ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

মাইকেল মধুসূদন দত্ত

বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে।
করুণার সিন্ধু তুমি, সেই জানে মনে,
দীন যে, দীনের বন্ধু!—উজ্জ্বল জগতে
হেমাদ্রির হেমকান্তি অম্লান কিরণে।
কিন্তু ভাগ্যবলে পেয়ে সে মহা পর্বতে,
যে জন আশ্রয় লয় সুবর্ণ চরণে,
সেই জানে কত গুণ ধরে কত মতে
গিরীশ। কি সেবা তার সে মুখ সদনে।—
দানে বারি নদীরূপ বিমলা কিঙ্করী;
যোগায় অমৃত ফল পরম আদরে
দীর্ঘশিরঃ তরুদল, দাসরূপ ধরি;
পরিমলে ফুলকুল দশ দিশ ভরে;
দিবসে শীতল শ্বাসী ছায়া, বনেশ্বরী,
নিশার সুশান্ত নিদ্রা, ক্লান্তি দূর করে!

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

—মহাত্মা গান্ধী

বাংলাদেশে বিলাতী মাল বর্জনের জন্য যে জোর আন্দোলন চলছে, এটা সাধারণ ঘটনা নয়। বাংলাদেশে যথেষ্ট শিক্ষা বিস্তার হয়েছে এবং বাঙালীরা বেশ বুদ্ধিমান জাতি। সেইজন্য ওখানে এমন আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে। স্যার হেনরি কটন বলেছেন, বাংলা কলকাতা থেকে পেশোয়ার পর্যন্ত শাসনকার্য চালায়। এর কারণ জানার প্রয়োজন আছে।

এটা নিশ্চিত যে, প্রত্যেক জাতির উন্নতি বা অবনতি তার বিশিষ্ট জনকের উপর নির্ভর করে। যে জাতির মধ্যে ভালো ভালো লোক জন্মায়, তার উপর ঐসব লোকদের প্রভাব না পড়ে যায় না। বাঙালীদের কিছু বিশেষত্ব আমি দেখিয়ে দিচ্ছি। এর কিছু কারণ আছে, যার মধ্যে মুখ্য কারণ হ’ল যে, গত শতাব্দীতে বাংলাদেশে বহু মহাপুরুষ জন্মেছেন। রামমোহন রায়ের পর ওখানে একের পর এক মহাপুরুষের আগমন হয়েছে, যাঁদের মধ্যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে সর্বশ্রেষ্ঠ বলা যায়। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর উপাধি লাভ করেন। তাঁর সংস্কৃত ভাষায় জ্ঞান এত বেশী ছিল যে, কলকাতার বিদ্বৎ সমাজ তাঁকে বিদ্যাসাগর উপাধি দেন। তবে ঈশ্বরচন্দ্র শুধু বিদ্যাসাগরই ছিলেন না, তিনি দয়া, উদারতা ও অন্য অনেক সদগুণেরও সাগর ছিলেন। উনি হিন্দু, তার ওপর ব্রাহ্মণও ছিলেন, কিন্তু তাঁর কাছে যিনি ভালো ব্রাহ্মণে-শূদ্রে, হিন্দু-মুসলমানে কোনো ভেদ ছিল না। যিনি ভালো কাজ করেন তিনি উচ্চ-নীচে প্রভেদ করেন না। তাঁর গুরুর ওলাউঠা রোগ হয়েছিল, তিনি তাঁর সেবা-শুশ্রূষা করেছিলেন। নিজে খরচা করে ডাক্তার আনিয়েছিলেন, নিজের হাতে মলমূত্র পরিষ্কার করেছিলেন।

উনি চন্দ্রনগরে দই রুটি কিনে গরীব মুসলমানদের খাওয়াতেন এবং প্রয়োজন হলে পয়সা দিয়ে সাহায্য করতেন। রাস্তায় কোনো পঙ্গু অক্ষম দুঃখী দেখলে তাকে নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে তার দেখা-শোনা করতেন। উনি পরের দুঃখকে নিজের দুঃখ ও পরের সুখকে নিজের সুখ বলে মনে করতেন। তাঁর নিজের জীবন অত্যস্ত সাদাসিধা ছিল। অঙ্গে মোটা ধুতি, মোটা চাদর এবং পায়ে সাধারণ চটি, এই ছিল ওনার পোশাক। ঐ পোশাকে উনি গভর্নরের সঙ্গে দেখা করতেন ও ঐ পোশাকেই গরীবদের অভ্যর্থনা জানাতেন। ঐ ব্যক্তি সত্যকারের ফকির, সন্ন্যাসী অথবা যোগী ছিলেন। ওঁর জীবন পর্যালোচনা করে আমরা শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি।

মেদিনীপুর তালুকের ছোট এক গাঁয়ে গরীব মা-বাবার ঘরে ঈশ্বরচন্দ্রের জন্ম হয়েছিল। তাঁর মা খুব সাধ্বী ছিলেন। আপনার মায়ের অনেক গুণ তিনি পেয়েছিলেন। তাঁর পিতা খুব কম ইংরেজি জানতেন। তিনি নিজ পুত্রকে উচ্চ ইংরেজি শিক্ষা দানের সঙ্কল্প নেন। পাঁচ বছর বয়সে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বিদ্যাশিক্ষা আরম্ভ হয় এবং আট বছর বয়সে উচ্চ শিক্ষার জন্য তিনি ষাট মাইল দূরে কলকাতায় পড়তে যান। সেখানে সংস্কৃত কলেজে ভর্তি হন। ওনার স্মরণশক্তি এত প্রখর ছিল যে, উনি কলকাতা পৌঁছাতে পৌঁছাতে মাইল-স্টোনের সংখ্যা দেখে ইংরেজি সংখ্যা শিখে নিয়েছিলেন। ষোলো বছর বয়সেই ওনার খুব ভালো সংস্কৃত শেখা হয়ে গিয়েছিল এবং উনি সংস্কৃতের অধ্যাপক নিযুক্ত হয়েছিলেন। যে কলেজের তিনি ছাত্র ছিলেন, ধাপে ধাপে উঠতে-উঠতে সেই কলেজেরই তিনি প্রধান আচার্যের পদ লাভ করেন। সরকার তাঁকে খুব মান্য করতেন। কিন্তু নিজের স্বতন্ত্র প্রকৃতির জন্য, উনি শিক্ষা বিভাগের এক ডাইরেক্টরের কথা সহ্য করতে পারেননি এবং সে-কারণে ঐ কাজে ইস্তফা দেন। বাঙলার তৎকালীন লেফটেনান্ট গভর্নর স্যার ফ্রেড্রিক হেলিডে তাঁকে পদত্যাগ না করার জন্য অনুরোধ করেন, কিন্তু সে অনুরোধ তিনি রক্ষা করতে অক্ষমতা জানান।

চাকরি ছাড়ার পর ঈশ্বরচন্দ্রের মহত্ত্ব ও মানবিকতার পরম বিকাশ ঘটে। তিনি দেখলেন তাঁর সুন্দর মাতৃভাষায় রচিত গ্রন্থের সংখ্যা খুব কম। তাই তিনি বাংলায় গ্রন্থ রচনা শুরু করলেন। উনি ছোটদের জন্য খুব সুন্দর অনেকগুলি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। আজ বাংলা ভাষার যে বিকাশ দেখা যায় তার জন্য বিদ্যাসাগরের শ্রেষ্ঠ সম্মান পাওয়া উচিত।

তারপর উনি দেখলেন পুস্তক রচনাই যথেষ্ট নয়। তার জন্য তিনি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হন।। কলকাতার মেট্রোপলিটান কলেজ বিদ্যাসাগরের প্রতিষ্ঠিত। এবং প্রারম্ভ থেকে ঐ কলেজ ভারতীয়দের দ্বারা পরিচালিত।

উচ্চ শিক্ষার যেমন প্রয়োজন, প্রাথমিক শিক্ষারও তেমনই প্রয়োজন। সেই কাজে সরকারের সহায়তা প্রয়োজন ছিল। লেফটেনান্ট গভর্নর বলেছিলেন যে, সরকার ব্যয়ভার বহন করবেন। সেই আশ্বাসে বিদ্যাসাগর গরীবদের জন্য প্রাথমিক পাঠশালা স্থাপন করেন। কিন্তু বড়লাট লর্ড এলেনবেরি এর বিরুদ্ধে ছিলেন। সে-কারণে বিদ্যাসাগর যখন খরচের জন্য আবেদন জানান তখন তা মঞ্জুর করা হয়নি। লেফটেনান্ট গভর্নরের তাতে খুবই দুঃখ হয় এবং তিনি বিদ্যাসাগরকে বলেন— ‘আপনি আমার বিরুদ্ধে নালিশ করুন।’ বীর বিদ্যাসাগর তার জবাবে বলেন— ‘আমি নিজের প্রয়োজনে আদালতে যাইনি, আপনার বিরুদ্ধে নালিশ করব, এ কেমন করে সম্ভব?’ তিনি নিজে খুব ধনী ব্যক্তি ছিলেন না, তাই অপরের দুঃখ দূর করতে গিয়ে তাঁর অনেক ঋণ হয়। কিন্তু নিজের প্রয়োজনে অন্যের সাহায্য নিতে তিনি কখনও স্বীকৃত হননি।

উনি উচ্চ শিক্ষা ও প্রাথমিক শিক্ষার বুনিয়াদ স্থাপন করেই সন্তুষ্ট হতে পারেননি। উনি দেখলেন, স্ত্রী শিক্ষার অভাবে

শিশুদের প্রকৃত শিক্ষা হওয়া সম্ভব নয়। উনি মনুস্মৃতি খুঁজে এক শ্লোক বার করেন যাতে বলা হয়েছে, স্ত্রীলোকদের শিক্ষা দেওয়া আমাদের কর্তব্য। তাই স্ত্রীলোকদের শিক্ষার উপযোগী করে তিনি পুস্তক রচনা করেন এবং বীটন (বেথুন) সাহেবের সহযোগিতায় মেয়েদের শিক্ষার জন্য বেথুন কলেজ স্থাপন করেন। কলেজ প্রতিষ্ঠার চেয়ে ছাত্রী যোগাড় করা অনেক কঠিন কাজ। উনি স্বয়ং সাধু-জীবন যাপন করতেন এবং মহান বিদ্বান ছিলেন, সে-কারণে তাঁকে সমস্ত লোক সম্মান করতেন, তাই উনি যখন সম্মানিত ব্যক্তিদের কাছে তাঁদের মেয়েদের কলেজে পাঠানোর কথা বললেন তাতে সকলেই সাড়া দিলেন। সম্মানিত ঘরের মেয়েরা কলেজে যেতে আরম্ভ করল।

কিন্তু তাতেও উনি সন্তুষ্ট হতে পারেননি। ছোট মেয়েদের প্রাথমিক শিক্ষার জন্য উনি ঐ কলেজেরই প্রাঙ্গণে পাঠশালা খোলেন। সেখানে মেয়েদের জামা-কাপড়, খাবার, বই প্রভৃতি দেওয়া হ’ত। এসবের জন্যই এখন কলকাতায় হাজার-হাজার শিক্ষিতা মেয়ে দেখা যায়।

উনি হিন্দু-বিধবাদের অসহনীয় অবস্থা দেখে বিধবা-বিবাহের উপদেশ দিতে শুরু করেন। সে কাজের জন্য তিনি পুস্তক রচনা করেন ও বহু ভাষণ দেন। বাংলার ব্রাহ্মণকুল তাঁর বিরোধিতা করেন, কিন্তু তিনি তাতে নিরুৎসাহ হননি। তাঁকে হত্যার জন্যও লোকেদের নীচতা প্রকাশ পায়, তিনি প্রাণের ভয় করতেন না। বিধবা-বিবাহ বৈধ করার জন্য তিনি সরকারকে দিয়ে আইন প্রণয়ন করান। তিনি বহু লোককে বুঝিয়েছিলেন এবং অনেক সম্মানিত বংশের বাল্যবিধবাদের তিনি পুন-বিবাহের ব্যবস্থা করেন। তিনি নিজ পুত্রেরও এক দরিদ্র বিধবার মেয়ের সঙ্গে বিবাহ দেন।

তখন কুলীন ব্রাহ্মণরা বহু বিবাহ করত। তাদের কি না ত্রিশটি পর্যন্ত বিবাহ হ’ত। সেই সব স্ত্রীদের দুঃখে বিদ্যাসাগর কাঁদতেন। ঐ কুপ্রথা বন্ধের জন্য তিনি, জীবনভর চেষ্টা করেছিলেন।

এইভাবে জীবন-যাপন করে সত্তর বছর বয়সে, ১৮৯১ সালে বিদ্যাসাগর মারা যান। পৃথিবীতে এমন লোক খুব কমই জন্মেছেন। একথা বলা যেতে পারে যে, যদি ঈশ্বরচন্দ্র কোনো ইউরোপীয় দেশে জন্মাতেন তবে ইংলণ্ডে নেলসনের যেমন স্মারক বানানো হয়েছে, সেই রকম স্মারক ঈশ্বরচন্দ্রের মৃত্যুর পরও স্থাপিত হ’ত। তবে ঈশ্বরচন্দ্রের স্মারক আজ বাংলার ছোট অথবা বড়, গরীব অথবা আমির, সব লোকের হৃদয়ে স্থাপিত।

কোন মন্তব্য নেই

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন

vidyasagar.info ©