—গোপা দত্তভৌমিক
বিদ্যাসাগরের কর্মমুখর জীবনের অজস্র তরঙ্গভঙ্গের মধ্যে কোন কাজটিকে সর্বাপেক্ষা প্রাধান্য দেওয়া যাবে তা নিয়ে বিস্তর মতভেদ আছে। সমাজ সংস্কার, শিক্ষা সংস্কার, ভাষা ও সাহিত্য— কোনওটিই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। দানধ্যানের কথা নাহয় আপাতত থাক। বিদ্যাসাগর নিজে কিন্তু স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ‘বিধবাবিবাহ প্রবর্ত্তন আমার জীবনের সর্ব্বপ্রধান সৎকর্ম্ম।’১ আজকাল অনেকে মনে করছেন বিধবাবিবাহ প্রবর্তনের জন্য এতটা পরিশ্রম ও কষ্টস্বীকার না করে তিনি যদি সাহিত্য চর্চায় সেই সময় ও অধ্যবসায় ব্যয় করতেন তবে চিরস্থায়ী কিছু ফল হত। অর্থাৎ এঁরা মনে করেন কালের গতিতে হিন্দু বিধবাদের বিয়ে একদিন প্রচলিত হতই— এত চাপাচাপি এবং আন্দোলনের দরকার ছিল না। বিশেষত এই কাজ করতে গিয়ে বিদ্যাসাগর রক্ষণশীল সমাজের বিরাগভাজন হন, আর্থিক দিকে নিঃস্ব হয়ে পড়েন এবং যাঁদের উপর ভরসা রেখেছিলেন তাঁরা কার্যকরী সাহায্য না করে সরে দাঁড়ানোতে বঙ্গসমাজের উপর তিনি আস্থা হারিয়ে ফেলেন। এককথায় শেষজীবনে যে তিনি শহর থেকে দূরে বিষণ্ণ এক প্রান্তিক জীবনে নিজেকে সরিয়ে নিলেন তার প্রধান কারণ বিধবাবিবাহ নিয়ে তাঁর প্রাণপণ আন্দোলন। এই ধারণা খুবই সরলীকৃত এবং বিদ্যাসাগর ও বঙ্গসমাজের পারস্পরিক সম্পর্কের লঘু বিচার। বিদ্যাসাগর কেন ‘বিধবাবিবাহ প্রবর্ত্তন’ তাঁর ‘সর্ব্বপ্রধান সৎকর্ম্ম’ বলে বিবেচনা করেছেন সেটি প্রথমত ভেবে দেখা দরকার। তিনিই যে বঙ্গসমাজে বিধবাবিবাহের কথা প্রথম বললেন এমনটা নয়। বস্তুত এই নিয়ে একটা চিন্তাভাবনা অষ্টাদশ শতক থেকেই ছিল। অদ্ভুত এক সমাপতন যে বিধবাবিবাহ আইন পাস (১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দ) হওয়ার ঠিক একশো বছর আগে ঢাকার নায়েব রাজবল্লভ সেন নিজের ছোট মেয়ে অভয়ার অকালবৈধব্যে ব্যথিত হয়ে বিধবাবিবাহের প্রচলন করার চেষ্টা করেন। তাঁর তিনজন দ্বার-পণ্ডিত কৃষ্ণদাস বেদান্তবাগীশ, নীলকণ্ঠ সার্বভৌম এবং কৃষ্ণদেব বিদ্যাবাগীশ জানিয়েছিলেন অক্ষতযোনি বিধবাদের পুনর্বিবাহে হিন্দুশাস্ত্রে কোনও নিষেধ নেই। রাজবল্লভ শুধু এঁদের কথার উপর নির্ভর করে মেয়ের বিয়ে দিতে ভরসা পেলেন না। তিনি কাশী, কাঞ্চী, মিথিলার পণ্ডিতদের কাছ থেকে অনুকূল মত আনালেন। কিন্তু তাঁর প্রয়াস ব্যর্থ হল নবদ্বীপে। নবদ্বীপের পণ্ডিতসমাজ চিরকালই রক্ষণশীল। চৈতন্যদেব ও তাঁর প্রেমভক্তিধর্মকেও তাঁরা সমকালে সুনজরে দেখেননি। তার উপর মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র তখন হিন্দুসমাজের মাথা। তিনি কীভাবে বাধা দিয়েছিলেন তা নিয়ে একটি কিংবদন্তি আছে। বিধবাবিবাহের প্রস্তাব নিয়ে রাজবল্লভের লোক আসার পর কৃষ্ণচন্দ্র তাঁদের যথাবিধি ভোজ্যের সঙ্গে একটি বাছুরও পাঠালেন। কারণ হিসেবে বলা হল বিধবাবিবাহ বহুকাল যাবৎ অপ্রচলিত আছে তা প্রচলিত হতে পারলে শাস্ত্রানুসারে গোমাংস ভক্ষণেও আপত্তি হতে পারে না।২ এরপর হিন্দুসমাজে আর কারও এগোবার সাহস হবে না বলা বাহুল্য। বিধবাবিবাহ নিয়ে অষ্টাদশ শতকে কেমন মনোভাব প্রচলিত ছিল ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের অন্নদামঙ্গল-এ তার একটি পরিচয় আছে। বাদশা জাহাঙ্গীর ও কৃষ্ণচন্দ্রের পূর্বপুরুষ ভবানন্দ মজুমদারের সম্পূর্ণ কাল্পনিক কথোপকথনে বিষয়টি এসেছে। এটি ধর্মাচার সম্বন্ধে মুসলমান শাসনের শেষপ্রহরে ইসলামি ও হিন্দু দুই বিরোধী পক্ষের ভারতাশ্রীয় ডিসকোর্স। জাহাঙ্গীর বিধবাদের বিষয়ে হিন্দুসমাজের আচারকে ধিক্কার দিলেন,
নিকা নাহি দিয়া রাঁঢ় করি রাখে তায়॥
ফল হেতু ফুল তার মাসে মাসে ফুটে।
বীজ বিনা নষ্ট হয় সে পাপ কি ছুটে॥
ভবানন্দের পালটা উত্তরে স্পষ্ট হয়ে যায় নিষ্ঠাবান উচ্চবর্ণের হিন্দুর কাছে কতটা অরুচিকর, বিতৃষ্ণাময় বৈধব্যের পর নারীর আবার বিবাহের ব্যাপারটি। উপমাটি অভূতপূর্ব কুৎসিত।
একে ছাড়ি গাই যেন ধরে আর ষাঁড়॥৩
রাজবল্লভ ব্যর্থ হলেও বোঝা যায় বালবিধবাদের নিদারুণ অবস্থার একটি প্রতিকারের ইচ্ছা অষ্টাদশ শতাব্দী থেকেই দেখা দিয়েছিল। কোটার রাজাও এই ব্যাপারে চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। ঊনবিংশ শতাব্দীতে রামমোহন রায়ের পদাঙ্কে ও প্রেরণায় আলোচনা আবার শুরু হল। রামমোহন রায় ‘আত্মীয় সভা’ স্থাপন করেন ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে। বাল্যবিবাহ ও বাল্যবৈধব্য নিয়ে এই সভায় আলোচনা হত। ডিরোজিয়ো তাঁর ছাত্রশিষ্যদের নিয়ে যে ‘অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন’ গঠন করেন সেখানেও এইসব সামাজিক কুপ্রথা নিয়ে তর্কবিতর্ক হত। বিদ্যাসাগর তখন সংস্কৃত কলেজে পড়ছেন। ইন্ডিয়ান ল’ কমিশন বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করেন। শিশুহত্যা প্রথার মূল অনুসন্ধান করতে গিয়ে তাঁরা সমস্যাটির মুখোমুখি হন। ল’ কমিশনের সেক্রেটারি জে.পি. গ্রান্ট ১৮৩৭ সালে কলকাতা, এলাহাবাদ, মাদ্রাজ প্রভৃতি অঞ্চলের সদর আদালতের বিচারকদের কাছে হিন্দু বিধবাদের পুনর্বিবাহের জন্য আইন পাস করা উচিত হবে কি না সেই বিষয়ে মতামত জানতে চান। প্রত্যেকেই প্রায় আইন পাস করার বিপক্ষে ছিলেন। এই পুনর্বিবাহ না থাকার ফলে সমাজে নানা দুর্নীতি দেখা দিচ্ছে সেই বিষয়ে অবহিত হয়েও তাঁরা হিন্দুদের ধর্মীয় চেতনায় আঘাত লাগার ভয় করেছিলেন। বিদ্যাসাগরও পরে বারবার ব্যভিচার, গর্ভপাত, ভ্রূণহত্যার মতো পাপের কথা বলতেন। ইংরেজ বিচারকরা হিন্দু উত্তরাধিকার আইন নিয়েও চিন্তিত ছিলেন। তবে মাদ্রাজের কোর্ট সেন্ট জর্জ সদর আদালতের রেজিস্ট্রার ডবলিউ ডগলাস হিন্দুসমাজ সম্বন্ধে যে পর্যবেক্ষণ ব্যক্ত করেছেন তা এই দেশের জনমন বিষয়ে তাঁর গভীর জ্ঞানের পরিচয় দেয়। উচ্চবর্ণের হিন্দুর অহমিকায় ঠিক কোথায় আঘাত লাগবে ডগলাস যথার্থ ধরেছিলেন।
ভারতের হিন্দুদের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল, দেশাচার ও সামাজিক প্রথার প্রতি অন্ধ আনুগত্য। তাতে হস্তক্ষেপ করলে তাদের বিরাগভাজন হতে হবে। বিধবাদের পুনর্বিবাহপ্রথা হিন্দুসমাজের নিম্নবর্ণের লোকদের মধ্যে প্রচলিত আছে। সাধারণত উচ্চবর্ণের হিন্দুসমাজেই এই প্রথা নিষিদ্ধ দেখা যায়। সুতরাং আইনের জোরে এই পুনর্বিবাহপ্রথা প্রবর্তনের চেষ্টা করলে উচ্চবর্ণের হিন্দুরা মনে করতে পারেন যে ভিন্নধর্মী বিদেশী সরকার আইনের বলে তাঁদের নিম্নবর্ণের হিন্দুদের সঙ্গে সমস্তরভুক্ত করে দিচ্ছে। এই ধরণের সামাজিক ধারণা যাঁদের মনে দৃঢ়মূল হয়ে রয়েছে যুগ-যুগ ধরে, তাঁদের সেই ধারণাকে হঠাৎ আইনের আঘাতে ধূলিসাৎ করে দেওয়া বিচক্ষণের কাজ হবেনা।৪
স্বভাবতই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সতীদাহপ্রথা নিবারণের জন্য আইন পাস হওয়ার পর আবার একটি আইন প্রণয়ন করে হিন্দু প্রজাদের চটাতে সাহস করা সুবিবেচনা বলে মনে করছিলেন না। বৃহত্তর সমাজে আলোচনা কিন্তু চলছিল। সব থেকে সরব ছিলেন ইয়ং বেঙ্গল দল। তাঁদের মুখপত্র বেঙ্গল স্পেকটেটর ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দে প্রশ্ন তুলে ফেলল, স্ত্রীর মৃত্যুর পর পুরুষ যদি পুনর্বিবাহ করতে পারে তবে নারীকে সেই অধিকার কেন দেওয়া হবে না? বিশেষত শাস্ত্রে যখন বিধান আছে—
পঞ্চস্বাপৎসু নারীণাং পতিরন্যো বিধীয়তে।’
শিবনাথ শাস্ত্রী অবশ্য অনুমান করেছেন বিদ্যাসাগর ও মদনমোহন তর্কালঙ্কার এই বচন উদ্ধারে সাহায্য করেছিলেন। তবে এই ধারণা অনুমানেই থেকে গিয়েছে। সে যুগের বিখ্যাত স্মার্ত পণ্ডিত ছিলেন রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ, ব্রাহ্মসমাজের প্রধান আচার্য ১৮৪৫ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যুর পর বেঙ্গল হরকরা-য় প্রকাশিত একটি পত্রে তাঁকে বিধবাদের পুনর্বিবাহে মত প্রকাশের জন্য শ্রদ্ধা জানানো হয়েছে।
যদিও রক্ষণশীল হিন্দুসমাজ এইসব কথা শোনার জন্য একেবারেই রাজি ছিল না। কলকাতার বউবাজারের নীলকমল বন্দ্যোপাধ্যায় এক বিধবার বিবাহ দেবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। পটলডাঙার শ্যামাচরণ দাস কর্মকার নিজের বিধবা মেয়ের বিয়ের জন্য তখনকার বিখ্যাত স্মার্ত পণ্ডিতদের সম্মতি স্বাক্ষর জোগা়ড় করেন। পরে এই পণ্ডিতরাই আবার বিধবাবিবাহের বিরোধিতা করেছেন। এইসব পণ্ডিতরা— যাঁরা ‘বিদায়’- এর লোভে সদাব্যস্ত, পাছে উৎসব অনুষ্ঠানে, দানধ্যানে তাঁরা বাদ পড়েন এই ভয়ে সদা চিন্তিত, বিদ্যাসাগর তাঁদের ‘ল্যাজকাটা’ বা ‘টিকিদাস’ বলে অভিহিত করতেন।৭ পূর্বের বিফল চেষ্টাগুলি মনে রাখলে বিদ্যাসাগরের মহাকাব্যিক সংগ্রামের গুরুত্ব হয়তো কিছুটা বোঝা যায়।
বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব প্রথম পুস্তিকাটি তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় প্রবন্ধ আকারে প্রকাশিত হয় ফাল্গুন ১৭৭৬ শকাব্দ অর্থাৎ ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে। এটি পড়লেই বোঝা যায় তিনি দস্তুরমতো পূর্ব প্রস্তুতি নিয়ে এগিয়েছেন। গ্রন্থ প্রকাশের দ্বিতীয় বিজ্ঞাপনেই তাঁর সংহারমূর্তি দেখা যায়। পটলডাঙার শ্যামাচরণ দাস যে নিজ বিধবা কন্যার বিবাহ দেবার উদ্দেশ্যে বিখ্যাত পণ্ডিতদের কাছে ব্যবস্থাপত্র নিয়েছিলেন সেটি সম্পূর্ণ উদ্ধৃত করেন বিদ্যাসাগর, স্মার্ত পণ্ডিতদের সইসাবুদ সুদ্ধ। তারপর ওই ব্যবস্থাপত্রের বঙ্গানুবাদ সংযুক্ত করেন। তাতে পরিষ্কার বলা আছে, ‘মনু প্রভৃতির শাস্ত্রে স্ত্রীলোকের পতিবিয়োগের পর ব্রহ্মচর্য সহমরণ ও পুনর্ব্বিবাহ বিধবাদের ধর্ম্ম বলিয়া বিহিত আছে।’৮ ওই ব্যবস্থাপত্র মুক্তারাম বিদ্যাবাগীশের রচনা এবং ভবশঙ্কর বিদ্যারত্ন ওই ব্যবস্থার পক্ষে বিচারে যোগ দিয়ে নবদ্বীপে জয়ী হন এবং জোড়া শাল পুরস্কার পান। তারপর দু’জনেই বিধবাবিবাহকে অশাস্ত্রীয় বলেছেন। এই তথ্য জানিয়ে বিদ্যাসাগর মন্তব্য করেছেন, ‘যাঁহাদের এইরূপ রীতি, সেই মহাপুরুষেরাই এ দেশে ধর্ম্মশাস্ত্রের মীমাংসাকর্ত্তা, এবং তাঁহাদের বাক্যে ও ব্যবস্থায় আস্থা করিয়াই এ দেশের লোকদিগকে চলিতে হয়।’৯ দ্বিচারিতার ব্যাপারে ভারতবর্ষের ভাগ্য প্রায় একইরকম আছে অদ্যাবধি। এই প্রশ্ন প্রায়শ উঠে থাকে যে বিদ্যাসাগর একজন মানবতাবাদী হিসেবে মানবিক কারণেই বিধবাবিবাহ প্রচলনের কথা বললেন না কেন, শাস্ত্রের দোহাই পাড়ার কী দরকার ছিল? তবে কি তিনি শাস্ত্রকেই চরম মানেন? শাস্ত্র যা বলেছে সেই অনুসারে কর্তব্যকর্ম স্থির করাই যদি তাঁর উদ্দেশ্য ছিল তবে তাঁকে আমরা সংস্কারক বর্গের মধ্যে কোন কোঠায় ফেলব! ঐতিহ্যানুসারী সংস্কারক? শাস্ত্রানুসারী সংস্কারক? মৃত্যুর কয়েক মাস পূর্বে সহবাস-সম্মতি আইনের বিরুদ্ধে অভিমত প্রকাশ করে সরকারকে বিদ্যাসাগর যে চিঠি দিয়েছিলেন তাতে বালিকাবধূদের আরক্ষার ব্যবস্থা যেন থাকে এই আবেদন জানিয়ে তিনি স্পষ্ট বলেন:
ভাবতে অবাক লাগে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় ‘বাল্যবিবাহের দোষ’ (১৮৫০) প্রবন্ধ লেখার সময় যুবক বিদ্যাসাগর সমস্যাটির একেবারে গোড়া ধরে টান দিয়েছিলেন, শাস্ত্র সম্বন্ধে তাঁর যে মনোভাব তখন প্রকাশ পেয়েছিল তা উদ্ধার করা যাক:
‘কল্পিত ফলম্তৃষ্ণা’ শব্দটি লক্ষ করার যোগ্য। ওই প্রবন্ধে তিনি এই সংসারে দাম্পত্যনিবন্ধন সুখকেই সর্বাপেক্ষা প্রধান সুখ বলেছেন। যে স্বামীর প্রণয়ের উপর স্ত্রীর সব সুখ নির্ভর করে, যার সচ্চরিত্রতা বা অসচ্চরিত্র স্ত্রীকে যাবজ্জীবন সুখী বা দুঃখী করে বিবাহের সময় সেই বরের আচার ব্যবহার ও চরিত্র বিষয়ে কন্যার যদি কোনও প্রয়োজন না হয় তবে দম্পতির সুখের সম্ভাবনা থাকে না— এই মত জানাবার সময় বিদ্যাসাগর অবশ্যই কোনও শাস্ত্রের কথা ভাবেননি। বিধবাবিবাহ প্রবর্তন করার জন্য যুদ্ধে নামার সময় অবশ্য শাস্ত্রকে তিনি নির্ভর করেছেন। কিন্তু কেন? তাঁর মুখ থেকেই শোনা যাক:
শাস্ত্রকে তিনি আয়ুধ হিসেবে নিচ্ছেন, কারণ এদেশের লোক যে যুক্তি মানবেন না তা তিনি জানেন। সুতরাং মানবতার নামে আবেদন নিষ্ফল হতে বাধ্য। ‘যস্মিন দেশে যদাচার’ নীতি অবলম্বন করে প্রাচীন হিন্দুশাস্ত্রে পারঙ্গম বিদ্যাসাগর তাঁর অগাধ জ্ঞানকে সমাজসংস্কারের কাজে লাগালেন। রামমোহন সমাজ সংস্কারে সরকারি হস্তক্ষেপ চাননি। বিদ্যাসাগর বারবার চেয়েছেন, তাঁর আন্দোলন সমাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহাত্মক। বিধবাবিবাহের ক্ষেত্রে সফল হলেও বহুবিবাহ রোধের ব্যাপারে তিনি ব্যর্থ হন। সিপাহি বিদ্রোহের পিছনে বিধবাবিবাহ আইন পাসও একটি কারণ বলে প্রচারিত হয়েছিল। বিদেশি সরকার আর কোনও ঝুঁকি নিতে চায়নি। শুধু তাই নয়, বিদ্যাসাগর প্রতিষ্ঠিত বহু নারীশিক্ষা প্রতিষ্ঠানও সরকারি আর্থিক আনুকূল্যের অভাবে বিপন্ন হয়। বিধবাবিবাহের ব্যাপারে যাঁরা তাঁকে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তাঁরা কথা রাখেননি। শিক্ষিত বঙ্গসমাজের উপর যে ভরসা বিদ্যাসাগর রেখেছিলেন তা চূর্ণ হয়ে যায়। হিন্দু পুনর্জাগরণের ফলে সনাতন ধর্মের স্রোতে আবার জোয়ার আসে। কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য জানিয়েছেন— ‘তিনি শেষাশেষি সভ্যজাতি ও সভ্যতাকে অত্যন্ত ঘৃণা করিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন।’১৩ সহবাস সম্মতি আইন বিষয়ে যখন মতামত দিচ্ছেন তখন বঙ্গসমাজের চারিত্র্য, দৃঢ়তা, সংস্কার উদ্যোগ সম্বন্ধে তিনি সম্ভবত নিস্পৃহ। ক্লান্ত, অবসন্ন যোদ্ধা আর যুদ্ধে যোগ দিতে রাজি হননি— এমনটা মনে করা যায়।
যাজ্ঞবল্ক্যসংহিতা অনুসারে বিদ্যাসাগর মোট কুড়িজন ধর্মশাস্ত্রকর্তার নাম উল্লেখ করেছেন। এঁদের মধ্যে আছেন পরাশর। বিশেষ করে কেন পরাশরকে নির্বাচন করেছেন বিদ্যাসাগর? শুধু ‘নষ্টে মৃতে’ ইত্যাদি শ্লোক আছে বলে? আসলে পরাশর হলেন কলিযুগের ধর্ম নিরূপণকর্তা। পরাশরসংহিতা হল কলিযুগের ধর্মশাস্ত্র। শ্লোক উদ্ধার করে তিনি প্রাসঙ্গিক ব্যাখ্যা করেছেন, ‘পরাশর কলিযুগের বিধবাদের পক্ষে তিন বিধি দিতেছেন, বিবাহ, ব্রহ্মচর্য, সহগমন। তন্মধ্যে রাজকীয় আদেশক্রমে সহগমনের প্রথা রহিত হইয়া গিয়াছে। এক্ষণে বিধবাদের দুই মাত্র পথ আছে বিবাহ ও ব্রহ্মচর্য; ইচ্ছা হয় বিবাহ করিবেক, ইচ্ছা হয় ব্রহ্মচর্য করিবে।’১৪
পরাশরের বিধানের মধ্যে সতীদাহ নিরোধ আইনের উল্লেখ করে প্রতিপক্ষকে বিদ্যাসাগর কোণঠাসা করে ফেলেছেন। অন্য যে সমস্যাটি এক্ষেত্রে উঠবেই তা হল উত্তরাধিকারের প্রশ্ন। যেহেতু মেয়েরা নিজেরা তখন সম্পত্তির উত্তরাধিকার পেত না তাই উত্তরাধিকারী পুত্রের কথাই বিদ্যাসাগর আলোচনা করেছেন। পূর্বযুগের দ্বাদশ প্রকার পুত্রের বদলে পরাশর ঔরস, দত্তক, কৃত্রিম ত্রিবিধ পুত্রের কথা বলেছেন। বিদ্যাসাগর প্রমাণ করে দিয়েছেন ‘বিবাহিতা বিধবার গর্ভে স্বয়ং উৎপাদিত পুত্রকে পৌনর্ভব না বলিয়া ঔরস বলিয়া গণনা করিতে হইবেক, তাহার সন্দেহ নাই।’১৫ স্বভাবতই কন্যাও ঔরস কন্যা বলে গৃহীত হবে এটি অনুক্ত থাকল।
শুধু বিধবা নারীর অসহ জীবনযন্ত্রণার কথা বললে যে অরণ্যে রোদন হবে তা বিদ্যাসাগর জানতেন। এই ব্যাপারে সমাজ অন্ধ ও বধির। ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দে এলাহাবাদ সদর আদালতের রেজিস্ট্রার এইচ. বি. হ্যারিংটন যথার্থ লক্ষ করেছিলেন,
বিদ্যাসাগর তুললেন বৈধব্যযন্ত্রণার পাশাপাশি সামাজিক ব্যভিচারের নিরাকরণ প্রসঙ্গ। শুধু বিধবা মেয়েরা নয়, ব্যভিচার বন্ধ হলে গোটা সমাজেরই লাভ এই যুক্তি দিয়ে স্থবির সমাজকে তিনি নাড়া দিতে চাইলেন।
লক্ষণীয়, বারবার কিন্তু তিনি অগ্রাধিকার দিচ্ছেন অসহ্য বৈধব্যযন্ত্রণাকে। সামাজিক কলঙ্কের কথা বলার আড়ালে একটি বার্তা ধ্বনিত হয় বিধবারাও রক্তমাংসের মানুষ, সে-কথা পরে তিনি আবার স্মরণ করাবেন সংস্কারান্ধ সমাজকে।
বিধবাবিবাহ সংক্রান্ত প্রথম পুস্তিকাটি প্রকাশের পর কয়েক হাজার কপি দ্রুত নিঃশেষিত হয়। প্রতিবাদও শুরু হয় তীব্রভাবে। এই বিতর্ক বিদ্যাসাগর উৎসাহ ভরে নিয়েছেন কারণ এতে প্রমাণ হয়েছে তিনি প্রার্থিত নাড়া দিতে পেরেছেন। বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব দ্বিতীয় পুস্তক তিনি প্রকাশ করেন ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে। তাঁর বিরোধীদের বক্তব্য ছিল পরাশরের ওই বচন বাগদত্তা কন্যা সম্পর্কেই প্রযুক্ত, বিবাহিতার ক্ষেত্রে নয়। বিদ্যাসাগর এবার নারদসংহিতা-র শরণাপন্ন হয়ে ওই বচনের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। ‘নষ্টে মৃতে’ শ্লোকটি উদ্ধার করে নারদসংহিতা-য় বলা হয়েছে, স্বামী অনুদ্দেশ হলে ব্রাহ্মণজাতীয়া স্ত্রী আট বৎসর, সন্তান না হলে চার বৎসর, ক্ষত্রিয়া জাতীয়া স্ত্রী ছয় বৎসর, সন্তান না হলে তিন বৎসর, বৈশ্যজাতীয়া স্ত্রী চার বৎসর, সন্তান না হলে দুই বৎসর অপেক্ষা করার পর পুনর্বিবাহ করতে পারে। শূদ্রজাতীয়া স্ত্রীর ক্ষেত্রে কালনিয়ম নেই। বাগ্দত্তা প্রসঙ্গে ওই বিধি হলে সন্তানের প্রসঙ্গ তো আসতেই পারে না।
তাঁর বিরোধীরা যেসব শাস্ত্রবচন উদ্ধৃত করে বিধবাবিবাহ অশাস্ত্রীয় বলেছিলেন বিদ্যাসাগর তা পর পর সংকলন করে ক্রমান্বয়ে খণ্ডন করেছেন। কলিযুগে যেসব কাজ বারণ বলে আদিপুরাণ, ক্রতু, বৃহন্নারদীয় ও আদিত্যপুরাণ ঘোষণা করেছিলেন, পরাশর তার মধ্যে বিবাহিতা স্ত্রীর বিবাহ ব্যাপারে পাঁচটি ক্ষেত্রে বিশেষ বিধি দিয়েছেন। ‘আদি পুরাণ প্রভৃতিতে সামান্যাকারে বিবাহিতার বিবাহ নিষিদ্ধ হইয়াছে; পরাশর অনুদ্দেশ প্রভৃতি স্থলে তাহার প্রতিপ্রসব করিতেছেন।... সামান্য বিধি-নিষেধ ও বিশেষ বিধি-নিষেদস্থলের নিয়মই এই যে, বিশেষ বিধি-নিষেদের অতিরিক্ত স্থলে সামান্য বিধি-নিষেধ খাটিয়া থাকে।’১৮ অর্থাৎ এ এক ধরনের অর্ডারের রাইডার বা অতিরিক্ত শর্তাদি। এই সামান্য ও বিশেষ বোঝাতে গিয়ে বিদ্যাসাগর বেদের জীবহিংসা বিষয়ে নির্দেশের প্রসঙ্গ এনেছেন। বেদে সামান্যাকারে জীবহিংসার স্পষ্ট নিষেধ থাকলেও বিশেষ বিধি দ্বারা যজ্ঞে পশুহিংসা বিহিত হয়েছে। মাধবাচার্য যে পরাশরের বচন ঠিকমতো ব্যাখ্যা করেননি তাও তিনি যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করেছেন।
বিরোধীদের একটি প্রধান আপত্তি ছিল মনুবিরুদ্ধ বলে বিধবাবিবাহ অশাস্ত্রীয়। বিদ্যাসাগর একে একে শ্লোক তুলে তুলে প্রমাণ করেছেন বিবাহে কন্যা ও বরের বয়স ব্যাপারে হিন্দুসমাজ মনুর নয়, অঙ্গিরার বিধিই মেনে চলে। উত্তরাধিকার প্রভৃতি প্রশ্নেও কাত্যায়নস্মৃতি অনুসৃত হচ্ছে। তারপর তিনি তূণ থেকে মোক্ষম বাণটি তুলে এনেছেন, মনুসংহিতা-র ‘পুনর্ভূ’ প্রসঙ্গ। মনু বলেছেন, যে নারী পতিকর্তৃক পরত্যক্তা অথবা বিধবা হয়ে স্বেচ্ছাক্রমে অন্য ব্যক্তিকে বিবাহ করে অর্থাৎ পুনর্ভূ হয়, তার পুত্রকে ‘পৌনর্ভব’ বলে। যাজ্ঞবল্ক্যর নির্দেশ হল, যে অক্ষতযোনি বা ক্ষতযোনি স্ত্রীর পুনর্বার বিবাহসংস্কার হয়, তাকে পুনর্ভূ বলে। বশিষ্টর বিধি অনুসারে, যে স্ত্রী ক্লীব, পতিত, উন্মত্ত পতিকে পরিত্যাগ করে অথবা পতির মৃত্যু হলে অন্য ব্যক্তিকে বিবাহ করে তাকে পুনর্ভূ বলে। মনু ও যাজ্ঞবল্ক্য পৌনর্ভবকে শ্রাদ্ধাদিকারী ও ধনাধিকারীও করে গিয়েছেন।
ভাবতে অবাক লাগে বিদ্যাসাগরের বিরোধীরা যুক্তি দিয়েছিলেন বিধবাবিবাহ যদি পরাশরের সম্মত হত তবে তিনি বৈধব্যদশাকে দণ্ড বলে ব্যাখ্যা করতেন না। অর্থাৎ স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রী যদি আবার বিয়ে করতে পারে তবে সে স্বামীর মৃত্যুতে আর দুঃখ পাবে কেন? বৈধব্য কীভাবে আর তা হলে দণ্ড হবে! বিদ্যাসাগর এই যুক্তির বিরুদ্ধে কোনও শাস্ত্রের ধার ধারেননি। তাঁর বক্তব্যে যেন প্রতিবাদের সিংহ গর্জন শোনা যায়:
মেয়েদের সম্বন্ধে তাঁর বিরোধীদের অভিমত স্পষ্টত জানান দেয় মনুষ্যত্বের মাপকাঠিতে মেয়েদের তাঁরা কতটা খাটো ভাবতেন, সম্ভোগেচ্ছা ছাড়া মেয়েদের আর যেন কোনও অনুভূতি নেই। এই দেশেই আবার ‘মাতৃরূপেণ সংস্থিতা’র জয়জয়কার। বিদ্যাসাগর যেভাবে এই নীচ মনোভাবের প্রতিবাদ করেছেন আজও তাতে মাথা নত হয়।
বিরোধীদের হাতে আর একটি অস্ত্র ছিল মহাভারতে আদিপর্বে দীর্ঘতমার বচন, ‘নারীর কেবল এক পতি হইবেক, যাবজ্জীবন তাহাকে আশ্রয় করিবে।’২০ বিদ্যাসাগর দীর্ঘতমার এই বচনের বাস্তব পটভূমি ব্যাখ্যা করেছেন যা একেবারেই আধুনিক পদ্ধতি। দীর্ঘতমা জন্মান্ধ ছিলেন, তাঁর ভরণপোষণ করতে তাঁর স্ত্রীর খুব কষ্ট হত ফলে তিনি এই কাজে অসম্মত হন। দীর্ঘতমা তখন কুপিত হয়ে উপর্যুক্ত নিয়ম সৃষ্টি করেন। কিন্তু তিনি নিজেই আবার পরে বলিরাজার মহিষী সুদেষ্ণার গর্ভে ক্ষেত্রজ পুত্র উৎপাদন করেছেন। পরিস্থিতি বুঝেই বোধহয় বিদ্যাসাগর মহাভারতেই দ্রৌপদীর পঞ্চপতির প্রসঙ্গ তোলেননি।
বিধবাবিবাহ বিষয়ে বিদ্যাসাগরের দ্বিতীয় পুস্তকে আজকের পাঠকের কাছে অসামান্য মূল্যবান মনে হবে কন্যা সম্প্রদান ও কন্যার গোত্রান্তর প্রসঙ্গ। ব্যক্তিগতভাবে বলতে পারি আমার অনেক ভুল ধারণা এই অংশ পাঠের পর ভেঙে গিয়েছে। বিরোধীরা আপত্তি তোলেন বিধবা কন্যার দানাধিকারী কে হবে? পিতা যখন একবার দান করেছেন তখন কন্যাতে আর তাঁর স্বত্ব নেই, আবার কী করে অন্য ব্যক্তিকে সেই কন্যা দান করবেন? বিদ্যাসাগর ভূমি, গৃহ, উদ্যান, গো, অশ্ব, মহিষ প্রভৃতি দান বিক্রয়ের সঙ্গে কন্যা সংক্রান্ত দান ও বিক্রয়ের অসাম্য দেখান। তিনি স্পষ্টত বলেছেন, এদেশে এখন দুই প্রকার বিবাহ চালু— ব্রাহ্ম ও আসুর— কন্যাদান ও কন্যাবিক্রয়। কন্যাপণ তখন বিয়ের বাজারে ভালই প্রচলিত। এখন অবশ্য বিক্রয় অনেক ক্ষেত্রে আর বিবাহার্থীকে করা হচ্ছে না, human trafficker সেই স্থান নিয়েছে। নারীমাংসের হাটে কন্যাবিক্রয় তখনও ছিল না তা নয়, কিন্তু বিধবাবিবাহ প্রসঙ্গে সেই পাপের কথা তোলা নিশ্চয়ই বিদ্যাসাগরের কাছে যুক্তিযুক্ত মনে হয়নি। তিনি প্রমাণ করে দিয়েছেন ‘বিবাহস্থলের দান বাচনিক দান। শাস্ত্রকারেরা দানকে বিবাহবিশেষের অঙ্গ বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়াছেন মাত্র। এই বিবাহাঙ্গ দান, যে কোনও ব্যক্তি করিলেও বিবাহ নির্ব্বাহ হইয়া থাকে।’২১ নারদবচন উদ্ধার করে তিনি দেখান পিতা, ভ্রাতা, মাতামহ, মাতুল, জ্ঞাতি, বান্ধব, মাতা— অভাবে স্বজাতীয়েরা কন্যাদান করতে পারেন। পরাশরভাষ্য ও নির্ণয়সিন্ধু-ধৃত কাত্যায়নবচন উদ্ধৃত করেছেন তিনি।
শাস্ত্রে বিবাহিতা কন্যাকেও বিশেষ ক্ষেত্রে পাত্রান্তরে সম্প্রদানের কথা আছে, তখন বিধবা কন্যার ক্ষেত্রে আপত্তির প্রশ্নই ওঠে না। এর পরের আপত্তি ছিল গোত্রসম্পর্কিত। সকলেই জানে হিন্দুবিবাহে বিবাহের পর কন্যা গোত্রান্তরিত হয়ে স্বামীর গোত্র লাভ করে। বিদ্যাসাগর যা লিখেছেন তাতে এই ধারণার ভিত পর্যন্ত নড়ে যায়।
কাত্যায়নবচন উদ্ধার করে বিদ্যাসাগর দেখিয়েছেন বিবাহসংস্কার হলে, স্ত্রী সপিণ্ডীকরণ পর্যন্ত পিতৃগোত্রে থাকে, সপিণ্ডীকরণের পর শ্বশুরগোত্রভাগিনী হয়। অর্থাৎ জীবৎকালে কোনও বিবাহিতা নারীরই গোত্রান্তর হয় না। বিদ্যাসাগরের ভাষা লক্ষ করলে বোঝা যায় শাস্ত্রকে তিনি ব্যবহার করছেন, প্রকৃতপক্ষে তাঁর অবলম্বন স্বচ্ছ যুক্তিবোধ।
‘কল্পনা করিয়াছেন’— বাক্যাংশটি তাঁর মনোভঙ্গি বুঝিয়ে দেয়। আসলে বিদ্যাসাগর প্রমাণ করেছেন বিবাহাদি ব্যাপারে শাস্ত্রকারেরা স্ত্রী-পুরুষের পক্ষে এক নিয়ম করেছেন।
অবশেষে বিরোধীদের হাতে ছিল একটিই অস্ত্র— দেশাচার। বিদ্যাসাগর মহাভারতের অনুশাসন পর্ব থেকে শ্লোক উদ্ধার করে দেখিয়ে দিয়েছেন যেখানে বেদে অথবা স্মৃতিতে স্পষ্ট বিধি অথবা নিষেধ না থাকে সেইখানে দেশাচার ও কুলাচার দেখে ধর্ম নিরূপণ করতে হয়। বিধবাবিবাহের ক্ষেত্রে স্পষ্ট শাস্ত্রীয় নির্দেশ থাকাতে দেশাচার জানার প্রশ্ন নেই। উপসংহারে বিদ্যাসাগর শাস্ত্রসাগর মন্থন করার পর দেশবাসীর বিবেকের কাছেই আবেদন জানিয়েছেন।
হা অবলাগণ! তোমরা কি পাপে, ভারতবর্ষে আসিয়া জন্মগ্রহণ কর, বলিতে পারি না!২৬
তাঁর লেখা এই লাইন ক’টি একবিংশ শতাব্দীর বিশ্বায়িত ভারতবর্ষেও কী প্রাসঙ্গিক। শুধু বিধবাবিবাহ নয়, নারীর উপর ভয়াবহ অত্যাচারের ঘটনাসমূহ আমাদের অন্তরে নিয়ত এই মহাত্মার আক্ষেপ অনুরণিত করে। শাস্ত্রের বাইরে এই প্রথম কেউ সমাজসংস্কারের জন্য এমন মানবিক আবেদন জানালেন। বিদ্যাসাগর ৯৮৭ জনের স্বাক্ষরসংবলিত আবেদনপত্র পাঠালেন সরকারের কাছে। রাজা রাধাকান্ত দেবের নেতৃত্বে ৩৬,৭৬৩ জনের স্বাক্ষরসহ বিধবাবিবাহ হিন্দুধর্মবিরোধী— এই মর্মে প্রতিবাদ পত্র যেতেও দেরি হল না। অবশেষে ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জুলাই বিধবাবিবাহ আইন পাশ হল। বাঙালির বাক্যবিলাসের প্রবাদকে ব্যর্থ করে বিদ্যাসাগর কীভাবে নিজব্যয়ে ও উদ্যোগে প্রথম কালীমতী দেবীর ও পরে অসংখ্য বালবিধবার বিবাহ দিয়েছেন তা আজ ইতিহাস। পুত্র হিসেবে নারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে সুখী করেছিলেন তা কেউই বলবে না, কিন্তু নারায়ণ যখন বিধবা ভবসুন্দরীকে বিবাহ করেন পিতা বিদ্যাসাগর গর্বিত হয়েছিলেন। ভাই শম্ভুচন্দ্রকে ওই সূত্রে লেখা তাঁর চিঠির প্রতিটি লাইন মনে গেঁথে যায়। এই চিঠিতেই তিনি লিখেছিলেন বিধবাবিবাহ প্রবর্তন তাঁর জীবনের সর্বপ্রধান সৎকর্ম।
এই চিঠি বিদ্রোহীর কলমে লেখা, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের নিশান এখানে সগর্বে উড়ছে। রাষ্ট্রীয় আইনের সাহায্য নিলেন একজন সংস্কারক, জগদ্দল বাধা ভাঙলেন। তখনকার মতো প্রাথমিক উৎসাহ পরে যথারীতি স্তিমিত হয়েছে বাঙালি যুবকদের। বিধবাবিবাহে যে ঝামেলা অনেক। উচ্চবর্ণ সমাজে বরপণ প্রথা কোনওভাবেই সংকুচিত হয়নি। ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে রিসলি তাঁর The tribes and castes of Bengal গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, একবার খরচপত্র করে বরপণ দিয়ে মেয়েদের বিবাহ দেওয়ার পর সেইসব মেয়ে বিধবা হয়ে ফিরে এলে ফের খরচ করে তাদের বিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে বেশিরভাগ পরিবারেই উৎসাহ দেখা যেত না। পুনরায় বিবাহের ফলে আইন অনুযায়ী মৃত স্বামীর সম্পত্তিতেও তাদের অধিকার নষ্ট হত। সমস্যাটির অর্থনৈতিক দিক তাই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। পিতৃ পরিবারের স্থাবর, অস্থাবর সম্পত্তিতে মেয়েদের অধিকার তখনও স্বীকৃত নয়। স্ত্রীধন ছাড়া তাদের তেমন কিছু থাকত না। সেইসব গহনাপত্র নানা ছলে-বলে পিতৃ ও শ্বশুর পরিবার হস্তগত করার চেষ্টায় থাকত। ফলে বাঙালি অনাথা বিধবাদের কাশী ও বৃন্দাবনগামী স্রোত বিংশ শতাব্দীর চল্লিশের দশক পর্যন্ত কম-বেশি অব্যাহত ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, মন্বন্তর, দাঙ্গা ও দেশভাগ অবশ্য পরে ছবিটা অনেকখানি পালটে দেয়। বিদ্যাসাগর বিধবাবিবাহ জনিত ঋণভারে বিপন্ন হয়ে ডা. দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে যে চিঠি লিখেছিলেন তাতে কেন তিনি সভ্য, শিক্ষিত সমাজ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন তা খুবই স্পষ্ট।
ভারতীয় সমাজে অন্ধ সংস্কারের দাপট অদ্যাবধি ভয়ানক। হিন্দু নিম্নবর্ণ ও মুসলমান সমাজে বিধবাবিবাহ প্রচলিত শুধু এই কারণেই উচ্চবর্ণ হিন্দুসমাজ এই প্রথাকে এড়িয়ে ব্রহ্মচর্যের দিকে বিধবাদের এগিয়ে দিয়ে এখনও গর্ব ও আভিজাত্য অনুভব করে। বিদ্যাসাগর এই সমাজকে জেনে, বুঝে অপরিসীম দুঃসাহসে ঘা দিয়েছিলেন। তার ফলে পরে মুক্তমনা সাহসী উদারহৃদয় অভিভাবকরা অভাগিনী কিশোরী ও তরুণী বিধবা কন্যাদের বিবাহ দিতে পেরেছিলেন। পুত্রের বিবাহ, কোনও যোগ্য বিধবা নারীর সঙ্গে দিতে সমর্থ হয়েছিলেন। এই অভিভাবকদের মধ্যে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের মতো মানুষ। সাধারণ মানুষও অনেকে ছিলেন, আবার নরেন্দ্র দেব, রাধারাণী দেবীর মতো বিখ্যাত দম্পতির নামও করা যায়। পলাতকা-র ‘নিষ্কৃতি’ কবিতার মঞ্জুলিকার মতো বিধবা মেয়েরা সাহস করে প্রেমিকের হাত ধরে সম্মানপূর্ণ দাম্পত্যজীবনের দিকে অনেকেই এগিয়েছিলেন। তাঁদের পাশে সহৃদয় মানুষরা দাঁড়াবার জোর পেয়েছিলেন। বিধবাবিবাহ আইন পাস হবার একশো বছর পর স্বাধীন ভারতে হিন্দু বিবাহ ও উত্তরাধিকার আইনে যে বিপুল পরিবর্তন সূচিত হল তা এক হিসেবে বিদ্যাসাগরের শুরু করা আন্দোলনের জয়। তিনি পরলোকে বিশ্বাস করতেন বলে মনে হয় না, তাই তাঁর আত্মা স্বর্গ থেকে এই সাফল্য দেখে তৃপ্ত হয়েছে এ কথা বলার মতো নির্বোধ সাহস আমার নেই, কিন্তু যেসব সমালোচক বিধবাবিবাহ প্রবর্তনের আন্দোলনকে সাময়িক নিস্তেজ ভাবের জন্য গুরুত্ব দিতে নারাজ হন, তাঁদের উদ্দেশে এটুকুই বলার থাকে ভারতীয় নারীর অধিকার অর্জনের বেদনাময় দীর্ঘ ইতিহাসে এই আন্দোলন মুক্তির সোপান রচনা করেছিল, আত্মবিশ্বাস ও সাহস জুগিয়েছিল। বিদ্যাসাগর নারীকে নিজের ভাগ্য সম্পর্কে প্রশ্ন করার অধিকার দিয়ে গিয়েছেন, সমাজে নারী ও পুরুষের সম অধিকার— এই সুচেতনা জাগিয়ে গিয়েছেন।
১.↩ ভাই শম্ভুচন্দ্রকে লেখা বিদ্যাসাগরের চিঠি। ৩১ শ্রাবণ, ১২৭৭। বিনয় ঘোষ, বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ (কলকাতা: ওরিয়েন্ট লংম্যান ১৯৮৪), পৃ. ৪৫০।
২.↩ ইন্দ্রমিত্র, করুণাসাগর বিদ্যাসাগর (কলকাতা: আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি., ২০০৭), পৃ. ২৪১।
৩.↩ ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর, অন্নদামঙ্গল (কলিকাতা: বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎ, ৪র্থ সংস্করণ, ১৪০৪ ব.)।
৪.↩ বিনয় ঘোষ, বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ, পৃ. ২৪৩।
৫.↩ ইন্দ্রমিত্র, করুণাসাগর বিদ্যাসাগর, পৃ. ২৪২।
৬.↩ তদেব, পৃ. ২৪৩।
৭.↩ কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য, ‘পুরাতন প্রসঙ্গ’, রচনা-সংগ্রহ, সম্পা. নির্মাল্য আচার্য (কলকাতা: সুবর্ণরেখা, ১৪০০ ব.) পৃ. ৩৫৮।
৮.↩ বিদ্যাসাগর রচনাবলী, অখণ্ড সংস্করণ। সম্পা. সুবোধ চক্রবর্তী (কলকাতা: কামিনী প্রকাশালয়, ১৪২১ ব.), পৃ. ৫৬৭।
৯.↩ তদেব, পৃ. ৫৬৫।
১০.↩ বিনয় ঘোষ, বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ, পৃ. ৪৪১।
১১.↩ বিদ্যাসাগর রচনাবলী, পৃ. ৫৫৫।
১২.↩ তদেব, পৃ. ৫৬৯।
১৩.↩ কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য, ‘পুরাতন প্রসঙ্গ’, পৃ. ৩৯৫।
১৪.↩ বিদ্যাসাগর রচনাবলী, পৃ. ৫৭৩।
১৫.↩ তদেব, পৃ. ৫৭৫।
১৬.↩ বিনয় ঘোষ, বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ, পৃ. ২৪৩।
১৭.↩ বিদ্যাসাগর রচনাবলী, পৃ. ৫৭৮।
১৮.↩ তদেব, পৃ. ৫৮৭।
১৯.↩ তদেব, পৃ. ৬১৯।
২০.↩ তদেব, পৃ. ৬২৭।
২১.↩ তদেব, পৃ. ৬৬৮।
২২.↩ তদেব, পৃ. ৬৬৯।
২৩.↩ তদেব, পৃ. ৬৭১।
২৪.↩ তদেব, পৃ. ৬৭১।
২৫.↩ তদেব, পৃ. ৬৭৮।
২৬.↩ তদেব, পৃ. ৬৮৪।
২৭.↩ বিনয় ঘোষ, বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ, পৃ. ৪৫০।
২৮.↩ তদেব, পৃ. ৪৫৩।
কোন মন্তব্য নেই
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন