মোট পৃষ্ঠাদর্শন

    ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
        মাইকেল মধুসূদন দত্ত

  বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে।
  করুণার সিন্ধু তুমি, সেই জানে মনে,
  দীন যে, দীনের বন্ধু!—উজ্জ্বল জগতে
  হেমাদ্রির হেমকান্তি অম্লান কিরণে।
  কিন্তু ভাগ্যবলে পেয়ে সে মহা পর্বতে,
  যে জন আশ্রয় লয় সুবর্ণ চরণে,
  সেই জানে কত গুণ ধরে কত মতে
  গিরীশ। কি সেবা তার সে মুখ সদনে।—
  দানে বারি নদীরূপ বিমলা কিঙ্করী;
  যোগায় অমৃত ফল পরম আদরে
  তরুদল, দাসরূপ ধরি;
  পরিমলে ফুলকুল দশ দিশ ভরে;
  দিবসে শীতল শ্বাসী ছায়া, বনেশ্বরী,
  নিশার সুশান্ত নিদ্রা, ক্লান্তি দূর করে!

ইংরেজ সরকারের আইন উপদেষ্টা ও শিক্ষা সংসদের সভাপতি শিক্ষাবিদ জন ইলিয়ট ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন ছিলেন কেম্ব্রিজ-এর কৃতী ছাত্র, গ্র্যাজুয়েট এবং ব্যারিস্টার। ভারতপ্রেমিক ও মানবতাবাদী এই মানুষটির ভারতবর্ষে তথা কলকাতায় আগমন এদেশের দুর্ভাগা ও অবহেলিত নারীসমাজের কাছে আশীর্বাদস্বরূপ বলা যায়। অনেকের মতে, যিনি এই বেথুন সাহেবকে বাঙালি নারীর শিক্ষাক্ষেত্রে অনগ্রসরতা এবং অসহায়তা সম্পর্কে অবহিত করে এ কাজে এগিয়ে আসতে সার্বিক প্রেরণা জুগিয়েছিলেন, তিনি স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।

—কানাই লাল রায়



অধ্যাপক আহমদ শরীফ তাঁর ‘বিদ্যাসাগর’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘তিনি [বিদ্যাসাগর] নতুন চেতনার জনক, সংস্কার মুক্তির জনক, জীবন-জিজ্ঞাসার জনক, বিদ্রোহের জনক, শিক্ষা ও সংস্কারের জনক, সংগ্রামীর জনক, ত্যাগ-তিতিক্ষার জনক। জনকত্বই তাঁর কৃতি ও কীর্তি। সমকালীন বাংলার সব নতুনেরই জনক ছিলেন তিনি। তিনিই ছিলেন ঈশ্বর। বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁর পরবর্তী কর্মীরা ছিলেন প্রবর্তনাদাতা, সে ঈশ্বরেরই অভিপ্রায়-চালিত নিমিত্ত মাত্র।’

আধুনিক পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যার সঙ্গে আমাদের দেশে লৌকিক সংস্কৃতবিদ্যার যোগসূত্র প্রতিষ্ঠা, শিক্ষাসংস্কার এবং বাংলা ভাষার মাধ্যমে গণশিক্ষা প্রচলন— শিক্ষাক্ষেত্রে এগুলি হল শিক্ষাব্রতী বিদ্যাসাগরের প্রধান কীর্তি। এই কথাটাকে আর একটু পরিষ্কারভাবে বলা যায়, মাতৃভাষাকে বিদ্যার মাধ্যম করা, মৌলিক চিন্তার বিকাশে উৎসাহ দেওয়া ও শিক্ষাকে সব রকমের ধর্মীয় গোঁড়ামি থেকে মুক্ত করে বিষয়বস্তুতে পরিপূর্ণ মানবিক আদর্শের বিকাশ ঘটানো— এই ছিল বিদ্যাসাগরের শিক্ষাপরিকল্পনার মূল কথা। তাঁর আর-একটি কীর্তি হল বালকদের জন্য বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সঙ্গে এদেশে স্ত্রীশিক্ষা প্রচলনের চেষ্টা ও বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন। সেসময় স্ত্রীশিক্ষা পুরুষদের তুলনায় অনেকটাই পিছিয়ে ছিল। জন ইলিয়ট ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন (১৮০১-১৮৫১), যিনি মহাত্মা বেথুন নামে সমধিক খ্যাত, তাঁর সহযোগী রূপে বিদ্যাসাগর বাংলাদেশে স্ত্রীশিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রে পদার্পণ করেন। সেকালে আমাদের দেশে স্ত্রীশিক্ষা সম্বন্ধে নানা বদ্ধমূল কুসংস্কার প্রচলিত ছিল। যেমন, নারীরা শিক্ষিত হলে তারা বিধবা হবে, তারা মুখরা, দুশ্চরিত্রা ও গৃহকর্মবিমুখ হবে। হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার পর আধুনিক পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান-সাহিত্যের নিরবচ্ছিন্ন চর্চার ফলে এদেশের মানুষ, সীমিত সংখ্যায় হলেও, প্রাচীন গোঁড়া সংস্কার থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করেন। এই শিক্ষিত নাগরিক উচ্চ সমাজের মধ্যে ধীরে ধীরে স্ত্রীশিক্ষা সম্বন্ধে প্রাথমিক চেতনা জাগছিল। ঠিক সেই সময় বেথুন ও বিদ্যাসাগর স্থির সংকল্পের সঙ্গে এগিয়ে এলেন স্ত্রীশিক্ষাকে বাস্তবে রূপদান করার জন্য। রাজপুরুষ ডালহৌসি ও হ্যালিডে-র সঙ্গে যুক্ত হল দুই শিক্ষাবিদ বেথুন ও বিদ্যাসাগরের অধ্যবসায়, দৃঢ়তা ও নিষ্ঠা।
আমরা আরম্ভ করি, শেষ করি না; আড়ম্বর করি, কাজ করি না, যাহা অনুষ্ঠান করি তাহা বিশ্বাস করি না, যাহা বিশ্বাস করি তাহা পালন করি না, ভূরিপরিমাণ বাক্যরচনা করিতে পারি, তিলপরিমাণ আত্মত্যাগ করিতে পারি না, আমরা অহংকার দেখাইয়া পরিতৃপ্ত থাকি, যোগ্যতালাভের চেষ্টা করি না, আমরা সকল কাজেই পরের প্রত্যাশা করি অথচ পরের ক্রুটি লইয়া আকাশ বিদীর্ণ করিতে থাকি, পরের অনুকরণে আমাদের গর্ব, পরের অনুগ্রহে আমাদের সম্মান, পরের চক্ষে ধূলিনিক্ষেপ করিয়া আমাদের পলিটিক্স, এবং নিজের বাক্চাতুর্যে নিজের প্রতি ভক্তিবিহ্বল হইয়া উঠাই আমাদের জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য। এই দুর্বল, ক্ষুদ্র, হৃদয়হীন, কর্মহীন, দাম্ভিক, তার্কিক জাতির প্রতি বিদ্যাসাগরের এক সুগভীর ধিক্কার ছিল। কারণ তিনি সর্ববিষয়েই ইহাদের বিপরীত ছিলেন।

—শুভেন্দু সরকার



হরনাথ তর্কভূষণের মৃত্যুর পর ১৮৪৪-এ সংস্কৃত কলেজের ব্যাকরণের অধ্যাপক হওয়ার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-৯১)। বিকল্প হিসেবে তারানাথ তর্কবাচস্পতির নাম তিনি শুধু সুপারিশই করেননি, কলকাতা থেকে হেঁটে অম্বিকা-কালনা গিয়ে তাঁর সম্মতিও নিয়ে আসেন। অথচ দেখা গেল, দু’বছর পর সে-কলেজের সহকারী সম্পাদক হতে বিদ্যাসাগর এককথায় রাজি। এমনকী, দরখাস্তে আত্মপক্ষ সমর্থনে বেশ কিছু যুক্তিও সাজালেন তিনি। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে বাংলা পড়ানোর সময় সংস্কৃত কলেজের বার্ষিক বৃত্তি পরীক্ষার মূল্যায়নে তাঁর সক্রিয় ভুমিকা থাকত। এ ছাড়া, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অধ্যক্ষ মেজর জি. টি. মার্শাল-এর সুপারিশপত্র বিশেষ কাজে দিল। বিদ্যাসাগর নতুন চাকরিতে ঢুকলেন ৬ এপ্রিল ১৮৪৬-এ। প্রশ্ন জাগে: তাঁর মত পালটানোর হেতু কী? ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে নিজের জায়গায় ভাই দীনবন্ধু ন্যায়রত্নকে নিতে অনুরোধ করার পেছনে এর সম্ভাব্য উত্তরটি পাওয়া যাবে। বিদ্যাসাগরের আশঙ্কা ছিল: সংস্কৃত কলেজে তাঁর চাকরি বেশিদিন না-ও টিকতে পারে। প্রাক্তন ছাত্র বলে সংস্কৃত কলেজের শিক্ষা-প্রণালীর নানা খামতির কথা বিদ্যাসাগর জানতেন। সেসব দূর করাই ছিল তাঁর আসল উদ্দেশ্য। তাই অধ্যাপক নয়, প্রশাসকের পদ তিনি বেছে নিলেন। কিন্তু তাঁর পথ যে মসৃণ হবে না— তা নিয়ে বিদ্যাসাগরের দুশ্চিন্তা ছিল।

চাকরি পাওয়ার পরই উঠে-পড়ে লাগলেন বিদ্যাসাগর। ১৯ সেপ্টেম্বর ১৮৪৬-এ সংস্কৃত কলেজের পঠনপাঠন নিয়ে তাঁর সংস্কার-পরিকল্পনাটি শিক্ষাপরিষদে পাঠানোর জন্যে সম্পাদক রসময় দত্তর কাছে দাখিল করলেন। এ ব্যাপারে তিনি চার-পাঁচজন শিক্ষকের সাহায্য পেয়েছিলেন। পরিকল্পনায় ব্যাকরণ পাঠের পদ্ধতি ও পাঠ্যপুস্তকের পরিবর্তন চাওয়া হল। এ ছাড়া, ইংরিজি বিভাগের আমূল সংস্কারও ছিল বিদ্যাসাগরের অভীষ্ট। গোড়া থেকেই নিজের কাছে তাঁর শিক্ষাচিন্তার লক্ষ্য ছিল স্থির। বিদ্যাসাগর বরাবর এমন একদল লোক গড়ে তুলতে চেয়েছেন যারা পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান দিয়ে বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করবে। তাই সংস্কৃতর পাশাপাশি ইংরিজি পড়ানোর ওপর জোর দেন তিনি। এ কথাও ঠিক, ভাল বাংলা লেখার জন্যে সংস্কৃতয় দখল থাকা জরুরি। তখন সংস্কৃত কলেজে ইংরিজি ছিল ঐচ্ছিক বিষয়; বিদ্যাসাগর সেটিকে বাধ্যতামূলকভাবে পড়াতে চাইলেন। বিদ্যাসাগরের প্রকল্পটি ব্যক্তিগতভাবে অনুমোদন করেন মার্শাল।
‘প্রতিদিন দেখিয়াছেন— আমরা আরম্ভ করি, শেষ করি না; আড়ম্বর করি, কাজ করি না, যাহা অনুষ্ঠান করি তাহা বিশ্বাস করি না, যাহা বিশ্বাস করি তাহা পালন করি না, ভূরিপরিমাণ বাক্যরচনা করিতে পারি, তিলপরিমাণ আত্মত্যাগ করিতে পারি না, আমরা অহংকার দেখাইয়া পরিতৃপ্ত থাকি, যোগ্যতালাভের চেষ্টা করি না, আমরা সকল কাজেই পরের প্রত্যাশা করি অথচ পরের ত্রুটি লইয়া আকাশ বিদীর্ণ করিতে থাকি, পরের অনুকরণে আমাদের গর্ব, পরের অনুগ্রহে আমাদের সম্মান, পরের চক্ষে ধূলিনিক্ষেপ করিয়া আমাদের পলিটিক্স, এবং নিজের বাক্চাতুর্যে নিজের প্রতি ভক্তিবিহ্বল হইয়া উঠাই আমাদের জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য। এই দুর্বল, ক্ষুদ্র, হৃদয়হীন, কর্মহীন, দাম্ভিক, তার্কিক জাতির প্রতি বিদ্যাসাগরের এক সুগভীর ধিক্কার ছিল। কারণ তিনি সর্ববিষয়েই ইহাদের বিপরীত ছিলেন।’ (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

—সেমন্তী ঘোষ



যোগবাশিষ্ঠের একটি শ্লোক উদ্ধৃত করে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জীবনীবিষয়ক প্রবন্ধ লিখতে শুরু করেছিলেন শিবনাথ শাস্ত্রী শ্লোকটি হল— ‘তরবোহপি হি জীবন্তি জীবন্তি মৃগপক্ষিণঃ/ স জীবতি মনো যস্য মননেন হি জীবতি’: ‘গাছপালাও জীবনধারণ করে, পশুপাখিও জীবনধারণ করে, কিন্তু সে-ই প্রকৃতরূপে জীবিত, যে মনের দ্বারা জীবিত থাকে’। আবার, তাঁর প্রবন্ধ থেকে ঠিক এই শ্লোকটি তুলে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘বিদ্যাসাগর’ নামে প্রবন্ধটি রচনা করেছিলেন ১৩০৫ বঙ্গাব্দে, অর্থাৎ ১৮৯৮ সালে।

সুতরাং, এই শ্লোক বিদ্যাসাগর-জীবনীর ক্ষেত্রে ঘুরে ঘুরে আসা একটি ধুয়ো, এমন কথা বললে খুব ভুল হবে না। আপাতত এই লেখা শুরু করার জন্যও বেশ উপযুক্ত মনে হচ্ছে শ্লোকটিকে, কেননা বিদ্যাসাগরের চরিত্র বিষয়ে পরবর্তী বাঙালি মনীষীদের কৌতূহলের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ এর মধ্যে মোক্ষমভাবে ধরা আছে। ইতিহাসে বিদ্যাসাগরকে কত নানাভাবে ফিরে ফিরে দেখা হয়েছে, আমরা এখানে তার একটা মোটের উপর ধারণা তৈরি করতে চাইছি, তাই এই শ্লোক আমাদের সহায়ক হতে পারে। বুঝিয়ে দিতে পারে, বিদ্যাসাগর বিষয়ে শ্রদ্ধাভিভূত রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে বিদ্যাসাগরের প্রধান গুণটি কেন এই সূত্রের মধ্যেই প্রকাশিত: ‘সাধারণ বাঙালির সহিত বিদ্যাসাগরের যে একটি জাতিগত সুমহান্‌ প্রভেদ দেখিতে পাওয়া যায়, সে প্রভেদ শাস্ত্রীমহাশয় যোগবাশিষ্ঠের একটিমাত্র শ্লোকের দ্বারা পরিস্ফুট করিয়াছেন। আমাদের অপেক্ষা বিদ্যাসাগরের একটা জীবন অধিক ছিল। তিনি কেবল দ্বিজ ছিলেন না, তিনি দ্বিগুণ জীবিত ছিলেন।’ এই কারণেই ‘তাঁহার লক্ষ্য, তাঁহার আচরণ, তাঁহার কার্যপ্রণালী আমাদের মতো ছিল না। আমাদের সম্মুখে আছে আমাদের ব্যক্তিগত সুখদুঃখ, ব্যক্তিগত লাভক্ষতি। তাঁহার সম্মুখেও অবশ্য সেগুলো ছিল, কিন্তু তাহার উপরেও ছিল তাঁহার অন্তর্জীবনের সুখদুঃখ, মনোজীবনের লাভক্ষতি। সেই সুখদুঃখ-লাভক্ষতির নিকট বাহ্য সুখদুঃখ-লাভক্ষতি কিছুই নহে।’
ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠী এবং ব্রাহ্মদের সঙ্গে বিদ্যাসাগরের সংস্কারপন্থার পার্থক্য সম্পর্কে অশোক সেন লিখেছেন যে, বিধবাবিবাহের মতো সংস্কারের ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগর চেয়েছিলেন জনসমর্থন, চেয়েছিলেন খাঁটি অর্থে সামাজিক বৈধতা, ‘Vidyasagar was striving in a more real sense to achieve the social legitimacy of reforms’। তাঁর শাস্ত্রনির্ভরতার মূল ছিল এই বৃহত্তর লক্ষ্যে। অশোক সেন সংগত কারণেই বলেছেন যে, বিস্তৃত হিন্দু ও তৎসংলগ্ন জনজাতিদের সমাজে তাঁর প্রচেষ্টা ব্যাহত হয় কারণ শাস্ত্রে আলোচিত বিষয়গুলি ছিল একান্তভাবেই উচ্চবর্ণ হিন্দুদের। ইংরেজদের চালু করা বিধবাবিবাহ আইনে প্রয়াত স্বামীর ধনে অধিকার ত্যাগে বাধ্য হত পুনর্বিবাহিত হিন্দু নারী। এ ব্যাপারে বিদ্যাসাগর আপত্তি তোলেননি, রক্ষণশীল হিন্দু সমাজপতিদের নতুন করে ক্ষুব্ধ করতে চাননি বলেই হয়তো।

—স্বপন চক্রবর্তী



ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের রচনা বলে একটি লেখা চলে আসছে। সংক্ষিপ্ত রচনাটির শিরোনাম ‘বাল্যবিবাহের দোষ’। ১৮৫০ সালে সেটি বেরিয়েছিল সর্ব্বশুভকরী নামের মাসিক কাগজে। অনামা লেখাটি যে বিদ্যাসাগরের কীর্তি তা বলেছেন শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন। বিদ্যাসাগর-রচনার বিভিন্ন সংগ্রহে সংকলিতও হয়েছে নিবন্ধটি। তবুও প্রবন্ধের একটি জায়গায় পৌঁছে খটকা লাগতে পারে পাঠকের। দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে লেখক বলছেন যে, স্মৃতিশাস্ত্রের অনুজ্ঞা এবং লোকাচার মিলে এমনই এক দুর্বহ সামাজিক চাপ সৃষ্টি করে গৃহস্থের উপর যে, বাল্যবিবাহ ও তার লঙ্ঘনের শাস্ত্রবিহিত শাস্তিকে নীতিবিরুদ্ধ মনে হলেও ব্যক্তিবিশেষের গত্যন্তর থাকে না, তিনি নিরুপায় চিত্তে ‘… চিরাচরিত লৌকিক ব্যবহারের পরতন্ত্র হইয়া স্বাভীষ্ট সিদ্ধি করিতে সমর্থ হন না। তাঁহার আন্তরিক চিন্তা অন্তরে উদয় হইয়া ক্ষণপ্রভার ন্যায় ক্ষণমাত্রেই অন্তরে বিলীন হইয়া যায়’ (১.৩৫৫)।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর আন্তর্জাতিক সম্মেলন সমাপ্ত

—নিজস্ব প্রতিবেদক
(প্রথমআলো)


বিদ্যাসাগর অনেক বড় একজন বিপ্লবী ছিলেন

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দ্বিশত জন্মবর্ষ উপলক্ষ করে অনলাইনে ‘২০০ বছরে বিদ্যাসাগর’ শীর্ষক শিরোনামে চার দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক সম্মেলন গতকাল রোববার সন্ধ্যায় শেষ হয়েছে। বাংলাদেশ ইতিহাস অলিম্পিয়াড জাতীয় কমিটির সভাপতি সেলিনা হোসেনের সভাপতিত্বে সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন কবি, কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক আনিসুল হক।

মুক্ত আসর ও বাংলাদেশ ইতিহাস অলিম্পিয়াড জাতীয় কমিটির আয়োজনে সমাপনী অনুষ্ঠানে আনিসুল হক বলেন, ‘বিদ্যাসাগর নারীদের প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও কর্তব্যবোধের পরিচয় দিয়েছেন। ২০০ বছর পর বিদ্যাসাগরকে স্মরণ করছি। এর দ্বারা প্রমাণিত হয় তিনি কত মহান ছিলেন। বিদ্যাসাগরের চর্চার মাধ্যমে জানা, বোঝার, পড়ার এক বিস্তারিত জগৎ খুলে যায়। ইতিহাসের আলোকে বর্তমানকে মোকাবিলা করতে হবে। বিদ্যাসাগরের কাজগুলো কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। বিদ্যাসাগর অনেক বড় একজন বিপ্লবী ছিলেন। তিনি আমাদের মনের মধ্যে পরিবর্তনের সূচনা করতে যে আগুনটা দরকার, সেই আগুনটা জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি আমাদের মনের বিপ্লবী।’
আগামীকাল ২৬ সেপ্টেম্বর বাঙালির রেনেসাঁর অন্যতম কান্ডারি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ২০০তম জন্মদিন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর লেখা ও বক্তৃতায় সার্বিকভাবে মূল্যায়ন করেছেন এই মনীষীকে। সেই মূল্যায়নের আলোকে বর্তমানে এই লেখায় খোঁজা হয়েছে বিদ্যাসাগরের প্রাসঙ্গিকতা।

—মালেকা বেগম


	‘হে নূতন,
দেখা দিক আর-বার জন্মের প্রথম শুভক্ষণ
তোমার প্রকাশ হোক কুহেলিকা করি উদঘাটন
            সূর্যের মতন।’

শুরুতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আনুষ্ঠানিক সংগীত’-এর তিনটি লাইন লিখলাম ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ২০০তম জন্মদিন স্মরণে। গানের এই কথাগুলো রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন নিজের জন্মদিন উপলক্ষে।

আজ এই লেখায় রবীন্দ্রনাথের শৈশব-কৈশোরের স্মৃতিচারণায় মূর্ত হয়ে ওঠা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রসঙ্গ আলোচনা করব। ‘রবীন্দ্রনাথের বিদ্যাসাগর’ শিরোনামাঙ্কিত এ লেখায় ঈশ্বর ও রবি ভাস্বর হয়েছেন স্মৃতিকথা ও স্মরণ-বক্তৃতার আলোকে। সে জন্য ১২ আশ্বিন; ২৬ সেপ্টেম্বর ১৮২০ এবং ২৫ বৈশাখ; ৭ মে ১৮৬১-এর ছেদ ঘুচিয়ে প্রবেশ করছি রবীন্দ্রচেতনার আয়নায় উদ্ভাসিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর—প্রসঙ্গ-জগতে।
বিদ্যাসাগর সমাজ সংস্কারের জন্য অব্যাহত ধারায় যে কর্মপ্রবাহে উদ্যোগী হয়ে উঠেছিলেন তার নানা দিক নিয়ে যুগ যুগ ধরে ঐতিহাসিকরা বিশ্লেষণ করেছেন। বাঙালির জীবনধারায় অল্প বয়সেই একনিষ্ঠ এই ব্রাহ্মণ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সমাজে প্রচলিত বিধি নিয়ে জিজ্ঞাসামুখর হয়ে উঠেছিলেন তা আজো বিস্ময়ের উদ্রেক করে। তাঁর ব্যক্তিস্বরূপে ছিল একাগ্র হওয়ার সাধনা ও দৃঢ়তা। শৈশব কেটেছিল নিদারুণ অর্থকষ্টে। তবুও সকল প্রতিকূলতা অতিক্রম করে তিনি হয়ে উঠেছিলেন শিক্ষাক্ষেত্রে এক অনন্য ব্যক্তিত্ব।

—আবুল হাসনাত



রেনেসাঁসপ্রাণিত ঊনবিংশ শতাব্দীর নবজাগরণ সমাজে শিক্ষা, সমাজচিন্তা ও বাঙালির জীবনসাধনা এবং সংস্কৃতি ক্ষেত্রে যে বিলোড়ন সৃষ্টি করেছিল, পশ্চাতে ফিরে তাকালে এই স্পন্দনকে কত না তাৎপর্যময় বলে মনে হয়।

রামমোহনের আবির্ভাব, পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে অবস্থান, সতীদাহ প্রথা বিলোপ ও ডিরোজিওর সঙ্গে যুক্তিনিষ্ঠতা তাঁর প্রমাণবহ। বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ প্রবর্তন এবং বহুবিবাহ রোধ ও স্ত্রীশিক্ষার উদ্যোগ গ্রহণ তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ কর্ম বলেই বিবেচিত হয়ে আসছে। কুলীন প্রথার ফলে ভারতীয় নারীর বিড়ম্বিত ভাগ্য নিয়ে তিনি সর্বদা খুবই বিচলিত ও চিন্তিত ছিলেন। তাঁর অবলোকন ও অনুধাবন শুধু মানবিক হওয়ার সাধনাকে দীপিত করেনি, সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রকেও করেছিল আলোড়িত। এই আলোড়ন মানবিকতার স্বরূপ সন্ধানের কাজেও তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছিল উত্তরকালে। যুক্তিকে মর্যাদার সঙ্গে অবলোকন করতে শিক্ষা দিয়েছিল। রেনেসাঁর মর্মমূল ও চেতনা নিয়ে যে বিতর্ক আছে ইতিহাসবিদদের মধ্যে, তা সত্ত্বেও এই জাগরণ বাঙালির জীবন আবহে দীর্ঘদিনের লালিত বিশ্বাসে ও যুক্তিবাদিতায় এক তরঙ্গ তুলেছিল। ধর্মবোধেও এনেছিল নবীন জিজ্ঞাসা। প্রচলিত ধর্মবিশ্বাসে তাঁর আস্থা ছিল না।
রবীন্দ্রনাথের দ্বারা নন্দিত বিদ্যাসাগর আবার কখনও রবীন্দ্রনাথকেও ছাপিয়ে গিয়েছেন, মত রামকৃষ্ণবাবুর। বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালী’-তে রয়েছে, বিদ্যাসাগরের ‘সীতার বনবাস’-এর বহুচর্চিত অংশের মুখস্থ শ্রুতিলিখন নিয়ে অপুর মুগ্ধতার কথা। ‘এই সেই জনস্থানমধ্যবর্তী প্রস্রবণ গিরি।’ রামকৃষ্ণবাবুর মতে, সহজপাঠ কিন্তু বর্ণপরিচয়ের মতো সর্বজনীন হয়নি।

—ঋজু বসু



এক জন বিদ্যাসাগরের মধ্যে মিশে রয়েছেন কত জন বিদ্যাসাগর? নারী-শিক্ষা, বিধবা বিবাহের প্রসারে ব্রতী সমাজ সংস্কারক বিদ্যাসাগর? না বাংলা ভাষার সংস্কারের দিশারী বিদ্যাসাগর? শুক্রবার সন্ধ্যায় জবাব খুঁজল বইমেলার মাঠ। ‘আনন্দবাজার পত্রিকা শাবাশ বাংলা’র সহায়তায় কলকাতা সাহিত্য উৎসবের আসর মগ্ন হল বিদ্যাসাগরের দ্বিশতবর্ষের উদ্‌যাপনে।
ভেবে অবাক হই, প্রায় দেড় শতাধিক বছর আগে আজকের তুলনায় আরও আঁধার যুগে ভাববাদী দর্শনের কুৎসীত বিষবৃক্ষের শিকড়ে ঈশ্বরচন্দ বিদ্যাসাগর যেভাবে আঘাত করার হিম্মত দেখিয়েছিলেন, আমরা একবিংশ শতাব্দীতে পৌঁছে তাঁকে কিংবা তাঁর কৃতকর্মকে সামান্যতমও মনে রাখার চেষ্টা করেছি কি?

—বিশ্বদীপ ভট্টাচার্য্য



বিদ্যাসাগর কি নাস্তিক ছিলেন? প্রশ্নটি বার বার মনে ফিরে আসে। এই কারণে ফিরে আসে যে, আশৈশব আমরা শিখেছি ঈশ্বরচন্দ্র নামক বাহ্যত ইস্পাত কঠিন পুরুষটি আসলে দয়া ও বিদ্যার সাগর। কিন্তু বহু খোঁজাখুঁজোর পরে একটি প্রায় না জানা বিষয় পাওয়া গেছে তা হল ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন ঘোর যুক্তিবাদী এবং নাস্তিক। ভাববাদী দর্শনের কুৎসীত বিষ, ধর্মীয় উন্মাদনা, যেভাবে আমাদের চৌকাঠ থেকে খিড়কিতে উঁকি মারছে তখন মনে হয় একবার ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের নাস্তিক ও যৌক্তিক দিকটা নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন।

বাঙালীর হৃদয়ে বিদ্যাসাগর নামটি আজও অনন্য ও বিস্ময়কর ! চাল নেই, চুলো নেই, ধন কৌলিন্য নেই, মাসিক ছ-টাকা বেতনের সওদাগরী অফিসের এক কেরাণীর ছেলে প্রধানত সংস্কৃত শিক্ষার পুঁজি ও ইংরেজীর ব্যবহারিক জ্ঞান নিয়ে সমাজ, শিক্ষা, সংস্কৃতি আন্দোলনের শীর্ষে আরোহন করলেন, হিমালয় সদৃশ উন্নত মস্তক পুরুষ হিসেবে বাঙালী জাতির প্রকৃত জনকের মর্যাদা পেলেন ক এ এক বিরলতম ঘটনা। টুত্লো পণ্ডিতের ঘরের ছেলে শাস্ত্রীয় শিক্ষাকে সম্বল করে কি ভাবে শ্রেষ্ঠ মানবতাপ্রেমী, নিরীশ্বরবাদী ও যুক্তিবাদী সমাজ সংস্কারক হয়ে উঠলেন তা এখনও গবেষণার অপেক্ষায়। স্থিতাবস্থা ও অন্ধকারপন্থীদের নির্মম নিন্দা-মন্দ সত্বেও জীবিতকালেই বিদ্যাসাগরের ছবি বিক্রী হত।
বিদ্যাসাগরের বিশিষ্টতা এখানে যে, ধর্মাক্রান্ত, দেশাচারপ্রবণ ও যৌনশুচিগ্রস্ত বাঙালীদের মধ্যে তিনি ছিলেন যথার্থই একজন মুক্ত চিন্তার মানুষ : আধুনিক, ইহজাগতিক এবং খুব সম্ভবত নাস্তিক। নানা শঙ্কায় কাতর ও অজুহাতপ্রবণ বাঙালী যে সকল স্থানে যেতে পিছপা হয়েছে, বিদ্যাসাগর সেখানে উপস্থিত হয়েছেন সদর্পে। বিদ্যাসাগরের এই যে চারিত্রিক দৃঢ়তা তাঁকে রবীন্দ্রনাথ আখ্যায়িত করেছেন অজেয় পৌরুষ হিসেবে।

—মন্ময় জাফর



উপক্রমণিকা


ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের (১৮২০-১৮৯১) দু’শো বছরের জন্মবার্ষিকীতে তাঁর সমাজ সংস্কার আন্দোলনকে ফিরে দেখার প্রচেষ্টা থেকে এই প্রবন্ধের উৎপত্তি। বিধবা বিবাহ সম্পর্কিত তর্কাতর্কি মাতিয়ে রেখেছিল উনিশ শতকের প্রায় পুরোভাগ। আলোচ্য প্রবন্ধে এর পক্ষে-বিপক্ষের যুক্তিগুলো পুনর্বিবেচনা করার প্রয়াস নেয়া হয়েছে। সে সঙ্গে আলোচিত হয়েছে বিধবা বিবাহ সিদ্ধকরণে বিদ্যাসাগরের যুগান্তকারী ভূমিকা। বঙ্কিমের সর্বজনবিদিত বিদ্যাসাগর বিরোধিতার প্রসঙ্গটি সঙ্গত কারণে এসেছে। এপার ও ওপার বাংলার, বিশেষত ‘বাম ঘরানার বুদ্ধিজীবীরা বিদ্যাসাগরের কি ধরনের মূল্যায়ন করেছেন, তার ওপরেও আলোকপাত করা হয়েছে। বিদ্যাসাগর নিজেকে একজন সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত হিসেবে শুধু দেখেন নি, দেখেছেন মুক্ত চিন্তার একজন মানুষ হিসেবে। সে কারণে মিল খোঁজা হয়েছে বিদ্যাসাগরের উনিশ শতকের বিধবা বিবাহ আন্দোলন এবং একুশ শতকের সমকামী সম্পর্ক ও বিবাহকে আইনগত বৈধতাদান আন্দোলনের গতিপ্রকৃতির মধ্যে। বিদ্যাসাগরকে যে শুধু একজন কুশলী ও বাস্তববাদী সমাজ সংস্কারক হিসেবে দেখানো হয়েছে তা-ই নয়, বরং তাঁকে উপস্থাপন করা হয়েছে বাঙালীর দেশাচারপ্রবণ, ধর্মাক্রান্ত, যৌনশুচিগ্রস্ত ও জাড্যময় জীবনের একজন কড়া সমালোচক হিসেবে।
বিদ্যাসাগরের জন্ম, শিক্ষা ও অবস্থান, সবই ছিল একটি সামন্তবাদী পরিবেশে। ইংরেজের বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক উপস্থিতি ও ইংরেজী শিক্ষার প্রচলন সমাজে এক ধরনের চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল। একটি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীও গড়ে উঠছিল। এই বিকাশের উজ্জ্বল প্রতিনিধিদের মধ্যে একজন ছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত, সমাজের সামন্তবাদী সঙ্কীর্ণতার বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত বিদ্রোহ ঘোষণা করে তিনি খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী হয়ে গিয়েছিলেন, চেয়েছিলেন ইংরেজী ভাষাতে সাহিত্য রচনা করে আন্তর্জাতিক যশ অর্জন করবেন। কিন্তু অত্যন্ত মেধাবান ও সাহিত্যসৃষ্টির অতিউচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ছিলেন যেহেতু তাই তিনি ফিরে এসেছেন মাতৃভাষার কাছে। বিদ্যাসাগরের ব্যাপারটা কিন্তু সম্পূর্ণ উল্টো। তিনি মাতৃভাষার চর্চা বর্জনের কথা কখনোই ভাবেন নি। ওদিকে রামমোহন যে বিলেত গেলেন এবং সেখানেই সমাধিস্থ হলেন, বিদ্যাসাগরের পক্ষে তেমন কাজও সম্ভব ছিল না। তিনি মাতৃভাষা ও মাতৃভূমিতে গভীর ভাবে প্রোথিত ছিলেন। স্তম্ভের মতো নয়, বৃক্ষের মতো।

—সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

(নতুন দিগন্ত-সম্পাদকীয়)


বিদ্যাসাগরের জন্ম আজ থেকে ঠিক দু’ শ’ বছর আগে, ১৮২০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বরে, তিনি অতিশয় কাতর ছিলেন চতুষ্পার্শ্বে নারী নির্যাতন দেখে। বিদ্যাসাগর জানতেন বিধবারা কেমন দুর্বিষহ জীবন যাপন করে। সে জন্য তিনি বিধবাদের বিবাহদানকে বৈধ করার জন্য রাতদিন পরিশ্রম করেছেন। মেয়েদের বিধবা হবার পেছনে বিশেষ দু’টি কারণ ছিল। বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ। বয়স্ক স্বামীর সঙ্গে অতি অল্পবয়সের যে মেয়েটিকে জুড়ে দেওয়া হতো, তার স্বামী মারা যেত মেয়েটির মৃত্যুর অনেক আগে। আর কুলীন সমাজে বহুবিবাহ তো কিছু ব্রাহ্মণের পেশাই ছিল, তাঁরা ঘুরে ঘুরে স্ত্রীদের বাড়িতে অতিথি হতেন; কতজন স্ত্রী, কী তাদের ঠিকানা এসব মনে রাখাও কঠিন হতো, সে জন্য খাতায় লিখে রাখতেন এবং তালিকা দেখে দেখে স্ত্রীদের খোঁজে বের হতেন। কুলীন ঘরের মেয়েদের পক্ষে কুলীন বর পাওয়া কঠিন ছিল; বাজারে তাই কুলীন পুরুষদের প্রচুর চাহিদা ও নীরব প্রতাপ বিদ্যমান থাকতো। বিদ্যাসাগর বিধবাবিবাহকে আইনসম্মত করাতে পেরেছিলেন, চেষ্টা করেছিলেন বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ নিবারণের জন্য আইনী ব্যবস্থা চালু করবেন। পারেন নি পর্যাপ্ত সামাজিক সমর্থন জোগাড় করা সম্ভব হয় নি। আর বিধবাবিবাহও যে খুব জনপ্রিয় হয়েছিল তাও নয়। তাঁর একমাত্র পুত্র একজন বালিকাবিধবাকে বিয়ে করায় বিদ্যাসাগর সন্তুষ্ট হয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর সে সন্তোষ দীর্ঘস্থায়ী হয় নি, কারণ তাঁর পুত্র নানাবিধ অন্যায় আচরণ করেছে যার জন্য বিদ্যাসাগর পুত্রকে কার্যত ত্যাজ্যই করে দিয়েছিলেন।

মেয়েদের জীবনে দুঃখ ও অনিশ্চয়তা দেখে মাতৃহৃদয়সম্পন্ন বিদ্যাসাগর অত্যন্ত কাতর থাকতেন। এক বন্ধুর শিশুকন্যা প্রভাবতী’র অকাল মৃত্যুতে শোকে বেদনাপুত বিদ্যাসাগর একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। ছোট্ট, কিন্তু অসাধারণ। ‘প্রভাবতীসম্ভাষণ’ নামের ওই প্রবন্ধটি সম্ভবত বাংলা সাহিত্যে প্রথম শোকগাথা। তাতে প্রভাবতী’র মৃত্যুতে অশ্রুসম্বরণের চেষ্টা করতে গিয়ে নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে বিদ্যাসাগর লিখেছেন, প্রভাবতী তুমি যে চলে গেলে একদিক দিয়ে সেটা ভালোই হলো; বেঁচে থাকলে ‘ভাগ্যদোষে’ তুমি হয়তো “অসৎপাত্রের হস্তগত ও অসৎপরিবারের কবলে পতিত হয়ে দুঃখসন্তাপে কালাতিপাত করিতে।” বঙ্গদেশে নারী হয়ে জন্মগ্রহণেই ছিল মস্ত একটি ভাগ্যদোষ।
ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিদ্যাসাগর হয়ে ওঠার সাক্ষী যে মানুষেরা ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বর্ধমানের এই ভূমিপুত্র। তিনি ছিলেন বিদ্যাসাগরের পাঠগুরু, তাঁর লেখালেখির সূচনাপর্বের উৎসাহদাতা। প্রেমচন্দ্র তর্কবাগীশকে নিয়ে লিখছেন স্বপ্নকমল সরকার। প্রেমচন্দ্র নিজেই যে শুধু কবি ছিলেন তা নয়, ছাত্রদের ভাল কবিতা পড়ে তাদের প্রশংসা করা ও লেখালেখি চালিয়ে যাওয়ায় অনুপ্রেরণা দেওয়ায় তাঁর জুড়ি ছিল না।

—স্বপ্নকমল সরকার



চলতি বছরটিতে পালিত হচ্ছে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দু’শো তম জন্মবার্ষিকী। সে উপলক্ষে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হচ্ছে। ঈশ্বরচন্দ্রের গড়ে ওঠা এবং তার প্রতিভার বিকাশে নানা ভাবে যে মনীষীরা সাহায্য করেছিলেন তাঁদের কথাও এই সময়ের প্রেক্ষিতে বিচার করা প্রয়োজন। ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিদ্যাসাগর হয়ে ওঠার সাক্ষী যে মানুষেরা ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বর্ধমানের এক ভূমিপুত্র। এক দিকে, তিনি ছিলেন বিদ্যাসাগরের পাঠগুরু, তাঁর লেখালেখির সূচনাপর্বের উৎসাহদাতা। এমনকি, বিদ্যাসাগরের আমন্ত্রণে সুকিয়া স্ট্রিটে আয়োজিত প্রথম বিধবা বিবাহের সেই ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানেরও সাক্ষী। তিনি উনিশ শতকের শিক্ষক ও কবি প্রেমচন্দ্র তর্কবাগীশ।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের তীব্র সমালোচক‌ও ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বঙ্কিমের সমালোচনা এতটাই মাত্রাতিরিক্ত ছিল যে, বিদ্যাসাগর কিছুটা হলেও বিরক্ত‌ হয়েছিলেন। লিখছেন গৌতম সরকার রাজপোশাক নষ্ট হয়ে যেতে পারে মনে করে শচীশচন্দ্র বাঁ হাত দিয়ে বিদ্যাসাগরকে সরিয়ে দিলেন। থতমত খেয়ে বিদ্যাসাগর চকিতে পিছু হটলেন।

—গৌতম সরকার



বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বড়দা শ্যামাচরণ চট্টোপাধ্যায়ের ছোট ছেলে শচীশচন্দ্রের বিয়ে। বিয়ে হচ্ছে সাহিত্যিক দামোদর মুখোপাধ্যায়ের মেয়ে সুরেশ্বরীর সঙ্গে। শচীশচন্দ্র পাইকপাড়ার জমিদারদের কাছ থেকে পোশাক ধার করে একেবারে রাজপুত্র সেছে এসেছেন। রাজবেশে তখন বর নামছেন। রাজপোশাক নষ্ট হয়ে যেতে পারে মনে করে শচীশচন্দ্র বাঁ হাত দিয়ে বিদ্যাসাগরকে সরিয়ে দিলেন। থতমত খেয়ে বিদ্যাসাগর চকিতে পিছু হটলেন। পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। ভাইপোর এমন আচরণ দেখে তিনি তো অগ্নিশর্মা, “তুমি জানো ইনি কে? ইনি বিদ্যাসাগর! এক্ষুণি ক্ষমা চাও।” মাথা নিচু করে ক্ষমা চাইতে বাধ্য হলেন শচীশচন্দ্র। বঙ্কিমের এরকম শ্রদ্ধা অটুট ছিল ঈশ্বরের মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত।
উনিশ শতকের নবজাগরণের মধ্য দিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে আধুনিকতার সূত্রপাত ঘটে। এই নবজাগরণের প্রধান চরিত্র বিদ্যাসাগর। বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্বের অধিকারী বিদ্যাসাগরের প্রধান পরিচয় তিনি রেনেসাঁস-পুরুষ। ইহজাগতিকতা, যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞানমনস্কতা, নতুন গদ্যরীতি, সমাজসংস্কার, নারীশিক্ষার প্রসার, পাঠ্যসূচি থেকে অলৌকিকতার বিলুপ্তি, চারিত্রিক দৃঢ়তা এবং মানবমুখিনতার মতো বৈশিষ্ট্য; যা ইউরোপীয় রেনেসাঁসকে তুলে ধরেছিল, বিদ্যাসাগর তার জীবন্ত প্রতীক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন।

—রাজীব সরকার



‘বাংলার রেনেসাঁস’ নামে বহুল আলোচিত ঘটনার কেন্দ্রস্থল ছিল উনিশ শতকের কলকাতা। বিভিন্ন ক্ষেত্রে কৃতী মনীষীদের আবির্ভাবে উত্তাল হয়ে উঠেছিল কলকাতা নগরী। খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে একটি জনপদে এত প্রতিভাবান মানুষের সম্মিলন বিশ্ব ইতিহাসে বিরল ঘটনা। রামমোহন রায় থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত শতাব্দীব্যাপী ইতিহাসে বাংলায় যে-উজ্জ্বল প্রতিভার মিছিল দৃশ্যমান, এর তুলনা সমগ্র ভারতবর্ষের ইতিহাসে আর নেই। ধর্ম ও সমাজসংস্কারে, শিক্ষা-দীক্ষায়, নারী উন্নয়নে, মানবসেবায়, জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্মেষে, শিল্প-সাহিত্য-সংগীতে, আধুনিক ধ্যান-ধারণায়, সর্বোপরি স্বাধীনতা আন্দোলনে এমন বহুমুখী জাগরণ আর কখনও দেখা যায়নি ভারতবর্ষে। গোপাল হালদার যথার্থই বলেছিলেন, ‘এমন অল্পকালের মধ্যে ভারতের মাত্র একটি জাতির (বাঙালির) মধ্যে যত মনস্বীর, যত কর্মীর, যত ভাবুকের, যত শিল্পী ও সাহিত্যিকের আবির্ভাব ঘটেছে, ভারতের ইতিহাসেও আর ঘটেনি– অশোকের কালে নয়, গুপ্ত সাম্রাজ্যের সময়ে নয়, মোগল রাজত্বে– আকবরের দিনেও নয়, বৈষ্ণব আন্দোলনের বাঙলায়ও নয়।’ এই প্রতিভাবান ব্যক্তিদের অন্যতম ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর; যাঁকে অনায়াসে রেনেসাঁস-পুরুষ আখ্যা দেওয়া যায়।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বা মাইকেল মধুসূদন দত্ত সম্পর্কে সামান্য ধারণা রাখেন এমন সবাই অন্তত এই তথ্যটি জানেন যে, মাইকেল বিদেশে গিয়ে বিপদে পড়লে তাঁর বন্ধু বিদ্যাসাগর তাঁকে টাকা পয়সা পাঠিয়ে উদ্ধার করেছিলেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর এই দুই মহীরূহের জীবনীর অবিচ্ছেদ্দ্য অংশ বিদ্যাসাগর-মধুসূদন পর্ব।


—চৌধুরী মুফাদ আহমদ



ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর* মাইকেল মধুসূদন দত্তের** চেয়ে তিন বছর চার মাসের বড় ছিলেন। মধুসূদন ১৮৩৭ সালে যখন হিন্দু কলেজে ভর্তি হন তখন বিদ্যাসাগর পাশের ভবনের সংস্কৃত কলেজের ছাত্র। ১৮৪১ সালের শেষ দিকে বিদ্যাসাগর পাশ করে বেরোনো পর্যন্ত দু’জন পাশাপাশি কলেজে লেখাপড়া করেছেন। কিন্তু তাঁদের মধ্যে কোন পরিচয় ছিল বলে জানা যায় না। থাকার কথাও নয়। দুই কলেজের ছাত্রদের অবস্থান পাশাপাশি থাকলেও তাদের মধ্যে বিরাট সামাজিক ও মানসিক ব্যবধান ছিল সংস্কৃত কলেজে বিনা বেতনে পড়তো মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্তদের হিন্দু উচ্চবংশীয় (ব্রাহ্মণ ও বৈশ্য) ছেলেরা। আর হিন্দু কলেজে পড়তো হিন্দু উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলেরা। তাদের অনেকেই জুড়ি-গাড়ি হাঁকিয়ে কলেজে আসতো। কলেজে মাসিক বেতন ছিল পাঁচ টাকা। অথচ তখন বিদ্যাসাগরের পিতার পুরো এক মাসের আয় ছিল দশ টাকা। দুই কলেজের ছাত্রদের মধ্যে মাঝে মধ্যে ঢিল ছোঁড়াছুঁড়ি হলেও তাদের মধ্যে তেমন যোগাযোগ বা বন্ধুত্ব সম্ভবত হতো না।
vidyasagar.info ©