গোচর হইল। ১৮২৯ সালের জুন মাসে তিনি ভর্তি হইলেন, ছয় মাসের মধ্যেই তিনি মাসিক ৫ টাকা বৃত্তি প্রাপ্ত হইলেন। সেই বৃত্তি সহায় করিয়া তিনি অধ্যয়ন করিতে লাগিলেন। ক্রমে কলেজের সমুদয় উচ্চবৃত্তি ও পুরস্কার লাভ করিলেন। সে সময়ে মফঃস্বলের ইংরাজ জজদিগের আদালতে এক-একজন জজ-পণ্ডিত থাকিতেন। হিন্দু ধর্মশাস্ত্র অনুসারে ব্যবস্থা দেওয়া তাঁহাদের কার্য ছিল। সংস্কৃত কলেজের উত্তীর্ণ ছাত্রগণ এ কাজ প্রাপ্ত হইতেন। তাহা একটা প্রলোভনের বিষয় ছিল। কিন্তু উক্ত কর্মপ্রার্থীদিগকে ল কমিটি নামক একটি কমিটির নিকট পরীক্ষা দিয়া কর্ম লইতে হইত। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বয়ঃক্রম যখন ১৭ বৎসরের অধিক হইবে না, তখন ল কমিটির পরীক্ষাতে উত্তীর্ণ হইয়া ত্রিপুরার জজ-পণ্ডিতের কর্ম প্রাপ্ত হন; কিন্তু পিতা ঠাকুরদাস অত দূরে যাইতে দিলেন না।
১৮৪১ সালে তিনি কলেজ হইতে উত্তীর্ণ হইয়া বিদ্যাসাগর উপাধি পাইয়া ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের প্রধান পণ্ডিতের পদ প্রাপ্ত হন। এই পদ প্রাপ্ত হওয়ার পর তিনি বাড়িতে বসিয়া ইংরাজী শিখিতে আরম্ভ করেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়কে সকলে সংস্কৃত পণ্ডিত বলিয়াই জানেন, কিন্তু তিনি ইংরাজীতে কিরূপ অভিজ্ঞ ছিলেন, কী সুন্দর ইংরাজী লিখিতে পারিতেন, তাহা অনেকে জানেন না; এমন কি, তাঁহার হাতের ইংরাজী লেখাটিও এমন সুন্দর ছিল যে, অনেক উন্নত উপাধিধারী ইংরাজীওয়ালাদের হাতের লেখাও তেমন সুন্দর নয়। এ সমুদয় তিনি নিজ চেষ্টা-যত্নে করিয়াছিলেন। তাঁহার আত্মোন্নতিসাধনের ইচ্ছা এরূপ প্রবল ছিল যে, তাঁহার সংস্পর্শে আসিয়া তাঁহার বন্ধুবান্ধব সকলেরই মনে এ ইচ্ছা সংক্রান্ত হইয়াছিল। তাঁহার দৃষ্টান্ত স্বরূপ দুইটি বিষয়ের উল্লেখ করা যাইতে পারে। বিদ্যাসাগর মহাশয় যখন ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে প্রতিষ্ঠিত, তখন তথাকার কেরানীর কর্মটি খালি হইলে, তাঁহারই চেষ্টাতে তাঁহার তদানীন্তন বন্ধু বাবু দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় সে কর্মটি প্রাপ্ত হন। দুর্গাচরণবাবু এ পদ প্রাপ্ত হইলেই বিদ্যাসাগর মহাশয় তাঁহাকে এ কর্মে থাকিয়া, মেডিকেল কলেজে ভর্তি হইয়া চিকিৎসা বিদ্যা অধ্যয়ন করিতে প্রবৃত্ত করেন। তাহাই দুর্গাচরণবাবুর সকল ভাবী উন্নতি ও প্রতিষ্ঠার কারণ। ইনি সুপ্রসিদ্ধ সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পিতা। এই সময়ে আর-এক বন্ধুর দ্বারা আর-এক কার্যের সূত্রপাত হয়। প্রেসিডেন্সি কলেজের সুপ্রসিদ্ধ ইংরাজী অধ্যাপক রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় অবসরকালে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের নিকট সংস্কৃত পড়িতে আরম্ভ করেন। তাঁহাকে সংস্কৃত শিখাইতে প্রবৃত্ত হইয়াই বিদ্যাসাগর মহাশয় অনুভব করিলেন যে, তাঁহারা যে প্রণালীতে সংস্কৃত শিখিয়াছিলেন, সে প্রণালীতে ইহাকে শিখাইলে চলিবে না, অনর্থক অনেক সময় যাইবে। সুতরাং নিজে চিন্তা করিয়া এক নূতন প্রণালীতে সংস্কৃত পড়াইতে আরম্ভ করিলেন। ইহা হইতেই তাঁহার উত্তরকালে রচিত উপক্রমণিকা ও ব্যাকরণ-কৌমুদী প্রভৃতির সূত্রপাত হইল।
১৮৪৬ সালে সংস্কৃত কলেজের এ্যাসিষ্ট্যান্ট সেক্রেটারির পদ শূন্য হইলে বিদ্যাসাগর মহাশয় এ পদ পাইলেন। কিন্তু উক্ত কলেজের অধ্যক্ষ রসময় দত্ত মহাশয়ের সহিত মতভেদ হওয়াতে দুই-এক বৎসরের মধ্যে এ পদ পরিত্যাগ করিতে হইল। ১৮৫০ সালের প্রারম্ভে দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের কেরানীগিরি কর্ম ত্যাগ করিয়া চিকিৎসা ব্যবসায় আরম্ভ করাতে, মার্শেল সাহেবের অনুরোধে, মাসিক ৮ টাকা বেতনে, বিদ্যাসাগর মহাশয় এ কর্ম গ্রহণ করেন। কিন্তু সে পদে তাহাকে অধিক দিন থাকিতে হয় নাই। এ সালেই তাঁহার বন্ধু মদনমোহন তর্কালঙ্কার মুর্শিদাবাদের জজ-পণ্ডিতের কর্ম পাইয়া চলিয়া যাওয়াতে সংস্কৃত কলেজের সাহিত্যাধ্যাপকের পদ শূন্য হইল। বিদ্যাসাগর মহাশয় এডুকেশন কাউন্সিলের সভাপতি মহাত্মা বেথুনের পরামর্শে এ পদ গ্রহণ করিলেন। সেই পদ হইতে ১৮৫১ সালের জানুয়ারি মাসে সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষের পদ প্রাপ্ত হন।
অধ্যক্ষের পদে প্রতিষ্ঠিত হইয়াই তিনি নানা প্রকার সংস্কারকার্যে হস্তার্পণ করেন। (১ম) প্রাচীন সংস্কৃত পুস্তকগুলির রক্ষণ ও মুদ্রণ; (২য়) ব্রাহ্মণ ও বৈদ্য ব্যতীত অন্য জাতির ছাত্রগণের জন্য কলেজের দ্বার উদ্ঘাটন; (৩য়) ছাত্রদিগের বেতনগ্রহণের রীতি প্রবর্তন, (৪র্থ) উপক্রমণিকা, ঋজুপাঠ প্রভৃতি সংস্কৃত শিক্ষার উপযোগী গ্রন্থাদি প্রণয়ন; (৫ম) ২ মাস গ্রীষ্মাবকাশপ্রথা প্রবর্তন; (৬ষ্ঠ) সংস্কৃতের সহিত ইংরাজী শিক্ষা প্রচলন। সংস্কৃত কলেজের শিক্ষাপ্রণালীর মধ্যে এই সকল পরিবর্তন সংঘটন করিতে বিদ্যসাগর মহাশয়কে যে কত চিন্তা ও কত শ্রম করিতে হইয়াছিল তাহা আমরা এখন কল্পনা করিতে পারি না। সেকালের লোকের মুখে তাঁহার শ্রমের কথা যাহা শুনিয়াছি, তাহা শুনিলে আশ্চর্যান্বিত হইতে হয়।
ইহার পর দিন-দিন তাঁহার পদবৃদ্ধি ও খ্যাতি-প্রতিপত্তি বাড়িতে লাগিল। ১৮৪৭ সালে তাঁহার “বেতাল পঞ্চবিংশতি” মুদ্রিত ও প্রচারিত হয়। “বেতাল” বঙ্গসাহিত্যে এক নবযুগের সূত্রপাত করিল। তৎপরে ১৮৪৮ সালে “বাঙ্গালার ইতিহাস”, ১৮৫০ সালে “জীবনচরিত”, ১৮৫১ সালে “বোধোদয়” ও “উপক্রমণিকা”, ১৮৫৫ সালে “শকুন্তলা” ও “বিধবা বিবাহ বিষয়ক প্রস্তাব” প্রকাশিত হইল। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের নাম আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সকলের নিকট পরিচিত হইল।
শিক্ষাবিভাগে ইন্স্পেক্টারের পদ সৃষ্ট হইলে বিদ্যাসাগর মহাশয় সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষের পদের উপরে নদীয়া, হুগলী, বর্ধমান ও মেদিনীপুরের ইন্স্পেক্টারের পদ প্রাপ্ত হন। একদিকে যখন তাঁহার পদ ও শ্রম বাড়িল, তখন অপরদিকে তিনি এক মহাব্রতে আত্মসমর্পণ করিলেন। সেই সালেই বিধবা-বিবাহ হিন্দুশাস্ত্রানুমোদিত ইহা প্রমাণ করিবার জন্য গ্রন্থ প্রচার করিলেন। বঙ্গদেশে আগুন জ্বলিয়া উঠিল। কিন্তু সমাজসংস্কারে এই তাঁহার প্রথম হস্তক্ষেপ নয়। ১৮৪৯ সালের মে মাসে বেথুন সাহেব যখন বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন, তখন বিদ্যাসাগর মহাশয় তাহার প্রথম সম্পাদক নিযুক্ত হন। তিনি ও তাঁহার বন্ধু মদনমোহন তর্কালঙ্কার বেথুনের পৃষ্ঠপোষক হইয়া দেশে স্ত্রীশিক্ষা প্রচলনকার্যে আপনাদের দেহমনপ্রাণ সমর্পণ করেন।
১৮৫৬ সাল বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ কাল। এই বৎসরে তাহার কার্যপটুতা যে কত তাহা জানিতে পারা গেল। একদিকে বিধবা-বিবাহের প্রতিপক্ষগণের আপত্তি খণ্ডনার্থ পুস্তক প্রণয়ন, বিধবা-বিবাহ প্রচলনার্থ রাজবিধি প্রণয়নের চেষ্টা, কার্যত বিধবা-বিবাহ দিবার আয়োজন, এই সকলে তাহাকে ব্যাপৃত হইতে হইল; অপরদিকে এই সময়েই শিক্ষাবিভাগের নবনিযুক্ত ডিরেক্টার মিস্টার গর্ডন ইয়ংয়ের সহিত তাঁঁহার ঘোরতর বিবাদ বাধিয়া গেল। এই বিবাদ প্রথমে জেলায়-জেলায় বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন লইয়া ঘটে। বিদ্যাসাগর মহাশয় নদীয়া, হুগলী, বর্ধমান ও মেদিনীপুর এই কয় জেলায় স্কুল ইন্স্পেক্টারের পদ প্রাপ্ত হইলেই, নানা স্থানে বালকদিগের শিক্ষার জন্য বিদ্যালয় স্থাপনের সঙ্গে সঙ্গে বালিকা বিদ্যালয় স্থাপনে প্রবৃত্ত হইলেন। তিনি মনে করিলেন এদেশে স্ত্রী-শিক্ষা প্রচলনের জন্য তাঁহার যে আন্তরিক ইচ্ছা ছিল, তাহা কিয়ৎ পরিমাণে কার্যে পরিণত করিবার সময় ও সুবিধা উপস্থিত। তিনি উৎসাহের সহিত তাঁহার সঙ্কল্প সাধনে অগ্রসর হইলেন। কিন্তু ইয়ং সাহেব, বালিকা বিদ্যালয় স্থাপনের জন্য গভর্মমেন্টের অর্থব্যয় করিতে অস্বীকৃত হইয়া, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের প্রেরিত বিল স্বাক্ষর করিলেন না। এই সঙ্কটে বিদ্যাসাগর লেফ্টেনান্ট গভর্নরের শরণাপন্ন হইলেন। সে যাত্রা তাঁহার মুখ রক্ষা হইল বটে, কিন্তু ডিরেক্টার তাঁহার প্রতি হাড়ে চটিয়া রহিলেন। কথায় কথায় মতভেদ ও বিবাদ হইতে লাগিল। এই বিবাদ ও উত্তেজনাতে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের চিত্ত এই বৎসরের অধিকাংশ সময় অতিশয় আন্দোলিত ছিল। কিন্তু কর্তৃপক্ষের বিবিধ চেষ্টা সত্ত্বেও এই বিবাদের মীমাংসা না হওয়ায় অবশেষে ১৮৫৮ সালে তাহাকে কর্ম পরিত্যাগ করিতে হয়।
এদিকে ১৮৫৬ সালের অগ্রহায়ণ মাসে তাঁহার অন্যতম বন্ধু শ্রীশচন্দ্র-বিদ্যারত্ব মহাশয় এক বিধবার পাণিগ্রহণ করিলেন। তাহাতে বঙ্গদেশে যে আন্দোলন উঠিল তাহার অনুরূপ জাতীয় আন্দোলন আমরা অল্পই দেখিয়াছি। ইতিপূর্বে শাস্ত্রানুসারে বিধবা-বিবাহের বৈধতা লইয়া যে বিচার চলিতেছিল তাহা পণ্ডিত ও শিক্ষিত ব্যক্তিদিগের মধ্যেই বদ্ধ ছিল। রাজবিধি প্রণয়নের চেষ্টা আরম্ভ হইলে, সেই আন্দোলন কিঞ্চিৎ পাকিয়া উঠিয়াছিল; কিন্তু বিদ্যাসাগর মহাশয় শাস্ত্রীয় বিচারে সন্তুষ্ট না থাকিয়া যখন কার্যত বিধবা-বিবাহ প্রচলনে প্রবৃত্ত হইলেন, তখন আপামর সাধারণ সকল লোকে একেবারে জাগিয়া উঠিল। পথে-ঘাটে, হাটে-বাজারে, মহিলা গোষ্ঠীতে এই কথা চলিল। শান্তিপুরের তাঁতীরা “বেঁচে থাক বিদ্যাসাগর চিরজীবী হয়ে”—এই গানাঙ্কিত কাপড় বাহির করিল। এমন কি, বিদ্যাসাগরের প্রাণের উপরেও লোকে হাত দিবে এরূপ আশঙ্কা বন্ধুবান্ধবের মনে উপস্থিত হইল।
এই সকল অবিশ্রান্ত পরিশ্রম ও সংগ্রামের মধ্যে যে কতিপয় বন্ধু বিদ্যাসাগর মহাশয়কে উৎসাহ ও হৃদয়ের অনুরাগদানে সবল করিয়াছিলেন তাহাদের মধ্যে (রামতনু) লাহিড়ী মহাশয় একজন।
সেপ্টেম্বর/অক্টোবর ১৯৬০ সালে প্রকাশিত।
কোন মন্তব্য নেই
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন