‘সাঁওতালরা তাঁকে তাদের ফসল উপহার দিত (শাকপাতা, কন্দ, মুল, কুদ্রুম), গরিবের যে-উপহার পেয়ে তিনি অশ্রপাত করেছেন। ১৮৮৮ অবধি তিনি কর্মাটাঁড়ে যেতেন, তার পরেও নিয়মিত খবরাখবর নিতেন ও মাসোহারা পাঠাতেন। বাংলোর মুখোমুখি, তাঁর প্রতিষ্ঠিত এই উপমহাদেশের প্রথম দাতব্য আদিবাসী বালিকা বিদ্যালয় ও দাতব্য হোমিও চিকিৎসালয় চালু রয়েছে।
—ড. অর্চনা বন্দ্যোপাধ্যায়
কুড়ি কুড়িকো নঁরঙা করমবুটে তিঁরিয়ঁ দ... (ওই শোনো মেয়েরা, করমগাছে করমবাঁশি বাজছে, চলো চলো) করো ত্বরা, করো ত্বরা, কাজ আছে মাঠ ভরা দেখিতে দেখিতে দিন আঁধার হবে। —রবীন্দ্রনাথ।
জীবনের শেষ দিকে বিদ্যাসাগর কর্মাটাঁড় (অর্থাৎ, বিস্তীর্ণ কর্মভূমি বা করমগাছ-এর ডাঙা)-এ আঠারো বছর সাঁওতালদের মধ্যে কাটান। (হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে, কর্মা নামে এক সাঁওতালের নামে কর্মাটাঁড়)। এখানে তিনি বিদ্যার গুরু নন, কর্মের পাহাড় করমবুরু বা কর্ম-দেবতা। ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চলের অনেক স্থানে বিভিন্ন গ্রামের এক নাম দেখা যায়, প্রধানত গাছের নামে, যেমন কর্মাটাঁড় (হলদু ও কেলিকদম), জামতাড়া, মাতকোমডিহি (মহুয়া), সারজংডিহি (শাল), সাপারমডিহি (শিউলিবনা)। এ ছাড়া, দুয়ারসিনি, যদুগোড়া, চকইচালান, ধুন্দিখাপ, ডাবা তোরাং, বাঘমুন্ডি, বুরুয়াকোচা, ঝালদা গ্রামগুলি ও আশপাশে কুমোরপাড়া, কামারপাড়া, পেটোপাড়া, তাঁতিপাড়া, গোয়ালপাড়ার বাসিন্দারা নিজেদের পেশা কাঠের কাজ, পাতার থালাবাটি, ঝুড়ি, খাটিয়া বোনার কাজ করে। কর্মনিপুণতা পরম্পরায় চর্চিত। চাষবাস, হস্তশিল্প হাটবারে কেনাবেচা, বিনিময় হয়। রোপণের পরের অবসরে, করম পরবের আগে, প্রধানত হস্তশিল্পের কাজ হয়।
হাওয়া বদল ও বিশ্রাম নিতে বিদ্যাসাগর বাঙালি-অধ্যুষিত দেওঘরের বড় বাড়ি কেনার চেয়ে নির্যাতিত, বিধ্বস্ত সাঁওতালদের মধ্যে থাকার জন্য এই কর্মাটাঁড়ের বৃক্ষবাগানসহ ছোট বাড়ি কেনা ঠিক করেন (১৮৬৯)। সাঁওতালরা ওখানকার সাত-আট ঘর দিকো (বহিরাগত) বা বাঙালিদের বিশ্বাস করত না, কারণ ভদ্রলোকদের কাছ থেকে তারা জিনিসের দাম বা শ্রমের মজুরি পেত না। বিদ্যাসাগর ন্যায্য মজুরি দিয়ে সাঁওতালদের আত্মীয়ের বিশ্বাস অর্জন করেন। সেই কালে প্রতি বছর হাজার টাকার বেশি খরচ করে কাপড়, শীতবস্ত্র, মোটা চাদর, কম্বল কিনে, কমলালেবু, খেজুর কলকাতা থেকে কিনে নিয়ে দিয়েছেন। রোগে ওষুধ, ভেষজ ও পথ্য দিয়েছেন। নিজ হাতে জমাদারনি কলেরা রোগীর, সাঁওতাল বালকের মলমুত্র পরিষ্কার করতে দ্বিধা করেননি। দুপুর রোদে তিন মাইল হেঁটে সাঁওতাল বালকের চিকিৎসা করেছেন। শিক্ষা, কর্ম, আনন্দে ভরা তাঁর বাগানবাড়ি। তাঁরই দেওয়া নাম নন্দন কানন-কে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ‘মহর্ষির আশ্রম’ বলেছেন। নন্দন কাননে সকালে আম, লতানে আমের কলম ও আরও নানা ফলবৃক্ষরোপণ, বাগানের কাজ এবং খাওয়াদাওয়ার পরে আনন্দের নাচ হতো।