ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

মাইকেল মধুসূদন দত্ত

বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে।
করুণার সিন্ধু তুমি, সেই জানে মনে,
দীন যে, দীনের বন্ধু!—উজ্জ্বল জগতে
হেমাদ্রির হেমকান্তি অম্লান কিরণে।
কিন্তু ভাগ্যবলে পেয়ে সে মহা পর্বতে,
যে জন আশ্রয় লয় সুবর্ণ চরণে,
সেই জানে কত গুণ ধরে কত মতে
গিরীশ। কি সেবা তার সে মুখ সদনে।—
দানে বারি নদীরূপ বিমলা কিঙ্করী;
যোগায় অমৃত ফল পরম আদরে
দীর্ঘশিরঃ তরুদল, দাসরূপ ধরি;
পরিমলে ফুলকুল দশ দিশ ভরে;
দিবসে শীতল শ্বাসী ছায়া, বনেশ্বরী,
নিশার সুশান্ত নিদ্রা, ক্লান্তি দূর করে!

ইতিহাসে বাড়ি বদল

—শেখর ভৌমিক
নগরেতে হইয়াছে গেল গেল রব।
পলাইয়া ক্ষেত্রে যায় নরনারী সব॥
…কাহারো পলায়ে গেল বিধবা বহুড়ী।
এর বাড়ি তার বাড়ি খুঁজিছে শাশুড়ু॥


বিধবাদের জগন্নাথধাম ‘পালানো’ সম্পর্কে এই বর্ণনা পাওয়া যায় ১৮৪৯ সালের ‘সম্বাদ রসরাজ’ পত্রিকায়। উনিশ শতকে এমন পলায়ন সংবাদ রাশি রাশি। অষ্টাদশ শতকেই তো বিজয়রাম সেন বঙ্গবিধবাদের কাশীবাসের কথা লিখে গিয়েছেন, “কাশীর মধ্যেতে আছেন বিধবা জতেক/ সবাকারে দিলা কর্তা [জয়নারায়ণ ঘোষাল] তঙ্কা এক এক।” মনে হয়, দশাশ্বমেধ ঘাটে দাঁড়ানো ‘ঘৃষ্টগাত্রী বাঙালি তরুণী বিধবার দল’ কি এঁদেরই উত্তরসূরি? যাঁদের দেখে ‘মহাস্থবির জাতক’-এ প্রেমাঙ্কুর আতর্থী নিজেকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, সংসারের সব বাধা ছিন্ন করে রোজ সকালে তাঁরা কাকে প্রণাম করেন। লেখক নিজেই উত্তর দিয়েছেন, তাঁরা এখানে আসেন ‘মরবে’ বলে, কারণ এখানে মরলে আর জন্মাতে হয় না। আসলে বালবৈধব্য যন্ত্রণা, মদনদেবতার শর সইতে না পেরে অনেক সময় ‘গর্ভ’ হয়ে পড়া এবং তা ‘নষ্ট’ করতে গিয়ে ভবলীলা সাঙ্গ হওয়া (যেমনটা হয়েছিল চন্দ্রা নামের সেই মেয়ের, যাঁর কাহিনি অনেককাল আগে তুলে ধরেছিলেন রণজিৎ গুহ)— এ তো ছিল সে কালের নিত্যকার ঘটনা। বঙ্গবিধবা এগুলোকে অবশ্য ভাগ্য বলেই মেনে নিয়েছিলেন। তবে এক-আধটু আওয়াজ যে মাঝেমধ্যে ওঠেনি এমন নয়। নিজের শিশুকন্যার বালবৈধব্য ঘোচাতে রাজা রাজবল্লভ অনেক কাল আগে বিধবাবিবাহ প্রচলনে উদ্যোগী হয়েছিলেন, কিন্তু নবদ্বীপের পণ্ডিতসমাজের বিরোধিতায় তা বানচাল হয়ে যায়। ডিরোজিয়োপন্থীদের উদ্যোগের কথা ‘বেঙ্গল স্পেকটেটর’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৪২-এ। তার পর প্রায় এক দশকেরও বেশি সময় অতিক্রান্ত হয়েছে। শেষ পর্যন্ত এই উদ্যোগ সার্থক রূপ পেল বীরসিংহের ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের জ্যেষ্ঠ পুত্রটির মাধ্যমে— বাংলাদেশে যিনি করুণাসাগর বিদ্যাসাগর নামেই বেশি পরিচিত।

বিদ্যাসাগর প্রাথমিক ভাবে কেন বিধবাবিবাহ নিয়ে এগিয়ে আসেন তা নিয়ে উনিশ শতকে তাঁর দুই জীবনীকার বিহারীলাল সরকার এবং চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষ্য আলাদা। তাঁর ছোট ভাই শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্নের বক্তব্যটিই অনেকে বেশি গ্রহণযোগ্য মনে করেন (‘বিদ্যাসাগর-জীবনচরিত ও ভ্রমনিরাস’)। চণ্ডীচরণের মতে, সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক শম্ভুচন্দ্র বাচস্পতির বালিকাবধূর অকালবৈধব্য বিদ্যাসাগরকে এই ‘মহৎ কর্মে ব্রতী’ হওয়ার জন্য প্রাণিত করে। বিহারীলাল লিখেছেন, বীরসিংহে বিদ্যাসাগরের এক বাল্যসহচরী ছিল। সে অকালে বিধবা হয়। এক দিন তিনি শুনলেন একাদশী বলে মেয়েটি সারা দিন খায়নি। আর শুনে তিনি কেঁদেই ফেললেন। তবে এই দুটো ঘটনাই তাঁর ছাত্রজীবনে ঘটা। আর শম্ভুচন্দ্র যা বলছেন তা তাঁর কর্মজীবনের শেষ দিকের। ঘটনা এ রকম যে, এক দিন বিদ্যাসাগর বাড়ির চণ্ডীমণ্ডপে বসে বাবার সঙ্গে স্থানীয় বিদ্যালয়গুলোর অবস্থা সম্পর্কে যখন আলোচনা করছেন, তখনই তাঁর মা ‘রোদন করিতে করিতে’ সেখানে এসে ‘একটি বালিকার বৈধব্য-সংঘটনের উল্লেখ করত,’ তাঁকে বললেন ‘তুই এত দিন যে শাস্ত্র পড়িলি, তাহাতে বিধবাদের কোনও উপায় আছে কিনা?’ তাঁর বাবাও তখন জানতে চাইলেন, ধর্মশাস্ত্রে বিধবাদের প্রতি শাস্ত্রকারেরা কী কী ব্যবস্থা করেছেন? এর পরই নাকি ‘শাস্ত্র-সমুদ্র মন্থন’ করে তিনি লিখলেন ‘বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা’ শীর্ষক প্রবন্ধটি, যা ১৮৫৪-র ফেব্রুয়ারিতে ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’-য় প্রকাশিত হয়। ১৮৫৫-র জানুয়ারিতে প্রকাশিত হল তাঁর ‘বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব।’ এর পরই সৃষ্টি হল প্রবল আলোড়ন। শেষে ১৮৫৬-র ২৬ জুলাই অনুমোদিত হল বিধবাবিবাহ আইন। আর চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘মাসত্রয় অতীত হইতে না হইতেই এ বৎসরের অগ্রহায়ণ মাসের ত্রয়োবিংশ দিবসে বিধবাবিবাহের অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়।’ ১৮৫৬-র ৭ ডিসেম্বর রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কলিকাতার অন্তঃপাতি সিমুলিয়ার সুকেস স্ট্রিটের ১২ সংখ্যক ভবন’-এ পটলডাঙার লক্ষ্মীমণি দেবীর দশ বছরের বিধবা কন্যা কালীমতির সঙ্গে প্রসিদ্ধ কথক রামধন তর্কবাগীশের কনিষ্ঠ পুত্র শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্নের বিবাহ হয়। রাজকৃষ্ণবাবু বিদ্যাসাগরের ‘আ-যৌবন সুহৃদ’। বৌবাজারে থাকাকালীন হৃদয়রাম ওরফে হিদারাম বাঁড়ুয্যের এই পৌত্রটির সঙ্গে বিদ্যাসাগরের পরিচয়। তাঁর কাছেই রাজকৃষ্ণবাবুর সংস্কৃত শিক্ষা।

‘সংবাদ প্রভাকর’-এ এই বিবাহ এবং তার পরবর্তী ঘটনাগুলোর বিস্তারিত বিবরণ প্রকাশিত হয়েছিল। ১৫ অগ্রহায়ণ বিয়ের দিন স্থির হলেও শ্রীশচন্দ্র নাকি ‘সময়কালে মাতৃপ্রতিবন্ধকের ছল করিয়া প্রতিজ্ঞাভঙ্গ’ করেন। পত্রিকায় আবার লিখেছে, ‘লোকে কহিতেছে’ পাত্রী বিধবা নয়, ন্যায়রত্ন মহাশয় অনেক টাকা দিয়ে কুমারী মেয়ে কিনে এনেছেন। শেষ অবধি অবশ্য ৭ ডিসেম্বর বিবাহটি হয়। বাবু রামগোপাল ঘোষ, রমাপ্রসাদ রায়, দিগম্বর মিত্র, প্যারীচাঁদ মিত্র বা কালীপ্রসন্ন সিংহের মতো সমকালীন কলকাতার তাবড় ‘সেলেব’রা সেখানে হাজির ছিলেন। ‘ভাস্কর সম্পাদক’ নাকি ‘নাকে চশমা দিয়া পাঁজি পুঁথি খুলিয়া উক্ত বিবাহ সমাজের মধ্যস্থলে বসিয়া ছিলেন।’ আর ‘রঙ্গতৎপর লোক সমারোহে রাজপথ আচ্ছন্ন হইয়াছিল, সারজন সাহেবরা পাহারাওয়ালা লইয়া জনতা নিবারণ করেন’। লক্ষ্মীমণি নাকি পাত্রের ‘চক্রাকার রূপচাঁদের মোহন মন্ত্রে মুগ্ধা’ হয়ে তাঁকে কন্যা সম্প্রদান করেন। আর 
‘কড়ি দে কিনলেম্,
দড়ি দে বাঁদলেম,
হাতে দিলেম মাকু,
একবার ভ্যা করতো বাপু’

—মহিলাদের এ জাতীয় ‘প্রার্থনায়’ বরবাবাজি নাকি ‘ভ্যা ও করিয়া ছিলেন।’ পত্রিকা লিখছে, ‘এইক্ষণে বিদ্যাসাগর আনন্দসাগর সলিলে পরিপূর্ণ হইয়াছেন’ এবং এই বিবাহে ‘বাবু রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গৃহ পবিত্র হইয়াছে।’

বৌবাজার ত্যাগ করে সুকিয়া স্ট্রিটে বাড়ি তৈরি করে রাজকৃষ্ণবাবুর বসবাসের কথা কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্যের স্মৃতিকথায় পাওয়া যায়। আর এই বাড়িতেই যে বিবাহটি অনুষ্ঠিত হয় তা নিয়েও সংশয় নেই। কিন্তু প্রশ্ন হল আজ সেই বাড়িটির অবস্থান কোথায়? ১৯৬১-তে শ্রীপান্থ লিখেছেন, সুকিয়া স্ট্রিটের এই অংশের নাম আজ কৈলাস বোস স্ট্রিট। বাড়ির সংখ্যাও আর ‘১২’ নেই। যদি কেউ বাংলার প্রথম বিধবাবিবাহ বাসরটি খুঁজে পেতে চান, তা হলে “এ দিকে সে দিকে ঘুরে তাঁকে দাঁড়াতে হবে ‘৪৮ এ’ এবং ‘৪৮ বি’ নম্বর আঁটা যমজ বাড়িটির সামনে।” পরবর্তী কালে সুনীল মুন্সি (১৯৭৪) এবং রাধারমণ মিত্রও (১৯৭৭) এই ‘৪৮’ সংখ্যক বাড়িটিকেই অতীতের ১২ নং বলে নির্দিষ্ট করেছেন।

১৮৫৯-৬৯ সালের কলকাতার ‘স্ট্রিট ডিরেক্টরি’গুলোতে ‘১২’ সংখ্যক বাড়িতে রাজকৃষ্ণবাবুর নাম পাওয়া যাচ্ছে, এক বার তাঁর সঙ্গে পদ্মলোচনেরও নাম আছে। তার পুব দিকে ‘১৩’-তে ছিল থানা এবং ‘১৪’-র মুখে রঘুনাথ চট্টোপাধ্যায় স্ট্রিট। তখন এই রাস্তায় ২৩ নং বাড়ির অস্তিত্ব ছিল না। ১৮৬৯-৭০’এর মধ্যে পুরনো ১২ থেকে ১৪ নম্বরের জায়গায় অনেক নতুন বাড়ি ওঠে, এবং পুরসভার খাতায় নতুন নম্বর দাঁড়ায় ১২ থেকে ২৪। ১৮৭০-এর ডিরেক্টরিতে প্রথম ২৩ নম্বরে পাচ্ছি রাজকৃষ্ণবাবুকে। আর ১৮৭১-এ ১২ নম্বরের বাসিন্দা প্রিয়নাথ দত্ত। সম্ভবত রাজকৃষ্ণবাবু এই সময় ২৩ নম্বরে নতুন বাড়ি করে উঠে আসেন। ১৮৭০-৭১-এর ডিরেক্টরিতে ২৪ নম্বরে রয়েছে বিদ্যাসাগরের সংস্কৃত প্রেস ডিপজ়িটরি। ১৮৭২-এর ডিরেক্টরিতে দেখছি ২৪ সংখ্যক ভবনে বিদ্যাসাগর প্রতিষ্ঠিত ‘মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন’। পূর্ণচন্দ্র দে কাব্যরত্ন, উদ্ভটসাগর ১৯৩০ নাগাদ লিখেছেন, “এখন সুকিয়া স্ট্রিটের পার্শ্বস্থিত স্বর্গত রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের বাড়ির পূর্বদিকে লাহা-বাবুদের যে প্রাসাদ রহিয়াছে, ঠিক সেইখানেই বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ‘মেট্রোপলিটন কলেজ’ ছিল।” ১৯১৫-র পি এম বাকচি-র ‘কলিকাতা স্ট্রিট ডাইরেক্টরি’তেও ২৩ নং বাড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়দের। আরও পরে এই ‘২৩’ সংখ্যক বাড়িটির পরিবর্তিত ঠিকানা দাঁড়ায় ‘৪৮’, যে কথা শ্রীপান্থ প্রমুখ লিখেছেন। বর্তমানেও ৪৮এ নং বাড়িতে বাস করেন রাজকৃষ্ণের উত্তরসূরিরাই।

খটকা লেগেছিল কয়েক মাস আগে। বিদ্যাসাগর কলেজের আশপাশ চিনতে এই কলেজের ইতিহাস বিভাগের ছাত্রছাত্রীরা যখন এই অ়ঞ্চলটি পায়ে হেঁটে দেখতে বেরোয়, তখন ওদের সঙ্গে থাকার সুযোগ হয়েছিল। আর তখনই কিছু প্রশ্ন আসে। প্রথমত পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য মহাফেজখানায় রাখা ১৮৯৪ সালের এক জরিপ নকশায় (সমীক্ষা ১৮৮৭-৯৩) ‘১২’ সুকিয়া স্ট্রিটের যে অবস্থান, মদন মিত্র লেনের বিপরীতে, তার সঙ্গে এখনকার ৪৮এ/বি কৈলাস বোস স্ট্রিটে বিধবাবিবাহ বাসরের গল্পটা ঠিক মেলানো যাচ্ছে না। কারণ রাজকৃষ্ণবাবুর যে ‘২৩’ সংখ্যক বাড়ি (যা পরে ‘৪৮’ হয়েছে), তার অবস্থান মদন মিত্র লেনের মুখ থেকে অনেকটা পুবে, এর মাঝে অনেকগুলো ‘premises’ রয়েছে। অন্তত ১৮৭১-এর স্ট্রিট ডিরেক্টরি থেকে ১৮৯৩-তে প্রকাশিত প্যারীমোহন দাস-এর ‘কলিকাতা পথ-প্রদর্শক এবং ডাইরেক্টরি’ পর্যন্ত সুকিয়া স্ট্রিটে মদন মিত্র লেনটি যেখানে শুরু হচ্ছে, তার ঠিক দক্ষিণ দিকের বা বিধান সরণি দিয়ে ঢুকলে ডান দিকের বাড়ির (তখন ১২, বর্তমান ৩২ নং) বাসিন্দা (occupier) হিসেবে পাচ্ছি প্রিয়নাথ দত্তকে। কলকাতা পুরসভার ১৮৯০-৯২’এর নথি অনুযায়ী ১২ নং এই দোতলা বাড়ির মালিক ছিলেন মন্তাজি (মাহাতাজি) গয়ালি এবং লাগোয়া ১১ নং বাড়িও ছিল হীরালাল পাঠক গয়ালির (গয়ার পাণ্ডাদের ‘গয়ালি’ বলা হত)। ‘মনোমোহন বসুর অপ্রকাশিত ডায়েরি’তে প্রিয়নাথ দত্তকে ‘রাধাকৃষ্ণ মাহাতো (মাহাতা) নামক গয়ালীর গমস্তা’ হিসেবেই পরিচয় দেওয়া হয়েছে। ১৯১৫-য় এই বাড়ির বাসিন্দা নারায়ণলাল মহৎ। ১৯৩৬-এ ৩২ কৈলাস বোস স্ট্রিটের বাড়ির বাসিন্দা এন এল মাহাতা (N L Mahata)। অনুমান করা যায় নারায়ণলাল মহৎ ও এন এল মাহাতা একই ব্যক্তি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে সে কালে অনেকেই গয়ার পাণ্ডাদের ঘরবাড়ি বা জমি দান করতেন। ৩২ নং বাড়ির মালিক বাস্তবিকই ছিল এই মাহাতা পরিবার। এর বর্তমান বাসিন্দা শিশু মণ্ডল বাড়ি হস্তান্তরের সময় গয়ার পাণ্ডারা এসেছিলেন বলে জানিয়েছেন। তথ্যটি সমর্থন করেছেন গয়ার কৃষ্ণদ্বারিকা মহল্লার বাসিন্দা, নারায়ণলালের অন্যতম অধস্তন পুরুষ অরুণলাল মাহাতা। পাশাপাশি তিনি আরও জানিয়েছেন ‘ঠনঠনের কোনও এক দত্ত’ নাকি এই বাড়ি তাঁদের দিয়েছিলেন। তা হলে কি রাজকৃষ্ণবাবুই ১৮৬৯-৭০-এর মধ্যে দত্তদের কাছে ওই ১২ নং বাড়িটি বিক্রি করেছিলেন?

মানচিত্র অনুযায়ী এটা স্পষ্ট যে, রাজকৃষ্ণবাবুর যে বাড়িতে (১২ নং সুকিয়া স্ট্রিট) প্রথম বিধবাবিবাহটি হয়েছিল তা কোনও মতেই আজকের ৪৮ নং কৈলাস বোস স্ট্রিট নয়। কারণ ১৮৫৯-র ‘ডিরেক্টরি’-তে ‘১২’-র যা অবস্থান, উনিশ শতকের প্রায় শেষ দিকের মানচিত্রে তার অবস্থানে বিশেষ বদল ঘটেনি। এটা বলা হচ্ছে কর্নওয়ালিস স্ট্রিট, রঘুনাথ চট্টোপাধ্যায় স্ট্রিট ও মদন মিত্র লেনের অবস্থানসাপেক্ষে। আজও মদন মিত্র লেনের মুখোমুখি ঠায় দাঁড়িয়ে ৩২ কৈলাস বোস স্ট্রিট, সে দিনের ১২ নং সুকিয়া স্ট্রিটের ‘premises’। ‘১২’ বদলে গিয়ে ‘২৩’ (পরবর্তী কালের ৪৮ কৈলাস বোস স্ট্রিট) হয়নি কারণ দু’য়ের মাঝে আজ প্রায় ছ’খানা বাড়ির দূরত্ব। সুতরাং এই ‘৪৮’ রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের দ্বিতীয় আশ্রয় বলেই ধরা যেতে পারে, প্রথম ভদ্রাসন এখানে ছিল বলে মনে হয় না। যাই হোক অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় ধরে প্রচলিত ও এই বিধবাবিবাহের প্রথম বাড়ি-সংক্রান্ত ধারণার পুনর্বিবেচনা তাই প্রয়োজন।

রাজকৃষ্ণবাবুর বাড়ি থেকে যার সূচনা, তার সাফল্য কত দূর? মনে রাখতে হবে বিধবাবিবাহ নিয়ে আজও আমাদের ‘কেমন কেমন ভাব’টাকে। বিদ্যাসাগরের লড়াই ছিল সারা জীবনের। ‘শ্রীশচন্দ্রকে বৃক্ষে তুলিয়া দিয়া নিম্নে দণ্ডায়মান থাকিয়া সাহস প্রদান করিতেছেন’ বলে ‘প্রভাকর’-এর তির্যক মন্তব্যও সইতে হয়েছে তাঁকে। বালির কয়েক জন ভদ্রসন্তান ওই অনুষ্ঠানে কেবল দর্শক থাকার অপরাধেই অপদস্থ হন। আর ‘সুরধুনী কাব্য’য় উল্লিখিত ‘বিধবা সধবা করা পথ প্রদর্শক’ শ্রীশচন্দ্র তো স্ত্রীর মৃত্যুর পর প্রায়শ্চিত্ত করেই জাতে ওঠেন। আবার অন্য ছবিও ‘প্রভাকর’ই তুলে ধরেছিল— সিউড়ির শ্রীহরি চক্রবর্তী ‘জ্ঞাতি কুটুম্বের তাড়না’ সত্ত্বেও ‘বিধবাপত্নী ত্যাগপূর্বক প্রায়শ্চিত্ত করিয়া সমাজ ভুক্ত হইতে সম্মত’ হননি। তবে ‘বিধবার গর্ভ হওয়াতে সমাজ ভয়ে উহার আত্মীয়গণ ঔষধ প্রয়োগ বশত তাহা নষ্ট করে’— এ জাতীয় খবর উনিশ শতকের শেষ দিককার পত্রপত্রিকায়ও অজস্র। এমনকি হুগলিতে দুই যুবতী বিধবার মধ্যে সমকামী সম্পর্কের ইঙ্গিতও আছে ‘সম্বাদ রসরাজ’-এর মতো কাগজে। তা হলে কি বলব সার কথাটা অনেককাল আগেই বুঝে গিয়েছিলেন জানবাজারের ওই বুদ্ধিমতী মহিলাটি? ১২৮৬ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত ‘রাণী রাসমণির জীবনচরিত’-এ হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছিলেন, সহমরণ প্রথা উঠিয়ে দেওয়ার সংবাদে রাণীর প্রতিক্রিয়া ছিল— এটা “ভালই বটে, কিন্তু বঙ্গ বিধবাদের পরিত্রাণের অন্যবিধ উপায় রহিল না। তাহারা যে কত কলঙ্ক রাশিতে কলঙ্কিত হইবে বলা যায় না।” হেমচন্দ্র আরও বলছেন, “বিশ্বস্তসূত্রে অবগত হওয়া গিয়াছে যে, তিনি (রাসমণি) বিধবাবিবাহের উপসংহার ও বহুবিবাহ পুস্তকের অনেকাংশ শ্রবণ করিয়া সময়ে সময়ে অশ্রুবর্ষণ করিয়াছিলেন।”

২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮ খ্রীস্টাব্দে প্রকাশিত।


কোন মন্তব্য নেই

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন

vidyasagar.info ©