মোট পৃষ্ঠাদর্শন

    ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
        মাইকেল মধুসূদন দত্ত

  বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে।
  করুণার সিন্ধু তুমি, সেই জানে মনে,
  দীন যে, দীনের বন্ধু!—উজ্জ্বল জগতে
  হেমাদ্রির হেমকান্তি অম্লান কিরণে।
  কিন্তু ভাগ্যবলে পেয়ে সে মহা পর্বতে,
  যে জন আশ্রয় লয় সুবর্ণ চরণে,
  সেই জানে কত গুণ ধরে কত মতে
  গিরীশ। কি সেবা তার সে মুখ সদনে।—
  দানে বারি নদীরূপ বিমলা কিঙ্করী;
  যোগায় অমৃত ফল পরম আদরে
  তরুদল, দাসরূপ ধরি;
  পরিমলে ফুলকুল দশ দিশ ভরে;
  দিবসে শীতল শ্বাসী ছায়া, বনেশ্বরী,
  নিশার সুশান্ত নিদ্রা, ক্লান্তি দূর করে!

প্রখর রোদে ঘর্মাক্ত বিদ্যাসাগর হনহন করে আল পথ ধরে হেঁটে আসছেন, একটি পাথরের বাটি। হরপ্রসাদ প্রশ্ন করাতে বিদ্যাসাগর জানালেন কিছুক্ষণ আগে একটি সাঁওতালি এসে খবর দিয়েছে তার ছেলের নাক দিয়ে হু হু করে রক্ত পড়ছে, বললে, বিদ্যাসাগর তুই এসে যদি তাকে বাঁচাস। আমি একটা হোমিওপ্যাথিক ওষুধ নিয়ে গেছিলাম জানিস এক ডোজ ওষুধেই ছেলেটার রক্ত পড়া বন্ধ হয়ে গেল। বিদ্যাসাগর আরো বললেন এরা তো মেলা ওষুধ খায় না অল্প ওষুধে এদের উপকার হয়।

—প্রসূন কাঞ্জিলাল



সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত, সমাজসেবী, সমাজ সংস্কারক, এক বিশাল জ্ঞানের অধিকারী ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়কে সারা বিশ্বের মানুষ চেনেন। কিন্তু চিকিৎসক রূপে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ব্যাপ্তি সমন্ধে খুব কম সংখ্যক মানুষই জ্ঞাত। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগর মহাশয় এর আগ্রহ ও অবদান ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য। কিন্তু তার চিকিৎসা পদ্ধতির মূল অস্ত্র ছিল তার নিঃস্বার্থ সেবাপরায়ণতা এবং দরিদ্র মানুষের প্রতি তার অন্তরের ভালোবাসা।

বিদ্যাসাগরের হোমিওপ্যাথি চর্চার অত্যন্ত মানবিক নাকি ঐশ্বরিক বিবরণ পাওয়া যায় তার কারমাটার বাস কালে দরিদ্র শিক্ষাহীন সাঁওতালদের সান্নিধ্যে। বিহারীলাল সরকার লিখছেন “সাঁওতাল প্রবল পীড়ায় প্রায় শয্যাগত বিদ্যাসাগর তাহার শিয়রে বসিয়া, মুখে ঔষধ ঢালিয়া দিতেন, হা করাইয়া পথ্য দিতেন উঠাইয়া বসাইয়া মলমূত্র ত্যাগ করাইতেন সর্বাঙ্গে হাত বুলাইয়া দিতেন।” এ আন্তরিকতার হদিশ পেয়েছে শুধু সাঁওতালরা নয় সমাজের বিভিন্ন বৃত্তের মানুষ আর এই প্রয়াসের বলিষ্ঠতা তার আকৈশোরের অভ্যাস অথবা বলা ভালো জীবনধর্ম। এই মরমী মনটি হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার বহু আগে থেকেই ছিল সে কোন কৈশোর কালে বাবা ঠাকুরদাসের আশ্রয়দাতা জগদ্দূর্লভ সিংহের পরিচিত কিছু মানুষ কলেরায় আক্রান্ত হয়েছে শুনে বালক ঈশ্বরচন্দ্র তার বাবা ও দুই ভাই এর ভোজনের আয়োজন করে অসহায় পাঁচজন রোগীর কাছে গেলেন। ক্রমাগত বমি ও মলত্যাগের ক্লান্ত ও পিপাসার্ত মানুষগুলির জন্য স্থানীয় গৃহস্থ বাড়ি থেকে জল এনে খাওয়ালেন, ডাক্তার রূপচাঁদের বাড়ি থেকে বেদানা, মিছরি, এক কলসি পরিষ্কার জল এনে রোগীদের খাওয়ালেন নিজের হাতে বমি মলমূত্র পরিষ্কার করে ধোয়া কাপড় পড়ালেন। ডাক্তারের জল চিকিৎসায় আর ঈশ্বরচন্দ্রের সেবায় ক্রমে রোগীরা সুস্থ হয়ে উঠলেন। ১৮৬৬ সালের দুর্ভিক্ষে কলকাতার কলেজ স্কয়ার অঞ্চলে উপোসী মানুষকে নিজে হাতে খাবার পরিবেশন করেছিলেন। বীর সিংহ গ্রামে অন্ন ছত্র খুলেছিলেন, বিদ্যাসাগরের কড়া হুকুম ছিল যত টাকা খরচ হোক কেউ যেন অভুক্ত না থাকে। ১৮৬৯-৭০ সালে বর্ধমান এ এক ভয়ানক জ্বরে প্রচুর মানুষ মারা যায়। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সেইসব মানুষদের বিদ্যাসাগর সেবা ঔষধ পথ্য দিয়ে সুচিকিৎসার বন্দোবস্ত করেছেন। সেই জ্বর ছিল প্রকৃতপক্ষে ম্যালেরিয়া। বিদ্যাসাগর এ রোগের চিকিৎসার জন্য ডিসপেনসারি, ওষুধ পত্রের ব্যবস্থা করে ক্ষান্ত হননি, কলকাতায় এসে সেকালের ছোটলাট গ্রে সাহেবের কাছে বিষয়ের গুরুত্ব বোঝান। ফলে সরকারি বদান্যতায় আরো অনেক ডিসপেন্সারি খোলা হল। বিদ্যাসাগরের ডিসপেন্সারি থেকে শুধু ওষুধ পত্র নয় পয়সা ও পরনের কাপড় পর্যন্ত পাওয়া যেত। এই ডিসপেন্সারীর কাজে বিদ্যাসাগরকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিলেন প্যারীচাঁদ মিত্রের ভাইপো ডাক্তার গঙ্গা নারায়ন মিত্র। ম্যালেরিয়া রোগীকে সেখান থেকে কুইনাইন দেওয়া হত প্রয়োজনে তাদের বাড়ি গিয়েও বিদ্যাসাগর স্বয়ং ওষুধ পথ্য পৌঁছে দিয়ে আসতেন। বিদ্যাসাগরের এই অনন্য সাধারণ সেবার কথা স্মরণ করে, আরেক বিশিষ্ট মানুষ রজনীকান্ত গুপ্ত লিখছেন “১৮৮৩ সালে একদা তিনি বিদ্যাসাগর মশাই প্রাত :কালে ভ্রমণ করিতে করিতে এই নগরের প্রান্ত ভাগ অতিক্রম করিয়া কিয়দ্দূর গিয়েছেন, সহসা দেখিলেন একজন বৃদ্ধা অতিসার রোগে আক্রান্ত হইয়া পথের পাশে পড়িয়া রহিয়াছে। দেখিয়ে তিনি ওই মল লিপ্ত বৃদ্ধাকে পরমযত্নে ক্রোড়ে করিয়া আনিলেন এবং তাহার যথোচিত চিকিৎসা করাইলেন। দরিদ্রা বৃদ্ধা তাহার যত্নে আরোগ্য লাভ করিল।”
বিদ্যাসাগরের প্রগতিশীল চিন্তা ভাবনা এবং উদ্যোম আর দ্বারকানাথের মুদ্রণযন্ত্র,আর্থিক সঙ্গতি ও স্বচ্ছ সামাজিক, রাজনৈতিক চেতনা সোমপ্রকাশকে এমন উচ্চতায় নিয়ে যায় যে, বিভিন্ন বিষয়ে জনমত গঠনে অতি প্রভাবশালী ভূমিকা গ্রহণ করে এই পত্রিকা।

—প্রসূন কাঞ্জিলাল



দ্বিশতবর্ষে বিদ্যাসাগর স্মরণ এবং শ্রদ্ধা এ প্রজন্মের বাঙালিকে করেছে ঋদ্ধ। উৎসাহিত করছে এই অন্যতম শ্রেষ্ঠ যুগপুরুষকে জানতে এবং আত্মস্থ করতে। রক্ত-মাংসের এই ঈশ্বরের সামগ্রিক কর্মকান্ডের ক’য়েক শতাংশও যদি থাকত অনুপস্থিত, তবে জাতি হিসেবে বাঙালি যে আজ কতটা দীন থেকে যেত তা কল্পনায় আনলেই শিউরে উঠতে হয়। বিদ্যাসাগরের মতো মহামানবের জন্মের জন্য যেমন অপেক্ষা করতে হয় ক’য়েক শতাব্দী, তেমনই যে জাতির একজন বিদ্যাসাগর থাকেন সে জাতিকে কখনই অন্ধকারের অতল গহ্বরে তলিয়ে যেতে হয় না। বিদ্যাসাগরের মতো ঈশ্বররা কোনো একটি বিশেষ কাজের জন্যও জন্মান না। এক জীবনে বহু কাজের মাধ্যমে সমগ্র জাতিকে উন্নত করার দায়িত্ব তুলে নেন কাঁধে।

বিদ্যাসাগরের কর্মময় জীবনের অজস্র ধারার অন্যতম ছিলতৎকালীন বিভিন্ন পত্র পত্রিকার পৃষ্ঠেপোষকতাও। পেশা নয়, তাঁর বহুমুখী কর্মকাণ্ডকে পূর্ণতা দিতেই হাতে তুলে নিতে হয়েছিল ক্ষুরোধার কলম। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে বেশ ক’য়েকটি সাময়িক পত্রের দায়িত্ব তাঁকে সামলাতে হয়েছে দীর্ঘদিন। ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’, ‘সর্ব্বশুভকরী পত্রিকা’, ‘সোমপ্রকাশ’ ও ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’ ছিল তাঁর এই পর্বের কর্মকান্ডের বিচরণ ক্ষেত্র। তত্ত্ববোধিনীসোমপ্রকাশ ছিল সেই সময়ের অত্যন্ত প্রভাবশালী দুটি বাংলা পত্রিকা। শিক্ষিত বাঙালি সমাজে অত্যধিক প্রভাবশালী ইংরেজি পত্রিকা ছিল হিন্দু পেট্রিয়ট
বিদ্যাসাগর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো (১৮৫৬) এবং রয়াল এশিয়াটিক সোসাইটির সম্মানিত সদস্য (১৮৬৪) নির্বাচিত হন। ১৮৭৭ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার লেফটেন্যান্ট-গভর্ণর স্যার রিচার্ড টেম্পল বিধবাবিবাহ আন্দোলনের নেতা হিসাবে তাঁকে এক বিশেষ সম্মানলিপি প্রদান করেন। ১৮৮০-তে ভারত সরকার তাঁকে সি.আই. ই. উপাধিতে ভূষিত করেন।

