মোট পৃষ্ঠাদর্শন

    ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
        মাইকেল মধুসূদন দত্ত

  বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে।
  করুণার সিন্ধু তুমি, সেই জানে মনে,
  দীন যে, দীনের বন্ধু!—উজ্জ্বল জগতে
  হেমাদ্রির হেমকান্তি অম্লান কিরণে।
  কিন্তু ভাগ্যবলে পেয়ে সে মহা পর্বতে,
  যে জন আশ্রয় লয় সুবর্ণ চরণে,
  সেই জানে কত গুণ ধরে কত মতে
  গিরীশ। কি সেবা তার সে মুখ সদনে।—
  দানে বারি নদীরূপ বিমলা কিঙ্করী;
  যোগায় অমৃত ফল পরম আদরে
  তরুদল, দাসরূপ ধরি;
  পরিমলে ফুলকুল দশ দিশ ভরে;
  দিবসে শীতল শ্বাসী ছায়া, বনেশ্বরী,
  নিশার সুশান্ত নিদ্রা, ক্লান্তি দূর করে!

করমবুরু

‘সাঁওতালরা তাঁকে তাদের ফসল উপহার দিত (শাকপাতা, কন্দ, মুল, কুদ্রুম), গরিবের যে-উপহার পেয়ে তিনি অশ্রপাত করেছেন। ১৮৮৮ অবধি তিনি কর্মাটাঁড়ে যেতেন, তার পরেও নিয়মিত খবরাখবর নিতেন ও মাসোহারা পাঠাতেন। বাংলোর মুখোমুখি, তাঁর প্রতিষ্ঠিত এই উপমহাদেশের প্রথম দাতব্য আদিবাসী বালিকা বিদ্যালয় ও দাতব্য হোমিও চিকিৎসালয় চালু রয়েছে।

—ড. অর্চনা বন্দ্যোপাধ্যায়

              কুড়ি কুড়িকো নঁরঙা করমবুটে তিঁরিয়ঁ দ...
              (ওই শোনো মেয়েরা, করমগাছে করমবাঁশি বাজছে, চলো চলো)
              করো ত্বরা, করো ত্বরা, কাজ আছে মাঠ ভরা
              দেখিতে দেখিতে দিন আঁধার হবে।         —রবীন্দ্রনাথ।


জীবনের শেষ দিকে বিদ্যাসাগর কর্মাটাঁড় (অর্থাৎ, বিস্তীর্ণ কর্মভূমি বা করমগাছ-এর ডাঙা)-এ আঠারো বছর সাঁওতালদের মধ্যে কাটান। (হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে, কর্মা নামে এক সাঁওতালের নামে কর্মাটাঁড়)। এখানে তিনি বিদ্যার গুরু নন, কর্মের পাহাড় করমবুরু বা কর্ম-দেবতা। ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চলের অনেক স্থানে বিভিন্ন গ্রামের এক নাম দেখা যায়, প্রধানত গাছের নামে, যেমন কর্মাটাঁড় (হলদু ও কেলিকদম), জামতাড়া, মাতকোমডিহি (মহুয়া), সারজংডিহি (শাল), সাপারমডিহি (শিউলিবনা)। এ ছাড়া, দুয়ারসিনি, যদুগোড়া, চকইচালান, ধুন্দিখাপ, ডাবা তোরাং, বাঘমুন্ডি, বুরুয়াকোচা, ঝালদা গ্রামগুলি ও আশপাশে কুমোরপাড়া, কামারপাড়া, পেটোপাড়া, তাঁতিপাড়া, গোয়ালপাড়ার বাসিন্দারা নিজেদের পেশা কাঠের কাজ, পাতার থালাবাটি, ঝুড়ি, খাটিয়া বোনার কাজ করে। কর্মনিপুণতা পরম্পরায় চর্চিত। চাষবাস, হস্তশিল্প হাটবারে কেনাবেচা, বিনিময় হয়। রোপণের পরের অবসরে, করম পরবের আগে, প্রধানত হস্তশিল্পের কাজ হয়।

হাওয়া বদল ও বিশ্রাম নিতে বিদ্যাসাগর বাঙালি-অধ্যুষিত দেওঘরের বড় বাড়ি কেনার চেয়ে নির্যাতিত, বিধ্বস্ত সাঁওতালদের মধ্যে থাকার জন্য এই কর্মাটাঁড়ের বৃক্ষবাগানসহ ছোট বাড়ি কেনা ঠিক করেন (১৮৬৯)। সাঁওতালরা ওখানকার সাত-আট ঘর দিকো (বহিরাগত) বা বাঙালিদের বিশ্বাস করত না, কারণ ভদ্রলোকদের কাছ থেকে তারা জিনিসের দাম বা শ্রমের মজুরি পেত না। বিদ্যাসাগর ন্যায্য মজুরি দিয়ে সাঁওতালদের আত্মীয়ের বিশ্বাস অর্জন করেন। সেই কালে প্রতি বছর হাজার টাকার বেশি খরচ করে কাপড়, শীতবস্ত্র, মোটা চাদর, কম্বল কিনে, কমলালেবু, খেজুর কলকাতা থেকে কিনে নিয়ে দিয়েছেন। রোগে ওষুধ, ভেষজ ও পথ্য দিয়েছেন। নিজ হাতে জমাদারনি কলেরা রোগীর, সাঁওতাল বালকের মলমুত্র পরিষ্কার করতে দ্বিধা করেননি। দুপুর রোদে তিন মাইল হেঁটে সাঁওতাল বালকের চিকিৎসা করেছেন। শিক্ষা, কর্ম, আনন্দে ভরা তাঁর বাগানবাড়ি। তাঁরই দেওয়া নাম নন্দন কানন-কে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ‘মহর্ষির আশ্রম’ বলেছেন। নন্দন কাননে সকালে আম, লতানে আমের কলম ও আরও নানা ফলবৃক্ষরোপণ, বাগানের কাজ এবং খাওয়াদাওয়ার পরে আনন্দের নাচ হতো।

সাঁওতালি গ্রামেও যেতেন সেই সময়ের পৈতাধারী ব্রাহ্মণ। সহজ, সরল মানুষদের দুঃখ দিতে না-চাওয়া বিদ্যাসাগর সাঁওতালদের দেওয়া মুরগিছানা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়েছেন, তাঁকে ঘিরে চলেছে আনন্দের নাচ। সাঁওতাল মেয়েরা কোনো বহিরাগত দিকোর কাছে যায় না, কিন্তু বিদ্যাসাগরের কাছে তাদের কোনো সংকোচ ছিল না। তিনিও সেখানে মানুষের প্রতি বিশ্বাস ফিরে পেয়েছিলেন। নন্দন কাননে তিনি স্কুল করেছেন (১৮৭৩)। কিন্তু সাঁওতালদের শিক্ষার মাধ্যম বা বিষয় কী ছিল? বাংলা ভাষার জনক সেখানে বসে বর্ণপরিচয়-এর নতুন সংস্করণ করছেন, কিন্তু সাঁওতালদের কী পড়াতেন তিনি? তাঁর কথা একজন মহিলা বুঝত, বাকিরা বাংলা বুঝত না। সেই একজন মহিলা অন্যদের বুঝিয়ে দিত। লিপিহীনদের ওপর নতুন লিপি ও সংস্কৃতির বোঝা চাপিয়ে দেননি। পরিশ্রম নিয়ে বহু পূর্বে নীতিবোধ (১৮৪১)-এ তাঁর লেখা—

যে দেশের লোক শ্রমবিমুখ হইয়া কেবল যদৃচ্ছালব্ধ ফলমূল অথবা মৃগয়ালব্ধ মাংসদ্বারা উদরপূর্তি করে তাহারা অসভ্য। ...তাহারা অতি কষ্টে কালযাপন করে, উত্তমরূপ ভক্ষ্য ও পরিধান পায় না এবং অসময়ের নিমিত্ত কোন সংস্থান করিয়া রাখে না, এজন্য সর্বদাই ভূরি ভূরি লোক অনাহারে প্রাণত্যাগ করে। ...পশুপালন, কৃষি, বাণিজ্য ইত্যাদি নানা উপায় দ্বারা তাহারা যেরূপ সুখ স্বাচ্ছন্দে কাল যাপন করে, তাহা অসভ্য জাতির স্বপ্নের অগোচর। ..ফলতঃ যে জাতি যেমন পরিশ্রম করে তাহাদের অবস্থা তদনুসারে উত্তম হয়। ...প্রতিদিন দশ ঘন্টা পরিশ্রম করিলে স্বাস্থ্যভঙ্গের সম্ভাবনা নাই।

কর্মগুরু তাদের পরম্পরার বিশাল জ্ঞানভাণ্ডারের ভিত্তিতে আম, অন্যান্য ফল ও ভেষজ গুল্মের বাগান করাতেন। কর্মাটাঁড়ে ধান চাষ নয়, ভুট্টা চাষ হতো। রুক্ষ, কাঁকুড়ে মাটিতে কাঁকড়, পাথর সরিয়ে, কলম রোপণ করিয়ে কৃষিশিক্ষা দিয়েছেন। করমগুরু তাদের নাচগানেও উৎসাহ দিয়েছেন।
        করমতিঁরিয় আনজমকাতে সেরমা রাসকায়েনা।
        ওরাতেপে বাকএ তাহেনা।
        ঝিজপেদুয়ার ঝিজপেদুয়ারপে।
        ভাবার্থ : মাঠের বাঁশি শুনে শুনে আকাশ খুশি হল।
                ঘরেতে আজ কে রবে গো,
                খোলো দুয়ার খোলো।
‘সাঁওতালরা তাঁকে তাদের ফসল উপহার দিত (শাকপাতা, কন্দ, মুল, কুদ্রুম), গরিবের যে-উপহার পেয়ে তিনি অশ্রপাত করেছেন। ১৮৮৮ অবধি তিনি কর্মাটাঁড়ে যেতেন, তার পরেও নিয়মিত খবরাখবর নিতেন ও মাসোহারা পাঠাতেন। বাংলোর মুখোমুখি, তাঁর প্রতিষ্ঠিত এই উপমহাদেশের প্রথম দাতব্য আদিবাসী বালিকা বিদ্যালয় ও দাতব্য হোমিও চিকিৎসালয় চালু রয়েছে। প্রথম তাঁর নামে ঔষধালয় স্থাপিত হয় বউবাজারে হিদারাম ব্যানার্জি লেনে।’ (বিনয় ঘোষ, সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র।) ‘তাঁকে আমরা দেশ, ভাষা, লোকহিত, দয়া ও সমাজসংস্কারকের ভূমিকায় চিনি। সাঁওতালদের সঙ্গে তিনি কর্মযোগে এক হয়ে, হৃদয় দিয়েছেন, ধর্মসংস্কার করেননি। জাত্যাভিমান বা জন্ম নিয়ে তাঁর কোনো অহংকার ছিল না।’ (ডা.মহেন্দ্রলাল সরকার, দ্য মেসেঞ্জার পত্রিকা।)

বিদ্যাসাগের তিরোধানের পর অমৃতলাল বসুর লেখা নাটকের তৃতীয় দৃশ্যে সাঁওতালদের গান :
        কি কঠিন জান তোর দেও রে। যমরাজা হামরা বাপ ছিনি নিলি রে।
        সাগর মোদের বাবা, সে সাগর মোদের মা গেল।
        বাপ মাতারি মোরা কোথা যাইরে।
        পণ্ডিত বাবা যেমন মিলে না দুটো তেমন।
        জ্বলা কপাল সাঁওতাল কে আর পালেরে। কে মেলাবে আর মুঠা ভাত।
        ঘুমবে কে আর লিয়ে হাত, জঙ্গলী জানা ফের জঙ্গলী হব রে।
‘সাঁওতাল করিলেন ভগবান’ গানের মতো মাস্টারের কানমলা খেতে হয়নি তাদের বিদ্যাসাগরের কাছে। হয়তো ভেবেছিলেন, সাঁওতাল সমাজের চেয়ে শিক্ষিত সমাজসংস্কারের প্রয়োজন ঢের বেশি, যা এখনও প্রাসঙ্গিক।

সাঁওতালদের মধ্যে মূর্তিপূজা, মন্দির নেই (ছিল না), আছে বৃক্ষ-অরণ্যমা বন্দনা। করম পরবের মূল কথা_ শুভ কর্মই ধর্ম, জীবন, আনন্দ। পূর্ণিমা রাতের চন্দ্রদেবতা, বসন্তের পুষ্পিত অরণ্যমা (জাহের এরা) ও সূর্যদেবতাকে শালফুলের অর্থ দিয়ে ‘বাহা’ পরব। অন্য সাঁওতালি মতে, বাহা পরব সুর্বদেবতার সঙ্গে ধরিত্রী মাতার ফুলের অর্ঘ্য নিবেদিত বিবাহ উৎসব। এই নাচে-গানে আনন্দ আছে, চপলতা নেই। কেউ অশোভন আচরণ করলে তাকে বের করে দেওয়া নিয়ম। সাঁওতাল মেয়েরা বলে, চারদিকে গাছে-ফুলে এত রং না-দেখে বোকা দিকুরা নিজেরা রং মাখে।

পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বীরভূমের অরণ্যলগ্ন পঞ্চাশটি গ্রামের সাঁওতাল ও অন্যান্য অধিবাসীদের নিয়ে ও ছোটনাগপুর অঞ্চলের সার্ভেয়ার নরেন্দ্রনাথ রায়চৌধুরী, তাঁর কন্যা ফুলু, পুরুলিয়ার গ্রামোন্নয়নে রাজ্য পরিকল্পনা পর্ষদ নিযুক্ত বিশেষজ্ঞ সন্তোষকুমার, বিশ্বভারতীর প্রাক্তন উপাচার্য সুরজিৎ সিংহ, সান্মানিক সাঁওতালি ভাষার অধ্যাপক বড়কা সোরেন, স্থানীয় জনজাতি মেয়েরা ও তাদের বংশপরম্পরায় চলে আসা গান— এদের থেকে চার দশক ধরে তথ্য পেয়ে জেনেছি, আদিবাসীদের দেবতা বড় পাহাড় বা মারাংবুরু, সূর্য ও চন্দ্র, নদী, সর্বোপরি অরণ্যমা জাহের এরা (সাঁওতাল), সারণা (ওরাও), ধরতি মায়ে (মুন্ডা), যেন জননী বসুন্ধরা। অরণ্য মায়ের রক্ষক কর্মদেব, কেলিকদম, হলদু বা করম গাছে তাঁর বাস। বাকি উপদেবতা বা বোঙা পরে এসেছে।

ঝাড়খণ্ড, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া ও বীরভূমের পঞ্চাশটি গ্রামের ওঝা (কবিরাজ)-বৃন্দ, যথা লখই, বেবে, চরে ও সোম মুর্মু, কালী মারান্ডি, উপেন কিস্কু, চুকু জানগুরু, কুবরাজ হেমব্রম, লবাই টুড়ু, সুমি মুর্মু, ফুলমণি, পাকু হেমব্রম (বীরভূম), সত্যভামা সিংসরদার, মাতাল কিস্কু, মঙ্গল মুর্মু গৌর হাঁসদা (পুরুলিয়া) প্রমুখের কাছ থেকে সাঁওতালি চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যবিধি বিষয়ে তথ্যসংগ্রহ করে রেভারেন্ড বোডিংয়ের বইয়ের সঙ্গে তুলনা করেছি। বোডিং জামতাড়া অঞ্চলের সাঁওতালদের ভাষা ও ভেষজ-জ্ঞানের বিশেষ প্রশংসা করেছেন। কিন্তু আমার ক্ষেত্রসমীক্ষার কোথাও বোডিং-বর্ণিত ‘কামরুগুরু’ কামরূপ-কামাখ্যার বশীকরণ মন্ত্রতন্ত্রের সন্ধান পাইনি, সর্বত্রই ‘করমবুরু’ বা ‘করমগুরু’-র কথা শুনেছি।

করম শুরু মোরগডাকা ভোরে। ধরিত্রী ও সূর্যদেবের জোহার সেরে, ভাত খেয়ে স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে কাজে যাওয়া। সারা দিন কাজের পারিশ্রমিক নিয়ে সূর্যাস্তের রাঙা আলোয় ঘরে ফেরা। তখন সমবেত আনন্দে প্রাচীন অথবা স্বভাবকবি মেয়েদের স্বরচিত গান গাওয়া। সমাজবদ্ধ জীবন। সঞ্চয় নেই স্বভাবে। সামান্য উদ্বৃত্ত টাকায়, পরবে, গ্রামসুদ্ধ ভাগ করে খাওয়া।

করমগুরু বিদ্যাসাগর দিনে ঘুমোতেন না, রাত্রেও কাজ করতেন, যতক্ষণ-না লেখা নিখুঁত হয়। অজস্র আয় করেছেন, দু’হাতে সদ্ব্যয় ও দান করেছেন। দেশি খাদ্য আপন হাতে প্রস্তুত করে সবার সঙ্গে ভাগ করে খেয়েছেন। রোগীদের পথ্য নিজে হাতে তৈরি করে খাইয়েছেন। ঠাকুরমা দুর্গা দেবী, মা ভগবতী দেবী সুতো কেটেছেন, বিদ্যাসাগর দেশি বস্ত্র পরিধান ও দান করেছেন।

শালবনে চিহড়লতার বনে ছিল বীরহড় (বনবাসী) আদি মানুষের বাস, অসংখ্য পাথর ঘিরে আছে নানাবিধ লতা, মেটে আলু, গুল্ম, আতেনা, শক্ত কাষ্ঠল চিহুঁত/নেড়িমুরুপ (লতাপলাশ), চিহড় বা লতাকাঞ্চন। এই লতার খাঁজকাটা পাতার পোশাকে তারা শীত-বর্ষা কাটাত। শালগাছ বেয়ে এ-গাছ, ও-গাছে অনেক দোলনা বানিয়ে ওপরে উঠে গেছে এই চিহড়লতা গং (অরণ্যমা), মারাংবুরু বা শিবের প্রতীক পাথর ঘিরে, তলায় বৃষ্টির জল সঞ্চিত হয়ে, জলধারা মিলে ঝরনা, নদীর সৃষ্টি। বৃক্ষের অভাবে লতা, গুল্ম, বীরৎ-এর অভাবে পাথরের ধ্বস নামে, নেড়া পাহাড় জলধারা ধরে রাখতে পারে না, বানে ভেসে যায়। ভূগোল খগোল বর্ণনম-এ বিদ্যাসাগর আধুনিক বৈজ্ঞানিক ভূগোলের বিবরণ দিয়েছেন। অমিয় কুমার সামন্ত তাঁর বইতে রাঢ়ভূমিতে ব্রিটিশ শাসক কর্তৃক অরণ্য উচ্ছেদ, ফলে নদীখাত ও নদীর গতি পরিবর্তন, জমিদারদের দেওয়া নদীবাঁধের প্রকোপে বন্যা, বদ্ধ জলে স্থানীয় গ্রামবাসীদের চাষবাস জীবন-জীবিকার দুরবস্থা, রোগব্যাধি ম্যালেরিয়া, কলেরা ইত্যাদি ও তার নিরাময়ে বিদ্যাসাগরের ভূমিকা সম্পর্কে লিখেছেন।

নববর্ষ আসে মাঘ মাসে, যখন অরণ্যের সব পাতা ঝরে গিয়ে বাসন্তী বন্দনায় প্রস্তুত হয় অরণ্য। জৈষ্ঠ মাসে অরণ্য-ষষ্ঠী, শিশুদের ও চারা গাছদের কল্যাণে অরণ্য মায়ের পূজা। রোহিণী নক্ষত্র দেখে ‘রোহিণ’ পরব। নানারকম বীজ সংগ্রহ করে বৃষ্টি শুরুর সঙ্গে শুরু হয় বীজ ছড়ানোর পরব রোহিণ (যা এখন শুধুই ধানের বীজ বা এরো)। অসংখ্য গান গাওয়া হতো, যাদের অর্থ, কাঁচা ফল পেড়ো না, কাঁচা ফল তেতো, টক, পাকা ফল খাও, বীজ রাখো রোদে, সিংবোঙা তাপ দেবে, বৃষ্টি দেবে জল, মাটি মায়ের কোলে বেড়ে উঠবে ছোট চারা। চারদিকে অজস্র পাখি, কাঠবিড়ালি, বানর, পশুপাখি, না-মানুষ প্রাণিরা অক্লান্ত বীজবিস্তারে নিজেদের দায়িত্ব পালন করে চলেছে, যা ভুলে গেছে ইতিহাসলিপিহারা আদিবাসীরা। এই বিবরণের প্রধান উৎস শ্রুতি, বংশপরম্পরায় চলে আসা আদ্যিকালের গান, সাঁওতাল মেয়েরাই যার রচয়িতা। নানা ফলের বীজ সংগ্রহ করে গ্রামে রাস্তার টোকাই বাচ্চাদের রং মেখে বাঘ, বানর, ভাল্লুক সাজিয়ে নিয়ে হয় রোহিণ পরব।

ফুল ফোটা শেষে ফল আসা, ফল পাকা, বীজ গঠন, বীজবিস্তার হয় জলে-হাওয়ায় ও প্রাণীদের (মানুষসহ) সহায়তায়। প্রকৃতি ও অরণ্যের নবজন্মোৎসব সম্ভাবনার রোহিণ ও অরণ্য-ষষ্ঠী (পাহাড়, শিলাখণ্ড, জঙ্গলের পূজা মেয়েরা করে)। এর পর ধানের বীজ ছড়ানো এরো (সাঁওতালি)। শ্রাবণ মাসে রোহয় বা রোপণ, এখন যা প্রধানত হোরোরোহয় বা ধান রোপণ। সাঁওতালরা যে যেখানেই থাকুক, ছুটি নিয়ে বা পালিয়ে গিয়ে এতে অংশ নেয়। এর পরের সময়ে শাকপাতা ও ছাতু সংগ্রহ হয়। জলে, আর্দ্রতায়, তাপে, প্রাণের পুণ্যে সবুজ শ্যামলিমায় ভরে ওঠে বসুন্ধরা, সব ক্ষত সেরে যায়। সজল হাওয়ায় দূর-দূরান্তরে ডানা মেলে উড়ে-উড়ে শাল অরণ্যে বীজবিস্তার হয়। আদিবাসীদের করমদেব বিশ্বকর্মা, কিন্তু বৃক্ষ ও প্রকৃতিকেন্দ্রিক। এই পরবে করম, শাল (সারি করম), কদম, মহুয়া, নিম ইত্যাদি দেশি গাছ ও অঙ্কুরিত শস্যের বন্দনা করা হয়।

ছেলেদের সাজ হলুদে ছোপানো ধুতি, ফতুয়া, গামছা, মেয়েদের লুঙ্গি, গামছা-পঞ্ছি কিংবা শাড়ি, নিজেদের ধরনে সহজভাবে পরা। রূপার গহনা ও মাথায় ফুল।

নাচ শিশুকাল থেকে দেখে শেখা, সুসংহত ছন্দে পা ও দেহ সঞ্চালন, যেন আন্দোলিত পল্লবিত তরুশ্রেণি। নাচ সমবেত, প্রকৃতি-অরণ্য জাহের মা-কে নিবেদিত, কর্ম ও আনন্দের প্রকাশ। মেয়েরা একা দেখনদারির নাচ নাচে না। তাদের সমবেত নাচের পবিত্র আনন্দ বিদ্যাসাগর উপভোগ করেছেন। দেশজ পোশাকের ধারাও চিরকাল বজায় রেখেছেন।

সাঁওতাল মেয়েদের পুনর্বিবাহ, বিধবাবিবাহ চিরকাল প্রচলিত। পণ তো দিতেই হয় না, উল্টে মেয়ের মা অনেক কিছুই পায়। গানেই আছে—‘কালোম জাঁওয়াই উঁচেরো’ (এ জামাই নেশা করে, আগামী বছর জামাই পাল্টে নেব)। বিদ্যাসাগর কর্মাটাঁড়ে চব্বিশ জন বালবিধবার বিবাহ দিয়েছেন বলে শোনা যায়।

মেয়েদের পর্দানশিন গৃহবন্দি জীবনের ঠিক বিপরীত প্রকৃতি, শিশু বালিকা নারীকেন্দ্রিক উৎসব অরণ্য-ষষ্ঠী, জাহেরা, সারণা সোহরায় সারা বছর জুড়ে আবর্তিত হয়। জাহেরা অর্থ অরণ্যমা; নবপত্রিকা (শাকম্ভরী মা দুর্গা) বা জননী বসুন্ধরা। বিল্ববৃক্ষমূলে ডালিম, কদলী, কেউ কচু শস্য দূর্বাঘাস, অর্থাৎ চার-পাঁচ স্তরে বনস্পতি— বৃক্ষ, গুল্ম, বীরুৎলতা নিয়ে মাটি পাথর আঁকড়ে ধরা অরণ্য; সিংহ, হাতি, ময়ূর, হাঁস, পেঁচা সর্প, মহিষ, নীলকণ্ঠ পাখি প্রাণীকুল নিয়ে বসুন্ধরা মা দুর্গা দশপ্রহরণধারিণী, দশ হাতে দশ দিক থেকে, অসুর থেকে, অশুভ শক্তি থেকে, ভোগবাদ-দূষণ থেকে সৃষ্টিরক্ষা করে চলেছেন। পুরুলিয়ায়, সরাইকেলায়, ময়ূরভঞ্জে ছৌ নাচে, হরপার্বতী, রাবণবধ বা অন্যান্য পালার চেয়ে বেশি হয় মা দুর্গার অসুরবধ। প্রকৃতি মায়ের কোলে সমস্ত জীবকুল একসূত্রে বাঁধা। মাতৃভক্ত বিদ্যাসাগরের মায়ের কথায় চোখের জল বাঁধ মানত না। চারশো আটটি শ্লৌকে তিনি বসুন্ধরার ভূ-বিবরণ দিয়েছেন।

ইদানীং লালমাটির সর্বত্র স্কুল কলেজে যাওয়া, সাইকেল চড়া, ফুটবল খেলা, হাসিখুশি মেয়েদের দেখা মেলে, তারা গৃহকাজ, কৃষিকাজেও সমান পটু। অরণ্য-ষষ্ঠটীর বদলে জামাই খাতির, রূপোর বদলে সোনার গহনা, কন্যাপণের বদলে বরপণ চালু হয়েছে। হুল পালিত হয়, কিন্তু সিদো, কানু, চাঁদ, ভৈরবের সঙ্গে উল্লেখ করা হয় না তাঁদের বোন অসীম সাহসিনী ফুলু, ঝুনুর কথা। আচার-উপচার, অর্থ, সময়ের অপচয়ে, লাউডস্পিকারে আলো শব্দ দূষণ করে, হুল বাঁধনা করমা বাহা পালন করা হয়। ওষধি-বনস্পতি নয়, মন্ত্র-ডাইনে বিশ্বাসী। জাহের মা, সারণা বা অরণ্যমা, যেখানে দেশজ গাছ ছাড়া সব কৃত্রিম গঠন নিষিদ্ধ, সব ভুলে আমাদের অনুকরণে গাছ বাঁধানো, গাছ কেটে মন্দির, মূর্তিতে, নিজেদের ‘জাতে তোলা’-র ব্যবস্থা করছে।

কর্মাটাঁড়ে বিদ্যাসাগর পিতামাতার ছবি ছাড়া ছবি বা মূর্তিপূজা করেননি, মূর্তি, মন্দির প্রতিষ্ঠা করেননি। দেশি পোশাক তাঁর আত্মমর্যাদার প্রতীক। সাহেবিয়ানাকে ঘৃণা করেছেন, কিন্তু মার্শাল, বেথুন, ময়েটের প্রতিকৃতি আঁকিয়ে দেওয়ালে রেখেছেন। সাঁওতাল সমাজের সারল্য সততা, স্বল্পে সন্তোষ, সমাজ-দলবদ্ধতা ও প্রকৃতিকেন্দ্রিক উৎসবের আনন্দ তিনি উপভোগ করেছিলেন। তাদের তিনি ‘আমার সাঁওতাল’ বলে উল্লেখ করতেন।

নানা করম পরবের প্রধান হলো মঁরে করম। সাঁওতালরা মৃত মানুষের কোনো ছবি, মূর্তি, চিহ্ন রাখে না। কেউ মারা গেলে ওই বছরের ভাদ্র শুক্লা একাদশীতে তার নামে ডাল বা বৃক্ষচারা পুঁতে অরণ্যমা জাহেরা ও তাঁর রক্ষক করমদেবকে আহ্বান করা হয়। তিনি যেন তাকে গ্রহণ করেন, জলে, ডালে হাওয়ায়, পাতায়-পাতায়। ইতিহাসলিপিহারা সাঁওতালদের মধ্যে এখনও বয়ে চলেছে এই প্রকৃতিবন্ধু মঁরে করমের ধর্ম, অসংখ্য প্রাচীন গানের মাধ্যমে, যথা :
        তাঁহারিতা নানা হো, নুতুমতে (মৃত ব্যক্তর নামে) মাতকোম খুন্টি বীর আকাদা।
        দেলাবোন বীর ওতে/গড়িওতে/উম নড়কো হাসাবেন উম হাজুয়া।
        জসিন আতো কুড়ি কোড়াবোন জমর জুমর।
        কুড়ি কোড়া জোড়জোলা তাহেকান, জড়জোলা জড় ভাঙাবেন।
        অদমদলে ইপিলি ন/অদমদলে কয়রা বাখালেন।
(গ্রামের ছেলেমেয়েরা, এসো, বৃক্ষরোপণ করম বাঁশিতে দলে দলে নাচো, একদিন সব দল, সব জোড় ভেঙে যাবে, যার যেমন করম, তেমন থাকবে, কেউ কলার চারায়-পাতায়, কেউ আকাশের তারায়-তারায়)। বাছুর যেমন মা-কে ছাড়ে না, করম তেমন মানুষকে ছাড়ে না। একই কথা বৌদ্ধ সংস্কৃতিতেও বলা হয়েছে।

রবীন্দ্রনাথ ১৮৯৩ সালে কর্মাটাঁড়ে দু’-বার যান ভাদ্র ও আশ্বিন মাসে। সেখান থেকে ভাইঝি ইন্দিরাকে চিঠি লেখেন। চিঠিতে সব ছেড়ে কেবল কাজ করার কথা লিখেছেন। পরবর্তীকালে কর্মাটাঁড়ের কর্মধারার প্রেরণায় সাঁওতালবন্ধু পিয়ারসনকে সেখানে পাঠিয়েছেন। বোডিং পিয়ারসনের কাছে জামতাড়ার সাঁওতালি ভাষা ও চিকিৎসা-পদ্ধতির প্রশংসা করেছেন। বিদ্যাসাগরের প্রভাবেই কি সাঁওতালদের সেই আত্মবোধের উন্নতি হয়েছিল, যা এখন বিস্মৃত? নিজে সংস্কৃত কলেজে উন্নত আয়ুর্বেদ পাঠক্রম রেখেছেন, হাঁপানির ওষুধ ব্লাটা ওরিয়েনটেলিস, সাপ ও বিছার বিষের ওষুধ লেক্সিন এবং নিজের যকৃৎ ক্যানসারের ওষুধ নিয়ে কাজ করেন, যে-তথ্য উত্তরাধিকারে মিহিজামে আছে। তিনি হোমিওপ্যাথিচর্চা ও গবেষণার সঙ্গে আ্যালোপ্যাথি ও আযুর্বেদচর্চা করেছেন। ভেষজ পথ্য ও লঘু আমিষ পথ্য প্রয়োগ করেছেন। ১৯৩৭ সালের ১৪ অগস্ট শান্তিনিকেতনের নিকটবর্তী সাঁওতালি গ্রামে হলকর্ষণ ও বৃক্ষরোপণ উৎসব হয়, কবিই পৌরোহিত্য করেন। বন্ধু পিয়ারসন, কালীমোহন ঘোষ, সন্তোষচন্দ্র মজুমদার প্রমুখ তাঁরই নির্দেশে সাঁওতাল-সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করেন। পিয়ারসন সাঁওতালদের আপন করে নিয়েছিলেন। শ্রীনিকেতনে বিশ্বকর্মা পূজার দিন শিল্পোৎসব প্রচলন করেন রবীন্দ্রনাথ। যেন করম উৎসবের রূপ।

বিদ্যাসাগরের ভাই ঈসানচন্দ্রের পুত্র মিহিজামের পরেশ ব্যানার্জি ও ঈশানচন্দ্রের দৌহিত্র, মিহিজামের বিজয়কান্ত রায়চৌধুরী ১৯৩৪ সালে প্রকাশিত পথের কথা বইটি রবীন্দ্রনাথকে উৎসর্গ করেছেন। ভূমিকায় বিজয়কান্তের গ্রামোন্নয়ন ভাবনার বিশেষ প্রশংসা করেছেন আচার্য প্রফুল্পচন্দ্র রায়। গ্রামীণ অর্থনীতি, সমবায়নীতি ও ব্যাঙ্কিং নিয়ে বিজয়কান্তের ভাবনা বাস্তব। চাষের কথা অংশে তিনি বিস্তারিতভাবে কৃষি, বাগান, সেচ, সার, জমি মাটির চরিত্র বদল না-করে স্থান উপযোগী চাষের বৈজ্ঞানিক বাস্তব চিন্তা করেছেন। দক্ষিণের নদীপারে নারকেল, তরমুজ চাষ ও অনূর্বর ভূমিতে বাবুই ঘাস, নানাবিধ সবজি চাষ, কলা, রেশম, মৎস্য, চিনি, দুগ্ধ উৎপাদনের পথ, পাটচাষ নিয়ন্ত্রণের কথা, শস্য চালান না-দিয়ে স্থানীয় ভাবে সদ্ব্যবহার ও উদ্বৃত্ত শস্য চালান দেবার কথা বলেছেন। আরামপ্রিয়তা ও সহজে বড়লোক হবার বিপদ, যক্ষাসমস্যা, কলকারখানা, জগতের প্রগতি, আদর্শ ও জগৎ, গ্রাম ও স্বাস্থ্য, কল্যাণের পথ নিয়ে লিখেছেন। কৃষি, স্বাস্থ্য, অন্যান্য ভাবনায় তিনি বিদ্যাসাগরের উত্তরসাধক। চিকিৎসা-সোপান নামে তাঁর বইতে বিদ্যাসাগরের ধরনে বায়োকেমিক ও হোমিও-চিকিৎসার কথা আছে। রবীন্দ্রনাথ এ-ধরনেরই চিকিৎসা করতেন।

সংস্কৃতি, অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, স্বাস্থ্যে রবীন্দ্রনাথ বুদ্ধ ও বিদ্যাসাগরের ধারা অনুসরণ করেছেন, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়কে তিনি এ-কথা জানিয়ে ছিলেন। বিবেকানন্দ নিবেদিতাকে বলেছিলেন যে তাঁর আদর্শ বিদ্যাসাগর। বিদ্যাসাগর চিঠি দিয়ে শিক্ষাদানে প্রহার ও নির্যাতন নিষেধ করেছিলেন। অথচ শহর, গ্রামে এখনও তা বন্ধ হয়নি। রিপন কলেজের সভায় ও পরে আশুতোষ, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ। যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর (১৮৩৭) বলেছিলেন, ‘বিদ্যাসাগর কলকাতার বাঙালি সমাজের অভিভাবক।’ সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, ‘ঈশ্বরচন্দ্র পথ সকলেরই অনুকরণযোগ্য, বিশেষ করে ছাত্রদের তা অবশ্যই গ্রহণ করা উচিৎ।’

ভারতে পাঁচ হাজার বছর আগে হরপ্পা (হর-মানুষ)-য় ও বৌদ্ধ যুগে বৃক্ষপূজার স্মারক পাওয়া গেছে। দেশজ অরণ্যসম্পদ, উর্বর জমি, মিষ্টি জল, বিশাল শস্য ও জীববৈচিত্র ভাণ্ডার, সৌরশক্তি ও সব কিছুর সঙ্গে মেলানো আদিকাল থেকে চলে আসা লোকসংস্কৃতি উৎসব রোহিণ, রোপণ এবং সারি করম বা সত্যকর্মের ক্রমবিকাশের ধারা বহমান।

অরণ্যের কাছাকাছি গ্রামগ্তলিতে এখনও আছে জাহের থান। সেখানে অন্তত পাঁচটি স্থানীয় সুপ্রাচীন বৃক্ষ দেখা যায়—শাল, সারি সারজং বা সত্যধর্ম বৃক্ষ। জাহের এরা একমাত্র দেবী (আর সব বোঙা বা উপদেবী)। এই অরণ্যমা নিরাকার নন, সাকার মুর্তি নন, বাস্তব জীবনদাত্রী প্রাণের পুণ্যে ভরা শক্তি, পঞ্চভূত মাটি, জল, তাপ, বাতাস, আকাশ নিয়ে তাঁর প্রতিষ্ঠা। বিদ্যাসাগর বোধোদয়-এর পরিবর্তিত সংস্করণের প্রথমে বলেছেন— ‘ইতস্তত পরিদৃশ্যমান বস্তসমূহ’-মধ্যে ঈশ্বর। বীরসিংহ গ্রামে ঠাকুরমার প্রতিষ্ঠিত একটি অশ্বথ গাছ রক্ষার জন্য টাকা ধার করে বহু বছর বহু ব্যয়ে দেওয়ানি ফৌজদারি মামলা করেছেন। ঠাকুরমা দুর্গা দেবী ছিলেন তাঁর প্রেরণা। বৈশাখ মাসে রোজ জল দেবার ব্যবস্থা করেছেন। সাঁওতালদের বাহা পরব, পুষ্পিত অরণ্যমায়ের সূর্যবন্দনা উৎসবেও, রং নয়, বৃক্ষশিশু ও মানুষকে জল দেওয়া হয়।

শান্তিনিকেতন আশ্রমে বিদ্যালয়ের আবাসিকদের সান্ধ্যবন্দনার মন্ত্রেও পঞ্চভূতের আরতি—
        ওঁ যো দেবগ্নৌ যো অপ্সু
        যো বিশ্বং ভুবনমাবিবেশ
        য ওষধিযু যো বনস্পতিষু
        তস্মৈ দেবায় নমো নমঃ।
করম ব্রতকথায় বলা হয়, কর্ম-অরণ্য-বৃক্ষই দেবতা, ধর্মকর্ম অবিচ্ছিন, কর্মই জীবন, কর্মই সত্যধর্ম (সারি ধরম)। কর্মাটাঁড়ের বাগানের বাইরে প্রাচীন অশ্ব গাছেরও যত্র ছিল। অশোকের শিলালিপি উদ্ধার করেছিলেন বিদ্যাসাগরের শিক্ষক প্রেমচন্দ্র তর্কবাগীশ। গুরুর প্রভাব শিষ্যের ‘পরে থাকাই স্বাভাবিক। করম যেন প্রাচীন কর্ম ও বোধিবৃক্ষ বন্দনা, রবীন্দ্রনাথের বৃক্ষরোপণ, হলকর্ষণ, রাখিবন্ধন শিল্পোৎসবের মিলিত আদি রূপ। যন্ত্র, ভাষা, ধর্ম, পরিবেশবিদ সন্তোষকুমারের কর্মব্রত গান, প্রথমোবোধিসত্ত্বায় অর্চনা চিরম। পথ-অষ্টাঙ্গ মার্গ। প্রকৃতিবৈজ্ঞানিক অর্থনীতি। পার্থিব পর্যাবরণ নিত্য মাতৃস্বরূপ রক্ষণীয়া। কু-কর্মের শুধিব পরিণাম, সু-কর্মের করিব সাধনা। বৃক্ষ, অরণ্য ভারতের সাংস্কৃতিক ধর্মীয় ঐতিহ্য। যেমন, অশ্বথ গাছ ও অন্যান্য বোধিবৃক্ষের সঙ্গে জড়িত গৌতম বুদ্ধ, তীর্থংকর— ঋষভনাথ (বট), মহাবীর (শাল)।

এখন অরণ্য, পঞ্চবটী, পবিত্র স্থান, জমি, পাহাড় গুঁড়িয়ে, গাছ কেটে পাকা মন্দির, মূর্তি, বাঁধ, খনি, খাদান, শহর তৈরি হয়। শান্তির প্রকৃতিকেন্দ্রিক উৎসবের চেয়ে হুল ও শিকারে বেশি উৎসাহ। ডাইন প্রথাও চলছে, অথচ প্রাচীন ওঝারা বলতেন, রাণ (বনৌষধি) যে চেনে, সে মন্তর বোঙা ডান মানে না। সুনুম সাকাম বা তেলপাতা করে, কারণ পাতার শিরা-উপশিরা-জালে অরণ্যমায়ের ছবি ফুটে ওঠে, মন-বুদ্ধি শান্ত হয়। আমরা কলাবউ নবপত্রিকা (শাকম্ভরী মা দুর্গা) বা জননী বসুন্ধরাকে চিনি না। কলাবউকে গণেশের বউ-পরিচিতি জ্ঞাপনে যা প্রকট। রাখি উৎসবে বোনেরা ভাইয়ের হাতে রাখি পরায়, রাজনৈতিক রাখিসম্প্রীতি পালিত হয়। বৃক্ষশাখায় রাখি পরানোর অরণ্যবন্দনা আমরা বিস্মৃত।

বুদ্ধ পূর্ণিমায় শিকারে তীর, ধনূক, বল্লপম দিয়ে জঙ্গল, পাহাড় কাঁপিয়ে, ঢাক, ঢোল, মাদল বাজিয়ে ছেলেরা অশ্লীল গানসহ উদ্দাম নাচে। (উৎস—সন্তোষচন্দ্র মজুমদারের ডায়েরি।) এখন বন্দুক পর্যন্ত ব্যবহার হয়, বরাভূমের বন্য বরাহ, হরিণ, সজারু সূর্য (প্যাঙ্গোলিন) লুপ্তপ্রায়। আশার কথা, এখন এই পরবে প্রাণীহত্যার বদলে তীর-ধনুক ছোঁড়া, archery sports চালু করার চেষ্টা হচ্ছে। অন্য দিকে, পৌষ সংক্রান্তি বা সেক্রাণে ফাঁদ পেতে মেঠো ইদুর শিকার ও পুড়িয়ে শালপাতায় পিঠে করার পরিবেশবান্ধব প্রথা হারিয়ে ফেলছে মেয়েরা। তেল ছাড়া সেদ্ধ বা সেঁকে খাওয়ার স্বাস্থ্যকর প্রথাও বিলুপ্ত। বিদ্যাসাগর তাঁর নন্দন কাননে খাবার সেঁকে নেওয়ার ব্যবস্থা করতেন, তাদের মতো করে খাওয়াতেন।

শুকরপালনের প্রাচীন প্রথা (মলত্যাগ স্থানের পাশে) মেনে এখনও শৌচালয়বিহীন সাঁওতাল গ্রাম সম্পূর্ণ নির্মল। সাঁওতাল মেয়েরা শিকার, নেশা করা পছন্দ করে না, তাদের গানে ও সমবেত নাচে অশ্লীলতার চিহ্নমাত্র নেই। বহিরাগতদের ভয় পায়, কিন্ত বিদ্যাসাগরকে তারা নির্ভয়ে আপন করে নিয়েছিল। ভোগবাদের বিরোধী উপাচার্য অম্লান দত্ত উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ-উত্তাল সময়ে বিদ্যাসাগরের ছবি আঁকতে দেন। শিল্পীকে বলেন, পৌরুষব্যঞ্জক নয়, বিদ্যাসাগরের মুখ হবে সৌন্দর্যমপ্তিত। সমাজভিত্তিক বনসৃজনের কথায় বলেছিলেন, ‘সবুজভিত্তিক সমাজসৃজন হবে।’ এই ভাবনা কি জনজাতিপ্রিয়, কৃষি, অর্থনীতি, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, আধুনিক ভূবিদ বিদ্যাসাগরের থেকে পেয়েছিলেন?

পাশ্চাত্য বিজ্ঞান অরণ্যরক্ষা ও বাস্তনীতির কথা বলে, আমরা অবহেলায় হারিয়ে ফেলছি এই ভারতীয় সংস্কৃতি, যার মূল কথা, অরণ্য, পাহাড়, নদীই পবিত্র দেবস্থান-ধর্মস্থান, সজীব বনস্পতি দেবতা। জনজাতিদের কথায়, মানুষের ঘরবাড়ি দেবতাকে ছাপিয়ে গেলে বোঙা সব ধ্বংস করে দেবে। বৌদ্ধ স্থাপত্যেও ছোটর মধ্যে বৃহৎ ভাবনা।

পরিশ্রমী জনজাতিরা আছে তাদের প্রকৃতিকেন্দ্রিক জীবন, উৎসব, নৃত্যগীত, আবহাওয়া উপযোগী শিল্পমণ্ডিত পরিচ্ছদ, অঞ্চল উপযোগী নিজ হাতে গড়া শিল্পমণ্ডিত বাসা ও পল্লি নিয়ে। অরণ্য, নদী তাদের মা, পাহাড়, সূর্য, প্রকৃতি আনন্দ ও জীবনের উৎস। ভোগবাদের বিপরীতে যুক্তিবিজ্ঞাননির্ভর এই সত্যধর্মে। এই কর্মের ধর্ম অনুভব, অনুসরণ করেছিলেন কর্মসাধনা বোধিবৃক্ষের বুদ্ধদেব, কর্মযোগী বিবেকানন্দ, নিবেদিতা, বৃক্ষরোপণ বনবাণী শান্তি-শ্রীনকেতনের রবীন্দ্রনাথ, কর্মাটাঁড়ে নন্দন কাননের কর্মগুরু বিদ্যাসাগর, ধর্ম সম্বন্ধে যিনি ছিলেন বুদ্ধদেবের মতোই মৌন। গোপাল হালদারের কথায়, বিদ্যাসাগরের মতে, জ্ঞানবিজ্ঞানের পথে এগিয়ে চলা, বৈজ্ঞানিক জ্ঞানে ও মানবিক প্রেমে-মমতায় কর্তব্যকর্মই ধর্ম।

শুভকর্ম রোহিণ, রোপণ, করমের জোহার (বন্দনা) গান—
        হিপিড় হিপিড় হয়দে ঝিপিঝিপি দা রে,
        হরিয়ের গে বীর রে,
        সিংচান্দো, মারাংবুরু কারামবুরু রে,
        দয়াঐ তালেমে কুঁইদি মীরু।
(হে সূর্যদেব, হে কর্মপাহাড়, সবুজ অরণ্যের শান্তির হাওয়া, ঝিরিঝিরি বৃষ্টি, অঙ্কুরিত চারা, পাখি, শিশুদের দয়া করো, রক্ষা করো)

কৃতজ্ঞতা : বন্দনা বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রাক্তনী, রবীন্দ্র ভবন, বিশ্বভারতী।


লেখিকা-পরিচিতি : অবসরপ্রাপ্ত প্রধানা, উদ্ভিদবিদ্যা, সুরেন্দ্রনাথ কলেজ; প্রাক্তন ছাত্রী, বিদ্যাসাগর কলেজ, প্রাক্তন ছাত্রী ও অধ্যাপক, বিশ্বভারতী।


* তথ্য সহায়তা *


১. ⦿ শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন, বিদ্যাসাগর-জীবনচরিত ও ভ্রমনিরাস (১২৯৪ বঙ্গাব্দ),চিরায়ত প্রকাশন ২০১৪।,

২. ⦿ বিজয়কান্ত রায়চৌধুরী, পথের কথা : চিকিৎসা সোপান (১৩৪১ বঙ্গাব্দ), আর. সি. দধি অ্যান্ড কোং, মিহিজাম।

৩. ⦿ Banerjee A., Forest festivals of the Chotanagpur plateau areas, India, Protecting Biodiversity. Proc. Indian Biodiversity Congress, Institute of Science, Bangalore. 2013, pp. 52-57.

Banerjee A., Economic importance of some flowers and minor fruits; Ethno-ecological approach of conservation in biodiversity assessment and conservation, Agrobios, India, 2006. ISBN: 81-7754-254-0.

Banerjee A., Ethno-botany of some trees in the santhal villages of Birbhum, in Ethnobotany and medicinal plants of India Subcontinent, Advance Books, Jaipur, India, 2003. ISBN 81-7233-221-1.

৪. ⦿ অমিয়কুমার সামন্ত, প্রসঙ্গ বিদ্যাসাগর, প্রোগ্রেসিভ পাবলিশার্স, ২০১২।

৫. ⦿ Bodding P.O., Studies In Santal Medicine and Connected Folklore, Asiatic Society, 1925-’40.

[অজানা বিদ্যাসাগর অনন্য দিশারি- সেপ্টেম্বর-২০১৯]

কোন মন্তব্য নেই

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

vidyasagar.info ©