বিদ্যাসাগর কেবল বাংলায় নয়, গোটা ভারতবর্ষেই যে প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিলেন তার বিস্তৃত ইতিহাস লেখা হয়নি এখনো। উড়িষ্যার বিখ্যাত লেখক এবং সমাজ সংস্কারক ফকির মোহন সেনাপতি [১৮৪৩—১৯১৮] ছিলেন বিদ্যাসাগরের সামাজিক আন্দোলনের দ্বারা প্রভাবিত। ওড়িয়া উপন্যাসের টমাস হার্ডি বলে খ্যাত এই লেখক তাঁর আত্মজীবনীতে বিদ্যাসাগরের প্রতি তাঁর ঋণ ব্যক্ত করে গেছেন। অন্য আরেক ওড়িয়া লেখক, ‘উত্কলমান’ গোপবন্ধু দাসও ছিলেন বিদ্যাসাগরের আদর্শে অনুপ্রাণিত। কলকাতায় এমএ পড়তে এসে তিনি বেশ কয়েক বছর এখানে থেকে যান, এবং বহু বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।
—মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়
উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণ যে-সমস্ত কার্যকারণ সমন্বয়ে গড়ে উঠেছিল, তার অন্যতম ছিল কলকাতাকে ১৭৭৪ সাল থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজধানী নির্বাচন। তার সঙ্গে যুক্ত করতে হবে ছাপাখানার আবিষ্কার এবং সেই সূত্রে বইপত্র এবং বিশেষ করে বাংলা ও ইংরেজি বহুতর সাময়িক পত্রিকার প্রকাশ। হিকির গেজেট থেকে শুরু করে ‘দিগ্দর্শন,’ ‘সমাচারদর্পণ,’ ইত্যাদি থেকে যার যাত্রা শুরু। একের পর এক ‘সম্বাদকৌমুদী,’ ‘সংবাদ প্রভাকর,’ ‘সমাচার চন্দ্রিকা,’ ‘সমাচার সভারাজেন্দ্র’ থেকে ‘তত্ত্ববোধিনী,’ ‘বঙ্গদর্শন’ পর্যন্ত আছে এক বিস্তৃত তালিকা।
এরই পাশাপাশি ১৮০০ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ স্থাপনের মাধ্যমে বাংলা গদ্যের সহসা জোয়ার আসে, রচিত হতে থাকে বহু বিষয়ে বিচিত্র পুস্তক। একালে গোলোকনাথ শর্মা, রামরাম বসু, উইলিয়াম কেরি, মৃত্যুঞ্জয় তর্কালঙ্কার, তারিনীচরণ মিত্র, মদনমোহন তর্কালঙ্কার-সহ বেশ ক’জন গদ্যকারের জন্ম হয়।
ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পাশাপাশি কলকাতায় ও মফস্বলে আরো কলেজ স্থাপিত হতে থাকে। কলকাতায় ১৮১৭-তে স্থাপিত হয় হিন্দু কলেজ, ১৮২৪-এ সংস্কৃত কলেজ, ১৯৩৫-এ কলিকাতা মেডিকেল কলেজ এ-পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য।
পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জীবন ও কৃতি আলোচনা করতে গিয়ে আমরা দেখব, উপরের ঘটনাবলির প্রভাব তাঁকে কতখানি পরিচালিত করেছে, এবং তাঁর জীবনব্যাপী সাধনা কীভাবেই তার প্রতিদান দিয়েছে।
বিদ্যাসাগরের জন্ম ঔপনিবেশিক ভারতে, পলাশীর যুদ্ধের চার যুগ অতিক্রান্ত তখন। এক অজ্ঞানধূসর গ্রামে জন্ম তাঁর, চিরায়ত সনাতন জীবনযাপনে অভ্যস্ত যে জনপদ। এরই নিকট-দূরত্বে যদি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ক্রম-প্রসরমান ভারতভূমির রাজধানী না থাকত, তাহলে না হতো তাঁর পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের কলকাতায় এসে চাকরি নেওয়া, না হতো পুত্র ঈশ্বরচন্দ্রের পঠনপাঠন। আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য না থাকায় পুত্রকে তখনকার দিনের উশ্বল মহাবিদ্যালয় হিন্দু কলেজে ভর্তি করানো ছিল ঠাকুরদাসের দুরাশা। আশঙ্কা ছিল, সংস্কৃত কলেজে পড়া ছাত্র ঈশ্বরচন্দ্র একজন রক্ষণশীল ও সনাতনপন্থিতে পরিণত হবেন না তো? ইতিহাসের দেবী ক্লিও তাঁর প্রতি সুপ্রসন্ন, তিনি তা হননি। উপরন্তু পরবর্তীসময়ে সেখানে অধ্যক্ষ রূপে যোগ দিয়ে অনড় গতানুগতিকতাকে ভেঙেছেন। অব্রাহ্মণদের অধিকার ছিল না সেখানে অধ্যয়ন করার, তিনি সে অধিকার দিয়েছেন। কেবল সংস্কৃত নয়, ইংরেজি ও গণিতের প্রবর্তন করেছেন সংস্কৃত কলেজে। সবচেয়ে যুগান্তকারী যা, পাণিনি-রচিত সুবিশাল ব্যাকরণগ্রন্থ ‘অষ্টাধ্যায়ী’ সম্পূর্ণ আয়ত্ত না করলে যেখানে সংস্কৃত ভাষায় প্রবেশাধিকারই জন্মাত না, তিনি সেই গ্রন্থকে এক-দশমাংশে এনে রচনা করলেন ‘ব্যাকরণ কৌমুদী,’ দেড়শো বছর ধরে বাঙালিকে আজও সংস্কৃতজ্ঞ বানানোর একক ভূমিকা রাখছে যে গ্রন্থটি। তাছাড়া সম্পাদনা করেছেন কালিদাসের ‘শকুন্তলা’ ও ‘মেঘদূত’। মেঘদূত-এর কতিপয় শ্লোককে তিনি প্রক্ষিপ্ত ও অন্যের রচনা বলে মত প্রকাশ করেছিলেন। পরবর্তী পণ্ডিতেরা তা সমর্থন করেছেন।
আজ মনে হতে পারে, শকুন্তলা ও মেঘদূত সম্পাদনা এমন কী গুরুত্বপূর্ণ কাজ? কিন্তু একথা মনে রাখতে হবে, আজকের মতো কালিদাস সেকালে বিশ্বনন্দিত ছিলেন না। পরবর্তীকালে যখন দেখি, জার্মান কবি গ্যেটে শকুন্তলা পাঠে কেবল তাঁর মুগ্ধতাই ব্যক্ত করেন না, তাঁর লেখা ‘ফাউস্ট’ নাটকে ইউরোপীয় নাটকের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ‘নান্দীপাঠ’ যোগ করেন নাট্যসূচনায়, কিংবা অন্য জার্মান কবি শিলার ‘মেঘদূত’-এর প্রভাবে কাব্য রচনা করেন, তখন বিদ্যাসাগরের কালিদাস-অনুসন্ধিৎসার তাৎপর্যটি ধরা পড়ে।
ঊনবিংশ শতাব্দীর মনীষীবৃন্দ —রাজা রামমোহন থেকে শুরু করে দেবন্দ্রনাথ শ্রীরামকৃষ্ণ কেশবচন্দ্র সেন স্বামী বিবেকানন্দ রবীন্দ্রনাথ অরবিন্দ ঘোষ প্রমুখ ছিলেন সকলেই ধর্মাশ্রিত। বঙ্কিমচন্দ্রও। কিন্তু একমাত্র বিদ্যাসাগর ছিলেন ধর্ম ব্যাপারে পুরোপুরি নির্লিপ্ত। তাঁর প্রখর যুক্তিবাদকে কি যথার্থ আধুনিকতার আবাহন বলা যায় না? মধ্যযুগে ইউরোপের রেনেসাঁ ধর্মীয় গোঁড়ামিকে চূর্ণ করেছিল। অন্যদিকে বাংলার নবজাগরণে ধর্ম একটি অনড় প্রাক-শর্ত হিসেবে দেখা দিয়েছিল। আরো অবাক হওয়ার ব্যাপার, রবীন্দ্রনাথ ও বিবেকানন্দ নিরাকার ও সাকারবাদী হলেও দুজনেরই কিন্তু আশ্রয় বেদান্ত তথা উপনিষদ। বিবেকানন্দ বলছেন, ‘I am He.’ আর রবীন্দ্রনাথ, ‘আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর, তোমার প্রেম হত যে মিছে।’ অন্যদিকে শ্রীরামকৃষ্ণ : ‘অদ্বৈতের (বেদান্ত) চাবি আঁচলে বেঁধে যথা ইচ্ছা তথায় যা।’ রামমোহনেরও যাবতীয় ধর্মচিন্তার কেন্দ্রে ছিল উপনিষদ। বস্তুত তিনি এজন্য উপনিষদ বাংলায় অনুবাদ পর্যন্ত করেন। অথচ বিদ্যাসাগর এই বেদান্তকেই কিনা করলেন কুঠারাঘাত! একে ভ্রান্ত দর্শন বলে আখ্যায়িত করলেন! পাশে পেয়েছিলেন একমাত্র অক্ষয়কুমার দত্তকে, অন্য আরেক যুক্তিবাদী মনীষা। আবার এঁরা দুজন মিলে ব্রাহ্ম বেদান্তে চূড়ান্ত আস্থাশীল দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পত্রিকা ‘তত্ত্ববোধিনী’ দীর্ঘদিন সম্পাদনা করেছেন।
বিদ্যাসাগর কেবল বাংলায় নয়, গোটা ভারতবর্ষেই যে প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিলেন তার বিস্তৃত ইতিহাস লেখা হয়নি এখনো। উড়িষ্যার বিখ্যাত লেখক এবং সমাজ সংস্কারক ফকির মোহন সেনাপতি [১৮৪৩—১৯১৮] ছিলেন বিদ্যাসাগরের সামাজিক আন্দোলনের দ্বারা প্রভাবিত। ওড়িয়া উপন্যাসের টমাস হার্ডি বলে খ্যাত এই লেখক তাঁর আত্মজীবনীতে বিদ্যাসাগরের প্রতি তাঁর ঋণ ব্যক্ত করে গেছেন। অন্য আরেক ওড়িয়া লেখক, ‘উত্কলমান’ গোপবন্ধু দাসও ছিলেন বিদ্যাসাগরের আদর্শে অনুপ্রাণিত। কলকাতায় এমএ পড়তে এসে তিনি বেশ কয়েক বছর এখানে থেকে যান, এবং বহু বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।
হিন্দি সাহিত্যের বিখ্যাত লেখক ভারতেন্দু হরিশ্চন্দ্রও বিদ্যাসাগরের আদর্শে আস্থাশীল ছিলেন। মাতৃভাষাপ্রীতি যেমন বিদ্যাসাগরকে বহু গ্রন্থ রচনায় প্রেরণা জুগিয়েছে, হরিশ্চন্দ্রকেও তেমনি। বিদ্যাসাগরের মাতৃভাষাপ্রীতির পেছনে উচ্চকিত ঘোষণা ছিল না কোনো। পাঠ্যপুস্তকের অভাব দূর করতে ‘বর্ণ পরিচয়’ রচনা আবশ্যিক মনে হয়েছিল তাঁর, যেমন নৈতিক শিক্ষাদানকল্পে ‘বোধোদয়,’ ‘কথামালা।’
বিদ্যাসাগর এবং স্যার আব্দুল লতিফ—এই দুজনের যে সমান্তরাল ধারা ছিল সমাজ ও শিক্ষাবিষয়ে, তা আমরা লক্ষ করে দেখার অবসর পাইনি এখনো। অন্যদিকে বিদ্যাসাগর যে অগাধ দানশীল, তা অবহিত আমরা। পাশাপাশি অন্য এক বাঙালি, হাজী মুহম্মদ মহসীন, বিদ্যাসাগরের পূর্বেই যাঁর জন্ম ও মৃত্যু (১৭৩২—১৮১২), তাঁর প্রসঙ্গ এবং প্রতিতুলনা অপেক্ষিত হয়ে আছে অদ্যাপি। নবাব ফয়জুন্নেসার শিক্ষাবিস্তারে অসামান্য অবদান কি কিঞ্চিত্ তুলিত হতে পারে না বিদ্যাসাগরের পাশাপাশি, যাতে বাংলার শিক্ষাজগেক আলোকিত ও আলোড়িত করার এই দুই দিশারিকে করপুটে পেতে পারি আমরা? এবং এতে বাংলায় শিক্ষা-আন্দোলনের ইতিহাস জানাও তো সম্পূর্ণতা পায়।
বিধবাবিবাহের জন্য বিদ্যাসাগরকে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হতো। নিয়মিত মাসোহারা দিতেন তিনি বহু লোককে। তাঁর মৃত্যুর পরেও যেন মাসোহারা বজায় থাকে, তার বন্দোবস্ত করে যান তিনি। মধুসূদনকে দফায় দফায় কত যে অর্থ সাহায্য করে গেছেন তার হিসাব মেলানো দুষ্কর। অথচ কি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে, কি সংস্কৃত কলেজে, তাঁর সর্বোচ্চ বেতন ছিল মাসিক পাঁচশো টাকা। তাহলে কী করে অন্যের জন্য এত ব্যয় করতেন তিনি? এর পেছনে কোনো মোজেজা নেই। তাঁর প্রকাশনার ব্যবসা ছিল, যা দিয়ে এসব ব্যয়নির্বাহ হতো। সার্থক উদ্যোক্তা বিদ্যাসাগরকে কতটুকু জানি আমরা?
বিদ্যাসাগর এখনো অনাবিষ্কৃত জলধি হয়ে আছেন আমাদের কাছে।
২৪ সেপ্টেম্বর ২০২১ খ্রীস্টাব্দে প্রকাশিত।
কোন মন্তব্য নেই
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন