—মযহারুল ইসলাম বাবলা
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বিশালত্ব আকাশচুম্বী। বিদ্যা, বুদ্ধি, জ্ঞানে, মননে, পাণ্ডিত্যে তিনি ছিলেন অনন্য-অসাধারণ। বিদ্যা-শিক্ষা প্রসারে তার ভূমিকা প্রবাদতুল্য। সেই সময়কার পশ্চাৎপদ হিন্দু সমাজে বিধবা বিবাহ প্রচলন করে সমাজে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করেছিলেন। বহু ক্ষেত্রে তার শ্রেষ্ঠত্বে বাঙালি জাতি তাকে চিরদিন স্মরণে রাখবে।
তার অমরত্ব লুপ্ত হওয়ার নয়। চাঁদের বক্ষে যেমন কলঙ্ক না থাকলে চাঁদকে পরিপূর্ণ বলা যায় না। চাঁদের বক্ষে কতিপয় চিহ্নকে আমরা চাঁদের কলঙ্ক বলে অভিহিত করে থাকি। আমাদের সাহিত্যে তার বহু দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রকৃতই ইহজাগতিক মানুষ ছিলেন। দেবদেবী কিংবা দেবদূত ছিলেন না, ওতে তার ন্যূনতম বিশ্বাসও ছিল না। আর অনিবার্যরূপে ছিলেন বাঙালি। তার মহান কীর্তির পাশাপাশি বিশেষ ক্ষেত্রে সীমারেখাও ছিল।
যে সীমা বা পরিসর তিনি অতিক্রম করতে পারেননি। রক্ত-মাংসের মানুষ ছিলেন তাই ত্রুটি-বিচ্যুতির ঊর্ধ্বেও ছিলেন না। একটি বিশেষ পরিসরের বৃত্তে আজীবন আবদ্ধ থেকেছেন। বৃত্ত ভাঙার চেষ্টা করেননি।
ঈশ্বরচন্দ্রের জন্ম ২৬ সেপ্টেম্বর ১৮২০ সালে বর্তমান পশ্চিমবাংলার পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে। বীরসিংহ গ্রামটি সেকালে হুগলি জেলায় অন্তর্ভুক্ত ছিল।
পিতামহ রামজয় তর্কভূষণ ছিলেন সুপণ্ডিত এবং দৃঢ়চেতা মানুষ। জন্মের পর তার নামকরণ ‘ঈশ্বরচন্দ্র’ পিতামহই দিয়েছিলেন। পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন টুলো ব্রাহ্মণ। কলকাতায় সামান্য বেতনের চাকরি করতেন।
কিন্তু আর্থিক অসঙ্গতির কারণে পুরো পরিবার নিয়ে কলকাতায় বসবাস করা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। সে কারণেই ঈশ্বরচন্দ্র মা ও ঠাকুরমার সঙ্গে বীরসিংহ গ্রামে বসবাস করতেন। গ্রামের সনাতন বিশ্বাসের পাঠশালা, কালীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের প্রতিষ্ঠিত পাঠশালায় বাংলা শিক্ষা গ্রহণ করেন। ১৮২৮ সালে পাঠশালার শিক্ষা শেষে উচ্চশিক্ষা লাভের উদ্দেশে পিতার সঙ্গে কলকাতায় আসেন।
কলকাতার গভর্নমেন্ট সংস্কৃত শিক্ষালয়ে ব্যাকরণ এবং ১৮৩০ সালে ইংরেজি বিষয়ে ভর্তি হন। শিক্ষাজীবনে তিনি অসামান্য মেধার পরিচয় দিয়েছেন। তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকাল ১৮২৯ থেকে ১৮৪১ সাল পর্যন্ত। বাংলা, সংস্কৃত, ইংরেজি ভাষায় তার দক্ষতা ও পাণ্ডিত্য ছিল অসামান্য।
তার নামটি ঈশ্বরচন্দ্র ছিল বটে, কিন্তু তিনি ঈশ্বরকেন্দ্রিক ছিলেন না। ছিলেন মানবকেন্দ্রিক। এর বহু প্রমাণ রয়েছে তার জীবনজুড়ে। সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষের পদে থাকাবস্থায় ওই কলেজে কেবল ব্রাহ্মণ শিক্ষার্থী ছাড়া অন্য বর্ণের শিক্ষার্থীদের প্রবেশ ছিল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
সংস্কৃত কলেজে যাতে কায়স্থ শিক্ষার্থীদের অন্তত পড়াশোনার সুযোগ দেয়া হয়; ঈশ্বরচন্দ্র সেই উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। এতে কলেজের ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা চরম বিরোধিতা করেন। যাদের মধ্যে তার ব্রাহ্মণ শিক্ষকেরা পর্যন্ত ছিলেন।
রাজা রামমোহন রায় সতীদাহ প্রথা বিলোপে অমর হয়েছেন। ঈশ্বরচন্দ্রও তেমনি বিধবা বিবাহ প্রবর্তনে ইতিহাসে অমরত্ব লাভ করেছেন। তার বিধবা বিবাহ প্রবর্তনের পেছনে একটি ব্যক্তিগত ঘটনা তাকে বিধবা বিবাহ প্রবর্তনে উদ্বুদ্ধ করেছিল।
বীরসিংহ গ্রামে তার সঙ্গে এক বালিকার চমৎকার বন্ধুত্ব ছিল। পরস্পর ছিল পরস্পরের খেলার সাথী। ঈশ্বরচন্দ্র বালিকাটিকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন, এবং পছন্দও। এক সময় তাদের মধ্যে অনুরাগের সৃষ্টি হয়।
ভালোলাগা পরিণত হয় ভালোবাসায়। কিন্তু বালিকাটি যখন জানতে পারল সে বাল্যবিধবা। সারা জীবন হিন্দু বিধবাদের মতো তাকে কঠোর ব্রহ্মচর্য পালন করতে হবে। সেই বালিকাটি হিন্দু বিধবাদের কঠোর নিয়ম পালনের প্রতিবাদ স্বরূপ আত্মহত্যা করে।
এ ঘটনাই ঈশ্বরচন্দ্রকে হিন্দু বিধবাদের পুনর্বিবাহে উদ্বুদ্ধ করেছিল। ঘৃণিত সেই প্রথা বাতিলে অঙ্গীকার করেন, সরকারকে দিয়ে যে কোনো উপায়ে হিন্দু বিধবাদের পুনর্বিবাহের অধিকার প্রচলন করে আইন দ্বারা বিধিবদ্ধ করাবেন।
তখনকার সমাজ-বাস্তবতায় কাজটি মোটেও সহজ ছিল না। বিধবা বিবাহের প্রচলনে তাকে নানামুখী ষড়যন্ত্র-বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। কিন্তু দমে যাওয়ার পাত্র নন ঈশ্বরচন্দ্র।
রাজা কমলকৃষ্ণ দেববাহাদুরের সভাসদগণসহ অনেক ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতেরা একজোটে ধর্মের সর্বনাশের আশঙ্কায় তীব্র আপত্তিসহ ধর্মশাস্ত্রের ব্যাখ্যা করে ঈশ্বরচন্দ্রকে বিধবা বিবাহ নিবৃত্তকরণের চেষ্টা করেন।
ধর্মশাস্ত্র অনুসারে তারা বলেন, ‘মহাভারতে ঋষি দীর্ঘতমা ইহলোকে স্ত্রীলোকের এক পতি মাত্র নিয়ম সংস্থাপন করিয়াছেন; অতএব বিধবা বিবাহ অচল।’ [বিদ্যাসাগর রচনাসংগ্রহ, ২:৯০] জ্ঞানে-পাণ্ডিত্যে অসামান্য ঈশ্বরচন্দ্র যে ন্যূনতম ধর্মাচার না করেও ধর্মশাস্ত্র সম্পর্কে অত্যধিক জ্ঞান রাখতেন; সে ধারণা ধর্মীয় পণ্ডিতদের জানা ছিল না।
ঈশ্বরচন্দ্র ধর্মশাস্ত্রের সেই বিতর্কে মহাভারত থেকেই উদ্ধৃতি অনুবাদ করে বলেন, ‘দীর্ঘতমা ওই নিয়ম প্রচলন করেছিলেন ব্যভিচার নিবারণের জন্য।’ [বিদ্যাসাগর রচনাসংগ্রহ, ২:৯৫] মহাভারত থেকে আরও দৃষ্টান্ত দেখিয়ে বলেন, ‘নাগরাজ ঐরাবতের বিধবা কন্যাকে অর্জুন বিয়ে করেছিলেন। দীর্ঘতমার নিয়ম স্থাপনের উদ্দেশ্য যদি বিধবা বিবাহ নিষেধ করা হতো, তাহলে নাগরাজ তার বিধবা কন্যার কন্যাদান করতেন না। আর অর্জুনও বিধবা কন্যাকে বিয়ে করতে রাজি হতেন না।’ এরপর নতমুখে পণ্ডিতগণের বিদায় নেয়া ছাড়া বিকল্প উপায় ছিল না। ঈশ্বরচন্দ্র ওইসব পণ্ডিতদের উদ্দেশে মহাভারত থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছিলেন, ‘কুন্তীকে পাণ্ডু বলছেন : আগে নারীরা অলুব্ধা, স্বাধীনতা ও স্বচ্ছন্দ বিহারিণী ছিলেন। পতিকে ছেড়ে অন্য পুরুষে উপগতা হলে তাদের অধর্ম হতো না। পুরাকালে এই ছিল ধর্ম। ঋষিরা এই ধর্মই মেনে চলেন। উত্তরকুরু দেশে এখনও এই ধর্ম মানা হয়। এই সনাতন ধর্ম স্ত্রীদের প্রতি অনুকূল। (স্ত্রীণাম্ অনুগ্রহকর স হি ধর্ম : সনাতন :)
তবে উত্তরকুরু নামে সব-পেয়েছির-দেশ-এর বাইরে এই প্রথা বহাল রইল না কেন? পাণ্ডু তারও বিবরণ দেন, শ্বেতকেতু, তার বাবা ও মা এক জায়গায় বসেছিলেন। এমন সময় এক ব্রাহ্মণ এসে শ্বেতকেতুর মায়ের হাত ধরে ‘এসো যাই’ বলে তাকে আড়ালে নিয়ে গেলেন। শ্বেতকেতু তাতে প্রচণ্ড ক্ষীপ্ত হয়েছেন দেখে তার বাবা বললেন, ‘রাগ কোরো না, পুত্র; এই তো সনাতন ধর্ম’ (মা তাত কোপং কার্ষীস্ ত্বম্ এষ ধর্মঃ সনাতনঃ)
শ্বেতকেতু এতে আশ্বস্ত না হয়ে নিয়ম ঘোষণা করেন : নারী বা পুরুষ কেউই তার স্বামী বা স্ত্রীকে অতিক্রম করতে পারবে না। উদ্দালকের ছেলে শ্বেতকেতু বলপূর্বক এই নিয়ম স্থাপন করেছিলেন।
তাহলে দেখা যায় অতীতে যেটা সনাতন ধর্ম ছিল, সেটা আর সনাতন ধর্ম রইল না। নতুন নিয়ম প্রচলন হল। স্বামী-স্ত্রী বিষয়ে সনাতন ধর্ম আর অপরিবর্তিত থাকল না। সনাতন ধর্মেরও পরিবর্তন হয়, যুগের তাগিদে।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিধবা বিবাহ প্রচলনের উদ্দেশ্যে ‘বিধবা বিবাহ’ দ্বিতীয় গ্রন্থের শেষে প্রতিপক্ষদের আরও বলেন, ‘আর আপনারা ইহাও বিবেচনা করিয়া দেখুন আমাদের দেশের আচার একেবারেই অপরিবর্তনীয় নহে।
ইহা কেহই প্রতিপন্ন করিতে পারিবেন না, সৃষ্টিকাল অবধি আমাদের দেশে আচার পরিবর্তন হয় নাই; এক আচারই পূর্বাপর চলিয়া আসিতেছে। অনুসন্ধান করিয়া দেখিলে, আমাদের দেশের আচার পরিবর্তিত হইয়া আসিয়াছে।
পূর্বকালে এ দেশে চারি বর্ণে যেরূপ আচার ছিল, এক্ষণকার আচারের সঙ্গে তুলনা করিয়া দেখিলে, ভারতবর্ষের ইদানীন্তন লোকদিগকে এক বিভিন্ন জাতি বলিয়া প্রতীতি জন্মে। বস্তুতঃ ক্রমে ক্রমে আচারের এত পরিবর্তন হইয়াছে যে, ভারতবর্ষের ইদানীন্তন লোক, পূর্বতন লোকদিগের সন্তান পরম্পরা, এরূপ প্রতীতি হওয়া অসম্ভব।’ [বিদ্যাসাগর রচনাসংগ্রহ, ২:১৬০-১৬১]
ধর্ম নিয়ে উত্তেজনা সৃষ্টি-মাতামাতি ছিল বিদ্যাসাগরের চিন্তা-দৃষ্টিভঙ্গি ও আচারের সম্পূর্ণ বহির্ভূত। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ধর্মাচার করতেন না এবং ধার্মিকও ছিলেন না। অথচ ধর্মশাস্ত্র-সংস্কৃতে তার পাণ্ডিত্য ছিল অসামান্য।
বিধবা বিবাহ যে ধর্ম বিরুদ্ধ নয়, বিপরীতে ধর্মীয় মতে বৈধ; সেটা প্রমাণে তাকে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি। অনায়াসে প্রতিপক্ষদের পরাস্ত করতে পেরেছিলেন, ধর্মশাস্ত্র প্রমাণে। তার ধর্ম-ধারণা সম্পর্কে ড. বিনয় ঘোষ একটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন। তিনি শিবনাথ শাস্ত্রীর উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন; বিদ্যাসাগর জিজ্ঞেস করলেন, ‘ও হে হারাণ, তুমি তো কাশীবাস করছ, কিন্তু গাঁজা খেতে শিখেছ ত?’ উত্তরে শিবনাথ শাস্ত্রীর পিতা হারাণ শাস্ত্রী বলেন, ‘কাশীবাস করার সঙ্গে গাঁজা খাওয়ার কি সম্বন্ধ আছে?’ বিদ্যাসাগর বলেন, ‘তুমি তো জান, সাধারণ লোকের বিশ্বাস যে কাশীতে মরলে শিব হয়। কিন্তু শিব হচ্ছেন ভয়ানক গাঁজাখোর। সুতরাং আগে থেকে গাঁজা খাওয়ার অভ্যাসটা করে রাখা উচিত নয় কি? তা না হলে যখন প্রথম গাঁজা খাবে তখন তো মুস্কিলে পড়তে পার।’ [ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বিনয় ঘোষ, পৃ ১৫২] ড. বিনয় ঘোষ ওই গ্রন্থের ৪০ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘বিদ্যাসাগরের পাণ্ডিত্য ছিল মানবকেন্দ্রিক ঈশ্বরকেন্দ্রিক নয়।’
ঋষি রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব বিদ্যাসাগরের বাড়িতে যান। তাকে শিষ্য করতে না পারলেও অন্তত ধার্মিক করতে। রামকৃষ্ণের উপস্থিতি বিদ্যাসাগরের কাছে অসহ্য ঠেকছিল। রামকৃষ্ণ তাকে বলেন, ‘আমি সাগরে এসেছি, ইচ্ছা আছে কিছু রত্ন সংগ্রহ করে নিয়ে যাব।’ বিদ্যাসাগর বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘আপনার ইচ্ছা পূর্ণ হবে বলে তো মনে হয় না, কারণ এ সাগরে কেবল শামুকই পাবেন।’
পরবর্তীতে রামকৃষ্ণ বিদ্যাসাগর প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘এমন কি তার (বিদ্যাসাগরের) নিজের মোক্ষলাভের জন্য ভগবানের নাম করবারও তার কোনো স্পৃহা নেই, সেইটা বোধ হয় তার সবচেয়ে বড় ত্যাগ। অন্য লোকের উপকার করতে গিয়ে তিনি নিজের আত্মার উপকার করার প্রয়োজন অগ্রাহ্য করেছেন।’ [ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বিনয় ঘোষ, পৃ ১৫৭]
দুরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত বিদ্যাসাগর, রাজা রামমোহন রায়ের পুত্র রাধাপ্রসাদ রায়ের পৌত্র ললিতমোহন রায়কে স্নেহে কাছে ডেকে বলেছেন, ‘ললিত তুমি কি সত্যিই বিশ্বাস কর যে মৃত্যুর পর জীবন আছে? আমরা আমাদের এই পার্থিব জীবন সম্বন্ধেই অনেক কিছু জানি না।
কিন্তু তুমি ভাগ্যবান, কারণ তুমি শুধু এই পার্থিব জীবন সম্বন্ধেই জান তা নয়, এমনকি মৃত্যুর পর পারলৌকিক জীবন সম্বন্ধেও তোমার জ্ঞান আছে।’ …বিদ্যাসাগর হাসতে হাসতে বললেন, ‘তোমার কথা শুনে বেশ মধুর লাগছে, যদিও হাসি পাচ্ছে। আমার এই জরাজীর্ণ বার্ধক্য অবস্থায় শুনে খুব সান্ত্বনা পেলাম যে মৃত্যুর পর আমি উপযুক্ত প্রতিদান পাব।’ [ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বিনয় ঘোষ, পৃ ১৫৪]
অসামান্য ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নানা ক্ষেত্রে উজ্জ্বলতম। কিন্তু তারও যে সীমা রয়েছে, সেটাও অস্বীকার করি কীভাবে। ইংরেজ শাসকদের প্রতি তার ছিল অগাধ বিশ্বাস-ভরসা এবং আনুগত্য।
ব্যক্তিগতভাবে এক ইংরেজ উচ্চ পদস্থ কর্তার সঙ্গে তার বিরোধ ও বিবাদের ঘটনা রয়েছে। সেটা ওই ইংরেজ ব্যক্তিটির সঙ্গে। ইংরেজ জাতি কিংবা ইংরেজদের ঘৃণিত শাসন ব্যবস্থার প্রতি নয়। যখন দেশজুড়ে ইংরেজবিরোধী মনোভাব দানা বাঁধছে।
শিক্ষিত-সচেতন মানুষ রাজনীতিতে একে একে যুক্ত হচ্ছেন। অথচ বিদ্যাসাগর তখন রাজনীতি বিমুখ। তিনি রাজনীতি সংশ্লিষ্ট ছিলেন না বলেই ইংরেজ শাসকেরা তার প্রতি ন্যূনতম বিরূপ ধারণা পোষণ করত না। ভারতীয় কংগ্রেসের সভাপতি উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং তাকে কংগ্রেসে যোগদানের অনুরোধ-আবেদন করেছিলেন।
কিন্তু বিদ্যাসাগর সেই আবেদনে সাড়া না দিয়ে বলেছিলেন, ‘আমাকে বাদ দিয়েই তোমরা কাজে এগোও।’ তার জীবনীকারদের রচনায় জানা যায় যে, তিনি আগাগোড়া ইংরেজদের প্রিয়পাত্র ছিলেন। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলেছেন, ‘তিনি গভর্নমেন্টের একজন প্রিয়পাত্র হইয়া উঠিলেন…।’ রমেশচন্দ্র দত্ত লিখেছেন, ‘…ভারতবর্ষের উন্নতিকামী ইংরেজ বর্গ একজন সহকর্মী পাইলেন।’
সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর ইংরেজ শাসকদের সঙ্গে তার সম্পর্ক কেমন ছিল? সে প্রসঙ্গে ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘বিদ্যাসাগর এখন আর সরকারি বেতনভোগী কর্মচারী নন।
না হইলেও, বেসরকারি পরামর্শদাতা হিসেবে তিনি সরকারের উপকার সাধন করিতে লাগিলেন। পরপর বহু ছোটলার্টই তাহার পরামর্শ গ্রহণ করিতেন। …অবসর গ্রহণের বিশ বছর পর ১৮৯০ সালে নববর্ষের প্রথম দিনে ভারত গভর্নমেন্ট তাহাকে সিআইই উপাধিতে ভূষিত করেন।’ C.I.E অর্থাৎ Companion of the Indian Empire. বঙ্গানুবাদে- ভারত সাম্রাজ্যের সহযোগী।
ইংরেজ কর্তৃক চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থা আরোপ সম্পর্কে বিদ্যাসাগর ছিলেন ইতিবাচক মনোভাবাসম্পন্ন। অর্থাৎ ঘৃণিত সেই ব্যবস্থার পক্ষে। তাই জনবিরোধী চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সম্পর্কে বলেছেন, ‘এই দশশলা বন্দোবস্ত ইহাই নির্ধারিত হইল, এ পর্যন্ত যে সকল জমিদার কেবল রাজস্ব সংগ্রহ করিতেছেন; অতঃপর তাহারাই ভূমির স্বামী হইবেন; প্রজারা তাহাদের সহিত রাজস্বের বন্দোবস্ত করিবেক। …চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হওয়াতে বাঙ্গালা দেশের যে সবিশেষ উপকার দর্শিয়াছে ইহাতে কোনও সন্দেহ নাই।’
‘বাঙ্গালার ইতিহাস’-এর দ্বিতীয় ভাগে বিদ্যাসাগর যেসব বাক্য রচনা করেছেন তাতে ইংরেজদের প্রতি তার ভক্তি-শ্রদ্ধা, আনুগত্য-ভালোবাসার সীমাহীন পরিচয় পাওয়া যায়।
বিদ্যাসাগর লিখেছেন, ‘বাঙ্গালার ইতিহাসের দ্বিতীয় ভাগ, শ্রীযুক্ত মার্শম্যান সাহেবের রচিত ঈঙ্গরেজী গ্রন্থের শেষ নয় অধ্যায় অবলম্বনপূর্বক সংকলিত, …এই পুস্তকে অতি দুরাচার নবাব সিরাজউদ্দৌলার সিংহাসনারোহণ অবধি, চিরস্মরণীয় লর্ড উইলিয়াম বেন্টিক মহোদয়ের অধিকার সমাপ্তি পর্যন্ত বৃত্তান্ত বর্ণিত আছে।’ [বিদ্যাসাগর রচনাবলী, ১ম খণ্ড, পৃ ১০৫]
ঈশ্বরচন্দ্রের ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’ প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক অসিত বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘বিদ্যাসাগর প্রায় মার্শম্যানের অবিকল অনুবাদ করিয়াছেন। মার্শম্যানের সাম্রাজ্যবাদী ও ইসলামবিদ্বেষী দৃষ্টিভঙ্গিমাও তিনি হুবহু স্বীকার করিয়া লইয়া অনুবাদ করিয়াছেন।’ [বিদ্যাসাগর রচনাবলী, ১ম খণ্ড, পৃ ৩২১]
পলাশীর প্রহসন যুদ্ধ সম্পর্কে দখলদার ইংরেজদের রচিত বিকৃত ও মিথ্যার ইতিহাসকে বিদ্যাসাগর কেবল স্বীকারই করেননি; বঙ্গানুবাদে ইংরেজদের রচিত বিকৃত ও মিথ্যার ইতিহাস দেশবাসীর অন্তরে প্রবেশ করিয়ে ইংরেজ শাসনের পক্ষে জনমত সৃষ্টিতে অবদান রেখেছেন।
ঔপনিবেশিক ইংরেজ শাসকদের বিরুদ্ধে পলাশীর প্রহসন যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌলার বীরত্ব-দেশপ্রেম এবং আত্মদানকে অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় তার সিরাজউদ্দৌলা গ্রন্থে সর্বপ্রথম তথ্য-উপাত্ত, প্রমাণসহ দেশবাসীর কাছে প্রকৃত সত্য উন্মোচন করেছিলেন, পলাশীর যুদ্ধের ১৩৯ বছর পর।
এর পূর্বে ইংরেজরা দেশীয় অনুগত দালাল লেখকদের দিয়ে দেশপ্রেমিক সিরাজউদ্দৌলার জীবন ও চরিত্রে মিথ্যা কালিমা লেপন করে তার বীরত্ব ও দেশপ্রেমকে হেয় প্রতিপন্ন করেছিল। ইংরেজদের সেই ইতিহাস বিকৃতিতে বিদ্যাসাগরের প্রত্যক্ষ ভূমিকা মাশম্যানের রচনার অবিকল অনুবাদ প্রমাণ করে তার পরিসরের সীমাবদ্ধতা।
১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহকে কার্ল মার্কস ভারতীয়দের প্রথম স্বাধীনতার যুদ্ধ বলে অভিহিত করেছেন, তার রচনায়। সিপাই বিদ্রোহের সময় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বয়স ৩৭ বছর। তিনি ওই বিদ্রোহের পক্ষে কিংবা বিপক্ষে অবস্থান নেননি সত্য। তবে তার নিরপেক্ষতা পক্ষান্তরে ইংরেজের পক্ষেই। তখন তিনি বহু বিবাহ বন্ধ করা নিয়ে মেতেছিলেন।
এ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, ‘কিন্তু এই হতভাগ্য দেশে দুর্ভাগ্যক্রমে সেই সময় রাজ বিদ্রোহ উপস্থিত হইল। রাজপুরুষেরা বিদ্রোহের নিবারণ বিষয়ে সম্পূর্ণ ব্যাপৃত হইলেন, বহু বিবাহের নিবারণ বিষয়ে আর তাহাদের মনোযোগ দিবার অবকাশ রহিল না।’ [ঊনবিংশ শতাব্দীর নারী প্রগতি ও রামমোহন-বিদ্যাসাগর, কনক মুখোপাধ্যায়, পৃ. ৭৫] সারা ভারতজুড়ে ছড়িয়ে পড়া সিপাহী বিদ্রোহে ইংরেজদের তখন ত্রাহি অবস্থা।
অথচ তখনই বিদ্যাসাগর বলছেন, ‘বাবুরা কংগ্রেস করিতেছেন, আন্দোলন করিতেছেন, আস্ফালন করিতেছেন, বক্তৃতা করিতেছেন, ভারত উদ্ধার করিতেছেন। দেশের সহস্র সহস্র লোক অনাহারে প্রতিদিন মরিতেছেন তাহার দিকে কেহই দেখিতেছেন না।
রাজনীতি লইয়া কি হইবে?…’ [ঊনবিংশ শতাব্দীর নারী প্রগতি ও রামমোহন-বিদ্যাসাগর, কনক মুখোপাধ্যায়, পৃ. ৭৬-৭৭] তার এই বক্তব্যকে বিশ্লেষণ করলে তার দৃষ্টিভঙ্গি বুঝে নেয়া মোটেও কঠিন নয়।
অনাহারে মানুষের মৃত্যুর জন্য তিনি আহাজারি করেছেন বটে। অথচ অনাহারে মানুষের মৃত্যুর প্রকৃত ও সম্পূর্ণ দায় তো ইংরেজ সরকারের। সরকারের দায় সম্পর্কে তিনি টুঁ শব্দটি করেননি।
বিপরীতে তিনি রাজনীতি ও রাজনীতিকদের প্রতি অপবাদ দিয়েছেন। কংগ্রেস রাজনীতি তখন কিংস পার্টির আবরণ ত্যাগ করতে পারেনি। ইংরেজদের অনুদানে কংগ্রেস তখন রাজকীয় এবং উঠতি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বৈঠকবাজি-খাওয়া খাদ্যে আমোদ-ফুর্তির পার্টি বিশেষ। ভারতবাসীর মুক্তির জন্য কিংবা পরাধীন ভারতকে শত্রুমুক্ত করতে রাজনীতির বিকল্প তো কিছু হতে পারে না।
সিপাহী বিপ্লব তো সে বার্তাই দিয়েছে। বিদ্যাসাগর সেই ক্রান্তিকালে ইংরেজদের বিরুদ্ধে না দাঁড়িয়ে কার পক্ষ সেদিন নিয়েছিলেন? তার বক্তব্যটি বিশ্লেষণ করলে কী দাঁড়ায়?
ইংরেজ শাসকদের থেকে তার প্রাপ্তি কম নয়। বিদ্যাসাগরকে বিদ্যা ও জ্ঞানের স্বীকৃতি স্বরূপ ইংরেজ সরকার ১৮৩৯ সালে তাকে ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি দিয়েছিল। সেই থেকেই ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় হয়ে ওঠেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।
১৮৪১ সালে ন্যায়ের শেষ পরীক্ষায় প্রথম হয়ে পান ইংরেজ সরকার থেকে ১০০ টাকা বৃত্তি। দেবনাগরী ভাষার হস্তলিপির জন্য ৮ টাকা পুরস্কার। সংস্কৃত রচনার জন্য ১০০ টাকা।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আইন ব্যুৎপত্তির জন্য ২৫ টাকা। কোম্পানি সরকার মাসিক ৮ টাকা বৃত্তি দেন। ১৮৪১ সালের ৪ ডিসেম্বর সংস্কৃত ভাষার পাণ্ডিত্যের জন্য সম্মাননা-প্রশংসাপত্র তাকে দেয়া হয়।
ওই বছরই তিনি ফোর্ড উইলিয়াম কলেজের বাংলা বিভাগের শিক্ষকরূপে যোগ দেন। এবং হেড রাইটার ও ট্রেজারারের পদও লাভ করেন। ১৮৪৬ সালে সংস্কৃত কলেজের সহকারী সচিব নিযুক্ত হন।
নিঃসন্দেহে বাঙালি মনীষা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর স্বীয় যোগ্যতায় শিক্ষাক্ষেত্রের নানা উচ্চপদে আসীন হয়েছিলেন। কিন্তু ইংরেজ বিরোধিতা করলে তাকে সে পদমর্যাদা নিশ্চয় ইংরেজ সরকার দিত না। পেতেন না উপাধি, পুরস্কার, বৃত্তিসহ নানা উপঢৌকনও। ১৯০ বছরের ইংরেজ শাসনের ইতিহাসে অমন নজির তো বহু রয়েছে।
অসামান্য বিদ্যাসাগরের পরিসর এখানেই নির্ধারিত। তিনি সেটা অতিক্রম করতে পারেননি। সিপাহী বিদ্রোহের বিরুদ্ধে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, নবীনচন্দ্র সেন প্রমুখের মতো বিদ্যাসাগর সিপাহী বিদ্রোহের বিরুদ্ধে এবং ইংরেজদের পক্ষে কলম ধরেননি সত্য।
তবে কৌশলগত উপায়ে বিদ্রোহের সময়কালে বহুবিবাহ রদ নিয়ে মেতে ছিলেন। যেটি বিদ্রোহের পক্ষে ছিল না। অপ্রত্যক্ষে বিদ্রোহের বিরুদ্ধে এবং ইংরেজদের পক্ষে। সীমা বা পরিসর অতিক্রম না করাদের তালিকা আমাদের ইতিহাসে ক্ষুদ্র নয়।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনে স্থানীয় সামন্ত জমিদার, রাজা, মহারাজাদের সহজেই ইংরেজরা চরম অনুগত-মিত্র রূপে পেয়েছিল। ঘৃণিত সেই প্রথার পক্ষে বিদ্যাসাগরের মতো অনেক জ্ঞানীগুণীরা ছিলেন বলেই হাজার হাজার মাইল পেরিয়ে প্রায় দুইশত বছর ভারতবাসীকে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ রাখতে পেরেছিল সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ। কত শত-সহস্র দেশপ্রেমিক ইংরেজ বিরোধিতায়-রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে প্রাণ দিয়েছে দেশ-মাতৃকার স্বাধীনতার জন্য, তাদের ক’জনের কথা আমরা স্মরণ করি!
অসামান্য ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮৯১ সালে ঘাতক ব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে কলকাতার নিজ বাড়িতে প্রাণত্যাগ করেন। পাণ্ডিত্যে অনন্য, প্রতিভাবান সাহিত্যিক, সংস্কৃতি-ইংরেজি ভাষার সুপণ্ডিত, বিধবা বিবাহ-প্রচলনের জন্য বিদ্যাসাগর ব্যক্তিগত পরিসরের পরও বাঙালির হৃদয়ে অমর হয়েই থাকবেন।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বিশালত্ব আকাশচুম্বী। বিদ্যা, বুদ্ধি, জ্ঞানে, মননে, পাণ্ডিত্যে তিনি ছিলেন অনন্য-অসাধারণ। বিদ্যা-শিক্ষা প্রসারে তার ভূমিকা প্রবাদতুল্য। সেই সময়কার পশ্চাৎপদ হিন্দু সমাজে বিধবা বিবাহ প্রচলন করে সমাজে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করেছিলেন। বহু ক্ষেত্রে তার শ্রেষ্ঠত্বে বাঙালি জাতি তাকে চিরদিন স্মরণে রাখবে।
তার অমরত্ব লুপ্ত হওয়ার নয়। চাঁদের বক্ষে যেমন কলঙ্ক না থাকলে চাঁদকে পরিপূর্ণ বলা যায় না। চাঁদের বক্ষে কতিপয় চিহ্নকে আমরা চাঁদের কলঙ্ক বলে অভিহিত করে থাকি। আমাদের সাহিত্যে তার বহু দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রকৃতই ইহজাগতিক মানুষ ছিলেন। দেবদেবী কিংবা দেবদূত ছিলেন না, ওতে তার ন্যূনতম বিশ্বাসও ছিল না। আর অনিবার্যরূপে ছিলেন বাঙালি। তার মহান কীর্তির পাশাপাশি বিশেষ ক্ষেত্রে সীমারেখাও ছিল।
যে সীমা বা পরিসর তিনি অতিক্রম করতে পারেননি। রক্ত-মাংসের মানুষ ছিলেন তাই ত্রুটি-বিচ্যুতির ঊর্ধ্বেও ছিলেন না। একটি বিশেষ পরিসরের বৃত্তে আজীবন আবদ্ধ থেকেছেন। বৃত্ত ভাঙার চেষ্টা করেননি।
ঈশ্বরচন্দ্রের জন্ম ২৬ সেপ্টেম্বর ১৮২০ সালে বর্তমান পশ্চিমবাংলার পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে। বীরসিংহ গ্রামটি সেকালে হুগলি জেলায় অন্তর্ভুক্ত ছিল।
পিতামহ রামজয় তর্কভূষণ ছিলেন সুপণ্ডিত এবং দৃঢ়চেতা মানুষ। জন্মের পর তার নামকরণ ‘ঈশ্বরচন্দ্র’ পিতামহই দিয়েছিলেন। পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন টুলো ব্রাহ্মণ। কলকাতায় সামান্য বেতনের চাকরি করতেন।
কিন্তু আর্থিক অসঙ্গতির কারণে পুরো পরিবার নিয়ে কলকাতায় বসবাস করা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। সে কারণেই ঈশ্বরচন্দ্র মা ও ঠাকুরমার সঙ্গে বীরসিংহ গ্রামে বসবাস করতেন। গ্রামের সনাতন বিশ্বাসের পাঠশালা, কালীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের প্রতিষ্ঠিত পাঠশালায় বাংলা শিক্ষা গ্রহণ করেন। ১৮২৮ সালে পাঠশালার শিক্ষা শেষে উচ্চশিক্ষা লাভের উদ্দেশে পিতার সঙ্গে কলকাতায় আসেন।
কলকাতার গভর্নমেন্ট সংস্কৃত শিক্ষালয়ে ব্যাকরণ এবং ১৮৩০ সালে ইংরেজি বিষয়ে ভর্তি হন। শিক্ষাজীবনে তিনি অসামান্য মেধার পরিচয় দিয়েছেন। তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকাল ১৮২৯ থেকে ১৮৪১ সাল পর্যন্ত। বাংলা, সংস্কৃত, ইংরেজি ভাষায় তার দক্ষতা ও পাণ্ডিত্য ছিল অসামান্য।
তার নামটি ঈশ্বরচন্দ্র ছিল বটে, কিন্তু তিনি ঈশ্বরকেন্দ্রিক ছিলেন না। ছিলেন মানবকেন্দ্রিক। এর বহু প্রমাণ রয়েছে তার জীবনজুড়ে। সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষের পদে থাকাবস্থায় ওই কলেজে কেবল ব্রাহ্মণ শিক্ষার্থী ছাড়া অন্য বর্ণের শিক্ষার্থীদের প্রবেশ ছিল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
সংস্কৃত কলেজে যাতে কায়স্থ শিক্ষার্থীদের অন্তত পড়াশোনার সুযোগ দেয়া হয়; ঈশ্বরচন্দ্র সেই উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। এতে কলেজের ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা চরম বিরোধিতা করেন। যাদের মধ্যে তার ব্রাহ্মণ শিক্ষকেরা পর্যন্ত ছিলেন।
রাজা রামমোহন রায় সতীদাহ প্রথা বিলোপে অমর হয়েছেন। ঈশ্বরচন্দ্রও তেমনি বিধবা বিবাহ প্রবর্তনে ইতিহাসে অমরত্ব লাভ করেছেন। তার বিধবা বিবাহ প্রবর্তনের পেছনে একটি ব্যক্তিগত ঘটনা তাকে বিধবা বিবাহ প্রবর্তনে উদ্বুদ্ধ করেছিল।
বীরসিংহ গ্রামে তার সঙ্গে এক বালিকার চমৎকার বন্ধুত্ব ছিল। পরস্পর ছিল পরস্পরের খেলার সাথী। ঈশ্বরচন্দ্র বালিকাটিকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন, এবং পছন্দও। এক সময় তাদের মধ্যে অনুরাগের সৃষ্টি হয়।
ভালোলাগা পরিণত হয় ভালোবাসায়। কিন্তু বালিকাটি যখন জানতে পারল সে বাল্যবিধবা। সারা জীবন হিন্দু বিধবাদের মতো তাকে কঠোর ব্রহ্মচর্য পালন করতে হবে। সেই বালিকাটি হিন্দু বিধবাদের কঠোর নিয়ম পালনের প্রতিবাদ স্বরূপ আত্মহত্যা করে।
এ ঘটনাই ঈশ্বরচন্দ্রকে হিন্দু বিধবাদের পুনর্বিবাহে উদ্বুদ্ধ করেছিল। ঘৃণিত সেই প্রথা বাতিলে অঙ্গীকার করেন, সরকারকে দিয়ে যে কোনো উপায়ে হিন্দু বিধবাদের পুনর্বিবাহের অধিকার প্রচলন করে আইন দ্বারা বিধিবদ্ধ করাবেন।
তখনকার সমাজ-বাস্তবতায় কাজটি মোটেও সহজ ছিল না। বিধবা বিবাহের প্রচলনে তাকে নানামুখী ষড়যন্ত্র-বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। কিন্তু দমে যাওয়ার পাত্র নন ঈশ্বরচন্দ্র।
রাজা কমলকৃষ্ণ দেববাহাদুরের সভাসদগণসহ অনেক ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতেরা একজোটে ধর্মের সর্বনাশের আশঙ্কায় তীব্র আপত্তিসহ ধর্মশাস্ত্রের ব্যাখ্যা করে ঈশ্বরচন্দ্রকে বিধবা বিবাহ নিবৃত্তকরণের চেষ্টা করেন।
ধর্মশাস্ত্র অনুসারে তারা বলেন, ‘মহাভারতে ঋষি দীর্ঘতমা ইহলোকে স্ত্রীলোকের এক পতি মাত্র নিয়ম সংস্থাপন করিয়াছেন; অতএব বিধবা বিবাহ অচল।’ [বিদ্যাসাগর রচনাসংগ্রহ, ২:৯০] জ্ঞানে-পাণ্ডিত্যে অসামান্য ঈশ্বরচন্দ্র যে ন্যূনতম ধর্মাচার না করেও ধর্মশাস্ত্র সম্পর্কে অত্যধিক জ্ঞান রাখতেন; সে ধারণা ধর্মীয় পণ্ডিতদের জানা ছিল না।
ঈশ্বরচন্দ্র ধর্মশাস্ত্রের সেই বিতর্কে মহাভারত থেকেই উদ্ধৃতি অনুবাদ করে বলেন, ‘দীর্ঘতমা ওই নিয়ম প্রচলন করেছিলেন ব্যভিচার নিবারণের জন্য।’ [বিদ্যাসাগর রচনাসংগ্রহ, ২:৯৫] মহাভারত থেকে আরও দৃষ্টান্ত দেখিয়ে বলেন, ‘নাগরাজ ঐরাবতের বিধবা কন্যাকে অর্জুন বিয়ে করেছিলেন। দীর্ঘতমার নিয়ম স্থাপনের উদ্দেশ্য যদি বিধবা বিবাহ নিষেধ করা হতো, তাহলে নাগরাজ তার বিধবা কন্যার কন্যাদান করতেন না। আর অর্জুনও বিধবা কন্যাকে বিয়ে করতে রাজি হতেন না।’ এরপর নতমুখে পণ্ডিতগণের বিদায় নেয়া ছাড়া বিকল্প উপায় ছিল না। ঈশ্বরচন্দ্র ওইসব পণ্ডিতদের উদ্দেশে মহাভারত থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছিলেন, ‘কুন্তীকে পাণ্ডু বলছেন : আগে নারীরা অলুব্ধা, স্বাধীনতা ও স্বচ্ছন্দ বিহারিণী ছিলেন। পতিকে ছেড়ে অন্য পুরুষে উপগতা হলে তাদের অধর্ম হতো না। পুরাকালে এই ছিল ধর্ম। ঋষিরা এই ধর্মই মেনে চলেন। উত্তরকুরু দেশে এখনও এই ধর্ম মানা হয়। এই সনাতন ধর্ম স্ত্রীদের প্রতি অনুকূল। (স্ত্রীণাম্ অনুগ্রহকর স হি ধর্ম : সনাতন :)
তবে উত্তরকুরু নামে সব-পেয়েছির-দেশ-এর বাইরে এই প্রথা বহাল রইল না কেন? পাণ্ডু তারও বিবরণ দেন, শ্বেতকেতু, তার বাবা ও মা এক জায়গায় বসেছিলেন। এমন সময় এক ব্রাহ্মণ এসে শ্বেতকেতুর মায়ের হাত ধরে ‘এসো যাই’ বলে তাকে আড়ালে নিয়ে গেলেন। শ্বেতকেতু তাতে প্রচণ্ড ক্ষীপ্ত হয়েছেন দেখে তার বাবা বললেন, ‘রাগ কোরো না, পুত্র; এই তো সনাতন ধর্ম’ (মা তাত কোপং কার্ষীস্ ত্বম্ এষ ধর্মঃ সনাতনঃ)
শ্বেতকেতু এতে আশ্বস্ত না হয়ে নিয়ম ঘোষণা করেন : নারী বা পুরুষ কেউই তার স্বামী বা স্ত্রীকে অতিক্রম করতে পারবে না। উদ্দালকের ছেলে শ্বেতকেতু বলপূর্বক এই নিয়ম স্থাপন করেছিলেন।
তাহলে দেখা যায় অতীতে যেটা সনাতন ধর্ম ছিল, সেটা আর সনাতন ধর্ম রইল না। নতুন নিয়ম প্রচলন হল। স্বামী-স্ত্রী বিষয়ে সনাতন ধর্ম আর অপরিবর্তিত থাকল না। সনাতন ধর্মেরও পরিবর্তন হয়, যুগের তাগিদে।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিধবা বিবাহ প্রচলনের উদ্দেশ্যে ‘বিধবা বিবাহ’ দ্বিতীয় গ্রন্থের শেষে প্রতিপক্ষদের আরও বলেন, ‘আর আপনারা ইহাও বিবেচনা করিয়া দেখুন আমাদের দেশের আচার একেবারেই অপরিবর্তনীয় নহে।
ইহা কেহই প্রতিপন্ন করিতে পারিবেন না, সৃষ্টিকাল অবধি আমাদের দেশে আচার পরিবর্তন হয় নাই; এক আচারই পূর্বাপর চলিয়া আসিতেছে। অনুসন্ধান করিয়া দেখিলে, আমাদের দেশের আচার পরিবর্তিত হইয়া আসিয়াছে।
পূর্বকালে এ দেশে চারি বর্ণে যেরূপ আচার ছিল, এক্ষণকার আচারের সঙ্গে তুলনা করিয়া দেখিলে, ভারতবর্ষের ইদানীন্তন লোকদিগকে এক বিভিন্ন জাতি বলিয়া প্রতীতি জন্মে। বস্তুতঃ ক্রমে ক্রমে আচারের এত পরিবর্তন হইয়াছে যে, ভারতবর্ষের ইদানীন্তন লোক, পূর্বতন লোকদিগের সন্তান পরম্পরা, এরূপ প্রতীতি হওয়া অসম্ভব।’ [বিদ্যাসাগর রচনাসংগ্রহ, ২:১৬০-১৬১]
ধর্ম নিয়ে উত্তেজনা সৃষ্টি-মাতামাতি ছিল বিদ্যাসাগরের চিন্তা-দৃষ্টিভঙ্গি ও আচারের সম্পূর্ণ বহির্ভূত। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ধর্মাচার করতেন না এবং ধার্মিকও ছিলেন না। অথচ ধর্মশাস্ত্র-সংস্কৃতে তার পাণ্ডিত্য ছিল অসামান্য।
বিধবা বিবাহ যে ধর্ম বিরুদ্ধ নয়, বিপরীতে ধর্মীয় মতে বৈধ; সেটা প্রমাণে তাকে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি। অনায়াসে প্রতিপক্ষদের পরাস্ত করতে পেরেছিলেন, ধর্মশাস্ত্র প্রমাণে। তার ধর্ম-ধারণা সম্পর্কে ড. বিনয় ঘোষ একটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন। তিনি শিবনাথ শাস্ত্রীর উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন; বিদ্যাসাগর জিজ্ঞেস করলেন, ‘ও হে হারাণ, তুমি তো কাশীবাস করছ, কিন্তু গাঁজা খেতে শিখেছ ত?’ উত্তরে শিবনাথ শাস্ত্রীর পিতা হারাণ শাস্ত্রী বলেন, ‘কাশীবাস করার সঙ্গে গাঁজা খাওয়ার কি সম্বন্ধ আছে?’ বিদ্যাসাগর বলেন, ‘তুমি তো জান, সাধারণ লোকের বিশ্বাস যে কাশীতে মরলে শিব হয়। কিন্তু শিব হচ্ছেন ভয়ানক গাঁজাখোর। সুতরাং আগে থেকে গাঁজা খাওয়ার অভ্যাসটা করে রাখা উচিত নয় কি? তা না হলে যখন প্রথম গাঁজা খাবে তখন তো মুস্কিলে পড়তে পার।’ [ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বিনয় ঘোষ, পৃ ১৫২] ড. বিনয় ঘোষ ওই গ্রন্থের ৪০ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘বিদ্যাসাগরের পাণ্ডিত্য ছিল মানবকেন্দ্রিক ঈশ্বরকেন্দ্রিক নয়।’
ঋষি রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব বিদ্যাসাগরের বাড়িতে যান। তাকে শিষ্য করতে না পারলেও অন্তত ধার্মিক করতে। রামকৃষ্ণের উপস্থিতি বিদ্যাসাগরের কাছে অসহ্য ঠেকছিল। রামকৃষ্ণ তাকে বলেন, ‘আমি সাগরে এসেছি, ইচ্ছা আছে কিছু রত্ন সংগ্রহ করে নিয়ে যাব।’ বিদ্যাসাগর বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘আপনার ইচ্ছা পূর্ণ হবে বলে তো মনে হয় না, কারণ এ সাগরে কেবল শামুকই পাবেন।’
পরবর্তীতে রামকৃষ্ণ বিদ্যাসাগর প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘এমন কি তার (বিদ্যাসাগরের) নিজের মোক্ষলাভের জন্য ভগবানের নাম করবারও তার কোনো স্পৃহা নেই, সেইটা বোধ হয় তার সবচেয়ে বড় ত্যাগ। অন্য লোকের উপকার করতে গিয়ে তিনি নিজের আত্মার উপকার করার প্রয়োজন অগ্রাহ্য করেছেন।’ [ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বিনয় ঘোষ, পৃ ১৫৭]
দুরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত বিদ্যাসাগর, রাজা রামমোহন রায়ের পুত্র রাধাপ্রসাদ রায়ের পৌত্র ললিতমোহন রায়কে স্নেহে কাছে ডেকে বলেছেন, ‘ললিত তুমি কি সত্যিই বিশ্বাস কর যে মৃত্যুর পর জীবন আছে? আমরা আমাদের এই পার্থিব জীবন সম্বন্ধেই অনেক কিছু জানি না।
কিন্তু তুমি ভাগ্যবান, কারণ তুমি শুধু এই পার্থিব জীবন সম্বন্ধেই জান তা নয়, এমনকি মৃত্যুর পর পারলৌকিক জীবন সম্বন্ধেও তোমার জ্ঞান আছে।’ …বিদ্যাসাগর হাসতে হাসতে বললেন, ‘তোমার কথা শুনে বেশ মধুর লাগছে, যদিও হাসি পাচ্ছে। আমার এই জরাজীর্ণ বার্ধক্য অবস্থায় শুনে খুব সান্ত্বনা পেলাম যে মৃত্যুর পর আমি উপযুক্ত প্রতিদান পাব।’ [ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বিনয় ঘোষ, পৃ ১৫৪]
অসামান্য ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নানা ক্ষেত্রে উজ্জ্বলতম। কিন্তু তারও যে সীমা রয়েছে, সেটাও অস্বীকার করি কীভাবে। ইংরেজ শাসকদের প্রতি তার ছিল অগাধ বিশ্বাস-ভরসা এবং আনুগত্য।
ব্যক্তিগতভাবে এক ইংরেজ উচ্চ পদস্থ কর্তার সঙ্গে তার বিরোধ ও বিবাদের ঘটনা রয়েছে। সেটা ওই ইংরেজ ব্যক্তিটির সঙ্গে। ইংরেজ জাতি কিংবা ইংরেজদের ঘৃণিত শাসন ব্যবস্থার প্রতি নয়। যখন দেশজুড়ে ইংরেজবিরোধী মনোভাব দানা বাঁধছে।
শিক্ষিত-সচেতন মানুষ রাজনীতিতে একে একে যুক্ত হচ্ছেন। অথচ বিদ্যাসাগর তখন রাজনীতি বিমুখ। তিনি রাজনীতি সংশ্লিষ্ট ছিলেন না বলেই ইংরেজ শাসকেরা তার প্রতি ন্যূনতম বিরূপ ধারণা পোষণ করত না। ভারতীয় কংগ্রেসের সভাপতি উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং তাকে কংগ্রেসে যোগদানের অনুরোধ-আবেদন করেছিলেন।
কিন্তু বিদ্যাসাগর সেই আবেদনে সাড়া না দিয়ে বলেছিলেন, ‘আমাকে বাদ দিয়েই তোমরা কাজে এগোও।’ তার জীবনীকারদের রচনায় জানা যায় যে, তিনি আগাগোড়া ইংরেজদের প্রিয়পাত্র ছিলেন। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলেছেন, ‘তিনি গভর্নমেন্টের একজন প্রিয়পাত্র হইয়া উঠিলেন…।’ রমেশচন্দ্র দত্ত লিখেছেন, ‘…ভারতবর্ষের উন্নতিকামী ইংরেজ বর্গ একজন সহকর্মী পাইলেন।’
সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর ইংরেজ শাসকদের সঙ্গে তার সম্পর্ক কেমন ছিল? সে প্রসঙ্গে ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘বিদ্যাসাগর এখন আর সরকারি বেতনভোগী কর্মচারী নন।
না হইলেও, বেসরকারি পরামর্শদাতা হিসেবে তিনি সরকারের উপকার সাধন করিতে লাগিলেন। পরপর বহু ছোটলার্টই তাহার পরামর্শ গ্রহণ করিতেন। …অবসর গ্রহণের বিশ বছর পর ১৮৯০ সালে নববর্ষের প্রথম দিনে ভারত গভর্নমেন্ট তাহাকে সিআইই উপাধিতে ভূষিত করেন।’ C.I.E অর্থাৎ Companion of the Indian Empire. বঙ্গানুবাদে- ভারত সাম্রাজ্যের সহযোগী।
ইংরেজ কর্তৃক চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থা আরোপ সম্পর্কে বিদ্যাসাগর ছিলেন ইতিবাচক মনোভাবাসম্পন্ন। অর্থাৎ ঘৃণিত সেই ব্যবস্থার পক্ষে। তাই জনবিরোধী চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সম্পর্কে বলেছেন, ‘এই দশশলা বন্দোবস্ত ইহাই নির্ধারিত হইল, এ পর্যন্ত যে সকল জমিদার কেবল রাজস্ব সংগ্রহ করিতেছেন; অতঃপর তাহারাই ভূমির স্বামী হইবেন; প্রজারা তাহাদের সহিত রাজস্বের বন্দোবস্ত করিবেক। …চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হওয়াতে বাঙ্গালা দেশের যে সবিশেষ উপকার দর্শিয়াছে ইহাতে কোনও সন্দেহ নাই।’
‘বাঙ্গালার ইতিহাস’-এর দ্বিতীয় ভাগে বিদ্যাসাগর যেসব বাক্য রচনা করেছেন তাতে ইংরেজদের প্রতি তার ভক্তি-শ্রদ্ধা, আনুগত্য-ভালোবাসার সীমাহীন পরিচয় পাওয়া যায়।
বিদ্যাসাগর লিখেছেন, ‘বাঙ্গালার ইতিহাসের দ্বিতীয় ভাগ, শ্রীযুক্ত মার্শম্যান সাহেবের রচিত ঈঙ্গরেজী গ্রন্থের শেষ নয় অধ্যায় অবলম্বনপূর্বক সংকলিত, …এই পুস্তকে অতি দুরাচার নবাব সিরাজউদ্দৌলার সিংহাসনারোহণ অবধি, চিরস্মরণীয় লর্ড উইলিয়াম বেন্টিক মহোদয়ের অধিকার সমাপ্তি পর্যন্ত বৃত্তান্ত বর্ণিত আছে।’ [বিদ্যাসাগর রচনাবলী, ১ম খণ্ড, পৃ ১০৫]
ঈশ্বরচন্দ্রের ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’ প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক অসিত বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘বিদ্যাসাগর প্রায় মার্শম্যানের অবিকল অনুবাদ করিয়াছেন। মার্শম্যানের সাম্রাজ্যবাদী ও ইসলামবিদ্বেষী দৃষ্টিভঙ্গিমাও তিনি হুবহু স্বীকার করিয়া লইয়া অনুবাদ করিয়াছেন।’ [বিদ্যাসাগর রচনাবলী, ১ম খণ্ড, পৃ ৩২১]
পলাশীর প্রহসন যুদ্ধ সম্পর্কে দখলদার ইংরেজদের রচিত বিকৃত ও মিথ্যার ইতিহাসকে বিদ্যাসাগর কেবল স্বীকারই করেননি; বঙ্গানুবাদে ইংরেজদের রচিত বিকৃত ও মিথ্যার ইতিহাস দেশবাসীর অন্তরে প্রবেশ করিয়ে ইংরেজ শাসনের পক্ষে জনমত সৃষ্টিতে অবদান রেখেছেন।
ঔপনিবেশিক ইংরেজ শাসকদের বিরুদ্ধে পলাশীর প্রহসন যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌলার বীরত্ব-দেশপ্রেম এবং আত্মদানকে অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় তার সিরাজউদ্দৌলা গ্রন্থে সর্বপ্রথম তথ্য-উপাত্ত, প্রমাণসহ দেশবাসীর কাছে প্রকৃত সত্য উন্মোচন করেছিলেন, পলাশীর যুদ্ধের ১৩৯ বছর পর।
এর পূর্বে ইংরেজরা দেশীয় অনুগত দালাল লেখকদের দিয়ে দেশপ্রেমিক সিরাজউদ্দৌলার জীবন ও চরিত্রে মিথ্যা কালিমা লেপন করে তার বীরত্ব ও দেশপ্রেমকে হেয় প্রতিপন্ন করেছিল। ইংরেজদের সেই ইতিহাস বিকৃতিতে বিদ্যাসাগরের প্রত্যক্ষ ভূমিকা মাশম্যানের রচনার অবিকল অনুবাদ প্রমাণ করে তার পরিসরের সীমাবদ্ধতা।
১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহকে কার্ল মার্কস ভারতীয়দের প্রথম স্বাধীনতার যুদ্ধ বলে অভিহিত করেছেন, তার রচনায়। সিপাই বিদ্রোহের সময় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বয়স ৩৭ বছর। তিনি ওই বিদ্রোহের পক্ষে কিংবা বিপক্ষে অবস্থান নেননি সত্য। তবে তার নিরপেক্ষতা পক্ষান্তরে ইংরেজের পক্ষেই। তখন তিনি বহু বিবাহ বন্ধ করা নিয়ে মেতেছিলেন।
এ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, ‘কিন্তু এই হতভাগ্য দেশে দুর্ভাগ্যক্রমে সেই সময় রাজ বিদ্রোহ উপস্থিত হইল। রাজপুরুষেরা বিদ্রোহের নিবারণ বিষয়ে সম্পূর্ণ ব্যাপৃত হইলেন, বহু বিবাহের নিবারণ বিষয়ে আর তাহাদের মনোযোগ দিবার অবকাশ রহিল না।’ [ঊনবিংশ শতাব্দীর নারী প্রগতি ও রামমোহন-বিদ্যাসাগর, কনক মুখোপাধ্যায়, পৃ. ৭৫] সারা ভারতজুড়ে ছড়িয়ে পড়া সিপাহী বিদ্রোহে ইংরেজদের তখন ত্রাহি অবস্থা।
অথচ তখনই বিদ্যাসাগর বলছেন, ‘বাবুরা কংগ্রেস করিতেছেন, আন্দোলন করিতেছেন, আস্ফালন করিতেছেন, বক্তৃতা করিতেছেন, ভারত উদ্ধার করিতেছেন। দেশের সহস্র সহস্র লোক অনাহারে প্রতিদিন মরিতেছেন তাহার দিকে কেহই দেখিতেছেন না।
রাজনীতি লইয়া কি হইবে?…’ [ঊনবিংশ শতাব্দীর নারী প্রগতি ও রামমোহন-বিদ্যাসাগর, কনক মুখোপাধ্যায়, পৃ. ৭৬-৭৭] তার এই বক্তব্যকে বিশ্লেষণ করলে তার দৃষ্টিভঙ্গি বুঝে নেয়া মোটেও কঠিন নয়।
অনাহারে মানুষের মৃত্যুর জন্য তিনি আহাজারি করেছেন বটে। অথচ অনাহারে মানুষের মৃত্যুর প্রকৃত ও সম্পূর্ণ দায় তো ইংরেজ সরকারের। সরকারের দায় সম্পর্কে তিনি টুঁ শব্দটি করেননি।
বিপরীতে তিনি রাজনীতি ও রাজনীতিকদের প্রতি অপবাদ দিয়েছেন। কংগ্রেস রাজনীতি তখন কিংস পার্টির আবরণ ত্যাগ করতে পারেনি। ইংরেজদের অনুদানে কংগ্রেস তখন রাজকীয় এবং উঠতি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বৈঠকবাজি-খাওয়া খাদ্যে আমোদ-ফুর্তির পার্টি বিশেষ। ভারতবাসীর মুক্তির জন্য কিংবা পরাধীন ভারতকে শত্রুমুক্ত করতে রাজনীতির বিকল্প তো কিছু হতে পারে না।
সিপাহী বিপ্লব তো সে বার্তাই দিয়েছে। বিদ্যাসাগর সেই ক্রান্তিকালে ইংরেজদের বিরুদ্ধে না দাঁড়িয়ে কার পক্ষ সেদিন নিয়েছিলেন? তার বক্তব্যটি বিশ্লেষণ করলে কী দাঁড়ায়?
ইংরেজ শাসকদের থেকে তার প্রাপ্তি কম নয়। বিদ্যাসাগরকে বিদ্যা ও জ্ঞানের স্বীকৃতি স্বরূপ ইংরেজ সরকার ১৮৩৯ সালে তাকে ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি দিয়েছিল। সেই থেকেই ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় হয়ে ওঠেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।
১৮৪১ সালে ন্যায়ের শেষ পরীক্ষায় প্রথম হয়ে পান ইংরেজ সরকার থেকে ১০০ টাকা বৃত্তি। দেবনাগরী ভাষার হস্তলিপির জন্য ৮ টাকা পুরস্কার। সংস্কৃত রচনার জন্য ১০০ টাকা।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আইন ব্যুৎপত্তির জন্য ২৫ টাকা। কোম্পানি সরকার মাসিক ৮ টাকা বৃত্তি দেন। ১৮৪১ সালের ৪ ডিসেম্বর সংস্কৃত ভাষার পাণ্ডিত্যের জন্য সম্মাননা-প্রশংসাপত্র তাকে দেয়া হয়।
ওই বছরই তিনি ফোর্ড উইলিয়াম কলেজের বাংলা বিভাগের শিক্ষকরূপে যোগ দেন। এবং হেড রাইটার ও ট্রেজারারের পদও লাভ করেন। ১৮৪৬ সালে সংস্কৃত কলেজের সহকারী সচিব নিযুক্ত হন।
নিঃসন্দেহে বাঙালি মনীষা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর স্বীয় যোগ্যতায় শিক্ষাক্ষেত্রের নানা উচ্চপদে আসীন হয়েছিলেন। কিন্তু ইংরেজ বিরোধিতা করলে তাকে সে পদমর্যাদা নিশ্চয় ইংরেজ সরকার দিত না। পেতেন না উপাধি, পুরস্কার, বৃত্তিসহ নানা উপঢৌকনও। ১৯০ বছরের ইংরেজ শাসনের ইতিহাসে অমন নজির তো বহু রয়েছে।
অসামান্য বিদ্যাসাগরের পরিসর এখানেই নির্ধারিত। তিনি সেটা অতিক্রম করতে পারেননি। সিপাহী বিদ্রোহের বিরুদ্ধে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, নবীনচন্দ্র সেন প্রমুখের মতো বিদ্যাসাগর সিপাহী বিদ্রোহের বিরুদ্ধে এবং ইংরেজদের পক্ষে কলম ধরেননি সত্য।
তবে কৌশলগত উপায়ে বিদ্রোহের সময়কালে বহুবিবাহ রদ নিয়ে মেতে ছিলেন। যেটি বিদ্রোহের পক্ষে ছিল না। অপ্রত্যক্ষে বিদ্রোহের বিরুদ্ধে এবং ইংরেজদের পক্ষে। সীমা বা পরিসর অতিক্রম না করাদের তালিকা আমাদের ইতিহাসে ক্ষুদ্র নয়।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনে স্থানীয় সামন্ত জমিদার, রাজা, মহারাজাদের সহজেই ইংরেজরা চরম অনুগত-মিত্র রূপে পেয়েছিল। ঘৃণিত সেই প্রথার পক্ষে বিদ্যাসাগরের মতো অনেক জ্ঞানীগুণীরা ছিলেন বলেই হাজার হাজার মাইল পেরিয়ে প্রায় দুইশত বছর ভারতবাসীকে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ রাখতে পেরেছিল সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ। কত শত-সহস্র দেশপ্রেমিক ইংরেজ বিরোধিতায়-রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে প্রাণ দিয়েছে দেশ-মাতৃকার স্বাধীনতার জন্য, তাদের ক’জনের কথা আমরা স্মরণ করি!
অসামান্য ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮৯১ সালে ঘাতক ব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে কলকাতার নিজ বাড়িতে প্রাণত্যাগ করেন। পাণ্ডিত্যে অনন্য, প্রতিভাবান সাহিত্যিক, সংস্কৃতি-ইংরেজি ভাষার সুপণ্ডিত, বিধবা বিবাহ-প্রচলনের জন্য বিদ্যাসাগর ব্যক্তিগত পরিসরের পরও বাঙালির হৃদয়ে অমর হয়েই থাকবেন।
২৬ অক্টোবর ২০১৮ খ্রীস্টাব্দে প্রকাশিত।
কোন মন্তব্য নেই
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন