ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

মাইকেল মধুসূদন দত্ত

বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে।
করুণার সিন্ধু তুমি, সেই জানে মনে,
দীন যে, দীনের বন্ধু!—উজ্জ্বল জগতে
হেমাদ্রির হেমকান্তি অম্লান কিরণে।
কিন্তু ভাগ্যবলে পেয়ে সে মহা পর্বতে,
যে জন আশ্রয় লয় সুবর্ণ চরণে,
সেই জানে কত গুণ ধরে কত মতে
গিরীশ। কি সেবা তার সে মুখ সদনে।—
দানে বারি নদীরূপ বিমলা কিঙ্করী;
যোগায় অমৃত ফল পরম আদরে
দীর্ঘশিরঃ তরুদল, দাসরূপ ধরি;
পরিমলে ফুলকুল দশ দিশ ভরে;
দিবসে শীতল শ্বাসী ছায়া, বনেশ্বরী,
নিশার সুশান্ত নিদ্রা, ক্লান্তি দূর করে!

গদ্য-ভাষার ঈশ্বর বিদ্যাসাগর

—ফরিদ আহমদ দুলাল

বোধ হবার পর আনন্দ পাই এই কথা ভেবে, ‘বর্ণ পরিচয়’ দিয়ে আমার শৈশবে বর্ণ পরিচয় হয়েছিল। সেদিন কি আর জানতাম কার হাত ধরে আমার বর্ণ পরিচয়ের যাত্রা শুরু হলো? যখন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সাথে পরিচয় হলো, সেদিন বুঝলাম বাংলা গদ্য-ভাষার ঈশ্বর বিদ্যাসাগরের হাত ধরে চিনেছিলাম অ-আ-ক-খ। সেদিন কিছুটা তৃপ্তির পাশাপাশি দায়বদ্ধতাও অনুভব করেছিলাম; ভেবেছিলাম ঈশ্বরের আশীর্বাদকে সম্মান করা প্রয়োজন। তাই শুদ্ধতায় ব্রতী হয়েছিলাম। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর জন্মেছিলেন ১৮২০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর হুগলি জেলার (বর্তমান মেদিনীপুর) বীরসিংহ গ্রামে। তাঁর পৈতৃক পদবী বন্দ্যোপাধ্যায়, যা ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধির আড়ালে খোয়া যায় সময়ের গৌরবের কাছে। সংস্কৃত কলেজ থেকে ১৮৪১-এ তিনি উচ্চতর শিক্ষা কৃতিত্বের সাথে সমাপ্ত করেন; তাঁর অসাধারণ কৃতিত্বে মুগ্ধ কলেজ কর্তৃপক্ষ তাঁকে ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধিতে ভূষিত করে। পাঠ্যপুস্তকে আমরা তাঁর মাতৃভক্তির কথা পড়েছি, সেখানেই জেনেছি মাতৃআজ্ঞা পালনে কী দুর্যোগের রাতে তিনি উত্তাল দামোদর সাঁতরে পাড়ি দিয়েছিলেন। ক্রমান্বয়ে জেনেছি সমাজসংস্কারক হিসেবে তিনি হিন্দু সম্প্রদায়ে প্রচলিত সতীদাহ প্রথা রোধ আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলেন শৈশবে; বিধবাবিবাহ প্রচলন এবং শিক্ষা বিস্তারে নেতৃত্ব দিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন যৌবনে। সাংবাদিক হিসেবে সমাজে প্রচলিত অবিচার-অনাচার-দুর্নীতির কথা তুলে ধরেন। তিনি যে কেবল বিধবাবিবাহের পক্ষে সরব ছিলেন, তাই নয়; নিজের ছেলেকেও তিনি বিয়ে করিয়ে ছিলেন একজন বিধবা নারীকে, সমাজ-পরিপার্শ্বে প্রবল আপত্তির মুখেও। পরবর্তীকালে তাঁর পুত্র যখন সেই স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক ছেদ করেন, তিনি তখন নিজের সম্পত্তি থেকে পুত্রকে বঞ্চিত করে পুত্রবধূকে দান করেন।

দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা ঈশ্বরচন্দ্রকে পরবর্তী জীবনে দেখা যায় দারিদ্র্যপীড়িত মানুষ এবং গুণী শিল্পী-সাহিত্যিকদের পৃষ্ঠপোষকতায় কতোটা মানবিক! বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ‘রাজপুত্র’ নামে খ্যাত মাইকেল মধুসূদন দত্ত শেষজীবনে যখন বিপর্যয়ে পড়েন, বিদ্যাসাগর সে সময় মধুকবির পাশে দাঁড়িয়েছিলেন ভালোবাসার ঔদার্যে। সে ঘটনা আজও সাহিত্য-ইতিহাসে কিংবদন্তিতুল্য গল্প হয়ে আছে। তাঁর সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মন্তব্য করেন, ‘দয়া নহে, বিদ্যা নহে, ঈশ্বরচন্দ্রের চরিত্রের প্রধান গৌরব ছিল তাঁহার অজেয় পৌরুষ, তাঁহার আশ্চর্য মনুষ্যত্ব।’ স্বয়ং শ্রী মধুসূদন তাঁকে চিঠিতে বলেছিলেন, ‘প্রতিভা ও বৈদগ্ধ্যে যিনি প্রাচীন ঋষিদের মতো, কর্মোদ্যমে ইংরেজদের মতো এবং হৃদয়বত্তায় বাঙালি জননীর মতো।’ দানশীল হিসেবে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এতোটাই সুবিদিত ছিলেন, যে মানুষ তাঁকে ‘দয়ার সাগর’ অভিধায় সম্বোধন করতো।

যাপিত জীবনে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অসংখ্য কীর্তির পাশে বড় এক কীর্তি হচ্ছে বাংলা গদ্যভাষার আধুনিকায়ন। বলা যায়, তিনিই বাংলা গদ্যভাষায় গতি সঞ্চার করেছিলেন, আরও স্পষ্ট করে বললে বলা যায়, তিনিই বাংলা গদ্যভাষায় প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। গদ্যের ভাষাতেও যে অদৃশ্য ছন্দ বিদ্যমান, গদ্যে প্রবহমানতার যে গতি, তা আবিষ্কার করেছিলেন তিনি; এবং বাংলা ভাষায় যতিচিহ্ন ব্যবহার করে গতি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি প্রয়োজন অনুযায়ী গতিকে সমন্বয় করার পথ দেখিয়েছিলেন; এভাবেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর হয়ে উঠেছিলেন বাংলা গদ্য-ভাষার এক ঈশ্বর।

আমরা ভাষাভিত্তিক এক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ করেছি, ত্রিশ লাখ মানুষের বুকের রক্তে অর্জন করেছি বাঙালির এক স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র। মাতৃভাষার সম্মান প্রতিষ্ঠায় সংগ্রাম করেছি আমরা, বুকের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করেছি; বাংলা ভাষা ও মৃত্তিকার সম্মান সমুন্নত রাখতে দীর্ঘদিন নির্যাতিত হয়েছি-পিষ্ট হয়েছি অত্যাচারে; তারপরও বাঙালির সম্মানের জন্য লাখ লাখ নারী হারিয়েছে সম্ভ্রম! কিছুই বিস্মৃত হতে চাই না আমরা! আমাদের সেই প্রাণের ভাষার প্রাণ প্রতিষ্ঠায় যিনি নিজেই হয়ে উঠেছিলেন ভাষার ঈশ্বর; তাঁর জন্মের দ্বিশতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে আমরা কি আবেগাপ্লুত হবো না? উচ্ছ্বাস প্রকাশ করবো না? ইতিহাসের এক অদ্ভুত ঐক্য আমাদের সামনে আজ; ২০২০ খ্রিস্টাব্দ বাঙালির শ্রেষ্ঠ সন্তান, যিনি স্বাধীন-সার্বভৌম বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাঁর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে পালন করছি মুজিববর্ষ; একই সময় বাংলা ভাষার এক শৈল্পিক কারিগর-ভাষার ঈশ্বর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্মের দ্বিশতবর্ষ পূর্ণ হচ্ছে; তাঁর এ পূর্তিতে আমরা কি আনন্দ প্রকাশ করবো না? জাতির কাছে আমি তাই নিবেদন করবো, আগামী ২৯ জুলাই তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে আসুন আমরা তাঁকে স্মরণ করি; এবং ২৬ সেপ্টেম্বর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দ্বিশত জন্মবার্ষিকীর উৎসবে সমস্বরে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে বলি- বাংলা গদ্য-ভাষার ঈশ্বর, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তোমায় সশ্রদ্ধ ভালোবাসা।

‘বিদ্যাসাগর বন্দনা’ শিরোনামে একটি কবিতায় তাঁর প্রতি সম্মান জানিয়ে, কবিতাটি উচ্চারণের মাধ্যমে গদ্য-ভাষার ঈশ্বর, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে শ্রদ্ধা নিবেদন করে কথা আপাতত শেষ করবো।

বিদ্যাব্রতী মানুষের ঘোর সংকটকাল এখন
আদর্শলিপি এবং বর্ণ পরিচয় নেই প্রয়োজন
অনাচারের অশুভ পৃথিবীতে তোমাকে বয়কট করেছে সবাই
মাতৃভক্তি বৃদ্ধাশ্রমে হাহাকার করে সন্তান-বিচ্ছিন্নতায়;
সামাজিক বাস্তবতা ভেবে যে ক’টি প্রদীপ দিয়েছিলে জ্বেলে
সে আলোর দ্যুতি থেকে কতটা আগুন তুমি পেলে?
সময়ের ব্যাভিচার-অন্ধকার ছিঁড়ে তুমি ছিলে প্রাগ্রসর,
ঈশ্বরের নাম করে ধারণ ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা তুমি শ্রদ্ধেয় বিদ্যাসাগর।

সহমরণের দীর্ঘশ্বাস সরিয়ে এনেছো স্বপ্নমগ্ন দিন
অবরোধবাসিনী নারীর অন্ধতা ভেঙেছো তাই সভ্যতার অনিঃশেষ ঋণ
মানুষের অকৃতজ্ঞতার বার্তা তোমার তো ছিলো জানা
জানা ছিলো স্বার্থান্ধ মানুষ যতটা কূপমণ্ডূক ততটাই রাতকানা,
অভব্যের অনৈতিক দাপট প্রবল এতোটাই
বধির ফিরিয়ে দিলে অবশিষ্ট থাকে অন্ধতাই,
তুমি তবু ঔদার্যের আলোয় একাকী হাঁটো পথ
কুষ্মাণ্ড সময়ে তোমার সুনীতিকথা লড়ে অশিষ্টের সাথে একাই দ্বৈরথ।


২৩ জুলাই, ২০২০ খ্রীস্টাব্দে প্রকাশিত।


কোন মন্তব্য নেই

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন

vidyasagar.info ©