বিদ্যাসাগরের তিরোভাবের পর ‘সখা’ পত্রিকায় তাঁহার লিখিত দু’তিনটি গল্প প্রকাশিত হইয়াছিল। ১৮৯৩-এ জর্জ ওয়াশিংটনের কাহিনী
অবলম্বনে ‘মাতৃভক্তি’ নামক গল্প, ১৮৯৪-এ ‘ছাগলের বুদ্ধি’ নামে অপর একটি গল্প এই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এতদ্ভিন্ন কখনও
‘মুকুল’-এ, কখনও ‘ধ্রুব’তে তাঁহার লিখিত গল্প প্রকাশিত হইয়াছে। পূর্বেই বলিয়াছি, সে যুগ গল্পের যুগ নহে, গঠনের যুগ।
—প্রতিভাকান্ত মৈত্র
বিদ্যাসাগরকে বাঙ্গালা গদ্যের জনক বলা সুযুক্তিসম্মত কি না সে-বিষয়ে মতভেদের অবকাশ যদি-বা থাকে, তবু, বিদ্যাসাগরকে আধুনিক বঙ্গের শিক্ষিত-সমাজের জনক বলিয়া মানিয়া লইতে দ্বিধা থাকিবার কথা নহে। সামগ্রিকভাবে বিচার করিয়া একথা মানিয়া লইতেই হইবে যে, বিংশ শতকের শিক্ষিত-সমাজের জন্মই হইয়াছে বিদ্যাসাগরের আনুকূল্যে। বঙ্গসন্তানকে কেমন করিয়া শৈশব হইতেই ধাপে ধাপে শিক্ষার পথে অগ্রসর করিয়া দিতে হইবে তাহা তিনি গভীর ও ব্যাপকরূপে চিন্তা করিয়াছিলেন। যথার্থ শিক্ষা-বিজ্ঞান বলিতে যাহা বুঝায় তাহা তাঁহার সম্পূর্ণ আয়ত্ত ছিল। যে-কালে বিদ্যাসাগর বর্তমান ছিলেন সেই কালের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষা-সম্পর্কে তাঁহার অবদান পর্যালোচনা করিলে মনে হয় কোনো একজন বাঙ্গালীর দ্বারা শিক্ষা-জগতের এমন সর্বাঙ্গীণ উপকার আর কখনও সাধিত হয় নাই। সর্ববিধ শিক্ষাবিস্তারে তাঁহার দান অপরিসীম।
এ-দেশীয় বালক-বালিকার সংস্কৃত শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা যদিও তিনি অনুভব করিতেন, তবু, তৎকালীন প্রথানুযায়ী টোল বা চতুষ্পাঠীর দীর্ঘসূত্রী শিক্ষায় তাঁহার আস্থা ছিল না। তখনকার দিনে যে সংস্কৃত-শিক্ষাক্রম দীর্ঘ দ্বাদশ বৎসর ধরিয়া আয়ত্ত করিতে হইত তাহা ছয় মাসে আয়ত্ত করিবার ব্যবস্থা বিদ্যাসাগর করিয়াছিলেন তাঁহার ‘সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা’ প্রণয়ন করিয়া। তিনি চাহিয়াছিলেন সমকালীন জীবনযুদ্ধে জয়ী হইবার উপযুক্ত শিক্ষাবিস্তার করিতে। বাঙ্গালা দেশের মানুষ জীবনের নিত্যপ্রয়োজনীয় সকল প্রকার জ্ঞান অর্জন করুক—ইহাই বিদ্যাসাগরের কাম্য ছিল। তৎকালীন পরিবেশে এই কথাটি তিনি স্পষ্ট বুঝিয়াছিলেন যে, মাতৃভাষা ও ইংরাজী ভাষার মধ্য দিয়াই দেশের মানুষকে শিক্ষিত করিয়া তোলা সহজ হইবে। “এই কারণে তিনি বাংলা ‘বর্ণপরিচয়’ দিয়া আরম্ভ করিয়াছেন, এবং শিশুকে ধাপে ধাপে ‘কথামালা’, ‘বোধোদয়’, ‘জীবনচরিত’, ‘চরিতাবলী’ ও ‘আখ্যানমঞ্জরী’-র গল্পগুলির মধ্য দিয়া পূর্ণবিকশিত মনুষ্যত্বের দ্বার পর্যন্ত উত্তীর্ণ করিয়া দিবার ব্যবস্থা স্বয়ং করিয়া গিয়াছেন।” এবম্বিধ শিক্ষা পরিকল্পনার শুরুতেই যে-গ্রন্থের সহিত বিদ্যার্থী বালকের প্রথম পরিচয় হইবার কথা, তাহা, বিদ্যাসাগর-প্রণীত ‘বর্ণপরিচয়’-১ম ও ২য় ভাগ। বিদ্যাসাগরের জীবনের সর্বাধিক স্মরণীয় কীর্তি এই ‘বর্ণপরিচয়’। সুকুমারমতি বালক-বালিকার ভবিষ্যৎ জীবনের বনিয়াদ পোক্ত করিয়া গড়িবার কাজেই এই গ্রন্থের গৌরব সীমায়িত নহে, বাঙ্গালা গল্পসাহিত্যের জন্ম-সম্ভাবনার আকর এই ‘বর্ণপরিচয়’।
শুধু বর্ণজ্ঞান বা বানান প্রকরণ নহে, শিক্ষিত হইয়া উঠিবার জন্য প্রয়োজনীয় সর্ববিধ বিষয়ের ন্যূনতম উপাদান ছড়ানো রহিয়াছে ‘বর্ণপরিচয়’-এর মধ্যে বাঙ্গালা দেশের শিশুকে জ্ঞানোন্মেষের প্রথম মুহূর্ত হইতে যে পরিবেষ্টনীর মধ্যে পড়িতে হয় তাহা স্মরণে রাখিয়া শিশুর চিত্ত-বিকাশের উপযোগী পর্যাপ্ত উপকরণ ইহাতে সুচারুরূপে বিদ্যাসাগর সন্নিবেশিত করিয়াছেন। সুদীর্ঘকালের অভ্যাসে যাহা আজ আমাদিগের নিকট অতি সহজ ও স্বাভাবিক বলিয়া প্রতিভাত, তাহা সেদিন, বিদ্যাসাগরের কালে, গ্যালিলিও, কোপার্নিকাস বা কলম্বাসের আবিষ্কারের ন্যায়ই অভাবিত ছিল। সে-যুগের শিশুপাঠ্য পুস্তক যে কত নীরস ও দুর্বোধ্য ছিল তাহা না দেখিলে ‘বর্ণপরিচয়’-রচনায় বিদ্যাসাগরের কৃতিত্ব পরিমাপ করা সহজে সম্ভব নহে। তৎকালের ‘শিশুবোধ’ ও ‘শিশুশিক্ষা’র সহিত তুলনা করিয়া বিচার করিবার সুযোগ যাঁহারা পাইয়াছেন তাঁহারা সহজেই এই উক্তির যথার্থতা হৃদয়ঙ্গম করিবেন।
মাইকেল মধুসূদনের ভাষায় ‘heart of a Bengali mother’ বিদ্যাসাগরের ছিল। বাঙ্গালী মা তাঁহার শিশুর জন্য যে মমতা, স্নেহ ও সহানুভূতি পোষণ করেন, এদেশের আগত ও অনাগত অগণিত শিশুর জন্য সেই মমতা, স্নেহ ও সহানুভূতি লইয়া বিদ্যাসাগর ‘বর্ণপরিচয়’ রচনা করিয়াছেন। শিশুর কল্পনার দৃষ্টিকে উম্মোচিত ও প্রসারিত করিয়া দিতে তিনি সচেষ্ট থাকিয়াছেন। ঠাকুমা-দিদিমা, মা-মাসীর মুখে রূপকথার গল্প শুনিতে অভ্যস্ত এ দেশের শিশু চিত্ত; ঘুম-পাড়ানী গান শুনিতে অভ্যস্ত তাহাদের মন; এক কথায়, চিত্র, সুর ও গল্প— এই তিনের প্রতিই শিশুর প্রাথমিক প্রবণতা। ‘বর্ণপরিচয়’ রচনা করিতে বসিয়া বিদ্যাসাগরের মন এই বিষয়ে খুবই সজাগ ছিল। সেখানে তিনি কথা দিয়া ছবি আঁকিয়াছেন, শব্দযোজনার মধ্য দিয়া সুর জাগাইয়াছেন, এবং পরিশেষে ছোটখাট বিষয় লইয়া গল্প গড়িয়াছেন।
