মোট পৃষ্ঠাদর্শন

    ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
        মাইকেল মধুসূদন দত্ত

  বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে।
  করুণার সিন্ধু তুমি, সেই জানে মনে,
  দীন যে, দীনের বন্ধু!—উজ্জ্বল জগতে
  হেমাদ্রির হেমকান্তি অম্লান কিরণে।
  কিন্তু ভাগ্যবলে পেয়ে সে মহা পর্বতে,
  যে জন আশ্রয় লয় সুবর্ণ চরণে,
  সেই জানে কত গুণ ধরে কত মতে
  গিরীশ। কি সেবা তার সে মুখ সদনে।—
  দানে বারি নদীরূপ বিমলা কিঙ্করী;
  যোগায় অমৃত ফল পরম আদরে
  তরুদল, দাসরূপ ধরি;
  পরিমলে ফুলকুল দশ দিশ ভরে;
  দিবসে শীতল শ্বাসী ছায়া, বনেশ্বরী,
  নিশার সুশান্ত নিদ্রা, ক্লান্তি দূর করে!

বিদ্যাসাগরের আত্মসম্মানবোধ

বিদ্যাসাগর একদিন শিবনাথ শাস্ত্রীকে বলিয়াছিলেন, “দেখ, ভারতবর্ষে এমন কোনো রাজা নাই যাহার নাকে এই চটিজুতাসুদ্ধ পায়ে টক্ করিয়া লাথি না মারিতে পারি।” শিবনাথ শাস্ত্রী লিখিয়াছেন, একথা শুনিয়া তাঁহার একটুও অবিশ্বাস হয় নাই।

—রাধারমণ মিত্র



৬.৪.১৮৪৬ হইতে ১৫.৭.১৮৪৭-এর মধ্যে কোনো এক সময়ের ঘটনা। বিদ্যাসাগর তখন সংস্কৃত কলেজের সহকারী সম্পাদক ও মিঃ জেমস্ কার হিন্দু কলেজের অধ্যক্ষ।

একদিন বিদ্যাসাগর কোনো প্রয়োজনে সংস্কৃত কলেজ হইতে হিন্দু কলেজে কার সাহেবের সহিত সাক্ষাৎ করিতে যান। কার সাহেব তখন তাঁহার কামরায় সম্মুখস্থ টেবিলের উপর পাদুুকা-শোভিত পদযুগল সম্প্রসারিত করিয়া চেয়ারে বসিয়াছিলেন। বিদ্যাসাগরকে দেখিয়া পদযুগল নামাইলেনও না বা গুটাইলেনও না, বরং পায়ের দিকে যে চেয়ার ছিল অঙ্গুলিসংকেতে তাহাতে বিদ্যাসাগরকে বসিতে বলিলেন। সেই অবস্থায় কথাবার্তা সারিয়া বিদ্যাসাগর চলিয়া গেলেন। এই ঘটনার কিছুদিন পরে কি প্রয়োজনে কার সাহেব সংস্কৃত কলেজে বিদ্যাসাগরের সহিত সাক্ষাৎ করিতে যান। বিদ্যাসাগর টেবিলের উপর তাহার তালতলার চটি-শোভিত পদযুগল কার সাহেবের দিকে প্রসারিত করিয়া দিয়া কথাবার্তা বলিলেন। এই ব্যবহারে কার সাহেব অত্যন্ত অপমানিত বোধ করিয়া উপরিওয়ালার নিকট নালিশ করিলেন। বিদ্যাসাগরের নিকট লিখিত কৈফিয়ৎ তলব করা হইলে তিনি উত্তরে যাহা লিখিয়াছিলেন তাহা অবিকল ইংরাজিতেই উদ্ধৃত করিয়া দিলাম দুই কারণে; প্রথম, বাংলা অনুবাদে মূলের তীব্র ব্যঙ্গরস রক্ষা করা সম্ভব হইবে না; দ্বিতীয়, এই সময়ের মধ্যেই তিনি ইংরাজি রচনায় কিরূপ সিদ্ধহস্ত হইয়াছিলেন তাহা দেখাইবার জন্য। বিদ্যাসাগর লিখিলেন, “I thought that we (natives) were an uncivilised race quite unacquainted with refined manners of receiving a gentleman visitor. I learned the manners of which Mr. Kerr complains from the gentleman himself, a few days ago, when I had an occasion to call on him. My notions of refined manners being thus formed from the conduct of an enlightened, civilised European, I behaved myself as respectfully towards him as he had himself done.

২৮.১.১৮৭৪ তারিখে কাশীর হিন্দী কবি ভারতেন্দু হরিশচন্দ্র ও সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় নামক এক যুবকের সঙ্গে বিদ্যাসাগর বঙ্গীয় এশিয়াটিক সোসাইটির মিউজিয়াম বা যাদুঘর দেখিতে গিয়াছিলেন। প্রথম দুই ব্যক্তির পরিধানে প্যাণ্ট, কোট ও বিলাতী জুতা ছিল। বিদ্যাসাগরের কটিতে ধুতি, গাত্রে শুধু চাদর ও পদে তালতলার চটি ছিল। প্রথম দুইজন বিনা বাধায় ভিতরে প্রবেশ করিলেন। বিদ্যাসাগরকে দ্বারবান আটকাইল, বলিল, চটি-জুতা খুলিয়া রাখিয়া ভিতরে যাইতে হইবে। বিদ্যাসাগর তৎক্ষণাৎ ফিরিয়া গিয়া পথে অপেক্ষমান গাড়িতে বসিয়া সঙ্গী দুইটির জন্য অপেক্ষা করিতে লাগিলেন। সংবাদ পাইয়া সোসাইটির সম্পাদক প্রতাপচন্দ্র ঘোষ ছুটিয়া আসিয়া জোড়হস্তে বিদ্যাসাগরকে ভিতরে যাইবার জন্য অনুরোধ করিলেন। কিন্তু বিদ্যাসাগর কিছুতেই যাইতে রাজী হইলেন না। বলিলেন, তাঁহার জন্য এক নিয়ম ও সাধারণের জন্য আর-এক নিয়ম হইতে পারে না। যতদিন না সর্বসাধারণে চটিজুতা পরিয়া ভিতরে যাইবার অধিকার পায়, ততদিন তিনি ভিতরে যাইবেন না। এ বিষয়ে ভারত গভর্নমেন্টে পর্যন্ত বহুদিন ধরিয়া বিস্তর লেখালেখি হইয়াছিল। কিন্তু তাঁহারা শেষপর্যন্ত সর্বসাধারণের জন্য প্রচলিত নিয়ম তুলিয়া দিতে সম্মত হইলেন না। বিদ্যাসাগরও আর কোনোদিন এশিয়াটিক সোসাইটির বা যাদুঘরের ছায়া মাড়ান নাই।

এই পণ্ডিত বেশে, শুধু ধুতি চাদর ও চটিজুতা পরিয়া তিনি সর্বত্র, এমন কি লাটভবন পর্যন্ত যাইতেন। একবার ছোটলাট হ্যালিডে সাহেব তাঁহাকে ইংরাজি পরিচ্ছদ পরিধান করিয়া লাটভবনে আসিতে অনুরোধ করিয়াছিলেন। বিদ্যাসাগর তাহার উত্তরে লাট সাহেবকে বলিয়াছিলেন যে, তাহা হইলে সেইটিই লাট সাহেবের সহিত তাঁহার শেষ সাক্ষাৎকার। কারণ লাট সাহেবের অনুরোধ তিনি রক্ষা করিতে পারিবেন না। অতএব তাঁহার আর লাটভবনে আসা হইবে না। লাট সাহেব অবস্থা বুঝিয়া তৎক্ষণাৎ তাঁহার অনুরোধ প্রত্যাহার করিয়া লইয়া পূর্ববৎ দেশী পরিচ্ছদেই বিদ্যাসাগরকে তৎসকাশে আসিতে বলিলেন।

বিদ্যাসাগর একদিন শিবনাথ শাস্ত্রীকে বলিয়াছিলেন, “দেখ, ভারতবর্ষে এমন কোনো রাজা নাই যাহার নাকে এই চটিজুতাসুদ্ধ পায়ে টক্ করিয়া লাথি না মারিতে পারি।” শিবনাথ শাস্ত্রী লিখিয়াছেন, একথা শুনিয়া তাঁহার একটুও অবিশ্বাস হয় নাই।

সেপ্টেম্বর/অক্টোবর ১৯৬০ সালে প্রকাশিত।


কোন মন্তব্য নেই

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

vidyasagar.info ©