সেই মহামানবের কর্মকীর্তির কথা আমি আর নূতন করিয়া কি বলিব, আর কতটুকুই বা বলিতে পারি? শুধু ইহাই বলিতে পারি—ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বঙ্গজননীর শ্রেষ্ঠতম সন্তান। পৃথিবীর ইতিহাসেও ঠিক এমন একটি চরিত্রের মানুষ আমি খুঁজিয়া পাই নাই।
—আশুতোষ মুখোপাধ্যায়
আমার বয়স যখন দশ বৎসর, তখন আমি বিদ্যাসাগর মহাশয়কে প্রথম দর্শন করি। সেই প্রথম দর্শনের স্মৃতি আমার মনে চিরজাগ্রত। সেই সময়ে তিনি আমাকে একখানি ‘রবিনসন ক্রুশো’ উপহার দিয়াছিলেন। তাঁহার নিজের হাতে দেওয়া সেই উপহারটি আমি সযত্বে এবং শ্রদ্ধার সঙ্গে রক্ষা করিয়াছি তাহার পর আমার কর্ম-জীবনের আরম্ভে আমি আর-একবার তাঁহার সংস্পর্শে আসিয়াছিলাম। তখন তিনি আমাকে তাঁহার মেট্রোপলিটন কলেজে একটি অধ্যাপকের চাকরি দিয়াছিলেন।
‘বিদ্যাসাগর’ এই কথাটি আমার নিকট একজন মানুষের নাম মাত্র নয়, ইহা আমার নিকট একটি মন্ত্রস্বরূপ। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জীবন আমার নিকট একটি জ্যোতির্ময় আলোকস্তম্ভ-স্বরূপ। মনুষ্যত্বের সাধনায় ইহজীবনে যদি কেহ সিদ্ধিলাভ করিতে চাহে, তাহার পক্ষে এই একটি মাত্র অমোঘ মন্ত্র আছে। বিদ্যাসাগর—এই কথাটির উচ্চারণেই পুণ্য। ইহা আমার উচ্ছ্বাসের কথা নয়, উপলব্ধির কথা। তাঁহারই আদর্শকে অনুসরণ করিয়া আমার জীবন অনেকখানি গড়িয়া উঠিয়াছে, চরিত্র বিকশিত হইয়াছে। তিনিই দেশীয় পোশাকের গৌরব শিক্ষিত-সমাজে প্রথম বাড়াইয়াছিলেন; তিনি যদি ধুতি চাদর ও চটিজুতা পরিহিত হইয়া সর্বসমক্ষে যাতায়াত না করিতেন তাহা হইলে আমরা, অন্তত আমি, আজ দেশী পোশাকের প্রতি অনুরক্ত হইতাম কি না সন্দেহ। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বহু অসাধারণত্বের মধ্যে এই একটি।
সেই মহামানবের কর্মকীর্তির কথা আমি আর নূতন করিয়া কি বলিব, আর কতটুকুই বা বলিতে পারি? শুধু ইহাই বলিতে পারি—ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বঙ্গজননীর শ্রেষ্ঠতম সন্তান। পৃথিবীর ইতিহাসেও ঠিক এমন একটি চরিত্রের মানুষ আমি খুঁজিয়া পাই নাই।
বিদ্যাসাগর মহাশয় অতি সরল ও সাধারণ মানুষ ছিলেন, অথচ জীবনের সর্বক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন অসাধারণ বস্তুত তিনি অসাধারণত্ব লইয়াই জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। তাঁহার ব্যক্তিত্ব, চরিত্র, জ্ঞান, বিদ্যা, শক্তি, সাহস ও গঠনশক্তি ছিল অসাধারণ। সর্ববিষয়েই তিনি ছিলেন স্বাধীনচেতা; তাঁহার জীবনের অতি ক্ষুদ্র কার্যটির মধ্য দিয়াও তাহাই প্রকাশ পাইয়াছে। তিনি কর্মী ছিলেন— কল্পনা-বিলাসী ছিলেন না। তাঁহার দৃষ্টি শুধু সন্মুখেই ছিল না, উহা বহুদূরের পর্যন্ত প্রসারিত ছিল। তাঁহার চরিত্র-মহিমায় বাঙালীর বহুদূরের ভবিষ্যৎ পর্যন্ত আলোকিত হইয়াছে। তাঁহার সময়ে এদেশে শিক্ষা-বিস্তারের ব্যাপারে আর কেহই তাঁহার ন্যায় অগ্রসর হইতে পারেন নাই। শিক্ষার ক্ষেত্রে আমি আমার ক্ষুদ্র শক্তিতে যেটুকু করিয়াছি, তাহা তাঁহারই আদর্শকে অনুসরণ করিয়া। শিক্ষাই ছিল তাঁহার জীবনের মূলমন্ত্র। কেমন করিয়া আমাদের দেশের সর্বত্র জ্ঞান বিস্তার হয়, ইহাই ছিল তাঁহার জীবনের একমাত্র সাধনা। সেই সাধনার উত্তরাধিকার আমরা লাভ করিয়াছি।
বিদ্যাসাগর মহাশয়ের দয়ার কথা, পিতামাতার প্রতি ভক্তির কথা এক্ষণে প্রবাদে পরিণত হইয়াছে। পিতামাতা যে আমাদের সাক্ষাৎ দেবতা ইহা তিনি যেমন করিয়া বুঝাইয়া দিয়াছেন, এমন আর কেহ পারে নাই, পারিবেও না। আমার পিতৃদেব প্রায়ই বলিতেন—এই বঙ্গদেশে বিদ্যাসাগরই একমাত্র মানুষ যিনি মানুষের দুঃখ বুঝিতেন, মানুষের দুঃখে কাঁদিতে জানিতেন এবং সেই দুঃখমোচনের জন্য যথাসাধ্য প্রয়াস পাইতেন। দয়া জিনিসটি যে কি তাহা তিনি যেমন করিয়া শিখাইয়াছেন, এমন আর কেহ পারিল না। এইজন্যই বাঙালীর হৃদয়ে বিদ্যাসাগরের আসন চিরকাল। পৃথিবীর অমর মহামানবদের সমগোত্রীয় তিনি। আমি তাঁহাকে প্রণাম করি।
সেপ্টেম্বর/অক্টোবর ১৯৬০ সালে প্রকাশিত।

কোন মন্তব্য নেই
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন