দক্ষিণেশ্বরের পূজারীঠাকুরের একবার খেয়াল হ’ল সমুদ্রস্নানের, অমনি অযাচিতভাবে বাদুড়বাগানের বাড়িতে এসে হাজির সাগর-সঙ্গমে। প্রথম সম্ভাষণও অদ্ভুত রকমের। ‘এতদিন ছিলাম খালে-বিলে নদী-নালায়, এবার এসে পড়েছি একেবারে সাগরে’। উত্তরও ঠিক তেমনই, ‘তা বেশ, খানিকটা! নোনা পানি নিয়ে যান।’
—জনার্দন চক্রবর্তী
আমাদের ধারণার অনধিগম্য যে-সমস্ত বিষয় আছে বিদ্যাসাগরের মনুষ্যমহিমা নিশ্চয়ই তেমন একটি বিষয়। এমন একটি মহাজীবনের আলোকে আমরা কিছুটা আভাস পেতে পারি ভূমা কাকে বলে, ভূমৈব সুখং নাল্পে সুখমস্তি, এই সুচিরশ্রুত বাণীরই বা অর্থসঙ্কেত কি? তদ্ধিদ্ধি প্রণিপাতেন পরিপ্রশ্নেন সেবয়া। প্রণিপাত পরিপ্রশ্ন ও সেবা, এই তিনটি সিংহদ্বার অতিক্রম করে জ্ঞানী তত্ত্বদর্শীর উপদেশে অনুভূতির সেই রাজ্যে আমরা প্রবেশাধিকার পেতে পারি। এই মহামানবের বিস্ময়কর প্রতিভা ও বিদ্যাবত্তার পরিমাপ করবার বিগলিত করুণা-মন্দাকিনীর উৎস নির্দেশ করতে পারি এমন সেবা-সুকৃতিও জীবনে সঞ্চয় করা হয়নি। আমাদের সম্বল শুধু প্রণিপাত।
এই প্রণিপাত প্রত্যক্ষ করেছি বিদ্যাসাগরের করুণাসিন্ধুর তটস্থ মহাকবি শ্রীমধুসূদনে। কবির স্বানুভবের স্বচ্ছ দর্পণে প্রতিবিম্বিত হয়েছে এই বিরাট মনুষ্যমহিমা—
বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে,
করুণার সিন্ধু তুমি, সেই জানে মনে
দীন যে, দীনের বন্ধু।
বিদ্যাসাগরের নিকটতম ব্যক্তিসান্নিধ্যে অবস্থান করে এই মহৎ উদার বিশাল কবিপ্রাণ স্বতঃস্ফুর্ত সুগভীর কৃতজ্ঞতার আবেশে জীবন-নাট্যের এক দুর্যোগসন্ধিতে সদ্যঃপরীক্ষালব্ধ নতুন ছন্দে এই কথাগুলি গেঁথেছিলেন। প্রাণসম্পদে রাজাধিরাজ এই মহাকবি নিজের দীনতার অকুণ্ঠ বৈষ্ণবজনোচিত স্বীকৃতি দিয়ে দেবমানবের মনুষ্যমহিমা এবং নামমহিমার কাব্যময় মহিম্নঃ স্তোত্র রচনা করেছিলেন।
‘বিদ্যার সাগর তুমি’, একথা গভীরভাবে সত্য। কিন্তু ‘এহো বাহ্য’। অদ্বিতীয় বহুভাষাবেত্তা বিশ্বসাহিত্য-রসিক বিদ্বৎকুলাগ্রগণ্য কবি যেন এই পরিচয়ে অতৃপ্ত হয়ে বলছেন, ‘এহো হয়’ অথবা ‘এহোত্তম’ ‘আগে কহ আর’। বিশ্বম্ভর শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যের বিশ্ববিমোহন বাচনভঙ্গিতে যেন অতর্কিতে ‘আগের কথা’টি পরম পরিতৃপ্তিভরে নিজেই বলেছিলেন, ‘করুণার সিন্ধু তুমি’। ‘বিদ্যার সাগর তুমি’, ‘করুণার সিন্ধু তুমি’, কোনটি গভীরতর সত্য? যে ‘যৈছে ভজে’। ‘রুচীনাং বৈচিত্র্যাৎ’।
ফরাসী-প্রবাসের ঘোর দুর্দিনে একদিন কবি অধ্যয়ন-সমাধিতে মগ্ন। বিপন্না জীবনসঙ্গিনী করুণ ভর্ৎসনার ভঙ্গিতে জানালেন, ঘরে একটি কপর্দক নেই। ছেলেমেয়েরা কান্নাকাটি করছে মেলায় যাবে বলে। প্রশান্ত দৃষ্টি দূরে প্রসারিত করে আনমনা কবি বললেন, ‘অধীর হ’য়ো না হেনরিয়েটা। এবার আমি দেশের এমন একটি মানুষের কাছে আমার অবস্থাসংকটের কথা জানিয়েছি যিনি প্রজ্ঞায় ভারতের ঋষি, সাহসে কর্মতৎপরতায় ইংরেজ এবং প্রাণের ঐশ্বর্ষে বাঙালী মায়ের মতো।’ একদিকে বিদ্যাসাগরের সহস্রপৃষ্ঠাব্যাপী জীবনচরিত, আর একদিকে এই কবি-নিরুক্তি। কোনটির ওজন বেশী?
‘বিদ্যাসাগর’ সংস্কৃত কলেজের দেওয়া উপাধি, তাঁর নাম নয়। উপাধির এমন পরিপূর্ণ সার্থকতার দৃষ্টান্ত ক’টি মেলে? বাংলাদেশের ইতিহাসে, মানবতার ইতিহাসে, বিদ্যাসাগর বলতে একটি মানুষকেই বুঝায়। অনেক সরল লোকের ধারণা ছিল, বিদ্যাসাগর বুঝি তাঁর নামই। সংস্কৃত কাব্য ব্যাকরণ অলঙ্কার স্মৃতি জ্যোতিষ ন্যায় এবং দর্শনের আরও নানা শাখায় বিদ্যাসাগর যে বুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন তার তুলনার স্থল হয়তো এদেশে সেকালের ও একালের কোনো-কোনো পণ্ডিত রয়েছেন। কিন্তু প্রতিভার এমন বহুমুখিতা, বিদ্যার এমন সার্থকতা ও সর্বতোমুখিতা কোনও কালের কোনও এক ব্যক্তিতে এমনভাবে প্রত্যক্ষ করা যায় কি? জীবনচর্যায় পাণ্ডিত্যের এমন রমণীয় পরিণাম প্রত্যক্ষগোচর হয় কি? ‘যস্য সর্বে সমারম্ভাঃ কামসঙ্কল্প-বর্জিতাং’, গীতা-প্রোক্ত এমন ‘পণ্ডিতাঃ সমদর্শিনঃ সত্যই ‘লাখে না মিলল এক’। সত্যিই অনুভূতির এই অপরিমেয় ঐশ্বর্য অমর্ত্য। বিদ্যাসাগরের এক শ্রদ্ধালু বন্ধু একদিন অতি দুঃখে তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি অমুকের এমন কি ক্ষতি করেছেন যে, সে হিংস্র হয়ে অযথা আপনার অপযশ প্রচার করে বেড়াচ্ছে?’ ‘তুল্যনিন্দাস্তুতি’ ‘মহাপুরুষ একটু হেসে উত্তর দিলেন, ‘কৈ, মনে তো পড়ে না কোনোদিন তাঁর কোনও উপকার করেছি বলে।’
স্থিতপ্রজ্ঞের চিত্তপ্রসাদ হতে বিচ্ছুরিত এই উজ্জল রসিকতার ব্যাখ্যা করবার প্রয়োজন নেই। অথচ বিদ্যাসাগরের ধর্মচেতনা ছিল কিনা, তা নিয়ে আমরা ক্রমাগত নানা গবেষণা চালিয়েও কোনো স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারিনি। ধর্মচেতনা যেন জীবন-বহির্ভূতি পোশাকী ব্যাপার!
দাতব্যমিতি যদ্ দানং দীয়তেহনুপকারিণে।
দেশে কালে চ পাত্রে চ তদ্দানং সাত্ত্বিকং স্মৃতম্॥
অথবা
অনুদ্বেগকরং বাক্যং সতং প্রিয়হিতঞ্চ যৎ।
স্বাধ্যায়াত্যসনং চৈব বাঙ্ময়ং তপ উচ্যতে॥
দেশে কালে চ পাত্রে চ তদ্দানং সাত্ত্বিকং স্মৃতম্॥
অথবা
অনুদ্বেগকরং বাক্যং সতং প্রিয়হিতঞ্চ যৎ।
স্বাধ্যায়াত্যসনং চৈব বাঙ্ময়ং তপ উচ্যতে॥
সপ্তশতী-পাঠের সময় এমন শ্লোকের সম্মুখীন হলে জীবন্ত শ্লোকময় যে মনুষ্যমূর্তি মনের চোখে ভেসে ওঠে সেটি বিদ্যাসাগরের।
টোলে প্রাচীন পন্থায় গুরুগত বিদ্যা অর্জন করে তিনি ব্যবহারিক প্রয়োজনে ইংরেজি ভাষা এমনভাবে আয়ত্ত করেছিলেন যে, যে-সমস্ত ভারতীয় প্রায় ইংরেজের মতো করে ইংরেজি লিখতে পারেন তাঁদের তালিকা প্রণয়ন করতে গেলে বিদ্যাসাগরের নাম এসে যাবে। ইংরেজিতে লিখিত তাঁর চিঠিপত্র এবং নানা বিষয়ে লিখিত নানা বিবরণী তাঁর লেখনী-সঞ্চালনের সচ্যসাচিতা প্রমাণিত করে। সেকালের উচ্চপদস্থ ছোটলাট হ্যালিডে-প্রমুখ ইংরেজের সঙ্গে তিনি সহজভাবে মিশতেন। একযোগে নানা কাজ করতেন, স্বাজাত্যবোধ ও আত্মমর্যাদা ক্ষুণ্ন হলে সংযোগ ছিন্ন করতেন, পদত্যাগ করতেন, সে সম্পর্কে সহস্র অবিস্মরণীয় নাটকোপযোগী ঘটনার স্মৃতি দেশের মানুষ ভুলতে পারেনি। আসল কথা এই, শুধু ইংরেজি ভাষা নয়, ইংরেজিতে যাকে বলা হয় The spirit of English, পশ্চিমের নবাগত মনুষ্যত্বের অন্তর্নিহিত যে মনোবল নতুন জীবন গড়তে আমরা কিছুটা কাজে লাগিয়েছি, আবার অনেকটা আয়ত্ত করতে পারিনি, বিদ্যাসাগরের মতো অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতার সঙ্গে শক্তিশালী চুম্বকের মতো তা অর্জন করতে এলাকা পর্যন্ত ক’জন ভারতীয় পেয়েছেন? বেশ কিছুদিন আগে ‘শনিবারের চিঠি’তে একটা ছবি দেখেছিলাম, হ্যাটকোট-পরা বিদ্যাসাগর, পাশে নামাবলীর অঙ্গাবরণে শ্রীমধুসূদন। আমাদের নিত্য-তর্পণীয় জাতীয় পিতৃযুগলের ভাব-কলেবর এক দিক দিয়ে এই শিল্পীর ধ্যানে ধরা দিয়েছিল।
একদিন ছিল যখন এদেশের মানুষ পল-বিপল গণনা করে গাত্রলোমের দৃশ্যাদৃশ্যতা বিচার করে যথাসময়ে আহ্নিক-কৃত্যাদি নিষ্পন্ন করতেন। কিন্তু ইদানীং আমরা ‘কালোহস্মি লোকক্ষয়কৃৎ’ ভুলে গিয়ে ‘কালো হ্যয়ং নিরবধিঃ’ কবি-বচনের আনুগত্যে কর্মসূচী পালন করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। বিদ্যাসাগরের সংস্কৃত কলেজে পঠদ্দশায় যাঁরা তাঁর সাক্ষাৎ শিক্ষাগুরু ছিলেন এমন কেউ-কেউ তাঁর সংস্কৃত কলেজে অধ্যক্ষ স্থলাভিষিক্ত হওয়ার পরে সময়মতো উপস্থিত হয়ে দৈনন্দিন অধ্যাপনার কাজ গ্রহণ করতে শৈথিল্য প্রদর্শন করতেন, আহারান্তে বিশ্রাম ও তন্দ্রাকর্ষণের পর খুশিমতো কলেজে আসতেন। তাঁদের অধ্যক্ষ-শিষ্যটি কিছুদিন দেখে, ঘড়িহাতে সবিনয়ে দ্বারদেশে দাঁড়িয়ে থেকে সমস্ত অধ্যাপক-প্রবীণদের অভিবাদন করে তাঁদের প্রতীক্ষারত ছাত্রদের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে লাগলেন। বলা বাহুল্য, এর ফলে শৈথিল্যের প্রতিকার হয়েছিল। সময়ের এই মূল্যবোধ দেড়শো বছর পরে আমাদের তো আরও বাড়বার কথা! এক নতুন জামাইবাবু অনায়াসে-বহনযোগ্য একটি ব্যাগ হাতে নিয়ে রেলগাড়ি থেকে নেমেছেন শ্বশুরবাড়ির দেশের স্টেশনে। ছোট স্টেশন, কুলি নেই। গ্রামবাসী আরোহীরা সকলেই স্বাবলম্বী। বাবুটি কুলি কুলি করে হয়রান হয়ে হতভাগা স্টেশন ও দেশকে গালি পাড়ছেন। এমন সময় প্রৌঢ় উৎকলবাসীর মতো দেখতে এক কুলি মিলে গেল। কুলি বাবুজির ব্যাগটি নির্বাকভাবে বহন করে গন্তব্য শ্বশুরালয়ের দ্বারদেশে উপনীত হলে শ্বশুরমশাই এসে কপালে আঘাত করলেন, কী সর্বনাশ! স্বয়ং বিদ্যাসাগরমশাই জামাইয়ের তল্পি বহন করে এনেছেন! এর দেড়শো বছর পরে আজও দেখা যায়, সত্তর বছরের বেকার বৃদ্ধ পিতা রেশন ব্যাগ হাতে ‘দুর্ভিক্ষের দ্বারে বসে ভাগ করে খেতে হবে সকলের সাথে অন্নপান’ কবিগুরুর এই অভিসম্পাত স্মরণ করে শ্রেণীবদ্ধ প্রতীক্ষায় রত আছেন, আর সংগৃহীত অন্নপানে যাঁরা শক্তিমান হবেন তাঁরা কিন্তু এই জঘণ্যতা পরিহার করে শ্রমের মর্যাদা-সংরক্ষণ ও অন্যত্র অন্যভাবে সময়ের সদ্ব্যবহার করেন! বিদ্যাসাগর আমাদের কালে জন্মগ্রহণ করেননি, আমাদের জীবনদর্শন, আমাদের আচরণ, আমাদের মত ও পথ গ্রহণ করেননি, এই অপরাধের শাস্তি তিনি অসীম প্রসাদে অধস্তন চতুর্থ বা পঞ্চম পুরুষের হাত থেকে গ্রহণ করছেন।
বিদ্যাসাগরের ইংরেজি শিক্ষার কথা বলতে গিয়ে কতকটা দূরে এসে পড়েছি। ইংরেজি শিক্ষার দ্রুত প্রসারে তাঁর আগ্রহ ও অবদানের কথা নতুন করে বলবার প্রয়োজন নেই। যুগের ইংরেজি শিক্ষিতদের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের প্রায় সকলের সঙ্গেই বিদ্যাসাগরের সখ্য ও কর্মসংযোগ ছিল। জানা যায়, তাঁরই অনুরোধে-প্রবর্তনায় প্যারীচরণ সরকার ও লেটাব্রিজ সাহেব প্রাথমিক ইংরেজি শিক্ষার উপযোগী অতুলনীয় পাঠ্যপুস্তক First Book of Reading এবং ক্রমান্বয়ে Third Book of Reading প্রণয়ন করেছিলেন। আবার তিনি নিজেই লেখনী ধারণ করে সংগ্রাম-সংকুল কর্মজীবন এবং অনলস সেবাব্রতের ফাঁকে ফাঁকে সংস্কৃত শিক্ষাকে সহজে আয়ত্ত করবার উপযোগী করে উপক্রমণিকা ব্যাকরণ-কৌমুদী, ঋজুপাঠ প্রভৃতি সংস্কৃত পাঠ্যগ্রন্থ এবং বিশ্বসাহিত্যের পর্যায়ভুক্ত শকুন্তলার মতো কাব্যগ্রন্থের প্রামাণ্য সংস্করণ প্রকাশ করেছিলেন।
বিদ্যাসাগরের প্রসাদেই আজও শিক্ষিত বাঙালী সংস্কৃত ভুলে যায়নি, আশ্রয়বৃক্ষের মূলোৎপাটন করেনি, যদিও শিক্ষার আধুনিকীকরণ ত্বরান্বিত করবার জন্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যনির্ধারণে প্রগতিশীল শিক্ষাবেত্তারা সংস্কৃতের প্রায় Quit India-র ব্যবস্থা পূর্ণাঙ্গ করে এনেছেন। অথচ পালি-প্রাকৃত ভাষাতত্ত্ব ভারততত্ত্ব প্রাচীন ভারত-ইতিহাস প্রভৃতি অনুশীলনের অজস্র ব্যয়সাধ্য পল্পবগ্রাহিতার পরিপোষক স্নাতকোত্তর অধ্যয়ন-অধ্যাপনার সমারোহ দিন-দিন বেড়ে চলেছে। বিদ্যাসাগরের উত্তরসাধকরূপে সাহিত্য ও শিক্ষা-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আমরা পেয়েছিলাম মধুসূদন ভূদেব বঙ্কিমচন্দ্র রবীন্দ্রনাথ বিবেকানন্দ হরপ্রসাদ এবং তাঁদের যুগসহচরদেরকে।। জীবনের সে গতিবেগ প্রগতি-ধারায় উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে তো?
সে-যুগে বাঙালীর বাংলাভাষা শিক্ষায় ও প্রয়োগে কি অবহেলা ছিল এবং এ-ক্ষেত্রে কিরূপ অরাজকতা বিরাজ করত ‘শিশুবোধক’ নামক একখানি পাঠ্যপুস্তকে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। সকলেই জানতেন বিদ্যাসাগর বর্ণপরিচয় প্রথমভাগ, দ্বিতীয়ভাগ, কথামালা,আখ্যানমঞ্জরী, বাসুদেব-চরিত, সীতার বনবাস, শকুন্তলা প্রভৃতি রচনা করে অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতার সঙ্গে সেই অরাজকতা দূর করে সেখানে শৃঙ্খলা স্থাপন করেন। এ সমস্ত রচনার বেশির ভাগই পাঠ্যপুস্তক সন্দেহে নেই। কিন্তু আমাদের মনে হয় বর্ণপরিচয় প্রথমভাগ থেকেই বিদ্যাসাগরের সাহিত্যসৃষ্টি শুরু হয়েছে। জীবনস্মৃতিতে ব্যক্ত রবীন্দ্রনাথের শৈশবের অনুভূতি তার প্রমাণ। বর্ণপরিচয় প্রথমভাগের ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ বিশ্বকবির শৈশবের মেঘদূত, আমাদেরও বৈষ্ণব পদাবলীর ‘রিমিঝিমি’। শব্দসঙ্গীতের এই নব-পরিচয়ের দিন নাকি শিশু-কবির মনে সারাদিন ধরে জল পড়েছিল, পাতা নড়েছিল। বর্ণবিন্যাস ও বর্ণসমাবেশের কী অদ্ভুত মনোবিকাশের সহায়ক বিজ্ঞানসম্মত কবিত্বপূর্ণ স্তরপরম্পরা! অজ আম ইট ঈশ, কাক গান ঘাস, তিল দিন হিম থেকে আরম্ভ করে অনুশোচনা পরিবেদনা অভিনিবেশ।
বড় গাছ, ভাল জল, লাল ফুল। উমেশ ছুরিতে হাত কাটিয়াছে। কৈলাসের পড়িবার বই নাই। তারপর রীতিমত কথাসাহিত্য, গোপাল অতি সুবোধ বালক। যা পায় তাই খায়, যা পায় তাই পরে। মনে পড়ে যায় সর্বত্যাগী নিস্কিঞ্চন বিদগ্ধ ভক্তপরিকরকে শিক্ষা দিতে গিয়ে মহাপ্রভুর শ্রীমুখনিঃসৃত ‘ভাল না খাইবে আর ভাল না পরিবে।’ ‘জিহ্বার লালসে জীব ইতি-উতি ধায়।’
সাহিত্যের ঐতিহাসিকেরা এই সমাজ-সংস্কারক শিক্ষাবিদ পাঠ্যপুস্তক-রচয়িতার গোপনচারী শিল্পিসত্তা ও কবিপ্রাণের পূর্ণস্বীকৃতি দিতে এখনও ইতস্ততঃ করেন। বাংলা গদ্যশৈলীর জনকত্বের শিরোপা কাকে দেওয়া যায় এ নিয়ে সাহিত্যিক গবেষকেরা এখনও মনঃস্থির করতে পারেননি। এই প্রসঙ্গে নব্যভারতের জনক রাজা রামমোহন, উইলিয়ম কেরি, মৃত্যুঞ্জয়, রামরাম, অক্ষয়কুমার-প্রমুখ অতন্দ্র সাহিত্যকর্মীর নাম এসে যায়। বাংলা গদ্যসাহিত্যে এঁদের প্রত্যেকেরই দান অমূল্য, অবিস্মরণীর সন্দেহ নেই। কিন্তু বাংলা গদ্যশৈলীর সহজ সুুশ্রব প্রথম সঙ্গীত কখন ধ্বনিত হয়েছিল তার বিস্তৃত বৈজ্ঞানিক আলোচনায় প্রবৃত্ত না হয়েও শুধু কান পাতলেই বোধ হয় সিদ্ধান্ত অনেক সহজ হয়ে উঠবে। নানা শাস্ত্র ও নানা ধর্মতত্ত্বের অনুশীলনে পাঠমার্জিতরুচি মনীষী রামমোহন স্মার্ত, মৌলবী পাদরী ও গোস্বামীর সঙ্গে বিচারে উপনিষদের ভাবানুবাদে ‘ব্রহ্মনিষ্ঠ গৃহস্থের লক্ষণ’-জাতীয় মৌলিক গ্রন্থ রচনায় বাংলা গদ্যের বহুল প্রচলন করতে গিয়ে সূক্ষ্ম বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি দিয়ে আবিষ্কার করলেন, বাংলা গদ্যের তখনও হাঁটি-হাঁটি পা-পা। তাই ‘গৌড়ীয় ভাষার ব্যাকরণ’-এ বিধান দিলেন, ‘যাবৎ বাক্যের ক্রিয়াপদ না পাইবেক তাবৎ বাক্যের পাঠ্যসমাপ্তি’ ঘটতে পারে না। রাজীবলোচন তাঁর ‘মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়স্য চরিত্রম্’-এ কালনির্দেশক ক্রিয়াপদ সম্বন্ধে একেবারেই উদাসীন বাক্যবিন্যাস করতেন, যেমন ‘তথাপি বিষণ্ন স্রীজদ্দৌলার বদন’। পণ্ডিত মৃত্যুঞ্জয় ‘অজ্ঞান-তিমিরান্ধজনের’ হিতার্থে ‘প্রবোধচন্দ্রিকা’য় ‘পদদ্বন্দ্ববিগলিত-মকরন্দে’র স্বাদপরিবেশনে ব্যাপৃত ছিলেন। এদিকে ‘কথোপকথন’-এ উইলিয়ম কেরি পিঠার আঠা ছাড়াবার ঠেলায় নাজেহাল হয়ে পড়েছিলেন।
এমন সময়ে আকাশে ‘জলধরপটল-সংযোগ’ দেখা দিল। ‘এই সেই জনস্থান মধ্যবর্তী প্রস্রবণগিরি যাহার শিখরদেশ সতত-সঞ্চরমাণ জলধরপটল-সংযোগে নিরন্তর নিবিড় নীলিমায় আচ্ছন্ন।’ ‘বাল্মীকি ব্যাস, ভবভূতি কালিদাস’ ভারতের কবিপিতৃপুরুষেরা বাঙালী অন্তর্লোকে দেখা দিলেন। এই অপূর্ব গদ্যশৈলীর বিশ্লেষণের প্রয়োজন ও অবকাশ নেই। তৎসম শব্দের প্রতি প্রীতি-পক্ষপাত এবং গুরুগম্ভীর শব্দসমাবেশ সত্ত্বেও খাঁটি বাংলা বাক্যরীতির সঙ্গে আমাদের এই ‘নব পরিচয়’, এই পূর্বরাগ। ‘রাম রাজপদে প্রতিষ্ঠিত হইয়া অপ্রতিহত-প্রভাবে রাজ্যশাসন এবং অপত্যনির্বিশেষে প্রজাপালন করিতে লাগিলেন।’ বাক্যবিন্যাসের প্রাক্কালীন আমাদের মানসচিত্রের অবিকল প্রতিবিম্ব বিদ্যাসাগরের এই বাক্যরীতিতে প্রথম ধরা দিয়েছে বলে আমরা মনে করি। বঙ্কিম রবীন্দ্রনাথ শরৎচন্দ্রে এই রীতিরই প্রসৃতি ও বিবর্তন লক্ষিত হয়।
উনবিংশ শতাব্দীর মানবতামুখী জীবনজিজ্ঞাসা নিয়ে এই টুলো শিক্ষাবিদ নানা দেশের মনুষ্যত্বের কাহিনীর সৌষ্ঠবময় সমাবেশ করলেন আখ্যানমঞ্জরীতে। আরবের অদ্ভুত আতিথেয়তাও তার থেকে বাদ পড়েনি। পাশ্চাত্ত্য জাতির স্বাজাত্যবোধ স্বাধীনতাপ্রিয়তা স্বাবলম্বন, শ্রমের মর্যাদা, নিয়মনিষ্ঠা কর্তব্যপরায়ণতা, তখনকার জাতীয় জীবনে অপরিদৃষ্ট এই সমস্ত গুণাবলী শুধু গল্পের পথ ধরে আমাদের হৃদয়ের দুয়ারে আঘাত হানেনি, মানবতার ইতিহাসে নিত্য-লোভনীয় এই সমস্ত সদ্গুণ এই মহামানবের সর্বজনবন্দিত বরেণ্য ব্যক্তিত্বে রূপ পরিগ্রহ করেছিল। এখানেও মনে পড়ে যায়, পাঁচশো বছর আগেকার সেই ‘আপনি আচরি ধর্ম জীবেরে শিখামু’। এঁরা একাধারে শিক্ষক ও আচার্য; শুধু কথা দিয়ে নয়, আচরণ দিয়ে শিখিয়েছিলেন।
বিশ্বমানবতার প্রথম পূজারীদের অন্যতম হয়েও তিনি আত্মস্থ হয়ে সাহিত্যসৃষ্টির উদ্দেশ্যে যখন লেখনী ধারণ করলেন তখন গদ্যে কথাসাহিত্যের রূপকল্প আশ্রয় করে শোনালেন সীতা ও শকুন্তলার কাহিনী। এই বিষয়টি একটু তলিয়ে দেখতে গিয়ে আমাদের যা মনে হয়েছে অকিঞ্চিংকর হলেও সেটি বলবার লোভ সংবরণ করতে পারছিনে। বিদ্যাসাগরের প্রায় এক শতাব্দী পূর্ব হতেই দেশের দুর্যোগময় যুগসন্ধিতে বাঙালীর অন্তর্লোকে দেখা দিয়েছিল মাতৃমন্ত্রে ক্রমপ্রসার্যমাণ শক্তির স্ফুরণ। মাতৃমহাভাবের পাঠক কবি রামপ্রসাদের মাতৃসঙ্গীত ভাগীরথীতীরের আকাশ-বাতাসে তরঙ্গ তুলেছিল। তাঁর নাতিপ্রবুদ্ধ স্বজাতিও অসহায় মাতৃনির্ভর শিশুর মতো মনে মনে সেই গান গাইতে শুরু করেছিলেন। ‘গাহিবে একজন খুলিয়া গলা আরেকজন গাবে মনে।’ তাই গান-ভঙ্গ হয়নি। এর অবব্যহিত পরেই পুণ্যশ্লোকা রাসমণির দক্ষিণেশ্বরের দেউলে পূজারী শ্রীরামকৃষ্ণের আকুল মা-মা ক্রন্দন শোনা গেল। ‘দেবো ভূত্বা দেবং যজেৎ’ দিব্যজীবনে লব্ধাস্বাদ এই স্পর্শমণির ছোঁয়াচ যাঁদের লেগেছিল তাঁদের মধ্যে সেযুগের দিক্পালগণের প্রায় সকলেই ছিলেন। তাঁদের জীবনসাধনার কথা ভাবতে গেলে এই কথাটি স্পষ্ট হয়ে উঠবে যে, একটি মাতৃমহাভাবের সর্বাত্মক সম্প্রসারণ এই যুগ-জাগৃতির মূলে কাজ করেছিল যার ফলশ্রুতি আসমুদ্রহিমাচল ভারতের জাগর-মন্ত্র ঋষি বঙ্কিমের হৃদয়গুহাস্থিত ‘বন্দে মাতরম্— মাটির মা-টিতে পরিণতি। এই মন্ত্রের জীবনময় যুগলমূর্তি, একদিকে গৃহী বঙ্কিম, অন্যদিকে সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ। তার পূর্বেই মধুসূদন বিশ্বসাহিত্যের পরিক্রমা সমাপ্ত করে ‘মাতৃকোষে রতনের রাজি’ আবিষ্কার করেছিলেন। বিদেশযাত্রাকালে বাংলাদেশের শ্যামলিম মধুর তটশোভা ধীরে ধীরে দিগন্তে বিলীন হতে দেখে বুকফাটা ডাক দিয়েছিলেন ‘শ্যামা জন্মদে’ বলে। এই ডাকের মধ্যেই আমরা ‘সুজলাং সুফলাং মলয়জশীতলাং শস্যশ্যামলাং মাতরম্’ মহামন্ত্রের অশ্রুত অস্ফুট ঝঙ্কার শুনেছিলাম।
বিদ্যাসাগরের স্তন্যপীযুষদায়িনী গর্ভধারিণী ভগবতী দেবী। আমরা বহু শতাব্দী ধরে চণ্ডীমণ্ডপে আবৃত্তি করেছি, ‘স্ত্রিয়ঃ সমস্তাঃ সকলা জগৎসু’। বিদ্যাসাগরের জীবনে ভগবতী সাক্ষাৎকার হয়েছিল। বিদ্যাসাগরের সমস্ত শক্তির উৎস এই আদিভূতা সনাতনী। কোটি কোটি ভক্ত যুগ যুগ ধরে ‘নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ’ আবৃত্তি করেছেন। ব্রহ্মপন্থী বিশ্বকবিও গীতাঞ্জলিতে সপ্তশতীর সুরঝঙ্কার তুলে নমস্কার করেছেন—
তোমারে নমি হে সকল ভূবনমাঝে
তোমারে নমি হে সকল জীবনকাজে।
তোমারে নমি হে সকল জীবনকাজে।
ভগবতীর স্থিতপ্রজ্ঞ প্রৌঢ় সন্তান ‘মা মা’ বলে বর্ষায় উদ্দাম দামোদরের উত্তাল তরঙ্গমালায় ঝাঁপ দিয়েছিলেন। অনুরূপ প্রেরণায় বিদ্যাসাগর দেশের যে সমস্ত কচি-মায়েরা মাতৃস্নেহবুভুক্ষা ও মাতৃস্তন্যপিপাসা মিটবার আগেই অবগুণ্ঠিতা হয়ে চোখের জলে সপত্মী-ননদীর ঘর করতে গিয়ে অকালবৈধব্য বরণ করতেন তাঁদের অসহায় অবস্থার প্রতিকার করবার দুর্জয় সঙ্কল্প গ্রহণ করেছিলেন। বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ-নিবারণ, বিধবা-বিবাহ-প্রচলন, স্ত্রীশিক্ষার প্রসার, একসঙ্গে এতগুলি সংস্কারকার্যে হাত দিয়ে পর্বতপ্রমাণ বাধার সম্মুখীন হয়েছিলেন। শাস্ত্রশাণিত রক্ষণশীল সমাজকে ‘কলৌ পরাশরঃ স্মৃতঃ’ অনুসারে পরাশরস্মৃতি উদ্ধার করে শোনালেন—
নষ্টে মৃতে প্রব্রজিতে ক্লীবে চ পতিতে পতৌ।
পঞ্চস্বাপৎসু নারীণাং পতিরন্যো বিধীয়তে॥
পঞ্চস্বাপৎসু নারীণাং পতিরন্যো বিধীয়তে॥
নিজে কিন্তু সমস্ত প্রমাণ হতে গরীয়সী ভগবতী দেবীর অনুজ্ঞা গ্রহণ করে তরঙ্গসঙ্কুল কর্মসমুদ্রে ঝাঁপ দিলেন। আমাদের দেশে মাতৃপুজার মতো মাতৃকা-পূজাও (worship of potential mothers, mothers in the making) প্রচলিত আছে। বিদ্যাসাগরও মাতৃকা-পূজার আয়োজনে স্ত্রীশিক্ষার প্রসারে মহাপ্রাণ বিদেশী ড্রিঙ্কওয়াটার বীট্ন-এর পাশে এসে দাঁড়ালেন, মনুস্মৃতি থেকে সমর্থন যুগিয়ে দিলেন, ‘কন্যাপ্যেব পালনীয়া শিক্ষণীয়াতিরত্মতঃ’। বিদ্যাসাগরের জীবনযজ্ঞের ভাব-প্রেরণার প্রবলতম উৎস একটি বলেই আমার মনে হয়। পূর্বাপর এক শতাব্দীকাল ধরে এই একই ভাব-প্রেরণা নানা রূপে বাঙালীর ধর্মচেতনা, কর্মচেতনা, সমাজচেতনা, রাষ্ট্রচেতনা ও সংস্কৃতিচেতনাকে আশ্রয় করে কাজ করেছে। এই শক্তি রামপ্রসাদে ‘ব্রহ্মময়ী, রামকৃষ্ণে ‘ভবতারিণী’ বিদ্যাসাগরে ‘ভগবতী দেবী, সীতা, শকুন্তলা, বালিকা বধূ, বালবিধবা, সপত্মী-নির্যাতিতা স্বামী-পরিত্যক্তা, এক কথায়— স্ত্রিয়ঃ সমস্তাঃ সকলা জগৎসু’। এই শক্তি মধুসূদনে ‘শ্যামা জন্মদে’ ‘জননী জাহ্নবী’, বহুবার বহুভাবে বহু কাব্যে স্বপ্নে আবির্ভূতা ‘কুললক্ষ্মী’। ‘নারিনু মা তোমারে চিনিতে।’ এই একই শক্তি রবীন্দ্রনাথের ‘ভুবনমনোমোহিনী জনকজননী’। এই শক্তির আবেশে বিশ্বনাথ ও ভুবনেশ্বরীর সন্তান নরেন্দ্র-বিবেকানন্দের স্বদেশমন্ত্রের আবাহন ‘ভূলিও না তোমার নারীজাতির আদর্শ সীতা সাবিত্রী দময়ন্তী.....তুমি জন্ম হইতেই মায়ের জন্য বলিপ্রদত্ত।’ এই শক্তি কেশবচন্দ্র, গিরিশচন্দ্র, দ্বিজেন্দ্রলাল, আশুতোষ, অশ্বিনীকুমার, সত্যেন্দ্রনাথ, নজরুল, অতুলপ্রসাদ, চিত্তরঞ্জন, সুভাষে—অজয় দামোদর কপোতাক্ষ ভৈরব ভাগীরথী মহানন্দা আড়িয়ালখাঁ ইছামতী পদ্মা-মেঘনা-শীতলাখ্যায় তিস্তা ব্রহ্মপুত্রে কর্ণফুলীর কূলে কূলে অগণিত অজ্ঞাতনামা ও খ্যাতনামা বীর সন্তানে।
দক্ষিণেশ্বরের পূজারীঠাকুরের একবার খেয়াল হ’ল সমুদ্রস্নানের, অমনি অযাচিতভাবে বাদুড়বাগানের বাড়িতে এসে হাজির সাগর-সঙ্গমে। প্রথম সম্ভাষণও অদ্ভুত রকমের। ‘এতদিন ছিলাম খালে-বিলে নদী-নালায়, এবার এসে পড়েছি একেবারে সাগরে’। উত্তরও ঠিক তেমনই, ‘তা বেশ, খানিকটা! নোনা পানি নিয়ে যান।’ ‘সেয়ানায় সেয়ানায় কোলাকুলি।’ একদিকে গুণগ্রাহী আশীর্বাদোদ্যত সদানন্দ ঠাকুর, অন্যদিকে শ্রদ্ধালু দৈন্যবিনয়মণ্ডিত সমুদ্র-গম্ভীর মহাপুরুষ।
যদ্ যদ্ বিভূতিসৎ সত্ত্বং শ্রীমদ্ উর্জিতম্ এব বা।
তৎতদ্ এবাবগচ্ছ ত্বং মম তেজৌহংশসম্ভবম্॥
তৎতদ্ এবাবগচ্ছ ত্বং মম তেজৌহংশসম্ভবম্॥
এই সাক্ষাৎকার মনে করিয়ে দেয় দীর্ঘ পাঁচ শত বৎসর পূর্বের আর-একটি সাক্ষাৎকার। এই ভাগীরথীতীরে, সেটি হয়েছিল দক্ষিণাত্যে গোদাবরীতীরে। ‘কাঞ্চনপঞ্চালিকা’ তুল্যভাবকান্তিময় এক সন্ন্যাসী এবং গৃহীভক্ত বিদগ্ধ এক রাজপুরুষের মধ্যে।
আর এক রকমের মিলন বিদ্যাসাগরের জীবনে প্রতিনিয়ত ঘটেছে। রাজপথে বিসূচিকাগ্রস্ত বমনশ্রান্ত অস্পৃশ্য অশুচি ‘হরিজন’। পাশে অকস্মাদাগত বিদ্যাসাগর, তৎক্ষণাৎ প্রসারিত বাহুবন্ধনে আবদ্ধ রুগ্ণ ব্যক্তি শুশ্রূষা ও চিকিৎসার উদ্দেশে গৃহে আনীত; যুগোপযোগী ভাষায় উপনিবদ্ধ মহাপ্রভুর একটি উক্তি মনে পড়ে, ‘ভারতভূমিতে হৈল মনুষ্যজন্ম সার। জন্ম সার্থক করি কর পর উপকার॥’ একে কি বলব? দেশাত্মবোধ, না ধর্ম? বিদ্যাসারের ধর্মচেতনা সম্বন্ধে বহু গবেষণার পরেও আমরা সংশয়বুদ্ধি পরিহার করতে পারিনি। ধর্মবস্তুটিকে আমরা কি ঠাউরেছি, কেউ বলতে পারেন কি? দূরবীক্ষণ ও অণুবীক্ষণের ন্যায় শক্তিশালী বৃহৎ মনোযন্ত্রে বিদ্যাসাগরের মনুষ্যমহিমার পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে। রমেন্দ্রসুন্দর-রবীন্দ্রনাথের হীরকের মতো ভাস্বর উক্তির সঙ্গে সকলেরই পরিচয় আছে। আমাদের পক্ষে অন্ধের হস্তিদর্শনের এই প্রয়াস হয়তো ক্ষমারও অযোগ্য।
নির্গুণ শব্দের অর্থ ভক্তিশাস্ত্রে গুণহীন নয়, গুণাতীত। ‘সত্যং পরং ধীমহি’ ব্রহ্মগায়ত্রীতে যে তত্ত্বের আরম্ভ বসুদেব-দেবকী, ব্রহ্মা নারদ দুর্বাসা ধ্রুব প্রহ্লাদ পৃথু উত্তানপাদ হিরণ্যকশিপু বেণ, বৃত্র দক্ষ কপিল মৈত্রের উদ্ধব অক্রুর দেবহুতি যশোদা ব্রজগোপী অশেষ-বিশেষে স্তবস্তুতির আশ্রয় নিয়েও যার শেষ করতে পারেননি তারই বিদ্যুদাভাস খেলে যায় এমন একটি মহাজীবনের প্রসঙ্গে।
সতাং প্রসঙ্গান্ মম বীর্যসংবিদো ভবন্তি হৃৎকর্ণরসায়নাঃ কথাঃ।
তজ্জোষণাদ্ আশ্বপবর্গবর্ত্ম নি শ্রদ্ধারতিভক্তিরনুক্রমিষ্যতি॥
তজ্জোষণাদ্ আশ্বপবর্গবর্ত্ম নি শ্রদ্ধারতিভক্তিরনুক্রমিষ্যতি॥
শুধু ভাগবতীয় দৃষ্টিভঙ্গিতেই নয়, কবিদৃষ্টিতেও এমন জীবনকে ‘অলোকসামান্যম্’ ‘অচিন্ত্যহেতুকম্’ বলা হয়েছে। এমন জীবন যে শুধু ‘কোটিকে গোটি মিলে’ তা নয়, জন্ম শিক্ষা ও যুগপরিবেশ দিয়ে এর সবটুকু বুঝা যায় না।
বিদ্যাসাগরের আবির্ভাব থেকে দেড়শো বছরের ব্যবধানে আজ সংশয় জাগে বিদ্যাসাগর কি সত্যই আমাদের দেশে এসেছিলেন? হাঁ, পাথুরে প্রমাণ তো আমরা গড়েছিলাম। একালের ইতিহাসও পাথুরে প্রমাণের বশ। কিন্তু আর কোনও প্রমাণ কি আছে? আমাদের যাঁরা ভবিষ্যৎ, আমাদের ‘অকৃত কার্য, অকথিত বাণী, অগীত গান’ যাঁরা সার্থক ও পূর্ণাঙ্গ করে তুলছেন তাঁদের কাছে একটি মাত্র অনুরোধ করে এই জাতীয়-পিতৃতর্পণের উপসংহার করি। আমাদের ভগ্ন সুরহীন কণ্ঠের সঙ্গে তাঁদের শক্তিশালী সুরময় কণ্ঠ মিলিয়ে একটি গুরুপ্রণামের মন্ত্র তাঁরা পাঠ করুন—
প্রতিষ্ঠিতং হৃদি তব চিন্ময়ং বপুঃ
ধৃতং ব্রতং খলুু ত্বদুপাসনাত্মকম্।
ক্কচিদ্ গুরো স্মৃতিপথিকো ভবামি চেৎ
তদা সা গুণরুচিরা কূপৈব তে॥
ধৃতং ব্রতং খলুু ত্বদুপাসনাত্মকম্।
ক্কচিদ্ গুরো স্মৃতিপথিকো ভবামি চেৎ
তদা সা গুণরুচিরা কূপৈব তে॥
হে গুরু, হৃদয়ে তোমার চিন্ময়মূর্তির প্রতিষ্ঠা করেছি। এবার তোমার ব্রত ধারণ করে তোমার উপাসনার সঙ্কল্প গ্রহণ করেছি। আমরা যে তোমার স্মৃতিপথিক হতে পেরেছি সে তোমারই গুণবিমোহন কৃপা!
সেপ্টেম্বর/অক্টোবর ১৯৬০ সালে প্রকাশিত।

কোন মন্তব্য নেই
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন