ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

মাইকেল মধুসূদন দত্ত

বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে।
করুণার সিন্ধু তুমি, সেই জানে মনে,
দীন যে, দীনের বন্ধু!—উজ্জ্বল জগতে
হেমাদ্রির হেমকান্তি অম্লান কিরণে।
কিন্তু ভাগ্যবলে পেয়ে সে মহা পর্বতে,
যে জন আশ্রয় লয় সুবর্ণ চরণে,
সেই জানে কত গুণ ধরে কত মতে
গিরীশ। কি সেবা তার সে মুখ সদনে।—
দানে বারি নদীরূপ বিমলা কিঙ্করী;
যোগায় অমৃত ফল পরম আদরে
দীর্ঘশিরঃ তরুদল, দাসরূপ ধরি;
পরিমলে ফুলকুল দশ দিশ ভরে;
দিবসে শীতল শ্বাসী ছায়া, বনেশ্বরী,
নিশার সুশান্ত নিদ্রা, ক্লান্তি দূর করে!

পথপ্রদর্শক বিদ্যাসাগর

একটি নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করে এবং প্রতিকূল ঔপনিবেশিক পরিবেশের মধ্যে অবস্থান করে বিদ্যাসাগর কীভাবে মনুষ্যত্বের চূড়ায় আরোহণ করতে পেরেছিলেন, তা আজকের বাঙালির কাছে বিস্ময় উদ্রেককারী বিষয়…
—খোন্দকার সিরাজুল হক


‘বিদ্যাসাগর’ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ—‘সাগরের মতো ব্যাপক ও গভীর বিদ্যা যাঁর’। কিন্তু সমগ্র বাঙালি সমাজে বিদ্যাসাগর বলতে একজনকেই বোঝায়, যাঁর পিতৃদত্ত নাম ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। এভাবেই আমরা পেয়েছি ‘বিশ্বকবি’, ‘বিদ্রোহী কবি’, ‘নেতাজী’, ‘দেশবন্ধু’, ‘শেরে বাংলা’, ‘বঙ্গবন্ধু’ প্রভৃতি উপাধির অনন্যসাধারণ ব্যক্তিবর্গকে, যাঁরা তাঁদের অসামান্য অবদানের জন্য পরিবারের গণ্ডি অতিক্রম করে সমগ্র জাতির পথপ্রদর্শকরূপে বিবেচিত হয়েছেন। এ কারণেই দেশবাসী এই প্রিয় মানুষদের বিশেষভাবে সম্বোধন করে আনন্দ পেয়েছে। পরিতৃপ্ত হয়েছে। বিদ্যাসাগর বাঙালি সমাজের এমনই একজন ব্যতিক্রমধর্মী মানুষ, যিনি শিক্ষা বিস্তারে, সমাজ সংস্কারে ও সাহিত্য সাধনায় তাঁর সমগ্র জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। বিদ্যাসাগরের জন্ম ১৮২০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে এবং মৃত্যু ১৮৯১ সালের ২৯ জুলাই কলকাতায়। আজ তাঁর ১২০তম মৃত্যুবার্ষিকী। আর কয়েক বছর পরেই ২০২০ সালে বাঙালি জাতি এই প্রতিভাধর মানুষটির দ্বিশত জন্মবার্ষিকী পালন করবে।

রবীন্দ্রনাথের [১৮৬১-১৯৪১] মতো বিদ্যাসাগরও উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, শিক্ষার মধ্য দিয়েই একটি জাতি তার মুক্তির পথ খুঁজে পায়। তাই শিক্ষা সংস্কার ও শিক্ষা বিস্তারকে বিদ্যাসাগর তাঁর জীবনের অন্যতম প্রধান আরাধ্য বিষয় হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। মাত্র একুশ বছর বয়সে তিনি কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে হেড পণ্ডিত হিসেবে যোগদান করে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। কিন্তু তাঁর শিক্ষা সংস্কারের কাজ শুরু হয় ১৮৪৬ সালে, সহকারী সম্পাদক হিসেবে সংস্কৃত কলেজে আসার পর থেকেই। তিনি সংস্কৃত কলেজে যোগ দিয়েই ঘোষণা করেন, শিক্ষার লক্ষ্য হবে মাতৃভাষার মাধ্যমে পাশ্চাত্যের জ্ঞান-বিজ্ঞানকে শিক্ষার্থীদের কাছে তুলে ধরা। শিক্ষাকে জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হলে মাধ্যম অবশ্যই মাতৃভাষা হওয়া প্রয়োজন। তাই তিনি বিজ্ঞান, অঙ্ক, ভূগোল, ইতিহাস সবকিছু বাংলা ভাষায় শেখানোর কথা বললেন। এ তো রীতিমতো এ যুগের জনশিক্ষার দাবি। বিদ্যাসাগরের কণ্ঠেই এ দাবি উঠেছিল দেড়শ’ বছর আগে। বাংলা ভাষার সঙ্গে বাঙালি জাতির পরিচয় সহজ ও বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে করে দেওয়ার উদ্দেশ্যেই তিনি ‘বর্ণপরিচয়’ [প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ] লিখেছিলেন ১৮৬৫ সালে। শিক্ষা সংস্কারের পাশাপাশি তিনি শিক্ষা বিস্তারেও মনোযোগী হয়েছিলেন। তিনি জনশিক্ষার জন্য বঙ্গ বিদ্যালয় ও গুরু ট্রেনিং স্কুল প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করেন। তাঁর প্রচেষ্টায় ১৮৫৫ সালের আগস্ট থেকে পরবর্তী ছয় মাসের মধ্যেই বিভিন্ন গ্রামে বিশটি মডেল স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। একই সঙ্গে স্ত্রীশিক্ষা বিস্তারেও তিনি এগিয়ে আসেন। আর এ নিয়ে শাসক ইংরেজ সরকারের সঙ্গে তাঁর দ্বন্দ্ব বাধে। এবং তিনি ১৮৫৮ সালের ৩ নভেম্বর সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষের পদে ইস্তফা দেন। এ সময়ে তাঁর বেতন ছিল মাসিক পাঁচশ’ টাকা। তাঁর পরিচিতজনের অনেকেই পদত্যাগ না করার জন্য অনুরোধ জানালেও তিনি নিজ সিদ্ধান্তে অটল থাকলেন। ছোটলাট হ্যালিডে তাঁকে বললেন, ‘তুমি যে কাজ ছেড়ে দিচ্ছ, খাবে কী?’ বিদ্যাসাগর উত্তর দিলেন, ‘ডাল-ভাত।’ হ্যালিডে আবার প্রশ্ন করলেন, ‘তা-ই বা কীভাবে জুটবে?’ বিদ্যাসাগরের সুস্পষ্ট জবাব— ‘দুবেলার বদলে তখন না হয় একবেলা খাবো। তাও না জুটলে একদিন অন্তর খাবো। কিন্তু যে কাজে আমার মন সায় দেয় না, সে কাজ আমি করতে পারবো না।’ এ-ই হচ্ছেন উন্নতশির বিদ্যাসাগর।

বিদ্যাসাগর যে কত বড় আত্মজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ ছিলেন, ১৮৪৬-৪৭ সালে সংঘটিত একটি ঘটনা থেকেই তা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। বিদ্যাসাগর সে সময়ে সংস্কৃতি কলেজের সহকারী সম্পাদক এবং জেমস কার হিন্দু কলেজের অধ্যক্ষ। একদিন বিদ্যাসাগর বিশেষ প্রয়োজনে হিন্দু কলেজের অধ্যক্ষের সঙ্গে দেখা করতে যান। কার সাহেব তখন তাঁর কক্ষে সামনের টেবিলে জুতোসুদ্ধ পা তুলে পাইপ টানছিলেন। এ সময়ে বিদ্যাসাগর তাঁর কক্ষে প্রবেশ করলেন। কার সাহেব পা না গুটিয়েই বিদ্যাসাগরের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে লাগলেন এবং পায়ের দিকে একটি চেয়ারে বসতে বললেন। কিন্তু বিদ্যাসাগর চেয়ারে না বসে ওই অবস্থায় কথাবার্তা সেরে ফিরে এলেন। এই ঘটনার কয়েকদিন পর কোনো প্রয়োজনে কার সাহেব বিদ্যাসাগরের সঙ্গে দেখা করার জন্য সংস্কৃত কলেজে এলেন। বিদ্যাসাগরও তাঁকে যথাযোগ্যভাবে অভ্যর্থনা জানালেন। তালতলার চটিসুদ্ধ পা টেবিলের ওপরে তুলে তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা বলতে লাগলেন। কার সাহেব অপমানিত বোধ করে ওপরওয়ালার কাছে বিদ্যাসাগরের বিরুদ্ধে নালিশ করলেন। লিখিত কৈফিয়ত তলব করা হলে বিদ্যাসাগর নিম্নোক্ত ভাষায় তাঁর উত্তর দেন— I thought that we [natives] were an uncivilized race quite unacquainted with refined manners of receiving a gentleman visitor. I learned the manners, of which Mr. Kerr completion from the gentleman himself, a few days ago, when I had an occasion to call on him, notions of refined manners feeing these formed from the conduct of an enlightened, civilized European. I behaved myself as respectfully towards him as he had himself done. শিক্ষা সংস্কারে ও শিক্ষা বিস্তারে তাঁর যে অনমনীয় ব্যক্তিত্বের পরিচয় পাওয়া যায়, সমাজ সংস্কারে তাঁর সে-ব্যক্তিত্ব আরও ঔজ্জ্বল্য লাভ করেছে।

রক্ত-মাংসের মানুষ হিসেবে নারীর পৃথিবীতে বেঁচে থাকার অধিকারের কথা রামমোহনই [১৭৭২-১৮৩৩] প্রথম বাঙালি সমাজকে শুনিয়েছিলেন। তাঁর অক্লান্ত প্রচেষ্টায় এবং লর্ড উইলিয়াম বেন্টিংকের মতো ‘বড়ো’ ইংরেজের সহৃদয়তায় ১৮২৯ সালে সতীদাহ নিবারণ আইন প্রণীত হয়। ফলে বিদ্যাসাগরের কালেই বিধবা-বিবাহ প্রবর্তনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। বিদ্যাসাগর বিধবা-বিবাহ প্রবর্তনের জন্য সংস্কারাচ্ছন্ন হিন্দু সমাজের বিরুদ্ধে রীতিমতো জেহাদে অবতীর্ণ হয়েছিলেন।

এ জন্য তিনি সমাজের নানা স্তরের ৯৮৭ জন লোকের স্বাক্ষর সংগ্রহ করে বিধবা-বিবাহ আইন বিধিবদ্ধ করার জন্য ১৮৫৫ সালের ৪ অক্টোবর ভারতীয় ব্যবস্থাপক সভায় আবেদনপত্র পাঠান। তাঁর এ প্রচেষ্টা জয়যুক্ত হয়েছিল। ১৮৫৬ সালের ১৬ জুলাই বিধবা-বিবাহ আইন পাস হয়। বিদ্যাসাগরের পুত্র নারায়ণচন্দ্র ১৮৭০ সালের ১১ আগস্ট শম্ভুচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের বিধবা কন্যা ভবসুন্দরীকে বিয়ে করেন। এই বিয়ের চার দিন পর ১৫ আগস্ট বিদ্যাসাগর তাঁর ছোট ভাই শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্নকে [আনু. ১৮২৮-১৯০৮] যে চিঠি লিখেছিলেন, তা নানা দিক থেকে এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, বিদ্যাসাগর-জীবনী আলোচনায় সে চিঠি অপরিহার্য হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। এখানে তার অংশবিশেষ উদ্বৃত করা যেতে পারে।

‘ইতিপূর্বে তুমি লিখিয়াছিলে, নারায়ণ বিধবা-বিবাহ করিলে আমাদের কুটুম্ব মহাশয়েরা আহার-ব্যবহার পরিত্যাগ করিবেন, অতএব নারায়ণের বিবাহ নিবারণ করা আবশ্যক। এ বিষয়ে আমার বক্তব্য এই যে, নারায়ণ স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া এই বিবাহ করিয়াছে; আমার ইচ্ছা বা অনুরোধে করে নাই। যখন শুনিলাম, সে বিধবা-বিবাহ করা স্থির করিয়াছে এবং কন্যাও উপস্থিত হইয়াছে, তখন সে বিষয়ে সম্মতি না দিয়া প্রতিবন্ধকতাচরণ করা আমার পক্ষে কোনো মতেই উচিত কর্ম হইত না। আমি বিধবাবিবাহের প্রবর্তক, আমরা উদ্যোগ করিয়া অনেকের বিবাহ দিয়াছি। এমন স্থলে আমার পুত্র বিধবা-বিবাহ না করিয়া কুমারী বিবাহ করিলে, আমি লোকের নিকট মুখ দেখাইতে পরিতাম না। ভদ্র সমাজে নিতান্ত হেয় ও অশ্রদ্ধেয় হইতাম। নারায়ণ স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া এই বিবাহ করিয়া আমার মুখ উজ্জ্বল করিয়াছে এবং লোকের নিকট আমার পুত্র বলিয়া পরিচয় দিতে পারিবে, তাহার পথ করিয়াছে। …কুটুম্ব মহাশয়েরা আহার-ব্যবহার পরিত্যাগ করিবে, এই ভয়ে যদি আমি পুত্রকে তাহার অভিপ্রেত বিধবা-বিবাহ হইতে বিরত করিতাম, তাহা হইলে আমা অপেক্ষা নরাধম আর কেহ হইত না। অধিক আর কি বলিব, সে স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া এই বিবাহ করাতে আমি আপনাকে চরিতার্থ জ্ঞান করিয়াছি। আমি দেশাচারের নিতান্ত দাস নহি, নিজের বা সমাজের মঙ্গলের নিমিত্ত যাহা উচিত বা আবশ্যক বোধ হইবে তাহা করিব; লোকের বা কুটুম্বের ভয়ে কদাচ সঙ্কুচিত হইব না।’

সেই চিঠির মধ্য দিয়ে বিদ্যাসাগর চরিত্রের অপার মহিমার প্রকাশ ঘটেছে। বিদ্যাসাগর যে কত বড়মাপের ও মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ ছিলেন, এই চিঠিটিই তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বিদ্যাসাগরের বিধবা-বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কি-না এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব শিরোনামের দুটি পুস্তিকা [জানুয়ারি ১৮৫৫ ও অক্টোবর ১৮৫৫] রচনা করেছিলেন বিধবা-বিবাহ প্রচলনার্থে সংস্কারাচ্ছন্ন হিন্দু পণ্ডিতদের বিরোধিতার উপযুক্ত জবাব দেওয়ার জন্য। তিনি হিন্দু সমাজে প্রচলিত বহুবিবাহ রোধ করার উদ্দেশ্যেও সংগ্রামে নেমেছিলেন এবং গণস্বাক্ষর সংগ্রহ করে ১৮৫৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর সরকারের কাছে আবেদনপত্র পাঠান। কিন্তু ইংরেজ সরকার এ আবেদনে কোনো সাড়া দেয়নি। তবু তাঁর সংগ্রাম অব্যাহত থাকে।

তিনি ১৮৭১ সালে প্রকাশ করেন ‘বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার’ শীর্ষক পুস্তিকা। এ গ্রন্থে তিনি উপস্থাপিত করেন বাংলা দেশের কুলীন ব্রাহ্মণদের মধ্যে প্রচলিত বহুবিবাহের বিরুদ্ধে শাস্ত্রীয় প্রমাণ। কিন্তু পুস্তিকাটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে দেশের নানা স্থান থেকে প্রতিবাদ উঠলে তিনি ১৮৭৩ সালে প্রকাশ করেন একই শিরোনামের দ্বিতীয় পুস্তিকা। আইনের সহায়তা না পাওয়ায় তিনি এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট সার্থকতা লাভ করতে না পারলেও তাঁর আন্দোলনের ফলে হিন্দু সমাজে সাড়া জাগে এবং বহুবিবাহের সংখ্যা হ্রাস পায়।

বিদ্যাসাগরের মৃত্যুর অব্যবহিত পরে ১৮৯১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কনিষ্ঠ ভ্রাতা শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন ‘বিদ্যাসাগর জীবনচরিত’ শিরোনামে একটি জীবনী গ্রন্থ প্রকাশ করেন। এর চার বছর পর ১৮৯৫ সালে ‘বিদ্যাসাগর’ শিরোনামে দুটি বৃহদাকারের জীবনী গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। গ্রন্থ দুটির লেখক চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় [১৮৫৮-১৯১৬] ও বিহারীলাল সরকার [১৮৫৫-১৯২১]। ১৮৯৬ সালে ‘বিদ্যাসাগর স্মৃতি সভা’র আমন্ত্রণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী [১৮৬৪-১৯১৯] ‘বিদ্যাসাগর চরিত’ ও ‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর’ শিরোনামে দুটি বক্তৃতা প্রদান করেন। রচনা দুটি বিদ্যাসাগর প্রতিভার মূল্যায়নে আজও দিকনির্দেশক হয়ে আছে। রবীন্দ্রনাথ বিদ্যাসাগরের সাহিত্য প্রতিভার মূল্যায়ন করতে গিয়ে ওই রচনায় লিখেছেন— ‘বিদ্যাসাগর বাংলা ভাষার প্রথম যথার্থ শিল্পী ছিলেন। তৎপূর্বে বাংলা গদ্য সাহিত্যের সূচনা হইয়াছিল, কিন্তু তিনিই সর্বপ্রথমে বাংলা গদ্যে কলানৈপুণ্যের অবতারণা করেন। …বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যভাষার উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে সুবিভক্ত, সুবিন্যস্ত, সুপরিচ্ছন্ন এবং সুসংযত করিয়া তাহাকে সহজ গতি এবং কার্যকুশলতা দান করিয়াছেন।’ বিদ্যাসাগর-চরিত্র মূল্যায়নে তিনি লিখেছেন— ‘বিদ্যাসাগরের জীবনবৃত্তান্ত আলোচনা করিয়া দেখিলে এই কথাটি বারম্বার মনে উদয় হয় যে, তিনি যে বাঙালি বড়োলোক ছিলেন তাহা নহে, তিনি রীতিমতো হিন্দু ছিলেন তাহাও নহে— তিনি তাহা অপেক্ষাও অনেক বেশি বড়ো ছিলেন, তিনি যথার্থ মানুষ ছিলেন।’

রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী তাঁর পূর্বোক্ত রচনায় লিখেছেন— ‘অণুবীক্ষণ নামে একরকম যন্ত্র আছে; তাহাতে ছোট জিনিসকে বড় করে দেখায়; বড় জিনিসকে ছোট করিয়া দেখাইবার নিমিত্ত উপায় পদার্থ বিদ্যাশাস্ত্রে নির্দিষ্ট থাকিলেও ঐ উদ্দেশ্যে নির্মিত কোনো যন্ত্র আমাদের মধ্যে সর্ব্বদা ব্যবহৃত হয় না। কিন্তু বিদ্যাসাগরের জীবনচরিত জিনিষকে ছোট দেখাইবার জন্য নির্মিত যন্ত্রস্বরূপ। আমাদের দেশের মধ্যে যাহারা খুব বড় বলিয়া আমাদের নিকট পরিচিত, ঐ গ্রন্থ একখানি সম্মুখে ধরিবা মাত্র তাঁহারা সহসা অতি ক্ষুদ্র হইয়া পড়েন; এবং এই যে বাঙালিত্ব লইয়া আমরা অহোরাত্র আস্ফালন করিয়া থাকি, তাহাও অতি ক্ষুদ্র ও শীর্ণ কলেবর ধারণ করে।’

রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী যথার্থই বলেছেন, বিদ্যাসাগরের সম্মুখে দাঁড়ালেই আমাদের ক্ষুদ্রত্ব সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। একটি নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করে এবং প্রতিকূল ঔপনিবেশিক পরিবেশের মধ্যে অবস্থান করে বিদ্যাসাগর কীভাবে মনুষ্যত্বের চূড়ায় আরোহণ করতে পেরেছিলেন, তা আজকের বাঙালিদের কাছে বিস্ময় উদ্রেককারী বিষয়। ১৯৭১ সালে বঙ্গদেশের পূর্বাঞ্চলের বাংলা ভাষাভাষী মানুষ বাঙালিত্বের গর্ব নিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে পৃথিবীর মানচিত্রে ‘বাংলাদেশ’ নামে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে সত্য, কিন্তু সে দেশে বিদ্যাসাগরের মতো ‘যথার্থ’ আধুনিক মানুষ একজনও খুঁজে পাওয়া যাবে না। স্ত্রীশিক্ষার প্রসার, বিধবা-বিবাহ প্রবর্তন এবং বহুবিবাহ রহিতের মধ্য দিয়ে বিদ্যাসাগর দেড়শ’ বছর আগে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে হিন্দু মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে যেভাবে সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিলেন, তাতে তাঁর চরিত্রের দুটি দুর্লভ দিক সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে— তাঁর দুর্জয় সাহস ও আধুনিকতার চেতনা। তাই এ কথা নিদ্বর্িধায় বলা যায়, তাঁর কীর্তির চেয়ে তিনি অনেক বড় মানুষ ছিলেন— ‘যথার্থ মানুষ ছিলেন’। বাঙালি মুসলমান সমাজে এ ধরনের ‘বিদ্যাসাগর’—এর আজ খুবই প্রয়োজন।

রবীন্দ্রনাথকে অনুসরণ করে আবারও বলি—
‘তোমার কীর্তির চেয়ে তুমি যে মহৎ,
তাই তব জীবনের রথ


২৮ জুলাই, ২০১১ খ্রীস্টাব্দে প্রকাশিত।


কোন মন্তব্য নেই

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন

vidyasagar.info ©