অবহেলিতা নারীজাতির প্রতি নবজাগৃতির এই অগ্রদূতের যে কী অপরিসীম সহানুভূতি ও সমবেদনা ছিল, তার প্রমাণ মেলে বিদ্যাসাগরের জীবনচরিত-এ বারবার। শুধু বিধবাবিবাহ নয়, নারীত্বের অবমাননাকারী কৌলিন্য প্রথার বিরুদ্ধে, বহুবিবাহের বিরুদ্ধে তাঁর সংগ্রাম এবং সর্বোপরি বেথুন স্কুলের সম্পাদনাকাল হতে পরবর্তীকালে জেলায়-জেলায় মেয়েদের স্কুল স্থাপনা— এ-সবকিছুই নারীমুক্তির অগ্রণী অভিভাবক ঈশ্বরচন্দ্র চরিত্রের এক অন্যতম বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছে।
—সোমেশ দাশগুপ্ত
মাইকেল এবং তাঁর ‘Vid’
উনিশ শতকের প্রথমার্ধে ইংরেজি শিক্ষার সংস্পর্শে আলোকপ্রাপ্ত দুই বাঙালি প্রতিভা— ঈশ্বরচন্দ্র এবং মধুসূদন, একই সংস্কারমুক্ত, যুক্তিবাদী মানসিকতায় গড়ে উঠেছেন, আধুনিক মানবতাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে। দুজনের কাজের মধ্যেই এই আদর্শবাদ এবং যুক্তিবাদী চেতনার স্বাক্ষর স্পষ্ট।
বিদ্যাসাগরের সীতার বনবাস এবং মাইকেলের মেঘনাদবধ কাব্য— এই উভয় রচনাতেই আর্যাবর্তের এ-যাবৎ কালের প্রধান নায়ক অযোধ্যার শ্রীরামচন্দ্র অবতারত্বের পদ থেকে নেমে সাধারণ মনুষ্যত্বের স্তরে এসে দাঁড়িয়েছেন।
সীতার বনবাস আলোচনার আগে আরও দুয়েকটি প্রাসঙ্গিক কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন। এক, সীতার বনবাস বিদ্যাসাগর মহাশয়ের অপেক্ষাকৃত পরিণত বয়সের রচনা। ১২৬৭ বঙ্গাব্দের ১ বৈশাখ (১৮৬০ এর ১৫ এপ্রিল) এর প্রথম প্রকাশ। রবীন্দ্রনাথের জন্মের এক বছর আগে। দুই, ওই ১৮৬০ সালের ২৪ এপ্রিল ঋষি রাজনারায়ণ বসুকে লেখা মধুসূদনের এক চিঠি থেকে জানতে পারি, তিলোত্তমা ও শর্মিষ্ঠা লেখার পরে মধুসূদনকে ‘একটি জাতীয় মহাকাব্য’, রচনার অনুরোধ জানিয়েছিলেন রাজনারায়ণ। তিন, ১৮৬৩-এর ২৪ এপ্রিল থেকে ১৮৬১-র জুনের মধ্যে মেঘনাদবধ কাব্য— প্রথম খণ্ড (প্রথম পাঁচটি সর্গ) লেখা হয়। রবীন্দ্রনাথের জন্মের পর-পরই।
উপরের তিনটি প্রসঙ্গ শুধুমাত্র মাইকেল এবং বিদ্যাসাগরকে নিয়েই নয়। তাঁদের দুটি সমধর্মী রচনার সময়কাল নিয়েও। সীতার বনবাস আর মেঘনাদবধ কাব্য যে ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে পায়ে পা ফেলে একই সময়ে সৃষ্টি হলো, এটা কি নিতান্তই কাকতালীয় ঘটনা?
আরও আশ্চর্য, ওই সময়কালকে যদি আমরা আধুনিক বাংলা সাহিত্যের জন্মকাল বলে ধরি, তা হলে কি এটাও লক্ষ করার মতো ঘটনা নয় যে, আধুনিক বঙ্গসাহিত্যের জন্ম আর রবীন্দ্রনাথের জন্ম যেন ঘণ্টা আর মিনিটের কাঁটার সঙ্গে সেকেন্ডের কাঁটাটাকেও মিলিয়ে বাংলা রেনেসাঁসের সূচনাকে শঙ্খধ্বনি দিয়ে অভ্যর্থনা করল? এটাও কি কাকতালীয়? নাকি রাজা রামমোহন রায়, হেনরি ভিভিয়ান ডিরোজিও, রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ মনীষীগণ যে-যুক্তিবাদী সাংস্কৃতিক পরিবেশ গড়ে তুলতে সচেষ্ট ছিলেন, সেই আধুনিক মানসিকতার ফলশ্রুতিতেই সীতার বনবাস ও মেঘনাদবধ কাব্য পেল বাঙালি?
বিদ্যাসাগর ও মাইকেল উভয়েই যে শ্রীরামকে অবতারত্বের স্তর থেকে সাধারণ মনুষ্যত্বের স্তরে নামিয়ে, দোষে-গুণে মেশানো মানুষ রূপে তুলে ধরেছেন, এর পিছনে যেমন ওই আধুনিক যুক্তিবাদী চিন্তা ছিল, হয়তো বা তার সঙ্গে একটা প্রচলিত বাঙালি মানসিকতাও কিছুটা কাজ করে থাকতে পারে।
কৃষ্ণভক্ত বৈষ্ণব কিংবা শিবভক্ত শৈবের সংখ্যা বাঙালিদের মধ্যে অনেক বেশি বলেই হয়তো কয়েক শতকের প্রচলিত বাঙালি মানসিকতায় ওই দুই অতি জনপ্রিয় অবতারের সঙ্গে তুলনা করে শ্রীরামচন্দ্রকে তৃতীয় স্থানে রাখার একটা মানসিকতা কাজ করছে।
তবে, সাহিত্যক্ষেত্রে এ-রকমটি ঘটে না। এ-কথা সত্য যে, উত্তর ভারতে শ্রীরামচন্দ্র বেশি পুজা পেয়ে থাকেন। কিন্তু এটাও সমান সত্য, পশ্চিমে রাজস্থান, গুজরাতে এবং পূর্ব ভারতে বঙ্গ-কলিঙ্গ অঞ্চলে কৃষ্ণভক্তের সংখ্যা অনেক বেশি। আর, দক্ষিণ ভারতে একচেটিয়া ভাবে এবং আসমুদ্র হিমাচল ভূখণ্ড জুড়েই সাধারণভাবে শিবের বন্দনা প্রচলিত। তা হলে মাইকেল বা বিদ্যাসাগর রামায়ণের কাহিনিকেই তাঁদের রচনার ভিত্তি হিসেবে নিলেন কেন?
কারণ, এ-কথাটা মনে রাখতে হবে, শ্রীরামচন্দ্রকে নিয়ে ভারতবিজয়ী আর্যরা যেরকম একটি সম্পূর্ণ মহাকাব্য লিখেছেন, কৃষ্ণ বা শিবকে নায়ক করে দেশজ যাদবেরা, বা আর্যপূর্ব ভারতীয়রা তেমন কোনো মহাকাব্য রচনা করে যাননি।
তাই আমাদের সাহিত্য-সম্পর্কিত আলোচনায় রামায়ণ একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। কৃষ্ণ আসেন ভাগবদ্গীতা-য়, নর বা দেবরূপে নয়, বিমূর্ত উপদেশ রূপে। আর আসেন মীরার ভজনে, কীর্তনে। কোনো মহাকাব্যের নায়করূপে নয়। তেমনই শিবও কোনো মহাকাব্যে নেই। আছেন অসংখ্য মন্দিরে।
নতুন যুগের নতুন সাহিত্যের কাঁচা মাল হিসেবে তাই কীর্তন বা মন্দিরের চাইতে রামায়ণ মহাকাব্যকেই মাইকেল ও বিদ্যাসাগর বেছে নিয়েছিলেন, সীতার বনবাস ও মেঘনাদবধ কাব্য-তে তাঁদের মানবতাবাদী মূল্যবোধ অর্পণ করে নতুন যুগের নতুম মনের খোরাক জোগান দিতে।
লক্ষণীয়, একই বহুপঠিত কাহিনি অবলম্বনে বিদ্যাসাগর এবং মাইকেল দুই পৃথক রচনায় নামলেন। মধুসূদন তাঁর কাব্যে রাবণকে জাতীয় নায়করূপে উপস্থাপিত করলেন, বাল্মীকির বিরুদ্ধাচরণ করে। এর পটভূমিকা কীভাবে মধুসূদনের মানসিকতায় তৈরি হয়েছিল, তার কিছু-কিছু ইঙ্গিত আমরা পেয়েছি, মধু-প্রসঙ্গে, পরবর্তী পরিচ্ছেদে।
আর, বিদ্যাসাগর কেন সীতাকেন্দ্রিক আখ্যান রচনা করলেন? এর উত্তর মিলবে বিদ্যাসাগরের জীবনচরিত-এ।
অবহেলিতা নারীজাতির প্রতি নবজাগৃতির এই অগ্রদূতের যে কী অপরিসীম সহানুভূতি ও সমবেদনা ছিল, তার প্রমাণ মেলে বিদ্যাসাগরের জীবনচরিত-এ বারবার। শুধু বিধবাবিবাহ নয়, নারীত্বের অবমাননাকারী কৌলিন্য প্রথার বিরুদ্ধে, বহুবিবাহের বিরুদ্ধে তাঁর সংগ্রাম এবং সর্বোপরি বেথুন স্কুলের সম্পাদনাকাল হতে পরবর্তীকালে জেলায়-জেলায় মেয়েদের স্কুল স্থাপনা— এ-সবকিছুই নারীমুক্তির অগ্রণী অভিভাবক ঈশ্বরচন্দ্র চরিত্রের এক অন্যতম বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছে।
অবহেলিতা নারীজাতির প্রতি এই বিশেষ পক্ষপাতিত্বের সঙ্গে সীতার বনবাস-এর সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। তদানীন্তন বাঙালি সমাজজীবনে ঈশ্বরচন্দ্র এ-রকম শত শত সীতাকে দেখেছেন। তাই, ‘সীতা’-চরিত্র আঁকতে গিয়ে বিদ্যাসাগর তার সমসাময়িক বাঙালি সমাজের পটভূমিকায় রাখা এক নারীচরিত্র এঁকেছেন।
জনমদুখিনী সীতাকে যদি তাঁর সমকালীন বঙ্গনারীর প্রতিনিধি চরিত্র বলে এঁকে থাকেন তো তার বহু বিচিত্র রূপই পরবর্তীকালে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর উত্তরসূরিদের সাহিত্যে, যে-সর্বংসহা নারীচরিত্রের পথ বেয়ে মতো কালজয়ী চরিত্র, কিংবা প্রতিবাদী বিমলা বা মুক্তির দিশারি নন্দিনী। যে-চরিত্রের পথ বেয়ে পরবর্তী যুগের অন্যতম যুক্তিবাদী, মানবতাবাদী সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র তাঁর রাজলক্ষ্মী, সাবিত্রী, অন্নদাদিদি, শুভদা, রমা ইত্যাদি আত্মোৎসর্গীকৃতা, নিগীড়িতা নারীচরিত্র এঁকেছেন, অথবা অভয়া-কিরণময়ী-কমল ইত্যাদি প্রতিবাদী চরিত্র গড়ে তুলেছেন নতুন যুগের নতুন সামাজিক পারিপার্শ্বিকে।
প্রসঙ্গত, নতুন যুগের শিক্ষার্থীদের সামনে রেখেই পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র সচেতনভাবেই হোক, বা অর্ধসচেতন ভাবেই হোক, নারী-পুরুষ সম্পর্কের সামন্ততান্ত্রিক ধ্যানধারণা পাল্টাতে সচেষ্ট ছিলেন। এবং এদিক থেকে তিনি শুধু রামমোহনের সার্থক উত্তরসূরিও ছিলেন না। উপরন্তু, পরবর্তীকালের পরিণত মানবতাবাদী (matured humanist) ভাবনা-ধারণাকে যথাযথভাবে আত্মস্থ করে নারীজাতিকে তাঁদের অধঃপতিত অবস্থা থেকে টেনে তোলার প্রচেষ্টায় নিজেকে নিযুক্ত রেখেছিলেন।
সীতার বারংবার লাঞ্ছিত, অপমানিত হবার কাহিনি বিদ্যাসাগর এমন অসাধারণ সাহিত্যিক আবেদনে পাঠকের সামনে উপস্থিত করেন যাতে তৎকালীন পুরুষ সমাজের মনে নারীর মর্ধাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠার সংকল্প স্বাভাবিক আবেগ-অনুভূতির মাধ্যমে সঞ্চারিত হয়। বাঙালি জাতির মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগে উত্তরণের পথে তাই সীতার বনবাস ছিল সেদিনকার বলিষ্ঠতম সাহিত্যিক পদক্ষেপ।
কিন্তু এ-কথা উপলব্ধি করতে যে-ধরনের মানসিকতার প্রয়োজন, সেই বিজ্ঞানভিত্তিক যুক্তিবাদী আধুনিক মানসিকতা আমরা উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে অর্জন করতে শুরু করে মাত্র এক শতকের মধ্যেই তার চর্চা বন্ধ করেছি। সেই কারণেই বিদ্যাসাগর-মাইকেলচর্চা আজ নতুন ভাবে প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে।
[লেখাটি ১৯৮৩-তে প্রকাশিত প্রয়াত লেখকের গ্রন্থের মুখবন্ধ।]
কোন মন্তব্য নেই
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন