ইউরোপীয় রেনেসাঁসের এক বিশিষ্ট গোষ্ঠী ছিলেন শিক্ষাব্রতী পণ্ডিতের দল। এঁদের মূল বিদ্যাক্ষেত্র ভাষা ও পাঠচর্চা। অনেকে
প্রশাসন বা রাজনীতিতেও যোগ দিতেন, অনেকে দিতেন না; কিন্তু স্রেফ মেধা ও বিদ্যার জোরে এঁদের অনেকে সমাজে ও ধর্মীয়
অনুশাসনে প্রভাবশালী ছিলেন। ধর্মবোধ ও নীতিজ্ঞানকে এঁরা যুক্তি ও মনুষ্যত্বের ব্যাপক পরিসরে মুক্তি দিয়েছিলেন। এই
বিদ্বানদের হিউমানিস্ট বলা হয়। শব্দটার উৎপত্তি এক বিশেষ ঐতিহাসিক সূত্রে, কিন্তু অবধারিত ভাবে তাতে সঞ্চার হয়েছে
‘হিউমান’ শব্দের বৃহত্তর মনুষ্যত্বের ব্যঞ্জনা। উনিশ শতকের বাংলায় নতুন নৈতিক ও সামাজিক চেতনা বিলক্ষণ সেই হিউমানিস্ট
ধাঁচে। বিদ্যাসাগর তার উজ্জ্বলতম প্রাণপুরুষ।
— সুকান্ত চৌধুরী
বিদ্যাসাগর সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ একটা মজার কথা বলেছেন: কাক যেমন কোকিলের ছানা পালন করে, বিধাতা তেমনই ‘বঙ্গভূমির প্রতি বিদ্যাসাগরকে মানুষ করিবার ভার দিয়াছিলেন’। ‘চারিত্রপূজা’-র ওই প্রবন্ধে কবি বাঙালিদের বিস্তর গাল দিয়েছেন। ধন্দে পড়েছেন, কোন বদখেয়ালে বিধাতা চার কোটি বাঙালির মধ্যে বিদ্যাসাগরের মতো ‘দুই-একজন মানুষ’ গড়ে বসেন।
তবু কাক বেচারাই তো কোকিলকে ‘মানুষ’ করে। বিদ্যাসাগরের বিরল মনুষ্যত্ব বঙ্গভূমিতেই লালিত, তার ছাপ যাবে কোথায়? আছে তাঁর ধুতি-চাদর-চটিতে, আধুনিক বাংলা ভাষা সৃষ্টিতে তাঁর অবদানে, বাংলার ছেলেমেয়েদের (হ্যাঁ, মেয়েদেরও) শিক্ষার জন্য তাঁর জীবনভর প্রয়াসে। অথচ ধুতি-চাদর আঁকড়ে থাকার এই জেদে রবীন্দ্রনাথ পাচ্ছেন এক অন্তরস্থ সাহেবিয়ানা— ‘অনুকরণগত সাদৃশ্য’ নয়, চরিত্রগত। সেই সাহেবিয়ানাই তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছে বাঙালি পরিচয়কে তুলে ধরতে।
মোট কথা, তাঁকে নিয়ে আইডেন্টিটি পলিটিক্স চলবে না। দু’শো বছর আগের যুগসন্ধিতে পাশাপাশি গড়ে উঠেছিল ভারতীয় উদ্যোগে নতুন পাশ্চাত্য বিদ্যাচর্চার জন্য হিন্দু কলেজ আর সাহেবি উদ্যোগে সাবেক প্রাচ্য বিদ্যাচর্চার জন্য সংস্কৃত কলেজ। নামেই ফাঁস, দুটোই সোনার পাথরবাটি। সংস্কৃত ভাষা হিন্দু পরিচিতি কি রক্ষা করবে বিজাতীয় কলেজ? কলেজি সাহেবি বিদ্যাই বা ঠাঁই পাবে কোথায়?
শিক্ষা-সংস্কৃতির এই আবর্তে বিদ্যাসাগর ঝাঁপ দিলেন। ছাত্রাবস্থায় সংস্কৃত কলেজে যেটুকু ইংরেজি পড়া যেত পড়লেন, তার পর পড়লেন শিক্ষক রেখে। অধ্যক্ষ হয়ে চাঞ্চল্যকর ‘নোটস’-এ সুপারিশ করলেন, সংস্কৃতের সব ছাত্রকে ইংরেজি শিখতে হবে। সেই বক্তব্য বিস্তারে লিখলেন কাশীর সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ ব্যালেন্টাইন সাহেবের সমীক্ষার জবাবে। ব্যালেন্টাইনের মতে সংস্কৃতের ছাত্রদের ইংরেজি শেখাতে হবে সাবধানে মেপে মেপে, নইলে প্রাচ্য আর পাশ্চাত্য বিদ্যার ঠোকাঠুকিতে তারা ভেবে বসবে সত্য দু’রকম। জ্ঞানের এই দ্বিত্ব বিদ্যাসাগর মানতে পারেননি; দৃঢ় ভাবে বলেছেন সত্য সত্যই, তার খাতিরে কখনও বা প্রাচ্য বিদ্যা ত্যাগ করে নব্য পাশ্চাত্য বিদ্যাকে অধিষ্ঠিত করতে হবে। আক্ষেপ করেছেন, প্রাচীন শাস্ত্রে যদি আধুনিক বিজ্ঞানের লেশমাত্র তত্ত্ব মেলে, কিছু লোকে বিজ্ঞান অস্বীকার করে শাস্ত্রবচনকে আরও আঁকড়ে ধরবে। আজকের ভারতে কথাটা বড়ই প্রাসঙ্গিক।