ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

মাইকেল মধুসূদন দত্ত

বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে।
করুণার সিন্ধু তুমি, সেই জানে মনে,
দীন যে, দীনের বন্ধু!—উজ্জ্বল জগতে
হেমাদ্রির হেমকান্তি অম্লান কিরণে।
কিন্তু ভাগ্যবলে পেয়ে সে মহা পর্বতে,
যে জন আশ্রয় লয় সুবর্ণ চরণে,
সেই জানে কত গুণ ধরে কত মতে
গিরীশ। কি সেবা তার সে মুখ সদনে।—
দানে বারি নদীরূপ বিমলা কিঙ্করী;
যোগায় অমৃত ফল পরম আদরে
দীর্ঘশিরঃ তরুদল, দাসরূপ ধরি;
পরিমলে ফুলকুল দশ দিশ ভরে;
দিবসে শীতল শ্বাসী ছায়া, বনেশ্বরী,
নিশার সুশান্ত নিদ্রা, ক্লান্তি দূর করে!

বিদ্যাসাগর: অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি

—বিশ্বজিৎ ঘোষ

হাজার বছরের ইতিহাসের ধারায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১) অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি। ভাবয়িত্রী এবং কারয়িত্রী প্রতিভা হিসেবে বাঙালি সমাজে তিনি সমধিক পরিচিত। জন্মের পর দুইশ’ বছর অতিক্রান্ত হলেও এখনও তিনি আমাদের কাছে নানামাত্রিকভাবে প্রাসঙ্গিক। তাঁর চিন্তা এবং কর্ম বাঙালি চিন্তকদের নানাভাবে উদ্বুব্ধ করে, দুইশ’ বছরের কালগত দূরত্ব সত্ত্বেও। অব্যাহত এই প্রাসঙ্গিকতাই বিদ্যাসাগরের আধুনিকতার মৌল-সূত্র। জন্ম নিয়েছিলেন তিনি হুগলি জেলার প্রত্যন্ত পাড়াগাঁয়ে, কিন্তু উত্তরকালে আপন চিন্তা-কর্ম-সাধনা দিয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন কেন্দ্রের মানুষ। তৎকালীন সমাজে প্রান্তিক অবস্থান থেকে কেন্দ্রে উঠে আসাটা ছিল রীতিমতো এক যুদ্ধ। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকেও অবতীর্ণ হতে হয়েছিল এই যুদ্ধে এবং লেখাই বাহুল্য, সে যুদ্ধে তিনি বিজয়ী।

পারিবারিক উত্তরাধিকার সূত্রে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর পেয়েছিলেন পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুঃসাহসী এবং পরিশ্রমী চারিত্র্য, পেয়েছিলেন তার দৃঢ়সংকল্প ও সময়ানুবর্তিতার বৈশিষ্ট্য। মেরুদণ্ড সোজা করে লড়াই করার শক্তি তিনি পিতৃ-সূত্রেই অর্জন করেছিলেন। পিতামহ রামজয় তর্কভূষণের কাছ থেকে বিদ্যাসাগর লাভ করেছিলেন মানবসেবা ও দানশীলতার আন্তরপ্রেরণা— অর্জন করেছিলেন অনমনীয় তেজস্বিতা ও চারিত্রিক দৃঢ়তা। পিতামহ রামজয় তর্কভূষণ সম্পর্কে বিদ্যাসগর লিখেছেন : ‘তিনি নিরতিশয় তেজস্বী ছিলেন; কোনো অংশে কাহারও নিকট অবনত হইয়া চলিতে, অথবা কোনও প্রকারে, অনাদর বা অবমাননা সহ্য করিতে পরিতেন না। তিনি, সকল স্থলে, সকল বিষয়ে, স্বীয় অভিপ্রায়ের অনুবর্তী হইয়া চলিতেন, অন্যদীয় অভিপ্রায়ের অনুবর্তন, তদীয় স্বভাব ও অভ্যাসের সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল।’ উত্তরকালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের চরিত্রেও এই বৈশিষ্ট্য বিশেষভাবে লক্ষ করা গেছে।

জননী ভগবতী দেবীর কাছ থেকেও বিদ্যাসাগর লাভ করেছেন নানামাত্রিক উচ্চ জীবনাদর্শ। শৈশবে মায়ের কাছ থেকে ঈশ্বরচন্দ্র পেয়েছিলেন নিরহংকারী হবার প্রেরণা। মায়ের হিসাবী এবং মিতচারী মানসিকতা শৈশবে ঈশ্বরচন্দ্রকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল। আত্মসুখের চেয়ে অপরের সুখই যে বড়— এই শিক্ষা বিদ্যাসাগর পেয়েছিলেন তাঁর মা ভগবতী দেবীর কাছ থেকেই।

বিদ্যাসাগর পড়তে চেয়েছিলেন ইংরেজি স্কুলে কিন্তু পিতৃ-নির্দেশে তিনি পড়ালেখা করেছেন কলকাতার বিখ্যাত সংস্কৃত কলেজে। বারো বছরেরও অধিক সময় সংস্কৃত কলেজে অধ্যয়ন করেন, অর্জন করেন প্রাচীন ভারতীয় নানা শাস্ত্রে অসামান্য ব্যুৎপত্তি। সংস্কৃত কলেজে পাঠাভ্যাসকালে অতিরিক্ত বিষয় হিসেবে তিনি ইংরেজিও পড়েন। সংস্কৃত কলেজ থেকেই ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় লাভ করেছিলেন ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি। সেখানে অধ্যয়নের সময় থেকেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কঠিন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জীবন অতিবাহিত করতেন। পিতার আর্থিক অবস্থা তেমন সচ্ছল ছিল না। তাই পাঠ সমাপ্ত করেই বিদ্যাসাগরকে চাকরিতে প্রবৃত্ত হতে হয়। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ এবং সংস্কৃত কলেজ— প্রধানত এই দুই প্রতিষ্ঠানেই বিদ্যাসাগর চাকরি করেছেন। বিদ্যাসাগর প্রথমেই চাকরিতে প্রবেশ করেন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে বাংলা বিভাগের সেরেস্তাদার বা প্রথম পণ্ডিতের পদে মাসিক পঞ্চাশ টাকা বেতনে। সে কালের বিবেচনায় বেতন যথেষ্টই বলতে হবে। বিদ্যাসাগরের এই চাকরিপ্রাপ্তি পরিবারের দীর্ঘদিনের আর্থিক দুরবস্থা দূর করল। সংস্কৃত কলেজে চাকরিরত অবস্থায় শোভাবাজার রাজবাড়িতে বিদ্যাসাগর নিয়মিত যেতেন অঙ্কশাস্ত্র, ইংরেজি ও হিন্দি ভাষা শিক্ষালাভ করতে। অথচ তিনি তখন ছিলেন সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জ্ঞানস্পৃহা ছিল অসীম। তিনি রাত জেগে পাঠ তৈরি করতেন, কত সহজে কঠিন বিষয় উপস্থাপন করা যায় সেজন্য তিনি আবিস্কার করেছিলেন নিজস্ব এক পদ্ধতি।

সংস্কৃত কলেজে অধ্যয়ন ও অধ্যাপনা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জীবনের উজ্জ্বলতম অধ্যায়। সংস্কৃত কলেজে টানা বারো বছর তিনি অধ্যাপনা করেন— কখনও সংস্কৃতের অধ্যাপক হিসেবে, কখনও-বা কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে। সংস্কৃত কলেজে চাকরি নিয়েই কলেজের সামগ্রিক অব্যবস্থা দূরীকরণ এবং উন্নত পাঠচর্চার দিকে বিদ্যাসাগর মনোনিবেশ করেন। এ সময় সংস্কৃত কলেজের সামগ্রিক অবস্থা ছিল খুবই শোচনীয়। কলেজের অব্যবস্থা দূর করে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনলেন বিদ্যাসাগর। প্রসঙ্গত স্মরণ করা যায় সুধীরকুমার গঙ্গোপাধ্যায়ের অভিমত : ‘There was hardly any discipline in the College. Some of the teachers, who were his teachers too, used to come late. Some of the teachers would sleep in the class. This was a very embarrassing situation for him. But discipline was to be enforced without being herst to these teachers. So Vidyasagar just stood at the gate of the College when classes were to beging for the day. The teachers who come late, seeing Vidyasagar at the gate, felt ashamed and avoided coming late. He would go round the classes no and them. Discipline was restored.’

সংস্কৃত কলেজের উন্নতির জন্য যোগদানের পর মাত্র ছয় মাসের মধ্যে বিদ্যাসাগর একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন। তার এই পরিকল্পনার মধ্যে ছিল কলেজের পাঠক্রমকে জুনিয়র ও সিনিয়র শাখায় বিন্যাস এবং পাঠ্যবিষয় পুনর্গঠন।

সংস্কৃত কলেজের চাকরি ছেড়ে দেওয়ার পরে বিদ্যাসাগর পুনরায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে যোগদান করেন। ১৮৫০ সালের ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত সেখানে চাকরি করার পর ৬ ডিসেম্বর তিনি সংস্কৃত কলেজে সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। যোগদানের দশ দিনের মধ্যে সংস্কৃত কলেজের শিক্ষা সংস্কারের জন্য শিক্ষা সংসদের কাছে একটি পরিকল্পনা উপস্থাপন করেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। ১৮৫১ সালের ২২ জানুয়ারি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ পদে যোগদান করেন। ১৮৫৭ সালের ২৪ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত হয় কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। প্রথম থেকেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে বাংলা সরকার ফেলো হিসেবে মনোনীত করেছিলেন। ১৮৫৫ সালের ১ মে মেদিনীপুর, হুগলি, নদীয়া এবং বর্ধমান জেলায় শিক্ষা বিভাগের সহকারী ইন্সপেক্টরের দায়িত্ব গ্রহণ করেন বিদ্যাসাগর। এ সময় সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ এবং শিক্ষা বিভাগের সহকারী ইন্সপেক্টরের চাকরিসূত্রে বিদ্যাসাগর একত্রে পাঁচশ’ টাকা বেতন পেতেন। উপার্জিত টাকার অধিকাংশই তিনি ব্যয় করতেন নারী শিক্ষা এবং বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক কাজে। ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহ ভারতব্যাপী ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়লে ভারত সরকারের নির্দেশে সংস্কৃত কলেজ বউবাজারে ভাড়াবাড়িতে স্থানান্তরিত হয় এবং সংস্কৃত কলেজের মূল ভবনে সরকারের অনুগত সৈনিকদের জন্য অস্থায়ী হাসপাতাল স্থাপন করা হয়। সরকারের এই সিদ্ধান্তে ক্ষুণ্ণ হন বিদ্যাসাগর। একদিকে সংস্কৃত কলেজের সামূহিক উন্নতির জন্য তার পরিকল্পনার প্রতি সরকারের অনীহা, অন্যদিকে তাঁর মতামতকে উপেক্ষা করে সংস্কৃত কলেজে অস্থায়ী হাসপাতাল নির্মাণ— এই দ্বৈত কারণে কলেজের অধ্যক্ষতার প্রতি সব আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন বিদ্যাসাগর। ১৮৫৮ সালের ৩ নভেম্বর সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষের পদ ত্যাগ কলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। পুনরায় স্মরণ করি, এ সময় বিদ্যাসাগর মাসিক বেতন পেতেন পাঁচশত টাকা, সময়টা ১৮৫৮ সাল, আর বিদ্যাসাগরের বয়স মাত্র ৩৮ বছর। জীবনে কখনো তিনি আপস করেননি। এক্ষেত্রেও কোনো আপস করলেন না সিংহপুরুষ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।

বাংলাদেশে জনশিক্ষা বিস্তারে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর পালন করেছেন ঐতিহাসিক ভূমিকা। শিক্ষা সংসদের অনুরোধে তিনি সমগ্র দক্ষিণ বাংলা মডেল স্কুলের পাঠক্রম রচনা করেন, বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির স্কুলসমূহের পাঠক্রম উন্নয়নে পালন করেন মুখ্য ভূমিকা। স্কুলে যাতে যথাযথ পাঠ-পদ্ধতি অনুসৃত হয়, সেজন্য তিনি ভারত সরকারকে বুঝিয়ে শিক্ষক প্রশিক্ষণ স্কুল প্রতিষ্ঠায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। জনশিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে মোদিনীপুরসহ নানা স্থানে তিনি দিবা ও নৈশ বিদ্যালয় স্থাপন করেছেন। বিদ্যাসাগর প্রতিষ্ঠিত নৈশ বিদ্যালয়ে গ্রামের কৃষক, জেলে, কামার, কুমোর, জোলা— এসব শ্রমজীবী মানুষ পড়ালেখা করতেন। বিদ্যাসাগর স্কুলের শিক্ষকদের বেতন দিতেন নিজের উপার্জিত অর্থ দিয়ে, স্কুল পরিচালনার জন্য তাকে ঋণগ্রস্তও হতে হয়েছে। স্কুলের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বিদ্যাসাগর কোনো বেতন নিতেন না, উপরন্তু পাঠোপকরণ তিনি নিজের অর্থে ক্রয় করে শিক্ষার্থীদের উপহার দিতেন। সাধারণ মানুষের মাঝে শিক্ষার আলো জ্বলে উঠুক— এই-ই ছিল বিদ্যাসাগরের স্বপ্ন।

বাঙালি সমাজে নারীশিক্ষা বিস্তারে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর পালন করেছেন ঐতিহাসিক ভূমিকা। নারীশিক্ষার কথা তিনি কেবল চিন্তাই করেননি, সেই চিন্তাকে বাস্তবে রূপ দেবার জন্য গ্রহণ করেছেন বহুমাত্রিক উদ্যোগও। নারীর কল্যাণকেই বিদ্যাসাগর সমাজের কল্যাণ বলে বিবেচনা করেছেন; তাই নারীশিক্ষার প্রতি তিনি বিশেষ মনোযোগী ছিলেন। কলকাতার বেথুন বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সঙ্গে বিদ্যাসাগর প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন। ১৮৭৯ সালে যখন বেথুন বালিকা বিদ্যালয় কলেজে উন্নীত হয়, তখন সেটিই ছিল এশিয়ার প্রথম গার্লস কলেজ। বেথুন গার্লস কলেজ প্রতিষ্ঠায়ও বিদ্যাসগর পালন করেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। একসময় বেথুন স্কুলটি তুলে দেবার উদ্যোগ নেয় বাংলা সরকার, কিন্তু বিদ্যাসাগরের অনড় আচরণ এবং দৃঢ় অবস্থানের কারণে শেষ পর্যন্ত তাদের উদ্যোগ সফল হয়নি— বেঁচে যায় স্যার ড্রিঙ্ক ওয়াটার বেথুন প্রতিষ্ঠিত ঐতিহাসিক এই বালিকা বিদ্যালয়টি।

নারীশিক্ষা বিস্তারের জন্য বিদ্যাসাগর বেছে নিয়েছিলেন প্রধানত চারটি জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলকে। ১৮৫৭ সালের নভেম্বর থেকে ১৮৫৮ সালের মে মাস— এই স্বল্প সময়ের মধ্যে মেদিনীপুর-হুগলি-নদীয়া ও বর্ধমান জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে নিজের অর্থে বিদ্যাসাগর মোট ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এসব স্কুলের পাঠক্রম নিজে প্রস্তুত করেন বিদ্যাসাগর। তিনি নিয়মিত স্কুলগুলো পরিদর্শনে যেতেন, স্কুলের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিতেন, কখনও-বা নিজেই শ্রেণিকক্ষে গিয়ে ক্লাস নিতেন। প্রথম ছয় মাস স্কুলের যাবতীয় খরচ তিনি নিজে বহন করেন। ভারতবর্ষে নারীশিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে ইংল্যান্ড থেকে আসা মিস মেরি কার্পেন্টারকেও বাংলা সরকারের অনুরোধে বিদ্যাসাগর প্রভূত সহায়তা করেন। মেরি কার্পেন্টারের সঙ্গে বিভিন্ন বালিকা বিদ্যালয় পরিদর্শনে যেতেন বিদ্যাসাগর, স্কুলসমূহ পরিচালনার জন্য কার্পেন্টারকে দিতেন যথাযথ পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা। কেবল নারীর প্রাথমিক শিক্ষা নয়, তার উচ্চশিক্ষার জন্যও বিদ্যাগর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নারীরা পরীক্ষা দিতে পারবে কিনা, এ বিষয় নিয়ে যখন বাদানুবাদ আরম্ভ হয়, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নারীর পরীক্ষা দেওয়ার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেন। এন্ট্রান্স থেকে স্নাতক— সকল পর্যায়ে নারী যাতে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারে, বিদ্যাসাগর তার পক্ষে সিদ্ধান্ত প্রদান করেছিলেন। বিদ্যাসাগরের একান্ত আগ্রহের ফলেই কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় (১৮৫৭) প্রতিষ্ঠার একুশ বছর পর ১৮৭৮ সালে সিনেটের এক বিশেষ সভার সিদ্ধান্ত অনুসারে বাংলার নারীর উচ্চশিক্ষার দ্বার উন্মুক্ত হয়। নারীশিক্ষা-বিষয়ক প্রচলিত ধারণাকেই পাল্টে দেন বিদ্যাসাগর। একসময় ভাবা হতো সন্তান লালন-পালন করা আর গৃহস্থালী কাজ শেখাই নারীশিক্ষা। কিন্তু বিদ্যাসাগর মনে করতেন দ্রুত পরিবর্তনশীল সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে সমতা রক্ষার জন্য নারীর শিক্ষাই প্রকৃত অগ্রগতি— এ উদ্দেশ্যেই তিনি প্রণয়ন করেছিলেন নারীশিক্ষার পাঠক্রম।

বাঙালি সমাজ সংস্কারক হিসেবে বিদ্যাসাগরের পরিচিতি সুবিদিত। তাঁর সমাজ সংস্কার চেতনা প্রধানত নারীকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে। উনিশ শতকে প্রচলিত নারীর জন্য অবমাননাকর ও অমানবিক অনেক প্রথা বিলোপের জন্য তিনি আন্দোলন গড়ে তোলেন, চালু করেন নারীর কল্যাণের জন্য অনেক বিধান। বস্তুত, তাঁর একক সংগ্রামের ফলেই ১৮৫৬ সালে ব্রিটিশ সরকার ভারতবর্ষে বিধবা বিবাহ আইন প্রবর্তন করেন। বিদ্যাসাগর বহুবিবাহ এবং বাল্যবিবাহের বিরোধিতা করেন, বিরোধিতা করেন কৌলীন্য প্রথার। বিধবা বিবাহ চালু, বহুবিবাহা প্রথা এবং বাল্যবিবাহ বন্ধের জন্য কাজ করেছেন, বর্জন করেছেন কৌলীন্য প্রথার অনাচার। বর্তমান সময়ের উদার নারীবাদের আলোকে বিদ্যাসাগরের কর্ম ও সাধনাকে মূল্যায়ন করলে তাঁকে অনায়াসেই একজন নারীবাদী তাত্ত্বিক এবং লেখক হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়।

একজন সাহিত্যিক হিসেবেও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর রেখে গেছেন অনন্য কীর্তির স্বাক্ষর। বাঙালি সমাজকে শিক্ষায় আগ্রহী করে গড়ে তোলার জন্যই বিদ্যাসাগর লেখনী ধারণ করেছিলেন। বেতাল পঞ্চবিংশতি (১৮৪৭, শকুন্তলা (১৮৫৪), সীতার বনবাস (১৮৬০), ভ্রান্তিবিলাস (১৮৬৯), আত্মচরিত (১৮৯০), প্রভাবতী সম্ভাষণ (১৮৯২)—এসব রচনা বিদ্যাসাগরের সাহিত্যকর্মের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। ১৮৫৫ সালে প্রকাশিত হয় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সুবিখ্যাত প্রাইমার বা শিশুশিক্ষার বই বর্ণপরিচয় (১ম-২য় ভাগ)। বাংলা ভাষায় শিশুশিক্ষার বই হিসেবে বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় একটি ঐতিহাসিক প্রয়াস। সরল ভাষায় এবং বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে বর্ণ, বর্ণের শ্রেণিবিভাগ, লিখনকৌশল এবং পাঠ্য-বিষয় এখানে উপস্থাপন করেছেন বিদ্যাসাগর।

বাংলার সমাজ-সংস্কৃতি-শিক্ষার ইতিহাসে চিরকালের এক উজ্জ্বল নাম ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তাঁর মৃত্যুর পরেও আমরা পেরিয়ে এসেছি একশ’ ত্রিশ বছর— তবু বাঙালি সমাজে এখনও তিনি অব্যাহতভাবে প্রাসঙ্গিক। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের নানামাত্রিক চিন্তা বাঙালি সমাজে এখনও পথের দিশা হিসেবে কাজ করতে পারে।

২৫ সেপ্টেম্বর ২০২০ খ্রীস্টাব্দে প্রকাশিত।


কোন মন্তব্য নেই

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন

vidyasagar.info ©