ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

মাইকেল মধুসূদন দত্ত

বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে।
করুণার সিন্ধু তুমি, সেই জানে মনে,
দীন যে, দীনের বন্ধু!—উজ্জ্বল জগতে
হেমাদ্রির হেমকান্তি অম্লান কিরণে।
কিন্তু ভাগ্যবলে পেয়ে সে মহা পর্বতে,
যে জন আশ্রয় লয় সুবর্ণ চরণে,
সেই জানে কত গুণ ধরে কত মতে
গিরীশ। কি সেবা তার সে মুখ সদনে।—
দানে বারি নদীরূপ বিমলা কিঙ্করী;
যোগায় অমৃত ফল পরম আদরে
দীর্ঘশিরঃ তরুদল, দাসরূপ ধরি;
পরিমলে ফুলকুল দশ দিশ ভরে;
দিবসে শীতল শ্বাসী ছায়া, বনেশ্বরী,
নিশার সুশান্ত নিদ্রা, ক্লান্তি দূর করে!

বিদ্যাসাগর ও বর্ধমান, একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক

—শ্যামলচন্দ্র দাস

বিদ্যাসাগরের জন্মের দু’শো বছর হতে চলল। নতুন অধ্যাপক পদ থেকে শুরু করে খণ্ডে খণ্ডে তাঁর রচনাবলী প্রকাশ— এর মধ্যেই নানা উদ্যোগ শুরু হয়েছে। তাঁর এই প্রেক্ষিতে বহুমুখী প্রতিভাধর বিদ্যাসাগর কী ভাবে তৎকালীন বর্ধমানেরও পরমাত্মীয় হয়ে উঠেছিলেন তা ফিরে দেখা যায়।

বর্ধমানে ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে দুর্ভিক্ষ হয়। এখানেই দুর্ভোগের শেষ নয়, তিন বছর পরেই ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে বর্ধমান ও হুগলিতে ম্যালেরিয়া মহামারির আকার নেয়। বহু গ্রাম ও শহর জনশূন্য হতে থাকে। এই সময় বিদ্যাসাগর ত্রাণশিবির ও চিকিৎসা-সত্র খোলেন বর্ধমানের কমলসায়র (এখন বর্ধমান শহরের নবাবহাটের কাছে) এলাকায়। কিছু দিন তিনি সেখানকার বাগানবাড়িতেও ছিলেন। বিদ্যাসাগর বর্ধমান শহর সংলগ্ন একাধিক বস্তি, আশপাশের এলাকা ঘুরে ঘুরে আক্রান্তদের সেবা করেছিলেন। এ ব্যাপারে মহারাজ মহতাবচাঁদ ও চিকিৎসক গঙ্গানারায়ণ মিত্র নানা ভাবে সাহায্য করেছিলেন। শুধু তাই নয়, তৎকালীন ইংরেজ সরকারের কাছে ওষুধপত্র ও ডাক্তারের জন্য বিদ্যাসাগর আবেদন জানালে তার ব্যবস্থাও হয়। তাঁর তৃতীয় ভাই শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন লিখেছেন, ‘এই সায়রের চারদিকে ছিল দরিদ্র নিরুপায় মুসলমানগণের বাস। এই পল্লীর বালকবালিকাগণকে প্রতিদিন প্রাতে জলখাবার দিতেন। যাহাদের পরিধেয় বস্ত্র জীর্ণ ও ছিন্ন দেখিতেন, তাহাদিগকে অর্থ ও বস্ত্র দিয়া কষ্ট নিবারণ করিতেন। এতদ্ভিন্ন কয়েক ব্যক্তিকে দোকান করিবার জন্য মূলধন দিয়াছিলেন।…ঐ সময়ে অগ্রজ মহাশয় কমলসায়রের সন্নিহিত একটী মুসলমান কন্যার বিবাহের সমস্ত খরচ প্রদান করিয়াছিলেন’ (বিদ্যাসাগর-জীবনচরিত)। সেই সময়ের ‘সঞ্জীবনী’ লিখেছিল, ‘বর্দ্ধমানে যখন বড় ম্যালেরিয়া জ্বরের ধুম, তখন আমরা কলিকাতাতে বসিয়া শুনিলাম যে বিদ্যাসাগর মহাশয় নিজ ব্যয়ে ডাক্তার ও ঔষধ লইয়া সেখানে গিয়াছেন; এবং হাড়ি, শুড়ি, জেলে, মালো, জাতি বর্ণ নির্বিশেষে সকলের দ্বারে দ্বারে ফিরিয়া চিকিৎসা করাইতেছেন। তিনি গাড়িতে বসিয়াছেন, একটী মুসলমানের বালক হয়ত তাঁহার ক্রোড়ে রহিয়াছে।’ জাতিভেদ আক্রান্ত সমাজে এমন উদারতা তখন বিরল।

বর্ধমানে বিধবাবিবাহ, বহুবিবাহ রোধ, নারীশিক্ষা, বাংলা ভাষায় প্রচলনের মতো বিষয়ে বিদ্যাসাগর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ যুক্ত ছিলেন। হিন্দু কলেজের অধ্যক্ষ থাকার সময় তিনি চারটি জেলার সহকারি ইনস্পেক্টর নিযুক্ত হন। কুড়িটি আদর্শ বা মডেল বিদ্যালয় স্থাপন করেন। সেই তালিকায় ছিল বর্ধমানও। ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের ২৬ অগস্ট বর্ধমানের আমাদপুরে প্রথম বিদ্যালয়টি শুরু হয়। তার পর ওই বছরই জৌগ্রামে, খণ্ডঘোষে, দাঁইহাটে একটি করে বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। বিদ্যাসাগর বর্ধমান জেলার রানাপাড়ায় ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের পয়লা ডিসেম্বর প্রথম বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। এর পরে ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এ জেলার জামুই, শ্রীকৃষ্ণপুর, রাজারামপুর, জোৎ-শ্রীরামপুর, দাঁইহাট, কাশীপুর, সানুই, রসুলপুর, বন্তীর, বেলগাছিতেও বালিকা বিদ্যালয় গড়ে ওঠে। ছাত্রদের জন্য খোলা বিদ্যালয়গুলি সরকারি অনুমোদন পেত। কিন্তু প্রথম দিকে বালিকা বিদ্যালয়গুলির খরচ তিনিই বহন করতেন। রাজা মহতাবচাঁদ কিছুটা ব্যয়ভার নিলেও পরে অনীহা দেখান। ফলে কয়েকটি বালিকা বিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যায়। তৎকালীন মডেল স্কুলের হেডমাস্টার বর্ধমানের জৌগ্রামের বাবু নবগোপাল মজুমদারের বাড়িতে একটি বালিকা বিদ্যালয় খোলা হলে বিদ্যাসাগর সরকারি সাহায্যের জন্য ডিরেক্টর অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশনকে চিঠি লিখেছিলেন ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ মে। ওই বিদ্যালয়ের জন্য মাসিক ৩২ টাকা করে সরকারি সাহায্য মঞ্জুরও হয়। তাঁর প্রভাবে চকদীঘির জমিদার নিজগ্রামে অবৈতনিক বিদ্যালয় স্থাপন করেন। আরও অনেকে অনুপ্রাণিত হন। এই জেলায় শিক্ষার প্রসারে বিদ্যসাগরের ভূমিকা অবিস্মরণীয়।

কিন্তু কেন বর্ধমান নিয়ে বিদ্যাসাগরের এত সক্রিয়? এর একটি কারণ হল, বন্ধুদের সঙ্গে অন্তরঙ্গতা। মহারাজ মহতাবচাঁদের অন্তরঙ্গ বন্ধু রসিকচন্দ্র রায় ছিলেন বিদ্যাসাগরের বন্ধু। তাঁকে বিদ্যাসাগর ‘প্রকৃত বাঙালী কবিশ্রেণীর শেষ কবি’ বলে মনে করতেন। তাঁর কবিতা বিদ্যাসাগর পাঠ্যপুস্তকে রেখেছিলেন এবং তাঁর কবিতা নাতি, নাতনিদের মুখস্থ করতে বলতেন। মনে হয়, এই যোগসূত্র বিদ্যাসাগরকে বর্ধমানমুখী করতে কিছুটা সহায়তা করে থাকতে পারে। তা ছাড়া, এই জেলার তৎকালীন কবি প্যারীমোহন কবিরত্ন, দাশরথি রায় প্রমুখ বিদ্যাসাগরের উদ্দেশে একাধিক গীতিকবিতা লিখেছিলেন। যেমন তৎকালীন বঙ্কিমচন্দ্র সম্পাদিত ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় বিদ্যাসাগরের কড়া সমালোচনা প্রকাশিত হলে প্যারীকবি লিখেছিলেন—‘এ আস্পর্ধা কর কারে/ গোষ্পদ বলে না যারে/ ডাগর সাগরে খোঁচা দিতে ভয় হল না তার?’ বিদ্যাসাগরের উদ্দেশে বাঙালি কবি দাশু রায় যেমন লিখেছিলেন, ‘দিতে নাগর, এলেন, গুণের সাগর বিদ্যাসাগর,/ বিধবাদের পার করতে, তরীর গুণ ধরেছেন গুণনিধি।।’ অথবা ‘তোমরা এই ঈশ্বরের দোষ দেখাবে কিরূপে?/…এসেছেন ঈশ্বর বিদ্যাসাগর-রূপে।।’ এই সূত্রও তাঁকে বর্ধমান অভিমুখী করতে পারে।

বিদ্যাসাগর তৎকালীন বর্ধমানের রাজসভায় যাতায়াত করতেন। আসতেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরেরও। সেই সম্পর্কের সূত্রে বিদ্যাসাগর তৎকালীন বর্ধমানাধিপতি মহতাবচাঁদ (১৮৩২-১৮৭৯)-কে আখ্যা দিয়েছিলেন ‘বঙ্গের প্রথম মানুষ’ বলে। মহতাবচাঁদও বিধবাবিবাহ আন্দোলনের অন্যতম সমর্থক, পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। বহুবিবাহ রোধে তৎকালীন সরকারের কাছে একটি আবেদনপত্র পাঠান। তাঁর দানধ্যান, শিক্ষার প্রসার উদ্যোগ, সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চায়ও কিছুটা হলেও বিদ্যাসাগরের প্রভাব ছিল। যখন, বিদ্যাসাগর বাংলা লিপি নিয়ে ভাবছেন তখন মহতাবচন্দ্র, ‘মহতাব-লিপি’ প্রচলন করেছিলেন। এই লিপি সংক্রান্ত বইয়ের প্রতিলিপি পাওয়া যায় লন্ডনের হোভ পাবলিক লাইব্রেরি থেকে। যার প্রথম ভাগ প্রকাশ পায় ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে। পাশাপাশি, সমাজ সংস্কারের জন্য এই রাজসান্নিধ্য বিদ্যাসাগরেরও প্রয়োজন ছিল।

ঋণস্বীকার: ‘করুণাসাগর বিদ্যাসাগর’ ইন্দ্র মিত্র

বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের শিক্ষক

১৩ মার্চ ২০১৯ খ্রীস্টাব্দে প্রকাশিত।


কোন মন্তব্য নেই

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন

vidyasagar.info ©