মোট পৃষ্ঠাদর্শন

    ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
        মাইকেল মধুসূদন দত্ত

  বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে।
  করুণার সিন্ধু তুমি, সেই জানে মনে,
  দীন যে, দীনের বন্ধু!—উজ্জ্বল জগতে
  হেমাদ্রির হেমকান্তি অম্লান কিরণে।
  কিন্তু ভাগ্যবলে পেয়ে সে মহা পর্বতে,
  যে জন আশ্রয় লয় সুবর্ণ চরণে,
  সেই জানে কত গুণ ধরে কত মতে
  গিরীশ। কি সেবা তার সে মুখ সদনে।—
  দানে বারি নদীরূপ বিমলা কিঙ্করী;
  যোগায় অমৃত ফল পরম আদরে
  তরুদল, দাসরূপ ধরি;
  পরিমলে ফুলকুল দশ দিশ ভরে;
  দিবসে শীতল শ্বাসী ছায়া, বনেশ্বরী,
  নিশার সুশান্ত নিদ্রা, ক্লান্তি দূর করে!

সাহিত্যিক বিদ্যাসাগর

বিদ্যাসাগরী ভাষাকে এখন কেউ কেউ কঠিন ভাষা বলেন, কিন্তু আমরা যদি তাঁর সমকালীন লেখকদের রচনার পাশাপাশি রেখে দেখি, তবে নিশ্চয়ই স্বীকার করব, তাঁর ভাষা অতিশয় প্রাঞ্জল ও সুবোধ্য। অন্বয়গুণে প্রতিটি বাক্যের অর্থ সুস্পষ্টঃ শুধু তাই নয়, বিন্যাস-কৌশলে বাক্যগুলি সুললিত। বিষয়ের অনুরোধে স্থানে স্থানে তাঁকে গম্ভীর সংস্কৃত শব্দ ব্যবহার করতে হয়েছে, কিন্তু তাতে লালিত্য ক্ষুণ্ন হয়নি, এবং সন্ধি-সমাসের জটিলতায় অর্থ আচ্ছন্ন হয়নি।

—ধীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়



কর্মবীর রূপে যিনি সর্বজনবন্দিত, সাহিত্য-শিল্পীরূপেও তিনি রেখে গেছেন তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর। জীবনের যে সকল কর্তব্য বিদ্যাসাগরের কাছে সাহিত্য-রচনার চেয়ে বড়ো বলে মনে হয়েছিল, তার প্রতিই তিনি বিশেষভাবে মন দিয়েছিলেন। বই লেখা ছিল নানান কাজের মধ্যে একটি এবং তাও প্রধানতঃ প্রয়োজনের তাগিদে—কখনও বিদ্যার্থীদের জন্য, কখনও সমাজসংস্কারের উদ্দেশ্যে। তথাপি সাহিত্যসৌন্দর্যে মণ্ডিত তাঁর অনেক রচনা—বিশেষ, তাঁর সংস্কৃত কাব্যের ভাবানুবাদ— ‘শকুন্তলা’ ও ‘সীতার বনবাস’। ‘শকুন্তলা’র মূলে আছে কালিদাসের বিখ্যাত নাটক; আর ‘সীতার বনবাসে’র প্রথম দুই পরিচ্ছেদের উৎস ভবভূতির ‘উত্তররামচরিত’, অবশিষ্টাংশের উপাদান প্রধানত; বাল্মীকি রামায়ণের উত্তরকাণ্ড থেকে নেওয়া। ‘রামের রাজ্যাভিষেক’ নামেও একখানি গ্রন্থ তিনি আরম্ভ করেছিলেন, কিন্তু তার কয়েক পৃষ্ঠার বেশী আর অগ্রসর হতে পারেননি। কাব্যানুবাদের বেলায় কেবল আখ্যান-বর্ণনা ও ভাব-পরিবেশনেই তাঁর দৃষ্টি নিবন্ধ ছিল না, তিনি চেয়েছিলেন মূল কাব্যের রস আহরণ করতে, গদ্যের চলনকেও ছন্দোময় করে তুলতে। বাক্যগঠনে অবহিত হলে শুধু যে অর্থকে সুবোধ্য করা যায়, তাই নয়, রচনাকে শ্রুতিমধুর ও তরঙ্গায়িত করে তোলা যায়, তার দৃষ্টান্ত তিনি রেখে গেছেন।

‘এই গিরির শিখরদেশ আকাশপথে সতত সঞ্চরমাণ জলধরপটল-সংযোগে নিরন্তর নিবিড় নীলিমায় অলঙ্কৃত; অধিত্যকাপ্রদেশ ঘনসন্নিবিষ্ট বনপাদপসমূহে সমাচ্ছন্ন থাকাতে, সতত স্নিগ্ধ, শীতল ও রমণীয়; পাদদেশে প্রসন্নসলিলা গোদাবরী তরঙ্গবিস্তার করিয়া প্রবল বেগে গমন করিতেছে।’ [সীতার বনবাস]—এ বাক্যের পর্বে পর্বে যে সুন্দর ধ্বনি-সামঞ্জস্য, তা তাঁর শিল্পবোধেরই অভ্রান্ত নিদর্শন।

রসবোধ ও বিচারশক্তি তাঁর কত প্রগাঢ় ও তীক্ষ্ম ছিল, তার প্রমাণ ‘সংস্কৃত ভাষা ও সংস্কৃত সাহিত্যবিষয়ক প্রস্তাব’। প্রকৃত সমালোচনা-সাহিত্যের পথপ্রদর্শক বলে আমরা বঙ্কিমচন্দ্রকে জানি, কিন্তু তাঁর পূর্বেই বিদ্যাসাগর উপরি-উক্ত পুস্তকে একটি উজ্জল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। কাব্য যে শুধু অলংকৃত বাক্য নয়, সেকথা তিনি মাঘের শিশুপালবধ আলোচনায় স্পষ্টরূপে উল্লেখ করেছেন : ‘মাঘ অতি অদ্ভুত কবিত্বশক্তি ও অতি অদ্ভুত বর্ণনাশক্তি পাইয়াছিলেন। যদি তাঁহার, কালিদাস ও ভারবির ন্যায়, সহৃদয়তা থাকিত, তাহা হইলে তদীয় ‘শিশুপালবধ’ সংস্কৃত ভাষায় সর্বপ্রধান কাব্য হইত সন্দেহ নাই।’ ‘সহৃদয়তা’ই যে কাব্যে প্রাণসঞ্চার করে, এ উপলব্ধির প্রমাণ এখানে বর্তমান। ‘কুমারসম্ভব’, ‘নৈষধচরিত’, ‘গীতগোবিন্দ’ প্রভৃতি কাব্যেরও রসবিচার উক্ত গ্রন্থে আছে।

মৌলিক সৃষ্টিকর্মে তিনি আত্মনিয়োগ করেননি। অপরের সৃষ্ট থেকে রসের আদান তাঁর সাহিত্য-সাধনার প্রধান প্রেরণা। সেক্ষেত্রে তাঁর সাফল্য তর্কাতীত।

কেবল সংস্কৃত কাব্যের রস নয়, ইংরেজী এবং হিন্দী সাহিত্য থেকেও তিনি রস আহরণ করেছেন। শেক্সপিয়রের বিখ্যাত নাটক ‘কমেডি অব্ এরর্স্’ অবলম্বনে রচিত ‘ভ্রান্তিবিলাস’ উপস্থাপনা-গুণে উপভোগ্য হয়েছে। বিলেতী নামধাম বদলে তিনি বাংলা নামধাম প্রয়োগ করেছেন। তাতে আখ্যানটি বিদেশিয়ানার আবরণ থেকে অনেকাংশে মুক্ত হয়েছে। ভাষার সাবলীলতা গল্পের গতিকে রেখেছে স্বচ্ছন্দ। ‘রাজপুরুষ জয়স্থলবাসী চিরঞ্জীবকে লইয়া তদীয় আলয় অভিমুখে প্রয়াণ করিলে পর উত্তমর্ণ বণিক অধমর্ণ স্বর্ণকারকে বলিলেন, তোমায় টাকা দিয়া পাইতে এত কষ্ট হইবেক, তাহা আমি একবারও মনে করি নাই। হয়তো এই টাকার গোলে আজ আমার যাওয়া হইল না; যাওয়া না হইলে বিলক্ষণ ক্ষতিগ্রস্ত হইব। এখন বোধ হইতেছে, সে সময়ে তোমার উপকার করিয়া ভালো করি নাই। স্বর্ণকার কুণ্ঠিত হইয়া বলিলেন, মহাশয়, আর আমায় লজ্জা দিবেন না। আমি আপনকার আবশ্যক সময়ে টাকা দিতে না পারিয়া মরিয়া রহিয়াছি। চিরঞ্জীববাবু যে আমার সঙ্গে এরূপ ব্যবহার করিবেন, ইহা স্বপ্নের অগোচর।’ [ভ্রান্তিবিলাস। ৫ম পরিচ্ছেদ]

‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’—‘বৈতাল পচীসী’ নামক হিন্দী গ্রন্থ অনুসরণে রচিত। গল্পগুলি মনোহর এবং এই বাংলা উপাখ্যানগুলিও সমাদৃত হয়েছিল। বিদ্যালয়-পাঠ্যরূপে এ পুস্তক পরিকল্পিত; তাই ছাত্রগণের প্রয়োজনের দিকে লেখককে দৃষ্টি রাখতে হয়েছে; কিন্তু এখানেও বাগাড়ন্বর নেই, ভাষা মার্জিত ও পরিচ্ছন্ন, কোথাও মন্থর বা আড়ষ্ট নয়।

‘নয়নানন্দ কহিল, আমি কতিপয় অর্ণবপোত লইয়া সিংহল দ্বীপে বাণিজ্য করিতে যাইতেছিলাম। দৈবের প্রতিকূলতা-প্রযুক্ত অকম্মাৎ প্রবল বাত্যা উত্থিত হওয়াতে সমস্ত অর্ণবপোত জলমগ্ন হইল। আমি ভাগ্যবলে এক ফলকমাত্র অবলম্বন করিয়া প্রাণরক্ষা করিয়াছি। এ পর্যন্ত আসিয়া আপনকার সহিত সাক্ষাৎ করিব, এমন আশা ছিল না। আমার সমভিব্যাহারের লোকসকল কে কোন দিকে গেল, বাঁচিয়া আছে কি মরিয়াছে, কিছুই অনুসন্ধান করিতে পারি নাই। দ্রব্যসামগ্রী সমগ্র জলমগ্ন হইয়াছে। এ অবস্থায় দেশে প্রবেশ করিতে লজ্জা হইতেছে। কি করি, কোথায় যাই, কোনও উপায় ভাবিয়া পাইতেছি না।’ [বেতালপঞ্চবিংশতি। ৪র্থ উপাখ্যান।]

বিদ্যাসাগরী ভাষাকে এখন কেউ কেউ কঠিন ভাষা বলেন, কিন্তু আমরা যদি তাঁর সমকালীন লেখকদের রচনার পাশাপাশি রেখে দেখি, তবে নিশ্চয়ই স্বীকার করব, তাঁর ভাষা অতিশয় প্রাঞ্জল ও সুবোধ্য। অন্বয়গুণে প্রতিটি বাক্যের অর্থ সুস্পষ্টঃ শুধু তাই নয়, বিন্যাস-কৌশলে বাক্যগুলি সুললিত। বিষয়ের অনুরোধে স্থানে স্থানে তাঁকে গম্ভীর সংস্কৃত শব্দ ব্যবহার করতে হয়েছে, কিন্তু তাতে লালিত্য ক্ষুণ্ন হয়নি, এবং সন্ধি-সমাসের জটিলতায় অর্থ আচ্ছন্ন হয়নি। অকারণে দুরূহ শব্দ ব্যবহারের তিনি পক্ষপাতী ছিলেন বলে মনে হয় না। ‘কথামালা’ এবং ‘আখ্যানমঞ্জরী’তে তাঁর ভাষা সম্পূর্ণ সহজ সরল। দুটি দৃষ্টান্ত নিই—

‘দেখ ভাই, এ গাছ কোনও কাজের নয়। না ইহাতে ভালো ফুল হয়, না ইহাতে ভালো ফল হয়। বলিতে কি, ইহা মানুষের কোনও উপকারে লাগে না। এই কথা শুনিয়া বটবৃক্ষ কহিল, মানুষ বড় অকৃত।’ [কথামালা। পথিকগণ ও বটবৃক্ষ]

‘যখন বাটীতে ছিলাম, জঘন্য পোড়া রুটি মাত্র খাইতে পাইতাম, তাহাও পর্যাপ্ত পরিমাণে নহে। একদিনও আহার করিয়া পেট ভরিত না। এখানে আমি প্রতিদিন উত্তম সূপ ও উত্তম রুটি পেট ভরিয়া খাইতেছি। এখানে আসিবার পূর্বে আমি কখনও এরূপ উত্তম ও প্রচুর আহার পাই নাই। আমার পিতামাতা প্রায় প্রতিদিন একপ্রকার উপবাসী থাকেন। আহার করিতে বসিলেই তাঁহাদের মনে পড়ে [আখ্যানমঞ্জরী। পিতৃবৎসলতা।]—এ ভাষা প্রায় আমাদের মুখের ভাষার কাছাকাছি।

‘বোধোদয়’-এর ভাষাও স্বচ্ছ ও সুবোধ্য।—‘সকল দেশেরই ভাষা পৃথক পৃথক। না শিখিলে এক দেশের লোক অন্য দেশীয় লোকের ভাষা বুঝিতে পারে না। আমরা যে ভাষা বলি, তাহাকে বাঙ্গালা বলে। কাশী অঞ্চলের লোকে যে ভাষা বলে, তাহাকে হিন্দী বলে। পারস্য দেশের ভাষা পারসী। আরব দেশের ভাষা আরবী। হিন্দী ভাষাতে আরবী ও পারসী ভাষা মিশ্রিত হইয়া এক ভাষা প্রস্তুত হইয়াছে, তাহাকে উর্দু বলে। উর্দুকে স্বতন্ত্র ভাষা বলা যাইতে পারে না। কতকগুলি আরবী ও পারসী কথা ভিন্ন ইহা সর্বপ্রকারেই হিন্দী। [বোধোদয়। বাক্যকথন]

সমাজসংস্কারের উদ্দেশ্যে তিনি কতকগুলি প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন : ‘বিধবা-বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কি না’—দুটি প্রস্তাব, বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কি না, এতদ্বিষয়ক বিচার’— দুটি খণ্ড, ‘বাল্য-বিবাহের দোষ’ প্রভৃতি। এগুলিতে তাঁর শাস্ত্রজ্ঞান, বিচারশক্তি এবং গভীর সহানুভূতির যোগ লক্ষ্য করি। সমাজের বাস্তব অবস্থার সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল। এই কারণেই তিনি কেবল বিধবা-বিবাহের অনুকুল শাস্ত্রীয় নির্দেশে উল্লেখ করেননি; চিরবৈধব্য প্রথার কুফলগুলি স্পষ্টভাবে নির্দেশ করেছেন। ‘বাল্যকালে যাহারা বিধবা হইয়া থাকে, তাহারা যাবজ্জীবন যে অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করে, তাহা যাঁহাদের কন্যা, ভগিনী, পুত্রবধূ প্রভৃতি অল্পবয়সে বিধবা হইয়াছেন, তাঁহারা বিলক্ষণ অনুভব করিতেছেন।...বিধবা-বিবাহের প্রথা-প্রচলিত হইলে অসহ্য বৈধব্য-যন্ত্রণা, ব্যভিচারদোষ ও ভ্রূণহত্যা পাপের নিবারণ ও তিন কুলের কলঙ্ক নিবারণ হইতে পারে।’ কৌলীন্যপ্রথা সম্বন্ধেও তাঁহার মন্তব্য অভিজ্ঞতা-প্রসূত : ‘কুলীন ভগিনী ও কুলীন ভগিনেয়ীদিগের বড় দুর্গতি। তাহাদিগকে পিত্রালয়ে অথবা মাতুলালয়ে থাকিয়া, পাচিকা ও পরিচারিকা উভয়ের কর্ম নির্বাহ করিতে হয়।....সংসারের সমস্ত কাজ নির্বাহ করিয়াও তাঁহারা সুশীলা ভ্রাতৃভার্যাদিগের নিকট প্রতিষ্ঠা লাভ করিতে পারেন না। তাঁহারা সর্বদাই তাঁহাদের উপর খড়াহস্ত।’

‘আত্মজীবনী’ রচনায়ও তিনি প্রবৃত্ত হয়েছিলেন। বিদ্যাসাগর-চরিত (স্বরচিত), গ্রন্থের দুটি মাত্র পরিচ্ছেদ তিনি রচনা করে গিয়েছেন। তাতে পিতামহ, মাতা-পিতা এবং আশ্রয়দাত্রী রাইমণির চরিত্র বর্ণিত হয়েছে। ছেলেবেলাকার কথা ছাড়া অন্য কথা এ বইয়ে কিছু নেই। একটি অনুভূতিশীল উদার মনের পরিচয় এই স্মৃতি-কথায় পরিস্ফুট হয়েছে।

‘প্রভাবতী-সম্ভাষণ’ একান্তই ব্যক্তিগত রচনা—সুহৃৎ রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের শিশুকন্যা প্রভাবতীর মৃত্যুতে শোকোচ্ছ্বাস। স্নেহের আবেগ এ রচনায় প্রবল: কিন্তু শুধু তাই নয়, এ শিশুর শৈশব-লীলার প্রতিটি ভঙ্গী—হাসি অশ্রু আদর অভিমান—বর্ণনায় প্রত্যক্ষ হয়ে উঠেছে। সম্ভবতঃ সাধারণের জন্য নয় মনে করে তিনি জীবনকালে এ গ্রন্থ প্রকাশ করে যাননি। পরে ৺সুরেশচন্দ্র সমাজপতি তাঁর ‘সাহিত্য’ পত্রে ছাপিয়েছিলেন। শিশুলীলার এমন করুণ মধুর চিত্র—সাহিত্য না-ই হোক—আন্তরিকতাগুণে মর্মস্পর্শী হয়ে উঠেছে।

জীবনে এবং কর্মে যাঁকে অনেক সময়েই গুরুগম্ভীর বলে মনে হয়েছে, তাঁর মধ্যেও যে একটি ব্যঙ্গরসিক কৌতুক ‘প্রিয় ব্যক্তি লুকিয়ে ছিল, তার প্রমাণ রয়েছে ‘কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপোস্য প্রণীত’— ‘অতি অল্প হইল’, ‘আবার অতি অল্প হইল’, ‘ব্রজবিলাস’—জাতীয় রচনায়। পরিহাসের ভাষা যেরূপ হালকা হওয়া উচিত, এগুলির ভাষা তাই।—‘যাঁহারা বিশেষ জানেন, তাঁহারা কিন্তু বলেন, তারানাথ কেবল মুখে পণ্ডিত, তাঁর মুখের জোর যত, বিদ্যার জোর তত নয়। ...আড়াআড়ি বড় মজার জিনিস। মেহনত ও বুদ্ধি খরচ করিয়া, কতকদূর পড়িয়া দেখিলাম, লোকে যাহা বলিতেছে তাহা নিতান্ত অলীক ও অসঙ্গত নয়। সত্যসত্যই খুড়’র দফা রফা হয়েছে।...খুড়’র লজ্জা-সরম কম বটে। কিন্তু লোকের কাছে আমাদের মাথা হেঁট হয়। দোহাই খুড়, তোমার পায়ে পড়ি, এমন করে আর ঢলিও না; এবং শতং বদ, মা লিখ, এই উপদেশ-বাক্য লঙ্ঘন করিয়া আর কখনও চলিও না।’

বিষয়-অনুসারে ভাষা প্রয়োগে যে তাঁর অসাধারণ নৈপুণ্য ছিল, তা তাঁর বিভিন্ন গ্রন্থ দেখলেই বোঝা যায়। শিল্পবোধ ছিল তাঁর সহজাত, কিন্তু শিল্পসৃষ্টিতে লেগে থাকার অবকাশ তিনি জীবনে পাননি। তবু তাঁর বহুমুখী প্রতিভার একটি রশ্মি সাহিত্য-জগতে বিকীর্ণ হয়েছে এবং তাকে উজ্জল করে তুলেছে তাতে সন্দেহ নেই।

সেপ্টেম্বর/অক্টোবর ১৯৬০ সালে প্রকাশিত।


কোন মন্তব্য নেই

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

vidyasagar.info ©