মোট পৃষ্ঠাদর্শন

    ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
        মাইকেল মধুসূদন দত্ত

  বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে।
  করুণার সিন্ধু তুমি, সেই জানে মনে,
  দীন যে, দীনের বন্ধু!—উজ্জ্বল জগতে
  হেমাদ্রির হেমকান্তি অম্লান কিরণে।
  কিন্তু ভাগ্যবলে পেয়ে সে মহা পর্বতে,
  যে জন আশ্রয় লয় সুবর্ণ চরণে,
  সেই জানে কত গুণ ধরে কত মতে
  গিরীশ। কি সেবা তার সে মুখ সদনে।—
  দানে বারি নদীরূপ বিমলা কিঙ্করী;
  যোগায় অমৃত ফল পরম আদরে
  তরুদল, দাসরূপ ধরি;
  পরিমলে ফুলকুল দশ দিশ ভরে;
  দিবসে শীতল শ্বাসী ছায়া, বনেশ্বরী,
  নিশার সুশান্ত নিদ্রা, ক্লান্তি দূর করে!

বিদ্যাসাগর নারীশিক্ষা, প্রৌঢ়শিক্ষা, বিধবাবিবাহ— এ-সবকিছুর মাধ্যমে চেয়েছিলেন সামাজিক পরিবর্তন। তিনি জোর দিয়েছিলেন শিক্ষার উপর, কারণ তিনি বুঝেছিলেন, শিক্ষাই সামাজিক পরিবর্তনের জন্য মোক্ষম অস্ত্র। নারীশিক্ষা ও নারীর প্রতি সম্মান সমাজের গতিপথে উন্নতি আনবে। এক শিক্ষিতা নারী পরিবারের শিক্ষার জন্য দীপশিখা। আমাদের দায়িত্ব সেই অদ্ভুত আধুনিক মনোভাবাপন্ন বিদ্যাসাগরের দীপশিখা প্রজ্জ্বলিত করে রাখা।

—প্রমথেশ দাস


শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য উত্তম চরিত্র ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ তৈরি করা। এই লক্ষ্য নিয়ে যুগ যুগ ধরে সারা পৃথিবীতে শিক্ষাধারা অব্যাহত রয়েছে। কোনো ব্যক্তিকে যদি উত্তম চরিত্র ও ব্যক্তিত্বের মাপকাঠিতে বিচার করতে হয়, তখন একটি বৈশিষ্ট্য বিশেষভাবে দেখতে হয়, যে তার চিন্তাভাবনা, কথাবার্তা ও আচার-আচরণের মধ্যে কী কী মূল্যবোধ, কত মাত্রায় বিদ্যমান বা প্রকাশ পাচ্ছে। যে-কোনো ব্যক্তির সঙ্গে দেখা হলে আমরা তার শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রমাণপত্র দেখি না, কিন্ত শিক্ষার প্রমাণ ও প্রভাব তার আচরণের মধ্যেই প্রকাশ পায়। আচরণ অন্তর্নিহিত জ্ঞান, চিন্তা ও বিচারবুদ্ধির পরিপ্রকাশ। কোনো মনীষী শিক্ষার সংজ্ঞা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে যথার্থই বলেছেন— শিক্ষা হলো সেই জিনিস যা একজন মানুষের মধ্যে থেকে যায় যখন তার পড়াশোনা শেষ হয়ে গেছে এবং পড়ার বিষয়বস্তু ভুলে গেছে।

বিদ্যাসাগরের অনাড়ম্বর পোশাক এবং অতি সাধারণ চেহারার ভেতর থেকে প্রকাশ পেত অন্তর্নিহিত তেজ, প্রচণ্ড বিচারশক্তি এবং প্রগাঢ় মূল্যবোধের অভিব্যক্তি। যে-শিক্ষা তিনি পেয়েছেন বীরসিংহ গ্রামে, পরিবারে এবং কলকাতায়, তিনি তাঁর অতিমানস শক্তির দ্বারা সে-শিক্ষাকে নিজের ব্যক্তিত্ব বিকাশে সুচারুভাবে কাজে লাগিয়েছেন। সেই অতিমানস শক্তি তাঁকে শিক্ষা ও সমাজসংস্কারে অদম্য প্রেরণা ও সাহস দিয়েছে। তাই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মূল্যবোধের এক জীবন্ত উদাহরণ।
‘সাঁওতালরা তাঁকে তাদের ফসল উপহার দিত (শাকপাতা, কন্দ, মুল, কুদ্রুম), গরিবের যে-উপহার পেয়ে তিনি অশ্রপাত করেছেন। ১৮৮৮ অবধি তিনি কর্মাটাঁড়ে যেতেন, তার পরেও নিয়মিত খবরাখবর নিতেন ও মাসোহারা পাঠাতেন। বাংলোর মুখোমুখি, তাঁর প্রতিষ্ঠিত এই উপমহাদেশের প্রথম দাতব্য আদিবাসী বালিকা বিদ্যালয় ও দাতব্য হোমিও চিকিৎসালয় চালু রয়েছে।

—ড. অর্চনা বন্দ্যোপাধ্যায়

              কুড়ি কুড়িকো নঁরঙা করমবুটে তিঁরিয়ঁ দ...
              (ওই শোনো মেয়েরা, করমগাছে করমবাঁশি বাজছে, চলো চলো)
              করো ত্বরা, করো ত্বরা, কাজ আছে মাঠ ভরা
              দেখিতে দেখিতে দিন আঁধার হবে।         —রবীন্দ্রনাথ।


জীবনের শেষ দিকে বিদ্যাসাগর কর্মাটাঁড় (অর্থাৎ, বিস্তীর্ণ কর্মভূমি বা করমগাছ-এর ডাঙা)-এ আঠারো বছর সাঁওতালদের মধ্যে কাটান। (হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে, কর্মা নামে এক সাঁওতালের নামে কর্মাটাঁড়)। এখানে তিনি বিদ্যার গুরু নন, কর্মের পাহাড় করমবুরু বা কর্ম-দেবতা। ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চলের অনেক স্থানে বিভিন্ন গ্রামের এক নাম দেখা যায়, প্রধানত গাছের নামে, যেমন কর্মাটাঁড় (হলদু ও কেলিকদম), জামতাড়া, মাতকোমডিহি (মহুয়া), সারজংডিহি (শাল), সাপারমডিহি (শিউলিবনা)। এ ছাড়া, দুয়ারসিনি, যদুগোড়া, চকইচালান, ধুন্দিখাপ, ডাবা তোরাং, বাঘমুন্ডি, বুরুয়াকোচা, ঝালদা গ্রামগুলি ও আশপাশে কুমোরপাড়া, কামারপাড়া, পেটোপাড়া, তাঁতিপাড়া, গোয়ালপাড়ার বাসিন্দারা নিজেদের পেশা কাঠের কাজ, পাতার থালাবাটি, ঝুড়ি, খাটিয়া বোনার কাজ করে। কর্মনিপুণতা পরম্পরায় চর্চিত। চাষবাস, হস্তশিল্প হাটবারে কেনাবেচা, বিনিময় হয়। রোপণের পরের অবসরে, করম পরবের আগে, প্রধানত হস্তশিল্পের কাজ হয়।

হাওয়া বদল ও বিশ্রাম নিতে বিদ্যাসাগর বাঙালি-অধ্যুষিত দেওঘরের বড় বাড়ি কেনার চেয়ে নির্যাতিত, বিধ্বস্ত সাঁওতালদের মধ্যে থাকার জন্য এই কর্মাটাঁড়ের বৃক্ষবাগানসহ ছোট বাড়ি কেনা ঠিক করেন (১৮৬৯)। সাঁওতালরা ওখানকার সাত-আট ঘর দিকো (বহিরাগত) বা বাঙালিদের বিশ্বাস করত না, কারণ ভদ্রলোকদের কাছ থেকে তারা জিনিসের দাম বা শ্রমের মজুরি পেত না। বিদ্যাসাগর ন্যায্য মজুরি দিয়ে সাঁওতালদের আত্মীয়ের বিশ্বাস অর্জন করেন। সেই কালে প্রতি বছর হাজার টাকার বেশি খরচ করে কাপড়, শীতবস্ত্র, মোটা চাদর, কম্বল কিনে, কমলালেবু, খেজুর কলকাতা থেকে কিনে নিয়ে দিয়েছেন। রোগে ওষুধ, ভেষজ ও পথ্য দিয়েছেন। নিজ হাতে জমাদারনি কলেরা রোগীর, সাঁওতাল বালকের মলমুত্র পরিষ্কার করতে দ্বিধা করেননি। দুপুর রোদে তিন মাইল হেঁটে সাঁওতাল বালকের চিকিৎসা করেছেন। শিক্ষা, কর্ম, আনন্দে ভরা তাঁর বাগানবাড়ি। তাঁরই দেওয়া নাম নন্দন কানন-কে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ‘মহর্ষির আশ্রম’ বলেছেন। নন্দন কাননে সকালে আম, লতানে আমের কলম ও আরও নানা ফলবৃক্ষরোপণ, বাগানের কাজ এবং খাওয়াদাওয়ার পরে আনন্দের নাচ হতো।
বিদ্যাসাগরের রচনাগুলি নিয়ে যখন আলোচনা হয়, তখন সাধারণভাবে আখ্যানমঞ্জরী-র তিনটি ভাগ শুধু উল্লেখ করা হয়। বিদ্যাসাগর বিভিন্ন বই থেকে নানান কাহিনি উদ্ধৃত করে সেগুলি সরল ভাষায় ছাত্রদের জন্য গ্রন্থনা করেন। প্রথম ভাগে একুশটি, দ্বিতীয় ভাগে ছাব্বিশটি ও তৃতীয় ভাগে কুড়িটি কাহিনি স্থান পেয়েছে। লেখাগুলি বেশ সুখপাঠ্য। রচনারীতি খানিকটা নতুন বলা যায়। বেশ ক’টি কাহিনি ঔপনিবেশিক নির্মমতা ও নিষ্ঠুরতার বিবরণ। সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দিতে দেশ দখল করতে গিয়ে ইংরেজ, স্পেনীয় দখলকারেরা অধিকৃত দেশগুলির আদিবাসীদের ওপর যে-নৃশংস অত্যাচার চালিয়েছিল, তারই পরিচয় তিনি দিয়েছেন। এই লেখাগুলি খুঁটিয়ে পড়লে ঔপনিবেশিকতাবাদীদের, বিশেষ করে ইংরেজ রবিনসন ক্রুসোদের, স্বরূপ বুঝতে অসুবিধে হয় না। তাঁর আগে বোধ হয় আর কেউ এমন উদ্ঘাটন করেননি। দু’একটি কাহিনির সংক্ষেপে উল্লেখ করছি।

—পবিত্রকুমার সরকার



তালিবান নেতা মোল্লা মুহম্মদ ওমরের নির্দেশে ২০০১ সালের মার্চের একেবারে গোড়ার দিকে একদল ধর্মীয় সন্ত্রাসী আফগানিস্তানের বামিয়ান বুদ্ধমূর্তি ডিনামাইট ফাটিয়ে উড়িয়ে দেয়। এটি ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় বুদ্ধমূর্তিগুলোর একটি। দেড় হাজার বছরের ওই মূর্তি ঐতিহাসিক সৌকর্ষের গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত হত। ওই জায়গাটি ইউনেস্কো ঘোষিত ঐতিহ্যকেন্দ্র বা হেরিটেজ সাইট। বামিয়ান উপত্যকায় পাহাড়ের পৃষ্ঠতল কেটে-কেটে একদিন ওই বুদ্ধমূর্তি তৈরি হয়েছিল। মৌলবাদী অন্ধতার কাছে অবশ্য এই সবের দাম নেই। ইসলামের নামে এই সব কাণ্ডকারখানা চলেছিল। গোটা বিশ্ব ওই ঘটনায় স্তম্ভিত হয়ে যায়। পাকিস্তানসহ চুয়ান্নটি ইসলামিক রাষ্ট্র বামিয়ান বুদ্ধমূর্তি ধ্বংসের নিন্দা করে। বর্তমানে সুইটজারল্যান্ডের উদ্যোগে ওই মূর্তি পুননির্মাণের চেষ্টা চলছে। মূর্তি নির্মাণ হলেও ঐতিহ্য ফিরে আসবে না।

২০০৩ সালে মার্কিনরা যখন ইরাক দখলে উন্মত্ত সামরিক অভিযান চালায়, ধ্বংস হয়েছিল সুমের ও মেসোপটেমিয়া সভ্যতার অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নসামগ্রী। এত বড় এবং এর তুল্য না-হলেও, একদা এই বাংলাতেও এই সব বোধবুদ্ধিহীন ঘটনা ঘটেছে রাজনৈতিক মৌলবাদের আশ্রয়ে। ১৯৬৯-৭০ আন্দোলনের পথ ধরে মাওবাদী (ওদের দাবি অনুযায়ী) কৃষক বিপ্লবের ধ্যানধারণা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য একদল তরুণ-তরুণী সংকল্পবদ্ধ হয়। ওদের নেতা ছিলেন চারু মজুমদার, সুশীতল রায়চৌধুরী, কানু সান্যাল, সরোজ দত্ত, জঙ্গল সাঁওতাল প্রমুখ। বহু মেধাবি উজ্জ্বল ছাত্রছাত্রী সশস্ত্র বিপ্লবের কুহক-আকর্ষণে ঝাপিয়ে পড়ে। ওরা জোতদার-জমিদার-মুৎসুদ্দি বুর্জোয়ার শাসন-শোষণ থেকে দেশকে দ্রুত মুক্ত করার লক্ষ্যে কলকাতা শহর-সহ রাজ্যের কয়েকটি অঞ্চলে চোরাগোপ্তা হামলা চালায় ও হত্যার আশ্রয় নেয়। ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের আগে লেনিন বিচ্ছিন্ন সন্ত্রাসী ক্রিয়াকাণ্ডের তীব্র নিন্দা করেন এবং একে ‘নারোদনিজম’ (রুশ দেশের ১৮৬০-৭০ সালে কৃষক অভ্যূত্থানভিত্তিক এই মতবাদ প্রচলিত। পরে এর পরিণতি হয় সন্ত্রাসমূলক কার্যকলাপে) আখ্যা দেন। তালিবানদের মতো এই বাংলার নকশালপন্থীরা স্কুল-কলেজ-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ধ্বংস করার এবং ওদের শ্রেণি-উৎস বা মতাদর্শগত পার্থক্য যা-ই থাক না কেন, উভয়ের প্রয়োগ-পদ্ধতি একই ছিল। নকশালপন্থী নামে পরিচিত ওই ছাত্র-যুবরা স্বাধীনতা ও সংস্কার আন্দোলনে অর্জিত গণতান্ত্রিক মূল্যবোধগুলি বিনির্মাণে নেমে পড়ে।
অবহেলিতা নারীজাতির প্রতি নবজাগৃতির এই অগ্রদূতের যে কী অপরিসীম সহানুভূতি ও সমবেদনা ছিল, তার প্রমাণ মেলে বিদ্যাসাগরের জীবনচরিত-এ বারবার। শুধু বিধবাবিবাহ নয়, নারীত্বের অবমাননাকারী কৌলিন্য প্রথার বিরুদ্ধে, বহুবিবাহের বিরুদ্ধে তাঁর সংগ্রাম এবং সর্বোপরি বেথুন স্কুলের সম্পাদনাকাল হতে পরবর্তীকালে জেলায়-জেলায় মেয়েদের স্কুল স্থাপনা— এ-সবকিছুই নারীমুক্তির অগ্রণী অভিভাবক ঈশ্বরচন্দ্র চরিত্রের এক অন্যতম বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছে।

—সোমেশ দাশগুপ্ত



মাইকেল এবং তাঁর ‘Vid’

উনিশ শতকের প্রথমার্ধে ইংরেজি শিক্ষার সংস্পর্শে আলোকপ্রাপ্ত দুই বাঙালি প্রতিভা— ঈশ্বরচন্দ্র এবং মধুসূদন, একই সংস্কারমুক্ত, যুক্তিবাদী মানসিকতায় গড়ে উঠেছেন, আধুনিক মানবতাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে। দুজনের কাজের মধ্যেই এই আদর্শবাদ এবং যুক্তিবাদী চেতনার স্বাক্ষর স্পষ্ট।

বিদ্যাসাগরের সীতার বনবাস এবং মাইকেলের মেঘনাদবধ কাব্য— এই উভয় রচনাতেই আর্যাবর্তের এ-যাবৎ কালের প্রধান নায়ক অযোধ্যার শ্রীরামচন্দ্র অবতারত্বের পদ থেকে নেমে সাধারণ মনুষ্যত্বের স্তরে এসে দাঁড়িয়েছেন।

সীতার বনবাস আলোচনার আগে আরও দুয়েকটি প্রাসঙ্গিক কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন। এক, সীতার বনবাস বিদ্যাসাগর মহাশয়ের অপেক্ষাকৃত পরিণত বয়সের রচনা। ১২৬৭ বঙ্গাব্দের ১ বৈশাখ (১৮৬০ এর ১৫ এপ্রিল) এর প্রথম প্রকাশ। রবীন্দ্রনাথের জন্মের এক বছর আগে। দুই, ওই ১৮৬০ সালের ২৪ এপ্রিল ঋষি রাজনারায়ণ বসুকে লেখা মধুসূদনের এক চিঠি থেকে জানতে পারি, তিলোত্তমাশর্মিষ্ঠা লেখার পরে মধুসূদনকে ‘একটি জাতীয় মহাকাব্য’, রচনার অনুরোধ জানিয়েছিলেন রাজনারায়ণ। তিন, ১৮৬৩-এর ২৪ এপ্রিল থেকে ১৮৬১-র জুনের মধ্যে মেঘনাদবধ কাব্য— প্রথম খণ্ড (প্রথম পাঁচটি সর্গ) লেখা হয়। রবীন্দ্রনাথের জন্মের পর-পরই।
প্রখর রোদে ঘর্মাক্ত বিদ্যাসাগর হনহন করে আল পথ ধরে হেঁটে আসছেন, একটি পাথরের বাটি। হরপ্রসাদ প্রশ্ন করাতে বিদ্যাসাগর জানালেন কিছুক্ষণ আগে একটি সাঁওতালি এসে খবর দিয়েছে তার ছেলের নাক দিয়ে হু হু করে রক্ত পড়ছে, বললে, বিদ্যাসাগর তুই এসে যদি তাকে বাঁচাস। আমি একটা হোমিওপ্যাথিক ওষুধ নিয়ে গেছিলাম জানিস এক ডোজ ওষুধেই ছেলেটার রক্ত পড়া বন্ধ হয়ে গেল। বিদ্যাসাগর আরো বললেন এরা তো মেলা ওষুধ খায় না অল্প ওষুধে এদের উপকার হয়।

—প্রসূন কাঞ্জিলাল



সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত, সমাজসেবী, সমাজ সংস্কারক, এক বিশাল জ্ঞানের অধিকারী ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়কে সারা বিশ্বের মানুষ চেনেন। কিন্তু চিকিৎসক রূপে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ব্যাপ্তি সমন্ধে খুব কম সংখ্যক মানুষই জ্ঞাত। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগর মহাশয় এর আগ্রহ ও অবদান ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য। কিন্তু তার চিকিৎসা পদ্ধতির মূল অস্ত্র ছিল তার নিঃস্বার্থ সেবাপরায়ণতা এবং দরিদ্র মানুষের প্রতি তার অন্তরের ভালোবাসা।

বিদ্যাসাগরের হোমিওপ্যাথি চর্চার অত্যন্ত মানবিক নাকি ঐশ্বরিক বিবরণ পাওয়া যায় তার কারমাটার বাস কালে দরিদ্র শিক্ষাহীন সাঁওতালদের সান্নিধ্যে। বিহারীলাল সরকার লিখছেন “সাঁওতাল প্রবল পীড়ায় প্রায় শয্যাগত বিদ্যাসাগর তাহার শিয়রে বসিয়া, মুখে ঔষধ ঢালিয়া দিতেন, হা করাইয়া পথ্য দিতেন উঠাইয়া বসাইয়া মলমূত্র ত্যাগ করাইতেন সর্বাঙ্গে হাত বুলাইয়া দিতেন।” এ আন্তরিকতার হদিশ পেয়েছে শুধু সাঁওতালরা নয় সমাজের বিভিন্ন বৃত্তের মানুষ আর এই প্রয়াসের বলিষ্ঠতা তার আকৈশোরের অভ্যাস অথবা বলা ভালো জীবনধর্ম। এই মরমী মনটি হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার বহু আগে থেকেই ছিল সে কোন কৈশোর কালে বাবা ঠাকুরদাসের আশ্রয়দাতা জগদ্দূর্লভ সিংহের পরিচিত কিছু মানুষ কলেরায় আক্রান্ত হয়েছে শুনে বালক ঈশ্বরচন্দ্র তার বাবা ও দুই ভাই এর ভোজনের আয়োজন করে অসহায় পাঁচজন রোগীর কাছে গেলেন। ক্রমাগত বমি ও মলত্যাগের ক্লান্ত ও পিপাসার্ত মানুষগুলির জন্য স্থানীয় গৃহস্থ বাড়ি থেকে জল এনে খাওয়ালেন, ডাক্তার রূপচাঁদের বাড়ি থেকে বেদানা, মিছরি, এক কলসি পরিষ্কার জল এনে রোগীদের খাওয়ালেন নিজের হাতে বমি মলমূত্র পরিষ্কার করে ধোয়া কাপড় পড়ালেন। ডাক্তারের জল চিকিৎসায় আর ঈশ্বরচন্দ্রের সেবায় ক্রমে রোগীরা সুস্থ হয়ে উঠলেন। ১৮৬৬ সালের দুর্ভিক্ষে কলকাতার কলেজ স্কয়ার অঞ্চলে উপোসী মানুষকে নিজে হাতে খাবার পরিবেশন করেছিলেন। বীর সিংহ গ্রামে অন্ন ছত্র খুলেছিলেন, বিদ্যাসাগরের কড়া হুকুম ছিল যত টাকা খরচ হোক কেউ যেন অভুক্ত না থাকে। ১৮৬৯-৭০ সালে বর্ধমান এ এক ভয়ানক জ্বরে প্রচুর মানুষ মারা যায়। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সেইসব মানুষদের বিদ্যাসাগর সেবা ঔষধ পথ্য দিয়ে সুচিকিৎসার বন্দোবস্ত করেছেন। সেই জ্বর ছিল প্রকৃতপক্ষে ম্যালেরিয়া। বিদ্যাসাগর এ রোগের চিকিৎসার জন্য ডিসপেনসারি, ওষুধ পত্রের ব্যবস্থা করে ক্ষান্ত হননি, কলকাতায় এসে সেকালের ছোটলাট গ্রে সাহেবের কাছে বিষয়ের গুরুত্ব বোঝান। ফলে সরকারি বদান্যতায় আরো অনেক ডিসপেন্সারি খোলা হল। বিদ্যাসাগরের ডিসপেন্সারি থেকে শুধু ওষুধ পত্র নয় পয়সা ও পরনের কাপড় পর্যন্ত পাওয়া যেত। এই ডিসপেন্সারীর কাজে বিদ্যাসাগরকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিলেন প্যারীচাঁদ মিত্রের ভাইপো ডাক্তার গঙ্গা নারায়ন মিত্র। ম্যালেরিয়া রোগীকে সেখান থেকে কুইনাইন দেওয়া হত প্রয়োজনে তাদের বাড়ি গিয়েও বিদ্যাসাগর স্বয়ং ওষুধ পথ্য পৌঁছে দিয়ে আসতেন। বিদ্যাসাগরের এই অনন্য সাধারণ সেবার কথা স্মরণ করে, আরেক বিশিষ্ট মানুষ রজনীকান্ত গুপ্ত লিখছেন “১৮৮৩ সালে একদা তিনি বিদ্যাসাগর মশাই প্রাত :কালে ভ্রমণ করিতে করিতে এই নগরের প্রান্ত ভাগ অতিক্রম করিয়া কিয়দ্দূর গিয়েছেন, সহসা দেখিলেন একজন বৃদ্ধা অতিসার রোগে আক্রান্ত হইয়া পথের পাশে পড়িয়া রহিয়াছে। দেখিয়ে তিনি ওই মল লিপ্ত বৃদ্ধাকে পরমযত্নে ক্রোড়ে করিয়া আনিলেন এবং তাহার যথোচিত চিকিৎসা করাইলেন। দরিদ্রা বৃদ্ধা তাহার যত্নে আরোগ্য লাভ করিল।”
বিদ্যাসাগরের প্রগতিশীল চিন্তা ভাবনা এবং উদ্যোম আর দ্বারকানাথের মুদ্রণযন্ত্র,আর্থিক সঙ্গতি ও স্বচ্ছ সামাজিক, রাজনৈতিক চেতনা সোমপ্রকাশকে এমন উচ্চতায় নিয়ে যায় যে, বিভিন্ন বিষয়ে জনমত গঠনে অতি প্রভাবশালী ভূমিকা গ্রহণ করে এই পত্রিকা।

—প্রসূন কাঞ্জিলাল



দ্বিশতবর্ষে বিদ্যাসাগর স্মরণ এবং শ্রদ্ধা এ প্রজন্মের বাঙালিকে করেছে ঋদ্ধ। উৎসাহিত করছে এই অন্যতম শ্রেষ্ঠ যুগপুরুষকে জানতে এবং আত্মস্থ করতে। রক্ত-মাংসের এই ঈশ্বরের সামগ্রিক কর্মকান্ডের ক’য়েক শতাংশও যদি থাকত অনুপস্থিত, তবে জাতি হিসেবে বাঙালি যে আজ কতটা দীন থেকে যেত তা কল্পনায় আনলেই শিউরে উঠতে হয়। বিদ্যাসাগরের মতো মহামানবের জন্মের জন্য যেমন অপেক্ষা করতে হয় ক’য়েক শতাব্দী, তেমনই যে জাতির একজন বিদ্যাসাগর থাকেন সে জাতিকে কখনই অন্ধকারের অতল গহ্বরে তলিয়ে যেতে হয় না। বিদ্যাসাগরের মতো ঈশ্বররা কোনো একটি বিশেষ কাজের জন্যও জন্মান না। এক জীবনে বহু কাজের মাধ্যমে সমগ্র জাতিকে উন্নত করার দায়িত্ব তুলে নেন কাঁধে।

বিদ্যাসাগরের কর্মময় জীবনের অজস্র ধারার অন্যতম ছিলতৎকালীন বিভিন্ন পত্র পত্রিকার পৃষ্ঠেপোষকতাও। পেশা নয়, তাঁর বহুমুখী কর্মকাণ্ডকে পূর্ণতা দিতেই হাতে তুলে নিতে হয়েছিল ক্ষুরোধার কলম। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে বেশ ক’য়েকটি সাময়িক পত্রের দায়িত্ব তাঁকে সামলাতে হয়েছে দীর্ঘদিন। ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’, ‘সর্ব্বশুভকরী পত্রিকা’, ‘সোমপ্রকাশ’ ও ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’ ছিল তাঁর এই পর্বের কর্মকান্ডের বিচরণ ক্ষেত্র। তত্ত্ববোধিনীসোমপ্রকাশ ছিল সেই সময়ের অত্যন্ত প্রভাবশালী দুটি বাংলা পত্রিকা। শিক্ষিত বাঙালি সমাজে অত্যধিক প্রভাবশালী ইংরেজি পত্রিকা ছিল হিন্দু পেট্রিয়ট
বিদ্যাসাগর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো (১৮৫৬) এবং রয়াল এশিয়াটিক সোসাইটির সম্মানিত সদস্য (১৮৬৪) নির্বাচিত হন। ১৮৭৭ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার লেফটেন্যান্ট-গভর্ণর স্যার রিচার্ড টেম্পল বিধবাবিবাহ আন্দোলনের নেতা হিসাবে তাঁকে এক বিশেষ সম্মানলিপি প্রদান করেন। ১৮৮০-তে ভারত সরকার তাঁকে সি.আই. ই. উপাধিতে ভূষিত করেন।

—আনিসুজ্জামান

১. বিদ্যাসাগরচরিত

উনিশ শতকের বাংলা দেশে বহু কীর্তিমান পুরুষের জন্ম হয়েছিল। এঁদের মধ্যেও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের স্বাতন্ত্র্য সহজেই ধরা পড়ে। যে-বিস্ময়বোধ থেকে রবীন্দ্রনাথ তাঁর সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘বিশ্বকর্মা যেখানে চার কোটি বাঙালি নির্মাণ করিতেছিলেন, সেখানে হঠাৎ দুই-একজন মানুষ গড়িয়া বসেন কেন, তাহা বলা কঠিন’, যুগান্তরেও আমাদের সে-বিস্ময়বোধের অবসান হয় না।

অথচ তিনি লালিত হয়েছিলেন নিতান্ত প্রাচীনপন্থী পরিবেশে। মেদিনীপুর (তখন হুগলি) জেলার বীরসিংহ গ্রামে তাঁর জন্ম হয় (২৬ সেপ্টেম্বর ১৮২০। ১২ আশ্বিন ১২২৭)। তাঁর পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় সামান্য কর্ম করতেন; তাঁর বেতন কখনো মাসে দশ টাকার বেশি হয়নি। দারিদ্র তাঁদের সহচর ছিল; সম্পদ বলতে ছিল পুরুষানুক্রমিক চরিত্রবল। বিদ্যাসাগর-জননী ভগবতী দেবীও এ-চরিত্রগুণের অধিকারী ছিলেন। উত্তরাধিকারসূত্রে বিদ্যাসাগর যদি তাঁর পরিবার থেকে কিছু পেয়ে থাকেন, তবে তা ছিল চরিত্রের এই তেজ।
প্রকাশকাল ১৮৩৬, প্রকাশক ‘কলিকাতা ট্রাক/ট্র্যাক সোসাইটি’। বইটিতে বর্ণপরিচয় অংশটি নেই, কিন্তু উনিশ শতকের প্রথমার্ধের বাংলা প্রাইমারের যাবতীয় বৈশিষ্ট্য ধরা আছে। বালকের প্রথম পড়িবার বহি গ্রন্থে আছে ছোট ছোট বাক্য গঠন এবং পরে প্রাথমিক পাঠের আয়োজন। পাঠের বিষয় হল— নীতিশিক্ষা এবং বিদ্যালয়ের সুফল সম্পর্কিত বক্তব্য। এ ছাড়া আছে খ্রিস্ট ধর্মের প্রচারমূলক আখ্যান এবং হিন্দু ধর্মের মূর্তিপূজা সম্পর্কে বিরূপ ব্যাখ্যা। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযোগ্য, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বর্ণপরিচয় গ্রন্থের বেশ কিছু বাক্যপাঠ নির্মিত হয়েছে হুবহু বালকের প্রথম পড়িবার বহি গ্রন্থে উল্লিখিত বাক্যপাঠের অনুকরণে।

—আবীর কর



তখনও বিদ্যাসাগরের জন্ম হয়নি। সময়কাল হল ১৮১৬, লঙ সাহেব প্রদত্ত বাংলা ক্যাটালগের তথ্যানুসারে যা বাংলা প্রাইমারের প্রথম প্রকাশকাল হিসেবে চিহ্নিত। ১৮১৬ সালে শ্রীরামপুর মিশনারিরা প্রকাশ করেছিলেন লিপিধারা নামে বর্ণশিক্ষার বই। যদিও এ যাবৎ বইটির কোনও হদিশ মেলেনি, তবে জেমস লঙ-এর তথ্য অনুসারে লিপিধারা নামে ১২ পৃষ্ঠার বইয়ে বাংলা বর্ণের আকৃতি অনুযায়ী ছিল বইটির বর্ণবিন্যাস। অর্থাৎ ভাষাতত্ত্বের পথ মেনে উচ্চারণভিত্তিক নয়, রূপগত বিচারে বর্ণের জ্যামিতিক ফর্ম মেনে প্রকাশিত হয়েছিল বাংলা বর্ণ পরিচয়ের প্রথম বইটি। এর পরের বছর অর্থাৎ ১৮১৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে ‘কলিকাতা স্কুল বুক সোসাইটি’, যার প্রথম ও প্রধান উদ্দেশ্য ছিল পাঠ্যপুস্তক রচনা ও প্রকাশনা। সেই ‘স্কুল বুক সোসাইটি’ থেকে স্টুয়ার্ট সাহেব লিখলেন বর্ণমালা, এই গ্রন্থটিরও উল্লেখ মিলছে লঙ-এর ক্যাটালগ থেকে, লঙ সাহেবের বর্ণনা অনুসারে বর্ণমালা বইয়ের গোড়ায় ছিল বর্ণের পরিচয় পরে ‘ত্র্যক্ষর’ শব্দের বানান। এরপর লঙ-এর ক্যাটালগে যে-বইটির উল্লেখ আছে সেটি রাধাকান্ত দেবের বাংলা বানানের বই। তার বক্তব্য অনুযায়ী বইটি বানান শেখার বই, পৃষ্ঠা সংখ্যা ২৫৬। কিন্তু এই বইটি নিয়ে সংশয়ের বিষয় হল এই যে, রাধাকান্ত দেবের আলোচনায় কোথাও এই গ্রন্থটির উল্লেখ পাওয়া যায় না। সাহিত্য-সাধক চরিতমালা-য় রাধাকান্ত দেব সম্পর্কে আলোচনায় বাংলা শিক্ষাগ্রন্থ (১৮২১)-এর নাম আছে, যেখানে বিষয় হিসেবে প্রাথমিক বাংলা, বাংলা ব্যাকরণ, ইতিহাস ভূগোল, গণিতের সংকলন লক্ষ করা যায়।
স্বভাবতই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সতীদাহপ্রথা নিবারণের জন্য আইন পাস হওয়ার পর আবার একটি আইন প্রণয়ন করে হিন্দু প্রজাদের চটাতে সাহস করা সুবিবেচনা বলে মনে করছিলেন না। বৃহত্তর সমাজে আলোচনা কিন্তু চলছিল। সব থেকে সরব ছিলেন ইয়ং বেঙ্গল দল। তাঁদের মুখপত্র বেঙ্গল স্পেকটেটর ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দে প্রশ্ন তুলে ফেলল, স্ত্রীর মৃত্যুর পর পুরুষ যদি পুনর্বিবাহ করতে পারে তবে নারীকে সেই অধিকার কেন দেওয়া হবে না?

—গোপা দত্তভৌমিক



বিদ্যাসাগরের কর্মমুখর জীবনের অজস্র তরঙ্গভঙ্গের মধ্যে কোন কাজটিকে সর্বাপেক্ষা প্রাধান্য দেওয়া যাবে তা নিয়ে বিস্তর মতভেদ আছে। সমাজ সংস্কার, শিক্ষা সংস্কার, ভাষা ও সাহিত্য— কোনওটিই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। দানধ্যানের কথা নাহয় আপাতত থাক। বিদ্যাসাগর নিজে কিন্তু স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ‘বিধবাবিবাহ প্রবর্ত্তন আমার জীবনের সর্ব্বপ্রধান সৎকর্ম্ম।’ আজকাল অনেকে মনে করছেন বিধবাবিবাহ প্রবর্তনের জন্য এতটা পরিশ্রম ও কষ্টস্বীকার না করে তিনি যদি সাহিত্য চর্চায় সেই সময় ও অধ্যবসায় ব্যয় করতেন তবে চিরস্থায়ী কিছু ফল হত। অর্থাৎ এঁরা মনে করেন কালের গতিতে হিন্দু বিধবাদের বিয়ে একদিন প্রচলিত হতই— এত চাপাচাপি এবং আন্দোলনের দরকার ছিল না। বিশেষত এই কাজ করতে গিয়ে বিদ্যাসাগর রক্ষণশীল সমাজের বিরাগভাজন হন, আর্থিক দিকে নিঃস্ব হয়ে পড়েন এবং যাঁদের উপর ভরসা রেখেছিলেন তাঁরা কার্যকরী সাহায্য না করে সরে দাঁড়ানোতে বঙ্গসমাজের উপর তিনি আস্থা হারিয়ে ফেলেন। এককথায় শেষজীবনে যে তিনি শহর থেকে দূরে বিষণ্ণ এক প্রান্তিক জীবনে নিজেকে সরিয়ে নিলেন তার প্রধান কারণ বিধবাবিবাহ নিয়ে তাঁর প্রাণপণ আন্দোলন। এই ধারণা খুবই সরলীকৃত এবং বিদ্যাসাগর ও বঙ্গসমাজের পারস্পরিক সম্পর্কের লঘু বিচার। বিদ্যাসাগর কেন ‘বিধবাবিবাহ প্রবর্ত্তন’ তাঁর ‘সর্ব্বপ্রধান সৎকর্ম্ম’ বলে বিবেচনা করেছেন সেটি প্রথমত ভেবে দেখা দরকার। তিনিই যে বঙ্গসমাজে বিধবাবিবাহের কথা প্রথম বললেন এমনটা নয়। বস্তুত এই নিয়ে একটা চিন্তাভাবনা অষ্টাদশ শতক থেকেই ছিল। অদ্ভুত এক সমাপতন যে বিধবাবিবাহ আইন পাস (১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দ) হওয়ার ঠিক একশো বছর আগে ঢাকার নায়েব রাজবল্লভ সেন নিজের ছোট মেয়ে অভয়ার অকালবৈধব্যে ব্যথিত হয়ে বিধবাবিবাহের প্রচলন করার চেষ্টা করেন। তাঁর তিনজন দ্বার-পণ্ডিত কৃষ্ণদাস বেদান্তবাগীশ, নীলকণ্ঠ সার্বভৌম এবং কৃষ্ণদেব বিদ্যাবাগীশ জানিয়েছিলেন অক্ষতযোনি বিধবাদের পুনর্বিবাহে হিন্দুশাস্ত্রে কোনও নিষেধ নেই। রাজবল্লভ শুধু এঁদের কথার উপর নির্ভর করে মেয়ের বিয়ে দিতে ভরসা পেলেন না। তিনি কাশী, কাঞ্চী, মিথিলার পণ্ডিতদের কাছ থেকে অনুকূল মত আনালেন। কিন্তু তাঁর প্রয়াস ব্যর্থ হল নবদ্বীপে। নবদ্বীপের পণ্ডিতসমাজ চিরকালই রক্ষণশীল। চৈতন্যদেব ও তাঁর প্রেমভক্তিধর্মকেও তাঁরা সমকালে সুনজরে দেখেননি। তার উপর মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র তখন হিন্দুসমাজের মাথা। তিনি কীভাবে বাধা দিয়েছিলেন তা নিয়ে একটি কিংবদন্তি আছে। বিধবাবিবাহের প্রস্তাব নিয়ে রাজবল্লভের লোক আসার পর কৃষ্ণচন্দ্র তাঁদের যথাবিধি ভোজ্যের সঙ্গে একটি বাছুরও পাঠালেন। কারণ হিসেবে বলা হল বিধবাবিবাহ বহুকাল যাবৎ অপ্রচলিত আছে তা প্রচলিত হতে পারলে শাস্ত্রানুসারে গোমাংস ভক্ষণেও আপত্তি হতে পারে না। এরপর হিন্দুসমাজে আর কারও এগোবার সাহস হবে না বলা বাহুল্য। বিধবাবিবাহ নিয়ে অষ্টাদশ শতকে কেমন মনোভাব প্রচলিত ছিল ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের অন্নদামঙ্গল-এ তার একটি পরিচয় আছে। বাদশা জাহাঙ্গীর ও কৃষ্ণচন্দ্রের পূর্বপুরুষ ভবানন্দ মজুমদারের সম্পূর্ণ কাল্পনিক কথোপকথনে বিষয়টি এসেছে। এটি ধর্মাচার সম্বন্ধে মুসলমান শাসনের শেষপ্রহরে ইসলামি ও হিন্দু দুই বিরোধী পক্ষের ভারতাশ্রীয় ডিসকোর্স। জাহাঙ্গীর বিধবাদের বিষয়ে হিন্দুসমাজের আচারকে ধিক্কার দিলেন,
সেইজন্য বিদ্যাসাগর এই বঙ্গদেশে একক ছিলেন। এখানে যেন তাঁহার স্বজাতি-সোদর কেহ ছিল না। এদেশে তিনি তাঁহার সমযোগ্য সহযোগীর অভাবে আমৃত্যুকাল নির্বাসন ভোগ করিয়া গিয়াছেন। তিনি সুখী ছিলেন না। তিনি নিজের মধ্যে যে এক অকৃত্রিম মনুষ্যত্ব সর্বদাই অনুভব করিতেন, চারিদিকের জনমণ্ডলীর মধ্যে তাহার আভাস দেখিতে পান নাই। তিনি উপকার করিয়া কৃতঘ্নতা পাইয়াছেন, কার্যকালে সহায়তা প্রাপ্ত হন নাই। এই দুর্বল, ক্ষুদ্র, হৃদয়হীন, কর্মহীন, দাম্ভিক, তার্কিক জাতির প্রতি বিদ্যাসাগরের এক সুগভীর ধিক্কার ছিল। কারণ তিনি সর্ববিষয়েই ইহাদের বিপরীত ছিলেন।

—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর



বিদ্যাসাগরের চরিত্রে যাহা সর্বপ্রধান গুণ—যে গুণে তিনি পল্লী আচারের ক্ষুদ্রতা, বাঙালি জীবনের জড়ত্ব সবলে ভেদ করিয়া একমাত্র নিজের গতিবেগপ্রাবল্যে কঠিন প্রতিকূলতার বক্ষ বিদীর্ণ করিয়া— হিন্দুত্বের দিকে নহে, সাম্প্রদায়িকতার দিকে নহে— করুণায় অশ্রুপূর্ণ উন্মুক্ত অপার মনুষ্যত্বে অভিমুখে আপনার দৃঢ়নিষ্ঠ একাগ্র একক জীবনকে প্রবাহিত করিয়া লইয়া গিয়াছিলেন, আমি যদি তাঁহার সেই গুণকীর্তন করিতে বিরত হই, তবে আমার কর্তব্য একেবারেই অসম্পন্ন থাকিয়া যায়। কারণ বিদ্যাসাগরের জীবন-বৃত্তান্ত আলোচনা করিয়া দেখিলে এই কথাটি বারংবার মনে উদয় হয় যে, তিনি যে বাঙালি বড়লোক ছিলেন, তাহা নহে, তিনি যে রীতিমতো হিন্দু ছিলেন, তাহাও নহে—তিনি তাহা অপেক্ষাও অনেক বেশী বড় ছিলেন, তিনি যথার্থ মানুষ ছিলেন।

বিদ্যাসাগরের গৌরব কেবলমাত্র তাঁহার প্রতিভার উপর নির্ভর করিতেছে না। প্রতিভা মানুষের সমস্তটা নহে, তাহা মানুষের একাংশ মাত্র। প্রতিভা মেঘের মধ্যে বিদ্যুতের মতো, আর মনুষ্য চরিত্রের দিবালোক, তাহা সর্বব্যাপী ও স্থির। প্রতিভা মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ অংশ— আর, মনুষ্যত্ব জীবনের সকল মুহূর্তেই সকল কার্যেই আপনাকে ব্যক্ত করিতে থাকে। প্রতিভা অনেক সময় বিদ্যুতের ন্যায় আপনার আংশিকতা বশতই লোকচক্ষে তীব্রতররূপে আঘাত করে এবং চরিত্র-মহত্ব আপনার ব্যাপকতাগুণেই প্রতিভা অপেক্ষা ম্লানতর বলিয় প্রতীয়মান হয়। কিন্তু চরিত্রের শ্রেষ্ঠতাই যে যথার্থ শ্রেষ্ঠতা, ভাবিয়া দেখিলে, সে বিষয়ে কাহারো সংশয় থাকিতে পারে না।
vidyasagar.info ©