—আনিসুজ্জামান

১. বিদ্যাসাগরচরিত

উনিশ শতকের বাংলা দেশে বহু কীর্তিমান পুরুষের জন্ম হয়েছিল। এঁদের মধ্যেও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের স্বাতন্ত্র্য সহজেই ধরা পড়ে। যে-বিস্ময়বোধ থেকে রবীন্দ্রনাথ তাঁর সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘বিশ্বকর্মা যেখানে চার কোটি বাঙালি নির্মাণ করিতেছিলেন, সেখানে হঠাৎ দুই-একজন মানুষ গড়িয়া বসেন কেন, তাহা বলা কঠিন’, যুগান্তরেও আমাদের সে-বিস্ময়বোধের অবসান হয় না।

অথচ তিনি লালিত হয়েছিলেন নিতান্ত প্রাচীনপন্থী পরিবেশে। মেদিনীপুর (তখন হুগলি) জেলার বীরসিংহ গ্রামে তাঁর জন্ম হয় (২৬ সেপ্টেম্বর ১৮২০। ১২ আশ্বিন ১২২৭)। তাঁর পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় সামান্য কর্ম করতেন; তাঁর বেতন কখনো মাসে দশ টাকার বেশি হয়নি। দারিদ্র তাঁদের সহচর ছিল; সম্পদ বলতে ছিল পুরুষানুক্রমিক চরিত্রবল। বিদ্যাসাগর-জননী ভগবতী দেবীও এ-চরিত্রগুণের অধিকারী ছিলেন। উত্তরাধিকারসূত্রে বিদ্যাসাগর যদি তাঁর পরিবার থেকে কিছু পেয়ে থাকেন, তবে তা ছিল চরিত্রের এই তেজ।
প্রকাশকাল ১৮৩৬, প্রকাশক ‘কলিকাতা ট্রাক/ট্র্যাক সোসাইটি’। বইটিতে বর্ণপরিচয় অংশটি নেই, কিন্তু উনিশ শতকের প্রথমার্ধের বাংলা প্রাইমারের যাবতীয় বৈশিষ্ট্য ধরা আছে। বালকের প্রথম পড়িবার বহি গ্রন্থে আছে ছোট ছোট বাক্য গঠন এবং পরে প্রাথমিক পাঠের আয়োজন। পাঠের বিষয় হল— নীতিশিক্ষা এবং বিদ্যালয়ের সুফল সম্পর্কিত বক্তব্য। এ ছাড়া আছে খ্রিস্ট ধর্মের প্রচারমূলক আখ্যান এবং হিন্দু ধর্মের মূর্তিপূজা সম্পর্কে বিরূপ ব্যাখ্যা। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযোগ্য, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বর্ণপরিচয় গ্রন্থের বেশ কিছু বাক্যপাঠ নির্মিত হয়েছে হুবহু বালকের প্রথম পড়িবার বহি গ্রন্থে উল্লিখিত বাক্যপাঠের অনুকরণে।

—আবীর কর



তখনও বিদ্যাসাগরের জন্ম হয়নি। সময়কাল হল ১৮১৬, লঙ সাহেব প্রদত্ত বাংলা ক্যাটালগের তথ্যানুসারে যা বাংলা প্রাইমারের প্রথম প্রকাশকাল হিসেবে চিহ্নিত। ১৮১৬ সালে শ্রীরামপুর মিশনারিরা প্রকাশ করেছিলেন লিপিধারা নামে বর্ণশিক্ষার বই। যদিও এ যাবৎ বইটির কোনও হদিশ মেলেনি, তবে জেমস লঙ-এর তথ্য অনুসারে লিপিধারা নামে ১২ পৃষ্ঠার বইয়ে বাংলা বর্ণের আকৃতি অনুযায়ী ছিল বইটির বর্ণবিন্যাস। অর্থাৎ ভাষাতত্ত্বের পথ মেনে উচ্চারণভিত্তিক নয়, রূপগত বিচারে বর্ণের জ্যামিতিক ফর্ম মেনে প্রকাশিত হয়েছিল বাংলা বর্ণ পরিচয়ের প্রথম বইটি। এর পরের বছর অর্থাৎ ১৮১৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে ‘কলিকাতা স্কুল বুক সোসাইটি’, যার প্রথম ও প্রধান উদ্দেশ্য ছিল পাঠ্যপুস্তক রচনা ও প্রকাশনা। সেই ‘স্কুল বুক সোসাইটি’ থেকে স্টুয়ার্ট সাহেব লিখলেন বর্ণমালা, এই গ্রন্থটিরও উল্লেখ মিলছে লঙ-এর ক্যাটালগ থেকে, লঙ সাহেবের বর্ণনা অনুসারে বর্ণমালা বইয়ের গোড়ায় ছিল বর্ণের পরিচয় পরে ‘ত্র্যক্ষর’ শব্দের বানান। এরপর লঙ-এর ক্যাটালগে যে-বইটির উল্লেখ আছে সেটি রাধাকান্ত দেবের বাংলা বানানের বই। তার বক্তব্য অনুযায়ী বইটি বানান শেখার বই, পৃষ্ঠা সংখ্যা ২৫৬। কিন্তু এই বইটি নিয়ে সংশয়ের বিষয় হল এই যে, রাধাকান্ত দেবের আলোচনায় কোথাও এই গ্রন্থটির উল্লেখ পাওয়া যায় না। সাহিত্য-সাধক চরিতমালা-য় রাধাকান্ত দেব সম্পর্কে আলোচনায় বাংলা শিক্ষাগ্রন্থ (১৮২১)-এর নাম আছে, যেখানে বিষয় হিসেবে প্রাথমিক বাংলা, বাংলা ব্যাকরণ, ইতিহাস ভূগোল, গণিতের সংকলন লক্ষ করা যায়।
স্বভাবতই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সতীদাহপ্রথা নিবারণের জন্য আইন পাস হওয়ার পর আবার একটি আইন প্রণয়ন করে হিন্দু প্রজাদের চটাতে সাহস করা সুবিবেচনা বলে মনে করছিলেন না। বৃহত্তর সমাজে আলোচনা কিন্তু চলছিল। সব থেকে সরব ছিলেন ইয়ং বেঙ্গল দল। তাঁদের মুখপত্র বেঙ্গল স্পেকটেটর ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দে প্রশ্ন তুলে ফেলল, স্ত্রীর মৃত্যুর পর পুরুষ যদি পুনর্বিবাহ করতে পারে তবে নারীকে সেই অধিকার কেন দেওয়া হবে না?

—গোপা দত্তভৌমিক



বিদ্যাসাগরের কর্মমুখর জীবনের অজস্র তরঙ্গভঙ্গের মধ্যে কোন কাজটিকে সর্বাপেক্ষা প্রাধান্য দেওয়া যাবে তা নিয়ে বিস্তর মতভেদ আছে। সমাজ সংস্কার, শিক্ষা সংস্কার, ভাষা ও সাহিত্য— কোনওটিই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। দানধ্যানের কথা নাহয় আপাতত থাক। বিদ্যাসাগর নিজে কিন্তু স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ‘বিধবাবিবাহ প্রবর্ত্তন আমার জীবনের সর্ব্বপ্রধান সৎকর্ম্ম।’ আজকাল অনেকে মনে করছেন বিধবাবিবাহ প্রবর্তনের জন্য এতটা পরিশ্রম ও কষ্টস্বীকার না করে তিনি যদি সাহিত্য চর্চায় সেই সময় ও অধ্যবসায় ব্যয় করতেন তবে চিরস্থায়ী কিছু ফল হত। অর্থাৎ এঁরা মনে করেন কালের গতিতে হিন্দু বিধবাদের বিয়ে একদিন প্রচলিত হতই— এত চাপাচাপি এবং আন্দোলনের দরকার ছিল না। বিশেষত এই কাজ করতে গিয়ে বিদ্যাসাগর রক্ষণশীল সমাজের বিরাগভাজন হন, আর্থিক দিকে নিঃস্ব হয়ে পড়েন এবং যাঁদের উপর ভরসা রেখেছিলেন তাঁরা কার্যকরী সাহায্য না করে সরে দাঁড়ানোতে বঙ্গসমাজের উপর তিনি আস্থা হারিয়ে ফেলেন। এককথায় শেষজীবনে যে তিনি শহর থেকে দূরে বিষণ্ণ এক প্রান্তিক জীবনে নিজেকে সরিয়ে নিলেন তার প্রধান কারণ বিধবাবিবাহ নিয়ে তাঁর প্রাণপণ আন্দোলন। এই ধারণা খুবই সরলীকৃত এবং বিদ্যাসাগর ও বঙ্গসমাজের পারস্পরিক সম্পর্কের লঘু বিচার। বিদ্যাসাগর কেন ‘বিধবাবিবাহ প্রবর্ত্তন’ তাঁর ‘সর্ব্বপ্রধান সৎকর্ম্ম’ বলে বিবেচনা করেছেন সেটি প্রথমত ভেবে দেখা দরকার। তিনিই যে বঙ্গসমাজে বিধবাবিবাহের কথা প্রথম বললেন এমনটা নয়। বস্তুত এই নিয়ে একটা চিন্তাভাবনা অষ্টাদশ শতক থেকেই ছিল। অদ্ভুত এক সমাপতন যে বিধবাবিবাহ আইন পাস (১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দ) হওয়ার ঠিক একশো বছর আগে ঢাকার নায়েব রাজবল্লভ সেন নিজের ছোট মেয়ে অভয়ার অকালবৈধব্যে ব্যথিত হয়ে বিধবাবিবাহের প্রচলন করার চেষ্টা করেন। তাঁর তিনজন দ্বার-পণ্ডিত কৃষ্ণদাস বেদান্তবাগীশ, নীলকণ্ঠ সার্বভৌম এবং কৃষ্ণদেব বিদ্যাবাগীশ জানিয়েছিলেন অক্ষতযোনি বিধবাদের পুনর্বিবাহে হিন্দুশাস্ত্রে কোনও নিষেধ নেই। রাজবল্লভ শুধু এঁদের কথার উপর নির্ভর করে মেয়ের বিয়ে দিতে ভরসা পেলেন না। তিনি কাশী, কাঞ্চী, মিথিলার পণ্ডিতদের কাছ থেকে অনুকূল মত আনালেন। কিন্তু তাঁর প্রয়াস ব্যর্থ হল নবদ্বীপে। নবদ্বীপের পণ্ডিতসমাজ চিরকালই রক্ষণশীল। চৈতন্যদেব ও তাঁর প্রেমভক্তিধর্মকেও তাঁরা সমকালে সুনজরে দেখেননি। তার উপর মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র তখন হিন্দুসমাজের মাথা। তিনি কীভাবে বাধা দিয়েছিলেন তা নিয়ে একটি কিংবদন্তি আছে। বিধবাবিবাহের প্রস্তাব নিয়ে রাজবল্লভের লোক আসার পর কৃষ্ণচন্দ্র তাঁদের যথাবিধি ভোজ্যের সঙ্গে একটি বাছুরও পাঠালেন। কারণ হিসেবে বলা হল বিধবাবিবাহ বহুকাল যাবৎ অপ্রচলিত আছে তা প্রচলিত হতে পারলে শাস্ত্রানুসারে গোমাংস ভক্ষণেও আপত্তি হতে পারে না। এরপর হিন্দুসমাজে আর কারও এগোবার সাহস হবে না বলা বাহুল্য। বিধবাবিবাহ নিয়ে অষ্টাদশ শতকে কেমন মনোভাব প্রচলিত ছিল ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের অন্নদামঙ্গল-এ তার একটি পরিচয় আছে। বাদশা জাহাঙ্গীর ও কৃষ্ণচন্দ্রের পূর্বপুরুষ ভবানন্দ মজুমদারের সম্পূর্ণ কাল্পনিক কথোপকথনে বিষয়টি এসেছে। এটি ধর্মাচার সম্বন্ধে মুসলমান শাসনের শেষপ্রহরে ইসলামি ও হিন্দু দুই বিরোধী পক্ষের ভারতাশ্রীয় ডিসকোর্স। জাহাঙ্গীর বিধবাদের বিষয়ে হিন্দুসমাজের আচারকে ধিক্কার দিলেন,
সেইজন্য বিদ্যাসাগর এই বঙ্গদেশে একক ছিলেন। এখানে যেন তাঁহার স্বজাতি-সোদর কেহ ছিল না। এদেশে তিনি তাঁহার সমযোগ্য সহযোগীর অভাবে আমৃত্যুকাল নির্বাসন ভোগ করিয়া গিয়াছেন। তিনি সুখী ছিলেন না। তিনি নিজের মধ্যে যে এক অকৃত্রিম মনুষ্যত্ব সর্বদাই অনুভব করিতেন, চারিদিকের জনমণ্ডলীর মধ্যে তাহার আভাস দেখিতে পান নাই। তিনি উপকার করিয়া কৃতঘ্নতা পাইয়াছেন, কার্যকালে সহায়তা প্রাপ্ত হন নাই। এই দুর্বল, ক্ষুদ্র, হৃদয়হীন, কর্মহীন, দাম্ভিক, তার্কিক জাতির প্রতি বিদ্যাসাগরের এক সুগভীর ধিক্কার ছিল। কারণ তিনি সর্ববিষয়েই ইহাদের বিপরীত ছিলেন।

—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর



বিদ্যাসাগরের চরিত্রে যাহা সর্বপ্রধান গুণ—যে গুণে তিনি পল্লী আচারের ক্ষুদ্রতা, বাঙালি জীবনের জড়ত্ব সবলে ভেদ করিয়া একমাত্র নিজের গতিবেগপ্রাবল্যে কঠিন প্রতিকূলতার বক্ষ বিদীর্ণ করিয়া— হিন্দুত্বের দিকে নহে, সাম্প্রদায়িকতার দিকে নহে— করুণায় অশ্রুপূর্ণ উন্মুক্ত অপার মনুষ্যত্বে অভিমুখে আপনার দৃঢ়নিষ্ঠ একাগ্র একক জীবনকে প্রবাহিত করিয়া লইয়া গিয়াছিলেন, আমি যদি তাঁহার সেই গুণকীর্তন করিতে বিরত হই, তবে আমার কর্তব্য একেবারেই অসম্পন্ন থাকিয়া যায়। কারণ বিদ্যাসাগরের জীবন-বৃত্তান্ত আলোচনা করিয়া দেখিলে এই কথাটি বারংবার মনে উদয় হয় যে, তিনি যে বাঙালি বড়লোক ছিলেন, তাহা নহে, তিনি যে রীতিমতো হিন্দু ছিলেন, তাহাও নহে—তিনি তাহা অপেক্ষাও অনেক বেশী বড় ছিলেন, তিনি যথার্থ মানুষ ছিলেন।

বিদ্যাসাগরের গৌরব কেবলমাত্র তাঁহার প্রতিভার উপর নির্ভর করিতেছে না। প্রতিভা মানুষের সমস্তটা নহে, তাহা মানুষের একাংশ মাত্র। প্রতিভা মেঘের মধ্যে বিদ্যুতের মতো, আর মনুষ্য চরিত্রের দিবালোক, তাহা সর্বব্যাপী ও স্থির। প্রতিভা মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ অংশ— আর, মনুষ্যত্ব জীবনের সকল মুহূর্তেই সকল কার্যেই আপনাকে ব্যক্ত করিতে থাকে। প্রতিভা অনেক সময় বিদ্যুতের ন্যায় আপনার আংশিকতা বশতই লোকচক্ষে তীব্রতররূপে আঘাত করে এবং চরিত্র-মহত্ব আপনার ব্যাপকতাগুণেই প্রতিভা অপেক্ষা ম্লানতর বলিয় প্রতীয়মান হয়। কিন্তু চরিত্রের শ্রেষ্ঠতাই যে যথার্থ শ্রেষ্ঠতা, ভাবিয়া দেখিলে, সে বিষয়ে কাহারো সংশয় থাকিতে পারে না।
অধ্যক্ষের পদে প্রতিষ্ঠিত হইয়াই তিনি নানা প্রকার সংস্কারকার্যে হস্তার্পণ করেন। (১ম) প্রাচীন সংস্কৃত পুস্তকগুলির রক্ষণ ও মুদ্রণ; (২য়) ব্রাহ্মণ ও বৈদ্য ব্যতীত অন্য জাতির ছাত্রগণের জন্য কলেজের দ্বার উদ্ঘাটন; (৩য়) ছাত্রদিগের বেতনগ্রহণের রীতি প্রবর্তন, (৪র্থ) উপক্রমণিকা, ঋজুপাঠ প্রভৃতি সংস্কৃত শিক্ষার উপযোগী গ্রন্থাদি প্রণয়ন; (৫ম) ২ মাস গ্রীষ্মাবকাশপ্রথা প্রবর্তন; (৬ষ্ঠ) সংস্কৃতের সহিত ইংরাজী শিক্ষা প্রচলন।

—শিবনাথ শাস্ত্রী



এক্ষণে আমরা বঙ্গ সমাজের ইতিবৃত্তের যে যুগে প্রবেশ করিতেছি, তাহার প্রধান পুরুষ পণ্ডিতপ্রবর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। এককালে রামমোহন রায় যেমন শিক্ষিত ও অগ্রসর ব্যক্তিগণের অগ্রণী ও আদর্শ পুরুষরূপে দণ্ডায়মান ছিলেন এবং তাঁহার পদভারে বঙ্গ সমাজ কাঁপিয়া গিয়াছিল, এই যুগে বিদ্যাসাগর মহাশয় সেই স্থান অধিকার করিয়াছিলেন। মানব-চরিত্রের প্রভাব যে কি জিনিস, উগ্র-উৎকট-ব্যক্তিত্বসম্পন্ন তেজীয়ান পুরুষগণ ধনবলে হীন হইয়াও যে সমাজমধ্যে কিরূপ প্রতিষ্ঠা লাভ করিতে পারেন, তাহা আমরা বিদ্যাসাগর মহাশয়কে দেখিয়া জানিয়াছি। যে দরিদ্র ব্রাহ্মণের সন্তান, যাঁহার পিতার দশ-বারো টাকার অধিক আয় ছিল না, যিনি বাল্যকালে অধিকাংশ সময় অর্ধাশনে থাকিতেন, তিনি এক সময় নিজ তেজে সমগ্র বঙ্গ সমাজকে কিরূপ কাঁপাইয়া গিয়াছেন তাহা স্মরণ করিলে মন বিস্মিত ও স্তব্ধ হয়। তিনি এক সময় আমাকে বলিয়াছিলেন—“ভারতবর্ষে এমন রাজা নাই যাহার নাকে এই চটি জুতা সুদ্ধ পায়ে টক করিয়া লাথি না মারিতে পারি।” আমি তখন অনুভব করিয়াছিলাম, এবং এখনও অনুভব করিতেছি ষে, তিনি যাহা বলিয়াছিলেন তাহা সত্য। তাঁহার চরিত্রের তেজ এমনই ছিল যে, তাঁহার নিকট ক্ষমতাশালী রাজারাও নগণ্য ব্যক্তির মধ্যে।

বিদ্যাসাগর মহাশয় ১৮২০ সালে মেদিনীপুর জেলার অন্তঃপাতী বীরসিংহ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। যে ব্রাহ্মণকুলে তিনি জন্মিলেন, তাঁহারা গুণ-গৌরবে ও তেজস্বিতার জন্য সে প্রদেশে প্রসিদ্ধ ছিলেন। তাঁহার পিতামহ রামজয় তর্কভূষণ কোনও পারিবারিক বিবাদে উত্যক্ত হইয়া স্বীয় পত্মী দুর্গাদেবীকে পরিত্যাগপূর্বক কিছুকালের জন্য দেশান্তরী হইয়া গিয়াছিলেন। দুর্গাদেবী নিরাশ্রয় হইয়া বীরসিংহ গ্রামে স্বীয় পিতা উমাপতি তর্কসিদ্ধান্ত মহাশয়ের ভবনে আশ্রয় গ্রহণ করেন। জ্যেষ্ঠ পুত্র ঠাকুরদাস সেই সময় হইতে ঘোর দারিদ্র্যে বাস করিয়া জীবন-সংগ্রাম আরম্ভ করেন। তাঁহার বয়ঃক্রম যখন ১৫ বৎসর হইবে তখন জননীর দুঃখ নিবারণার্থ অর্থোপার্জনের উদ্দেশ্যে কলিকাতাতে আগমন করেন। এই অবস্থায় তাঁহাকে দারিদ্রের সঙ্গে যে ঘোর সংগ্রাম করিতে হইয়াছিল, তাহার হৃদয়বিদারক বিবরণ এখানে দেওয়া নিষ্প্রয়োজন। এই বলিলেই যথেষ্ট হইবে যে, অনেক দিনের পর, অনেক ক্লেশ ভূগিয়া, অবশেষে একটি আট টাকা বেতনের কর্ম পাইয়াছিলেন। এই অবস্থাতে গোঘাটনিবাসী রামকান্ত তর্কবাগীশের দ্বিতীয়া কন্যা ভগবতী দেবীর সহিত ঠাকুরদাসের বিবাহ হয়, ঈশ্বরচন্দ্র তাঁহাদের প্রথম সন্তান।
ঈশ্বরচন্দ্রের ন্যায় তেজস্বিতা, মানসিক বল ও দৃঢ় প্রতিজ্ঞা সকলের সম্ভবে না। ঈশ্বরচন্দ্রের ন্যায় জগৎগ্রাহী সহৃদয়তা, বদান্যতা ও উপচিকীর্ষাও সকলের হইয়া উঠে না। কিন্তু তথাপি ঈশ্বরচন্দ্রের কথা স্মরণ করিয়া আমরা বোধ হয় একটু সোজা পথে চলিতে শিখিতে পারি,—একটু কর্তব্য অনুষ্ঠানে উদ্যম করিতে পারি; একটু ভণ্ডামি ত্যাগ করিতে পারি।

—রমেশচন্দ্র দত্ত



ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর আমাদের মধ্যে আর নাই, কিন্তু পুরুষানুক্রমে বঙ্গবাসীদিগের নিকট প্রাতঃস্মরণীয় হইয়া থাকিবেন। তিনি ইদানীন্তন বঙ্গ সাহিত্যের প্রণেতা, তিনি বঙ্গ সমাজের সংস্কার-কর্তা, তিনি হৃদয়ের ওজস্বিতা ও দাক্ষিণ্যগুণে জগতের একজন শিক্ষা গুরু। গুরু আজ পাঠশালা বন্ধ করিলেন, কিন্তু, তাঁহার কীর্তিমণ্ডিত চিত্রখানি ধ্যান করিয়া দুই-একটি বিষয়ে আজ শিক্ষালাভ করিব।

যাঁহাদিগের বয়ঃক্রম ৪০ বৎসর পার হইয়া গিয়াছে, আজ তাঁহারা নিজ শৈশবাবস্থার করা স্মরণ করিতেছেন। সে সময়ের বঙ্গ সমাজ অদ্যকার সমাজের মতো নহে, তখনকার সাহিত্য অদ্যকার সাহিত্যের ন্যায় নহে। প্রাচীনা গৃহিণীগণ অথবা দোকানী পসারী লোকে রামায়ণ মহাভারত পড়িতেন, যুবকগণ ভারতচন্দ্র আওড়াইতেন, শাক্তগণ রামপ্রসাদের গান গাহিতেন, নব্য সম্প্রদায় নিধুবাবুর টপ্পা গাহিতেন অথবা দাশু রায়ের ভক্ত ছিলেন। বৈষ্ণব পাঠক কেহ কেহ চৈতন্য-চরিতামৃতের পাতা উল্টাইতেন, শাক্ত পাঠক কেহ কেহ মুকুন্দরামের চণ্ডীখানি খুলিয়া দেখিতেন। এই ছিল বাঙ্গলা গদ্যের অবস্থা, সুমার্জিত বাঙ্গলা গদ্য তখনও সৃষ্ট হয় নাই।
ইংরেজ সরকারের আইন উপদেষ্টা ও শিক্ষা সংসদের সভাপতি শিক্ষাবিদ জন ইলিয়ট ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন ছিলেন কেম্ব্রিজ-এর কৃতী ছাত্র, গ্র্যাজুয়েট এবং ব্যারিস্টার। ভারতপ্রেমিক ও মানবতাবাদী এই মানুষটির ভারতবর্ষে তথা কলকাতায় আগমন এদেশের দুর্ভাগা ও অবহেলিত নারীসমাজের কাছে আশীর্বাদস্বরূপ বলা যায়। অনেকের মতে, যিনি এই বেথুন সাহেবকে বাঙালি নারীর শিক্ষাক্ষেত্রে অনগ্রসরতা এবং অসহায়তা সম্পর্কে অবহিত করে এ কাজে এগিয়ে আসতে সার্বিক প্রেরণা জুগিয়েছিলেন, তিনি স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।

—কানাই লাল রায়



অধ্যাপক আহমদ শরীফ তাঁর ‘বিদ্যাসাগর’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘তিনি [বিদ্যাসাগর] নতুন চেতনার জনক, সংস্কার মুক্তির জনক, জীবন-জিজ্ঞাসার জনক, বিদ্রোহের জনক, শিক্ষা ও সংস্কারের জনক, সংগ্রামীর জনক, ত্যাগ-তিতিক্ষার জনক। জনকত্বই তাঁর কৃতি ও কীর্তি। সমকালীন বাংলার সব নতুনেরই জনক ছিলেন তিনি। তিনিই ছিলেন ঈশ্বর। বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁর পরবর্তী কর্মীরা ছিলেন প্রবর্তনাদাতা, সে ঈশ্বরেরই অভিপ্রায়-চালিত নিমিত্ত মাত্র।’

আধুনিক পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যার সঙ্গে আমাদের দেশে লৌকিক সংস্কৃতবিদ্যার যোগসূত্র প্রতিষ্ঠা, শিক্ষাসংস্কার এবং বাংলা ভাষার মাধ্যমে গণশিক্ষা প্রচলন— শিক্ষাক্ষেত্রে এগুলি হল শিক্ষাব্রতী বিদ্যাসাগরের প্রধান কীর্তি। এই কথাটাকে আর একটু পরিষ্কারভাবে বলা যায়, মাতৃভাষাকে বিদ্যার মাধ্যম করা, মৌলিক চিন্তার বিকাশে উৎসাহ দেওয়া ও শিক্ষাকে সব রকমের ধর্মীয় গোঁড়ামি থেকে মুক্ত করে বিষয়বস্তুতে পরিপূর্ণ মানবিক আদর্শের বিকাশ ঘটানো— এই ছিল বিদ্যাসাগরের শিক্ষাপরিকল্পনার মূল কথা। তাঁর আর-একটি কীর্তি হল বালকদের জন্য বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সঙ্গে এদেশে স্ত্রীশিক্ষা প্রচলনের চেষ্টা ও বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন। সেসময় স্ত্রীশিক্ষা পুরুষদের তুলনায় অনেকটাই পিছিয়ে ছিল। জন ইলিয়ট ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন (১৮০১-১৮৫১), যিনি মহাত্মা বেথুন নামে সমধিক খ্যাত, তাঁর সহযোগী রূপে বিদ্যাসাগর বাংলাদেশে স্ত্রীশিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রে পদার্পণ করেন। সেকালে আমাদের দেশে স্ত্রীশিক্ষা সম্বন্ধে নানা বদ্ধমূল কুসংস্কার প্রচলিত ছিল। যেমন, নারীরা শিক্ষিত হলে তারা বিধবা হবে, তারা মুখরা, দুশ্চরিত্রা ও গৃহকর্মবিমুখ হবে। হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার পর আধুনিক পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান-সাহিত্যের নিরবচ্ছিন্ন চর্চার ফলে এদেশের মানুষ, সীমিত সংখ্যায় হলেও, প্রাচীন গোঁড়া সংস্কার থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করেন। এই শিক্ষিত নাগরিক উচ্চ সমাজের মধ্যে ধীরে ধীরে স্ত্রীশিক্ষা সম্বন্ধে প্রাথমিক চেতনা জাগছিল। ঠিক সেই সময় বেথুন ও বিদ্যাসাগর স্থির সংকল্পের সঙ্গে এগিয়ে এলেন স্ত্রীশিক্ষাকে বাস্তবে রূপদান করার জন্য। রাজপুরুষ ডালহৌসি ও হ্যালিডে-র সঙ্গে যুক্ত হল দুই শিক্ষাবিদ বেথুন ও বিদ্যাসাগরের অধ্যবসায়, দৃঢ়তা ও নিষ্ঠা।
আমরা আরম্ভ করি, শেষ করি না; আড়ম্বর করি, কাজ করি না, যাহা অনুষ্ঠান করি তাহা বিশ্বাস করি না, যাহা বিশ্বাস করি তাহা পালন করি না, ভূরিপরিমাণ বাক্যরচনা করিতে পারি, তিলপরিমাণ আত্মত্যাগ করিতে পারি না, আমরা অহংকার দেখাইয়া পরিতৃপ্ত থাকি, যোগ্যতালাভের চেষ্টা করি না, আমরা সকল কাজেই পরের প্রত্যাশা করি অথচ পরের ক্রুটি লইয়া আকাশ বিদীর্ণ করিতে থাকি, পরের অনুকরণে আমাদের গর্ব, পরের অনুগ্রহে আমাদের সম্মান, পরের চক্ষে ধূলিনিক্ষেপ করিয়া আমাদের পলিটিক্স, এবং নিজের বাক্চাতুর্যে নিজের প্রতি ভক্তিবিহ্বল হইয়া উঠাই আমাদের জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য। এই দুর্বল, ক্ষুদ্র, হৃদয়হীন, কর্মহীন, দাম্ভিক, তার্কিক জাতির প্রতি বিদ্যাসাগরের এক সুগভীর ধিক্কার ছিল। কারণ তিনি সর্ববিষয়েই ইহাদের বিপরীত ছিলেন।

—শুভেন্দু সরকার



হরনাথ তর্কভূষণের মৃত্যুর পর ১৮৪৪-এ সংস্কৃত কলেজের ব্যাকরণের অধ্যাপক হওয়ার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-৯১)। বিকল্প হিসেবে তারানাথ তর্কবাচস্পতির নাম তিনি শুধু সুপারিশই করেননি, কলকাতা থেকে হেঁটে অম্বিকা-কালনা গিয়ে তাঁর সম্মতিও নিয়ে আসেন। অথচ দেখা গেল, দু’বছর পর সে-কলেজের সহকারী সম্পাদক হতে বিদ্যাসাগর এককথায় রাজি। এমনকী, দরখাস্তে আত্মপক্ষ সমর্থনে বেশ কিছু যুক্তিও সাজালেন তিনি। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে বাংলা পড়ানোর সময় সংস্কৃত কলেজের বার্ষিক বৃত্তি পরীক্ষার মূল্যায়নে তাঁর সক্রিয় ভুমিকা থাকত। এ ছাড়া, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অধ্যক্ষ মেজর জি. টি. মার্শাল-এর সুপারিশপত্র বিশেষ কাজে দিল। বিদ্যাসাগর নতুন চাকরিতে ঢুকলেন ৬ এপ্রিল ১৮৪৬-এ। প্রশ্ন জাগে: তাঁর মত পালটানোর হেতু কী? ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে নিজের জায়গায় ভাই দীনবন্ধু ন্যায়রত্নকে নিতে অনুরোধ করার পেছনে এর সম্ভাব্য উত্তরটি পাওয়া যাবে। বিদ্যাসাগরের আশঙ্কা ছিল: সংস্কৃত কলেজে তাঁর চাকরি বেশিদিন না-ও টিকতে পারে। প্রাক্তন ছাত্র বলে সংস্কৃত কলেজের শিক্ষা-প্রণালীর নানা খামতির কথা বিদ্যাসাগর জানতেন। সেসব দূর করাই ছিল তাঁর আসল উদ্দেশ্য। তাই অধ্যাপক নয়, প্রশাসকের পদ তিনি বেছে নিলেন। কিন্তু তাঁর পথ যে মসৃণ হবে না— তা নিয়ে বিদ্যাসাগরের দুশ্চিন্তা ছিল।

চাকরি পাওয়ার পরই উঠে-পড়ে লাগলেন বিদ্যাসাগর। ১৯ সেপ্টেম্বর ১৮৪৬-এ সংস্কৃত কলেজের পঠনপাঠন নিয়ে তাঁর সংস্কার-পরিকল্পনাটি শিক্ষাপরিষদে পাঠানোর জন্যে সম্পাদক রসময় দত্তর কাছে দাখিল করলেন। এ ব্যাপারে তিনি চার-পাঁচজন শিক্ষকের সাহায্য পেয়েছিলেন। পরিকল্পনায় ব্যাকরণ পাঠের পদ্ধতি ও পাঠ্যপুস্তকের পরিবর্তন চাওয়া হল। এ ছাড়া, ইংরিজি বিভাগের আমূল সংস্কারও ছিল বিদ্যাসাগরের অভীষ্ট। গোড়া থেকেই নিজের কাছে তাঁর শিক্ষাচিন্তার লক্ষ্য ছিল স্থির। বিদ্যাসাগর বরাবর এমন একদল লোক গড়ে তুলতে চেয়েছেন যারা পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান দিয়ে বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করবে। তাই সংস্কৃতর পাশাপাশি ইংরিজি পড়ানোর ওপর জোর দেন তিনি। এ কথাও ঠিক, ভাল বাংলা লেখার জন্যে সংস্কৃতয় দখল থাকা জরুরি। তখন সংস্কৃত কলেজে ইংরিজি ছিল ঐচ্ছিক বিষয়; বিদ্যাসাগর সেটিকে বাধ্যতামূলকভাবে পড়াতে চাইলেন। বিদ্যাসাগরের প্রকল্পটি ব্যক্তিগতভাবে অনুমোদন করেন মার্শাল।
vidyasagar.info ©