রবীন্দ্রনাথ যাকে বিদ্যাসাগরের ‘অক্ষয় মনুষ্যত্ব’ বলেছেন তা তাঁর মানবিকতারই একটি দিক। তাঁর মানবসেবায় আত্মনিয়োগের কথা ইতিমধ্যেই উল্লেখ করা হয়েছে। মানবপ্রীতিই তাঁর মূল প্রেরণা। সম্ভবত রবীন্দ্রনাথ যা বলতে চেয়েছিলেন তা হ’ল এই যে, তাঁর মানবসেবা কোনো ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না।
—হিরণ্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর একটি অনন্যসাধারণ চরিত্র। উনবিংশ শতাব্দীতে যে সকল ক্ষণজন্মা মহাপুরুষের বাংলাদেশে আবির্ভাব হয়েছিল তাঁদের মধ্যেও তিনি স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে বিশেষভাবে চিহ্নিত ছিলেন। অগণিত গুণের বিচিত্র সমাবেশ নিয়ে তিনি একক মাহাত্ম্যে জীবনের পথে বলিষ্ঠ পদক্ষেপে চলে গেছেন। তিনি যে আছেন তা জীবনের সকল ক্ষেত্রে সকলে অনুভব করেছে এবং সকলেরই শ্রদ্ধা তাঁর প্রতি আপনা হতে আকৃষ্ট হয়েছে। তাঁর জন্মের সার্ধশতবৎসর পূর্তি উপলক্ষে তাঁর চরিত্রের একটি সংক্ষিপ্ত মূল্যায়নের মধ্য দিয়ে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করবার প্রস্তাব করি।
তাঁর সমসাময়িক মানুষদের মন্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়েই এই মূল্যায়ন আরম্ভ করা যাক। মাইকেল মধুসূদন দত্ত শুধু তাঁর সমসাময়িক ছিলেন না, বন্ধু ছিলেন। কাছে থেকে জানবার সুযোগ তাঁর যথেষ্ট হয়েছিল। তিনি বিদ্যাসাগর সম্বন্ধে স্ত্রীর নিকট মন্তব্য করেছিলেন, বিদ্যাসাগর এমন একজন মানুষ ‘যাঁর মনীষা প্রাচীন ঋষিদের মতো, কর্মদক্ষতা ইংরেজের মতো এবং হৃদয়বত্তা বাঙালী জননীর মতো।’ এই উক্তি যে অক্ষরে অক্ষরে তাঁর ওপর প্রযোজ্য তা তাঁর জীবনী হতেই প্রমাণিত হয়।
তাঁর ধী-শক্তির প্রমাণ রয়েছে তাঁর ছাত্রজীবনের অনন্যসাধারণ কীর্তির মধ্যে। ১৮২৯ খ্রীষ্টাব্দে তিনি সংস্কৃত কলেজের তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র হিসাবে ভর্তি হন এবং ১৮৪১ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে তিনি ব্যাকরণ, সাহিত্য, অলঙ্কার, বেদান্তদর্শন, ন্যায়শাস্ত্র, জ্যোতিষ এবং স্মৃতির সবগুলি পরীক্ষায় উর্ত্তীণ হন। একটি ছাড়া কোনোটিতে তিনি দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেননি। কলেজের কর্তৃপক্ষ এই অসাধারণ বিদ্যাবত্তায় মুগ্ধ হয়ে বিদ্যাসাগর উপাধিতে ভূষিত করে এবং একটি বিশেষ প্রশস্তিপত্র প্রদান করে তাকে সম্মানিত করেন।
মাইকেল তাঁর কর্মশক্তি সম্বন্ধে যে মন্তব্য করেছেন তাও তাঁর প্রাপ্য। কর্মবহুল তাঁর সমগ্র জীবনই তার প্রমাণ। এই প্রসঙ্গে তাঁর কর্মের ক্ষেত্র কত বিস্তৃত এবং বিচিত্র ছিল তার আভাস পাওয়া যাবে যে কয় বৎসর তিনি কলিকাতা সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষপদে নিযুক্ত ছিলেন সে সময়কার বিবরণ হতে। ১৮৫১ হতে ১৮৫৮ খ্রীষ্টাব্দ অবধি তার ব্যাপ্তি। সংস্কৃত কলেজের প্রশাসনিক দায়িত্ব বহন করা ছাড়া এই সময় তিনি দক্ষিণ বাংলার চারটি জেলার বিদ্যালয়-পরিদর্শকের কাজও করতেন। শিক্ষার উৎকর্ষসাধনের জন্য এই সময় তিনি শিক্ষকদের শিক্ষণের জন্য কতকগুলি নর্মাল স্কুল স্থাপন করেন। নারীশিক্ষা প্রসারের জন্য নিজ দায়িত্বে তিনি এই সময়ের মধ্যে অনেকগুলি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। একটি চালু প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধান করা অপেক্ষা একটি নূতন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা আরও কষ্টসাধ্য। এই নূতন প্রতিষ্ঠানগুলি গড়ে তোলার দায়িত্ব তিনি স্বেচ্ছায় গ্রহণ করেছিলেন।
ছাত্রদের পাঠ্যপুস্তকের অভাব দূর করবার জন্য তিনি এই সময় বিভিন্ন বয়সের ছাত্রের উপযোগী পাঠ্যপুস্তক রচনার ভার গ্রহণ করেন। এই সময়ের মধ্যেই তিনি এই প্রসঙ্গে ‘বর্ণপরিচয়’ হতে শুরু করে ‘বোধোদয়’, ‘কথামালা’ প্রভৃতির মধ্য দিয়ে ‘শকুন্তলা’ গ্রন্থও রচনা করেন। সংস্কৃত শিক্ষাকে সহজসাধ্য করবার জন্য এই সময়ের মধ্যেই তিনি ‘উপক্রমণিকা’ এবং ‘ব্যাকরণ কৌমুদী’ প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ভাগ রচনা করেন।
একই সময় অতিরিক্তভাবে তিনি হিন্দু বিধবাদের পুনর্বিবাহ বিধিবদ্ধ করতে আগ্রহী হয়ে তুমুল আন্দোলন আরম্ভ করেন এবং সরকারকে প্রয়োজনীয় আইন পাস করতে বাধ্য করান। এই প্রসঙ্গে বিধবাদের পুনর্বিবাহের সমর্থন আছে এমন শাস্ত্রবাক্য অন্বেষণের জন্য তাঁকে অনেক প্রাচীন পুঁথি পড়তে হয়েছিল, জনমত গড়ে তোলবার জন্য একাধিক পুস্তিকা রচনা করতে হয়েছিল; এবং তাদের সমর্থনের জন্য সভা-সমিতি করতে হয়েছিল। এতগুলি কাজ তিনি অনায়াসে করে যেতে পেরেছিলেন। তা তাঁর কর্মশক্তির সুন্দর পরিচয় দেয়। কাজেই তাঁর চরিত্রের ওই গুণটি যা মাইকেলের বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই।
তাঁর হৃদয় যে বাঙালী জননীর মতো মমতায় পরিপূর্ণ ছিল তা প্রমাণিত করবার জন্য বেশী তথ্যস্থাপনের প্রয়োজন নেই। অর্থার্থী মানুষের জন্য তাঁর বাড়ির দরজা যে সর্বদাই উন্মুক্ত থাকত তা সর্বজনবিদিত। তাঁর অগণিত দাক্ষিণ্যের পরিচয় পেয়ে তার চরিত্রের এই গুণটির প্রতি জনসাধারণের দৃষ্টি এমনভাবে আকৃষ্ট হয়েছিল বলেই সাধারণ মানুষ তাঁকে ‘দয়ার সাগর’ নামে ভূষিত করেছিল। মানবসেবাকেই তিনি ধর্মরূপে গ্রহণ করেছিলেন, আনুষ্ঠানিক ধর্মে তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল না। তাঁর আয়ের একটি বড় অংশ অভাবী মানুষের আর্থিক কষ্টমোচনে ব্যয়িত হত।
বাংলার আর-একজন বিশিষ্ট সন্তান বিদ্যাসাগর সম্পর্কে প্রশস্তি লিখে গেছেন। মনে হয় তাঁর চরিত্র রবীন্দ্রনাথকে যতখানি মুগ্ধ করেছিল তেমন বাংলার অন্য কোনো বিশিষ্ট সন্তানকে করেনি। দয়া, বিদ্যা ও কর্মশক্তি ছাড়াও বিদ্যাসাগর-চরিত্রে তিনি আরও দুটি অতিরিক্ত গুণ দেখেছিলেন যা তাঁর বিবেচনায় আরও মহত্তর গুণ। তিনি বলেছেন : ‘দয়া নহে, বিদ্যা নহে, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের চরিত্রের প্রধান গৌরব তাঁহার অজেয় পৌরুষ, তাঁহার অক্ষয় মনুষ্যত্ব।’ (বিদ্যাসাগর-চরিত)
সাধারণত ঈশ্বরচন্দ্র ছিলেন মিষ্টভাষী, তাঁর ব্যবহার ছিল অত্যন্ত সৌজন্যপূর্ণ; কিন্তু তাই বলে তিনি ক্ষমতায় অধিষ্টিত মানুষের অসৌজন্যসূচক আচরণ বরদাস্ত করতেন না। জাতীয় সংস্কৃতির প্রতিও তাঁর শ্রদ্ধা ছিল অপরিসীম। তাই বিদেশী প্রভুর মনোরঞ্জন করতে তিনি নিজের বেশ পরিবর্তন করতেও সম্মত হননি। এইখানেই তাঁর পৌরুষের পরিচয়। তাঁর এই গুণ কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তকেও কম মুগ্ধ করেনি এবং সেই কারণেই তাঁর রচিত প্রশস্তিতে তিনি ঈশ্বরচন্দ্রকে ‘বীরসিংহের সিংহশিশু’ বলে সম্বোধন করেছেন। এই প্রসঙ্গে দুটি বিষয় উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি যখন সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ তখন হিন্দু কলেজের অধ্যক্ষ কার সাহেবের ঘরে গিয়ে একবার দেখা করবার প্রয়োজন ঘটে। তখন অভ্যর্থনা করা দূরের কথা, মিঃ কার তাকে বসতে অনুরোধও করেননি এবং টেবিলে পা তুলে রেখেই তাঁর সঙ্গে আলাপ চালিয়েছিলেন। তার প্রত্যুত্তরে কার সাহেব যখন তাঁর আপিসে তাঁর সহিত দেখা করতে আসেন তখন তিনি তার সহিত অনুরূপ ব্যবহার করে তাকে সমুচিত শিক্ষা দিয়েছিলেন। দ্বিতীয় কথা হ’ল এই—সেকালে উচ্চপদস্থ রাজপুরুষের সঙ্গে দেখা করতে হলে ভারতীয়দের চোগা চাপকান ও পাগড়ি ধারণ করতে হ’ত। তখন ফ্রেডারিক হ্যালিডে ছিলেন বাংলার লেঃ গভর্নর। তিনি বিদ্যাসাগর মহাশয়কে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন এবং নানা প্রসঙ্গে আলাপ-আলোচনা করবার জন্য তাঁর বেলভেডিয়ারের প্রাসাদে ডেকে পাঠাতেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় তাঁর ধুতি চাদর এবং চটি দিয়ে সজ্জিত হয়েই তাঁর সহিত সাক্ষাৎ করবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন এবং ছোটলাট তাতে সম্মতি দিয়েছিলেন। এইভাবেই বিদ্যাসাগরের আচরণের মধ্য দিয়ে বাঙালী পণ্ডিতের পোশাকের আভিজাত্য রক্ষিত এবং বর্ধিত হয়েছিল।