শিশুর চিত্তে অক্ষরের পরিচয় মুদ্রিত করিয়া দিবার যে সহজ পন্থাটি তিনি বাছিয়া লইয়াছেন তাহা শিশুর নিত্য-দেখা আনারস, লিচু, ওল, কোকিল, খরগোস, গরু, ঘোড়া ইত্যাদির সামীপ্যে যুক্ত করিয়া। ‘অ’ চিনিতে শিশুর মনে ‘অজগর’ উঁকি দিল, ‘আ’ চিনিতে গিয়া সে ‘আনারস’ দেখিল, ‘ক’ চিনিতে গিয়া মনের মধ্যে জাগিল ‘কোকিলের’ ছবি, ‘খ’ বলিতেই সেখানে ‘খরগোস’ দৌড়িয়া আসিল। শিশুর শিক্ষা যেন তাহার চিত্তে ভীতির সঞ্চার না করিয়া কৌতূহল ও কৌতুক উদ্রিক্ত করে সেদিকে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের দৃষ্টি ছিল সজাগ।
এইভাবে ‘বর্ণপরিচয়’-এ বাঙ্গালা বর্ণসমূহের সহিত শিশুকে পরিচিত করাইয়া লইয়া তিনি ‘পাঠ’ শুরু করিলেন। ১ম পাঠে ‘বড় গাছ’, ‘ছোট পাতা’; ২য় পাঠে ‘হাত ধর’, ‘বাড়ি যাও’; ৩য় পাঠে ‘জল পড়ে’ ‘মেঘ ডাকে’। শিশুর কৌতূহলী দৃষ্টি জগৎ ও জীবনের যেটুকু পরিচয় পাইয়াছে তাহারই মধ্যে তাহার পাঠের বিষয় ঘুরিয়া ফিরিয়া বেড়াইতেছে। যেন ‘বড় গাছে ছোট পাতা’ দেখিয়া বিস্মিত শিশুটি বয়স্কদের ‘হাত ধরিয়া বাড়ি যাইবে’ তখনই যখন ‘মেঘ ডাকিবে, জল পড়িবে’। চলমান জগতের চিত্র শিশুচিত্তে জাগাইতেছেন বিদ্যাসাগর, সেইসঙ্গে সুরের দোলায় দোলাইতেছেন তাহাকে। ক্রমে শিশু যখন ৮ম পাঠে আসিয়া পঁহুছিয়াছে তখন জগতের দিকে চাহিয়া সে দেখিতেছে— ‘জল পড়িতেছে’, ‘পাতা নড়িতেছে’, ‘পাখী উড়িতেছে’, ‘গরু চরিতেছে’।
এই পর্যন্ত চিত্র ও সুর লইয়া শিশুচিত্তকে অল্পে অল্পে জাগাইয়াছেন বিদ্যাসাগর; এইবার তাহাকে গল্পের জগতে লইয়া যাইবেন। শুরু হইল ‘বর্ণপরিচয়’-এর ৯ম পাঠ। গোপাল, মাধব, রাখাল, যাদব ও ভুবন আসিয়া পড়িল। তাহারা শিশুর নিত্যসঙ্গী। তাহাদের চরিত্রের নানা বৈচিত্র্য। এইটি তাহাদের নিজস্ব জগৎ। ১৩শ পাঠ পর্যন্ত সেই জগৎ সৃজনের কাজ চলিয়াছে।
১৪শ পাঠ-এ আসিয়া সেই শিশুজগতে ঘটনার সূত্রপাত হইল। ‘আর রাতি নাই। ভোর হইয়াছে। আর শুইয়া থাকিলে চলিবে না।’ ক্রমে ১৫শ পাঠ-এ–‘বেলা হইল। পড়িতে চল।’ ৬শ পাঠ হইতে ক্রমান্বয়ে শুরু হইল বিভিন্ন চরিত্রের বিচিত্র পরিচয়। ‘রাম কাল পড়িবার সময় গোল করিয়াছিল।’ ‘নবীন কাল ভুবনকে গালি দিয়াছিল।’ ‘গিরিশ কাল পড়িতে আসে নাই, সারাদিন খেলা করিয়াছে।’ ‘গোপাল বড় সুবোধ, গোপালকে যে দেখে সে ভালবাসে’, —‘রাখাল তেমন নয়, রাখালকে কেহ ভালবাসে না।’ এইভাবে শিশু- চিত্তে ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রের স্বাদ জাগাইয়া ‘বর্ণপরিচয়’ ১ম ভাগ সমাপ্ত হইল।
শুরু হইল ‘বর্ণপরিচয়’ ২য় ভাগ। সংযুক্তবর্ণ শিক্ষা করিতে বসিয়া প্রথমেই শিশুমন ‘ঐক্য, বাক্য, মাণিক্য’র ঝঙ্কার শুনিল। তাহার পরে ১ম ও ২য় পাঠ-এ কুবাক্য কহা; শ্রম না করা ও মিথ্যা কহা যে অপরের ঘৃণা উদ্রেক করে সে জ্ঞান শিশুকে দেওয়া হইল। আদর্শ মনুষ্যত্বের সন্ধানে শিশুকে অগ্রসর করিয়া দিতেছেন বিদ্যাসাগর। তাই, ৩য় পাঠ-এ আসিয়া ‘সুশীল বালক’-এর পরিচয় দিলেন। কিন্তু শুধু পরিচয় বর্ণনা করিয়াই তিনি ক্ষান্ত হইবেন না। তিনি গল্পের জগৎ রচনা করিবেন। সেই জন্য ক্রমে ক্রমে আট বৎসরের যাদব, নয় বৎসরের নবীন ও দশ বৎসরের মাধবের কথা বলিলেন। চরিত্র ও ঘটনা— এই দুই-এর যোগে গল্পের সৃষ্টি। প্রথমে বিভিন্ন ধরনের শিশুচরিত্র উদ্ঘাটন করিয়া তাহার পরে বিদ্যাসাগর মহাশয় ঘটনার জগতে প্রবেশ করিতেছেন। পরিশেষে ‘বর্ণপরিচয়’ ২য় ভাগের ১০ম পাঠ-এ আসিয়া বিদ্যাসাগর পরিপূর্ণ গল্প উপহার দিলেন—
“একদা, একটি বালক, বিদ্যালয় হইতে, অন্য এক বালকের একখানি পুস্তক চুরি করিয়া আনিয়াছিল।... তাহার মাসী তাহাকে লালনপালন করিয়াছিলেন।... তিনি বুঝিতে পারিলেন, ভুবন ঐ পুস্তকখানি চুরি করিয়া আনিয়াছে। কিন্তু তিনি পুস্তক ফিরিয়া দিতে বলিলেন না, এবং ভুবনের শাসন বা ভুবনকে চুরি করিতে নিষেধ করিলেন না। ইহাতে ভুবনের সাহস বাড়িয়া গেল।...কিছুকাল পরে, ভুবন চোর বলিয়া ধরা পড়িল।... বিচারকর্তা ভুবনের ফাঁসীর আজ্ঞা দিলেন।...ভুবন রাজপুরুষদিগকে কহিল, তোমরা দয়া করিয়া, এ জন্মের মতো, একবার আমার মাসীর সঙ্গে দেখা করাও।
ভুবনের মাসী ঐস্থানে আনীত হইলেন এবং ভুবনকে দেখিয়া, উচ্চৈঃস্বরে কাঁদিতে কাঁদিতে তাহার নিকট গেলেন।...মাসীর নিকটে গেলে পর, ভুবন তাঁহার কানের নিকট মুখ লইরা গেল এবং জোরে কামড়াইয়া, দাঁত দিয়া মাসীর একটি কান কাটিয়া লইল। পরে ভৎর্সনা করিয়া কহিল, মাসি! তুমিই আমার এই ফাঁসীর কারণ। যখন আমি প্রথম চুরি করিয়াছিলাম, তুমি জানিতে পারিয়াছিলে। সে সময়ে যদি তুমি শাসন ও নিবারণ করিতে, তাহা হইলে আমার এ দশা ঘটিত না। তাহা কর নাই, এজন্য তোমার এ পুরস্কার হইল।”
‘বর্ণপরিচয়’ ২য় ভাগের এই ১০ম পাঠ শুধু শিশুর পাঠ নহে, ইহা শিশুর অভিভাবক-শ্রেণীর পাঠ। ইহাই বাঙ্গালা সাহিত্যে প্রথম মৌলিক গল্প। এই গল্প সেদিন বাঙ্গালীর মর্মের মধ্যে প্রবেশ করিয়াছিল। এখন এই গল্প আমাদের দেশের মানুষ ভুলিয়া গিয়াছে। আজ কোনও তরুণ যখন চোঙা-জাতীয় পাৎলুন পরিধান করিয়া রঙ্গীন ছিটের ব্লাউজ বা কুর্তা গায়ে দিয়া চুলের সম্মুখভাগে সিঙ্গাড়ার ন্যায় চূড়া বানাইয়া বই খুলিয়া পরীক্ষা দিতে বসে তখন ‘ভুবনের মালী’কে মনে পড়ে। মনে হয়, উহাদের অভিভাবকদের ‘বর্ণপরিচয়’ ২য় ভাগের ১০ম পাঠটি পড়া হয় নাই। কিন্তু, উহা আমাদের প্রতিপাদ্য বিষয় নহে; আমাদের প্রতিপাদ্য বিদ্যাসাগর বাঙ্গলা গল্পের জনক, এবং সে গল্পের জন্ম ‘বর্ণপরিচয়’ ২য় ভাগে।
বস্তুতঃ বিদ্যাসাগর মহাশয়ের মনটিই ছিল গল্পকারের মন। শুধু যুগ-প্রতিবেশ ছোট গল্প রচনার অনুকূল ছিল না বলিয়াই তিনি পরিপূর্ণ গল্প-রচনায় মনোযোগী হয়েন নাই। জাতীয় জীবনের গতিবেগ যখন দ্রুত হয় তখনই সাহিত্যে গল্পের প্রাচুর্য দেখা দেয়, মন্থরগতি জীবনে রচিত হয় মহাকাব্য বা উপন্যাস। বিদ্যাসাগরের কালে এই দেশ তাহার দীর্ঘকালপোষিত মন্থরগতি জীবন হইতে দ্রুতগতিবেগসম্পন্ন জীবনের দিকে অগ্রসর হইবার জন্য প্রস্তুত হইতেছে। সেই প্রস্তুতির প্রভূত উপকরণ স্বয়ং বিদ্যাসাগরই অনেকাংশে রচনা করিয়াছেন। সমাজ-সংস্কার, শিক্ষা-সংস্কার ও ভাষা-সংস্কারে লিপ্ত থাকিয়া তিনি অগ্রিম গল্প লিখিয়া ফেলিয়াছেন। গল্পের দিকে তাঁহার ঝোঁক ছিল খুব। হিন্দী গল্প, সংস্কৃত গল্প, ইংরাজী গল্প সব দিকেই তাঁহার অপরিসীম আগ্রহ। ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’, ‘কথামালা’ এবং ‘আখ্যানমঞ্জরী’ বা ‘শকুন্তলা’ ও ‘ভ্রান্তিবিলাস’ তাহারই সাক্ষ্য দেয়। বিদ্যাসাগর তাঁহার পিতৃদেবকে যখন কাশীতে লইয়া যান সেই সময়ে নৌকায় রাত্রিযাপন প্রসঙ্গে অমৃতলাল বলিয়াছেন— “সতীর্থ বন্ধু মধুসূদন লাহিড়ীর ইঙ্গিতে বিদ্যাসাগর মহাশয়কে ধরিয়া বসিলাম— গল্প বলিতে হইবে। তিনি বলিলেন, ‘গল্প শুনবি? কি রকম গল্প বলবো— দু’ মিনিটের মতো, না, আধ ঘণ্টার মতো? ছোট-বড় বিচিত্র রূপকথায় বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সহিত নিশাযাপন করিলাম” ( পুরাতন প্রসঙ্গ, ২য়, পূঃ ৭৫ )। বিদ্যাসাগরের তিরোভাবের পর ‘সখা’ পত্রিকায় তাঁহার লিখিত দু’তিনটি গল্প প্রকাশিত হইয়াছিল। ১৮৯৩-এ জর্জ ওয়াশিংটনের কাহিনী অবলম্বনে ‘মাতৃভক্তি’ নামক গল্প, ১৮৯৪-এ ‘ছাগলের বুদ্ধি’ নামে অপর একটি গল্প এই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এতদ্ভিন্ন কখনও ‘মুকুল’-এ, কখনও ‘ধ্রুব’তে তাঁহার লিখিত গল্প প্রকাশিত হইয়াছে। পূর্বেই বলিয়াছি, সে যুগ গল্পের যুগ নহে, গঠনের যুগ। প্রতিভার পূর্বগামিতার বলেই বিদ্যাসাগর উপযুক্ত যুগ আসিবার পূর্বে গল্প লিখিয়া গিয়াছেন। বাঙ্গালা গল্পের যে রাজরথ রবীন্দ্রনাথের নিপুণ সারথ্যে একদা বিশ্ববিজয়ে বাহির হইবে, পূর্ব হইতেই তাহার পথ প্রস্তুত করিয়াছেন বিদ্যাসাগর। সেই প্রস্তুতির প্রকৃষ্ট পরিচয় বর্ণপরিচয় ২য় ভাগের ১০ম পাঠ : বাঙ্গালা গল্পের প্রথম অনবদ্য চরিত্র ভুবন ও ভুবনের মাসী।
সেপ্টেম্বর/অক্টোবর ১৯৬০ সালে প্রকাশিত।

কোন মন্তব্য নেই
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন