মোট পৃষ্ঠাদর্শন

    ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
        মাইকেল মধুসূদন দত্ত

  বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে।
  করুণার সিন্ধু তুমি, সেই জানে মনে,
  দীন যে, দীনের বন্ধু!—উজ্জ্বল জগতে
  হেমাদ্রির হেমকান্তি অম্লান কিরণে।
  কিন্তু ভাগ্যবলে পেয়ে সে মহা পর্বতে,
  যে জন আশ্রয় লয় সুবর্ণ চরণে,
  সেই জানে কত গুণ ধরে কত মতে
  গিরীশ। কি সেবা তার সে মুখ সদনে।—
  দানে বারি নদীরূপ বিমলা কিঙ্করী;
  যোগায় অমৃত ফল পরম আদরে
  তরুদল, দাসরূপ ধরি;
  পরিমলে ফুলকুল দশ দিশ ভরে;
  দিবসে শীতল শ্বাসী ছায়া, বনেশ্বরী,
  নিশার সুশান্ত নিদ্রা, ক্লান্তি দূর করে!

বিধবা বিবাহ আইন প্রবর্তনের পক্ষে ভারত সরকারের কাছে প্রেরিত গণ-আবেদনপত্রে প্রথম স্বাক্ষরটি করেন পণ্ডিত মদনমোহন তর্কালঙ্কার। বিদ্যাসাগর অগস্ট মাসে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেও মদনমোহন এ সময়ে নিশ্চেষ্ট ছিলেন না। লিখছেন গৌতম সরকারবিধবা বিবাহের ব্যাপারে মদনমোহনের দ্বিতীয় ও প্রধান কাজ ছিল আইন পাশের পরে বিধবা বিবাহের জন্য পাত্র-পাত্রীর সন্ধান করা।

—গৌতম সরকার



হিন্দু রক্ষণশীল সমাজের তীব্র প্রতিবাদ, অভব্য আচরণ, সংস্কৃত ও বাংলা শ্লোকমিশ্রিত অনবরত গালি উপেক্ষা করে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অক্লান্ত পরিশ্রম এবং নাছোড় লড়াইয়ের ফলে শেষ পর্যন্ত ১৮৫৬ সালের ২৬ জুলাই পাশ হয়ে গেল যুগান্তকারী ‘বিধবা বিবাহ আইন’। এর ফলে তৎকালীন হিন্দু সমাজে বাল্যবিধবা মেয়েদের সারা জীবন ধরে অসহ্য বৈধব্য যন্ত্রণার নিরসন ঘটল। তবে এই আন্দোলনে বিদ্যাসাগরকে সমর্থন করেন মুর্শিদাবাদবাসীর কিয়দংশ। কেননা জেলাতে সৈয়দাবাদ নিবাসী কবিরাজ গঙ্গাধর সেনের নেতৃত্বে বিরুদ্ধ জনমত সংগঠিত করার উদ্যোগও চলেছিল। কাশিমবাজার রাজপরিবারের মহারানি স্বর্ণময়ীর‌ অবশ্য এই আন্দোলনে সহযোগিতার কথা শোনা যায়। মদনমোহন নিজে মুর্শিদাবাদে বিধবাবিবাহের পক্ষে আইন পাশ করানোর জন্য স্বাক্ষর সংগ্রহে নেমেছিলেন। তার পরে এ জেলা থেকেই ১৮৫৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পণ্ডিত মদনমোহন তর্কালঙ্কার, সার্কেল পণ্ডিত সুরেশচন্দ্র বিদ্যারত্ন ও অন্য বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নেতৃত্বে গৃহীত স্বাক্ষরপত্র কলকাতায় পৌঁছয়। বিধবা বিবাহ আইন প্রবর্তনের পক্ষে ভারত সরকারের কাছে মুর্শিদাবাদ থেকে প্রেরিত শতাধিক গণ-আবেদনপত্রে প্রথম স্বাক্ষরটি করেন পণ্ডিত মদনমোহন তর্কালঙ্কার।

সমাজ সংস্কারক, দয়ার সাগর... নানা অভিধায় বাঙালি আগলে রাখে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে। কিন্তু সব স্তরেই অপমানিত হতে হয়েছে তাঁকে। তেমনই কিছু টুকরো চিত্র সন্ধানের চেষ্টায় অর্ঘ্য বন্দ্যোপাধ্যায়

—অর্ঘ্য বন্দ্যোপাধ্যায়

(১)


মা-ছেলেতে বেশ বাদানুবাদ চলছে। ছেলে সুরেশচন্দ্র সমাজপতি বিলেত গিয়ে আইন পড়ে ব্যারিস্টার হতে চান। তাই গোপনে মায়ের অনুমতি নিয়ে রওনা হওয়ার পরিকল্পনা করলেন তিনি। গোপনীয়তার কারণ, দাদামশাইকে বললে যদি অনুমতি না মেলে! কিন্তু মা হেমলতাদেবী জানালেন, তিনি তাঁর বাবাকে একটি বার বিষয়টি বলবেন।

দাদামশাইয়ের কাছে গোপন থাকল না কিছুই। সব জেনে নাতিকে বললেন, ‘টাকাপয়সার বড় অনটন হয়ে পড়েছে, এ-অবস্থায় আর হয় না।’ সুরেশচন্দ্রের মুখ ভার। কয়েক দিন পরে বাড়িতেই মাকে বললেন, ‘আমার বাবা থাকলে কি আর তোমার বাবার কাছে আবদার করতে যেতাম?’ কথাটা কানে যেতেই দু’চোখে বান ডাকল দাদামশায়ের। নাতিকে বললেন, ‘তোরা আমাকে পর ভাবিস…’
চিরকালের ‘কমন ম্যান’
বিদ্যাসাগর আরও কিছু, আরও মহৎ কোনও শক্তিপুঞ্জ যিনি সাধারণ্যে ‘কমন ম্যান’দের মধ্যে থেকে, নিজ পুরুষকারের জোরে উদ্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জন করেছেন।

—অশোককুমার মুখোপাধ্যায়



বিদ্যাসাগর মানে কি শুধু বর্ণপরিচয়--প্রথম ভাগ দ্বিতীয় ভাগ, বেতাল পঞ্চবিংশতি-সহ তাঁর যাবতীয় শিশুভোগ্য স্কুলপাঠ্য বই? ভাষা আর শিক্ষা-সংস্কার? স্কুল-কলেজ স্থাপনা? অথবা বিদ্যাসাগর মানে কি শুধুই প্রবহমানতার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে শাস্ত্রের যুক্তি শানিয়ে বিধবা-বিবাহের প্রচলন? যদিও তিনি লিখেছেন, ‘বিধবাবিবাহ-প্রবর্তন আমার জীবনের সর্বপ্রধান সৎকর্ম’, তবুও বিদ্যাসাগরকে মনে রাখা কি শুধুই এক সমাজ-সংস্কারক হিসাবে?

বিদ্যাসাগরের কাছে ধর্ম কোনও তত্ত্ব বা তর্ক নয়, ধর্ম মানে কাজ
আমাদের মনে এ প্রশ্ন জাগবেই। ধর্ম-সমাজের বিপক্ষেই তো তাঁর কথা বলার কথা ছিল। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে কদাচার ও অত্যাচার প্রবিষ্ট বলে কিছু দিন পরই যিনি নিজের প্রাণটিকে পর্যন্ত পণ করে লড়াইয়ে নামবেন, তাঁর কি মনে হয়নি, হিন্দুধর্মের বিরুদ্ধে প্রচারে নিজেকে একটু হলেও জড়াতে? অন্তত নিজে কী ভাবছেন, তা স্পষ্ট করে বলতে— যাকে আজ আমরা বলি, একটা ‘অবস্থান’— নিতে?

—সেমন্তী ঘোষ



বাবার হাত ধরে যখন ঈশ্বরচন্দ্র কলকাতায় এসে পড়াশোনা শুরু করলেন, সে এক অদ্ভুত সময়। ১৮২৯ সাল। রামমোহন রায়ের ধারাবাহিক প্রচেষ্টায় সতীদাহ প্রথা রদ আইন পাশ হচ্ছে সেই বছর। নয় বছরের বালক ঈশ্বরের কানে বিষয়টা ভেসে এসেছিল কি?
শিক্ষা সংস্কার করে আধুনিক যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা পদ্ধতি প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে নিজেকে উজাড় করে দেন ঈশ্বরচন্দ্র। বিদ্যাসাগরের জন্ম দ্বিশতবর্ষ লিখছেন কাকলি ভৌমিক

—কাকলি ভৌমিক



ভারতীয় দর্শনের মধ্যে চার্বাক দর্শনই হল স্বতন্ত্র ও ব্যতিক্রমী ধারা। ভারতীয় দর্শন মূলত অধ্যাত্মবাদের দর্শন, তাই এই প্রকার দর্শনের প্রচলিত বা সর্বজনবিদিত দিকটি চার্বাকবাদীরা অনুসরণ করেননি। চার্বাক দর্শন নাস্তিক ও জড়বাদী। ভারতীয় দর্শনিকদের ধারণা অনুযায়ী মোক্ষ লাভের জন্য যে জ্ঞানচর্চা, সেটিই আসল দর্শন। চার্বাক মত এই মোক্ষলাভকেই সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন জগতের অন্তিম উপাদান হল জড় এবং জড় থেকেই এই জগতের উৎপত্তি। অজড় বলে এ জগতে কিছু নেই। দেহাতিরিক্ত আত্মাও নেই, পাপ-পুণ্য কিছুই নেই, তাই কর্মফল, মুক্তি এ সব কিছুই নেই।
ব্যক্তি-বিদ্যাসাগর খুব একটা রম্য অনুভূতি গড়ে তুলতে পারেননি বালক রবীন্দ্রনাথের মনে। কিন্তু সীতার বনবাস, শকুন্তলা, বেতাল পঞ্চবিংশতি, বোধোদয়— এইসব বইয়ের মধ্য দিয়ে যে বিদ্যাসাগরকে সেই বালক কালে পাশে পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, তার অনুরণন ছিল আজীবন।

—প্রবীর সরকার



তখন চলছিল ‘ঘরের পড়া’। বালক রবীন্দ্রনাথের জীবনে সেটা ছিল গড়ে ওঠার কাল। জোড়াসাঁকোর বাড়িতে শিক্ষকেরা আসতেন নিয়ম করে এবং তার ব্যতিক্রম হত না বলে দুঃখ হত খুব। বৃষ্টির দিনেও দেখা যেত সমস্ত প্রত্যাশা ভঙ্গ করে “দৈবদুর্যোগে-অপরাহত সেই কালো ছাতাটি দেখা দিয়াছে।” এঁদেরই একজন রামসর্বস্ব পণ্ডিত যিনি একই সঙ্গে ছিলেন ‘ক্যালকাটা ট্রেনিং একাডেমী’ তথা মেট্রোপলিটান স্কুলের শিক্ষক এবং রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃত ভাষার গৃহশিক্ষক। তাঁর উৎসাহে তাঁরই সঙ্গে “ম্যাকবেথের” অনুবাদ শোনাতে বিদ্যাসাগরের কাছে গিয়েছিলেন বালক রবীন্দ্রনাথ, যার উল্লেখ রয়েছে ‘জীবনস্মৃতি’তে। এই স্কুলের সভাপতি ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তাই সেকালে লোকের মুখে এটি বিদ্যাসাগরের স্কুল নামেই পরিচিত ছিল।
উনিশ শতকে বাংলায় ইউরোপের মতোই নবজাগরণ হয়ে ছিল কি না, তা নিয়ে ঐতিহাসিক বিতর্ক চলতেই থাকবে। সেই নবজাগরণের প্রধান পথিকৃৎরা কতটা ‘প্রগতিবাদী’ বা ‘কৃষকদরদি’ ছিলেন, তা নিয়ে ঝোড়ো বিপ্লবী সমালোচনাও চলবে।

—শিবাজীপ্রতিম বসু



পুরনো লব্‌জে বললে, পিতামাতার প্রতি ঋণের মতোই, আধুনিক বাঙালির বিদ্যাসাগর মশাইয়ের প্রতি ঋণের হাত থেকে মুক্তি নেই। উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে সাম্প্রতিক সময় ইস্তক বাঙালি দু’টি গর্বের কথা এই অধোগতির চূড়ান্ত মুহূর্তেও ভুলতে পারেনি: আধুনিক শিক্ষা ও সমাজসংস্কারে বাঙালির গৌরবময় নেতৃত্বের যশ-কথা। দু’টি ক্ষেত্রেই বিদ্যাসাগরী ঋণ অপরিমেয় ও মৌলিক। এই পরিসরে শিক্ষা প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা বলে নেওয়া জরুরি, যা থেকে তাঁর এই দ্বিমুখী সংস্কার ভাবনারও খানিকটা হদিস পাব, যা না পেলে জন্মের দু’শো বছর পরেও মানুষটা আমাদের কাছে স্রেফ ‘অধরা’ই (‘এলিউসিভ’) হয়ে থাকবেন।
বিদ্যাসাগরের বিভিন্ন জীবনীর সূত্রে এই তথ্য অল্পস্বল্প অনেকেরই জানা। কিন্তু সরকারি নথির ইংরেজি বয়ানে বিদ্যাসাগর কী ভাবে তাঁর মতামত প্রকাশ করেছিলেন? দু’একটি বাক্যে তো বলেননি, যত্ন করে যুক্তিপরম্পরা সাজিয়েছিলেন। কায়স্থদের পড়বার অধিকার দেওয়ার পক্ষে তাঁর যুক্তিগুলি ঠিক কী ছিল? বিপক্ষের যুক্তিই বা তিনি কী ভাবে খণ্ডন করেছিলেন?

—ইন্দ্রজিৎ চৌধুরী



বিদ্যাসাগর ‘‘সহসা এক মহা আন্দোলনের কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিলেন’’, লিখছেন তাঁর জীবনীকার চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। সালটা ১৮৫১, বিদ্যাসাগর সবে সংস্কৃত কলেজে অধ্যক্ষের দায়িত্ব নিয়েছেন। সংস্কৃত কলেজে গোড়া থেকেই পড়বার অধিকার ছিল শুধু ব্রাহ্মণ আর বৈদ্যসন্তানদের, তাও বৈদ্যরা ধর্মশাস্ত্র শিক্ষার অধিকারী ছিলেন না। এ বার উঠল কায়স্থ ও অন্যান্য বর্ণের কথা। যে কেউ সংস্কৃত পড়তে পারবে? রে রে করে উঠল তাবৎ পণ্ডিতসমাজ। কাউন্সিল অব এডুকেশনের সেক্রেটারি মতামত চাইলেন বিদ্যাসাগরের। উত্তরের গোড়াতেই বিদ্যাসাগর স্পষ্ট লিখলেন, ব্রাহ্মণ ও বৈদ্য ছাড়া অন্যান্য বর্ণের হিন্দু— অর্থাৎ বিভিন্ন শ্রেণির শূদ্রদের সংস্কৃত কলেজে প্রবেশের অধিকার দিতে তাঁর কোনও রকম আপত্তি নেই। কিন্তু, এই মুহূর্তে শুধু কায়স্থদেরই সেই অধিকার দেওয়া যুক্তিযুক্ত হবে। অন্যেরা এখনও সেই সম্মান অর্জন করতে পারেননি, সামাজিক বিবেচনাতেও অন্যদের অবস্থান নিম্নতর। ফলে তাঁদের প্রবেশাধিকার দিলে প্রতিষ্ঠানের স্বার্থহানি ঘটবে। সংস্কৃত কলেজের প্রধান অধ্যাপকরা অবশ্য দরজা একটুও ফাঁক করতে দিতে রাজি ছিলেন না, তবে সরকার বিদ্যাসাগরের মতটিই মেনে নেয়।
At that time, the entire society was under the sway of spiritualist religious thinking. The British government had not allowed the secular ideas based on scientific outlook proposed by Vidyasagar to be implemented. Ramkrishna-Bankimchandra-Vivekananda and later Rabindranath, each in their own way, had mixed spiritualism with humanism and championed religiosity in the main. The only exception was Vidyasagar.

—Susnata Das


Innumerable research papers about and biographies of Vidyasagar happen to be in circulation. This is quite natural given that he was one of the greatest Bengalis to have lived in the nineteenth century.1 Amalesh Tripathi has indicated the limitations of his work by terming him as a “traditional modernizer”.2 Power and expectations are limited for all which was the case with Vidyasagar as well. There cannot be any objection to admit the fact that Vidyasagar was traditional minded and yet had a remarkably progressive viewpoint. He had an uncompromising attitude and yet was not unduly rigid in his approach. Any sort of dilemma or indecisiveness was never his characteristic trait. Rabindranath Tagore was very appreciative of him in his essay, ‘Vidyasagar Charit’ too. Vidyasagar’s legendary knowledge, wisdom and magnanimity could not find a better comparison than himself. How this ‘Renaissance Man’ had brought about revolutionary changes in the superstitious Bengali society through his modern outlook would be discussed subsequently in this paper.
বাংলার নবজাগরণের পথিকৃৎ এই অতি বিরল, ক্ষণজন্মা, প্রগতিশীল সমাজসংগঠক, দয়ার সাগর ও সৃজনশীল মানুষটির তুলনা কেবল তিনি নিজেই।

—পূরবী বসু



(ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮২০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তখন তাঁর নাম ছিল ঈশ্বরচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়। সংস্কৃত শাস্ত্রে অসাধারণ পাণ্ডিত্যের জন্যে সংস্কৃত কলেজ তাঁকে বিদ্যাসাগর উপাধি দান করে।)

বিধবা নারীর জন্যে একটি মানবিক জীবন-সৃষ্টি করাই শুধু নয়, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উন্নয়নের ইতিহাসে এবং জনশিক্ষা বনাম নারী শিক্ষার প্রসারতায় মানবদরদি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের (১৮২০-১৮৯১) অবদান রয়েছে অপরিসীম। তাঁর পাণ্ডিত্য, ব্যক্তিত্ব এবং বিপুল ও বহুমুখী কর্মক্ষমতার উৎস ও চালিকাশক্তি ছিল মানুষের প্রতি তাঁর অগাধ সহমর্মিতা ও ভেদাভেদহীন দৃষ্টিভঙ্গিতে সকলের কল্যাণকামিতা। তাঁর এই অসাধারণ মানবিক কর্মকাণ্ডকে চারটি ধারায় ভাগ করা চলে :
বিদ্যাসাগরের দ্বিশত জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে তাঁর সঙ্গে কাল্পনিক কথোপকথনে পবিত্র সরকার। সেই অগ্নিচক্ষু ব্রাহ্মণের সামনে দাঁড়িয়ে কাঁপছিলাম আমি। তিনি কোমল স্বরে বললেন, ‘আগে বল্‌, আমাকে নিয়ে এখন তোরা কী ভাবছিস?’

—পবিত্র সরকার



‘বিদ্যাসাগর, আপনি আমাদের প্রণম্য, তবু আপনাকে নিয়ে আমরা বেশ ভয়ে ভয়ে থাকি। হ্যাঁ, আমরা জানি যে, যতবার আমরা আপনার মূর্তির মাথা ভাঙি বা নতুন মূর্তি বসাই, বা আপনার নামে সেতু করি, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় করি, তাতে আপনার কিছু এসে যায় না। আপনি যা ছিলেন আপনি তাই থাকবেন। কোথায় থাকবেন, কার কাছে? আমাদের স্মৃতির কুলুঙ্গিতে, দ্বিশত জন্মবার্ষিকীর ধুপধুনোয় আচ্ছন্ন হয়ে হাঁচি-কাশিতে বিপর্যস্ত, না কি মুদ্রিত গ্রন্থে মলাটবদ্ধ ও দূরবর্তী, যা আমরা খেরোর কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখব। আপনিই বলে দিন, আপনাকে নিয়ে আমরা কী করব।’

সেই অগ্নিচক্ষু ব্রাহ্মণের সামনে দাঁড়িয়ে কাঁপছিলাম আমি। তিনি কোমল স্বরে বললেন, ‘আগে বল্‌, আমাকে নিয়ে এখন তোরা কী ভাবছিস?’
আলুপটল অবশ্য বেচেননি বিদ্যাসাগর। কিন্তু বই বেচেছিলেন। নিজের বইয়ের স্বত্ত্ব প্রকাশককে বেচা নয়। রীতিমতো প্রকাশনা-ব্যবসা খুলেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র।

—আশিস পাঠক



সংস্কৃত কলেজের সহকারী সম্পাদকের চাকরি তখন ছেড়ে দিয়েছেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। বিরোধটা বেধেছিল সম্পাদক রসময় দত্তের সঙ্গে। কী ভাবে পড়ানো হবে ছাত্রদের, তাই নিয়ে। রসময়বাবু তাঁর উদ্বেগ প্রকাশ করতে লাগলেন আড়ালে, চাকরি ছেড়ে দিয়ে বিদ্যাসাগর খাবে কী! বিদ্যাসাগর শুনে বললেন, ‘রসময়বাবুকে বলো বিদ্যাসাগর আলু পটল বেচে খাবে।’

আলুপটল অবশ্য বেচেননি বিদ্যাসাগর। কিন্তু বই বেচেছিলেন। নিজের বইয়ের স্বত্ত্ব প্রকাশককে বেচা নয়। রীতিমতো প্রকাশনা-ব্যবসা খুলেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র। সময়টা উনিশ শতকের মাঝামাঝি। বাণিজ্যে বাঙালি তখনও বীতরাগ। আর মুদ্রণ বা প্রকাশনার ব্যবসায় তো সে ভাবে শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত বাঙালি তখন আসেইনি।
বড় কাজ একাই করতে হয়
সেই সময়ে তো বটেই, এই সময়ের পক্ষেও তাঁর কাজকর্ম আচারব্যবহার খুব যে সুলভ তা নয়। আজও তিনি সময়ের থেকে এগিয়ে। যে ভাবে ভেবেছিলেন, যে কথা ভেবেছিলেন, এর কোনওটাই এখনও খুব সুলভ নয়।

—সাক্ষাৎকার: ইন্দ্রজিৎ চৌধুরী



প্রশ্ন: আটপৌরে বাঙালি পোশাকে বিদ্যাসাগর ছিলেন সর্বত্রগামী। প্রবল জেদ ও আত্মসম্মানবোধ নিয়ে সরকারি চাকরি করেছেন, দ্বিরুক্তি না করে ইস্তফাও দিয়েছেন। পাঠ্যবই লিখে ছেপে বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করেছেন, দানের জন্য ধারও করেছেন। উনিশ শতকে সমাজবদলের সব আন্দোলনেই তিনি অগ্রপথিক। এমন ব্যক্তিত্ব সমসময়ে ব্যতিক্রম। দু’শো বছর পর আজ আমরা তাঁকে কী চোখে দেখব?

শঙ্খ ঘোষ: সেই সময়ে তো বটেই, এই সময়ের পক্ষেও তাঁর কাজকর্ম আচারব্যবহার খুব যে সুলভ তা নয়। আজও তিনি সময়ের থেকে এগিয়ে। যে ভাবে ভেবেছিলেন, যে কথা ভেবেছিলেন, এর কোনওটাই এখনও খুব সুলভ নয়। সরকারি চাকরি থেকে ইস্তফার প্রসঙ্গে বলি, পরে বাম সমালোচকরা তাঁর প্রতি বিরুদ্ধভাব পোষণ করলেন এই জন্য যে— বিদ্যাসাগর সিপাহিবিদ্রোহের সময় তাঁর কলেজ সরকারি কাজে ব্যবহার করতে দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁরা মনে রাখলেন না যে, সেই সরকারি নির্দেশের উত্তরে বিদ্যাসাগর যে চিঠিটি লিখেছিলেন, তার প্রথমেই জানিয়েছিলেন সরকারি চাকরি থেকে ইস্তফা দেওয়ার ইচ্ছা। এক বছর পর সত্যিই ইস্তফা দিলেন, নানা অনুরোধেও তা প্রত্যাহার করলেন না।
মহিলাদের নিরাপত্তা নিয়ে অনেক অমীমাংসিত সমস্যা আজও রয়েছে। কিন্তু মহিলাদের জন্য বিদ্যাসাগর যা করেছেন তার তুলনা হয় না। লিখছেন দেবযানী ভৌমিক চক্রবর্তী

—দেবযানী ভৌমিক চক্রবর্তী



বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্বের পাশাপাশি বেশ কিছু প্রশাসনিক দায়িত্বও সামলেছেন। এ ক্ষেত্রে আরও কিছু সংযোজন হল। আসলে তাঁর কর্ম রূপায়ণ দক্ষতায় মুগ্ধ হয়েই কর্তৃপক্ষ তাঁকে এই দায়িত্বগুলি দিতেন। ১৮৫৪ সালে ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ বন্ধ করে সেখানে বোর্ড অব এগজামিনার্স স্থাপন করা হয়। তাঁকে সেখানকার এক জন সক্রিয় সদস্য হিসেবে রাখা হয়। এ ছাড়া ফ্রেডারিক হ্যালিডের নির্দেশে ঠিক করা হল যে, বাংলার শিক্ষাব্যবস্থা ডিরেক্টর অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশনের মাধ্যমে পরিচালিত হবে। এ ছাড়া বিদ্যালয় পরিদর্শকই সবরকম কর্তৃত্ব করবেন। হ্যালিডের ইচ্ছেতেই বিদ্যাসাগর সহকারী পরিদর্শকের পদ পেলেন। ক্যালকাটা ট্রেনিং স্কুলেরও তিনি পরিচালন সমিতির সদস্য ছিলেন। তার পরে সম্পাদক হলেন। এটাই পরবর্তীতে হিন্দু মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন হয়। এখন এখানেই বিদ্যাসাগর কলেজ।
পাত্র শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন। পাত্রী কালীমতি বর্ধমানের পলাশডাঙার প্রয়াতত ব্রহ্মানন্দ মুখোপাধ্যায়ের দশ বছরের বিধবা মেয়ে। দাঁড়িয়ে থেকে বিদ্যাসাগর, কনের মা লক্ষ্মীদেবীকে দিয়ে কন্যা সম্প্রদান করালেন। আন্তর্জাতিক বিধবা দিবসে লিখছেন স্বপ্নকমল সরকারশিবনাথ শাস্ত্রীর লেখা থেকে জানা যায়, এই সময়ে বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজের পাঠাগারে সারা দিন ধরে নানা শাস্ত্র পড়তে শুরু করলেন। মাঝে এক বার শুধু খেতে উঠতেন। সালটা ১৮৫৩, শীতকাল।

—স্বপ্নকমল সরকার



উনিশ শতকের মাঝামাঝি। বীরসিংহ গ্রামে বাবা ঠাকুরদাসের সঙ্গে গ্রামের নানা সমস্যা নিয়ে আলোচনা করছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র। এমন সময়ে মা ভগবতীদেবী অকাল বিধবা পড়শি কিশোরীর দুঃখে আকুল হয়ে ঈশ্বরচন্দ্রে কাছে বিধবাদের বাঁচার উপায় জানতে চাইলেন। একই প্রশ্ন রাখলেন ঠাকুরদাসও। বিদ্যাসাগর জানালেন, এমন বিধবার আবার বিয়ে শাস্ত্র সিদ্ধ। এ বিষয়ে তাঁর বই লেখার ইচ্ছে আছে। কিন্তু সমাজে বিরোধের আশঙ্কায় দ্বিধাগ্রস্ত। ঠাকুরদাস ও ভগবতীদেবী দু’জনেই এগিয়ে যেতে বললেন।
ছোটলাটের কাছে কড়া চিঠি লিখে ছাত্রদের জন্য সুবিচার চেয়েছিলেন। ডাক্তারি পড়ুয়াদের বৃত্তি বন্ধ থাকায় করেছিলেন আর্থিক সাহায্যও। শুভাশিস চক্রবর্তী

—শুভাশিস চক্রবর্তী



সময়টা ১৮৬২। মেডিক্যাল কলেজে ডাক্তারি ছাত্রদের হাতে-কলমে শেখানো হত, রোগীকে কী ভাবে ওষুধ ও পথ্য দিতে হবে। ক্লাস হত রোজ সকালে। এক সকালে বনমালী চট্টোপাধ্যায় নামে এক ছাত্র নিজের মনে কাজ করছিলেন। হঠাৎ হাসপাতালের এক পরিচারকের সঙ্গে কী নিয়ে ঝগড়া শুরু। বনমালী মৌখিক হুমকিতে থেমে গেলেও, থামল না পরিচারকটি। বনমালী চলে যাওয়ার পরে সে ওষুধের ঘরে ঢুকে একটা কুইনাইনের পাত্র তুলে নিয়ে সোজা গেল তৎকালীন প্রিন্সিপাল লেক সাহেবের কাছে। অভিযোগ করল, কুইনাইন চুরি করবে বলে বনমালী পাত্রটা সরিয়ে রেখেছিল, পরিচারক এসে পড়ায় পারেনি।
ঈশ্বরচন্দ্র ছিলেন সত্যনিষ্ঠ একজন সাহসী মানুষ; তিনি যা বিশ্বাস করতেন, তাই তিনি বলতেন এবং করতেন। সমাজে তিনি বিধবা বিবাহের জন্য দাবি তুলেছিলেন; তাঁর সে দাবি তিনি প্রতিষ্ঠাও করেছিলেন। গোটা নারীজাতি এবং সমাজকে পথ দেখিয়ে নিজেও তিনি কখনো পিছিয়ে থাকেননি। নিজের একমাত্র ছেলে নারায়ণ চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়কে ভব সুন্দরী নামে এক বিধবার সাথে তিনি বিয়ে দিয়েছিলেন।

—ফরিদ আহমদ দুলাল



ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর জন্মেছিলেন আজ থেকে দু’শবছর আগে। এই দু’শবছর ধরেই বিদ্যাসাগর বাঙালির জীবনে বেঁচে আছেন সরবে। জীবন, এমন এক সময়, যে সময়টাকে মানুষের কল্যাণে সঠিক ব্যবহার করতে পারলে মৃত্যু তাকে মেরে ফেলতে পারে না কোনোদিন; এবং সেখানেই জীবনের সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে। আমাদের অহংকার, বাঙালি জাতির মুক্তির দিশারি বঙ্গবন্ধুর বুকে বুলেট-মৃত্যু সেঁটে দিয়ে যারা ১৯৭৫-এ তাঁকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল; যারা দশকেরও অধিক সময় ধরে প্রতিদিন মেরে ফেলতে চেয়েছে শেখ মুজিবের নাম; তারা কি ব্যর্থ হয়ে যায়নি? তারা আজ কোথায়? ইতিহাসের কোন আঁস্তাকুড়ে ঠাঁই পেয়েছে তারা আজ? কিন্তু বঙ্গবন্ধু বেঁচে আছেন তাঁর কীর্তি আর ত্যাগের মহিমায়। সাধারণেরা আয়ুষ্কাল ফুরালেই মরে যায়; কিন্তু কীর্তিমানেরা বেঁচে থাকেন মানুষের চিন্তায়-মননে আর সৃষ্টিশীলতায়। পৃথিবীতে যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, যতদিন বাঙালির স্বাধীনতার সম্মান উজ্জীবিত থাকবে; ততদিন বাঙালির জাতিপিতার নাম উচ্চারিত হবে বাঙালির ঘরে ঘরে। একইভাবে বাংলা ভাষা যতদিন বেঁচে থাকবে, বাঙালি নারীর সম্মানবোধ যতদিন জাগরূক থাকবে, ততদিন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের নাম বাঙালি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে, ততদিন বাঙালিকে শরণাপন্ন হতে হবে তাঁর কাছে।
যাপিত জীবনে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অসংখ্য কীর্তির পাশে বড় এক কীর্তি হচ্ছে বাংলা গদ্যভাষার আধুনিকায়ন। বলা যায়, তিনিই বাংলা গদ্যভাষায় গতি সঞ্চার করেছিলেন, আরও স্পষ্ট করে বললে বলা যায়, তিনিই বাংলা গদ্যভাষায় প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। গদ্যের ভাষাতেও যে অদৃশ্য ছন্দ বিদ্যমান, গদ্যে প্রবহমানতার যে গতি, তা আবিষ্কার করেছিলেন তিনি; এবং বাংলা ভাষায় যতিচিহ্ন ব্যবহার করে গতি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি প্রয়োজন অনুযায়ী গতিকে সমন্বয় করার পথ দেখিয়েছিলেন; এভাবেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর হয়ে উঠেছিলেন বাংলা গদ্য-ভাষার এক ঈশ্বর।

—ফরিদ আহমদ দুলাল



বোধ হবার পর আনন্দ পাই এই কথা ভেবে, ‘বর্ণ পরিচয়’ দিয়ে আমার শৈশবে বর্ণ পরিচয় হয়েছিল। সেদিন কি আর জানতাম কার হাত ধরে আমার বর্ণ পরিচয়ের যাত্রা শুরু হলো? যখন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সাথে পরিচয় হলো, সেদিন বুঝলাম বাংলা গদ্য-ভাষার ঈশ্বর বিদ্যাসাগরের হাত ধরে চিনেছিলাম অ-আ-ক-খ। সেদিন কিছুটা তৃপ্তির পাশাপাশি দায়বদ্ধতাও অনুভব করেছিলাম; ভেবেছিলাম ঈশ্বরের আশীর্বাদকে সম্মান করা প্রয়োজন। তাই শুদ্ধতায় ব্রতী হয়েছিলাম। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর জন্মেছিলেন ১৮২০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর হুগলি জেলার (বর্তমান মেদিনীপুর) বীরসিংহ গ্রামে। তাঁর পৈতৃক পদবী বন্দ্যোপাধ্যায়, যা ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধির আড়ালে খোয়া যায় সময়ের গৌরবের কাছে। সংস্কৃত কলেজ থেকে ১৮৪১-এ তিনি উচ্চতর শিক্ষা কৃতিত্বের সাথে সমাপ্ত করেন; তাঁর অসাধারণ কৃতিত্বে মুগ্ধ কলেজ কর্তৃপক্ষ তাঁকে ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধিতে ভূষিত করে। পাঠ্যপুস্তকে আমরা তাঁর মাতৃভক্তির কথা পড়েছি, সেখানেই জেনেছি মাতৃআজ্ঞা পালনে কী দুর্যোগের রাতে তিনি উত্তাল দামোদর সাঁতরে পাড়ি দিয়েছিলেন। ক্রমান্বয়ে জেনেছি সমাজসংস্কারক হিসেবে তিনি হিন্দু সম্প্রদায়ে প্রচলিত সতীদাহ প্রথা রোধ আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলেন শৈশবে; বিধবাবিবাহ প্রচলন এবং শিক্ষা বিস্তারে নেতৃত্ব দিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন যৌবনে। সাংবাদিক হিসেবে সমাজে প্রচলিত অবিচার-অনাচার-দুর্নীতির কথা তুলে ধরেন। তিনি যে কেবল বিধবাবিবাহের পক্ষে সরব ছিলেন, তাই নয়; নিজের ছেলেকেও তিনি বিয়ে করিয়ে ছিলেন একজন বিধবা নারীকে, সমাজ-পরিপার্শ্বে প্রবল আপত্তির মুখেও। পরবর্তীকালে তাঁর পুত্র যখন সেই স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক ছেদ করেন, তিনি তখন নিজের সম্পত্তি থেকে পুত্রকে বঞ্চিত করে পুত্রবধূকে দান করেন।
বিধবা বিবাহ চালু প্রসঙ্গে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর দীর্ঘ এক পুরাণ পাঠের দিকে অগ্রসর হয়েছেন, পুস্তক রচনা করেছেন। শুধু যুক্তি দিয়ে নয়, শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যার দিকে মনোনিবেশ করেছেন বুঝেশুনেই। দীর্ঘদিন ধরে চালু থাকা কুসংস্কারকে আঁকড়ে ধরেছিল বাঙালি হিন্দুসমাজ। প্রকৃত অর্থে বিদ্যাসাগরের পক্ষে হিন্দু পুরাণের নতুন ব্যাখ্যা ব্যতিরেকে বিধবা বিবাহ চালুকরণ প্রসঙ্গ উত্থাপন করা কঠিন ছিল।

—মাজেদা মুজিব



উপমহাদেশে হিন্দু ধর্মে নয় শুধু অন্যান্য ধর্মেও মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে দেবার প্রথা পুরনো। এই প্রথা থেকে বের হবার জন্য বিদ্যাসাগরের চেষ্টা দেখবো ‘বাল্যবিবাহের দোষ’ প্রবন্ধে। নারীদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর যেমন গুরুত্ব দিয়ে দেখেছেন তেমনি নারী-পুরুষের প্রণয়ে বাল্যবিবাহ কীভাবে বাঁধ সাধে সে বিষয়েও বিস্তর আলোচনা করেছেন। বিদ্যাসাগরের প্রেমবোধ পুণ্য পর্যায়ের। বলাবাহুল্য, বাল্যবিবাহ নিয়ে বাংলাদেশে আইন আছে কিন্তু এখনো প্রায় ষাট শতাংশ মেয়ের বাল্যবিয়ে হয়। দেড়শো বছর আগে বিদ্যাসাগর পরিণত শরীরে পরিণত মন ও নারী-পুরুষের প্রণয়ের মধ্যে গড়ে ওঠা সংসারের কথা ভেবেছিলেন। এছাড়া একটি অপ্রাপ্তবয়স্ক শরীর যেমন করে উৎপাদনে অংশগ্রহণ করতে পারে না তেমনই এদেশীয় সাংসারিক আচারও তো তার জন্য কম কঠিন কিছু নয়!
সাগর-তর্পণ
সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত

বীরসিংহের সিংহশিশু!  বিদ্যাসাগর!  বীর!
উদ্‌বেলিত দয়ার সাগর-বীর্যে সুগম্ভীর!
সাগরে যে অগ্নি থাকে কল্পনা সে নয়,
তোমায় দেখে অবিশ্বাসীর হয়েছে প্রত্যয়।

নিঃস্ব হয়ে বিশ্বে এলে, দয়ার অবতার!
কোথাও তবু নোয়াওনি শির, জীবনে একবার!
দয়ায় স্নেহে ক্ষুদ্র দেহে বিশাল পারাবার,
সৌম্য মূর্তি তেজের স্ফূর্তি চিত্ত-চমৎকার!
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

বঙ্গ সাহিত্যের রাত্রি স্তব্ধ ছিল তন্দ্রার আবেশে
অখ্যাত জড়ত্বভারে অভিভূত।  কী পুণ্য নিমেষে
তব শুভ অভ্যুদয়ে বিকীরিল প্রদীপ্ত প্রতিভা
প্রথম আশার রশ্মি নিয়ে এল প্রত্যূষের বিভা,
বঙ্গ ভারতীর ভালে পরাল প্রথম জয়টিকা।
রুদ্ধ ভাষা আঁধারের খুলিলে নিবিড় যবনিকা,
পণ্ডিতপ্রবর
শ্রীযুক্ত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

মাইকেল মধুসূদন দত্ত

শুনেছি লোকের মুখে পীড়িত আপনি
হে ঈশ্বরচন্দ্র!  বঙ্গে বিধাতার বরে
বিদ্যার সাগর তুমি; তব সব মণি,
মলিনতা কেন কহ ঢাকে তার করে?
বিধির কি বিধি সুরি, বুঝিতে না পারি,
হেন ফুলে কীট কেন পশিবারে পারে?
করমনাশার স্রোত অপবিত্র বারি
ঢালি জাহ্নবীর গুণ কি হেতু নিবারে?
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বিশালত্ব আকাশচুম্বী। বিদ্যা-বুদ্ধি-জ্ঞান-মনন-পাণ্ডিত্যে তিনি ছিলেন অনন্যসাধারণ। বিদ্যা-শিক্ষা প্রসারে তার ভূমিকা প্রবাদতুল্য। সেই সময়কার পশ্চাৎপদ হিন্দু সমাজে বিধবা বিবাহ প্রচলন করে সমাজে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত করেছিলেন। বহুক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রাখায় বাঙালি জাতি তাকে চিরদিন স্মরণে রাখবে। তার অমরত্ব লুপ্ত হওয়ার নয়।

—মযহারুল ইসলাম বাবলা



ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বিশালত্ব আকাশচুম্বী। বিদ্যা-বুদ্ধি-জ্ঞান-মনন-পাণ্ডিত্যে তিনি ছিলেন অনন্যসাধারণ। বিদ্যা-শিক্ষা প্রসারে তার ভূমিকা প্রবাদতুল্য। সেই সময়কার পশ্চাৎপদ হিন্দু সমাজে বিধবা বিবাহ প্রচলন করে সমাজে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত করেছিলেন। বহুক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রাখায় বাঙালি জাতি তাকে চিরদিন স্মরণে রাখবে। তার অমরত্ব লুপ্ত হওয়ার নয়।

বিদ্যাসাগর প্রকৃত অর্থেই ইহজাগতিক মানুষ ছিলেন। দেবদেবী কিংবা দেবদূত ছিলেন না। ওতে তার বিশ্বাসও ছিল না। আর অনিবার্যরূপে তিনি ছিলেন বাঙালি। তার মহান কীর্তির পাশাপাশি বিশেষ ক্ষেত্রে সীমারেখাও ছিল। যে সীমা বা পরিসর তিনি অতিক্রম করতে পারেননি। রক্ত-মাংসের মানুষ ছিলেন, তাই ত্রুটি-বিচ্যুতির ঊর্ধ্বে ছিলেন না। একটি বিশেষ পরিসরের বৃত্তে আজীবন আবদ্ধ থেকেছেন। বৃত্ত ভাঙার চেষ্টা করেননি।

তার নাম ঈশ্বরচন্দ্র ছিল বটে, কিন্তু তিনি ঈশ্বরকেন্দ্রিক ছিলেন না। ছিলেন মানবকেন্দ্রিক। এর বহু প্রমাণ রয়েছে তার জীবনজুড়ে। সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষের পদে থাকাকালে ওই কলেজে কেবলমাত্র ব্রাহ্মণ শিক্ষার্থী ছাড়া অন্যদের প্রবেশ ছিল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। সংস্কৃত কলেজে যাতে কায়স্থ শিক্ষার্থীদের অন্তত পড়াশোনার সুযোগ দেওয়া হয়— ঈশ্বরচন্দ্র সেই উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এতে কলেজের ব্রাহ্মণ পণ্ডিতরা চরম বিরোধিতা করেন। এ দলে তার ব্রাহ্মণ শিক্ষকরাও ছিলেন।
একটি নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করে এবং প্রতিকূল ঔপনিবেশিক পরিবেশের মধ্যে অবস্থান করে বিদ্যাসাগর কীভাবে মনুষ্যত্বের চূড়ায় আরোহণ করতে পেরেছিলেন, তা আজকের বাঙালির কাছে বিস্ময় উদ্রেককারী বিষয়…

—খোন্দকার সিরাজুল হক



‘বিদ্যাসাগর’ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ—‘সাগরের মতো ব্যাপক ও গভীর বিদ্যা যাঁর’। কিন্তু সমগ্র বাঙালি সমাজে বিদ্যাসাগর বলতে একজনকেই বোঝায়, যাঁর পিতৃদত্ত নাম ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। এভাবেই আমরা পেয়েছি ‘বিশ্বকবি’, ‘বিদ্রোহী কবি’, ‘নেতাজী’, ‘দেশবন্ধু’, ‘শেরে বাংলা’, ‘বঙ্গবন্ধু’ প্রভৃতি উপাধির অনন্যসাধারণ ব্যক্তিবর্গকে, যাঁরা তাঁদের অসামান্য অবদানের জন্য পরিবারের গণ্ডি অতিক্রম করে সমগ্র জাতির পথপ্রদর্শকরূপে বিবেচিত হয়েছেন। এ কারণেই দেশবাসী এই প্রিয় মানুষদের বিশেষভাবে সম্বোধন করে আনন্দ পেয়েছে। পরিতৃপ্ত হয়েছে। বিদ্যাসাগর বাঙালি সমাজের এমনই একজন ব্যতিক্রমধর্মী মানুষ, যিনি শিক্ষা বিস্তারে, সমাজ সংস্কারে ও সাহিত্য সাধনায় তাঁর সমগ্র জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। বিদ্যাসাগরের জন্ম ১৮২০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে এবং মৃত্যু ১৮৯১ সালের ২৯ জুলাই কলকাতায়। আজ তাঁর ১২০তম মৃত্যুবার্ষিকী। আর কয়েক বছর পরেই ২০২০ সালে বাঙালি জাতি এই প্রতিভাধর মানুষটির দ্বিশত জন্মবার্ষিকী পালন করবে।
ভালো পাঠ্যবই মানসম্পন্ন শিক্ষার অন্যতম শর্ত। কিন্তু যোগ্য পাঠ্যবইয়ের বড়ো অভাব ছিল সেকালে। এই অভাব পূরণে বিদ্যাসাগর ও তার বন্ধু মদনমোহন তর্কালঙ্কার এগিয়ে আসেন। বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’ ও মদনমোহনের ‘শিশুশিক্ষা’ ছিল সম্প্রদায়নির্বিশেষ বাঙালির সূচনা-শিক্ষার হাতেখড়ির পুস্তিকা। আজও এর আবেদন নিঃশোষিত নয়। এর পাশাপাশি বিদ্যাসাগরের ‘বোধোদয়’, ‘ঋজুপাঠ’, ‘কথামালা’, ‘আখ্যানমঞ্জরী’র কথা কে ভুলতে চাইবেন! প্রাইমার-রচনার যে ধারা বিদ্যাসাগর প্রবর্তন করেছিলেন, তা-ই বাঙালির কাছে আদর্শ হয়ে উঠেছিল।

—আবুল আহসান চৌধুরী



ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-৯১) উনিশ শতকের এক কীর্তিমান বাঙালি। সমাজসংস্কার, শিক্ষাপ্রসার, নারীর আলোকিত ভুবন-নির্মাণ, বাঙলা গদ্যের বিন্যাস ও পরিচর্যা, অমিতবীর্য পৌরুষ, গভীর মানবিক মূল্যবোধ, ‘দয়া’ ও ‘করুণা’র প্রকাশ, সেক্যুলার চেতনা— তাকে বাঙালি সমাজে স্বতন্ত্র পরিচয়ে চিহ্নিত করেছে।

উনিশ শতকের বাংলার জাগরণ বলতে যা বোঝায়, প্রকৃতপক্ষে তা ছিল কলকাতাকেন্দ্রিক শিক্ষিত বাঙালি জাগরণ। অন্য-অর্থে এ হলো বিত্ত ও বিদ্যার সমন্বয়ে নবচেতনায় প্রাণিত বাঙালি হিন্দুর সামাজিক উত্থান। এই যে নবজাগৃতি, কারণ বা ব্যাখ্যা যাই হোক না কেন, এর আলোকিত আঙিনায় বাঙালি মুসলমান ছিল অনুপস্থিত— শুধু তাই নয়, বৃহত্তর বঙ্গদেশের গ্রামীণ সমাজেরও কোনো যোগ ছিল না এর সঙ্গে। সেক্যুলার-চেতনাবিহীন বাংলার খণ্ডিত ও অসম্পূর্ণ এই নবজাগরণের সূত্রে গড়ে ওঠে হিন্দু জাতীয়তাবাদ, যা সমাজে জন্ম দেয় সাম্প্রদায়িকতা নামের বিষবৃক্ষের— যার কটু কথায় ফল জাতিবৈরতা। সংকীর্ণ ও রক্ষণশীল দৃষ্টির এই পরিবেশে অনিবার্যভাবে এসে যায় জাতিগত বিচ্ছিন্নতা এবং তার প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্টি হয় পাল্টা মুসলিম জাতিগত-স্বাতন্ত্র্যবোধ ও সাম্প্রদায়িকতার। জাতীয় জীবনে এর পরিণাম হয়ে উঠেছিল ভয়ংকর। যাঁরা এর ব্যতিক্রম ছিলেন বিদ্যাসাগর তাঁদের অন্যতম— উগ্র ধর্মীয় জাতীয়তাবাদে যাঁরা মজেছিলেন, বিদ্যাসাগর তাঁদের দোসর হতে পারেননি।
১৮২৯ সালে ৯ বছর বয়সে কলকাতা গভর্নমেন্ট সংস্কৃত কলেজে ব্যাকরণের তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন ঈশ্বরচন্দ্র। পরের বছর ব্যাকরণের পাশাপাশি সংস্কৃত কলেজের ইংরেজি শ্রেণিতেও ভর্তি হন তিনি। সেখানে ইংরেজি ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় ১৮৩৪ সালে ক্ষীরপাই নিবাসী শত্রুঘ্ন ভট্টাচার্যের কন্যা দীনময়ী দেবীর সঙ্গে তার বিয়ে হয়। ১৮৩৯ সালে এ কলেজে অধ্যয়নকালেই ঈশ্বরচন্দ্র ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি পান। ১৮৪১ সালে সংস্কৃত কলেজে শিক্ষা সমাপ্ত হওয়ার পর সে বছরই মাত্র একুশ বছর বয়সে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলা বিভাগে প্রধান পণ্ডিতের পদে যোগ দেন বিদ্যাসাগর। ১৮৪৬ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ ছেড়ে তিনি সংস্কৃত কলেজের সহকারী সম্পাদক পদে যোগ দেন। পরের বছর সংস্কৃত প্রেস ডিপজিটরি নামে একটি বইয়ের দোকান প্রতিষ্ঠা করেন বিদ্যাসাগর। সে বছরই হিন্দি ‘বেতাল পচ্চিসী’ অবলম্বনে রচিত তার প্রথম গ্রন্থ ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’। এ গ্রন্থেই প্রথম বিরাম চিহ্নের সফল ব্যবহার করা হয়।

—সঞ্জয় ঘোষ



আজ বাংলার নবজাগরণের অনন্য পুরোধা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্মদিন। আজ তার জন্মের দ্বিশততম বর্ষপূর্তি। তাকে মনে করা হয় বাংলার প্রথম সার্থক গদ্যকার। তিনিই প্রথম বাংলালিপি সংস্কার করেছিলেন, যতিচিহ্নের সঠিক প্রয়োগ ঘটিয়ে ভাষার বিশৃঙ্খলা দূর করেছিলেন; তিনি যে শুধু বাংলা ভাষাকে যুক্তিগ্রাহ্য ও সবার বোধগম্য করে তুলেছিলেন তা নয়, তিনি ছিলেন বাংলার শিক্ষাব্যবস্থা এবং বাঙালি সমাজে প্রগতিশীল সংস্কারের অনন্য অগ্রদূত।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘বাঙালির জাতীয় জীবনে বিদ্যাসাগরের চরিত্র চিরকালের জন্যে প্রতিষ্ঠা পাবে, কেননা যতই দিন যাবে, ততই তারা উপলব্ধি করবে, …দয়া নহে, বিদ্যা নহে, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের চরিত্রের প্রধান গৌরব তাঁহার অজেয় পৌরুষ, তাঁহার অক্ষয় মনুষ্যত্ব।’ বাংলা সাহিত্যে তার স্থান আমাদের কাছে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে রবীন্দ্রনাথের এই কথা থেকে, ‘বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যভাষার উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে সুবিভক্ত, সুবিন্যস্ত, সুপরিচ্ছন্ন ও সুসংহত করিয়া তাহাকে সহজ গতি ও কর্মকুশলতা দান করিয়াছিলেন।’
ঈশ্বরচন্দ্রের লক্ষ্যেই ছিল দেশের মানুষের সার্বিক প্রগতি। স্বেচ্ছায় পারিবারিক জীবন থেকে বঞ্চিত হয়ে ক্রমশ আত্মীয়পরিজনহীন নিঃসঙ্গতার মধ্যেও আজীবন জনবিচ্ছিন্ন হননি। মানসিক আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে তিক্ততাবোধে তাঁর জীবনের সেরা কাজ বিধবা বিবাহ প্রবর্তনের জন্য একবার সখেদে বিরূপ মনোভাব ব্যক্ত করেছিলেন মাত্র, কিন্তু তা থেকে সরে থাকেননি। স্বনামধন্য সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পিতা দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ঈশ্বরচন্দ্রের সুহৃদ ছিলেন। বারবার প্রতারিত হওয়ার পরে সেই পরম সুহৃদকে তিনি লিখেছিলেন, ‘আমাদের দেশের লোক এত অসার ও অপদার্থ বলিয়া পূর্বে জানিলে আমি কখনই বিধবাবিবাহ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করিতাম না।’

—স্বপনকুমার মণ্ডল



প্রাতিষ্ঠানিক উপাধি কী ভাবে একজন ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যেতে পারে, তার উদাহরণ ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। অবশ্য তিনি ‘বন্দ্যোপাধ্যায়’-এর জায়গায় ‘শর্ম্মা’ বা ‘শর্ম্মণঃ’ লিখতেন। তাঁর ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি শুধু তাঁর কৌলিক উপাধিই শুধু নয়, নামটিকে পর্যন্ত অপ্রয়োজনীয় করে তুলেছে।

মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর গুণমুগ্ধবন্ধুকে নিয়ে যে সকল চিঠি লিখেছিলেন তা শুধু মুগ্ধতাই বয়ে আনে না, বহুরূপী ঈশ্বরচন্দ্রকে খুঁজে পাওয়া যায় সেখানে। সেখানেই ঈশ্বরচন্দ্রের বিদ্যাসাগর হওয়ার পাশাপাশি ‘করুণাসাগর’ হওয়ার হদিস মেলে। তবে আম বাঙালির ‘দয়ার সাগর’ বিশেষণে সুবাসিত হলেও তা বিদ্যাসাগরের মতো তা বিশেষ্য হতে পারেনি।

মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘চতুর্দশপদী কবিতাবলী’র (১৮৬৬) দু’টি সনেট ঈশ্বরচন্দ্রকে নিয়ে লেখা। প্রথমটিতে (‘বঙ্গদেশে এক মান্য বন্ধুর উপলক্ষে’) যাও-বা উহ্য ছিল, পরেরটিতে (‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর’) তা শিরোনামে প্রকট হয়ে উঠেছে। মধু কবির মূল্যায়নেই ঈশ্বরচন্দ্রের বহুমুখী পরিচয়ের নিদান বর্তমান। ‘সমকালের সেরা ব্যক্তি’, ‘শ্রেষ্ঠ বাঙালি’, ‘প্রাচীন মুনিঋষির মতো প্রজ্ঞা ও জ্ঞান’, ‘ইংরেজের মননশক্তি ও বাঙালি নারীর হৃদয়ের সমন্বয়’ প্রভৃতির মধ্যে ঈশ্বরচন্দ্রের বহুধা ব্যাপ্ত ব্যক্তিত্বের পরিচয় উঠে এলেও সবগুলিই সমুদ্রগামী নদীর মতো বিদ্যাসাগরে মিলিত হয়েছে।
ইতালীয় রেনেসাঁসের সঙ্গে প্রায়ই বাংলার নবজাগরণের তুলনা করা হয়। ইতালীয় রেনেসাঁসের নায়কদেরও ছাড়িয়ে গেছে বিদ্যাসাগরের কীর্তি। তিনি ছিলেন পরাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক। প্রখর আত্মমর্যাদা ও অসামান্য তেজস্বিতায়, বিপন্ন মানুষের দুর্দশা মোচনে, শিক্ষা বিস্তারে, নারী অধিকার রক্ষায় খাঁটি হিউম্যানিস্ট বিদ্যাসাগর ছিলেন অতুলনীয়। রবীন্দ্রনাথ যথার্থই বলেছিলেন, ‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের চরিত্রে প্রধান গৌরব তাঁহার অজেয় পৌরুষ, তাঁহার অক্ষয় মনুষ্যত্ব।’ সমাজসংস্কারে আধুনিকতার জাজ্ব্বল্যমান প্রতীক বিদ্যাসাগর ধর্মীয় অনাচার ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন ইহজাগতিকতাকে প্রাধান্য দিয়ে। উপমহাদেশে ও বিশ্বের নানা স্থানে যখন সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় উগ্রবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, তখন বিদ্যাসাগরের মানবকেন্দ্রিক ইহজাগতিকতাকে স্মরণ করা একান্ত জরুরি।

—রাজীব সরকার



উনিশ শতকের নবজাগরণের মধ্য দিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে আধুনিকতার সূত্রপাত ঘটে। এই নবজাগরণের প্রধান চরিত্র বিদ্যাসাগর। বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্বের অধিকারী বিদ্যাসাগরের প্রধান পরিচয় তিনি রেনেসাঁস পুরুষ। ইহজাগতিকতা, যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞানমনস্কতা, নতুন গদ্যরীতি, সমাজসংস্কার, নারী শিক্ষার প্রসার, পাঠ্যসূচি থেকে অলৌকিকতার বিলুপ্তি, চারিত্রিক দৃঢ়তা এবং মানবমুখিনতার মতো বৈশিষ্ট্য যা ইউরোপীয় রেনেসাঁসকে তুলে ধরেছিল— বিদ্যাসাগর তার জীবন্ত প্রতীক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন।

রবীন্দ্রনাথের মতে, বিদ্যাসাগর বাংলা ভাষার প্রথম যথার্থ শিল্পী ছিলেন। বাংলা গদ্যের জনক বিদ্যাসাগর সম্পর্কে সুকুমার সেনের মন্তব্য যথার্থ— ‘তিনি প্রচলিত ফোর্ট-উইলিয়মি পাঠ্যপুস্তকের বিভাষা, রামমোহন রায়ের পণ্ডিতি ভাষা এবং সমসাময়িক সংবাদপত্রের অপভাষা কোনটিকেই একান্তভাবে অবলম্বন না করিয়া তাহা হইতে যথাযোগ্য গ্রহণবর্জন করিয়া সাহিত্যযোগ্য লালিত্যময় সুডৌল যে গদ্যরীতি চালাইয়া দিলেন তাহা সাহিত্যের ও সংসারকার্যের সব রকম প্রয়োজন মিটাইতে সমর্থ হইল।’ পরবর্তীকালে বাংলা গদ্যের যে সুরম্য অট্টালিকা তৈরি হয়েছে এর ভিত্তি স্থাপন করেছেন বিদ্যাসাগরই।
বাংলাদেশে জনশিক্ষা বিস্তারে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর পালন করেছেন ঐতিহাসিক ভূমিকা। শিক্ষা সংসদের অনুরোধে তিনি সমগ্র দক্ষিণ বাংলা মডেল স্কুলের পাঠক্রম রচনা করেন, বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির স্কুলসমূহের পাঠক্রম উন্নয়নে পালন করেন মুখ্য ভূমিকা। স্কুলে যাতে যথাযথ পাঠ-পদ্ধতি অনুসৃত হয়, সেজন্য তিনি ভারত সরকারকে বুঝিয়ে শিক্ষক প্রশিক্ষণ স্কুল প্রতিষ্ঠায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। জনশিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে মোদিনীপুরসহ নানা স্থানে তিনি দিবা ও নৈশ বিদ্যালয় স্থাপন করেছেন। বিদ্যাসাগর প্রতিষ্ঠিত নৈশ বিদ্যালয়ে গ্রামের কৃষক, জেলে, কামার, কুমোর, জোলা— এসব শ্রমজীবী মানুষ পড়ালেখা করতেন। বিদ্যাসাগর স্কুলের শিক্ষকদের বেতন দিতেন নিজের উপার্জিত অর্থ দিয়ে, স্কুল পরিচালনার জন্য তাকে ঋণগ্রস্তও হতে হয়েছে। স্কুলের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বিদ্যাসাগর কোনো বেতন নিতেন না, উপরন্তু পাঠোপকরণ তিনি নিজের অর্থে ক্রয় করে শিক্ষার্থীদের উপহার দিতেন। সাধারণ মানুষের মাঝে শিক্ষার আলো জ্বলে উঠুক— এই-ই ছিল বিদ্যাসাগরের স্বপ্ন।

—বিশ্বজিৎ ঘোষ



হাজার বছরের ইতিহাসের ধারায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১) অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি। ভাবয়িত্রী এবং কারয়িত্রী প্রতিভা হিসেবে বাঙালি সমাজে তিনি সমধিক পরিচিত। জন্মের পর দুইশ’ বছর অতিক্রান্ত হলেও এখনও তিনি আমাদের কাছে নানামাত্রিকভাবে প্রাসঙ্গিক। তাঁর চিন্তা এবং কর্ম বাঙালি চিন্তকদের নানাভাবে উদ্বুব্ধ করে, দুইশ’ বছরের কালগত দূরত্ব সত্ত্বেও। অব্যাহত এই প্রাসঙ্গিকতাই বিদ্যাসাগরের আধুনিকতার মৌল-সূত্র। জন্ম নিয়েছিলেন তিনি হুগলি জেলার প্রত্যন্ত পাড়াগাঁয়ে, কিন্তু উত্তরকালে আপন চিন্তা-কর্ম-সাধনা দিয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন কেন্দ্রের মানুষ। তৎকালীন সমাজে প্রান্তিক অবস্থান থেকে কেন্দ্রে উঠে আসাটা ছিল রীতিমতো এক যুদ্ধ। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকেও অবতীর্ণ হতে হয়েছিল এই যুদ্ধে এবং লেখাই বাহুল্য, সে যুদ্ধে তিনি বিজয়ী।

পারিবারিক উত্তরাধিকার সূত্রে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর পেয়েছিলেন পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুঃসাহসী এবং পরিশ্রমী চারিত্র্য, পেয়েছিলেন তার দৃঢ়সংকল্প ও সময়ানুবর্তিতার বৈশিষ্ট্য। মেরুদণ্ড সোজা করে লড়াই করার শক্তি তিনি পিতৃ-সূত্রেই অর্জন করেছিলেন। পিতামহ রামজয় তর্কভূষণের কাছ থেকে বিদ্যাসাগর লাভ করেছিলেন মানবসেবা ও দানশীলতার আন্তরপ্রেরণা— অর্জন করেছিলেন অনমনীয় তেজস্বিতা ও চারিত্রিক দৃঢ়তা। পিতামহ রামজয় তর্কভূষণ সম্পর্কে বিদ্যাসগর লিখেছেন : ‘তিনি নিরতিশয় তেজস্বী ছিলেন; কোনো অংশে কাহারও নিকট অবনত হইয়া চলিতে, অথবা কোনও প্রকারে, অনাদর বা অবমাননা সহ্য করিতে পরিতেন না। তিনি, সকল স্থলে, সকল বিষয়ে, স্বীয় অভিপ্রায়ের অনুবর্তী হইয়া চলিতেন, অন্যদীয় অভিপ্রায়ের অনুবর্তন, তদীয় স্বভাব ও অভ্যাসের সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল।’ উত্তরকালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের চরিত্রেও এই বৈশিষ্ট্য বিশেষভাবে লক্ষ করা গেছে।
ধর্ম নিয়ে উত্তেজনা সৃষ্টি-মাতামাতি ছিল বিদ্যাসাগরের চিন্তা-দৃষ্টিভঙ্গি ও আচারের সম্পূর্ণ বহির্ভূত। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ধর্মাচার করতেন না এবং ধার্মিকও ছিলেন না। অথচ ধর্মশাস্ত্র-সংস্কৃতে তার পাণ্ডিত্য ছিল অসামান্য।

—মযহারুল ইসলাম বাবলা



ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বিশালত্ব আকাশচুম্বী। বিদ্যা, বুদ্ধি, জ্ঞানে, মননে, পাণ্ডিত্যে তিনি ছিলেন অনন্য-অসাধারণ। বিদ্যা-শিক্ষা প্রসারে তার ভূমিকা প্রবাদতুল্য। সেই সময়কার পশ্চাৎপদ হিন্দু সমাজে বিধবা বিবাহ প্রচলন করে সমাজে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করেছিলেন। বহু ক্ষেত্রে তার শ্রেষ্ঠত্বে বাঙালি জাতি তাকে চিরদিন স্মরণে রাখবে।

তার অমরত্ব লুপ্ত হওয়ার নয়। চাঁদের বক্ষে যেমন কলঙ্ক না থাকলে চাঁদকে পরিপূর্ণ বলা যায় না। চাঁদের বক্ষে কতিপয় চিহ্নকে আমরা চাঁদের কলঙ্ক বলে অভিহিত করে থাকি। আমাদের সাহিত্যে তার বহু দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রকৃতই ইহজাগতিক মানুষ ছিলেন। দেবদেবী কিংবা দেবদূত ছিলেন না, ওতে তার ন্যূনতম বিশ্বাসও ছিল না। আর অনিবার্যরূপে ছিলেন বাঙালি। তার মহান কীর্তির পাশাপাশি বিশেষ ক্ষেত্রে সীমারেখাও ছিল।
“তাহার জীবনে প্রথম হইতে ইহাই দেখা যায় যে, তাহার চরিত্র সমস্ত প্রতিকূল অবস্থার বিরুদ্ধে ক্রমাগতই যুদ্ধ করিয়া জয় লাভ করিয়াছে। তাহার মতো অবস্থাপন্ন ছাত্রের পক্ষে বিদ্যালাভ করা পরম দুঃসাধ্য, কিন্তু এই গ্রাম্য বালক শীর্ণ খর্ব দেহ এবং প্রকাণ্ড মাথা লইয়া আশ্চর্য অল্পকালের মধ্যে বিদ্যাসাগর উপাধিপ্রাপ্ত হইয়াছেন। তাহার মতো দরিদ্রাবস্থার লোকের পক্ষে দান করা, দয়া করা বড় কঠিন; কিন্তু তিনি যখন যে অবস্থাতেই পড়িয়াছেন নিজের কোনো প্রকার অসচ্ছলতায় তাহাকে পরের উপকার হইতে বিরত করিতে পারে নাই, এবং অনেক মহিশ্চার্যশালী রাজা রায় বাহাদুর প্রচুর ক্ষমতা লইয়া যে উপাধি লাভ করিতে পারে নাই এই দরিদ্র পিতার দরিদ্র সন্তান সেই ‘দয়ার সাগর’ নামে বঙ্গদেশে চিরদিনের জন্য বিখ্যাত হইয়া রহিলেন।”

—রাজীব সরকার



বিদ্যাসাগরের জীবদ্দশায় ও পরবর্তীকালে তাকে নিয়ে অসংখ্য লেখালেখি হয়েছে। উনিশ শতকীয় নবজাগরণের অন্য কোনো মনীষীকে নিয়ে এত চর্চা হয়নি। যে কয়জন লেখক অসাধারণ নৈপুণ্যে বিদ্যাসাগরকে উপস্থাপন করেছেন তাদের মধ্যে সর্বাগ্রে থাকবে রবীন্দ্রনাথের নাম।

একটি চতুর্দশপদী কবিতা, চারটি প্রবন্ধ এবং বিদ্যাসাগর কলেজ পত্রিকায় বিদ্যাসাগর স্মরণে ‘মৃত্যুঞ্জয়’ শিরোনামে একটি কবিতা লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। মণিমুক্তা খচিত এ শ্রদ্ধার্ঘ্য সম্পর্কে আলোচনার আগে ফিরে যেতে হয় রবীন্দ্রনাথের শৈশবে। মাটির প্রতিমায় চক্ষুদান করেন পুরোহিত। বঙ্গ প্রতিমায় ‘চক্ষুদান’ করেছিল বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’। এই মহামূল্যবান বইয়ের সান্নিধ্য রবীন্দ্রনাথের শৈশবকে রাঙিয়ে দিয়েছিল- “কেবল মনে পড়ে, জল পড়ে পাতা নড়ে তখন ‘কর’ ‘খল’ প্রভৃতি বানানের তুফান কাটাইয়া সবেমাত্র কূল পাইয়াছি। আমার জীবনের এইটেই আদি কবির প্রথম কবিতা।”

‘তিনি (রামসর্বস্ব পণ্ডিত) একদিন আমার ম্যাকবেথের তর্জমা বিদ্যাসাগর মহাশয়কে শুনাইতে হইবে বলিয়া আমাকে তাহার কাছে লইয়া গেলেন। তখন তাহার কাছে রামকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় বসিয়া ছিলেন। পুস্তকে ভরা তাহার ঘরের মধ্যে ঢুকিতে আমার বুক দুরুদুরু করিতেছিল; তাহার মুখচ্ছবি দেখিয়া যে আমার সাহসবৃদ্ধি হইল তাহা বলিতে পারি না। ইহার পূর্বে বিদ্যাসাগরের মতো শ্রোতা আমি তো পাই নাই; অতএব, এখান হইতে খ্যাতি পাইবার লোভটা মনের মধ্যে খুব প্রবল ছিল। বোধ করি কিছু উৎসাহ সঞ্চয় করিয়া ফিরিয়াছিলাম।’
বিদ্যাসাগর কেবল বাংলায় নয়, গোটা ভারতবর্ষেই যে প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিলেন তার বিস্তৃত ইতিহাস লেখা হয়নি এখনো। উড়িষ্যার বিখ্যাত লেখক এবং সমাজ সংস্কারক ফকির মোহন সেনাপতি [১৮৪৩—১৯১৮] ছিলেন বিদ্যাসাগরের সামাজিক আন্দোলনের দ্বারা প্রভাবিত। ওড়িয়া উপন্যাসের টমাস হার্ডি বলে খ্যাত এই লেখক তাঁর আত্মজীবনীতে বিদ্যাসাগরের প্রতি তাঁর ঋণ ব্যক্ত করে গেছেন। অন্য আরেক ওড়িয়া লেখক, ‘উত্কলমান’ গোপবন্ধু দাসও ছিলেন বিদ্যাসাগরের আদর্শে অনুপ্রাণিত। কলকাতায় এমএ পড়তে এসে তিনি বেশ কয়েক বছর এখানে থেকে যান, এবং বহু বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।

—মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়



উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণ যে-সমস্ত কার্যকারণ সমন্বয়ে গড়ে উঠেছিল, তার অন্যতম ছিল কলকাতাকে ১৭৭৪ সাল থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজধানী নির্বাচন। তার সঙ্গে যুক্ত করতে হবে ছাপাখানার আবিষ্কার এবং সেই সূত্রে বইপত্র এবং বিশেষ করে বাংলা ও ইংরেজি বহুতর সাময়িক পত্রিকার প্রকাশ। হিকির গেজেট থেকে শুরু করে ‘দিগ্‌দর্শন,’ ‘সমাচারদর্পণ,’ ইত্যাদি থেকে যার যাত্রা শুরু। একের পর এক ‘সম্বাদকৌমুদী,’ ‘সংবাদ প্রভাকর,’ ‘সমাচার চন্দ্রিকা,’ ‘সমাচার সভারাজেন্দ্র’ থেকে ‘তত্ত্ববোধিনী,’ ‘বঙ্গদর্শন’ পর্যন্ত আছে এক বিস্তৃত তালিকা।

এরই পাশাপাশি ১৮০০ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ স্থাপনের মাধ্যমে বাংলা গদ্যের সহসা জোয়ার আসে, রচিত হতে থাকে বহু বিষয়ে বিচিত্র পুস্তক। একালে গোলোকনাথ শর্মা, রামরাম বসু, উইলিয়াম কেরি, মৃত্যুঞ্জয় তর্কালঙ্কার, তারিনীচরণ মিত্র, মদনমোহন তর্কালঙ্কার-সহ বেশ ক’জন গদ্যকারের জন্ম হয়।

ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পাশাপাশি কলকাতায় ও মফস্বলে আরো কলেজ স্থাপিত হতে থাকে। কলকাতায় ১৮১৭-তে স্থাপিত হয় হিন্দু কলেজ, ১৮২৪-এ সংস্কৃত কলেজ, ১৯৩৫-এ কলিকাতা মেডিকেল কলেজ এ-পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য।
বিদ্যাসাগর যে আধুনিক মানুষ ছিলেন, তার দ্বিতীয় উদাহরণ হচ্ছে মেয়েদের লেখাপড়ার জন্য তার সত্যিকারের আগ্রহ। সারা পৃথিবীতেই এখনো মেয়েদের পড়াশোনার ব্যাপারটা সহজ হয়নি। আমাদের দেশে মেয়েদের লেখাপড়ার জন্য এত রকম চেষ্টা চালানো হয় কিন্তু আমরা কি জানি এই দেশের হাই স্কুলের ছাত্রীদের শতকরা ৮০ ভাগ মেয়ে উত্ত্যক্তের শিকার হয়? আমাদের দেশের ছেলেরা যথেষ্ট সত্যবাদী, তাদের শতকরা ৯৭ জন স্বীকার করেছে, তারা মেয়েদের উত্ত্যক্ত করে একধরনের বিমলানন্দ পেয়ে থাকে! তার পরও স্কুল পর্যায়ে ছাত্র থেকে ছাত্রীর সংখ্যা বেশি, সেজন্য মেয়েদের প্রশংসা করতেই হয়। কিছু মেয়ে যে ঝরে পড়ে না তা নয়, যারা ঝরে পড়ে তার ৭০ ভাগ থেকে বেশি মেয়ের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায় এই উত্ত্যক্তের কারণে। এখনো যদি এরকম অবস্থা হয়ে থাকে, ২০০ বছর আগে কী রকম অবস্থা ছিল আমরা সেটা কল্পনা করতে পারি। সেই সময়ে বিদ্যাসাগর এক বছরেরও কম সময়ে একটি নয়, দুইটি নয়, মেয়েদের জন্য ৩৫টি স্কুল খুলে ফেলেছিলেন। তার কাণ্ড দেখে ইংরেজ সাহেবেরা যখন সেসব স্কুলের দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করল, তখন তিনি নিজের পকেট থেকে টাকা দিয়ে শিক্ষক-কর্মকর্তাদের বেতন দিয়েছেন!

—মুহম্মদ জাফর ইকবাল



আমাদের ছেলেবেলায় আমরা রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, বিদ্যাসাগর কিংবা মহাত্মা গান্ধীর মতো মানুষদের সঙ্গে নিয়ে বড় হয়েছি। ভালো করে কথা বলা শেখার আগে রবীন্দ্রনাথের কবিতা মুখস্থ করতে হয়েছে, কথা বলা শেখার পর নজরুলের কবিতা। ল্যাম্পপোস্টের নিচে বসে বিদ্যাসাগর পড়ালেখা করতেন এবং বাবার খাবার নষ্ট হবে বলে বিদ্যাসাগর কাউকে দেখতে না দিয়ে আস্ত তেলাপোকা চিবিয়ে খেয়ে ফেলেছিলেন, সেই গল্পটি আমাদের অনেক বার শুনতে হয়েছে। (তখনই টের পেয়েছিলাম, আস্ত তেলাপোকা কখনো চিবিয়ে খেতে পারব না বলে আর যা-ই হই, কখনো বিদ্যাসাগর হতে পারব না।) শৈশবে সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়েছিল মহাত্মা গান্ধীকে নিয়ে। তার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার আগেই বিষাক্ত, দুর্গন্ধযুক্ত, গান্ধি পোকার সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলাম এবং কেউ ভালো করে বুঝিয়ে দেয়নি বলে আমি কিছুতেই বুঝতে পারতাম না, একটা পোকা কেমন করে এত ভালো ভালো কাজ করে। (এখন টের পাই, শৈশবে আমি অন্য বাচ্চাদের থেকে অনেক বেশি হাবাগোবা ছিলাম।)

অপরিণত বয়সে কিছু বোঝার বয়স হওয়ার আগেই এই ধরনের অসাধারণ মানুষদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কাজটি ঠিক হয়েছে, না ভুল হয়েছে সেটা নিয়ে বড় মানুষেরা বিতর্ক করতে পারেন কিন্তু আমাদের একটা বড় লাভ হয়েছে। এই ধরনের মানুষগুলোকে একধরনের আপন মানুষ ভেবে ভেবে বড় হয়েছি। নুতন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা হয়তো জুকারবার্গ কিংবা ইলন মাস্কের কথা জেনে রোমাঞ্চিত হয়, ১৯৭৫ থেকে ৯৬-এর সময়টিতে তারা সত্যিকারের বড় মাপের মানুষ হিসেবে বঙ্গবন্ধুর নামটি পর্যন্ত শোনার সুযোগ পায়নি। সেই তুলনায় আজকালকার শিশু-কিশোরেরা খানিকটা সৌভাগ্যবান, তারা অন্তত বঙ্গবন্ধুর কথা শুনতে পারছে, জানতে পারছে।

এই বছর বিদ্যাসাগরের জন্মের দুই শতবার্ষিকী পালন করা হচ্ছে। ২০০ বছর অনেক সময়। বিদ্যাসাগর পুরোনো কালের মানুষ, সেটা আমরা সবাই জানি কিন্তু তিনি যে ২০০ বছর আগের মানুষ, সেটা কখনোই সেইভাবে খেয়াল করিনি। কাজেই যখন বিষয়টা টের পেয়েছি তখন রীতিমতো চমকে উঠেছি। ২০০ বছর আগে এই দেশের মাটিতে এরকম একটা আধুনিক মানুষের জন্ম হয়েছিল? কী অবিশ্বাস্য ব্যাপার!
His reformist campaign though had to face opposition from Hindu orthodoxy. The chief antagonist, of course, was the conservative Raja Radhakanta Deb who had also sparred with Ram Mohan Roy over Sati. Vidyasagar had to face opposition on the streets of Calcutta and amongst the Bengali bhadralok. The backlash also came in the form of a counter-petition with 30,000 signatories. However, the Widows’ Remarriage Act was passed successfully in 1856.

—SANJEET KASHYAP



Ishwar Chandra Vidyasagar’s many roles as an educationist, writer, social reformer, and feminist have rightly earned him the credential of being one of the early progenitors of Indian modernity. Underlying all these credentials of Vidyasagar, however, was his own brand of liberal humanism. While the modernising metropolitan West is considered to be the fertile ground for liberal humanism and indeed the colonizing mission brought these newfound influences to the periphery of Indian society, Vidyasagar essentially embodied practical humanism.

The practical humanism of Vidyasagar was shaped by both his readings and lived experience. Born a poor Brahmin, his deprived childhood was made bearable by the generosity of kind strangers. Vidyasagar fondly recalls one particular widow Raimoni in his memoirs who treated him as her own son. Besides, despite his training as a Sanskritist, he was also exposed to the western Enlightenment ideas of secularism, agnosticism, rationalism, and liberty. These two distinct experiences determined the career trajectory of Vidyasagar.
উনি উচ্চ শিক্ষা ও প্রাথমিক শিক্ষার বুনিয়াদ স্থাপন করেই সন্তুষ্ট হতে পারেননি। উনি দেখলেন, স্ত্রী শিক্ষার অভাবে শিশুদের প্রকৃত শিক্ষা হওয়া সম্ভব নয়। উনি মনুস্মৃতি খুঁজে এক শ্লোক বার করেন যাতে বলা হয়েছে, স্ত্রীলোকদের শিক্ষা দেওয়া আমাদের কর্তব্য। তাই স্ত্রীলোকদের শিক্ষার উপযোগী করে তিনি পুস্তক রচনা করেন এবং বীটন (বেথুন) সাহেবের সহযোগিতায় মেয়েদের শিক্ষার জন্য বেথুন কলেজ স্থাপন করেন। কলেজ প্রতিষ্ঠার চেয়ে ছাত্রী যোগাড় করা অনেক কঠিন কাজ। উনি স্বয়ং সাধু-জীবন যাপন করতেন এবং মহান বিদ্বান ছিলেন, সে-কারণে তাঁকে সমস্ত লোক সম্মান করতেন, তাই উনি যখন সম্মানিত ব্যক্তিদের কাছে তাঁদের মেয়েদের কলেজে পাঠানোর কথা বললেন তাতে সকলেই সাড়া দিলেন। সম্মানিত ঘরের মেয়েরা কলেজে যেতে আরম্ভ করল।

—মহাত্মা গান্ধী



বাংলাদেশে বিলাতী মাল বর্জনের জন্য যে জোর আন্দোলন চলছে, এটা সাধারণ ঘটনা নয়। বাংলাদেশে যথেষ্ট শিক্ষা বিস্তার হয়েছে এবং বাঙালীরা বেশ বুদ্ধিমান জাতি। সেইজন্য ওখানে এমন আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে। স্যার হেনরি কটন বলেছেন, বাংলা কলকাতা থেকে পেশোয়ার পর্যন্ত শাসনকার্য চালায়। এর কারণ জানার প্রয়োজন আছে।

এটা নিশ্চিত যে, প্রত্যেক জাতির উন্নতি বা অবনতি তার বিশিষ্ট জনকের উপর নির্ভর করে। যে জাতির মধ্যে ভালো ভালো লোক জন্মায়, তার উপর ঐসব লোকদের প্রভাব না পড়ে যায় না। বাঙালীদের কিছু বিশেষত্ব আমি দেখিয়ে দিচ্ছি। এর কিছু কারণ আছে, যার মধ্যে মুখ্য কারণ হ’ল যে, গত শতাব্দীতে বাংলাদেশে বহু মহাপুরুষ জন্মেছেন। রামমোহন রায়ের পর ওখানে একের পর এক মহাপুরুষের আগমন হয়েছে, যাঁদের মধ্যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে সর্বশ্রেষ্ঠ বলা যায়। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর উপাধি লাভ করেন। তাঁর সংস্কৃত ভাষায় জ্ঞান এত বেশী ছিল যে, কলকাতার বিদ্বৎ সমাজ তাঁকে বিদ্যাসাগর উপাধি দেন। তবে ঈশ্বরচন্দ্র শুধু বিদ্যাসাগরই ছিলেন না, তিনি দয়া, উদারতা ও অন্য অনেক সদগুণেরও সাগর ছিলেন। উনি হিন্দু, তার ওপর ব্রাহ্মণও ছিলেন, কিন্তু তাঁর কাছে যিনি ভালো ব্রাহ্মণে-শূদ্রে, হিন্দু-মুসলমানে কোনো ভেদ ছিল না। যিনি ভালো কাজ করেন তিনি উচ্চ-নীচে প্রভেদ করেন না। তাঁর গুরুর ওলাউঠা রোগ হয়েছিল, তিনি তাঁর সেবা-শুশ্রূষা করেছিলেন। নিজে খরচা করে ডাক্তার আনিয়েছিলেন, নিজের হাতে মলমূত্র পরিষ্কার করেছিলেন।
বিদ্যাসাগর তৎকালীন বর্ধমানের রাজসভায় যাতায়াত করতেন। আসতেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরেরও। সেই সম্পর্কের সূত্রে বিদ্যাসাগর তৎকালীন বর্ধমানাধিপতি মহতাবচাঁদ (১৮৩২-১৮৭৯)-কে আখ্যা দিয়েছিলেন ‘বঙ্গের প্রথম মানুষ’ বলে। মহতাবচাঁদও বিধবাবিবাহ আন্দোলনের অন্যতম সমর্থক, পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। বহুবিবাহ রোধে তৎকালীন সরকারের কাছে একটি আবেদনপত্র পাঠান। তাঁর দানধ্যান, শিক্ষার প্রসার উদ্যোগ, সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চায়ও কিছুটা হলেও বিদ্যাসাগরের প্রভাব ছিল। যখন, বিদ্যাসাগর বাংলা লিপি নিয়ে ভাবছেন তখন মহতাবচন্দ্র, ‘মহতাব-লিপি’ প্রচলন করেছিলেন।

—শ্যামলচন্দ্র দাস



বিদ্যাসাগরের জন্মের দু’শো বছর হতে চলল। নতুন অধ্যাপক পদ থেকে শুরু করে খণ্ডে খণ্ডে তাঁর রচনাবলী প্রকাশ— এর মধ্যেই নানা উদ্যোগ শুরু হয়েছে। তাঁর এই প্রেক্ষিতে বহুমুখী প্রতিভাধর বিদ্যাসাগর কী ভাবে তৎকালীন বর্ধমানেরও পরমাত্মীয় হয়ে উঠেছিলেন তা ফিরে দেখা যায়।

বর্ধমানে ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে দুর্ভিক্ষ হয়। এখানেই দুর্ভোগের শেষ নয়, তিন বছর পরেই ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে বর্ধমান ও হুগলিতে ম্যালেরিয়া মহামারির আকার নেয়। বহু গ্রাম ও শহর জনশূন্য হতে থাকে। এই সময় বিদ্যাসাগর ত্রাণশিবির ও চিকিৎসা-সত্র খোলেন বর্ধমানের কমলসায়র (এখন বর্ধমান শহরের নবাবহাটের কাছে) এলাকায়। কিছু দিন তিনি সেখানকার বাগানবাড়িতেও ছিলেন। বিদ্যাসাগর বর্ধমান শহর সংলগ্ন একাধিক বস্তি, আশপাশের এলাকা ঘুরে ঘুরে আক্রান্তদের সেবা করেছিলেন। এ ব্যাপারে মহারাজ মহতাবচাঁদ ও চিকিৎসক গঙ্গানারায়ণ মিত্র নানা ভাবে সাহায্য করেছিলেন। শুধু তাই নয়, তৎকালীন ইংরেজ সরকারের কাছে ওষুধপত্র ও ডাক্তারের জন্য বিদ্যাসাগর আবেদন জানালে তার ব্যবস্থাও হয়। তাঁর তৃতীয় ভাই শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন লিখেছেন, ‘এই সায়রের চারদিকে ছিল দরিদ্র নিরুপায় মুসলমানগণের বাস। এই পল্লীর বালকবালিকাগণকে প্রতিদিন প্রাতে জলখাবার দিতেন। যাহাদের পরিধেয় বস্ত্র জীর্ণ ও ছিন্ন দেখিতেন, তাহাদিগকে অর্থ ও বস্ত্র দিয়া কষ্ট নিবারণ করিতেন। এতদ্ভিন্ন কয়েক ব্যক্তিকে দোকান করিবার জন্য মূলধন দিয়াছিলেন।…ঐ সময়ে অগ্রজ মহাশয় কমলসায়রের সন্নিহিত একটী মুসলমান কন্যার বিবাহের সমস্ত খরচ প্রদান করিয়াছিলেন’ (বিদ্যাসাগর-জীবনচরিত)। সেই সময়ের ‘সঞ্জীবনী’ লিখেছিল, ‘বর্দ্ধমানে যখন বড় ম্যালেরিয়া জ্বরের ধুম, তখন আমরা কলিকাতাতে বসিয়া শুনিলাম যে বিদ্যাসাগর মহাশয় নিজ ব্যয়ে ডাক্তার ও ঔষধ লইয়া সেখানে গিয়াছেন; এবং হাড়ি, শুড়ি, জেলে, মালো, জাতি বর্ণ নির্বিশেষে সকলের দ্বারে দ্বারে ফিরিয়া চিকিৎসা করাইতেছেন। তিনি গাড়িতে বসিয়াছেন, একটী মুসলমানের বালক হয়ত তাঁহার ক্রোড়ে রহিয়াছে।’ জাতিভেদ আক্রান্ত সমাজে এমন উদারতা তখন বিরল।
মানচিত্র অনুযায়ী এটা স্পষ্ট যে, রাজকৃষ্ণবাবুর যে বাড়িতে (১২ নং সুকিয়া স্ট্রিট) প্রথম বিধবাবিবাহটি হয়েছিল তা কোনও মতেই আজকের ৪৮ নং কৈলাস বোস স্ট্রিট নয়। কারণ ১৮৫৯-র ‘ডিরেক্টরি’-তে ‘১২’-র যা অবস্থান, উনিশ শতকের প্রায় শেষ দিকের মানচিত্রে তার অবস্থানে বিশেষ বদল ঘটেনি। এটা বলা হচ্ছে কর্নওয়ালিস স্ট্রিট, রঘুনাথ চট্টোপাধ্যায় স্ট্রিট ও মদন মিত্র লেনের অবস্থানসাপেক্ষে। আজও মদন মিত্র লেনের মুখোমুখি ঠায় দাঁড়িয়ে ৩২ কৈলাস বোস স্ট্রিট, সে দিনের ১২ নং সুকিয়া স্ট্রিটের ‘premises’। ‘১২’ বদলে গিয়ে ‘২৩’ (পরবর্তী কালের ৪৮ কৈলাস বোস স্ট্রিট) হয়নি কারণ দু’য়ের মাঝে আজ প্রায় ছ’খানা বাড়ির দূরত্ব। সুতরাং এই ‘৪৮’ রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের দ্বিতীয় আশ্রয় বলেই ধরা যেতে পারে, প্রথম ভদ্রাসন এখানে ছিল বলে মনে হয় না। যাই হোক অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় ধরে প্রচলিত ও এই বিধবাবিবাহের প্রথম বাড়ি-সংক্রান্ত ধারণার পুনর্বিবেচনা তাই প্রয়োজন।

—শেখর ভৌমিক


নগরেতে হইয়াছে গেল গেল রব।
পলাইয়া ক্ষেত্রে যায় নরনারী সব॥
…কাহারো পলায়ে গেল বিধবা বহুড়ী।
এর বাড়ি তার বাড়ি খুঁজিছে শাশুড়ু॥


বিধবাদের জগন্নাথধাম ‘পালানো’ সম্পর্কে এই বর্ণনা পাওয়া যায় ১৮৪৯ সালের ‘সম্বাদ রসরাজ’ পত্রিকায়। উনিশ শতকে এমন পলায়ন সংবাদ রাশি রাশি। অষ্টাদশ শতকেই তো বিজয়রাম সেন বঙ্গবিধবাদের কাশীবাসের কথা লিখে গিয়েছেন, “কাশীর মধ্যেতে আছেন বিধবা জতেক/ সবাকারে দিলা কর্তা [জয়নারায়ণ ঘোষাল] তঙ্কা এক এক।” মনে হয়, দশাশ্বমেধ ঘাটে দাঁড়ানো ‘ঘৃষ্টগাত্রী বাঙালি তরুণী বিধবার দল’ কি এঁদেরই উত্তরসূরি? যাঁদের দেখে ‘মহাস্থবির জাতক’-এ প্রেমাঙ্কুর আতর্থী নিজেকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, সংসারের সব বাধা ছিন্ন করে রোজ সকালে তাঁরা কাকে প্রণাম করেন। লেখক নিজেই উত্তর দিয়েছেন, তাঁরা এখানে আসেন ‘মরবে’ বলে, কারণ এখানে মরলে আর জন্মাতে হয় না। আসলে বালবৈধব্য যন্ত্রণা, মদনদেবতার শর সইতে না পেরে অনেক সময় ‘গর্ভ’ হয়ে পড়া এবং তা ‘নষ্ট’ করতে গিয়ে ভবলীলা সাঙ্গ হওয়া (যেমনটা হয়েছিল চন্দ্রা নামের সেই মেয়ের, যাঁর কাহিনি অনেককাল আগে তুলে ধরেছিলেন রণজিৎ গুহ)— এ তো ছিল সে কালের নিত্যকার ঘটনা। বঙ্গবিধবা এগুলোকে অবশ্য ভাগ্য বলেই মেনে নিয়েছিলেন। তবে এক-আধটু আওয়াজ যে মাঝেমধ্যে ওঠেনি এমন নয়। নিজের শিশুকন্যার বালবৈধব্য ঘোচাতে রাজা রাজবল্লভ অনেক কাল আগে বিধবাবিবাহ প্রচলনে উদ্যোগী হয়েছিলেন, কিন্তু নবদ্বীপের পণ্ডিতসমাজের বিরোধিতায় তা বানচাল হয়ে যায়। ডিরোজিয়োপন্থীদের উদ্যোগের কথা ‘বেঙ্গল স্পেকটেটর’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৪২-এ। তার পর প্রায় এক দশকেরও বেশি সময় অতিক্রান্ত হয়েছে। শেষ পর্যন্ত এই উদ্যোগ সার্থক রূপ পেল বীরসিংহের ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের জ্যেষ্ঠ পুত্রটির মাধ্যমে— বাংলাদেশে যিনি করুণাসাগর বিদ্যাসাগর নামেই বেশি পরিচিত।
হেন ঈশ্বরচন্দ্রের ব্যক্তিজীবন যে খুব একটা সুখের ছিল এমন নয়! বিধবা বিবাহ নিয়ে লড়ছিলেন বটে কিন্তু ভেতরটা ক্রমশ ক্ষতবিক্ষত হচ্ছিল! সময়টা ১৮৬৯। ক্ষীরপাই গ্রামের মুচীরাম বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে একদা বিধবা মনমোহিনীর বিয়ে। সব ঠিকঠাক। খবর পেয়েই গ্রামে ছুটে এলেন ঈশ্বরচন্দ্র। তাঁর আনন্দ আর দেখে কে! কিন্তু হালদারেরা দলবেঁধে দেখা করলেন ঈশ্বরচন্দ্রের সঙ্গে। অনুরোধ,যাতে বিয়ে না হয়। ঈশ্বরচন্দ্র মেনে নিলেন। বিয়ে হবে না! বিদ্যাসাগর বাধ্য হয়ে মনমোহিনী ও তাঁর মা’কে নিজেদের বাড়ি ফিরে যেতে বললেন। এ যন্ত্রণা তিনি আজীবন ভুলতে পারেননি!

—অময় দেব রায়



ঠাকুরদাস বাড়িতে নেই। রামজয় ছুটলেন। খবরটা যে এখনই দিতে হয়। পথেই ছেলের সঙ্গে দেখা। “একটি এঁড়ে বাছুর হইয়াছে।’’ ঠাকুরদাস জানতেন গোয়ালে একটি গাভী গর্ভবতী। এ তো বেশ ভাল খবর। ঘরে পৌঁছেই সোজা ছুটলেন গোয়ালে। ছেলের কাণ্ড দেখে রামজয় তর্কভূষণের হাসি আর দেখে কে! “ও দিকে নয়, এ দিকে এস, আমি তোমায় এঁড়ে বাছুর দেখাইয়া দিতেছি।” নিয়ে গেলেন আঁতুড়ঘরে। একটি ফুটফুটে সদ্যোজাত সন্তান। পিতৃত্বের অহঙ্কারে হাসি ফুটল বাবার মু্খেও। বাবার পুরো নাম ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। ছেলের নাম ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়।

ছোটবেলায় ঈশ্বরচন্দ্র ছিলেন ভয়ানক দুরন্ত। মারধর, বকাবকি, কিছুতেই তাঁকে থামানো যেত না। ঠাকুরদাস তখন আত্মীয়-পরিজনদের জড়ো করে বাবার গল্পটি শোনাতেন। “ইনি হলেন সেই এঁড়ে বাছুর, বাবা পরিহাস করিয়াছিলেন বটে, কিন্তু, তিনি সাক্ষাৎ ঋষি ছিলেন, তাঁহার পরিহাস বাক্যও বিফল হইবার নহে, বাবাজি আমার, ক্রমে, এঁড়ে গরু অপেক্ষাও একগুঁইয়া হইয়া উঠিতেছেন।”
হিন্দু কলেজের ভিতরেও ছাত্ররা মারদাঙ্গায় জড়িয়ে পড়ত প্রায়ই। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন তাঁর স্মৃতিচারণায় আছে এমন এক ঘটনা। হিন্দু স্কুল তখন শ্যাম মল্লিকদের জোড়াসাঁকোর থামওয়ালা বাড়িতে কিছু দিনের জন্য স্থানান্তরিত হয়েছে। এক দিন টিফিনের ছুটিতে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ দেখলেন, স্কুলের গণ্ডির মধ্যেই একটা লোককে পুলিশের এক কনস্টেবল থানায় নিয়ে যাওয়ার জন্য টানাটানি করছে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ আর তাঁর বন্ধুরা পুলিশটিকে অনুরোধ করলেন তাকে ছেড়ে দিতে। কনস্টেবল সে কথা কানেই তুলছে না দেখে ইটের ঢিবি থেকে ইট তুলে ছুড়ে মারতে শুরু করলেন পুলিশটিকে তাক করে। প্রাণ বাঁচানোর দায়ে কনস্টেবল লোকটিকে ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে গেল।

—শুভাশিস চক্রবর্তী



দুই কলেজের ছাত্রদের মধ্যে সংঘর্ষ থামাতে রীতিমত পুলিশ ডাকতে হত। রক্তগঙ্গা বইত কোনও কোনও দিন, এতই তীব্র ছিল দু’টি কলেজের ছাত্রদের রেষারেষি। আজ থেকে কম—বেশি দেড়শো বছর আগে। যুযুধান দুই পক্ষের একটি সংস্কৃত কলেজ, অন্যটি হিন্দু কলেজ।

সংস্কৃত কলেজের ছাত্ররা ইট—পাটকেল জোগাড় করে রাখত তেতলার ছাদে। মারামারি শুরু হলে উপর থেকে ছুড়ে মারত। আটকে পড়ত শান্ত, গোবেচারা ছেলেরা। দু—পক্ষের সংঘর্ষ যত ক্ষণ চলত, তারা লুকিয়ে থাকত কলেজের কোনও ক্লাসঘরে। পুলিশ এলে লড়াই থামত, তারা সাহস পেত বাড়ি যেতে। ‘সমাচারচন্দ্রিকা’ পত্রিকার ১৮৬২—র ৩০ অগস্ট সংখ্যায় লেখা, ‘হিন্দু কালেজ ও সংস্কৃত কালেজের কতিপয় ছাত্র বিরোধী হইয়া পথিমধ্যে পরস্পর দাঙ্গা করিয়াছে।’ এই সংবাদেই জানা গেছে সংস্কৃত কলেজের ছেলেরা হেরে গেছে; হারের কারণ নাকি ‘হিন্দু কালেজের ছাত্রেরা তেজস্বী বিশেষতঃ ধনী ভাগ্যধর লোকের সন্তান।’
সতীদাহ প্রথা নিবারণের ফলে বহু অল্পবয়ষ্ক নারী বিধবা হয়। তাদের অসহায়ত্ব, নিরাপত্তাহীনতা এবং উঠতি বয়সের স্বাভাবিক শারীরিক চাহিদার কারণে পরবর্তীকালে কেউ কেউ পতিতাবৃত্তি গ্রহণ করে, অনেকে সংসারে বা বাড়ির বাইরে অবৈধ যৌনাচারে লিপ্ত হয়। গুপ্ত ভ্রূণ হত্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর রামমোহন রায়ের মতোই টের পেলেন অকাট্য যুক্তির জোরে নয়, শাস্ত্রীয় কুসংস্কার দিয়েই এদেশের মানুষের অন্ধ বিশ্বাস ও কর্মধারা পরিচালিত হয়। ফলে সতীদাহ নিবারণের জন্য রামমোহন যেমন শাস্ত্র থেকেই মাল-মসলা জোগাড় করে শাস্ত্রকেই ঘায়েল করেছিলেন, বিদ্যাসাগর-ও এক-ই পথ বেছে নিলেন। শাস্ত্র দিয়েই শাস্ত্রের সংস্কারকে প্রতিহত করেন। তিনি দীর্ঘ সময় ধরে মনোসংযোগ করেন বিভিন্ন ধরনের শাস্ত্র অধ্যয়ন করার জন্য। সহমরণের বদলে ব্রহ্মাচার্য্য পালনের মধ্য দিয়ে বিধবা নারী যে জীবন ধারণ করে, বিদ্যাসাগর তাকে স্বাভাবিক জীবনের পরিবর্তে মৃতসম জীবন বলে অবহিত করেন। অথচ তিনি নারীকে দিতে চেয়েছিলেন একটি পরিপূর্ণ, উপভোগ্য জীবন। নারীর শরীরকে তিনি নারীর হাতে ফিরিয়ে দিয়ে নিজেকে পরিতৃপ্ত রাখার অধিকার নারীকেই দিতে চেয়েছিলেন বিধবা বিবাহের মাধ্যমে। সেই হিসেবে বিদ্যাসাগর প্রকৃত-ই প্রগতিশীল ও আধুনিক দৃষ্টিসম্পন্ন একজন নারীবান্ধব মানুষ বলে নিজেকে প্রমাণ করেন।

—পূরবী বসু



ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ অর্ধাংশে এই উপমহাদেশ আলোকিত করে নারী পুরুষ নির্বিশেষে আবির্ভূত হয়েছিলেন বেশ কিছু ক্ষণজন্মা মানুষ। বাংলার সেই রেনেসাঁসের যুগে— রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে শুরু করে সাহিত্য, সংস্কৃতি, সমাজ সংস্কার, নারী প্রগতিসহ সকল উন্নয়নমূলক কাজে এই সাহসী, প্রখঢ় বুদ্ধিসম্পন্ন ও মৌলিক চিন্তার মানুষরা মাত্র একশ বছরে এই ভূখণ্ডকে মিলিতভাবে যতখানি এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন, তা আর অন্য কোনো শতাব্দীতে ঘটেছে বলে মনে হয় না। এই সময়টিতে কী ধরনের নারীবান্ধব নীতির সংযোজন ঘটেছিল বা সামাজিক সংস্কারে কী ধারার বৈপ্লবিক কাজ চলছিল, এবং এসব ব্যাপারে কারা নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন, নারীরা কতখানি এগিয়ে যেতে পেরেছিল, কোন কোন মহল বা শক্তি তাদের সহযোগিতা করেছিল, কারা বাধা দিয়েছিল, তার আভাস পেতে পারি আমরা। পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত অথবা বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলোকে তখন বিশ্লেষণ করা সহজতর হয়ে ওঠে।

আমরা জানি রাজা রামমোহন রায় থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত বাংলার গৌরবোজ্জ্বল এক সময়। বলা চলে আঠারো শতাব্দীর শেষ ভাগ থেকে বিংশ শতাব্দীর চল্লিশের দশকের মধ্যেকার সময়টি— বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও সমাজ সংস্কারের, বিশেষ করে নারীর অবস্থার উন্নয়নের, এক স্বর্ণযুগ ছিল। একে বাংলার নবযুগও বলা চলে।
vidyasagar.info ©