মোট পৃষ্ঠাদর্শন

    ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
        মাইকেল মধুসূদন দত্ত

  বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে।
  করুণার সিন্ধু তুমি, সেই জানে মনে,
  দীন যে, দীনের বন্ধু!—উজ্জ্বল জগতে
  হেমাদ্রির হেমকান্তি অম্লান কিরণে।
  কিন্তু ভাগ্যবলে পেয়ে সে মহা পর্বতে,
  যে জন আশ্রয় লয় সুবর্ণ চরণে,
  সেই জানে কত গুণ ধরে কত মতে
  গিরীশ। কি সেবা তার সে মুখ সদনে।—
  দানে বারি নদীরূপ বিমলা কিঙ্করী;
  যোগায় অমৃত ফল পরম আদরে
  তরুদল, দাসরূপ ধরি;
  পরিমলে ফুলকুল দশ দিশ ভরে;
  দিবসে শীতল শ্বাসী ছায়া, বনেশ্বরী,
  নিশার সুশান্ত নিদ্রা, ক্লান্তি দূর করে!

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

ঈশ্বরচন্দ্রের ন্যায় তেজস্বিতা, মানসিক বল ও দৃঢ় প্রতিজ্ঞা সকলের সম্ভবে না। ঈশ্বরচন্দ্রের ন্যায় জগৎগ্রাহী সহৃদয়তা, বদান্যতা ও উপচিকীর্ষাও সকলের হইয়া উঠে না। কিন্তু তথাপি ঈশ্বরচন্দ্রের কথা স্মরণ করিয়া আমরা বোধ হয় একটু সোজা পথে চলিতে শিখিতে পারি,—একটু কর্তব্য অনুষ্ঠানে উদ্যম করিতে পারি; একটু ভণ্ডামি ত্যাগ করিতে পারি।

—রমেশচন্দ্র দত্ত



ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর আমাদের মধ্যে আর নাই, কিন্তু পুরুষানুক্রমে বঙ্গবাসীদিগের নিকট প্রাতঃস্মরণীয় হইয়া থাকিবেন। তিনি ইদানীন্তন বঙ্গ সাহিত্যের প্রণেতা, তিনি বঙ্গ সমাজের সংস্কার-কর্তা, তিনি হৃদয়ের ওজস্বিতা ও দাক্ষিণ্যগুণে জগতের একজন শিক্ষা গুরু। গুরু আজ পাঠশালা বন্ধ করিলেন, কিন্তু, তাঁহার কীর্তিমণ্ডিত চিত্রখানি ধ্যান করিয়া দুই-একটি বিষয়ে আজ শিক্ষালাভ করিব।

যাঁহাদিগের বয়ঃক্রম ৪০ বৎসর পার হইয়া গিয়াছে, আজ তাঁহারা নিজ শৈশবাবস্থার করা স্মরণ করিতেছেন। সে সময়ের বঙ্গ সমাজ অদ্যকার সমাজের মতো নহে, তখনকার সাহিত্য অদ্যকার সাহিত্যের ন্যায় নহে। প্রাচীনা গৃহিণীগণ অথবা দোকানী পসারী লোকে রামায়ণ মহাভারত পড়িতেন, যুবকগণ ভারতচন্দ্র আওড়াইতেন, শাক্তগণ রামপ্রসাদের গান গাহিতেন, নব্য সম্প্রদায় নিধুবাবুর টপ্পা গাহিতেন অথবা দাশু রায়ের ভক্ত ছিলেন। বৈষ্ণব পাঠক কেহ কেহ চৈতন্য-চরিতামৃতের পাতা উল্টাইতেন, শাক্ত পাঠক কেহ কেহ মুকুন্দরামের চণ্ডীখানি খুলিয়া দেখিতেন। এই ছিল বাঙ্গলা গদ্যের অবস্থা, সুমার্জিত বাঙ্গলা গদ্য তখনও সৃষ্ট হয় নাই।

এইরূপ কালে ক্ষণজন্মা ঈশ্বরচন্দ্র বঙ্গভূমিতে অবতীর্ণ হইলেন। তাঁহার সহস্র সদ্‌গুণের মধ্যে ওজস্থিতা এবং দৃঢ় প্রতিজ্ঞতাই সর্বপ্রধান গুণ। যেটি কর্তব্য সেটি অনুষ্ঠান করিব, যেটি অনুষ্ঠান করিব সেটি সাধন করিব, এই ঈশ্বরচন্দ্রের হৃদয়ের সঙ্কল্প। সমস্ত সমাজ যদি বাধা দিবার চেষ্টা করে সিংহবীর্য ঈশ্বরচন্দ্রর সে সমাজব্যূহ ভেদ করিয়া তাঁহার অলঙ্ঘনীয় সঙ্কল্প সাধন করেন। ঈশ্বরচন্দ্র আজি আমাদের এই চরম শিক্ষা দান করিতেছেন, এই শিক্ষা যদি আমরা লাভ করিতে পারি, তবে আমাদের ভবিষ্যৎ আমাদের হস্তে, পরের হস্তে নহে।

ঈশ্বরচন্দ্র দেখিলেন, বঙ্গভাষায় সুমার্জিত নির্মল হৃদয়গ্রাহী গদ্যগ্রন্থ নাই। ক্ষণজন্মা বিদ্যাসাগর স্বহস্তে তাহার সৃষ্টি করিলেন, সংস্কৃত ভাষার অমূল্য ভাণ্ডার হইতে সুন্দর সুন্দর পবিত্র গল্প ও পবিত্র ভাব নির্বাচন করিলেন, সংস্কৃতরূপ মাতৃভাষার সাহায্যে নূতন বাঙ্গলা ভাষায় সেই গল্প ও সেই ভাব প্রকাশ করিলেন, নিজের হৃদয়গুণে, নিজের প্রতিভাবলে সেই গল্পগুলি মনোহর ও হৃদয়গ্রাহী করিয়া তুলিয়া বঙ্গ-সাহিত্য-ভাণ্ডারের উচ্চতম স্থানে স্থাপন করিলেন। বেতাল পঞ্চবিংশতি, শকুন্তলা ও সীতার বনবাস, কোন বাঙ্গালী ভদ্রমহিলা এই পুস্তকগুলি পড়িয়া চক্ষুর জল না বর্ষণ করিয়াছেন? কোন সহৃদয় বাঙ্গালী অদ্যাবধি যত্ন সহকারে না পাঠ করেন? ঈশ্বরচন্দ্রের একটি সঙ্কল্প সাধিত হইল,—নির্মল সুমার্জিত বাঙ্গলা গদ্যের সৃষ্টি হইল। ইহাতেই বিদ্যাসাগর নিরস্ত রহিলেন না। আপনি যে পথে গিয়াছেন, প্রতিভাসম্পন্ন স্বদেশবাসীগণকে সেই পথে লইবার আয়োজন করিতে লাগিলেন। সংস্কৃত না শিখিলে বাঙ্গলা ভাষার ও বাঙ্গলা গদ্যের উন্নতি নাই। কিন্তু সংস্কৃত কে শিখায়, কে শিখে? টোলে পড়িতে গেলে অর্ধেক জীবন তথায় যাপন করিতে হয়,—তখনকার পণ্ডিতগণ বলিতেন, এরূপ না করিলে সংস্কৃত শিক্ষা হয় না। তবে কি শিক্ষিত হিন্দুগণ চিরকাল এ পবিত্র ভাষায় বঞ্চিত থাকিবে? তবে কি হিন্দুগণের পবিত্র রত্মরাজি ও অনন্ত ভাণ্ডার হিন্দুদিগের চিরকাল অবিদিত থাকিবে? তবে কি হিন্দুজাতির গৌরবস্বরূপ সংস্কৃত সাহিত্য কেবল অল্পসংখ্যক লোকের একচেটিয়া ধন হইয়া থাকিবে?

বিদ্যাসাগর চিন্তা করিলেন, বিদ্যাসাগর উপায় উদ্ভাবন করিলেন, বিদ্যাসাগর কার্য সম্পন্ন করিলেন। সংস্কৃত শিক্ষা একচেটিয়া উঠিয়া গেল, সহস্র দেশানুরাগী যুবক বিদ্যাসাগর মহাশয়ের উদ্ভাবিত সরল প্রণালী দ্বারা সংস্কৃত সাহিত্যের মধুরতা আস্বাদন করিল, প্রাচীন গ্রন্থের, প্রাচীন রীতির, প্রাচীন ধর্মের মাহাত্ম্য ও পবিত্রতা অনুভব করিল। ফলে আদি হিন্দুসমাজ সেই প্রাচীন পবিত্রতার দিকে ধাবিত হইতে চলিল। স্বার্থপর লোকের কি এ সমস্ত গায়ে সহে? হিন্দুধর্মের ভণ্ডামি করিয়া যাহারা পয়সা আদায় করে, তাহারা সনাতন হিন্দুধর্মের দ্বার উদ্‌ঘাটিত দেখিয়া হতাশ হইয়া পড়িয়াছে। আবার দ্বার রুদ্ধ কর,—আবার শিক্ষিত দেশহিতৈষীদিগকে প্রাচীন শাস্ত্র-ভাণ্ডার হইতে বঞ্চিত কর, আবার স্বার্থপরদিগকে সেই ভাণ্ডারের প্রহরী স্বরূপ স্থাপন কর, তাহা হইলে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কার্য নষ্ট হয়। কিন্তু ভাণ্ডারীদিগের মনস্কামনা সিদ্ধ হয়। প্রকৃত হিন্দুধর্ম লোপ হইয়া উপধর্মের অন্ধকারে দেশ পুনরায় আবৃত হয়, তাহাতে হানি কি? ভাণ্ডারীদিগের পয়সা আদায়ের উপায় হয়।

বৃথা আশা! জ্ঞান-ভাণ্ডারের দ্বার উদ্‌ঘাটিত হইয়াছে, হিন্দুজাতি আপনাদিগের প্রাচীন সাহিত্য, প্রাচীন বিজ্ঞান, প্রাচীন ধর্ম পুনরায় চিনিতে পারিয়াছে, তাহারা সে-ধনে আর বঞ্চিত হইবে না।

তাহার পর? তাহার পর—বিদ্যাসাগর মহাশয় সামাজিক উন্নতিসাধনে কৃতসঙ্কল্প হইলেন। নির্জীব জাতির সামাজিক উন্নতি সাধন করা কত কষ্টসাধ্য, তাহা আমরা অদ্যাবধি পদে পদে দেখিতে পাইতেছি। হিন্দুনারীদিগের অবস্থার উন্নতি সাধন করাতে স্বার্থপর পুরুষে কত বাধা দেয়, তাহা আমরা আধুনিক ঘটনা হইতে দেখিতে পাইতেছি। যাঁহারা নিজে আর্যসন্তান বলিয়া দর্প করেন, তাঁহারাই বাল্য-বিবাহ, বিধবার চিরবৈধব্য প্রভৃতি অনার্য প্রথাগুলি সমর্থন করিতে কুণ্ঠিত হয়েন না। যাঁহারা নিজে হিন্দুয়ানির গর্ব করেন, তাঁহারাই রমণীগণকে অশিক্ষিত রাখা ও দাসীর ন্যায় ব্যবহার করা প্রভৃতি অহিন্দু আচারগুলির অনুষ্ঠান করিয়া থাকেন। এ সমস্ত কুপ্রথা ও কুতর্কের একমাত্র ঔষধি আছে;—এ সমস্ত অহিন্দু আচার প্রতিবিধান করিবার একমাত্র উপায় আছে;—সে ঔষধি ও সে উপায়,—প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্য ও প্রাচীন ধর্মগ্রন্থের আলোচনা।

অদ্যাবধি যদি কুসংস্কারের এরূপ বল থাকে, তাহা হইলে ত্রিংশৎ বৎসর পূর্বে ইহার কিরূপ বল ছিল, সহজে অনুভব করা যায়। সামান্য লোকে এরূপ অবস্থায় হতাশ হইত,—কৃতসঙ্কল্প ঈশ্বরচন্দ্র হইবার লোক ছিলেন না। একদিকে স্বার্থপরতা, জড়তা, মূর্খতা ও ভণ্ডামি, অন্যদিকে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। একদিকে বিধবাদিগের উপর সমাজের অত্যাচার, পুরুষের হৃদয়শূণ্যতা, নির্জীব জাতির নিশ্চলতা,—অন্যদিকে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। একদিকে শত শত বৎসরের কুসংস্কার ও কুরীতির বল, উপধর্মের উৎপীড়ন, অপ্রকৃত হিন্দুধর্মের গণ্ডমূর্খ ও স্বার্থপর ভট্টাচার্যদিগের মত, অন্যদিকে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। একদিকে নির্জীব, নিশ্চল, তেজোহীন বঙ্গ সমাজ, অন্যদিকে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।

আমাদিগের নির্জীব বঙ্গ সমাজে এরূপ ব্যাপার বড় অধিক দেখা যায় নাই,—পবিত্রনামা রামমোহনের সময়ের পর এরূপ তীব্র যুদ্ধ, এরূপ সামাজিক দ্বন্দ্ব, এরূপ সঙ্কল্প, এরূপ অনুষ্ঠান, এরূপ সিংহবীর্য বড় দেখা যায় নাই। পুরুষসিংহের সম্মুখে সমাজের মূর্খতা, জড়তা ও স্বার্থপরতা হাটিয়া গেল, সামাজিক যোদ্ধা অসি হস্তে পথ পরিষ্কার করিয়া বিধবা-বিবাহ সম্বন্ধে আইন জারি করাইলেন; বিদ্যাসাগরের গৌরবে দেশ পূর্ণ হইল, বিদ্যাসাগরের বিজয়লাভে প্রকৃত হিন্দুসমাজ উপকৃত হইল।

আর একটি মহৎ কার্যে ঈশ্বরচন্দ্র হস্তক্ষেপে করেন। আমাদের প্রাচীন হিন্দুশাস্ত্র অনুসারে সন্তানাদি না হইলে দ্বিতীয় দারপরিগ্রহের বিধান আছে, নচেৎ ইচ্ছানুসারে বহু বিবাহ নিষিদ্ধ। কিন্তু মনুষ্যদেহের সৌন্দর্য, বল, তেজ ও গৌরব সমস্তই যেরূপ মৃত্যুর পর লোপ প্রাপ্ত হয় এবং অবয়বখানি বিকৃত ও পুতিগন্ধে পূর্ণ হয়, জাতীয় জীবন লোপ হইলে জাতীয় ধর্মও সেইরূপ সৌন্দর্য, পবিত্রতা ও উপকারিতা হারাইয়া নানারূপ জঘন্য আচার-ব্যবহারে পরিবৃত হয়। দ্বিতীয় দারপরিগ্রহের কারণ ও আবশ্যকতা বিস্মৃত হইয়া এখনকার স্বার্থপর, বিশাল লালসাপরায়ণ পুরুষগণ ইচ্ছানুসারে বহু বিবাহ করাই হিন্দু আচার বলিয়া স্থির করিয়াছেন, এবং ভণ্ড ধর্মব্যবসায়ীগণ এই কুপ্রথাই ধর্ম বলিয়া প্রচার করিতেছেন। এইরূপেই আমাদের দেশের, আমাদের জাতির, আমাদের ধর্মের সর্বনাশ হইয়াছে। বিদ্যাসাগর মহাশয় আইনদ্বারা বহু বিবাহ প্রথা নিষিদ্ধ করিবার প্রয়াস পাইলেন, কিন্তু তাহাতে বিফল-প্রযত্ম হইলেন। আমাদিগের বিদেশীয় রাজা সত্যই বলিলেন, “যদি তোমাদের সামাজিক কোনও কুপ্রথা উঠাইবার ইচ্ছা থাকে, সমাজ সে বিষয়ে যত্ম করুক, আমরা তাহাতে হস্তক্ষেপ করিতে ইচ্ছা করি না। কেবল দণ্ডনীয় অপরাধমাত্র আমরা নিষেধ করিতে পারি। রাজা এবাক্য প্রতিপালন করিয়াছেন। পাশব অপরাধ দুই-একটি আইনদ্বারা নিষেধ করিয়াছেন, নচেৎ সামাজিক আচার-বাবহারে হস্তক্ষেপ করেন নাই।”

ইহার পর বিদ্যাসাগর মহাশয়ের শরীর ক্রমশঃ হীনবল হইতে লাগিল। আমি ইতিপূর্বে মধ্যে মধ্যে তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া আপনাকে কৃতার্থ জ্ঞান করিতাম। পরে আজি ছয় বৎসর হইল যখন রাজকীয় কার্য হইতে অবসর লইয়া কলিকাতায় কিছুদিন বাস করিয়া ঋগ্বেদসংহিতার অনুবাদ আরম্ভ করি, তখন সর্বদাই বিদ্যাসাগর মহাশয়ের নিকট উপদেশ লইতে যাইতাম। এই সূত্রে তাঁহার সহিত বিশেষ পরিচয় হইল। বলা বাহুল্য যে, তাঁহার উদারতা, তাঁহার সহৃদয়তা, তাঁহার প্রকৃত দেশহিতৈষিতা ও তাঁহার প্রকৃত হিন্দুযোগ্য সমদর্শিতা যতই দেখিতে লাগিলাম, ততই বিস্মিত ও আনন্দিত হইতে লাগিলাম। তাঁহার সুন্দর পুস্তকালয় তিনি আমাকে দেখাইলেন, তাঁহার সংস্কৃত পুঁথিগুলি বসিয়া বসিয়া ঘাঁটিতাম। অনেক বিষয়ে—সন্দেহ হইলে তাঁহার নিকট উপদেশ চাহিতাম। বাঙ্গালী মাত্র ঋগ্বেদের অনুবাদ পড়িবে, একথা শুনিয়া যাহারা হিন্দুধর্মের দোহাই দিয়া পয়সা আদায় করে, তাহাদের মাথায় বজ্রাঘাত পড়িল। ধর্মব্যাপারীগণ ঋগ্বেদের অচিন্তিত অবমাননা ও সর্বনাশ বলিয়া গলাবাজি করিতে লাগিল,—গলাবাজিতে পয়সা আসে! ধর্মের দোকানদারগণ অনুবাদ ও অনুবাদককে যথেষ্ট গালিবর্ষণ করিতে লাগিল, গালিবর্ষণে পয়সা আসে! এ সময়ে বিদ্যাসাগর মহাশয় আমাকে যে কথাগুলি বলিলেন, তাহা আমি কদাচ বিস্মৃত হইব না। তিনি বলিলেন, “ভাই, উত্তম কাজে হাত দিয়াছ, কাজটি সম্পন্ন কর। যদি আমার শরীর একটু ভাল থাকে, যদি আমি কোনোরূপে পারি, তোমাকে সাহায্য করিব।” পাঠকগণ, প্রকৃত হিন্দুয়ানি ও হিন্দুধর্ম লইয়া ভণ্ডামির বিভিন্নতা দেখিতে পাইলেন? নিঃস্বার্থ দেশোপকার এবং দেশের নাম লইয়া পয়সা উপায়ের মধ্যে প্রভেদ বুঝিতে পারিলেন? সর্বসাধারণকে প্রকৃত হিন্দুশাস্ত্রে দীক্ষিত করা, এবং হিন্দুশাস্ত্র সিন্দুকে বন্ধ করিয়া রাখিয়া তাহার নাম লইয়া রোজগারের উপায় উদ্ভাবন করার মধ্যে কি বিভিন্নতা অবগত হইলেন?

আজি সে মহাপ্রাণ হিন্দু-অবতার ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর আর নাই,—সমস্ত দেশের লোকে তাঁহার জন্য রোদন করিতেছে, তাঁহার জন্মস্থান মেদিনীপুর জেলা হইতে আমিও একবিন্দু অশ্রুবারি মোচন করিলাম। কিন্তু আমাদের রোদন যদি অশ্রুবিন্দুতেই শেষ হয়, তাহা হইলে আমরা বিদ্যাসাগরের নাম উচ্চারণ করিতেও অযোগ্য। তাঁহার জীবন হইতে কি কোনো শিক্ষালাভ করিতে পারি না? তাঁহার কার্য-পরম্পরা আলোচনা করিয়া কি কোনে উপকার লাভ করিতে পারি না?

ঈশ্বরচন্দ্রের ন্যায় বিদ্যাবুদ্ধি সকলের ঘটে না। ঈশ্বরচন্দ্রের ন্যায় তেজস্বিতা, মানসিক বল ও দৃঢ় প্রতিজ্ঞা সকলের সম্ভবে না। ঈশ্বরচন্দ্রের ন্যায় জগৎগ্রাহী সহৃদয়তা, বদান্যতা ও উপচিকীর্ষাও সকলের হইয়া উঠে না। কিন্তু তথাপি ঈশ্বরচন্দ্রের কথা স্মরণ করিয়া আমরা বোধ হয় একটু সোজা পথে চলিতে শিখিতে পারি,—একটু কর্তব্য অনুষ্ঠানে উদ্যম করিতে পারি; একটু ভণ্ডামি ত্যাগ করিতে পারি। যেটি সমাজের উপকারী, যেটি প্রাচীন হিন্দুধর্মের অভিমত সে প্রথাটি যেন ক্রমে ক্রমে অবলম্বন করিতে শিখি। যেটি সমাজের অপকারক, যেটি হিন্দুধর্মের অনভিমত, সে প্রথা যেন ক্রমে ক্রমে বর্জন করিতে শিখি। প্রাচীন শাস্ত্রে ও সনাতন হিন্দুধর্ম যেন আস্থা হয়। উপনিষদাদি প্রাতঃস্মরণীয় গ্রন্থপাঠে যেন অনাদি অনন্ত ব্রহ্মের পূজা দেশে প্রচারিত হয়,—প্রস্তর ও মৃত্তিকার পূজা যেন বিলুপ্ত হয়। আর্যসন্তানগণ যেন প্রাচীন আর্যের ন্যায় নিজের দেবকে স্মরণ করিয়া নিজে আহুতি দিতে শিখেন,—ধর্মানুষ্ঠানে কালীঘাটের পাণ্ডাকে মোক্তারনামা দিবার আবশ্যক নাই। এবং মনুর সন্তানগণ যেন মনুর আদেশ অনুসারে নারীকে সম্মান দিতে শিখেন, যোগ্য বয়সে কন্যার বিবাহ দেন, অল্পবয়স্কা বিধবার পুনরুদ্বার প্রথা প্রচলিত করেন, বহু বিবাহ প্রথা বর্জন করেন এবং পাশব আচরণ বিস্মৃত হইয়া মনু-সন্তানের নামের যোগ্য হয়েন। হত্যা, সুুরাপান, চৌর্য, পরস্ত্রীগমন এবং পাপীর সংসর্গ, এইগুলি মনুর মতে মহাপাতক। এই দোষের জন্য যদি সমাজ দোষীকে দণ্ডিত করিতে শিখেন, তবেই সমাজ আর্য নামের যোগ্য হইবে, এবং ক্রমশঃ উন্নতি লাভ করিবে।

সমাজ কাহাকে বলে? মনুষ্য জড় হইয়াই সমাজ হয়। যদি আমরা প্রত্যেকে একটু করিয়া সৎপথে যাইতে প্রয়াস করি, ভণ্ডামির কথা না শুনি, অসৎকার্যে বিমুখ হই, তাহা হইলে সমাজ উন্নতির পথে চলিবে। সেদিন রথযাত্রা হইয়া গিয়াছে। প্রকাণ্ড রথ, তাহাকে টানে মনুষ্যের সাধ্য নাই, কিন্তু শত শত লোকে দড়ি ধরিল, সকলে একটু একটু করিয়া টানিল, রথ হড়-হড় করিয়া চলিল। আমরা সকলে যদি আমাদের ক্ষুদ্র বল ও ক্ষুদ্র বুদ্ধি প্রয়োগ করিয়া হিন্দুসমাজকে সনাতন প্রশস্ত পথে চালিত করি, সমাজ সেদিকে চলিবে। যদি আমরা সেটুকুও না করিতে জানি, তবে আমাদের শিক্ষা বৃথা, আমাদের হিন্দু নামে অভিমান বৃথা, এবং প্রাতঃস্মরণীয় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বৃথাই আমাদিগের মধ্যে জন্মধারণ করিয়া আজীবন আমাদিগের জন্য শ্রম করিয়া গিয়াছেন।

সেপ্টেম্বর/অক্টোবর ১৯৬০ সালে প্রকাশিত।


কোন মন্তব্য নেই

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

vidyasagar.info ©