রবীন্দ্রনাথ যাকে বিদ্যাসাগরের ‘অক্ষয় মনুষ্যত্ব’ বলেছেন তা তাঁর মানবিকতারই একটি দিক। তাঁর মানবসেবায় আত্মনিয়োগের কথা ইতিমধ্যেই উল্লেখ করা হয়েছে। মানবপ্রীতিই তাঁর মূল প্রেরণা। সম্ভবত রবীন্দ্রনাথ যা বলতে চেয়েছিলেন তা হ’ল এই যে, তাঁর মানবসেবা কোনো ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে সকল অবহেলিত মানুষই তাঁর সেবার পাত্র ছিল। হিন্দুনারীদের দুর্দশা সম্বন্ধে তাঁর সচেতনতার কারণ, সমাজের প্রতিকূলতায় তাঁরা নানাভাবে নিপীড়িত ও নিগৃহীত হতেন। মিহিজামে যখন থাকতেন তখন সাঁওতালদের সেবায় তিনি আত্মনিয়োগ করতেন, বা মহামারীতে আর্তত্রাণের কাজে ডাক আসত, তখন তিনি সকল সম্প্রদায়ের মানুষের ত্রাণের ব্যবস্থা করতেন। তাঁর নিজগ্রামে যখন একবার দুর্ভিক্ষ হয় তিনি সকল দুঃস্থ মানুষের আহার যোগাবার দায়িত্ব নিজে গ্রহণ করেছিলেন। বর্ধমান জেলায় যখন একবার ম্যালেরিয়া মহামারী আকারে প্রকট হয় তখন রোগীদের সেবা-শুশ্রূষার জন্য ব্যাপক ব্যবস্থা করেছিলেন। এই সময় যাঁরা তাঁর সেবা পেয়েছিলেন তাঁদের বেশির ভাগ মানুষ ছিলেন মুসলমান সম্প্রদায়ের লোক।
এই মহামানবের চরিত্রে এইভাবে এমন বহু গুণের বিচিত্র সমাবেশ ঘটেছিল যে, তা বলে এক রকম শেষ করা যায় না। এক কথায় বলা যায় এমন মানুষ বাংলা দেশে আর জন্মায়নি। এইখানেই তাঁর চরিত্রের আলোচনা তাই শেষ করবার প্রস্তাব করি। তবে আর-একটি কাহিনী উল্লেখ করার লোভ সংবরণ করা শক্ত হয়ে পড়ছে। তার উল্লেখ করেই এই ক্ষুদ্র প্রশস্তি শেষ করা যাক। তা তার ব্যক্তিত্বের এবং সৌজন্যের সুন্দর পরিচয় দেয়।
একবার পাইকপাড়ার রাজার বাড়িতে তিনি কোনো কর্ম উপলক্ষে গিয়েছিলেন। সেখানে তখন হডসন নামে একজন ইংরেজ চিত্রকর রাজ-পরিবারের মানুষদের প্রতিকৃতি-অঙ্কনে নিযুক্ত ছিলেন। তিনি বিদ্যাসাগরকে দেখে এমন মুগ্ধ হন যে, তাঁর প্রতিকৃতি আঁকবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। বিদ্যাসাগরের প্রজ্ঞাভাস্বর, পৌরুষদীপ্ত মমত্বমণ্ডিত চেহারার মধ্যে এই গুণী চিত্রকর নিশ্চয় এমন একটি আঁকবার মতো বিষয় লক্ষ্য করেছিলেন যার জন্য তাঁর মনে এই ইচ্ছা জেগেছিল। বিদ্যাসাগর স্বাভাবিক সৌজন্যবোধহেতু সম্মতি দিয়েছিলেন। ছবি আঁকা শেষ হলে বিদ্যাসাগর যখন জিজ্ঞাসা করলেন পারিশ্রমিক হিসাবে তাঁকে কত দিতে হবে, হডসন বললেন যে কিছুই দিতে হবে না, কারণ তিনি এটা শখ করে এঁকেছেন। এই তো প্রকৃত চিত্রকর! যখন কিছুতেই শিল্পীকে পারিশ্রমিক নিতে রাজী করানো গেল না, তখন বিদ্যাসাগর তাঁকে দিয়ে তাঁর পিতা ও মাতার ছুটি প্রতিকৃতি আঁকিয়ে নিয়েছিলেন এবং সেজন্য পর্যাপ্ত পারিশ্রমিক দিয়েছিলেন। হডসন-অঙ্কিত এই চিত্রখানি বিদ্যাসাগরের যতগুলি চিত্রের সহিত আমরা পরিচিত তাদের মধ্যে অবিসম্বাদিভাবে সর্বশ্রেষ্ঠ। তাঁর চরিত্রের গুণগুলি যেন এই প্রতিকৃতির মুখচ্ছবিতে সুন্দর প্রতিফলিত হয়েছে মনে হয়।
সেপ্টেম্বর/অক্টোবর ১৯৬০ সালে প্রকাশিত।

কোন মন্তব্য নেই
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন