মোট পৃষ্ঠাদর্শন

    ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
        মাইকেল মধুসূদন দত্ত

  বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে।
  করুণার সিন্ধু তুমি, সেই জানে মনে,
  দীন যে, দীনের বন্ধু!—উজ্জ্বল জগতে
  হেমাদ্রির হেমকান্তি অম্লান কিরণে।
  কিন্তু ভাগ্যবলে পেয়ে সে মহা পর্বতে,
  যে জন আশ্রয় লয় সুবর্ণ চরণে,
  সেই জানে কত গুণ ধরে কত মতে
  গিরীশ। কি সেবা তার সে মুখ সদনে।—
  দানে বারি নদীরূপ বিমলা কিঙ্করী;
  যোগায় অমৃত ফল পরম আদরে
  তরুদল, দাসরূপ ধরি;
  পরিমলে ফুলকুল দশ দিশ ভরে;
  দিবসে শীতল শ্বাসী ছায়া, বনেশ্বরী,
  নিশার সুশান্ত নিদ্রা, ক্লান্তি দূর করে!

দীর্ঘ ও বৈচিত্রময় জীবনে বিদ্যাসাগর আরো বহু মেধাবী ব্যক্তির সঙ্গ পেয়েছেন। তাঁদের মধ্যে রাজেন্দ্রলাল মিত্র, মদনমোহন তর্কলংকার, প্যারিচরণ সরকার প্রমুখ। বিদ্যাসাগরের জীবনে প্রত্যেকের অবদান আছে। সে সমস্ত কথা বাকি রেখেই বলতে পারি বিদ্যাসাগর তাঁর মহত্ত্ব দিয়েই এই সম্পর্কগুলো গড়ে তুলতে পেরেছিলেন। তাঁর সুউচ্চ ব্যক্তিত্বই অনেকের মধ্যে থেকে তাঁকে স্বতন্ত্র মহিমা দিয়েছে।

—তুলসীদাস মাইতি



“বিদ্যাসাগর আচারের দুর্গকে আক্রমণ করেছিলেন, এই তাঁর আধুনিকতার একমাত্র পরিচয় নয়। যেখানে তিনি পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যবিদ্যার মধ্যে সম্মিলনের সেতুস্বরূপ হয়েছিলেন সেখানেও তাঁর বুদ্ধির ঔদার্য প্রকাশ পেয়েছে। তিনি যা-কিছু পাশ্চাত্য তাকে অশুচি বলে অপমান করেন নি। তিনি জানতেন বিদ্যার মধ্যে পূর্ব-পশ্চিমের দিগবিরোধ নেই। তিনি নিজে সংস্কৃতশাস্ত্রে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। তিনিই বর্তমান য়ুরোপীয় বিদ্যার অভিমুখে ছাত্রদের অগ্রসর করবার প্রধান উদ্যোগী হয়েছিলেন এবং উৎসাহ ও চেষ্টায় পাশ্চাত্য বিদ্যা আয়ত্ত করে করেছিলেন।”

কথাগুলি রবীন্দ্রনাথের। ১৩২৯ সালের ১৭ শ্রাবণ ব্রাহ্মসমাজ আয়োজিত বিদ্যাসাগর-স্মরণ সভায় তিনি একথা বলেছিলেন। এই কথাগুলি থেকে ‘আধুনিকতম মানুষ বিদ্যাসাগর’— এই প্রসঙ্গের একটা আভাস পাই। বলা বাহুল্য, সমকালীন বঙ্গভূমির সামাজিক ইতিহাসে যে সমস্ত শিক্ষিত মেধাবী মনীষীগণের পরিচয় পাই তাঁদের সাথে বিদ্যাসাগরের মননগত মিল বা অমিল কতখানি তাও এই নিরিখেই করতে চাই।
ঈশ্বরচন্দ্রের “বিদ্যাসাগর” হয়ে ওঠার সদাব্যস্ত প্রক্রিয়ায় তাঁর থেকে বহু দূরে বীরসিংহ গ্রামে শাশুড়ি ভগবতী দেবীর কর্তৃত্বাধীনে দীনময়ী ছিলেন আজীবন ব্রাত্য। তাঁর একাকিত্ব অনুভব করার অবকাশ কখনও পাননি ঈশ্বরচন্দ্র। স্বামীসঙ্গ লাভ থেকে বঞ্চিত ছিলেন দিনময়ী দেবী । তাঁর বুক ফাটলেও মুখ ফুটে কিছুই বলেননি। বিদ্যাসাগর সারাজীবন সমাজের নানাবিধ কার্যাকলাপে ব্যস্ত ছিলেন। পরিবারে তাঁর যে একটি স্ত্রী আছে সেকথা তিনি হয়তো বেমালুম ভুলেই যেতেন। স্ত্রীর নীরব প্রশ্রয়ে বিদ্যাসাগর সাংসারিক কাজ বাদে অন্যকাজে দিনরাত ব্যস্ত থাকতেন। দীনময়ী দেবীর মতো সুশীলাকে জীবনসঙ্গিনী হিসাবে পেয়েছিলেন বলেই হয়তো বিদ্যাসাগর “বিদ্যাসাগর” হতে পেরেছিলেন। দীনময়ী দেবীর ত্যাগ কোনোদিনই আমাদের কাছে প্রাধান্য পায়নি। পর্দার আড়ালে তাঁর মুখ ঢাকা পড়ে যায়।

—দীপক সাহা



দেশের নারীকল্যাণে বিদ্যাসাগরের অবদান অনস্বীকার্য। স্ত্রী-শিক্ষার প্রসার, বাল্যবিবাহ বিরোধিতা করা, বিধবাবিবাহ আইনের সমর্থন প্রভৃতি যুগান্তকারী পদক্ষেপের রূপকার ছিলেন তিনি। নারীদের প্রতি তাঁর অসামান্য অবদানের কথা স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। বিদ্যাসাগর মহাশয় নারীশিক্ষার প্রসারে যেভাবে অবতীর্ণ হয়েছিলেন, তাঁর কাছে এ বঙ্গের সমস্ত নারীদের আজীবন ঋণী থাকতে হবে। নারীও যে মানুষ এবং চেতনাময়ী নারী একটা সুন্দর জীবন যাতে পেতে পারে এই প্রচেষ্টায় তাঁর খামতি ছিল না। সেই চেষ্টার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিকটা ছিল স্ত্রী-শিক্ষার বিস্তার। শিক্ষার আলোয় আলোকিত হলে নারী নিজের ভালোমন্দ বুঝতে পারবে, তার বিরুদ্ধে ঘটে চলা সমস্ত অন্যায়ের প্রতিবাদ করার ক্ষমতা অর্জন করবে, এটা বুঝেছিলেন। তাঁর উৎসাহ, প্রচেষ্টাতেই প্রথম বালিকা বিদ্যালয় তৈরি হয়েছিল। অভাগীদের ঠাকুরঘরে, মনের মন্দিরে অচিরেই বিদ্যাসাগর স্থাপিত হলেন আর এক ঈশ্বর রূপে। ওদিকে বিদ্যাসাগরের হস্ত দ্বারা প্রজ্বলিত নারীশিক্ষার দীপটি শত ঝঞ্ঝায় না নিভে গিয়ে জ্বলে রয়েছে একইভাবে... তাঁর মৃত্যুর বহু বছর পরেও আজও সে দীপশিখা একইরকমভাবে অনির্বাণ।

আজ আলোকপাত করার চেষ্টা করব বিদ্যাসাগরের নিজের ঘরে স্ত্রী-শিক্ষার আলো কতদূর প্রসারিত হয়েছিল।
ইউরোপীয় রেনেসাঁসের এক বিশিষ্ট গোষ্ঠী ছিলেন শিক্ষাব্রতী পণ্ডিতের দল। এঁদের মূল বিদ্যাক্ষেত্র ভাষা ও পাঠচর্চা। অনেকে প্রশাসন বা রাজনীতিতেও যোগ দিতেন, অনেকে দিতেন না; কিন্তু স্রেফ মেধা ও বিদ্যার জোরে এঁদের অনেকে সমাজে ও ধর্মীয় অনুশাসনে প্রভাবশালী ছিলেন। ধর্মবোধ ও নীতিজ্ঞানকে এঁরা যুক্তি ও মনুষ্যত্বের ব্যাপক পরিসরে মুক্তি দিয়েছিলেন। এই বিদ্বানদের হিউমানিস্ট বলা হয়। শব্দটার উৎপত্তি এক বিশেষ ঐতিহাসিক সূত্রে, কিন্তু অবধারিত ভাবে তাতে সঞ্চার হয়েছে ‘হিউমান’ শব্দের বৃহত্তর মনুষ্যত্বের ব্যঞ্জনা। উনিশ শতকের বাংলায় নতুন নৈতিক ও সামাজিক চেতনা বিলক্ষণ সেই হিউমানিস্ট ধাঁচে। বিদ্যাসাগর তার উজ্জ্বলতম প্রাণপুরুষ।

— সুকান্ত চৌধুরী



বিদ্যাসাগর সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ একটা মজার কথা বলেছেন: কাক যেমন কোকিলের ছানা পালন করে, বিধাতা তেমনই ‘বঙ্গভূমির প্রতি বিদ্যাসাগরকে মানুষ করিবার ভার দিয়াছিলেন’। ‘চারিত্রপূজা’-র ওই প্রবন্ধে কবি বাঙালিদের বিস্তর গাল দিয়েছেন। ধন্দে পড়েছেন, কোন বদখেয়ালে বিধাতা চার কোটি বাঙালির মধ্যে বিদ্যাসাগরের মতো ‘দুই-একজন মানুষ’ গড়ে বসেন।

তবু কাক বেচারাই তো কোকিলকে ‘মানুষ’ করে। বিদ্যাসাগরের বিরল মনুষ্যত্ব বঙ্গভূমিতেই লালিত, তার ছাপ যাবে কোথায়? আছে তাঁর ধুতি-চাদর-চটিতে, আধুনিক বাংলা ভাষা সৃষ্টিতে তাঁর অবদানে, বাংলার ছেলেমেয়েদের (হ্যাঁ, মেয়েদেরও) শিক্ষার জন্য তাঁর জীবনভর প্রয়াসে। অথচ ধুতি-চাদর আঁকড়ে থাকার এই জেদে রবীন্দ্রনাথ পাচ্ছেন এক অন্তরস্থ সাহেবিয়ানা— ‘অনুকরণগত সাদৃশ্য’ নয়, চরিত্রগত। সেই সাহেবিয়ানাই তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছে বাঙালি পরিচয়কে তুলে ধরতে।

মোট কথা, তাঁকে নিয়ে আইডেন্টিটি পলিটিক্স চলবে না। দু’শো বছর আগের যুগসন্ধিতে পাশাপাশি গড়ে উঠেছিল ভারতীয় উদ্যোগে নতুন পাশ্চাত্য বিদ্যাচর্চার জন্য হিন্দু কলেজ আর সাহেবি উদ্যোগে সাবেক প্রাচ্য বিদ্যাচর্চার জন্য সংস্কৃত কলেজ। নামেই ফাঁস, দুটোই সোনার পাথরবাটি। সংস্কৃত ভাষা হিন্দু পরিচিতি কি রক্ষা করবে বিজাতীয় কলেজ? কলেজি সাহেবি বিদ্যাই বা ঠাঁই পাবে কোথায়?

শিক্ষা-সংস্কৃতির এই আবর্তে বিদ্যাসাগর ঝাঁপ দিলেন। ছাত্রাবস্থায় সংস্কৃত কলেজে যেটুকু ইংরেজি পড়া যেত পড়লেন, তার পর পড়লেন শিক্ষক রেখে। অধ্যক্ষ হয়ে চাঞ্চল্যকর ‘নোটস’-এ সুপারিশ করলেন, সংস্কৃতের সব ছাত্রকে ইংরেজি শিখতে হবে। সেই বক্তব্য বিস্তারে লিখলেন কাশীর সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ ব্যালেন্টাইন সাহেবের সমীক্ষার জবাবে। ব্যালেন্টাইনের মতে সংস্কৃতের ছাত্রদের ইংরেজি শেখাতে হবে সাবধানে মেপে মেপে, নইলে প্রাচ্য আর পাশ্চাত্য বিদ্যার ঠোকাঠুকিতে তারা ভেবে বসবে সত্য দু’রকম। জ্ঞানের এই দ্বিত্ব বিদ্যাসাগর মানতে পারেননি; দৃঢ় ভাবে বলেছেন সত্য সত্যই, তার খাতিরে কখনও বা প্রাচ্য বিদ্যা ত্যাগ করে নব্য পাশ্চাত্য বিদ্যাকে অধিষ্ঠিত করতে হবে। আক্ষেপ করেছেন, প্রাচীন শাস্ত্রে যদি আধুনিক বিজ্ঞানের লেশমাত্র তত্ত্ব মেলে, কিছু লোকে বিজ্ঞান অস্বীকার করে শাস্ত্রবচনকে আরও আঁকড়ে ধরবে। আজকের ভারতে কথাটা বড়ই প্রাসঙ্গিক।
বিদ্যাসাগরের তিরোভাবের পর ‘সখা’ পত্রিকায় তাঁহার লিখিত দু’তিনটি গল্প প্রকাশিত হইয়াছিল। ১৮৯৩-এ জর্জ ওয়াশিংটনের কাহিনী অবলম্বনে ‘মাতৃভক্তি’ নামক গল্প, ১৮৯৪-এ ‘ছাগলের বুদ্ধি’ নামে অপর একটি গল্প এই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এতদ্ভিন্ন কখনও ‘মুকুল’-এ, কখনও ‘ধ্রুব’তে তাঁহার লিখিত গল্প প্রকাশিত হইয়াছে। পূর্বেই বলিয়াছি, সে যুগ গল্পের যুগ নহে, গঠনের যুগ।

—প্রতিভাকান্ত মৈত্র



বিদ্যাসাগরকে বাঙ্গালা গদ্যের জনক বলা সুযুক্তিসম্মত কি না সে-বিষয়ে মতভেদের অবকাশ যদি-বা থাকে, তবু, বিদ্যাসাগরকে আধুনিক বঙ্গের শিক্ষিত-সমাজের জনক বলিয়া মানিয়া লইতে দ্বিধা থাকিবার কথা নহে। সামগ্রিকভাবে বিচার করিয়া একথা মানিয়া লইতেই হইবে যে, বিংশ শতকের শিক্ষিত-সমাজের জন্মই হইয়াছে বিদ্যাসাগরের আনুকূল্যে। বঙ্গসন্তানকে কেমন করিয়া শৈশব হইতেই ধাপে ধাপে শিক্ষার পথে অগ্রসর করিয়া দিতে হইবে তাহা তিনি গভীর ও ব্যাপকরূপে চিন্তা করিয়াছিলেন। যথার্থ শিক্ষা-বিজ্ঞান বলিতে যাহা বুঝায় তাহা তাঁহার সম্পূর্ণ আয়ত্ত ছিল। যে-কালে বিদ্যাসাগর বর্তমান ছিলেন সেই কালের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষা-সম্পর্কে তাঁহার অবদান পর্যালোচনা করিলে মনে হয় কোনো একজন বাঙ্গালীর দ্বারা শিক্ষা-জগতের এমন সর্বাঙ্গীণ উপকার আর কখনও সাধিত হয় নাই। সর্ববিধ শিক্ষাবিস্তারে তাঁহার দান অপরিসীম।

এ-দেশীয় বালক-বালিকার সংস্কৃত শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা যদিও তিনি অনুভব করিতেন, তবু, তৎকালীন প্রথানুযায়ী টোল বা চতুষ্পাঠীর দীর্ঘসূত্রী শিক্ষায় তাঁহার আস্থা ছিল না। তখনকার দিনে যে সংস্কৃত-শিক্ষাক্রম দীর্ঘ দ্বাদশ বৎসর ধরিয়া আয়ত্ত করিতে হইত তাহা ছয় মাসে আয়ত্ত করিবার ব্যবস্থা বিদ্যাসাগর করিয়াছিলেন তাঁহার ‘সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা’ প্রণয়ন করিয়া। তিনি চাহিয়াছিলেন সমকালীন জীবনযুদ্ধে জয়ী হইবার উপযুক্ত শিক্ষাবিস্তার করিতে। বাঙ্গালা দেশের মানুষ জীবনের নিত্যপ্রয়োজনীয় সকল প্রকার জ্ঞান অর্জন করুক—ইহাই বিদ্যাসাগরের কাম্য ছিল। তৎকালীন পরিবেশে এই কথাটি তিনি স্পষ্ট বুঝিয়াছিলেন যে, মাতৃভাষা ও ইংরাজী ভাষার মধ্য দিয়াই দেশের মানুষকে শিক্ষিত করিয়া তোলা সহজ হইবে। “এই কারণে তিনি বাংলা ‘বর্ণপরিচয়’ দিয়া আরম্ভ করিয়াছেন, এবং শিশুকে ধাপে ধাপে ‘কথামালা’, ‘বোধোদয়’, ‘জীবনচরিত’, ‘চরিতাবলী’ ও ‘আখ্যানমঞ্জরী’-র গল্পগুলির মধ্য দিয়া পূর্ণবিকশিত মনুষ্যত্বের দ্বার পর্যন্ত উত্তীর্ণ করিয়া দিবার ব্যবস্থা স্বয়ং করিয়া গিয়াছেন।” এবম্বিধ শিক্ষা পরিকল্পনার শুরুতেই যে-গ্রন্থের সহিত বিদ্যার্থী বালকের প্রথম পরিচয় হইবার কথা, তাহা, বিদ্যাসাগর-প্রণীত ‘বর্ণপরিচয়’-১ম ও ২য় ভাগ। বিদ্যাসাগরের জীবনের সর্বাধিক স্মরণীয় কীর্তি এই ‘বর্ণপরিচয়’। সুকুমারমতি বালক-বালিকার ভবিষ্যৎ জীবনের বনিয়াদ পোক্ত করিয়া গড়িবার কাজেই এই গ্রন্থের গৌরব সীমায়িত নহে, বাঙ্গালা গল্পসাহিত্যের জন্ম-সম্ভাবনার আকর এই ‘বর্ণপরিচয়’।
বিদ্যাসাগরী ভাষাকে এখন কেউ কেউ কঠিন ভাষা বলেন, কিন্তু আমরা যদি তাঁর সমকালীন লেখকদের রচনার পাশাপাশি রেখে দেখি, তবে নিশ্চয়ই স্বীকার করব, তাঁর ভাষা অতিশয় প্রাঞ্জল ও সুবোধ্য। অন্বয়গুণে প্রতিটি বাক্যের অর্থ সুস্পষ্টঃ শুধু তাই নয়, বিন্যাস-কৌশলে বাক্যগুলি সুললিত। বিষয়ের অনুরোধে স্থানে স্থানে তাঁকে গম্ভীর সংস্কৃত শব্দ ব্যবহার করতে হয়েছে, কিন্তু তাতে লালিত্য ক্ষুণ্ন হয়নি, এবং সন্ধি-সমাসের জটিলতায় অর্থ আচ্ছন্ন হয়নি।

—ধীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়



কর্মবীর রূপে যিনি সর্বজনবন্দিত, সাহিত্য-শিল্পীরূপেও তিনি রেখে গেছেন তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর। জীবনের যে সকল কর্তব্য বিদ্যাসাগরের কাছে সাহিত্য-রচনার চেয়ে বড়ো বলে মনে হয়েছিল, তার প্রতিই তিনি বিশেষভাবে মন দিয়েছিলেন। বই লেখা ছিল নানান কাজের মধ্যে একটি এবং তাও প্রধানতঃ প্রয়োজনের তাগিদে—কখনও বিদ্যার্থীদের জন্য, কখনও সমাজসংস্কারের উদ্দেশ্যে। তথাপি সাহিত্যসৌন্দর্যে মণ্ডিত তাঁর অনেক রচনা—বিশেষ, তাঁর সংস্কৃত কাব্যের ভাবানুবাদ— ‘শকুন্তলা’ ও ‘সীতার বনবাস’। ‘শকুন্তলা’র মূলে আছে কালিদাসের বিখ্যাত নাটক; আর ‘সীতার বনবাসে’র প্রথম দুই পরিচ্ছেদের উৎস ভবভূতির ‘উত্তররামচরিত’, অবশিষ্টাংশের উপাদান প্রধানত; বাল্মীকি রামায়ণের উত্তরকাণ্ড থেকে নেওয়া। ‘রামের রাজ্যাভিষেক’ নামেও একখানি গ্রন্থ তিনি আরম্ভ করেছিলেন, কিন্তু তার কয়েক পৃষ্ঠার বেশী আর অগ্রসর হতে পারেননি। কাব্যানুবাদের বেলায় কেবল আখ্যান-বর্ণনা ও ভাব-পরিবেশনেই তাঁর দৃষ্টি নিবন্ধ ছিল না, তিনি চেয়েছিলেন মূল কাব্যের রস আহরণ করতে, গদ্যের চলনকেও ছন্দোময় করে তুলতে। বাক্যগঠনে অবহিত হলে শুধু যে অর্থকে সুবোধ্য করা যায়, তাই নয়, রচনাকে শ্রুতিমধুর ও তরঙ্গায়িত করে তোলা যায়, তার দৃষ্টান্ত তিনি রেখে গেছেন।

‘এই গিরির শিখরদেশ আকাশপথে সতত সঞ্চরমাণ জলধরপটল-সংযোগে নিরন্তর নিবিড় নীলিমায় অলঙ্কৃত; অধিত্যকাপ্রদেশ ঘনসন্নিবিষ্ট বনপাদপসমূহে সমাচ্ছন্ন থাকাতে, সতত স্নিগ্ধ, শীতল ও রমণীয়; পাদদেশে প্রসন্নসলিলা গোদাবরী তরঙ্গবিস্তার করিয়া প্রবল বেগে গমন করিতেছে।’ [সীতার বনবাস]—এ বাক্যের পর্বে পর্বে যে সুন্দর ধ্বনি-সামঞ্জস্য, তা তাঁর শিল্পবোধেরই অভ্রান্ত নিদর্শন।
দক্ষিণেশ্বরের পূজারীঠাকুরের একবার খেয়াল হ’ল সমুদ্রস্নানের, অমনি অযাচিতভাবে বাদুড়বাগানের বাড়িতে এসে হাজির সাগর-সঙ্গমে। প্রথম সম্ভাষণও অদ্ভুত রকমের। ‘এতদিন ছিলাম খালে-বিলে নদী-নালায়, এবার এসে পড়েছি একেবারে সাগরে’। উত্তরও ঠিক তেমনই, ‘তা বেশ, খানিকটা! নোনা পানি নিয়ে যান।’

—জনার্দন চক্রবর্তী



আমাদের ধারণার অনধিগম্য যে-সমস্ত বিষয় আছে বিদ্যাসাগরের মনুষ্যমহিমা নিশ্চয়ই তেমন একটি বিষয়। এমন একটি মহাজীবনের আলোকে আমরা কিছুটা আভাস পেতে পারি ভূমা কাকে বলে, ভূমৈব সুখং নাল্পে সুখমস্তি, এই সুচিরশ্রুত বাণীরই বা অর্থসঙ্কেত কি? তদ্ধিদ্ধি প্রণিপাতেন পরিপ্রশ্নেন সেবয়া। প্রণিপাত পরিপ্রশ্ন ও সেবা, এই তিনটি সিংহদ্বার অতিক্রম করে জ্ঞানী তত্ত্বদর্শীর উপদেশে অনুভূতির সেই রাজ্যে আমরা প্রবেশাধিকার পেতে পারি। এই মহামানবের বিস্ময়কর প্রতিভা ও বিদ্যাবত্তার পরিমাপ করবার বিগলিত করুণা-মন্দাকিনীর উৎস নির্দেশ করতে পারি এমন সেবা-সুকৃতিও জীবনে সঞ্চয় করা হয়নি। আমাদের সম্বল শুধু প্রণিপাত।

এই প্রণিপাত প্রত্যক্ষ করেছি বিদ্যাসাগরের করুণাসিন্ধুর তটস্থ মহাকবি শ্রীমধুসূদনে। কবির স্বানুভবের স্বচ্ছ দর্পণে প্রতিবিম্বিত হয়েছে এই বিরাট মনুষ্যমহিমা—
                বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে,
                করুণার সিন্ধু তুমি, সেই জানে মনে
                দীন যে, দীনের বন্ধু।

বিদ্যাসাগরের নিকটতম ব্যক্তিসান্নিধ্যে অবস্থান করে এই মহৎ উদার বিশাল কবিপ্রাণ স্বতঃস্ফুর্ত সুগভীর কৃতজ্ঞতার আবেশে জীবন-নাট্যের এক দুর্যোগসন্ধিতে সদ্যঃপরীক্ষালব্ধ নতুন ছন্দে এই কথাগুলি গেঁথেছিলেন। প্রাণসম্পদে রাজাধিরাজ এই মহাকবি নিজের দীনতার অকুণ্ঠ বৈষ্ণবজনোচিত স্বীকৃতি দিয়ে দেবমানবের মনুষ্যমহিমা এবং নামমহিমার কাব্যময় মহিম্নঃ স্তোত্র রচনা করেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ যাকে বিদ্যাসাগরের ‘অক্ষয় মনুষ্যত্ব’ বলেছেন তা তাঁর মানবিকতারই একটি দিক। তাঁর মানবসেবায় আত্মনিয়োগের কথা ইতিমধ্যেই উল্লেখ করা হয়েছে। মানবপ্রীতিই তাঁর মূল প্রেরণা। সম্ভবত রবীন্দ্রনাথ যা বলতে চেয়েছিলেন তা হ’ল এই যে, তাঁর মানবসেবা কোনো ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না।

—হিরণ্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়



ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর একটি অনন্যসাধারণ চরিত্র। উনবিংশ শতাব্দীতে যে সকল ক্ষণজন্মা মহাপুরুষের বাংলাদেশে আবির্ভাব হয়েছিল তাঁদের মধ্যেও তিনি স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে বিশেষভাবে চিহ্নিত ছিলেন। অগণিত গুণের বিচিত্র সমাবেশ নিয়ে তিনি একক মাহাত্ম্যে জীবনের পথে বলিষ্ঠ পদক্ষেপে চলে গেছেন। তিনি যে আছেন তা জীবনের সকল ক্ষেত্রে সকলে অনুভব করেছে এবং সকলেরই শ্রদ্ধা তাঁর প্রতি আপনা হতে আকৃষ্ট হয়েছে। তাঁর জন্মের সার্ধশতবৎসর পূর্তি উপলক্ষে তাঁর চরিত্রের একটি সংক্ষিপ্ত মূল্যায়নের মধ্য দিয়ে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করবার প্রস্তাব করি।

তাঁর সমসাময়িক মানুষদের মন্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়েই এই মূল্যায়ন আরম্ভ করা যাক। মাইকেল মধুসূদন দত্ত শুধু তাঁর সমসাময়িক ছিলেন না, বন্ধু ছিলেন। কাছে থেকে জানবার সুযোগ তাঁর যথেষ্ট হয়েছিল। তিনি বিদ্যাসাগর সম্বন্ধে স্ত্রীর নিকট মন্তব্য করেছিলেন, বিদ্যাসাগর এমন একজন মানুষ ‘যাঁর মনীষা প্রাচীন ‌ঋষিদের মতো, কর্মদক্ষতা ইংরেজের মতো এবং হৃদয়বত্তা বাঙালী জননীর মতো।’ এই উক্তি যে অক্ষরে অক্ষরে তাঁর ওপর প্রযোজ্য তা তাঁর জীবনী হতেই প্রমাণিত হয়।
বিদ্যাসাগর একদিন শিবনাথ শাস্ত্রীকে বলিয়াছিলেন, “দেখ, ভারতবর্ষে এমন কোনো রাজা নাই যাহার নাকে এই চটিজুতাসুদ্ধ পায়ে টক্ করিয়া লাথি না মারিতে পারি।” শিবনাথ শাস্ত্রী লিখিয়াছেন, একথা শুনিয়া তাঁহার একটুও অবিশ্বাস হয় নাই।

—রাধারমণ মিত্র



৬.৪.১৮৪৬ হইতে ১৫.৭.১৮৪৭-এর মধ্যে কোনো এক সময়ের ঘটনা। বিদ্যাসাগর তখন সংস্কৃত কলেজের সহকারী সম্পাদক ও মিঃ জেমস্ কার হিন্দু কলেজের অধ্যক্ষ।

একদিন বিদ্যাসাগর কোনো প্রয়োজনে সংস্কৃত কলেজ হইতে হিন্দু কলেজে কার সাহেবের সহিত সাক্ষাৎ করিতে যান। কার সাহেব তখন তাঁহার কামরায় সম্মুখস্থ টেবিলের উপর পাদুুকা-শোভিত পদযুগল সম্প্রসারিত করিয়া চেয়ারে বসিয়াছিলেন। বিদ্যাসাগরকে দেখিয়া পদযুগল নামাইলেনও না বা গুটাইলেনও না, বরং পায়ের দিকে যে চেয়ার ছিল অঙ্গুলিসংকেতে তাহাতে বিদ্যাসাগরকে বসিতে বলিলেন। সেই অবস্থায় কথাবার্তা সারিয়া বিদ্যাসাগর চলিয়া গেলেন। এই ঘটনার কিছুদিন পরে কি প্রয়োজনে কার সাহেব সংস্কৃত কলেজে বিদ্যাসাগরের সহিত সাক্ষাৎ করিতে যান। বিদ্যাসাগর টেবিলের উপর তাহার তালতলার চটি-শোভিত পদযুগল কার সাহেবের দিকে প্রসারিত করিয়া দিয়া কথাবার্তা বলিলেন। এই ব্যবহারে কার সাহেব অত্যন্ত অপমানিত বোধ করিয়া উপরিওয়ালার নিকট নালিশ করিলেন। বিদ্যাসাগরের নিকট লিখিত কৈফিয়ৎ তলব করা হইলে তিনি উত্তরে যাহা লিখিয়াছিলেন তাহা অবিকল ইংরাজিতেই উদ্ধৃত করিয়া দিলাম দুই কারণে; প্রথম, বাংলা অনুবাদে মূলের তীব্র ব্যঙ্গরস রক্ষা করা সম্ভব হইবে না; দ্বিতীয়, এই সময়ের মধ্যেই তিনি ইংরাজি রচনায় কিরূপ সিদ্ধহস্ত হইয়াছিলেন তাহা দেখাইবার জন্য।
সেই মহামানবের কর্মকীর্তির কথা আমি আর নূতন করিয়া কি বলিব, আর কতটুকুই বা বলিতে পারি? শুধু ইহাই বলিতে পারি—ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বঙ্গজননীর শ্রেষ্ঠতম সন্তান। পৃথিবীর ইতিহাসেও ঠিক এমন একটি চরিত্রের মানুষ আমি খুঁজিয়া পাই নাই।

—আশুতোষ মুখোপাধ্যায়



আমার বয়স যখন দশ বৎসর, তখন আমি বিদ্যাসাগর মহাশয়কে প্রথম দর্শন করি। সেই প্রথম দর্শনের স্মৃতি আমার মনে চিরজাগ্রত। সেই সময়ে তিনি আমাকে একখানি ‘রবিনসন ক্রুশো’ উপহার দিয়াছিলেন। তাঁহার নিজের হাতে দেওয়া সেই উপহারটি আমি সযত্বে এবং শ্রদ্ধার সঙ্গে রক্ষা করিয়াছি তাহার পর আমার কর্ম-জীবনের আরম্ভে আমি আর-একবার তাঁহার সংস্পর্শে আসিয়াছিলাম। তখন তিনি আমাকে তাঁহার মেট্রোপলিটন কলেজে একটি অধ্যাপকের চাকরি দিয়াছিলেন।
বিদ্যাসাগরের উন্নত সুদৃঢ় চরিত্রে যাহা মেরুদণ্ড, সাধারণ বাঙালীর চরিত্রে তাহার একান্তই অসদ্ভাব। মেরুদণ্ডের অস্তিত্ব প্রাণীর পক্ষে সামর্থ্যের ও আত্মনির্ভরশক্তির প্রধান পরিচয়। বিদ্যাসাগর যে সামর্থ্য ও আত্মনির্ভরশক্তি লইয়া জন্ম গ্রহণ করিয়াছিলেন, সাধারণ বাঙালীর চরিত্রে তাহার তুলনা মিলে না।

—রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী



রত্নাকরের রামনাম উচ্চারণের ক্ষমতা ছিল না। অগত্যা ‘মরা’ ‘মরা’ বলিয়া তাঁহাকে উদ্ধার লাভ করিতে হইয়াছিল।

এই পুরাতন পৌরাণিক নজিরের দোহাই দিয়া আমাদিগকেও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের নামকীর্তনে প্রবৃত্ত হইতে হইবে। নতুবা ঐ নাম গ্রহণ করিতে আমাদের কোনোরূপ অধিকার আছে কি না, এ বিষয়ে ঘোর সংশয় আরম্ভেই উপস্থিত হইবার সম্ভাবনা। বস্তুত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এত বড় ও আমরা এত ছোট, তিনি এত সোজা ও আমরা এত বাঁকা যে, তাঁহার নাম গ্রহণ আমাদের পক্ষে বিষম আস্পর্ধার কথা বলিয়া বিবেচিত হইতে পারে। বাঙালী জাতির প্রাচীন ইতিহাস কেমন ছিল, ঠিক স্পষ্ট জানিবার উপায় নাই। লক্ষ্মণসেনঘটিত প্রাচীন কিংবদন্তী অনৈতিহাসিক বলিয়া উড়াইয়া দেওয়া যাইতে পারে; কিন্তু পলাশির লড়াই-এর কিছুদিন পূর্ব হইতে আজ পর্যন্ত বাঙালী-চরিত্র ইতিহাসে যে স্থান লাভ করিয়া আসিয়াছে, বিদ্যাসাগরের চরিত্র তাহা অপেক্ষা এত উচ্চে অবস্থিত যে, তাঁহাকে বাঙালী বলিয়া পরিচয় দিতেই অনেক সময় কুণ্ঠিত হইতে হয়। বাগ্ যত, কর্মনিষ্ঠ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যসাগরও আমাদের মতো! বাক্‌ সর্বস্ব সাধারণ বাঙালী, উভয়ের মধ্যে এত ব্যবধান যে, স্বজাতীয় পরিচয়ে তাঁহার গুণকীর্তন দ্বারা প্রকারান্তরে আত্মগৌরব খ্যাপন করিতে গেলে বোধহয় আমাদের পাপের মাত্রা আরও বাড়িয়া যাইতে পারে।
vidyasagar.info ©