বিদ্যাসাগরের রচনাগুলি নিয়ে যখন আলোচনা হয়, তখন সাধারণভাবে আখ্যানমঞ্জরী-র তিনটি ভাগ শুধু উল্লেখ করা হয়। বিদ্যাসাগর বিভিন্ন বই থেকে নানান কাহিনি উদ্ধৃত করে সেগুলি সরল ভাষায় ছাত্রদের জন্য গ্রন্থনা করেন। প্রথম ভাগে একুশটি, দ্বিতীয় ভাগে ছাব্বিশটি ও তৃতীয় ভাগে কুড়িটি কাহিনি স্থান পেয়েছে। লেখাগুলি বেশ সুখপাঠ্য। রচনারীতি খানিকটা নতুন বলা যায়। বেশ ক’টি কাহিনি ঔপনিবেশিক নির্মমতা ও নিষ্ঠুরতার বিবরণ। সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দিতে দেশ দখল করতে গিয়ে ইংরেজ, স্পেনীয় দখলকারেরা অধিকৃত দেশগুলির আদিবাসীদের ওপর যে-নৃশংস অত্যাচার চালিয়েছিল, তারই পরিচয় তিনি দিয়েছেন। এই লেখাগুলি খুঁটিয়ে পড়লে ঔপনিবেশিকতাবাদীদের, বিশেষ করে ইংরেজ রবিনসন ক্রুসোদের, স্বরূপ বুঝতে অসুবিধে হয় না। তাঁর আগে বোধ হয় আর কেউ এমন উদ্ঘাটন করেননি। দু’একটি কাহিনির সংক্ষেপে উল্লেখ করছি।
—পবিত্রকুমার সরকার
তালিবান নেতা মোল্লা মুহম্মদ ওমরের নির্দেশে ২০০১ সালের মার্চের একেবারে গোড়ার দিকে একদল ধর্মীয় সন্ত্রাসী আফগানিস্তানের বামিয়ান বুদ্ধমূর্তি ডিনামাইট ফাটিয়ে উড়িয়ে দেয়। এটি ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় বুদ্ধমূর্তিগুলোর একটি। দেড় হাজার বছরের ওই মূর্তি ঐতিহাসিক সৌকর্ষের গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত হত। ওই জায়গাটি ইউনেস্কো ঘোষিত ঐতিহ্যকেন্দ্র বা হেরিটেজ সাইট। বামিয়ান উপত্যকায় পাহাড়ের পৃষ্ঠতল কেটে-কেটে একদিন ওই বুদ্ধমূর্তি তৈরি হয়েছিল। মৌলবাদী অন্ধতার কাছে অবশ্য এই সবের দাম নেই। ইসলামের নামে এই সব কাণ্ডকারখানা চলেছিল। গোটা বিশ্ব ওই ঘটনায় স্তম্ভিত হয়ে যায়। পাকিস্তানসহ চুয়ান্নটি ইসলামিক রাষ্ট্র বামিয়ান বুদ্ধমূর্তি ধ্বংসের নিন্দা করে। বর্তমানে সুইটজারল্যান্ডের উদ্যোগে ওই মূর্তি পুননির্মাণের চেষ্টা চলছে। মূর্তি নির্মাণ হলেও ঐতিহ্য ফিরে আসবে না।
২০০৩ সালে মার্কিনরা যখন ইরাক দখলে উন্মত্ত সামরিক অভিযান চালায়, ধ্বংস হয়েছিল সুমের ও মেসোপটেমিয়া সভ্যতার অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নসামগ্রী। এত বড় এবং এর তুল্য না-হলেও, একদা এই বাংলাতেও এই সব বোধবুদ্ধিহীন ঘটনা ঘটেছে রাজনৈতিক মৌলবাদের আশ্রয়ে। ১৯৬৯-৭০ আন্দোলনের পথ ধরে মাওবাদী (ওদের দাবি অনুযায়ী) কৃষক বিপ্লবের ধ্যানধারণা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য একদল তরুণ-তরুণী সংকল্পবদ্ধ হয়। ওদের নেতা ছিলেন চারু মজুমদার, সুশীতল রায়চৌধুরী, কানু সান্যাল, সরোজ দত্ত, জঙ্গল সাঁওতাল প্রমুখ। বহু মেধাবি উজ্জ্বল ছাত্রছাত্রী সশস্ত্র বিপ্লবের কুহক-আকর্ষণে ঝাপিয়ে পড়ে। ওরা জোতদার-জমিদার-মুৎসুদ্দি বুর্জোয়ার শাসন-শোষণ থেকে দেশকে দ্রুত মুক্ত করার লক্ষ্যে কলকাতা শহর-সহ রাজ্যের কয়েকটি অঞ্চলে চোরাগোপ্তা হামলা চালায় ও হত্যার আশ্রয় নেয়। ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের আগে লেনিন বিচ্ছিন্ন সন্ত্রাসী ক্রিয়াকাণ্ডের তীব্র নিন্দা করেন এবং একে ‘নারোদনিজম’ (রুশ দেশের ১৮৬০-৭০ সালে কৃষক অভ্যূত্থানভিত্তিক এই মতবাদ প্রচলিত। পরে এর পরিণতি হয় সন্ত্রাসমূলক কার্যকলাপে) আখ্যা দেন। তালিবানদের মতো এই বাংলার নকশালপন্থীরা স্কুল-কলেজ-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ধ্বংস করার এবং ওদের শ্রেণি-উৎস বা মতাদর্শগত পার্থক্য যা-ই থাক না কেন, উভয়ের প্রয়োগ-পদ্ধতি একই ছিল। নকশালপন্থী নামে পরিচিত ওই ছাত্র-যুবরা স্বাধীনতা ও সংস্কার আন্দোলনে অর্জিত গণতান্ত্রিক মূল্যবোধগুলি বিনির্মাণে নেমে পড়ে।
বিশ্ববিপ্লবের ইতিহাসে এই সব প্রয়োগ-পদ্ধতির আর কোনো নজির আছে বলে আমার জানা নেই। ১৯১৭-র ৬-৭ নভেম্বর, বিপ্লবীরা যেদিন পিতার্সবার্গের শীত-প্রাসাদের দখল নেন, হাজার হাজার উৎসাহী মানুষ বাঁধভাঙা আনন্দ-উচ্ছ্বাসে প্রাসাদে ঢুকে পড়েন। কেউ কেউ মূল্যবান রাজকীয় সামগ্রী লুটের চেষ্টা করেন। রেডগার্ডরা প্রাসাদ রক্ষা করেন এবং ইতিহাসের প্রত্ন-উপাদান হিসেবে লুণ্ঠিত সামগ্রী অনেকটাই ফিরিয়ে আনেন। তাঁরা প্রাসাদ ধ্বংস হতে দেননি। সাংবাদিক জন রিড-এর টেন ডেজ দ্যাট শুক দ্য ওয়ার্ল্ড বইতে এর অনুপুঙ্খ বিবরণ রয়েছে।
বাংলায় সত্তরের দশকের গোড়ায় যা ঘটেছিল তার মধ্যে বৈপ্লবিক আবেগ, আকাঙ্ক্ষা যা-ই থাক, জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের ধারপাশ দিয়ে যায়নি। সামন্ত ও মুৎসুদ্দি পুঁজিবিরোধী বিপ্লবের নামে তারা রামমোহন-বিদ্যাসাগর-রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ মনীষীদের ‘বুর্জোয়া প্রতিক্রিয়াশীল’ আখ্যা দিয়ে এবং তাঁদের মূর্তি কলঙ্কলিপ্ত করে অতিবিপ্লবী সাজার চেষ্টা করে। নিছক চমক সৃষ্টি ছাড়া এর দ্বারা আর কী উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়েছিল?
এই পর্বে তাদের প্রথম টার্গেট ছিলেন বোধ হয় বিদ্যাসাগর। দুর্ভাগ্য, এই মানুষটি ভারতে জন্মেছিলেন। ১৯৭০ সালের ২০ অক্টোবর কয়েকজন ছাত্র-যুবক রাতের অন্ধকারে কলেজ স্কোয়ারে ঈশ্বরচন্দ্রের মূর্তি মুণ্ডচ্ছেদ করে। বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়েরও একই দিনে মুণ্ডপাত হয়েছিল। বিদ্যাসাগরকে কিছুদিন কণিষ্করূপে থাকতে হয়। যাই হোক, পশ্চিমবঙ্গ নিরক্ষরতা দূরীকরণ সমিতির কর্মীরা রক্তদান করে সেই মূর্তি দুটি সংস্কার করেন। বিদ্যাসাগরের বিরুদ্ধে এই জিঘাংসার কারণ কী ছিল? ১৮৫৭ সালে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ কথিত সিপাহি অভ্যু্ত্থান বাংলার ভদ্রলোক বাবুসমাজের বা জায়মান বুর্জোয়া শ্রেণির সমর্থন পায়নি। সেই সময় ঈশ্বরচন্দ্র সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে নকশালপন্থীদের বড় অভিযোগ, তিনি সেই অভ্যুত্থানের সময় ইংরেজ ফৌজদের কলেজে আশ্রয় দিয়েছিলেন। অতএব তিনি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের আজ্ঞাবহ ছিলেন। শিশুসুলভ বামমার্গিতায় যাঁরা ভোগেন তাঁদের বোধহয় এমন সহজ সমীকরণ নিয়ে চলতে হয়। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর জীবিকার তাগিদে ইংরেজ সরকারের অধীনে শিক্ষা বিভাগে কাজ করতেন এবং সেই সূত্রে সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ হয়েছিলেন। সরকার কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ফৌজি বা মিলিটারি রাখতে চাইলে তাঁর সম্মতি বা আপত্তিতে কিছু আসত-যেত না। ঔপনিবেশিক শাসকেরা যা করার করতই। বিদ্যাসাগর হঠাৎ বিপ্লবী হয়ে সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষের পদে ইস্তফা দেবেন, এটা অভাবনীয় ছিল। আজ গোটা দেশের অজস্র বাম ও প্রগতিশীল কর্মী তাঁদের নীতি ও আদর্শবিরোধী সরকারের অধীনে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন জীবিকার প্রয়োজনে। কেউ কি সরকারি নীতি ও কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদে পদত্যাগ করছেন? আর, এ-কারণে তাঁদের কি প্রতিক্রিয়াশীল বলা যায়? অথচ বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ আধুনিকতার যিনি আলোকদিশারি তাঁর দিকে অজস্র গালি বর্ষিত হলো, ‘সাচ্চা বিপ্লবী’-দের চোখে তিনি হলেন ‘ইংরেজ শাসকের গোলাম’। মার্কসবাদে Mechanical determinism বা যান্ত্রিক নির্ণয়বাদ বলে একটি বিষয় আছে। সময়, কাল ও প্রেক্ষিত উপেক্ষা করে কেউ যদি নিজের ইচ্ছা বা অভিলাষ যান্ত্রিকভাবে চাপিয়ে দিতে চান, তাকে ‘যান্ত্রিক নির্ণয়বাদ’ বলে। যেমন, কোনো ব্যক্তি যদি মনে করেন ভারতে ঔপনিবেশিক সামন্ত যুগে একমাত্র কৃষক বিপ্লব ও অভ্যুত্থান সমর্থন করাটাই প্রগতিশীলতার মাপকাঠি, তাঁকে একপেশে মতাবলম্বী বলতেই হয়। ওই অন্ধকার যুগের ধর্মসংস্কার, সমাজসংস্কার, নারীবৈষম্য নিরসন, শিক্ষাবিস্তার ইত্যাদির জন্য লড়াই অবশ্যই প্রগতিশীলতার নিদর্শন। এ-সব লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে সমাজ এগোয়, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটে এবং মানবতার আদর্শ মান্যতা পায়। উনবিংশ শতাব্দিতে নবজাগরণের কালপর্বে বাংলায় এ-ঘটনাই ঘটেছিল। বিদ্যাসাগরের মূল্যায়ন এই নিরিখেই হওয়া উচিত।
দুর্ভাগ্য, ১৯৭০ সালে বিদ্যাসাগর-মূর্তির মস্তক ছেদনের প্রায় চার দশক পর ২০১৯ সালের ১৪ মে ওই মহামনীষীর মূর্তি আবার ভাঙা হলো বিদ্যাসাগর কলেজ প্রাঙ্গণে, যে-কলেজ তিনিই হাতে গড়েছিলেন। একেবারে সংকীর্ণ রাজনৈতিক ফায়দা লুঠবার জন্য একাজ করা হয়েছে। এই অপকাণ্ডের জন্য তৃণমূল দুষছে বি.জে.পি.-কে, বি.জে.পি. তৃণমুলকে। তবে হিন্দুত্ববাদী বি.জে.পি-র আদর্শের সঙ্গে বিদ্যাসাগরের আদর্শ একেবারেই মেলে না। বিদ্যাসাগরের জন্মের দুশো বছর পর তিনি রাজনীতিক পাশাখেলার ঘুঁটিতে পরিণত হবেন, এটা ভাবতেও লজ্জা হয়। এ-লজ্জা আমরা রাখব কোথায়? নকশালপন্থীরা তবু মূর্তি ভাঙার একটা ব্যর্থ তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু এ-ক্ষেত্রে সে-সবের বালাই নেই। এখন ভাঙা মূর্তি গড়ার প্রতিযোগিতা চলছে তৃণমূল ও বি.জে.পি.র মধ্যে। এ যেন গরু মেরে জুতোদান।
আগেই বলেছি, বিদ্যাসাগরের পক্ষে সে-যুগে সেভাবে ঔপনিবেশিকতাবিরোধী প্রত্যক্ষ লড়াই-সংগ্রামে জড়িত থাকা সম্ভব ছিল না। কিন্তু ইংরেজ ও অন্যান্য উপনিবেশিক দখলদারদের চরিত্র বুঝতে তাঁর বিন্দুমাত্র অসুবিধে হয়নি। তিনি বহু রচনায় তা চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন। প্রথমেই তাঁর বাঙ্গালার ইতিহাস (দ্বিতীয় ভাগ) উল্লেখ করতে চাই। বাংলায় নবাবি আমলের অবসানে কীভাবে ইংরেজ শাসন এ-দেশে জাঁকিয়ে বসল, তার বস্তুনিষ্ঠ ধারাবিবরণ রয়েছে এতে। গ্রন্থটি ১৮৪৮ সালে প্রকাশিত হয়। নবাব সিরাজউদ্দৌল্লা ১৭৫৬ সালে বাংলার মসনদে বসেন। সেই ১৭৫৬ থেকে পরবর্তী আশি বছরের বাংলার ইতিহাস বিদ্যাসাগর লেখেন। তিনি ইংরেজ শাসককে নির্মোহ দৃষ্টিতে কাটাছেঁড়া করেছেন, তার আসল চেহারা, কুটিল রূপ সাধ্যমতো তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।
১৭৫৬ সালের ২০ জুন নবাব সিরাজউদ্দৌল্লা বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে কলকাতায় ইংরেজদের কেল্লা দখল করে নিলেন। ওই কেল্লা দখলের রাতে একটা সংকীর্ণ, প্রায় বন্ধ ঘরে একশো তেইশ জন ইংরেজ বন্দি শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যান। তেইশ জন কোনোক্রমে বেঁচে যান। বিদ্যাসাগরই ‘অন্ধকূপে হত্যা নামক অতি ভয়ঙ্কর ব্যাপার’-এর উল্লেখ করে দেখালেন, এর জন্য নবাব সিরাজউদ্দৌল্লা কোনোমতেই দায়ী ছিলেন না। অথচ অকারণে এর দায় নবাবের ওপর চাপিয়ে তাঁকে ‘নৃশংস রাক্ষস’ বলে গাল পাড়া হয়। বিদ্যাসাগর লিখেছেন— ‘কিন্তু তিনি (অর্থাৎ নবাব) পরদিন প্রাতঃকাল পর্যন্ত এই ব্যাপারে বিন্দুবিসর্গ জানিতেন না। সে রাত্রিতে সেনাপতি মাণিকচাঁদের হাতে দুর্গের ভার অর্পিত ছিল; অতএব তিনি সমস্ত দোষের ভাগী।’ অতএব বিদ্যাসাগরই প্রথম সিরাজের কলঙ্কমোচন করেন। ১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধে পরাজিত নবাবের প্রতি তাঁর প্রচ্ছন্ন সহানুভূতি ছিল। তাঁর প্রাণঘাতক মহম্মদ মিরনকে ‘দুরাচার’ বলে ধিক্কার দেন।
মুসলমান ইতিহাস-লেখকের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে তিনি দেখালেন, নবাবের অন্তঃপুরে এক গোপন কোষাগার ছিল। তাতে সোনা, রূপা ও রত্ন মিলিয়ে কম করে আট কোটি টাকার সামগ্রী ছিল। তা মীরজাফর, আমির, ক্লাইবের দেওয়ান রামচাঁদ ও মুন্সি নবকৃষ্ণ গোপনে ভাগ করে নেন। ক্লাইব এই গোপন ভাগাভাগি জানতে পারেননি। ষাট টাকা বেতনের রামচাঁদ ও ষাট টাকা বেতনের নবকৃষ্ণ কীভাবে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছিলেন তা বিদ্যাসাগরের চোখ এড়ায়নি। এ থেকে এই ইঙ্গিত স্পষ্ট, নবাববিরোধী ষড়যন্ত্রে মীরজাফরের মতো রামচাঁদ, নবকৃষ্ণেরা সমান ভাবে জড়িত ছিলেন।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনকালে বাংলায় অবাধ ঘুষ-দুর্নীতি ও কাটমানিরাজ কায়েম হয়েছিল। বিশেষ করে বাংলার প্রথম গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস ১৭৭২ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর অবস্থা আরও চরমে ওঠে। ভারতীয় প্রজাদের সুশাসন দেওয়ার উদ্দেশ্যে ১৭৭৪ সালে সুপ্রিম কোর্ট স্থাপিত হয়। কিন্তু সুশাসন দূরস্থান, বড়লাট হেস্টিংস সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ইলাইজা ইম্পির সঙ্গে মিলে এক স্বৈরশাসন কায়েম করেন। বিচারের নামে প্রহসনের নগ্ন নিদর্শন ছিল নন্দকুমারের প্রাণদণ্ড। বিদ্যাসাগরের সংশিষ্ট ইতিহাস-কথন তুলে ধরছি—
অতি শীঘ্র শীঘ্র, হেষ্টিংসের নামে ভূরি ভুরি অভিযোগ উপস্থিত হইতে লাগিল। একজন এই বলিয়া দরখাস্ত দিল যে, হুগলীর ফৌজদার বৎসরে ৭২০০০ টাকা বেতন পাইয়া থাকেন; তন্মধ্যে তিনি হেষ্টিংস সাহেবকে ৩৬০০০ ও তাঁহার দেওয়ানকে ৪০০০ টাকা দেন। আমি বার্ষিক ৩২০০০ টাকা পাইলেই এ কর্ম সম্পন্ন করিতে পারি। উপস্থিত অভিযোগ গ্রাহ্য করিয়া সাক্ষ্য লওয়া গেল। হেষ্টিংসের বিপক্ষ মেম্বারেরা কহিলেন, যথেষ্ট প্রমাণ হইয়াছে। তদনুসারে ফৌজদার পদচ্যুত হইলেন। অন্য এক ব্যক্তি, ন্যূন বেতনে, এ পদে নিযুক্ত হইলেন; কিন্তু অভিযোক্তার কিছুই হইল না।
এক মাস হইতে না হইতেই আর এক অভিযোগ উপস্থিত হইল, মণি বেগম নয় লক্ষ টাকার হিসাব দেন নাই। পীড়াপীড়ি করাতে বেগম কহিলেন, ‘হেষ্টিংস সাহেব যখন আমাকে নিযুক্ত করিতে আইসেন আমোদ উপলক্ষে ব্যয় করিবার নিমিত্ত, তাঁহার এক লাখ পঞ্চাশ হাজার টাকা উৎকোচ দিয়াছি।’ হেষ্টিংস কহিলেন, ‘আমি ঐ টাকা লইয়াছি বটে, কিন্তু সরকারী হিসাবে খরচ করিয়া কোম্পানির দেড় লক্ষ টাকা বাঁচাইয়াছি।’ হেষ্টিংস সাহেবের এই হেতুবিন্যাস কাহারও মনোনীত হইল না।
এক্ষণে স্পষ্ট দৃষ্ট হইল, অভিযোগ করিলেই গ্রাহ্য হইতে পারে। এই সুযোগ দেখিয়া নন্দকুমার হেষ্টিংসের নামে এই অভিযোগ উপস্থিত করিলেন যে— ‘গবর্ণর জেনেরল বাহাদুর সাড়ে তিন লক্ষ টাকা লইয়া মণি বেগমকে ও আমার পুত্র গুরুদাসকে মুরশিদাবাদে নবাবের রক্ষণাবেক্ষণ কার্যে নিযুক্ত করিয়াছিলেন।’ ফ্রান্সিস ও তৎপক্ষীয়েরা প্রস্তাব করিলেন, সাক্ষ্য দিবার নিমিত্ত নন্দকুমারকে কৌন্সিলের সম্মুখে আনীত করা যাউক। হেষ্টিংস উত্তর করিলেন, ‘আমি যে সভার অধিপতি তথায় আমার অভিযোক্তাকে আসিতে দিব না; বিশেষতঃ এমন বিষয়ে অপদার্থ ব্যক্তির ন্যায় সম্মত হইয়া গবর্ণর জেনেরলের পদের অমর্যাদা করিব না; এই সমস্ত ব্যাপার সুপ্রীম কোর্টে প্রেরণ করা যাউক।’ ইহা করিয়া হেষ্টিংস গাত্রোত্থান করিয়া কৌন্সিলগৃহ হইতে চলিয়া গেলেন, বারওয়েল সাহেবও তাঁহার অনুগামী হইলেন। তাঁহাদের প্রস্থানের পর, ফ্রান্সিস ও তৎপক্ষীয়েরা নন্দকুমারকে কৌন্সিলগৃহে আহ্বান করিলে তিনি এক পত্র পাঠ করিয়া কহিলেন, ‘মণি বেগম যখন যাহা ঘুষ দিয়াছেন, তদ্বিষয়ে এই পত্র লিখিয়াছেন।’ কিছুদিন পূর্বে বেগম গবর্ণমেন্টে এক পত্র লিখিয়াছিলেন; সর জন ডাইলি সাহেব, নন্দকুমারের পঠিত পত্রের সহিত মিলাইবার নিমিত্ত এ পত্র বাহির করিয়া দিলেন। মোহর মিলিল, হস্তাক্ষরের ঐক্য হইল না। যাহা হউক, কৌন্সিলের মেম্বারেরা নন্দকুমারের অভিযোগ যথার্থ বলিয়া স্থির করিলেন এবং হেষ্টিংসকে ঐ টাকা ফিরিয়া দিতে কহিলেন। কিন্তু তিনি তাহাতে কোনও মতে সম্মত হইলেন না।
এই বিষয়ে নিষ্পত্তি না হইতেই, হেষ্টিংস নন্দকুমারের নামে, চক্রান্তকারী বলিয়া, সুপ্রীম কোর্টে অভিযোগ উপস্থিত করিলেন। এই অভিযোগের কিছুদিন পরেই কামালউদ্দীন নামে একজন মুসলমান এই অভিযোগ উপস্থিত করিল, নন্দকুমার এক কাগজে আমার নাম জাল করিয়াছেন। সুপ্রীম কোর্টের জজেরা উক্ত অভিযোগ গ্রাহ্য করিয়া নন্দকুমারকে কারাগারে নিক্ষিপ্ত করিলেন। ফ্রান্সিস ও তৎপক্ষীয়েরা জজদিগের নিকট বারংবার প্রস্তাব করিয়া পাঠাইলেন, জামীন লইয়া নন্দকুমারকে কারাগার হইতে মুক্ত করিতে হইবেক। কিন্তু জজেরা ঔদ্ধত্য প্রদর্শন পূর্বক তাহা অস্বীকার করিলেন। বিচারের সময় উপস্থিত হইলে জজেরা ধর্মাসনে অধিষ্ঠান করিলেন; জুরীরা নন্দকুমারকে দোষী নির্ধারিত করিয়া দিলেন; জজেরা নন্দকুমারের প্রাণদপণ্ডের আদেশ প্রদান করিলেন। তদনুসারে ১৭৭৫ খৃঃ অব্দের জুলাই মাসে তাঁহার ফাঁসি হইল।
যে দোষে সুপ্রীম কোর্টের বিচারে নন্দকুমারের প্রাণদণ্ড হইল তাহা যদি তিনি যথার্থই করিয়া থাকেন, সুপ্রীম কোর্ট স্থাপিত হইবার ছয় বৎসর পূর্বে করিয়াছিলেন। সুতরাং তৎসংক্রান্ত অভিযোগ কোনও ক্রমে সুপ্রীম কোর্টের গ্রাহ্য ও বিচার্য হইতে পারে না। বিশেষতঃ যে আইন অনুসারে এই সুবিচার হইল, ন্যায়পরায়ণ হইলে প্রধান জজ সর ইলাইজা ইম্পি, কদাচ উপস্থিত ব্যাপারে, এ আইনের মর্ম অনুসারে কর্ম করিতেন না। কারণ, এ আইন ভারতবর্ষীয় লোকদিগের বিষয়ে প্রচলিত হইবেক বলিয়া নির্দিষ্ট হয় নাই। ফলতঃ নন্দকুমারের প্রাণদণ্ড ন্যায়মার্গ অনুসারে বিহিত হইয়াছে, ইহা কোনও ক্রমে প্রতিপন্ন হইতে পারে না।
এতদ্দেশীয় লোকেরা, এই অভূতপূর্ব ব্যাপার দর্শনে একেবারে হতবুদ্ধি হইলেন, কলিকাতাবাসী ইংরেজরা প্রায় সকলেই গবর্ণর জেনরেলের পক্ষ ও তাঁহার প্রতি অতিশয় অনুরক্ত ছিলেন; তাঁহারাও অবিচারে নন্দকুমারের প্রাণদণ্ড দেখিয়া যৎপরোনাস্তি আক্ষেপ ও বিরাগপ্রদর্শন করিয়াছিলেন।
নন্দকুমার এতদ্দেশের একজন অতি প্রধান লোক ছিলেন। ইংরেজদিগের সৌভাগ্যদশা উদিত হইবার পূর্বে, তাঁহার এরূপ আধিপত্য ছিল যে, ইংরেজরাও বিপদ পড়িলে, সময়ে সময়ে, তাঁহার আনুগত্য করিতেন ও শরণাগত হইতেন। নন্দকুমার দুরাচার ছিলেন, যথার্থ বটে; কিন্তু ইম্পি ও হেষ্টিংস তাহা অপেক্ষা অধিক দুরাচার, তাহার সন্দেহ নাই।
এক মাস হইতে না হইতেই আর এক অভিযোগ উপস্থিত হইল, মণি বেগম নয় লক্ষ টাকার হিসাব দেন নাই। পীড়াপীড়ি করাতে বেগম কহিলেন, ‘হেষ্টিংস সাহেব যখন আমাকে নিযুক্ত করিতে আইসেন আমোদ উপলক্ষে ব্যয় করিবার নিমিত্ত, তাঁহার এক লাখ পঞ্চাশ হাজার টাকা উৎকোচ দিয়াছি।’ হেষ্টিংস কহিলেন, ‘আমি ঐ টাকা লইয়াছি বটে, কিন্তু সরকারী হিসাবে খরচ করিয়া কোম্পানির দেড় লক্ষ টাকা বাঁচাইয়াছি।’ হেষ্টিংস সাহেবের এই হেতুবিন্যাস কাহারও মনোনীত হইল না।
এক্ষণে স্পষ্ট দৃষ্ট হইল, অভিযোগ করিলেই গ্রাহ্য হইতে পারে। এই সুযোগ দেখিয়া নন্দকুমার হেষ্টিংসের নামে এই অভিযোগ উপস্থিত করিলেন যে— ‘গবর্ণর জেনেরল বাহাদুর সাড়ে তিন লক্ষ টাকা লইয়া মণি বেগমকে ও আমার পুত্র গুরুদাসকে মুরশিদাবাদে নবাবের রক্ষণাবেক্ষণ কার্যে নিযুক্ত করিয়াছিলেন।’ ফ্রান্সিস ও তৎপক্ষীয়েরা প্রস্তাব করিলেন, সাক্ষ্য দিবার নিমিত্ত নন্দকুমারকে কৌন্সিলের সম্মুখে আনীত করা যাউক। হেষ্টিংস উত্তর করিলেন, ‘আমি যে সভার অধিপতি তথায় আমার অভিযোক্তাকে আসিতে দিব না; বিশেষতঃ এমন বিষয়ে অপদার্থ ব্যক্তির ন্যায় সম্মত হইয়া গবর্ণর জেনেরলের পদের অমর্যাদা করিব না; এই সমস্ত ব্যাপার সুপ্রীম কোর্টে প্রেরণ করা যাউক।’ ইহা করিয়া হেষ্টিংস গাত্রোত্থান করিয়া কৌন্সিলগৃহ হইতে চলিয়া গেলেন, বারওয়েল সাহেবও তাঁহার অনুগামী হইলেন। তাঁহাদের প্রস্থানের পর, ফ্রান্সিস ও তৎপক্ষীয়েরা নন্দকুমারকে কৌন্সিলগৃহে আহ্বান করিলে তিনি এক পত্র পাঠ করিয়া কহিলেন, ‘মণি বেগম যখন যাহা ঘুষ দিয়াছেন, তদ্বিষয়ে এই পত্র লিখিয়াছেন।’ কিছুদিন পূর্বে বেগম গবর্ণমেন্টে এক পত্র লিখিয়াছিলেন; সর জন ডাইলি সাহেব, নন্দকুমারের পঠিত পত্রের সহিত মিলাইবার নিমিত্ত এ পত্র বাহির করিয়া দিলেন। মোহর মিলিল, হস্তাক্ষরের ঐক্য হইল না। যাহা হউক, কৌন্সিলের মেম্বারেরা নন্দকুমারের অভিযোগ যথার্থ বলিয়া স্থির করিলেন এবং হেষ্টিংসকে ঐ টাকা ফিরিয়া দিতে কহিলেন। কিন্তু তিনি তাহাতে কোনও মতে সম্মত হইলেন না।
এই বিষয়ে নিষ্পত্তি না হইতেই, হেষ্টিংস নন্দকুমারের নামে, চক্রান্তকারী বলিয়া, সুপ্রীম কোর্টে অভিযোগ উপস্থিত করিলেন। এই অভিযোগের কিছুদিন পরেই কামালউদ্দীন নামে একজন মুসলমান এই অভিযোগ উপস্থিত করিল, নন্দকুমার এক কাগজে আমার নাম জাল করিয়াছেন। সুপ্রীম কোর্টের জজেরা উক্ত অভিযোগ গ্রাহ্য করিয়া নন্দকুমারকে কারাগারে নিক্ষিপ্ত করিলেন। ফ্রান্সিস ও তৎপক্ষীয়েরা জজদিগের নিকট বারংবার প্রস্তাব করিয়া পাঠাইলেন, জামীন লইয়া নন্দকুমারকে কারাগার হইতে মুক্ত করিতে হইবেক। কিন্তু জজেরা ঔদ্ধত্য প্রদর্শন পূর্বক তাহা অস্বীকার করিলেন। বিচারের সময় উপস্থিত হইলে জজেরা ধর্মাসনে অধিষ্ঠান করিলেন; জুরীরা নন্দকুমারকে দোষী নির্ধারিত করিয়া দিলেন; জজেরা নন্দকুমারের প্রাণদপণ্ডের আদেশ প্রদান করিলেন। তদনুসারে ১৭৭৫ খৃঃ অব্দের জুলাই মাসে তাঁহার ফাঁসি হইল।
যে দোষে সুপ্রীম কোর্টের বিচারে নন্দকুমারের প্রাণদণ্ড হইল তাহা যদি তিনি যথার্থই করিয়া থাকেন, সুপ্রীম কোর্ট স্থাপিত হইবার ছয় বৎসর পূর্বে করিয়াছিলেন। সুতরাং তৎসংক্রান্ত অভিযোগ কোনও ক্রমে সুপ্রীম কোর্টের গ্রাহ্য ও বিচার্য হইতে পারে না। বিশেষতঃ যে আইন অনুসারে এই সুবিচার হইল, ন্যায়পরায়ণ হইলে প্রধান জজ সর ইলাইজা ইম্পি, কদাচ উপস্থিত ব্যাপারে, এ আইনের মর্ম অনুসারে কর্ম করিতেন না। কারণ, এ আইন ভারতবর্ষীয় লোকদিগের বিষয়ে প্রচলিত হইবেক বলিয়া নির্দিষ্ট হয় নাই। ফলতঃ নন্দকুমারের প্রাণদণ্ড ন্যায়মার্গ অনুসারে বিহিত হইয়াছে, ইহা কোনও ক্রমে প্রতিপন্ন হইতে পারে না।
এতদ্দেশীয় লোকেরা, এই অভূতপূর্ব ব্যাপার দর্শনে একেবারে হতবুদ্ধি হইলেন, কলিকাতাবাসী ইংরেজরা প্রায় সকলেই গবর্ণর জেনরেলের পক্ষ ও তাঁহার প্রতি অতিশয় অনুরক্ত ছিলেন; তাঁহারাও অবিচারে নন্দকুমারের প্রাণদণ্ড দেখিয়া যৎপরোনাস্তি আক্ষেপ ও বিরাগপ্রদর্শন করিয়াছিলেন।
নন্দকুমার এতদ্দেশের একজন অতি প্রধান লোক ছিলেন। ইংরেজদিগের সৌভাগ্যদশা উদিত হইবার পূর্বে, তাঁহার এরূপ আধিপত্য ছিল যে, ইংরেজরাও বিপদ পড়িলে, সময়ে সময়ে, তাঁহার আনুগত্য করিতেন ও শরণাগত হইতেন। নন্দকুমার দুরাচার ছিলেন, যথার্থ বটে; কিন্তু ইম্পি ও হেষ্টিংস তাহা অপেক্ষা অধিক দুরাচার, তাহার সন্দেহ নাই।
বিদ্যাসাগরের ওই বিবরণী থেকে বাংলায় ঔপনিবেশিক শাসনের প্রথম পর্বের একটা আদল পাওয়া যায়। বিদ্যাসাগরের আগে এ-দেশে আর কেউ বাংলা তথা ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনপর্বের কথা তুলে ধরেননি। তিনি বাংলার ইতিহাস লিখলেও এটা ছিল আসলে তাঁর স্বকালের ভারতের ইতিহাস, ব্রিটিশ শাসন-বিস্তারের কাহিনি। তিনি নিছক ইতিহাসের নীরস তথ্যাদি লিপিবদ্ধ করেননি, কাহিনির ছলে সময়টাকে ধরার চেষ্টা করেছেন। বাঙ্গালার ইতিহাস শুধু একটি কালখণ্ডের রাজনৈতিক ইতিহাস নয়, সামাজিক ইতিহাসও। ১৭৭০ সালের মন্বন্তরে বাংলার এক-তৃতীয়াংশ মানুষের প্রাণহানি, ১৭৮০ সালের ভারতের প্রথম সংবাদপত্র হিকিজ বেঙ্গল গেজেট প্রকাশ, ১৭৮৪ সালে সুপ্রিম কোর্টের জজ উইলিয়াম জোন্সের উদ্যোগে এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠা, ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে রাজস্ব বৃদ্ধির ব্যবস্থা, রামমোহন রায়ের সমাজসংস্কার ইত্যাদি কোনো বিষয় তাঁর নজর এড়ায়নি। বিদ্যাসাগর আধুনিকমনস্ক সমাজসংস্কারকামী উদ্যোগী পুরুষ ছিলেন, কিন্তু শ্রেণির ঊর্ধ্বে ওঠার সাধ্য তাঁর ছিল না। এ-কারণে সে-আমলের অন্যান্য বাবু-ভদ্রলোকের মতোই লর্ড কর্নওয়ালিশ-প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রশংসা করেন। তবে কোনো ব্যক্তির সীমাবদ্ধতা দিয়ে তাঁর সমগ্রতা মাপা উচিত নয়। বিদ্যাসাগর সম্পর্কে এই কথাগুলি বিশেষভাবে প্রযোজ্য। ১৮৩৫ সালের মার্চে বড়লাট লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক ভারত ছেড়ে যান যখন ভারতে ইংরেজ রাজত্ব ডালপালা বিস্তার করছিল। বিদ্যাসাগর এখানেই তাঁর ইতিহাস শেষ করেন।
বিদ্যাসাগরের রচনাগুলি নিয়ে যখন আলোচনা হয়, তখন সাধারণভাবে আখ্যানমঞ্জরী-র তিনটি ভাগ শুধু উল্লেখ করা হয়। বিদ্যাসাগর বিভিন্ন বই থেকে নানান কাহিনি উদ্ধৃত করে সেগুলি সরল ভাষায় ছাত্রদের জন্য গ্রন্থনা করেন। প্রথম ভাগে একুশটি, দ্বিতীয় ভাগে ছাব্বিশটি ও তৃতীয় ভাগে কুড়িটি কাহিনি স্থান পেয়েছে। লেখাগুলি বেশ সুখপাঠ্য। রচনারীতি খানিকটা নতুন বলা যায়। বেশ ক’টি কাহিনি ঔপনিবেশিক নির্মমতা ও নিষ্ঠুরতার বিবরণ। সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দিতে দেশ দখল করতে গিয়ে ইংরেজ, স্পেনীয় দখলকারেরা অধিকৃত দেশগুলির আদিবাসীদের ওপর যে-নৃশংস অত্যাচার চালিয়েছিল, তারই পরিচয় তিনি দিয়েছেন। এই লেখাগুলি খুঁটিয়ে পড়লে ঔপনিবেশিকতাবাদীদের, বিশেষ করে ইংরেজ রবিনসন ক্রুসোদের, স্বরূপ বুঝতে অসুবিধে হয় না। তাঁর আগে বোধ হয় আর কেউ এমন উদ্ঘাটন করেননি। দু’একটি কাহিনির সংক্ষেপে উল্লেখ করছি।
প্রথম কাহিনিটি— বর্বর জাতির সৌজন্য। আমেরিকার এক আদিবাসী শিকারে গিয়ে সন্ধ্যাবেলায় ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর হয়ে এক ইয়োরোপীয়র বাসস্থানে এসে দাঁড়ালেন। তিনি গৃহকর্তার কাছে কিছু খাদ্য ও পানীয় চাইলেন। গৃহকর্তা তাঁকে কর্কশভাবে দুর দুর করে তাড়িয়ে দিলেন। এই ঘটনার ছয় মাস পর ওই ইয়োরোপীয় ব্যক্তি বন্ধুবান্ধব নিয়ে একই বনে শিকারে গেলেন। সন্ধ্যায় তাঁরা একইভাবে ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর হয়ে বিহ্বল হয়ে পড়েন। অবশেষে একটি পর্ণকুটিরের সন্ধান পান। এক আদিবাসীকে দেখে তাঁকে বললেন, ‘আমাকে আমার ঘরের পথ দেখিয়ে দাও। তোমাকে অনেক টাকাপয়সা দেব।’ আদিবাসী কুটিরবাসী সে-রাতে তাঁদের ফেরা অসম্ভব বুঝে, তাঁদের কষ্টের মধ্যেও নিজ কুটিরে আশ্রয় দিলেন এবং তাঁদের খাদ্য-পানীয় ও শয্যার ব্যবস্থা করলেন। সকালে উঠে সেই মানুষটি আগন্তুকদের তাঁদের ঘরের পথ দেখিয়ে দিলেন। পরস্পর বিদায় নেওয়ার সময় আদিবাসী ব্যক্তিটি সেই ইয়োরোপীয়কে একটু হেসে বলল, ‘দেখুন তো, আমায় চিনতে পারেন কি না।’ ইউরোপীয় ব্যক্তিটি অনেকক্ষণ তাঁর মুখের দিকে চেয়ে তাঁকে চিনতে পারলেন এবং পূর্ব কৃতকর্ম মনে পড়ায় লজ্জায়় মাথা হেঁট করলেন। তিনি ক্ষমা চাওয়ার ভাষা খুঁজে পেলেন না। তখন সেই অসভ্য জাতির ব্যক্তি গর্বিত বাক্যে বললেন, ‘মহাশয়, আমরা বহুকালের অসভ্য জাতি; আপনারা সভ্য জাতি বলিয়া অভিমান করিয়া থাকেন। কিন্তু দেখুন, সৌজন্য ও সদ্যবহার বিষয়ে অসভ্য জাতি সভ্য জাতি অপেক্ষা কত অংশে উৎকৃষ্ট।’
দ্বিতীয় কাহিনি, নৃশংসতার চুড়ান্ত। কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারকে ইংরেজি পাঠ্যপুস্তকগুলিতে মহিমামণ্ডিত করা হয়। এই আবিষ্কারের স্বরূপ কী ছিল, তা বোঝাতে বিদ্যাসাগর তাঁর এই কাহিনিতে লিখলেন :
সুপ্রসিদ্ধ নাবিক কলম্বাস আমেরিকা মহাদ্বীপ আবিষ্কৃত করিলে সর্বপ্রথম তথায় স্পানিয়ার্ডদের অধিকার ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। তাঁহারা অর্থলালসা চরিতার্থ করিবার নিমিত্ত দুর্বল নিরপরাধ আদিমনিবাসী লোকদিগের উপর যৎপরোনাস্তি অত্যাচার করেন। কেয়নাবো নামে এক ব্যক্তি কোন প্রদেশের অধিপতি ছিলেন। স্পানিয়ার্ডরা তাঁহাকে অধিকারচ্যুত ও কারাগারে রুদ্ধ করিয়া রাখেন। তিনি কারাগারে থাকিয়া অশেষবিধ কষ্ট ও যাতনা ভোগ করিয়া প্রাণত্যাগ করেন। এইরূপে তাঁহার অধিকারভ্রংশ ও দেহযাত্রার পর্যবসান হওয়াতে তদীয় সহধর্মিণী এনাকেয়োনা নিতান্ত নিরুপায় ও নিঃসহায় হইলেন; তাঁহার সহোদর বিহিচিয়ো জারাপুয়া প্রদেশের অধিপতি ছিলেন, তাঁহার অধিকারে গিয়া আশ্রয় গ্রহণ করিলেন।
কিছুদিন পরে বিহিচিয়োর মৃত্যু হইল। তাঁহার ভগিনী এনাকেয়োনা তদীয় অধিকারে প্রতিষ্ঠিত হইলেন। ইতিপূর্বে স্পানিয়ার্ডরা তাঁহার সর্বনাশ করিয়াছিলেন। কিন্তু তিনি বৈরসাধনবৃদ্ধির অধীন না হইয়া তাঁহাদের প্রতি অত্যন্ত সদয় ব্যবহার করিতে লাগিলেন। তাঁহাদের অনিষ্ট চেষ্টা বা উচ্ছেদবাসনা এক ক্ষণের জন্য তাঁহার উন্নত অন্তঃকরণে উদিত হয় নাই। ফলতঃ তিনি বিলক্ষণ মহানুভবা ও উদারস্বভাবা ছিলেন। কিন্তু এনাকেয়োনার সৌজন্য ও সদয় ব্যবহার দর্শনে স্পানিয়ার্ডদিগের অনায়াসে আমাদের উচ্ছেদসাধন করিতে পারিবেক, এই অভিপ্রায়েই এইরূপ আত্মীয়তা করিতেছে। অতএব তাহাদিগকে সমুচিত প্রতিফল দেওয়া উচিত। অনন্তর তিনি সৈন্যসংগ্রহপূর্বক তৎপ্রদেশাভিমুখে প্রস্থান করিলেন ও প্রচার করিয়া দিলেন, এনাকেয়োনার সাক্ষাৎকার মাত্র এই যাত্রার উদ্দেশ্য।
জারাপুয়াবাসীরা সেনাপতি ওবেন্ডোর শঠতা ও হীন ষড়যন্ত্রমূলক আচরণকে বিন্দুমাত্র সন্দেহ করেননি, তাঁদের রানি এনাকেয়োনা ওরেন্ডো ও তাঁর দলবলকে রাজকীয় অভ্যর্থনা দিলেন ও তাঁদের সাদর পরিচর্যা করতে লাগলেন। এর প্রতিদানে তাঁরা গোপন কৌশলে রানি ও তাঁর সহযোগীদের পাল্টা অভ্যর্থনার নামে বন্দি করে হত্যা করলেন। ঔপনিবেশিক দখলদারেরা কতখানি হীন ও নির্মম ছিল, এই একটি কাহিনিতেই তার পরিচয় রয়েছে। স্পানিয়ার্ডরা জারাপুয়া গোষ্ঠীপতিদের অভ্যর্থনা বন্ধ রেখে জতুগৃহ দাহের মতো কাণ্ড করলেন এবং তারপর শিশু ও নারীসহ মানুষদের কচুকাট করলেন। রানিকে মনগড়া অভিযোগে ফাঁসি দিলেন। যাঁরা এ-সব ঘৃণ্য আচরণ করেছিলেন, বিদ্যাসাগর তাঁদের ‘রাক্ষস’ আখ্যা দেন। সব দেশে ঔপনিবেশিক শাসকদের চরিত্র একই। আর একেই তাঁরা ‘সভ্যতা বিস্তার’ বলে থাকেন।
এমন আরেক রাক্ষসের গল্প পুরুষ জাতির নৃশংসতা। লন্ডনের এক বখে যাওয়া ছেলে টমাস ইঙ্কল আমেরিকা যাত্রা করল বেশি অর্থলাভের আশায়। আদিবাসীদের ভয়ে ইঙ্কল গভীর জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছিল। ওই প্রদেশের জনজাতিরাজের কন্যা ইয়ারিকো ওই যুবককে উদ্ধার করে ও তাকে সেবা-যত্নে সুস্থ করে তোলে। কালক্রমে ইয়ারিকো ওই যুবকের প্রেমে পড়ে ও তার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়। ইয়ারিকো তার স্বামীর সুখস্বাচ্ছন্দ্যের জন্য যথাসাধ্য করল। কয়েক মাস পর ইঙ্কল ইয়ারিকোকে প্রস্তাব দিল, এ-সব কঠিন পরিবেশে না-থেকে তাকে নিয়ে সে স্বদেশে ফিরে যেতে চায়। ইয়ারিকো ইঙ্কলকে এতটাই ভালোবাসত যে স্বামীর প্রস্তাবে তৎক্ষণাৎ সম্মত হল। স্বামীর মনে যে অন্যতর মন্দ অভিপ্রায় আছে, ভাবতে পারেনি। ইয়োরোপীয় জাহাজ দেখে সে-ই স্বামীকে খবর দিল। ইঙ্কল খবর নিয়ে জানতে পারল, ওই জাহাজ দাস সংগ্রহে আমেরিকায় এসেছে। এক দাসব্যবসায়ী চড়া দামে ইয়ারিকোকে কিনতে চাইল। প্রথমে সে রাজি হয়নি। পরে ভাবনাচিন্তা করে দেখল, সে অর্থলাভের আশায় এত দূর এসেছে। কিন্তু সময় নষ্ট হয়েছে, কাজের কাজ হয়নি। অতএব আরও বেশি দামে নিজের স্ত্রী ইয়ারিকোকে বিক্রি করে দিল। সেই তরুণী তখন সন্তানসম্ভবা ছিল। তার কাতর আবেদন ইঙ্কলের মন ভেজাতে পারল না। এই কাহিনি শেকসপীয়ারের ওথেলো-কে হার মানায়। বঙ্কিমচন্দ্র অমর উপন্যাস কপালকুণ্ডলা সৃষ্টির আগে বিদ্যাসাগর এ-সব লাইভ-স্টোরি লিখেছিলেন।
পরিশেষে, আমেরিকায় ইংরেজদের উপনিবেশ স্থাপনের আদি পর্বের একটি কাহিনি নিঃস্পৃহতা ও উন্নতচিত্ততা তুলে ধরছি। এ বার পাঠকেরাই বুঝে নিন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ঔপনিবেশিকতার সমর্থক ছিলেন কি না।
নিঃস্পৃহতা ও উন্নতচিত্ততা
আমেরিকা দেশের ইংরেজদিগের এক উপনিবেশ স্থাপিত হইয়াছিল। ক্রমে ক্রমে অনেক ইংরেজ তথায় গিয়া বাস করিয়াছিলেন। এই উপনিবেশ ইংলণ্ডের রাজশাসনের অধীন ছিল। ইংলণ্ডে রাজা ও প্রজার পরস্পর যেরূপ সম্বন্ধ, আমেরিকার উপনিবেশবাসী প্রজাবর্গেরও ইংলণ্ডের রাজার সহিত সেইরূপ সম্বন্ধ ছিল। ফলতঃ এই উপনিবেশ ইংলণ্ড রাজ্যের অংশস্বরূপ পরিগণিত হইত।
উপনিবেশবাসী প্রজাবর্গ ইংলণ্ডের রাজশাসনপ্রণালীতে অসন্তুষ্ট হইতে লাগিলেন। অনেক বিষয়ে তাঁহাদের উপর অবিচার ও অত্যাচার হইতেছিল। এ সমস্ত অবিচার ও অত্যাচার ক্রমে ক্রমে অসহ্য হইয়া উঠিল। উপনিবেশবাসীরা প্রতিজ্ঞা করিলেন, ইংলণ্ডের অধীনতা হইতে মুক্ত হইয়া স্বাধীন হইবেন; অর্থাৎ ইংলণ্ডের সহিত আর কোনও সংস্রব না রাখিয়া, উপনিবেশের রাজশাসনকার্য আপনারাই সম্পন্ন করিবেন। এইরূপ অভিপ্রায় প্রকাশিত হওয়াতে, উপনিবেশবাসীরা ইংলণ্ডে রাজবিদ্রোহী বলিয়া পরিগণিত হইলেন। বিদ্রোহশান্তির নিমিত্ত ইংলণ্ড হইতে বহুসংখ্যক সৈন্য প্রেরিত হইল। উভয় পক্ষে ঘোরতর সংগ্রাম হইতে লাগিল। অবশেষে, উপনিবেশবাসীরা সম্পূর্ণ জয়লাভ করিলেন এবং সর্বতোভাবে স্বাধীন হইয়া আপনারা উপনিবেশের রাজশাসনকার্য সম্পন্ন করিতে লাগিলেন।
যখন এই উপলক্ষে ইংলণ্ডের সহিত উপনিবেশের প্রথম বিরোধ উপস্থিত হয়, তখন উপনিবেশবাসীরা সমবেত হইয়া, আপনাদিগের মধ্য হইতে কতিপয় উপযুক্ত ব্যক্তিকে সর্বসাধারণের প্রতিনিধি স্থির করিয়া, একটি প্রতিনিধিসমাজের স্থাপন ও এ সমাজের উপর সমস্ত কার্যনির্বাহের ভারার্পণ করেন। প্রতিনিধিরা সমাজে সমবেত হইয়া, সর্ববিষয়ের সবিশেষ সমালোচনাপূর্বক সমস্ত কার্য সম্পন্ন করিতেন। এই প্রতিনিধিসমাজের সভাপতি সেনাপতি রীড সাহেব যারপরনাই ধর্মশীল ও দেশহিতৈষী ছিলেন; সবিশেষ যত্ন, আগ্রহ ও অভিনিবেশ সহকারে কার্যনির্বাহ করিতেন। তাঁহার সভাপতিত্ব সময়ে বিবাদ নিষ্পত্তির নিমিত্ত ইংলণ্ড হইতে কতিপয় দূত প্রেরিত হইয়াছিলেন। তাঁহারা সকল বিষয়ের সবিশেষ সমস্ত অবগত হইয়া ইংলণ্ডের ইষ্টসিদ্ধির পথ পরিষ্কৃত হয়; তখন তাঁহারা রীড সাহেবের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া বলিলেন, যদি আপনি উপনিবেশের সংস্রব পরিত্যাগ করিয়া ইংলণ্ডের পক্ষ অবলম্বন করেন, তাহা হইলে আমরা আপনকার যথোচিত সম্মান করি।
এই বলিয়া তাঁহারা তাঁহাকে দশ সহস্র গিনি উৎকোচ দিবার অভিপ্রায় প্রকাশ করিলেন। রীড সাহেব উৎকোচ দানের প্রস্তাব শ্রবণে মনে মনে যৎপরোনাস্তি বিরক্ত হইয়া, সহাস্য বদনে বলিলেন, ‘দেখুন, আমি অতি হীন, তাহার সন্দেহ নাই; কিন্তু আপনাদের রাজা আমায় কিনিতে পারেন, তাঁহার এত টাকা নাই।’ এই বলিয়া তিনি তাঁহাদিগকে তৎক্ষণাৎ বিদায় করিয়া দিলেন।
ফলকথা এই, অর্থলোভের বশীভূত হইয়া, উৎকোচ গ্রহণ পূর্বক স্বদেশের হিতসাধনে বিরত অথবা অনিষ্টসাধনে প্রবৃত্ত হইবেন, মহামতি সেনাপতি রীড সাহেব সেরূপ প্রকৃতির ও সেরূপ প্রবৃত্তি লোক ছিলেন না। যাহাদের অর্থলোভ অতি প্রবল, এবং ধর্মাধর্মবোধ ও উচিতানুচিত বিবেচনা নাই; সেই নিতান্ত নীচাশয় নরাধমেরাই উৎকোচ গ্রহণে প্রবৃত্ত হয়। আর যাহারা ন্যায়মার্গ অনুসারে কৃতকার্য হইতে না পারে; সেই দুরাচারেরাই উৎকোচদানরূপ অন্যায্য উপায় অবলম্বন পূর্বক স্বীয় অভিপ্রেতসাধনের চেষ্টা করিয়া থাকে। ফলতঃ উৎকোচ দান ও উৎকোচ গ্রহণ, উভয়ই সর্বতোভাবে নিতান্ত ন্যায়বিরুদ্ধ ও ধর্মবিরুদ্ধ ব্যবহার, তাহার সন্দেহ নাই। বিবেচনা করিয়া দেখিলে, দস্যু, তস্কর, উৎকোচগ্রাহী, ইহারা এক সম্প্রদায়ের লোক।
লেখক-পরিচিতি : প্রবীণ সাংবাদিক, প্রবন্ধকার ও রাজনৈতিক কর্মী। বাহান্ন বছর সাংবাদিকতা পেশায় যুক্ত। ১৯৬৬ সালে দৈনিক কালান্তর-এর শুরু থেকে ২০১৮-র বন্ধ হওয়া পর্যন্ত জড়িত ছিলেন। পেশাগত সূত্রে ১৯৭৬ সালে ইয়োরোপের চারটি দেশে যান এবং ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমন্ত্রণে আন্তর্জাতিক সাংবাদিক দলের সঙ্গে সে-দেশের যমুনা সেতু উদ্বোধনে উপস্থিত ছিলেন। রাজ্যের প্রায় সব ক’টি দৈনিকে ও বিভিন্ন সাময়িক পত্রিকায় প্রবন্ধ ও ফিচার লিখেছেন।
প্রকাশিত গ্রন্থ : পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ (১৯৭১), সম্পাদক রবীন্দ্রনাথ।
একাধিক পুস্তিকা ও স্মারক-পত্রিকার সম্পাদক বা যুগ্ধ-সম্পাদক।
প্রকাশিত গ্রন্থ : পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ (১৯৭১), সম্পাদক রবীন্দ্রনাথ।
একাধিক পুস্তিকা ও স্মারক-পত্রিকার সম্পাদক বা যুগ্ধ-সম্পাদক।
[অজানা বিদ্যাসাগর অনন্য দিশারি- সেপ্টেম্বর-২০১৯]
কোন মন্তব্য নেই
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন