ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

মাইকেল মধুসূদন দত্ত

বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে।
করুণার সিন্ধু তুমি, সেই জানে মনে,
দীন যে, দীনের বন্ধু!—উজ্জ্বল জগতে
হেমাদ্রির হেমকান্তি অম্লান কিরণে।
কিন্তু ভাগ্যবলে পেয়ে সে মহা পর্বতে,
যে জন আশ্রয় লয় সুবর্ণ চরণে,
সেই জানে কত গুণ ধরে কত মতে
গিরীশ। কি সেবা তার সে মুখ সদনে।—
দানে বারি নদীরূপ বিমলা কিঙ্করী;
যোগায় অমৃত ফল পরম আদরে
দীর্ঘশিরঃ তরুদল, দাসরূপ ধরি;
পরিমলে ফুলকুল দশ দিশ ভরে;
দিবসে শীতল শ্বাসী ছায়া, বনেশ্বরী,
নিশার সুশান্ত নিদ্রা, ক্লান্তি দূর করে!

সাগর-তর্পণ

সাগর-তর্পণ
সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত

বীরসিংহের সিংহশিশু!  বিদ্যাসাগর!  বীর!
উদ্‌বেলিত দয়ার সাগর-বীর্যে সুগম্ভীর!
সাগরে যে অগ্নি থাকে কল্পনা সে নয়,
তোমায় দেখে অবিশ্বাসীর হয়েছে প্রত্যয়।

নিঃস্ব হয়ে বিশ্বে এলে, দয়ার অবতার!
কোথাও তবু নোয়াওনি শির, জীবনে একবার!
দয়ায় স্নেহে ক্ষুদ্র দেহে বিশাল পারাবার,
সৌম্য মূর্তি তেজের স্ফূর্তি চিত্ত-চমৎকার!

নামলে একা মাথায় নিয়ে মায়ের আশীর্বাদ,
করলে পূরণ অনাথ আতুর অকিঞ্চনের সাধ;
অদৃষ্টেরে ব্যর্থ তুমি করলে বারংবার।

বিশ বছরে তোমার অভাব পূরল নাকো, হায়
বিশ বছরের পুরানো শোক নূতন আজো প্রায়;
তাইতো আজি অশ্রুধারা ঝরে নিরন্তর!
কীর্তি-ঘন মূর্তি তোমার জাগে প্রাণের পর।

স্মরণ-চিহ্ন রাখতে পারি শক্তি তেমন নাই,
প্রাণপ্রতিষ্ঠা নাই যাতে সে মূরৎ নাহি চাই;
মানুষ খুঁজি তোমার মত, একটি তেমন লোক,—
স্মরণ-চিহ্ন মূর্ত!  যেজন ভুলিয়ে দেবে শোক।

রিক্ত হাতে করবে যেজন যজ্ঞ বিশ্বজিৎ,—
রাত্রে স্বপন চিন্তা দিনে দেশের দশের হিত,—
বিঘ্নবাধা তুচ্ছ ক’রে লক্ষ্য রেখে স্থির
তোমার মত ধন্য হবে,  চাই সে এমন বীর।

তেমন মানুষ না পাই যদি খুঁজব তবে হায়,
ধূলায় ধূসর বাঁকা চটি ছিল যা ঐ পায়;
সেই যে চটি উচ্চে যাহা উঠ্‌ত এক-একবার
শিক্ষা দিতে অহংকৃতে শিষ্ট ব্যবহার!

সেই যে চটি দেশী চটি বুটের বাড়া ধন;
খুঁজব তারে, আন্‌ব তারে, এই আমাদের পণ;
সোনার পিঁড়েয় রাখব তারে থাকব প্রতীক্ষায়
আনন্দহীন বঙ্গভূমির বিপুল নন্দিগাঁয়।

রাখব তারে স্বদেশপ্রীতির নূতন ভিতের ‘পর,
নজর কারো লাগবে নাকো, অটুট হবে ঘর!
উঁচিয়ে মোরা রাখবো তারে উচ্চে সবাকার,—
বিদ্যাসাগর বিমুখ হ’ত—অমর্যাদায় যার।

শাস্ত্রে যারা শস্ত্র গড়ে হৃদয়-বিদারণ,
তর্ক যাদের অর্কফলার তুমুল আন্দোলন;
বিচার যাদের যুক্তিবিহীন অক্ষরে নির্ভর,
সাগরের এই চটি তারা দেখুক নিরন্তর।

দেখুক, এবং স্মরণ করুক সব্যসাচীর রণ,—
স্মরণ করুক বিধবাদের দুঃখ-মোচন পণ;
স্মরণ করুক পাণ্ডারূপী গুণ্ডাদিগের হার,
‘বাপ-মা বিনা দেবতা সাগর মানেই নাকো আর!’

অদ্বিতীয় বিদ্যাসাগর!  মৃত্যু-বিজয় নাম,
ঐ নামে হায় লোভ করেছে অনেক ব্যর্থ কাম;
নামের সঙ্গে যুক্ত আছে জীবন-ব্যাপী কাজ,
কাজ দেবে না;  নামটি নেবে?  একি বিষম লাজ!

বাংলা দেশের দেশী মানুষ!  বিদ্যাসাগর!  বীর!
বীরসিংহের সিংহশিশু!  বীর্যে সুগম্ভীর!
সাগরে যে অগ্নি থাকে কল্পনা সে নয়,
চক্ষে দেখে অবিশ্বাসীর হয়েছে প্রত্যয়!

কোন মন্তব্য নেই

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন

vidyasagar.info ©