মোট পৃষ্ঠাদর্শন

    ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
        মাইকেল মধুসূদন দত্ত

  বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে।
  করুণার সিন্ধু তুমি, সেই জানে মনে,
  দীন যে, দীনের বন্ধু!—উজ্জ্বল জগতে
  হেমাদ্রির হেমকান্তি অম্লান কিরণে।
  কিন্তু ভাগ্যবলে পেয়ে সে মহা পর্বতে,
  যে জন আশ্রয় লয় সুবর্ণ চরণে,
  সেই জানে কত গুণ ধরে কত মতে
  গিরীশ। কি সেবা তার সে মুখ সদনে।—
  দানে বারি নদীরূপ বিমলা কিঙ্করী;
  যোগায় অমৃত ফল পরম আদরে
  তরুদল, দাসরূপ ধরি;
  পরিমলে ফুলকুল দশ দিশ ভরে;
  দিবসে শীতল শ্বাসী ছায়া, বনেশ্বরী,
  নিশার সুশান্ত নিদ্রা, ক্লান্তি দূর করে!

‘সাঁওতালরা তাঁকে তাদের ফসল উপহার দিত (শাকপাতা, কন্দ, মুল, কুদ্রুম), গরিবের যে-উপহার পেয়ে তিনি অশ্রপাত করেছেন। ১৮৮৮ অবধি তিনি কর্মাটাঁড়ে যেতেন, তার পরেও নিয়মিত খবরাখবর নিতেন ও মাসোহারা পাঠাতেন। বাংলোর মুখোমুখি, তাঁর প্রতিষ্ঠিত এই উপমহাদেশের প্রথম দাতব্য আদিবাসী বালিকা বিদ্যালয় ও দাতব্য হোমিও চিকিৎসালয় চালু রয়েছে।

—ড. অর্চনা বন্দ্যোপাধ্যায়

              কুড়ি কুড়িকো নঁরঙা করমবুটে তিঁরিয়ঁ দ...
              (ওই শোনো মেয়েরা, করমগাছে করমবাঁশি বাজছে, চলো চলো)
              করো ত্বরা, করো ত্বরা, কাজ আছে মাঠ ভরা
              দেখিতে দেখিতে দিন আঁধার হবে।         —রবীন্দ্রনাথ।


জীবনের শেষ দিকে বিদ্যাসাগর কর্মাটাঁড় (অর্থাৎ, বিস্তীর্ণ কর্মভূমি বা করমগাছ-এর ডাঙা)-এ আঠারো বছর সাঁওতালদের মধ্যে কাটান। (হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে, কর্মা নামে এক সাঁওতালের নামে কর্মাটাঁড়)। এখানে তিনি বিদ্যার গুরু নন, কর্মের পাহাড় করমবুরু বা কর্ম-দেবতা। ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চলের অনেক স্থানে বিভিন্ন গ্রামের এক নাম দেখা যায়, প্রধানত গাছের নামে, যেমন কর্মাটাঁড় (হলদু ও কেলিকদম), জামতাড়া, মাতকোমডিহি (মহুয়া), সারজংডিহি (শাল), সাপারমডিহি (শিউলিবনা)। এ ছাড়া, দুয়ারসিনি, যদুগোড়া, চকইচালান, ধুন্দিখাপ, ডাবা তোরাং, বাঘমুন্ডি, বুরুয়াকোচা, ঝালদা গ্রামগুলি ও আশপাশে কুমোরপাড়া, কামারপাড়া, পেটোপাড়া, তাঁতিপাড়া, গোয়ালপাড়ার বাসিন্দারা নিজেদের পেশা কাঠের কাজ, পাতার থালাবাটি, ঝুড়ি, খাটিয়া বোনার কাজ করে। কর্মনিপুণতা পরম্পরায় চর্চিত। চাষবাস, হস্তশিল্প হাটবারে কেনাবেচা, বিনিময় হয়। রোপণের পরের অবসরে, করম পরবের আগে, প্রধানত হস্তশিল্পের কাজ হয়।

হাওয়া বদল ও বিশ্রাম নিতে বিদ্যাসাগর বাঙালি-অধ্যুষিত দেওঘরের বড় বাড়ি কেনার চেয়ে নির্যাতিত, বিধ্বস্ত সাঁওতালদের মধ্যে থাকার জন্য এই কর্মাটাঁড়ের বৃক্ষবাগানসহ ছোট বাড়ি কেনা ঠিক করেন (১৮৬৯)। সাঁওতালরা ওখানকার সাত-আট ঘর দিকো (বহিরাগত) বা বাঙালিদের বিশ্বাস করত না, কারণ ভদ্রলোকদের কাছ থেকে তারা জিনিসের দাম বা শ্রমের মজুরি পেত না। বিদ্যাসাগর ন্যায্য মজুরি দিয়ে সাঁওতালদের আত্মীয়ের বিশ্বাস অর্জন করেন। সেই কালে প্রতি বছর হাজার টাকার বেশি খরচ করে কাপড়, শীতবস্ত্র, মোটা চাদর, কম্বল কিনে, কমলালেবু, খেজুর কলকাতা থেকে কিনে নিয়ে দিয়েছেন। রোগে ওষুধ, ভেষজ ও পথ্য দিয়েছেন। নিজ হাতে জমাদারনি কলেরা রোগীর, সাঁওতাল বালকের মলমুত্র পরিষ্কার করতে দ্বিধা করেননি। দুপুর রোদে তিন মাইল হেঁটে সাঁওতাল বালকের চিকিৎসা করেছেন। শিক্ষা, কর্ম, আনন্দে ভরা তাঁর বাগানবাড়ি। তাঁরই দেওয়া নাম নন্দন কানন-কে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ‘মহর্ষির আশ্রম’ বলেছেন। নন্দন কাননে সকালে আম, লতানে আমের কলম ও আরও নানা ফলবৃক্ষরোপণ, বাগানের কাজ এবং খাওয়াদাওয়ার পরে আনন্দের নাচ হতো।
বিদ্যাসাগরের রচনাগুলি নিয়ে যখন আলোচনা হয়, তখন সাধারণভাবে আখ্যানমঞ্জরী-র তিনটি ভাগ শুধু উল্লেখ করা হয়। বিদ্যাসাগর বিভিন্ন বই থেকে নানান কাহিনি উদ্ধৃত করে সেগুলি সরল ভাষায় ছাত্রদের জন্য গ্রন্থনা করেন। প্রথম ভাগে একুশটি, দ্বিতীয় ভাগে ছাব্বিশটি ও তৃতীয় ভাগে কুড়িটি কাহিনি স্থান পেয়েছে। লেখাগুলি বেশ সুখপাঠ্য। রচনারীতি খানিকটা নতুন বলা যায়। বেশ ক’টি কাহিনি ঔপনিবেশিক নির্মমতা ও নিষ্ঠুরতার বিবরণ। সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দিতে দেশ দখল করতে গিয়ে ইংরেজ, স্পেনীয় দখলকারেরা অধিকৃত দেশগুলির আদিবাসীদের ওপর যে-নৃশংস অত্যাচার চালিয়েছিল, তারই পরিচয় তিনি দিয়েছেন। এই লেখাগুলি খুঁটিয়ে পড়লে ঔপনিবেশিকতাবাদীদের, বিশেষ করে ইংরেজ রবিনসন ক্রুসোদের, স্বরূপ বুঝতে অসুবিধে হয় না। তাঁর আগে বোধ হয় আর কেউ এমন উদ্ঘাটন করেননি। দু’একটি কাহিনির সংক্ষেপে উল্লেখ করছি।

—পবিত্রকুমার সরকার



তালিবান নেতা মোল্লা মুহম্মদ ওমরের নির্দেশে ২০০১ সালের মার্চের একেবারে গোড়ার দিকে একদল ধর্মীয় সন্ত্রাসী আফগানিস্তানের বামিয়ান বুদ্ধমূর্তি ডিনামাইট ফাটিয়ে উড়িয়ে দেয়। এটি ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় বুদ্ধমূর্তিগুলোর একটি। দেড় হাজার বছরের ওই মূর্তি ঐতিহাসিক সৌকর্ষের গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত হত। ওই জায়গাটি ইউনেস্কো ঘোষিত ঐতিহ্যকেন্দ্র বা হেরিটেজ সাইট। বামিয়ান উপত্যকায় পাহাড়ের পৃষ্ঠতল কেটে-কেটে একদিন ওই বুদ্ধমূর্তি তৈরি হয়েছিল। মৌলবাদী অন্ধতার কাছে অবশ্য এই সবের দাম নেই। ইসলামের নামে এই সব কাণ্ডকারখানা চলেছিল। গোটা বিশ্ব ওই ঘটনায় স্তম্ভিত হয়ে যায়। পাকিস্তানসহ চুয়ান্নটি ইসলামিক রাষ্ট্র বামিয়ান বুদ্ধমূর্তি ধ্বংসের নিন্দা করে। বর্তমানে সুইটজারল্যান্ডের উদ্যোগে ওই মূর্তি পুননির্মাণের চেষ্টা চলছে। মূর্তি নির্মাণ হলেও ঐতিহ্য ফিরে আসবে না।

২০০৩ সালে মার্কিনরা যখন ইরাক দখলে উন্মত্ত সামরিক অভিযান চালায়, ধ্বংস হয়েছিল সুমের ও মেসোপটেমিয়া সভ্যতার অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নসামগ্রী। এত বড় এবং এর তুল্য না-হলেও, একদা এই বাংলাতেও এই সব বোধবুদ্ধিহীন ঘটনা ঘটেছে রাজনৈতিক মৌলবাদের আশ্রয়ে। ১৯৬৯-৭০ আন্দোলনের পথ ধরে মাওবাদী (ওদের দাবি অনুযায়ী) কৃষক বিপ্লবের ধ্যানধারণা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য একদল তরুণ-তরুণী সংকল্পবদ্ধ হয়। ওদের নেতা ছিলেন চারু মজুমদার, সুশীতল রায়চৌধুরী, কানু সান্যাল, সরোজ দত্ত, জঙ্গল সাঁওতাল প্রমুখ। বহু মেধাবি উজ্জ্বল ছাত্রছাত্রী সশস্ত্র বিপ্লবের কুহক-আকর্ষণে ঝাপিয়ে পড়ে। ওরা জোতদার-জমিদার-মুৎসুদ্দি বুর্জোয়ার শাসন-শোষণ থেকে দেশকে দ্রুত মুক্ত করার লক্ষ্যে কলকাতা শহর-সহ রাজ্যের কয়েকটি অঞ্চলে চোরাগোপ্তা হামলা চালায় ও হত্যার আশ্রয় নেয়। ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের আগে লেনিন বিচ্ছিন্ন সন্ত্রাসী ক্রিয়াকাণ্ডের তীব্র নিন্দা করেন এবং একে ‘নারোদনিজম’ (রুশ দেশের ১৮৬০-৭০ সালে কৃষক অভ্যূত্থানভিত্তিক এই মতবাদ প্রচলিত। পরে এর পরিণতি হয় সন্ত্রাসমূলক কার্যকলাপে) আখ্যা দেন। তালিবানদের মতো এই বাংলার নকশালপন্থীরা স্কুল-কলেজ-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ধ্বংস করার এবং ওদের শ্রেণি-উৎস বা মতাদর্শগত পার্থক্য যা-ই থাক না কেন, উভয়ের প্রয়োগ-পদ্ধতি একই ছিল। নকশালপন্থী নামে পরিচিত ওই ছাত্র-যুবরা স্বাধীনতা ও সংস্কার আন্দোলনে অর্জিত গণতান্ত্রিক মূল্যবোধগুলি বিনির্মাণে নেমে পড়ে।
অবহেলিতা নারীজাতির প্রতি নবজাগৃতির এই অগ্রদূতের যে কী অপরিসীম সহানুভূতি ও সমবেদনা ছিল, তার প্রমাণ মেলে বিদ্যাসাগরের জীবনচরিত-এ বারবার। শুধু বিধবাবিবাহ নয়, নারীত্বের অবমাননাকারী কৌলিন্য প্রথার বিরুদ্ধে, বহুবিবাহের বিরুদ্ধে তাঁর সংগ্রাম এবং সর্বোপরি বেথুন স্কুলের সম্পাদনাকাল হতে পরবর্তীকালে জেলায়-জেলায় মেয়েদের স্কুল স্থাপনা— এ-সবকিছুই নারীমুক্তির অগ্রণী অভিভাবক ঈশ্বরচন্দ্র চরিত্রের এক অন্যতম বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছে।

—সোমেশ দাশগুপ্ত



মাইকেল এবং তাঁর ‘Vid’

উনিশ শতকের প্রথমার্ধে ইংরেজি শিক্ষার সংস্পর্শে আলোকপ্রাপ্ত দুই বাঙালি প্রতিভা— ঈশ্বরচন্দ্র এবং মধুসূদন, একই সংস্কারমুক্ত, যুক্তিবাদী মানসিকতায় গড়ে উঠেছেন, আধুনিক মানবতাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে। দুজনের কাজের মধ্যেই এই আদর্শবাদ এবং যুক্তিবাদী চেতনার স্বাক্ষর স্পষ্ট।

বিদ্যাসাগরের সীতার বনবাস এবং মাইকেলের মেঘনাদবধ কাব্য— এই উভয় রচনাতেই আর্যাবর্তের এ-যাবৎ কালের প্রধান নায়ক অযোধ্যার শ্রীরামচন্দ্র অবতারত্বের পদ থেকে নেমে সাধারণ মনুষ্যত্বের স্তরে এসে দাঁড়িয়েছেন।

সীতার বনবাস আলোচনার আগে আরও দুয়েকটি প্রাসঙ্গিক কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন। এক, সীতার বনবাস বিদ্যাসাগর মহাশয়ের অপেক্ষাকৃত পরিণত বয়সের রচনা। ১২৬৭ বঙ্গাব্দের ১ বৈশাখ (১৮৬০ এর ১৫ এপ্রিল) এর প্রথম প্রকাশ। রবীন্দ্রনাথের জন্মের এক বছর আগে। দুই, ওই ১৮৬০ সালের ২৪ এপ্রিল ঋষি রাজনারায়ণ বসুকে লেখা মধুসূদনের এক চিঠি থেকে জানতে পারি, তিলোত্তমাশর্মিষ্ঠা লেখার পরে মধুসূদনকে ‘একটি জাতীয় মহাকাব্য’, রচনার অনুরোধ জানিয়েছিলেন রাজনারায়ণ। তিন, ১৮৬৩-এর ২৪ এপ্রিল থেকে ১৮৬১-র জুনের মধ্যে মেঘনাদবধ কাব্য— প্রথম খণ্ড (প্রথম পাঁচটি সর্গ) লেখা হয়। রবীন্দ্রনাথের জন্মের পর-পরই।
vidyasagar.info ©