মোট পৃষ্ঠাদর্শন

    ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
        মাইকেল মধুসূদন দত্ত

  বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে।
  করুণার সিন্ধু তুমি, সেই জানে মনে,
  দীন যে, দীনের বন্ধু!—উজ্জ্বল জগতে
  হেমাদ্রির হেমকান্তি অম্লান কিরণে।
  কিন্তু ভাগ্যবলে পেয়ে সে মহা পর্বতে,
  যে জন আশ্রয় লয় সুবর্ণ চরণে,
  সেই জানে কত গুণ ধরে কত মতে
  গিরীশ। কি সেবা তার সে মুখ সদনে।—
  দানে বারি নদীরূপ বিমলা কিঙ্করী;
  যোগায় অমৃত ফল পরম আদরে
  তরুদল, দাসরূপ ধরি;
  পরিমলে ফুলকুল দশ দিশ ভরে;
  দিবসে শীতল শ্বাসী ছায়া, বনেশ্বরী,
  নিশার সুশান্ত নিদ্রা, ক্লান্তি দূর করে!

বিদ্যাসাগর ও মুল্যবোধ-সম্পর্কিত চিন্তাভাবনা

বিদ্যাসাগর নারীশিক্ষা, প্রৌঢ়শিক্ষা, বিধবাবিবাহ— এ-সবকিছুর মাধ্যমে চেয়েছিলেন সামাজিক পরিবর্তন। তিনি জোর দিয়েছিলেন শিক্ষার উপর, কারণ তিনি বুঝেছিলেন, শিক্ষাই সামাজিক পরিবর্তনের জন্য মোক্ষম অস্ত্র। নারীশিক্ষা ও নারীর প্রতি সম্মান সমাজের গতিপথে উন্নতি আনবে। এক শিক্ষিতা নারী পরিবারের শিক্ষার জন্য দীপশিখা। আমাদের দায়িত্ব সেই অদ্ভুত আধুনিক মনোভাবাপন্ন বিদ্যাসাগরের দীপশিখা প্রজ্জ্বলিত করে রাখা।

—প্রমথেশ দাস


শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য উত্তম চরিত্র ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ তৈরি করা। এই লক্ষ্য নিয়ে যুগ যুগ ধরে সারা পৃথিবীতে শিক্ষাধারা অব্যাহত রয়েছে। কোনো ব্যক্তিকে যদি উত্তম চরিত্র ও ব্যক্তিত্বের মাপকাঠিতে বিচার করতে হয়, তখন একটি বৈশিষ্ট্য বিশেষভাবে দেখতে হয়, যে তার চিন্তাভাবনা, কথাবার্তা ও আচার-আচরণের মধ্যে কী কী মূল্যবোধ, কত মাত্রায় বিদ্যমান বা প্রকাশ পাচ্ছে। যে-কোনো ব্যক্তির সঙ্গে দেখা হলে আমরা তার শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রমাণপত্র দেখি না, কিন্ত শিক্ষার প্রমাণ ও প্রভাব তার আচরণের মধ্যেই প্রকাশ পায়। আচরণ অন্তর্নিহিত জ্ঞান, চিন্তা ও বিচারবুদ্ধির পরিপ্রকাশ। কোনো মনীষী শিক্ষার সংজ্ঞা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে যথার্থই বলেছেন— শিক্ষা হলো সেই জিনিস যা একজন মানুষের মধ্যে থেকে যায় যখন তার পড়াশোনা শেষ হয়ে গেছে এবং পড়ার বিষয়বস্তু ভুলে গেছে।

বিদ্যাসাগরের অনাড়ম্বর পোশাক এবং অতি সাধারণ চেহারার ভেতর থেকে প্রকাশ পেত অন্তর্নিহিত তেজ, প্রচণ্ড বিচারশক্তি এবং প্রগাঢ় মূল্যবোধের অভিব্যক্তি। যে-শিক্ষা তিনি পেয়েছেন বীরসিংহ গ্রামে, পরিবারে এবং কলকাতায়, তিনি তাঁর অতিমানস শক্তির দ্বারা সে-শিক্ষাকে নিজের ব্যক্তিত্ব বিকাশে সুচারুভাবে কাজে লাগিয়েছেন। সেই অতিমানস শক্তি তাঁকে শিক্ষা ও সমাজসংস্কারে অদম্য প্রেরণা ও সাহস দিয়েছে। তাই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মূল্যবোধের এক জীবন্ত উদাহরণ।

সেই সময়, যখন সমাজ অন্ধকার কুসংস্কার ও কুপ্রথার মধ্যে নিমজ্জিত, এক অদ্ভুত আধুনিক মানসিকতা নিয়ে আবির্ভাব তাঁর। এ-আধুনিকতা তাঁর নিজস্ব সৃষ্টি, কষ্ট করে নিজেকে তৈরি করেছেন সেই ভাবে।

তাই, যখন তিনি শিক্ষাসংস্কারে হাত দেন, তাঁর কাছে কতকগুলো সমস্যা দেখা দেয়। তাঁর ভাবনায় শিক্ষার জন্য প্রয়োজন পাঠ্যক্রম, পুস্তক, বিদ্যালয়-পরিসর ও আসবাবপত্র এবং সুশিক্ষক। সব কিছুরই অভাব ছিল। তাই তিনি প্রথম হাত দিলেন পাঠ্যক্রম প্রস্তুতিতে। এবং বিভিন্ন বিষয় অন্তর্ভূক্ত করে সুষম পাঠ্যক্রম প্রস্তুত করেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল, জীবনের প্রয়োজনে যে-জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার দরকার, তার যেন ব্যবস্থা থাকে পাঠ্যক্রমে। তাই সংস্কৃতভাবনার গণ্ডি অতিক্রম করে তিনি সংস্কৃতের সঙ্গে মাতৃভাষা বাংলা ও ইংরেজিও অন্তর্ভুক্ত করেন। তার সঙ্গে জীবনচরিত, কথামালা, বেতাল পঞ্চবিংশতি ইত্যাদিও সংযুক্ত করেন, তাতে শিক্ষার্থীদের মানসিক ও নৈতিক উন্নতি সম্ভব হয়।

পরের সমস্যা পাঠ্যপুস্তক। তিনি কিছু পুস্তক প্রস্তুত করেন, কিছু অনুবাদ করেন ও অন্যদের দিয়েও লেখান। বিভিন্ন গ্রেডের জন্য পাঠ্যপুস্তকগুলির উপযোগিতা অনুযায়ী পাঠ্যক্রম নির্ধারণ করেন।

পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক নির্ধারণে তাঁর মধ্যে সব সময় কাজ করেছে একটাই চিন্তা— এ-শিক্ষা যেন শিক্ষার্থীদের বৌদ্ধিক বিকাশ, নৈতিক শিক্ষা, মূল্যবোধ ও ব্যক্তিত্ব বিকাশের সহায়ক হয়। যদি আমরা গভীরভাবে তাঁর পাঠ্যক্রমও পুস্তকগুলির বিষয় বিশ্লেষণ করে দেখি, তাঁর এই অন্তর্নিহিত ভাবনার বিষয়টি আমাদের মনে নিশ্চয়ই রেখাপাত করবে।

শিক্ষার প্রারম্ভকালই সবচেয়ে গুরুত্বপৃর্ণ। তাই তিনি নিজে বর্ণপরিচয় লেখার কথা ভাবেন। ১৮৫৫ সালে তিনি বর্ণপরিচয় লেখেন। এবং বর্ণানুসারে সে-সব শব্দ চয়ন করেছেন যেগুলি সাধারণত জীবনে ব্যবহৃত হয়, তারপর বর্ণযোজনা— আ-কার থেকে ও-কার এবং পরপর জটিল বর্ণযোজনার অবতারণা করেন। দুই, তিন, চার ও পাঁচ অক্ষরের মিশ্র উদাহরণ দেন। সহজ ও সরল থেকে জটিল ও কঠিন নীতির অনুসরণ করেন, শিক্ষার্থীদের মানসিক শক্তির বিকাশকে লক্ষ করে এর পর ছোট ছোট বাক্য দিয়ে দৈনন্দিন জীবনের কথাগুলো তুলে ধরেছেন। ভোরে ওঠা, মুখ-হাত ধোওয়া, হাঁটার ধরন ইত্যাদি যাকে আমরা এখন ‘জীবন-কৌশল শিক্ষা’ বলি, সেগুলির অবতারণা করেছেন। এর পর ছোট ছোট অনুচ্ছেদ গল্পের মতো লিখেছেন এবং পড়াশোনা করা, মনোযোগ দেওয়া, ঝগড়া না করা ইত্যাদির মাধ্যমে তিনি মূল্যবোধ শিক্ষার অবতারণা করেছেন। রাম, নবীন, গিরীশ, গোপাল ও রাখাল চরিত্রগুলির উল্লেখ করেছেন। যদিও বিদ্যাসাগর নারীশিক্ষার জন্য উদ্যম নিয়েছেন, এখানে কোনো বালিকার নাম নেই, সম্ভবত তৎকালীন সামাজিক পরিস্থিতির প্রতিফলন ঘটেছে।

দেখা যায়, গোপাল বড় সুবোধ, কিন্ত রাম, নবীন, গিরীশ এবং সর্বোপরি রাখাল মোটেই গোপালের মতো নয়। বিদ্যাসাগরের এ-সব চরিত্রই সমাজে দেখা যায়। নীতিবোধ ও চরিত্রগঠন এবং ভালো অভ্যাস ও ব্যবহারের ভিত্তিভূমি প্রস্তুত করেন বিদ্যাসাগর।

বর্ণপরিচয়-এর দ্বিতীয় ভাগে সংযুক্ত বর্ণ-সংযোজনার মাধ্যমে প্রথম উপদেশাবলি (জীবনকৌশল সম্পর্কিত) এবং পরে বেশ কিছু গল্পের অবতারণা করছেন, যেমন সুশীল বালকের চরিত্র ও ব্যবহার, যাদব ও ভুবন, নবীন ও রাখাল, মাধব, রাম, সুরেন্দ্র এবং সর্বশেষে ভুবনের কথা উল্লেখ করেছেন বিদ্যাসাগর, মূল্যবোধ শিক্ষার কতগুলি পদ্ধতির অনুসরণ করেছেন— সোজাসুজি উপদেশ প্রদান প্রত্যক্ষ মূল্যবোধ শিক্ষার জন্য।

কিন্তু তিনি জানেন, উপদেশগুলো এক কান দিয়ে ঢুকে অন্য কান দিয়ে বেরিয়ে যায়। তাই তিনি দ্বিতীয় পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন— গল্পের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে মূল্যবোধ-শিক্ষা। তিনি বেশি গল্পের সাহায্য নিয়েছেন যাতে শিক্ষার্থীরা গল্পের মাধ্যমে প্রকৃত মূল্যবোধ উপলব্ধি করতে পারে। তিনি চেয়েছেন, ভুবনের মাসি যেরকম ভুবনকে প্রথম থেকে চুরি করার অভ্যাস থেকে বিরত করেননি এবং ভুবনকে ফাঁসির সাজা পেতে হলো, সেভাবে বড়রা ও গুরুজনদের তাঁদের দায়িত্ব পালন করা উচিৎ। ওঁদের ব্যবহার ও আচরণ, মূল্যবোধের পরিপ্রকাশ শিশুদের প্রভাবিত করে। উপদেশের চেয়ে উদাহরণ ফলপ্রদ।

‘জাতীয় শিক্ষানীতি ১৯৮৬’, নথিটিতে মূল্যবোধ-শিক্ষার উপরে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, যেহেতু সমাজ ও ব্যক্তিজীবনে মূল্যবোধের শুধুমাত্র অবক্ষয় নয়, সংকট দেখা দিয়েছে। যার ফলে উভয় ব্যক্তি ও সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত ও অসুস্থ। এর নিরাকরণের উপায় একমাত্র শিক্ষা।

বিদ্যাসাগর যেভাবে শিক্ষার মাধ্যমে মূল্যবোধের জন্য ১৮৫৫ সালে চিন্তা করেছিলেন, সেই উপায়গুলি ১৯৮৬ সালের জাতীয় শিক্ষানীতিতে প্রয়োগ করা হয়েছে। প্রত্যেক বিষয়ের মধ্যে রয়েছে মূল্যবোধ-শিক্ষার অফুরন্ত ভাণ্ডার। যেমন রয়েছে সমুদ্রের অতলে মুক্তারাশি। কিন্তু, না শিক্ষক, না শিক্ষার্থী বিষয়গুলির ভেতরে ঢোকেন। পরীক্ষানিমিত্ত শিক্ষালাভ ও শিক্ষাদানে, জীবনের মূল্যবোধ যে-বিষয়গুলিতে অন্তর্নিহিত রয়েছে, সেগুলি অনাবিষ্কৃতই থেকে যায়।

বিদ্যাসাগর সে-কথাও ভেবেছিলেন যে, শুধুমাত্র পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নে হবে না, উপযুক্ত শিক্ষক দরকার। তা হলে পাঠ্যক্রমের সঠিক উপযোগ হবে ও শিক্ষা জীবনমুখী হয়ে উত্তম চরিত্র ও ব্যক্তিত্ব গঠনে সাহায্য করবে। ব্যক্তি উত্তম হলে সমাজ ভালো হবে এবং সমাজ ভালো হলে তা ব্যক্তিত্ববিকাশে সহায়ক পৃষ্ঠভূমি হবে। তাই বিদ্যাসাগর নরম্যাল স্কুল আরম্ভ করেন শিক্ষক প্রশিক্ষণের জন্য, ১৯৮৬-র শিক্ষানীতি প্রণয়নের পরে পাঠ্যক্রমে যে-পরিবর্তন এসেছিল এবং শিক্ষণপদ্ধতিতে যে-পরিবর্তন দরকার ছিল, শিক্ষার লক্ষ্যপূরণের জন্য দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের সকল শিক্ষকদের শিক্ষানীতি বিষয়ে সূচনা দেওয়ার জন্যে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল।

বিদ্যাসাগর নারীশিক্ষা, প্রৌঢ়শিক্ষা, বিধবাবিবাহ— এ-সবকিছুর মাধ্যমে চেয়েছিলেন সামাজিক পরিবর্তন। তিনি জোর দিয়েছিলেন শিক্ষার উপর, কারণ তিনি বুঝেছিলেন, শিক্ষাই সামাজিক পরিবর্তনের জন্য মোক্ষম অস্ত্র। নারীশিক্ষা ও নারীর প্রতি সম্মান সমাজের গতিপথে উন্নতি আনবে। এক শিক্ষিতা নারী পরিবারের শিক্ষার জন্য দীপশিখা। আমাদের দায়িত্ব সেই অদ্ভুত আধুনিক মনোভাবাপন্ন বিদ্যাসাগরের দীপশিখা প্রজ্জ্বলিত করে রাখা।

লেখিকা-পরিচিতি : অধ্যাপক, সভাপতি, Alumni Association, RIE (Bhubaneswar).


[অজানা বিদ্যাসাগর অনন্য দিশারি- সেপ্টেম্বর-২০১৯]


কোন মন্তব্য নেই

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

vidyasagar.info ©